এসেছ পাষাণী। দয়া হয়েছে কি মনে?
হল সারা সংসারের যত কাজ ছিল?
মনে কি পড়িল তবে অধীন এ জনে
সংসারের সব শেষে? জান না কি, প্রিয়ে,
প্রেম এই হৃদয়ের স্বাধীন কর্তব্য–
সকল কর্তব্য চেয়ে প্রেম গুরুতর!
এরপর রানি সুমিত্রার সংলাপ। এর আগের ক’দিন রিহার্সালে বই দেখে পার্ট হচ্ছিল, আজ মুখস্থ বলা হবে, রাজা বিক্রমদেবের কথা শেষ হতে না হতেই রানি শুরু করবে। কিন্তু নয়নমণি চুপ করে রইল।
যেদিন থিয়েটারে শো থাকে না, সেদিন রঙ্গমঞ্চেই রিহার্সাল হয়। অমরেন্দ্রনাথ হাঁটাচলা, অঙ্গভঙ্গির ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়। কাঠের পুতুলের মতন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পার্ট বলে যাওয়া তার ঘোর অপছন্দ। প্রথম রিহার্সাল থেকেই প্রত্যেক অভিনেতাকে মুভমেন্ট শেখানো হয়।
অমরেন্দ্রনাথ নিজে মদ্যপান করে না, রিহাসলের সময় কেউ মদ ছুঁতে পারবে না, এই রকম কঠোর নির্দেশ দেওয়া আছে। কোনও রকম উটকো মন্তব্য, গল্প-গুজব নিষিদ্ধ। প্রত্যেককে আগাগোড়া উপস্থিত থাকতে হবে, কোনও দৃশ্যে পাট নেই বলে আড়ালে যাওয়া চলবে না। বঙ্গ সন্তানের পক্ষে বেশিক্ষণ মুখ বুজে থাকা খুবই কষ্টকর, রিহার্সালের মধ্যে অবান্তর কথা বলার অপরাধে দুজনকে এর মধ্যেই তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
অমরেন্দ্রনাথের চেয়ে প্রায় আর সকলেরই বয়েস বেশি। তবু তার ব্যক্তিত্বের প্রতাপে সবাই তটস্থ হয়ে থাকে।
বিভিন্ন নাটকে সে বিভিন্ন বয়েসী ভূমিকা নেয়, সব রকম পাটেই সে তার অভিনয়-প্রতিভা দেখাতে চায়। হ্যামলেট বা হরিরাজ নাটকে সে তরুণ নায়ক, ‘রাজা রানী’ নাটকে সে প্রৌঢ় রাজা। সব নাটকেই নয়নমণি তার বিপরীত ভূমিকায়। ঠিক সময় পার্ট শুরু না করায় অমরেন্দ্রনাথ উচ্চকণ্ঠে বলল, কী হল, নয়নের পাট মুখস্থ হয়নি?
নয়নমণি রাজার সংলাপের মাঝখানে প্রবেশ করে দাঁড়িয়ে আছে, সে বলল, আপনার কিউ ঠিক হয়নি!
অমরেন্দ্রনাথ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কিউ ঠিক হয়নি মানে? আমার মুখস্থ কখনও ভুল হয়।
নয়নমণি বলল, মুখস্থ ঠিকই আছে। কিন্তু শেষ দুটি লাইন উল্টে গেছে। প্রেম এই হৃদয়ের স্বাধীন কর্তব্য’, এই লাইনটা শেষে হবে। আপনি প্রেম গুরুতর দিয়ে শেষ করলেন, কিন্তু ‘কর্তব্য’-তে আমার কিউ।
অমরেন্দ্রনাথ বললেন, হতেই পারে না। প্রম্পটার!
