1 of 2

১৪. ভাল খেলিয়াও পরাজিত

খেলার জগতে যেমন ‘ভাল খেলিয়াও পরাজিত’ বলে একটি কথার প্রচলন আছে, গিরিশচন্দ্রের ম্যাকবেথের ভাগ্যেও ঘটল তাই। বিদ্বজ্জন ও সমালোচকরা ভুয়সী প্রশংসা করলেন এই নাটকের অনুবাদ ও অভিনয়েব, এমনকী ইংরেজরাও তুলনা করল বিলেতি প্রযোজনার সঙ্গে, কিন্তু দর্শকদের আসনগুলিতে দিনদিনই বাড়তে লাগল শুন্যতা। টিকিটঘরে মাছি ওড়ে। ঢাকা, পাটনা, এলাহাবাদ, লখনউ, লাহোর থেকে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা গিরিশচন্দ্রকে চিঠি লেখেন, তাঁরা ম্যাকবেথ-এর সুখ্যাতি শুনে শীঘ্রই কলকাতায় এসে অভিনয় দেখতে চান। কিন্তু গুটিকতক বিশিষ্ট ব্যক্তির জন্য তো আর রাতের পর রাত মঞ্চের বাতি জ্বালিয়ে রাখা যায় না! থিয়েটার চালাতে গেলে লাভ-লোকসানের প্রশ্ন আছে। মিনাভ অবিলম্বে লোকসানের দশায় পড়ল।

খুবই নিরাশ হয়ে গেলেন গিরিশচন্দ্র। এমনই মন ভেঙে গেল যে এক একবার সংকল্প নিতে গেলেন, আবার থিয়েটারের সঙ্গে সব সংশ্রব ত্যাগ করবেন। বড় মুখ করে অনেককে বলেছিলেন, এরপর একটার পর একটা শেকসপীয়ারের রচনা অনুবাদ করে বাংলা মঞ্চে উত্তম নাটক পরিবেশন করবেন। ঘুচে গেল সে সাধ! ছ্যা ছা ছ্যা, কাদের জন্য করবেন ভাল নাটক, সে রকম দর্শকই তৈরি হয়নি। ভাল থিয়েটার দেখতে গেলে দর্শকদেরও যোগ্য হয়ে উঠতে হয়, সে জন্য আরও কতদিন অপেক্ষা করতে হবে কে জানে।

মিনার্ভার সঙ্গে গিবিশচন্দ্র চুক্তিবদ্ধ, হুট কবে ছেড়ে দেওয়া যায় না। নগেন্দ্রভূষণ সজ্জন ব্যক্তি, তাঁব স্বার্থও দেখতে হয়, তিনি কত দিন লোকসানের খাতে টাকা ঢালবেন? এতগুলি অভিনেতা-অভিনেত্রী জীবিকার প্রশ্নও জড়িত।

গিবিশচন্দ্র হালকা, চুটকি নাটক রচনা শুরু করলেন। তাতে রসের চেয়ে গ্যাঁজলা বেশি। হাস্যরসের বদলে ভাঁড়ামি। টিকিট-কাটা দর্শকরা যে এই সবই চায়। মঞ্চস্থ হতে লাগল ‘মুকুল-মুঞ্জরা’, ‘আবু হোসেন’, ‘বড়দিনের বখশিস’, ‘সপ্তমীতে বিসর্জন’ ইত্যাদি। কোনওটাই একটানা নয়, দু’চারদিন অন্তর বদল করে করে। গানে মিশিয়ে দেওয়া হতে লাগল আদিরস। ‘আবু হোসেন’-এর এই একখানা গান খুব জনপ্রিয় হল।

একে লো তোর ভরা যৌবন
বসে করেছে অবশ, আবেশে ঢলে নয়ন
ঘোর বিরহ-বিকার তাতে
জোর করেছে নাড়ির ধাতে
বাই কুপিতে সরল মন মাতে–
ভরা হৃদি, গুরু ঊরু–বিষম কুলক্ষণ…

টিকিটঘর কিছুটা চাঙ্গা হবার পর গিরিশচন্দ্র মন দিয়ে আর একটি নাটক লিখলেন। পাকেচক্রে পেশাদার থিয়েটারে তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু তাঁর তো মূল সাধ ছিল বাংলার নাট্যশিল্পের উন্নতি। দর্শক মজালেও নিছক লঘু নাটকে তাঁর মন ভরে না।