একটু পেছনে দাঁড়ানো প্রমপটার ভয়ে কাঁপছে। নয়নমণি ঠিকই ভুল ধরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু সে কথা শুনলে অমরেন্দ্রনাথ চটে যাবে। সে বলল, ‘প্রেম এই হৃদয়ের স্বাধীন কর্তব্য’, আপনি এখানেই তো শেষ করলেন। এটা স্পষ্ট মিথ্যে কথা, অন্য সকলেই বুঝল, কেউ প্রতিবাদ জানাল না।
অমরেন্দ্রনাথ নয়নমণিকে ধমক দিয়ে বলল, তুমি মন দিয়ে শোনোনি। অন্য কিছু ভাবছিলে?
নয়নমণি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তা হলে আমারই ভুল হয়েছে। আপনি আর একবার বলবেন? এবার অমরেন্দ্রনাথ শেষ করতেই নয়নমণি ধরল :
হায়, ধিক মোরে। কেমনে বোঝাব, নাথ
তোমারে যে ছেড়ে যাই সে তোমারি প্রেমে।
মহারাজ, অধিনীর শোনো নিবেদন–
এ রাজ্যের প্রজার জননী আমি। প্রভু,
পারি নে শুনিতে আর কাতর অভাগা
সন্তানের করুণ ক্রন্দন। রক্ষা করো
পীড়িত প্রজারে—
অমরেন্দ্রনাথ চেঁচিয়ে উঠল, পীৱিত নয়, পীরিত নয়, পীড়িত। বাঙাল মুল্লুক থেকে এসেছ নাকি! ড, ড স্পষ্ট উচ্চারণ করবে! তুমি আগে যাদের কাছ থেকে শিখেছ, তারা তোমাকে র আর ড-এর উচ্চারণ ঠিকমতন শেখায়নি?
নয়নমণি বলল, আমি বাঙাল দেশে কোনও দিন যাইনি। তবু চেষ্টা করব, এর পর আর ভুল হবে না।
টানা দু ঘণ্টা মহড়ার পর মধ্যাহ্নভোজের বিরতি।
অমরেন্দ্রনাথ নিজের ঘরে নয়নমণিকে ডেকে পাঠাল। একটা চেয়ারে বসার ইঙ্গিত করে জিজ্ঞেস করল, তুমি তখন কেন বললে, আমি কিউ দিতে ভুল করেছি? ম্যানেজারের মুখে মুখে কথা বলতে তোমাকে কে শিখিয়েছে?
নয়নমণি উত্তর না দিয়ে হাসল।
অমরেন্দ্রনাথ আরও উত্তপ্ত হয়ে বলল, আমার কথার উত্তর না দিয়ে হাসছ যে?
নয়নমণি বলল, সে জন্য আজই বরখাস্ত হব নাকি? আমি এর আগে দুতিনটি থিয়েটারে কাজ করেছি। কখনও এ রকম ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়নি। এখানে সবাই ভাবে, যে-কোনও দিনই বুঝি বরখাস্ত হয়ে যেতে পারে।
অমরেন্দ্রনাথ বলল, ভয় পেলে বুঝি মানুষ হাসে? তোমার ব্যবহারে তো ভয়ের কোনও লক্ষণ নেই।
নয়নমণি বলল, আমি গিরিশবাবু, অর্ধেন্দুশেখরের অধীনে পার্ট শিখেছি। তাঁরা নমস্য ও মহা শ্রদ্ধেয়। তাঁদের খুব ভয় পেতাম। কিন্তু আপনার সামনে দাঁড়ালে … আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না যে আপনি আমার চেয়ে বয়েসে ছোট। তাই ভয় লাগে না।
অমরেন্দ্রনাথ বলল, বয়েসে ছোট হলেই বুঝি গুণে কম হয়? বুড়ো দামড়াদের মধ্যে কি বহু নিবোধ নেই?
নয়নমণি বলল, আপনার অবশ্যই অনেক গুণ আছে। দর্শকরা কি এমনি এমনি আপনাকে ভালবাসছে। কিন্তু আপনার অহং বড় বেশি। নিজের ভুল স্বীকার করাটাও মহতের লক্ষণ। অমরেন্দ্রনাথ বলল, তবু বলবে, আমি ভুল করেছি? প্রপটারের কথা শুনলে না?