তা ছাড়া সমালোচনা এখন উল্টো সুর গাইতে শুরু করেছেন। আবু হোসেন নাটক সম্পর্কে ‘অনুসন্ধান’ পত্রিকা লিখল, ‘জহুরী গিরিশবাবু, ঠিক জহরই সম্মুখে ধরিয়াছেন। যেমন দেশ, যেমন রুচি, যেমন দর্শক, তেমনই তো তার আয়োজন চাই? তা ভাল। বুঝিলাম, দেশকাল-পাত্র বুঝিয়া, সও নাচ দিয়া কাজ হাসিল হইল। লোকেও হাসিল-মজিল-আনন্দ পাইল। কিন্তু প্রবীণ গিরিশবাবুর কাছ হইতে আমরা তো এরূপ সঙ নাচ দেখিবার আশা করি না!’

অনেক ভেবেচিন্তে এবার গিরিশচন্দ্র বিষয়বস্তু নির্বাচন করলেন মহাভারত থেকে।

দর্শকদের রুচি ঘন ঘন বদলায়। কখনও ঐতিহাসিক নাটকে তারা মেতে ওঠে, কখনও সামাজিক বিষয়ে। কখনও ভক্তিরস তাদের পছন্দ, কখনও বীররস। মহাভারত সব রসেরই খনি। গিরিশ বেছে নিলেন জনার কাহিনী, এতে অনেকগুলি রসের সংমিশ্রণ করা যায়, পৌরাণিক নাটকও অনেকদিন হয়নি, পৌরাণিক নাটকে ভাবগম্ভীর সংলাপ আসে স্বাভাবিকভাবে, পোশাক-পরিচ্ছদও ঐতিহাসিক নাটকের মতন।

দর্শক-মনোরঞ্জনের সব রকম উপাদান থাকলেও গিরিশচন্দ্র-এর মধ্যে নিজস্ব জীবন-দর্শনের কথাও ঢুকিয়ে দিলেন কিছু কিছু। বিদূষক চরিত্র গিরিশের খুব প্রিয়, তার হাতে খেলেও ভাল। ‘জনা নাটকেও বিদূষকই যেন প্রধান, তার মুখে শ্লেষ-বিদ্রুপের আড়ালে জীবনের সব সার কথা উচ্চারিত।

বিদূষকের ভূমিকায় অর্ধেন্দুশেখর একেবারে অতুলনীয়। কৌতুক যেন তাঁর শরীরের প্রতিটি ভঙ্গিতে সহজাত। অর্ধেন্দুশেখরের চলনে, বলনে, পোশাকে এমনকী নীরবতাতেও লোকে হাসে। এমন নিরভিমান মানুষও দেখা যায় না। নাটকে যে-কোনও ভূমিকা দেওয়া হোক, তার আপত্তি নেই। একটি মাত্র দৃশ্যের ভূতের ভূমিকাতেও তিনি অদ্বিতীয়। কোনও কোনও নাটকে অর্ধেন্দুশেখরের নাম বিজ্ঞাপিত থাকে, কিন্তু দর্শকরা প্রথম প্রথম অর্ধেন্দুশেখরকে চিনতেই পারে না। তিনি নায়ক নন, প্রধানও নন, চার পাঁচটি ছোটখাটো চরিত্রে বিভিন্ন সাজে তিনি অবতীর্ণ হন এবং মাতিয়ে দেন।

‘জনা’ নাটকে বিদৃষকই অবশ্য মুখ্য আকর্ষণ। নায়ক প্রবীরের ভূমিকায় নেমেছে সুবেন্দ্র, যদিও তার এই নামটি অনেকেই জানে না, গিরিশচন্দ্রের ছেলেকে গিরিশচন্দ্রের অনুকরণে সবাই দানী বলেই ডাকে। দর্শকদের কাছেও সে দানীবাবু। দানীর কণ্ঠস্বর অপূর্ব, এর মধ্যেই লোকে বলাবলি করতে শুরু করেছে যে কালে কালে দানী তার বাবাকেও ছাড়িয়ে যাবে অভিনয়প্রতিভায়। জনার ভূমিকায় তিনকড়ি দাসী যেন লেডি ম্যাকবেথেরই আরেক রূপ। নয়নমণি একটি ছোট ভুমিকা পেয়েছে, তাতেই সে সন্তুষ্ট।

জনার জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে, তখনই হঠাৎ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হল।

একদিন সকালে গিরিশচন্দ্রের বাড়িতে এলেন অর্ধেন্দুশেখর। কচুরি-রসগোল্লা ও চা পানের সঙ্গে সঙ্গে রসালাপ চলল কিছুক্ষণ। তারপর আচম্বিতে অর্ধেন্দুশেখর বললেন, জি সি, এবার আমায় ছুটি দিতে হবে। পাখি আবার উড়ে যাবে।

গিরিশচন্দ্ৰ আঁতকে উঠলেন।

অর্ধেন্দুশেখর অতিশয় খেয়ালি, তার রক্তের মধ্যে যেন রয়েছে এক যাযাবর। অর্থ কিংবা যশ, কোনও কিছুরই লালসা নেই। নাট্যজগতে তার এত খ্যাতি, তবু মাঝে মাঝেই থিয়েটার ছেড়ে কোথায় যেন উধাও হয়ে যান। বেশ কিছুদিন পাহাড়ে পড়েহিসেন এক সন্ন্যাসীর কাছে হঠযোেগ শেখার জন্য। কর্নেল আলকটের কাছে শিখেছেন হিপনোটিজম।

গিরিশচন্দ্র বলেন, আবার কোথায় পালাবার কথা ভাবছ? না, না, ওসব চলবে না। পাগলামি ছড়ো। মিনার্ভা এখন সবে মাত্র জমে উঠেছে, এখন তুমি চলে যাবে বললেই হল আর কি।

অর্ধেন্দুশেখর মুচকি হেসে বললেন, পালাব না, কলকাতাতেই থাকব। কিন্তু মিনার্ভায় থাকব না। গিরিশচন্দ্র বলেন, কেন? তোমায় কেউ কিছু বলেছে? কার এমন সাহস হবে? তোমাকে সকলেই খুব প্রীতি করে–

অর্ধেন্দুশেখর মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বললেন, কেউ কিছু বলেনি। বগলেও কি আমি গায়ে মাখি? কিন্তু তুমি আমায় ছেড়ে দাও!

গিরিশচন্দ্র এক মুহূর্ত চিন্তা করে বললেন, তা হলে স্টার থেকে তোমাকে ডেকেছে?

অর্ধেন্দুশেখর বললেন, উহুঃ! কেউ ডাকেনি। স্টারে কে যাবে, ধুৎ!

গিরিশচন্দ্র ধমক দিয়ে বললেন, বাড়ি যাও তো, আমাকে বিরক্ত কোনো না। যতসব উটে কথা! কেউ খারাপ কথা বলেনি, অন্য থিয়েটার থেকে ডাকেনি, বিদূষকের রোলে তোমার নামডাক কত বেড়েছে, তবু তুমি মিনার্ভা ছাড়তে চাও! এর মাথা-মু কিছু বোঝা যায়?

গিরিশের কাছ থেকে গড়গড়ার নলটা নিয়ে না মুছেই ভুড়ক ভুড়ক করে টানলেন কয়েকবার। তারপর একগাল হেসে ‘অর্ধেন্দুশেখর বললেন, আসল কথাটা বলি? তুমি যেন আবার রেগে গিয়ে আমায় মারতে এসো না। আমার মাথায় একটা শখের ভূত চেপেছে। আমার ইচ্ছে হয়েছে, আমি এক নম্বর হব।

–তার মানে?

—সব সময় তুমিই এক নম্বর। তুমি নাট্যকার, তুমি পরিচালক, তুমি গান বাঁধো। আমরা শুধু স্টেজে নাচি কুঁদি। বড়জোর দু নম্বর হতে পারি। তা দু নম্বরের কি কখনও সখনও এক নম্বর হওয়ার সাধ জাগে না?

–ও, এই কথা? ঠিক আছে, পরের পালায় তুমিই এক নম্বর হও। তুমি নাট্যশিক্ষা দেবে, তুমিই সব কিছু হবে। আমি আড়ালে থাকব।

—পর্বতকে কি আড়াল করা যায়? তুমি পেছনে থাকলেই লোকে বলবে, তোমার ঠেকনোতে আমি লম্ফ ঝম্প কবছি। তা হয় না, জি সি! এক অরণ্যে ব্যার্থ আর সিংহ দুজনে থাকতে পারে না। কাল স্বপ্ন দেখেছি, আমি এক বনে বাঘ সেজে হালুম হালুম করছি। তখনই বুঝলুম, তুমি সিংহ, আর তো তোমার পাশে আমার থাকা চলবে না। ভোরের স্বপ্ন মিথ্যে হয় না কখনও।

–কাল বুঝি খুব পোলাও কালিয়া সাঁটিয়েছ? বদহজমের স্বপ্ন। আমিও সিংহ নই, তুমিও বাঘ নও। আমরা দুজনেই রং মাখা সঙ। সুতোয় বাঁধা পুতুল। যাও, বাড়ি গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোও গে ভাল করে।

–মা গো, আমার মাথায় পোকা নড়েছে। জান তো, একবার গো ধরলে আমি সহজে ছাড়ি না। এমারেল্ড থিযেটাবটা খালি পড়ে আছে। ওটা ভাড়া নিয়ে আমি নিজে একটা দল চালাব। কালই কথাবার্তা বলেছি।

–টাকা কে দেবে?