—সে আপনার ভয়ে সত্যি কথাটা বলেনি।
–তা হলে একমাত্র তোমার কথাটাই মানতে হবে? রিহাসলের সময় কোনও রকম বাদ-প্রতিবাদ আমি সহ্য করব না। ফেব যদি কোনও দিন শুনি…
–তা হলে আজই আমি বাড়ি চলে যাই?
–বাড়ি যাবে মানে? তোমাকে আম চুক্তি দিয়ে বেঁধে রেখেছি, জানো না? অর্ধেন্দুশেখরের কাছ থেকে তুমি মুক্তি পেয়েছ, আমার কাছ থেকে অত সহজে নিষ্কৃতি নেই।
—অমরবাবু, মানুষের মনকে কি কোনও চুক্তি দিয়েই বেঁধে রাখা যায়? আমি তো নিছক টাকা রোজগাবের জন্য থিয়েটারে আসিনি। অভিনয় ভাল লাগে বলে এসেছি। অভিনযে যদি মন না লাগে, সব সময় আপনাব ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়, তা হলে নাটক জমাবে কেন? সবাইকেই আপনি দাবড়ে ভয় পাইযে বাখছেন। মহেন্দ্র বসুর মতন অত বড় একজন পাক অভিনেতাকেও আপনি ধমকেছেন।
—নয়নমণি, আমিও থিযেটাব খুলেছি নাটক ভালবেসে। নিছক টাকা রোজগারের জন্য নয়। আমি নতুন পবনেব অ্যাকটিং দেখাতে চাই, তা সকলে মানাবে না? তা হলে যে জগাখিচুডি হবে।
–কিন্তু আপনি কিউ দিতে ভুল কবলে অন্যদের অসুবিধে হবে না?
–এখনও বলছ, আমি ভুল বলেছি? আচ্ছা ঠিক আছে, ধবো, পাবলিকের সামনে শো করার সময় এরকম একটা ভুলই হয়ে গেল, তখন তুমি সামলাবে না?
–তখন অবশ্যই সামলাব। সেটা তো প্রত্যেকের দায়িত্ব। কিন্তু সে রকম ভুল যাতে না হয়, সেই জন্যই তো রিহার্সালে সাবধান হওয়া দরকার। অভিনয় যাতে সার্থক হয়, তা আমবা সবাই চাই। আর একটা কথা বলব? আপনি আমার র আর ড-এর ভুল ধরলেন, কোনও দিন আমাকে কেউ এমন কথা বলেনি। আপনিই বরং হৃদ-কে বিদয় উচ্চারণ করেন। থিয়েটাবে প্রত্যেকটি শব্দ ঠিকঠিক উচ্চারণ করাই তা উচিত।
—আমি হৃদয়কে বিদ্য বলি? কক্ষনও না। তোমার এত সাহস?
–না, না, সাহস নয়। অধীনার অপবাধ হয়েছে। তবে কি আজই বরখাস্ত?
—কোথায় যাবে তুমি, চুলের মুঠি ধরে তোমায় বেঁধে রাখব।
নয়নমণি আবার হেসে ফেলল। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বলল, অন্য কেউ এমন কথা বললে ভয়ে কাঁপতুম। কিন্তু আপনার কথা শুনে ভয় লাগে না।
অমরেন্দ্রনাথ এমনই রাগে ছটফট কবতে লাগল যেন নয়নমণিকে শারীরিক আঘাত করে সে বশে আনতে চায়। টেবিলের ওপর একটা কাচের পেপার ওয়েট সে মুঠোয় চেপে ধবল। এখানে আর কেউ তার নির্দেশ অবহেলা করতে সাহস পায় না, শুধু এই রমণীটি তার কর্তৃত্ব অস্বীকার করে চলেছে।
আর কোনও কথা খুঁজে না পেয়ে সে গরম কণ্ঠস্বরে বলল, যাও, ভাল করে পার্ট মুখস্থ কবো। ফেব যদি ভুল হয়—