—আমার নিজের টাকা। যেখানে যা আছে কুড়িয়ে বাড়িয়ে প্রথমটা চলে যাবে। এক নম্বর যখন হব ঠিক করেছি, তখন মাথার ওপর আর কেউ থাকবে না। মালিক ফালিক কেউ না।

গিরিশচন্দ্র স্তম্ভিত হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। অর্ধেন্দুশেখর যে মস্করা করছেন না, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। অর্ধেন্দুশেখরের কাছ থেকে এরকম ব্যবহার সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। তারা দুজনে। বহুদিনের বন্ধু। কখনও মনোমালিন্য ঘটেনি। অর্ধেন্দুশেখরের মনে ঈর্ষা নামে কোনও কি অস্তিত্বই নেই। তঁাব মুখে আজ এমন কথা!

গিরিশচন্দ্র অর্ধেন্দুশেখরের হাত জড়িয়ে ধরে ব্যাকুলভাবে বললেন, সাহেব, এমন কম্মাে কিছুতেই করতে যেয়ো না! থিয়েটারের মালিক হতে যেয়ো না কক্ষনও। হিসেব রাখা, সকলের পাওনা-গণ্ডা মেটানো, এর অনেক হ্যাপা। আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়। দ্যাখো না, আমি কি কখনও থিয়েটারের মালিক হয়েছি? ইচ্ছে করলে কি প্রথম আমলে স্টারের হর্তাকর্তা আমি হতে পারতুম না? ওসব ঝামেলায় নিজেকে জড়াইনি কখনও। তোমাকে ভাল মতন চিনি, তুমি আপনভোলা মানুষ, তুমিও পারবে না। এই চিন্তা ছাড়ো!

অর্ধেন্দুশেখর নিজের মাথায় টোকা দিয়ে বললেন, ওই যে বললুম পোকা নড়েছে। এখন আর অন্য কোনও চিন্তা ঢুকবে না মাথায়। একবার দেখিই না চেষ্টা করে। |||

||||||| গিরিশচন্দ্র অস্ফুট স্বরে বললেন, তুমি চলে গেলে জনা নাটক কানা হয়ে যাবে। ওই বিদূষকের পার্ট আর তো কেউ পারবে না।

—কেন, তুমি নামবে?

–আমি! এই বুড়ো বয়েসে আর মুখে রং মেখে আমার মঞ্চে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না।

—আহা, তুমি বুড়ো হলে আমিই বা কি কচি? এই সেদিনও তো ম্যাকবেথে ফাটালে।

–তোমার কথা ভেবেই বিদূষক চরিত্রটির সৃষ্টি। ওই ভূমিকায় তোমার যে সুখ্যাতি হয়েছে, তাতে দর্শক আর এখন আমাকে নেবে না।

–বড়বাবু, তুমি সব পারো। যে ডায়ালগে আমি মানুষকে হাসাই, সেই ডায়ালগেই তুমি মানুষকে কাদাবে!

–মিনার্ভায় জনা চলুক বা বন্ধ হয়ে যাক, সে সব ভেবে বলছি না। সাহেব, তোমার সুহৃদ হিসেবে বলছি, তুমি নিজে মালিক হয়ে থিয়েটার চালাতে যেয়ো না। অন্য যা হয় ইচ্ছে করো।

অনেক যুক্তি-তর্কেও আর্ধেন্দুশেখরকে আর বোঝানো গেল না। গিরিশচন্দ্রকে বিদৃষকের ভূমিকায় তৈরি হবার সময় দেবার জন্য তিনি আর মাত্র দুটি রজনীর অভিনয়ে রাজি হলেন, তারপর থেকে তিনি এমারাল্ডে এক নম্বর।

কিছু কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রীও অর্ধেন্দুশেখরের সঙ্গে চলে যাবে মিনার্ভা ছেড়ে। থিয়েটারের জগতে এরকম দল ভাঙাভাঙি অবিরাম চলে। এরই মধ্যে একদিন নয়নমণিকে নিজের ঘরে ডেকে আনলেন অর্ধেন্দুশেখর।