পরপর তিনটি নাটকের রিহার্সাল চলেছে, সকলেই স্বীকার করে যে নয়নমণির স্মৃতিশক্তি সবচেয়ে ভাল। কোনও সংলাপই সে ভোলে না কিংবা জোড়াতালি দেয় না। ‘আলিবাবা’-তে সে মর্জিনার ভূমিকায় নাচ ও গান এমনই জমিয়ে তুলল যে কলাকুশলীরাও নিজেদের কাজ ফেলে বিহাসাল দেখার জন্য ভিড় জমায়, তাদের ছুটি হলেও বাড়ি যেতে চায় না।
পুরনো যাবা এমারাল্ডে নয়নমণির সঙ্গে কাজ করেছে, তারা নয়নমণির চবিত্রে অনেকখানি পরিবর্তন লক্ষ করে বিস্মিত হয়। আগে ছিল সে লাজুক ও নিভৃতচারিণী, মঞ্চে অভিনয়ের সময় ছাড়া অন্য সময় কারুর সঙ্গে কথাই বলত না প্রায়। পরিচালকের সমস্ত নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলত। এখন তার ব্যবহার অনেক সাবলীল, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে হাসিমুখে উত্তর দেয়, মালিক ও নির্দেশক অমরেন্দ্রনাথের সঙ্গে তর্ক করে।
অবশ্য সকলেই মনে মনে স্বীকার করে, অন্য নাটকগুলি পুরুষপ্রধান, স্ত্রী চরিত্রগুলিতে বিশেষ কিছু অভিনয়-ক্ষমতা দেখার সুযোগ নেই, কিন্তু ‘আলিবাবা’-তে নয়নমণি একাই চুম্বকের মতন হাজার হাজার দর্শক টেনে আনবে।
কিছুদিন পরেই আবার নয়নমণির সঙ্গে অমরেন্দ্রনাথের খটাখটি লেগে গেল।
থিয়েটারের জন্য অমরেন্দ্রনাথ দুটি জুড়িগাড়ি কিনেছে। তার একটিতে চারজন প্রধান অভিনেত্রীকে আনা-পৌঁছনো হয়। অমরেন্দ্রনাথের আদেশ, পথে যাওয়া-আসার সময় সেই গাড়ির দলা বন্ধ থাকবে, জানলা থাকবে টাকা, মাঝপথে দোকানপাটে কেউ নামতে পারবে না, রাস্তার লোক যাতে বুঝতেই না পারে যে সেই গাডির যাত্রী কারা।
একদিন অমরেন্দ্রনাথ নাট্যশালার হাতায় বসে চা খাচ্ছে, দেখল অভিনেত্রীদের নিয়ে একটি গাড়ি টি দিয়ে ঢুকছে চত্ববে, সে গাড়ির দরজা খোলা, ভেতবে শোনা যাচ্ছে ঝর্নার জলের মতন রমণীদের ছলোচ্ছল হাসির শব্দ।
বিরক্তিতে অম্রেন্দ্রনাথের ভুরু বক্র হয়ে গেল। একটু পরে নিজের ঘরে বসে সে কোচোয়ানকে ডেকে পাঠাল। সে সেলাম করে দাঁড়াতেই অমরেন্দ্রনাথ তার দিকে না তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, রহমত, তুমি মাইনে পাও, এ মাসে তার অর্ধেক পাবে। প্রথম অপরাধের জন্য এই শাস্তি। ফের যদি কোনও দিন গাড়ির দরজা খোলা দেখি, একেবারে দূর করে দেব।
রহমত হাউ হাউ করে বলে উঠল, আমার কোনও দোষ নেই হুজুর, আমি বারবার বলেছি, কিন্তু একটা দিদি কলুটোলায় চুড়ির দোকানে গাড়ি থামিয়ে নামল।
অমরেন্দ্রনাথ বলল, গাড়ি থামাল মানে? গাড়ি কে চালায়?
রহমত বলা, দলজা খুলে দিদি বলল, রোকো, রোকো, তখন আমি কী করি?
–কোন দিদি?