নতমুখী সেই তরুণীকে তিনি বললেন, নয়ন, আমি এমারেন্দ্রে গিয়ে নতুন দল খুলছি। তুই আমার সঙ্গে যাবি? মিনার্ভায় তোর ভাগ্য চাপা পড়ে থাকবে। তিনকড়ি যতদিন আছে, তুই বড় পার্ট পাবি না। তিনকড়ি গিরিশবাবুর খুব পেয়ারের। তোর দিকে তাঁর চোখ নেই। আমি বুঝেছি, তোর ভেতরে অনেক শক্তি আছে। একটু মাজা ঘষা করলে তুই হিরোইন হাতে পারবি। পয়সাও বেশি। পাবি। আজই উত্তর দিতে হবে না, কী করবি ভেবে দ্যাখ। আমি তোকে চাই!

নয়নমণি দারুণ দোলাচলের মধ্যে পড়ে গেল। এর মধ্যে দু তিন জায়গা থেকে তার কাছে প্রস্তাব এসেছে, কিন্তু সে মিনার্ভা ছাড়তে রাজি হয়নি। সে গিরিশচন্দ্রের পায়ের কাছে পড়ে থেকে অভিনয় কলা শিখতে চায়। কিন্তু ইনি যে অর্ধেন্দুশেখর, এর ডাক সে ফেরাবে কী কবে? অর্ধেন্দুশেখরই বলতে গেলে নয়নমণিকে রাস্তা থেকে তুলে এনে থিয়েটারে সুযোগ করে দিয়েছেন। ইনি নয়নমণির পিতৃতুল্য।

বাড়িতে এসে গঙ্গামণিকে কথাটা জানাতেই সে বলল, নিয়ে নে, নিয়ে নে। হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলিসনি! এক থিয়েটারে বেশিদিন পড়ে থাকলে নট-নটীদের কদর হয় না। লোকে ভাবে, তাকে বুঝি অন্য কেউ চায় না। যত বদল করবি, তত তোর দাম বাড়বে! মুখপুড়ি, তুই এবার আপত্তি করলে তোর মুখে আমি ঝাটা মারব!

তারপর গলা নামিয়ে সে আবার বলল, তুই অ্যাকটিং শিখতে চাস তো? তোকে আমি সত্যি কথাটা বলি। গিরিশবাবুর চেয়ে আমাদের এই অর্ধেন্দুসাহেব অনেক ভাল পার্ট শেখায়। আমি থিয়েটারের ঘাগি, আমি সব জানি।

নয়নমণি মিনার্ভা ছেড়ে যোগ দিল এমারাল্ড থিয়েটারে।

নাটক বাছা হল অতুলকৃষ্ণ মিত্তিরের ‘মা’। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলের কাহিনী অবলম্বনে লেখা। নয়নমণিই প্রধানা নায়িকা। সঙ্গে সঙ্গে নয়নমণির মান-মর্যাদা অনেক বেড়ে গেল। এখন তাকে রিহার্সালে নিয়ে যাবার জন্য গাড়ি আসে, বাড়িতেও পৌঁছে দিয়ে যায়। রিহার্সালের সময় বিনা পয়সায় খাওয়া, মাস মাইনে দেড় শশা টাকা। খরচের ব্যাপারে অর্ধেন্দুশেখর দিলদরিয়া।

অর্ধেন্দুশেখর তার দলে অধিকাংশই অখ্যাত নট-নটীদের নিয়েছেন। তার ইচ্ছে, নামের জোর দিয়ে দর্শক টানরেন না, দর্শক আসবে অভিনয়ের গুণে। তিনি সকলকে এমন ভাবে তৈরি করবেন, যেমনটি আগে কেউ কখনও দেখেনি।

এমনিতে এমন সময় ভালমানুষ, কিন্তু রিহার্সান্সের সময় অর্ধেন্দুশেখর যেন সত্যিই বাঘ। কারুর টু শব্দটি করার উপায় নেই।

রিহার্সাল চলছে সামনে দু’জনকে নিয়ে, পেছনে কেউ একজন অন্যকে ফিসফিস করে বলল, এই এক খিলি পান দিবি।

অমনি অর্ধেন্দুশেখর হাত তুলে মহড়া বন্ধ করে দিয়ে বললেন, থামো গো, ওদিকে বাবুদের কী সব কথাবার্তা হচ্ছে, আগে শেষ হোক, তারপর আবার শুরু করা যাবে।

কেউ একজন উঠে গেল, সামান্য পায়ের শব্দ হয়েছে, অমনি অর্ধেন্দুশেখর গর্জন করে উঠলেন, আর কে কে উঠে যাবেন, যান, যান, ইচ্ছে না হলে বসে থাকার দরকার নেই!

নয়নমণিও বকুনি খেয়েছে, তবে একবার মাত্র। ব্যোমকেশ নামে একটি ছোকরা মেয়েদের সঙ্গে বড় দুষ্টামি করে। রিহার্সালের সময় সকলের একাগ্রতার সুযোগ নিয়ে সে মেয়েদের অচল ধরে টানে। একদিন সে নয়নমণির ঠিক পিছনে বসেছে, মেঝেতে ছড়ানো তার আচল ধরে গোপনে একটু একটু করে টানছে ব্যোমকেশ।

পার্ট বলতে বলতে হঠাৎ একসময় মুখ ফিরিয়ে নয়নমণি বিরক্ত স্বরে বলল, এই কী হচ্ছে? ছাড়ো!

অর্ধেন্দুশেখর তৎক্ষণাৎ হাত তুলে বললেন, এটা কী হল? এটা কী হল? এই কী হচ্ছে, ছাড়ো, এ কী সংলাপের মধ্যে আছে?

নয়নমণি চুপ করে গেল।

অন্যের নামে নালিশ করা তার স্বভাব নয়। উত্তাক্ত হয়ে সে এই কথা বলে ফেলেছে, তা বলে ব্যোমকেশকে সে শাস্তি দেওয়াতে চায় না।

অর্ধেন্দুশেখর বললেন, ব্যোমকেশ কী করেছে আমি জানি, দেখেছি। কিন্তু নয়ন, স্টেজেও যদি ব্যোমকেশের মতন কেউ পেছন থেকে তোর সঙ্গে ফচকেমি কবে, তখনও কি তুই পার্ট ভুলে ওই কথা বলবি? জানিস, বিনোদিনীর শাড়িতে একবাব আগুন ধরে গিয়েছিল, তাও সে কারুকে বুঝতে দেয়নি। অভিনয় হচ্ছে ধ্যানের মতন, এরকম সামান্য ব্যাঘাতে ধ্যান ভেঙে গেলে চলবে কী করে?

তারপর তিনি ব্যোমকেশকে বললেন, বাপধন, তোমাকে তো আমি দুঃশাসনের পার্ট দিইনি, তা হলে আঁচল ধরে টানাটানি কেন? যখন মহাভারতের পালা নামাব, তখন তোমায় ডাকব, এখন তুমি এসস।

শুধু অভিনয় শেখানোই নয়, প্রত্যেকটি নট-নটার প্রতিদিনের জীবনযাপনের প্রতিও অর্ধেন্দুশেখরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।

একদিন তিনি নয়নমণিকে নিভতে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই সারাদিন কী কী খাস, আমাকে বল তো! একেবারে সকাল থেকে শুরু কর।

সব শুনে তিনি বললেন, তুই মাছ-মাংস খাস না। এ তো বড় সাতিক কথা। শরীরে তাগদ না থাকলে টানা তিনঘণ্টা স্টেজে লাফালাফি করবি কী করে? মাংস বা মাছ কিছু একটা খাবি রোজ। তুই কি বিধবা নাকি? নটীরা কেউ বিধবা-সধবা কুমারী থাকে না, তারা শুধু নটী। সকালে উঠে চিরতার জল খাবি কিংবা চুনের জল। পেট পরিষ্কার রাখা দরকার, সবসময় মনে রাখবি, পেট পরিষ্কার না থাকলে গলা ভাল খোলে না। শাক খাস না কেন? সপ্তাহে তিনদিন পুঁই শাক, কুমড়ো শাক, কলমি শাক কিছু একটা খেতে হয়। শাক রাঁধতে জানিস তো? না হলে আমি শিখিয়ে দেব। জানিস, আমি কোর্মা-কালিয়া থেকে শাক-চচ্চড়ি সব রাঁধতে পারি, একদিন খাওয়াব তোদের। তুই মদ খাম?

নয়নমণি দু’দিকে মাথা নেড়ে জোরে জোরে বলল, না।

–তোর কোনও বাধা বাবু আছে? কেউ তোকে রেখেছে?

–না।

-–তোর কোনও পেয়ারের লোক আছে?