–এই মর্জিনাদিদি তার সঙ্গে আর দুটা দিদিও নামল। দিদিদের হুকুম মানব না, এমন কথা তো আপনি বলেননি হুজুর।
রহমতকে বিদায় করে অমরেন্দ্রনাথ উত্তেজিতভাবে পায়চারি করতে লাগল। বাল্যকাল থেকেই সে জেদি। তার পরিবাবের লোকেরা বারবার তার অনেক জেদ মানতে বাধ্য হয়েছে, আর এখানে, এই থিয়েটারে সবাই তার বেতনভুক কর্মচারী, তারা তার নির্দেশের অবাধ্য হবে? যে-কোনও উপায়ে ওই নয়নমণি নামেব মেয়েটিকে শায়েস্তা করতে হবে। না হলে ওর দেখাদেখি অন্যরাও মাথায় bও বসব।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই যে, নয়নমণিকে যে তাড়িয়ে দেবার ভয় দেখানো যায় না। যে-কোনও মুহূর্তে ও চলে যেতে রাজি। টাকা-পয়সা গ্রাহ্য করে না। ধমক দিলে হাসে। ও কি ভাবে, একে বাদ দিয়ে ক্লাসিক থিয়েটার চলবে না? তারাসুন্দরী নামে মেয়েটিও দুর্দান্ত অভিনয় করে, শুধু গানের গলাটা তেমন সুবেলা নয়, আবও কিছু তালিম দিয়ে ওই তারাসুন্দরীকেই নয়নমণির ওপরে তুলতে হবে।
কিও অপেক্ষা কবাবও ধৈর্য নেই অমরেন্দ্রনাথের। নয়নমণির সঙ্গে আজ কুসুমকুমারী ও স সরোজিনী ছিল, তিন জনেই ডাক পড়ল একটু বাদে।
ঘরে তিন-চারটি চেয়ার আছে, তবু ওদের বসতে বলল না অমরেন্দ্রনাথ। গলার আওয়াজে সমস্ত ব্যক্তিত্ব এনে সে বলল, আজ কলুটোলায় মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে তোমরা নেমেছিলে কেন?
অন্যরা অমরেন্দ্রনাথের সামনে কথা বলতে সাহস পায় না, আড়ালে তারা অমরেন্দ্রনাথের নাম দিয়েছে ধানিলঙ্কা, তারা কনুই দিয়ে ঠেলল নয়নমণিকে।
নয়নমণি বলল, ওখানে একটা বড় চুড়ির দোকান আছে। কত রকম বেলোয়াড়ি চুড়ি, পুঁতির মালা, গলার বালা। আলিবাবা নাটকের ড্রেসের সঙ্গে ওগুলো খুব ভাল যাবে। তাই কিনে আনলাম।
অমরেন্দ্রনাথ বলল, চুড়ি কেনার দরকার, তা বড়ালবাবুকে বললে না কেন? আমাদের প্রোডাকশন থেকে কিনে আনত।
নয়নমণি বলল, পুরুষ মানুষে আবার চুড়ি পছন্দ করতে জানে নাকি? কোন রঙের সঙ্গে কোন রং মানায়, তাই-ই বোঝে না।
—ড্রেসারদের চেয়েও তুমি ভাল বোঝো? তোমাকে অত রং নিয়ে মাথা ঘামাতে কে বলেছে? মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে কোথাও নামতে আমি নিষেধ করেছি না? গাড়ির দরজাই বা কেন খুলে রেখেছিলে?
–দরজা বন্ধ রাখলে হাঁসফাঁস করতে হয়। এত গরম পড়েছে।
–যেতে-আসতে কতক্ষণ লাগে? এইটুকু গরম সহা করতে হবে। মোট কথা দরজা খোলা রাখা চলবে না। মাঝপথে কোথাও নামার কথা কোচোয়ানকে কক্ষণও বলবে না।
–আমরা কি বেনে বাড়ির বউ নাকি?
–চোপ! আবার হাসছ, তোমার এত সাহস! যা বললাম, তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হাবে। যাও!
—এসব কথা চুক্তিতে লেখা ছিল নাকি?
–সব কথা লেখার দরকার হয় না। থিয়েটারের স্বার্থেই এটা করতে হবে।
—একটু বুঝিয়ে বলুন না, অমরবাবু। এতে থিয়েটারের কী স্বার্থ রক্ষা হবে?
—আমি চাই না, স্টেজে ছাড়া আর কোথাও রাস্তার পাঁচপেঁচি লোকেরা তোমাদের দেখুক। থিয়েটারের সময় মেক-আপ দিয়ে তোমাদের চেহারা সব বদলে যায়। লোকে টিকিট কেটে তোমাদের দেখতে আসে। পথেঘাটে তোমাদের মেক-আপ ছাড়া খেদিপেঁচি মুখ যদি লোকে দেখে ফেলে, তা হলে তারা বলবে, ও হরি, এই, এ যে আমাদের ঘরের বউ-ঝিদের মতনই! এদের জন্য শুধুমুদু পয়সা ওড়াতে যাব কেন? তোমাদের নিয়ে কেউ আর স্বপ্ন দেখবে না।
–লোকে কি শুধু চেহারা দেখতে আসে, না অভিনয় দেখতে আসে? আপনিও তো নাটকের হিরো, আপনি কি সব সময় মেক-আপ দিয়ে রাস্তায় ঘোরেন?
–পুরুষ মানুষ আর মেয়েমানুষের কথা এক হল? নয়ন, তর্ক করবে না! থিয়েটারের গাড়িতে দরজা বন্ধ করে আসতে হবে, এই আমার ফাইনাল কথা!
নয়নমণি অন্য দুজনের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, কী রে, তোরা রাজি আছিস? কুসুমকুমারী ও সরোজিনী ফ্যাকাসে মুখে চুপ করে রইল।
নয়নমণি বলল, আমরা কি গুড়ের নাগরি? বন্ধ গাড়িতে অন্ধকারের মধ্যে বসে থাকতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আমার থিয়েটারের গাড়ি দরকার নেই। আমি ভাড়া গাড়িতে আসব, কেমন? এইটুকু আমাকে ছাড় দিন।
অমরেন্দ্রনাথ আবার কিছু বলতে যেতেই নয়নমণি বলল, লোকেরা এখনও আমাদের থিয়েটারের মেয়ে বলে চিনতে পারে না। খেদি-পেচি বলে কেউ তাকিয়েও দেখে না।
এর দুদিন বাদে নয়নমণি বেলা এগারোটার সময় রিহার্সালে এসে দেখল, মঞ্চের সব আলো জ্বেলে দেওয়া হয়েছে, এক কোণে একটি সিংহাসনের মতন চেয়ারে একজন অত্যন্ত রূপবান, অচেনা ব্যক্তি বসে আছে। অতি দামি কোঁচানো ধুতি পরা, পায়ে মখমলের লপেটা, গায়ে ফিনফিনে সাদা কাপড়ের পিরান, গালে কালো দাড়ি, ঘাড় পর্যন্ত এলানো ঘন চুলের বাবরি, দীঘল দুটি চক্ষু, বয়ে হবে ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ। এমন সুদর্শন পুরুষ আগে কখনও দেখেনি নয়নমণি। প্রথমেই তার মনে হয়, নতুন কোনও নায়ক এল নাকি? বাংলার কোনও রঙ্গমঞ্চেই এমন দীর্ঘকায়, স্বাস্থ্যবান, সুপুরুষ নায়ক নেই।
রিহাসাল এখনও শুরু হয়নি, অমরেন্দ্রনাথ খুব খাতির করে কথা বলছে সেই ব্যক্তিটির সঙ্গে। অহংকারী, উগ্র স্বভাব অমরেন্দ্রনাথের মুখে এমন গদগদ ভাব দেখা যায়নি আগে।
নয়নমণি কুসুমকুমারীকে জিজ্ঞেস করল, ইনি কে?
কুসুমকুমারী ঠিক জানে না, সে বলল, শুনছি তো আজ যে পালাটার মহলা হবে, ইনি সেই পালাটা লিখেছেন। মহলা দেখতে এসেছেন।
শুনে নয়নমণি বিস্মিত হল। বাংলার প্রতিটি মঞ্চেই গিরিশবাবুর লেখা নাটকের অভিনয় হয়। নাট্যকার হিসেবে একমাত্র তাঁরই সম্মান আছে। আর যারা খুচরো-খাচরা নাটক দেখে, তারা বিশেষ পাত্তা পায় না। তাদের নাটকের যে-কোনও অংশ যখন-তখন বদলানো হয়।
নয়নমণি অন্যদের কাছ থেকে ক্রমশ জানতে পারল, এই নাট্যকারকে যে এত খাতির করা হচ্ছে, তার মূল কারণ, এর বংশগবিমা। ইনি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সন্তান, এর নাম রবীন্দ্রবাবু। ‘রাজা ও রানী’ নাটকের রিহার্সাল দেখে সন্তুষ্ট হলে তবেই ইনি মঞ্চস্থ করার অনুমতি দেবেন। শুধু নাট্যকার নন, ইনি একজন ভাল গায়ক এবং শখের অভিনেতা হিসেবেও সুনাম আছে। নয়নমণির মনে হল, ইস এই অপরূপ মানুষটির সঙ্গে যদি একবার এক মঞ্চে অভিনয় করার সুযোগ পেতাম! এর দিকে তাকালেই মনে হয়, ইনি সকলের চেয়ে আলাদা।
একটু পরেই রিহার্সাল শুরু হল।
অন্য দিন সবাই পার্ট বলে হবে শুনা চেয়ারগুলির দিকে চেয়ে। আজ রিহার্সাল হচ্ছে রবীন্দ্রবাবুর দিকে ফিরে কেন যেন, অনেকেই আজ বেশি ভুল করতে লাগল। এমনকী অমরেন্দ্রনাথের পর্যন্ত সংলাপে শব্দ বাদ যাচ্ছে। সকলেরই যেন স্নায়ু চঞ্চল। রবীন্দ্রবাবু অবশ্য মাঝপথে কারুকই বাধা দিচ্ছেন না, কোনও মন্তব্য করছেন না, সহাস্য মুখে তাকিয়ে শুনছেন।
নয়নমণি প্রতিদিনই রিহার্সাল শুরু করার আগে একটুক্ষণ নিরালায় বসে তার ঘরের শ্রীকৃষ্ণ মূর্তিটির রূপ মনে এনে চক্ষু বুজে ধ্যান করে। তাতেই তার মানসিক শক্তি ও আত্মবিশ্বাস দৃঢ় হয়, স্মৃতিতে কোনও কুয়াশা হয় না। এক সময়ে অমরেন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করল, রবীন্দ্রবাবু, কেমন লাগছে, ঠিক হচ্ছে কি?
রবি এতক্ষণ স্থির হয়ে বসে ছিলেন, এবার একটু নড়েচড়ে উঠলেন। প্রশ্ন করা না হলে নিজে থেকে কিছু বলবেন না, এটাই বোধ হয় তাঁদের পরিবারের কেত।
তিনি বললেন, এই নাটক কিছুটা গদ্যে লেখা, কিছুটা কবিতায়। গদ্যাংশ ভারী চমৎকার হচ্ছে, খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু কবিতার সংলাপে মাঝে মাঝে বোধ হয় ছন্দের ঝোঁক ঠিক থাকছে না।
অমরেন্দ্রনাথ বলল, সেটা আমিও বুঝি। বাংলা থিয়েটারের আকটর-অ্যাকট্রেসরা এতকাল মাইকেলের অমিত্রাক্ষর কিংবা গিরিশবাবুর ভাঙা পয়ারে অভ্যস্ত। আপনার দূরে নতুন রকম চাটা এখনও ঠিক ধরতে পারছে না।
রবি বললেন, শক্ত তো নয় তেমন। কবিতার সংলাপেও স্বাভাবিক কথা ভাবটা থাকবে, আবার প্রতি পঙক্তিতে আট মাত্রার পর সামান্য বিরতির কথাও মনে রাখতে হবে।
অমরেন্দ্রনাথ বলল, কোথায় কত মাত্রা, সে তো আমিই জানি না। আপনি একটু দেখিয়ে দেবেন? কয়েকটা লাইন যদি পড়ে দেন…
রবি প্রথমে বসে বসেই বললেন, এই যে পঙক্রিটা, এসেছ পাষাণী, দয়া হয়েছে কি মনে? এটাকে তুমি বললে এই ভাবে :
এসেছ
পাষাণী?
দয়া হয়েছে কি মনে?
এটা বরং এভাবে যদি বলা যায়,
এসেছ পাষাণী।
দয়া–
হয়েছে কি মনে?
অর্থাৎ দয়া শব্দটির পর সামান্য টান দিয়ে পরবর্তী ছ’মাত্রায় চলে গেলে ছন্দটা ঠিক বজায় থাকে।
তারপর উঠে দাঁড়িয়ে তিনি নয়নমণিকে বললেন, রানি সুমিত্রা, তুমি আমার সঙ্গে সংলাপ বলল, এইখান থেকে।
আরামে
রয়েছে তারা,
যুদ্ধ ছাড়া কভু
নড়িবে না একপদ
নয়নমণি সঙ্গে সঙ্গে বলল, তবে যুদ্ধ করো।
রবি বললেন, যুদ্ধ করো! হায় নারী, তুমি কি রমণী!
ভালো, যুদ্ধে যাব আমি। কিন্তু তার আগে তু
মি মানে অধীনতা, তুমি দাও ধরা—
ধর্মাধর্ম, আত্মপর, সংসারের কাজ–
সব ছেড়ে হও তুমি আমারি কেবল…
একটু আগে নয়নমণির যে ইচ্ছেটা হয়েছিল, তা আংশিকভাবে সার্থক হল। সত্যিকারের অভিনয় হলেও রিহার্সাল তো দেওয়া হল রবীন্দ্রবাবুর সঙ্গে। কী সুন্দর ভরাট, উচ্চগ্রাম এর কণ্ঠস্বর। রবীন্দ্রবাবু একবার তাঁর কাঁধে হাত ছোঁয়াতেই শরীরটা ঝনঝন করে উঠল। যেন সর্বশ্রেষ্ঠ এক পুৰুষের স্পর্শ।
রবি নয়নমণিকে বললেন, তোমার বেশ ভাল হচ্ছে। উচ্চারণে কোনও ত্রুটি নেই। নয়নমণি নিচু হয়ে রবির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।
ববি তাকে ধরে তুলে, থুতনিতে হাত দিয়ে আশীবাদ করে বললেন, তোমাকে তখন থেকে দেখছি, আর খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে। আগে কোথাও তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল?
নয়নমণি মাথা নাড়ল। এমন একজন মানুষের সঙ্গে আগে দেখা হলে তার মনে থাকবে না, এমন কখনও হতে পারে।
রবি বললেন, মনে হচ্ছে, খুব মনে হচ্ছে। এরকম অভিনয়ের ব্যাপারেই, কোথায়, কোথায়? ওঃ হো, মনে পড়েছে, কটকে। তুমি কটকে কখনও আমার একটি নাটকে অভিনয় করেছিলে?
নয়নমণি আবার মাথা নাড়ল দু’দিকে।
রবি বললেন, তা হলে তুমি নও। কটকে কয়েকটি ছেলেমেয়ে মিলে আমার বাল্মীকি-প্রতিভা শখের অভিনয় করেছিল। সেখানে একটি বেশ গুণী মেয়ে ছিল, তার নাম মহিলামণি। তার সঙ্গে তোমার মুখের গড়নের খুব মিল আছে। বিশেষত একপাশ থেকে দেখলে। সেই মেয়েটি কি তোমার বোন-টোন কিছু হয়? কটকে তোমার আত্মীয়-স্বজন থাকে?
নয়নমণি বলল, না, কটকে আমার আত্মীয়-স্বজন থাকে না যতদুর জানি।
তারপর মুখ নিচু করে মৃদু গলায় বলল, আমার কেউ নেই, কোথাও কেউ নেই।