–না।–তবে কি তোর বিয়ে হয়েছিল নাকি রে? স্বামী আছে?

না।

অর্ধেন্দুশেখর এবার ধমক দিয়ে বললেন, খালি না না বঙ্গে। একটা কিছু যা বলতে পারিস না? তোর কোনও পুরুষমানুষ যদি না থাকে, সেটা তো ভাল কথা নয়। মাঝে মাঝে কোনও পুরুষের আলিঙ্গন না পেলে মেয়েদের শরীরের রস শুকিয়ে যায়। মুখখানা প্যান্তাখাঁচা হয়ে যায়, তা নিয়ে বেশি দিন পার্ট করা যায় না। থিয়েটারের জগতে সাত্ত্বিক হলে চলে না রে! তোর পুরুষমানুষ নেই, এ তো মহা চিন্তার কথা। এই বুড়ো বয়সে আমি তো তোর নাগর হতে পারি না। তা হলে কি এই ব্যোমকেশটার ওপর তোর মন মজেছিল? বল, তবে তাকে ফিরিয়ে আনি।

নয়নমণি এবার হেসে ফেলে বলল, আপনি তাকে ফিরিয়ে আনন। সে নাকি ব্রেজ গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁদে। তবে আমার জন্য নয়, আমার একঞ্জন আছে।

সাধারণত দশ বারোদিন রিহার্সাল দিয়েই একটা নাটক শুরু হয়ে যায়। কিন্তু অর্ধেন্দুশেখর মাসের পর মাস রিহার্সাল চালিয়ে গেলেন, তবু নাটক মঞ্চস্থ হবার নাম নেই। সব কিছু একেবারে নিখুঁত না ইলে অর্ধেন্দুশেখরের মনে ধরে না। এদিকে টাকা পয়সা খরচ হয়ে যাচ্ছে জলের মতন।

ব্যোমকেশ ফিরে এসে একটা ছোট ভূমিকা পেল বটে, কিন্তু সে নয়নমণির পেছনে লেগে রইল। এখন আর সে অন্য মেয়েদের আঁচল ধরে টানে না। নয়নমণির জন্যই যে সে অর্ধেন্দুশেখরের দয়া পেয়েছে সেটা সে জেনে গেছে, সুতরাং সে ধরেই নিয়েছে নয়নমণির কাছ থেকে সে আরও অনেক কিছু পাবে।

নয়নমণি তাকে দূরে দূরে সরিয়ে রাখে। কিন্তু একদিনও কোনও শৌখিন বাবু নয়নমণিকে নিতে আসে না, সে রোজ মহড়ার পর বাড়ি ফিরে যায়, এতে সকলেরই খটকা লাগে। থিয়েটারের মানুষদের রাতটাই দিন, দিনটাই রাত। তারা দিনে ঘুমোয়, রাত জেগে আমোদ করে। নয়নমণির মতন কোনও সোমশ্ব যুবতী একলা একলা থাকবে, এটা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।

ব্যোমকেশ নয়নমণির বাড়িতে পর্যন্ত ধাওয়া করে। বাধ্য হয়ে নয়নমণিকে গঙ্গামণির শরণ নিতে হল। গঙ্গামণি অতিশয় দজ্জাল, জীবনে সে অনেক পুরুষ চরিয়েছে, পুরুষ মানুষদের কী করে আটকাতে হয়, তাও সে জানে। ব্যোমকেশকে সে দোতলায় ধরে রাখে, তিনতলায় উঠতে দেয় না। একদিন সে ব্যোমকেশকে আদর করে বড় এক গেলাস শরবত খেতে দিল। আসলে তা ক্যাস্টর অয়েল, তাতে একটু চিনি মেশাননা। সেটা খাবার পর তিনদিন আর ব্যোমকেশ বাথরুম থেকে দূরে থাকতে পারেনি।

অবশেষে এমারাল্ড থিয়েটার অধিগ্রহণ করার সাড়ে ছ’মাস পরে মা’ নাটকটি পাদপ্রদীপের সামনে এল।

সমালোচকরা ধন্য ধন্য করল, দর্শকও মন্দ হল না। অর্ধেন্দুশেখর সম্পর্কে অনেকেই খুব উৎসাহ, শুধু তাঁর অভিনয় দেখার জন্যই লোকে আসে, আর এ নাটক তো তাঁর সৃষ্টি। গিরিশচন্দ্র শ্রদ্ধেয় আর অর্ধেন্দুশেখর সকলের প্রিয়। তিনি যা-ই করুন, তাতেই তার সমর্থকের অভাব নেই। এ নাটকে নতুন নট-নটীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রশংসা পেল নয়নমণি। বেশ কয়েকটি পত্রিকায় লিখল, বাংলার নাট্যজগতে আর এক প্রতিভাময়ী অভিনেত্রীর আবির্ভাব।

কিন্তু আয়ের চেয়ে যে ব্যয় বেশি হয়ে যাচ্ছে, অর্ধেন্দুশেখর সে হিসেব রাখছেন না। বহু ঘুরতে-ঘুরতেই দেখা গেল তার অনেক দেনা হয়ে গেছে। গিরিশবাবু যা বলেছিলেন, তা যেন অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে।

তবু হাল ছাড়লেন না অর্ধেন্দুশেখর। নিজের সর্ব গেছে এরপরেও থিয়েটার চালিয়ে যাবার সঙ্কল্প নিয়ে তিনি একজন অংশীদার ঠিক করলেন। হরিশ্চন্দ্র মালাকার নামে এক ব্যক্তি অর্থ নিয়োগ করবেন, আয়-ব্যয়ের হিসেব রাখার ভার তার ওপর। তবে নাটক নির্বাচন বা প্রযোজনায় ব্যাপারে তিনি মাথা গলাতে পারবেন না।

হরিশ্চন্দ্ৰবাবু পাকা লোক। মখের কথায় তিনি বিশ্বাসী নন, সব কিছু লেখাপড়ায় থাকা চাই। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গেও তিনি নতুন ভাবে চুক্তি করিয়ে নিচ্ছেন। তিনি সঙ্গে এনেছেন একজন তরুণ ব্যারিস্টার।

এই ব্যারিস্টারের নাম যাদুগোপাল রায়। থিয়েটারের সব লোকজন অফিস ঘরে এসে চুক্তিপত্র সই করে যাচ্ছে, যাদুগোপাল বসে আছে একপাশে। নয়নমণির দিকে সে তাকিয়ে আছে অনেকক্ষণ। তার মক্কেলের অনুরোধে যাদুগোপাল এর মধ্যে ‘মা’ নাটক দেখে গেছে একবার। পৌরাণিক নাটকে সাজগোজ করা নয়নমণির সঙ্গে আজকের আটপৌরে শাড়ি পরা নয়নমণির অনেক তফাত।

নয়নমণির সই হয়ে যাবার পর সেই কাগজটি হাতে তুলে নিয়ে যাদুগোপাল বলল, নয়নমণি দাসী? থিয়েটারের জন্য অনেকে নতুন নাম নেয়, আপনার আসল নাম কী?

নয়নমণি বলল, ওই একই নাম।

ভুরু কুঞ্চিত করে আবার নয়নমণির মুখের দিকে তাকাল যাদুগোপাল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, আমার স্মৃতিশক্তি খুব ভাল। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলাম। আমি কিছুই ভুলি না। কলেজ জীবনে আমার এক বন্ধু ছিল ভরত সিংহ, বেশ কয়েক বছর আগে তার ভবানীপুরের বাড়ির কাছাকাছি একটি বাগানে আমরা একদিন বনভোজন করেছিলাম। সেখানে আমাদের উনুন ধরিয়ে দিয়েছিল একটি কিশোরী। সে লেখাপড়া জানত, গান জানত। যতদূর মনে পড়ে, তার নাম ছিল ভূমিসূতা। তাই না?

নয়নমণির শরীরটা যেন অনড় পাথর হয়ে গেছে। সে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল যাদুগোপালের দিকে।

যাদুগোপাল বলল, ভরত আমার খুব ভাল বন্ধু ছিল। শুনেছি, আপনার জন্য সে বিবাগী হয়ে গেছে। সে এখন কোথায় আছে, আপনি জানেন?

এবারে নয়নমণির শরীরে স্পন্দন এল, থরথর করে কাঁপছে তার ঠোঁট। সে বলল, না, জানি না, জানি না। আমি কিছুই জানি না।

আর দাঁড়াল না নয়নমণি, ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

ফেরার পথে ঘোড়ার গাড়িতে বসে সে একা একা কাদতে লাগল অঝোরে। বাড়ি ফিরেও তার কান্না থামে না। গঙ্গামণি উদ্বিগ্ন হয়ে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল, কী হয়েছে, হ্যাঁ লা, কী হল তোর, কোন অগীর ব্যাটা তাকে কী বলেছে?

নয়নমণি একটা কথাও বলতে পারল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *