এখনও ভোর হতে দেরি আছে, গঙ্গার মোহনা দিয়ে প্রবেশ করে একটি জাহাজ ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে কলকাতা বন্দরের দিকে। গঙ্গাবক্ষে আরও প্রচুর স্টিমার, গাদা বোট, নৌকোর ছড়াছড়ি, ইংলন্ড থেকে আসা এই বড় যাত্রীবাহী জাহাজটি উজ্জ্বল সার্চ লাইট ফেলে পথ করে নিচ্ছে। যাত্রী-যাত্রিণীরা প্রায় সকলেই ঘুমন্ত, শুধু মার্গারেট নামে তরুণীটি একলা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে ডেকে।
চতুর্দিক কুয়াশায় ঢাকা, জাহাজের আলোতেও দু তীরের কিছুই দেখা যায় না, মার্গারেট তবু ব্যর্থ চোখে চেয়ে আছে। জানুয়ারির প্রায় শেষ, নদীর ওপর বইছে হিমেল বাতাস। যদিও এই সময়কার ইংল্যান্ডের দুর্দান্ত শীতের তুলনায় কিছুই নয়, তবু এখানকার হাওয়ায় একটা কনকনে ভাব আছে। মার্গারেট গায়ে জড়িয়ে আছে একটা শাল, শীত ছাড়াও এক অজানা আশঙ্কায় কাঁপছে তার বুক। এ দেশটা ঠিক কেমন? পশ্চাতের সমস্ত টান ছিন্ন করে সে চলে এসেছে, সে কি এখানকার মানুষ ও পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে?
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল থেকেই ইংল্যান্ড থেকে জাহাজে চেপে দলে দলে ইংরেজ মেয়েরা এসেছে ভারতবর্ষে, নেমেছে রাজধানী কলকাতায়। তখন চতুর্দিকে রটে গিয়েছিল ভাগ্যান্বেষী ইংরেজরা ভারতে গিয়ে প্রভুত ধনসম্পদের অধিকারী হয়েছে, তাদের বিলাসিতার বিচিত্র সব কাহিনী শুনে তাক লেগে যায়। কারু কারু নিজস্ব দাস-দাসীর সংখ্যা চল্লিশ-পঞ্চাশের বেশি, কিন্তু গৃহে নেই গৃহিণী। কিছু কিছু ইংরেজ শরীরের জ্বালা মেটাবার জন্য দেশীয় রমণীদের রক্ষিতা করে নিত, সিপাহি বিদ্রোহের পর সেটাও কমে যায়, দেশীয় নারী-পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ হয়ে যায়। ঝাঁক ঝাঁক ইংরেজ মেয়ে তখন আসত স্বামী পাকড়াও করার আশায়।
মার্গারেট অবশ্য সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম, যার ওরকম কোনও উদ্দেশ্য নেই, সে আসছে ভারতকে ভালবেসে, এ দেশের মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করার আকাঙক্ষায়।
এ দেশের প্রতি সে আকৃষ্ট হয়েছে স্বামী বিবেকানন্দকে দেখে। তিনিই একমাত্র যোগসূত্র। স্বামীজী লন্ডন ছেড়ে চলে এসেছেন বছর খানেক আগে, তখনও মার্গারেট ভারতে আসার কথা চিন্তা করেনি। স্বামীজি তার ওপর বেদান্ত প্রচার কেন্দ্রের ভার দিয়ে এসেছিলেন। ভারতপ্রেমিক মিস্টার স্টার্ডি এবং স্বামী অভেদানন্দ সহযোগিতা করবেন তার সঙ্গে। প্রথম কিছুদিন কাজ চলছিল ভালই, বেদান্ত সমিতির কাজে সে মনোনিবেশ করেছিল, মাঝে মাঝে স্বামী বিবেকানন্দর স্মৃতি তাকে উতলা করে তুলত। চিঠিপত্রে যোগাযোগ ছিল নিয়মিত। কিন্তু বেদান্ত প্রচার সমিতি চালানো গেল না বেশি দিন। মিস্টাব স্টার্ডির স্বভাব খানিকটা উদ্ধত ধরনের, তাঁর সঙ্গে স্বামী অভেদানন্দের মতবিরোধ ঘটতে লাগল বারবার, একসময় স্বামী অভেদানন্দ ক্ষুণ্ন মনে ইংল্যান্ড ছেড়ে চলে গেলেন আমেরিকায়, মিস্টার স্টার্ডিও আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন। গ্রীষ্মের ছুটিতে বেদান্তচর্চা বন্ধ ছিল, পরে তা আর শুরুই হল না। মার্গারেট একা কী করবে?
স্বামীজির চিঠিতে সে জানতে পারে যে ভারতে কিছু কিছু কাজ শুরু হয়ে গেছে। স্বামীজির গুরুদেব শ্ৰীরামকৃষ্ণের নামে মিশন গড়া হয়েছে, সেবা ও শিক্ষামূলক কাজে স্বামীজি অনেককে প্রবৃত্ত করছেন। মার্গারেট সেই কাজে যোগ দিতে পারে না? ইংল্যান্ডের সমাজের মধ্যে থেকেও নিঃসঙ্গ জীবন আর ভাল লাগে না তার।
কিন্তু স্বামীজি প্রত্যেক চিঠিতে নিরুৎসাই করছেন তাকে। তার ভারতে আসার দরকার নেই। ইংল্যান্ডে থাকলেই তার দ্বারা বেশি কাজ হবে। পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে এবং বক্তৃতা দিয়ে সে বেদান্তের প্রচার করতে পারবে, কলকাতার মিশনের কাজের জন্য কিছু কিছু অর্থ সংগ্রহ করার কাজেও মন দিতে পারে সে। একা একা এ সব কিছুই করতে আর ইচ্ছে করে না মার্গারেটের। সে স্বামীজির কাছাকাছি থেকে যে কোনও কাজে নিযুক্ত হতে চায়। বিশেষত মেয়েদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের ভার তো সে নিতেই পারে।
স্বামীজি কেন বারবার নিষেধ করেছেন তাকে? স্বামীজির ধারণা হয়েছে, ইওরোপিয়ান বা আমেরিকানদের পক্ষে ভারতে এসে দীর্ঘস্থায়ী কোনও গঠনমূলক কাজে আবদ্ধ থাকা সম্ভব নয়। এ দেশে জলবায়ু তাদের সহ্য হবে না, দু তিন মাস বাদ দিলে প্রায় সারা বছরই তো গ্রীষ্ম। এখানকার জাত-পাত, ছোঁয়াছানির কত রকম সমস্যা, তারা বুঝবেই না। শ্বেতাঙ্গ মিশনারিরা অনেকে পাহাড়ে-জঙ্গলে ছড়িয়ে আছে বটে, কিন্তু তারা ভারতকে ভালবাসে না। তারা আসে স্বার্থের কারণে, খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিতদের সংখ্যা বৃদ্ধিই তাদের একমাত্র কাম্য। ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি অনুরক্ত সেভিয়ার দম্পতি আলমোড়ায় একটি আশ্রম খুলেছেন বটে, সেটা ঠাণ্ডা, আরামপ্রদ স্থান, সে আশ্রমের সঙ্গে ভারতের নিপীড়িত মানুষদের কী সম্পর্ক!
আমেরিকা থেকে ওলি বুল আর জো মাকলাউডও ভারতে আসার জন্য ব্যস্ত। তাঁদের কথা আলাদা। তাঁরা স্বামীজির সব রকম কাজে সাহায্য করার জন্য বদ্ধপরিকর, মিশনে ও নতুন মঠ গড়ার জন্য প্রচুর অর্থ দিয়েছেন, তাঁরা এই রহস্যময় দেশটি একবার স্বচক্ষে দেখে যেতে চান। কয়েক মাস থেকে ফিরে যাবেন। এ দেশে ঘোরাফেরার জন্য কত রকম অসুবিধে ভোগ করতে হবে, সে সম্পর্ক সাবধান করে দিলেও স্বামীজি তাঁদের আসতে বারণ করেননি। কিন্তু মার্গারেট যে লন্ডনের সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে চলে আসতে চায়!
স্বামীজি যতই নিবৃত্ত করতে চেয়েছেন, ততই মার্গারেটের জেদ বেড়ে গেছে।
মার্গারেটকে উৎসাহ জুগিয়েছেন মিসেস মুলার। মার্গারেটের যাওয়ার ভাড়া, ভারতে অবস্থানের জন্য টাকাপয়সা যা দরকার, সবই তিনি দেবেন। মিসেস মুলার এর মধ্যেই চলে এসেছেন ভারতে। তিনিও আপাতত রয়েছেন আলমোড়ায়।
স্বামীজি তার আন্তরিকতা ও ঐকান্তিকতার কতখানি মূল্য দেন, সে সম্পর্কে মার্গারেট মাঝে মাঝে ধাঁধায় পড়েছে। ভারতবর্ষ একটি বিশাল দেশ, এই দেশের সামগ্রিক ছবি সম্পর্কে মার্গারেটের ধারণা নেই। এ দেশের ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার কিংবা ইংরেজ শাসনের অব্যবস্থা দূর করার ক্ষমতা তার নেই, সে স্বামী বিবেকানন্দকে দেখে মুগ্ধ হয়েছে, তাঁর কাছাকাছি থেকে, তার নির্দেশমতন নিজের সাধ্য অনুযায়ী কাজ করতে চায়। স্বামীজি যদি তাঁর ইচ্ছার গুরুত্ব না দেন, তা হলে আর ভারতে গিয়ে কী হবে? ইংলন্ডের শুষ্ক জীবনে পড়ে থাকারই বা কী মানে হয়? না, এখানকার চেয়ে তবু একবার সেই অনিশ্চিতের দিকে ঝাঁপ দেওয়াই ভাল।
মিস্টার স্টার্ডি ও মিসেস মুলার স্বামীজিকে জানালেন, মার্গারেট ভারতে যাবার জন্য দৃঢ় সংক্ষল্প নিয়েছে। এঁরা দুজনে সব ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। স্বামীজি এ বার মনোভাব বদলালেন। আসুক মেয়েটি। নারীসমাজের জন্য কাজ করতে পারবে। নারীদের মধ্যে কাজের জন্য একজন নারীরই প্রয়োজন, দুর্ভাগ্যের বিষয় ভারতবর্ষ এখনও সে রকম কোনও মহিয়সী মহিলার জন্ম দিতে পারছে না। তাই অগত্যা অন্য জাতি থেকে ধার করতে হবে। মার্গারেটের সিংহিনীর মতন তেজ এখানকার কাজে লাগাতে হবে।
স্বামীজি তাকে লিখলেন, আসতে চাও, এসো, কিন্তু কয়েকটি ব্যাপার মনে রেখো। সারা বছরই গরম সহ্য করতে হবে, এখানকার শীতও তোমাদের গ্রীষ্মকালের মতন। বড় বড় শহরে দু চারটে হোটেল আছে বটে, শহরের বাইরে কোথাও ইওরোপীয় স্বাচ্ছন্দ্য পাবার উপায় নেই। সর্বত্র নোংরা আর আবর্জনা। এ দেশের মানুষের দুঃখ, দারিদ্র্য, কুসংস্কার ও দাসত্ব যে কী ধরনের, তা তুমি ধারণাও করতে পারবে না। যেখানেই যাবে অর্ধ উলঙ্গ অসংখ্য মানুষ তোমাকে ঘিরে ধরবে। এ দেশের ইংরেজরা এ দেশের মানুষের সঙ্গে মেশে না, ঘৃণা করে। এ দেশের মানুষও কিন্তু ঘৃণা করে ইংরেজদের। তারা ইংরেজদের ছুঁলে অশুচি বোধ করে, ইংরেজদের সঙ্গে বসে খায় না। আমিও হয়তো তোমার সঙ্গে বসে খাব না। তুমি ইচ্ছে করলে এ দেশের ইংরেজদের সঙ্গে মিশতে পারো, তাতে খানিকটা নিজের দেশের পরিবেশ পাবে, তা হলে অবশ্য এ দেশের মানুষদের চিনতেই পারবে না। আর যদি এ দেশের মানুষদের সঙ্গে মেশো, তা হলে ইংরেজরা তোমার গতিবিধি সন্দেহের চক্ষে দেখবে!
এ সব পড়ে মার্গারেট একটুও নিরাশ বোধ করেনি। এ সব বাধা কিছুই নয়। সব বাধাই তার কাছে তুচ্ছ। শারীরিক সুখস্বাচ্ছন্দ্যের ব্যাপার সে গ্রাহ্যই করে না। প্রায় সমগ্র ভারত যে দারিদ্র্য ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে, তা তো সে জানেই। স্বামীজির চিঠির একটা অংশ পড়ে তার রক্ত উচ্ছলিত হয়ে উঠল। এ যে প্রত্যাশার অতিরিক্ত অনেক কিছু।
স্বামীজি লিখেছেন, এ সব জেনে শুনেও তুমি যদি কর্মে প্রবৃত্ত হতে সাহস কর, তবে অবশ্যই তোমাকে শতবার স্বাগত জানাচ্ছি।…কাজে ঝাঁপ দেবার পরে যদি তুমি বিফল হও কিংবা কখনও কর্মে বিরক্তি আসে, তবুও আমার দিক থেকে নিশ্চিত জেনো যে, আমাকে আমরণ তোমার পাশেই পাবে-তা তুমি ভারতবর্ষের জন্য কাজ করো আর নাই করো, বেদান্ত ধর্ম ত্যাগই করো আর ধরে থাক। ‘মরদ কী বাত হাতি কা দাঁত’-একবার বেরুলে আর ভিতরে যায় না; খাঁটি লোকের কথারও তেমনি নড়চড় নেই—এই আমার প্রতিজ্ঞা!
‘আমাকে আমরণ তোমার পাশেই পাবে’, এর চেয়ে আর বেশি কি চাইবার থাকতে পারে। এই বাক্যটি ভরসা করেই মার্গারেট জাহাজে চেপেছে।
জাহাজ এসে লাগছে জেটিতে, ভোঁ বাজছে জোরে জোরে। তীরে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়জনদের অভ্যর্থনা করবার জন্য। মার্গারেট উৎসুক নয়নে সেই ভিড়ের মুখগুলির ওপর চক্ষু বোলাতে লাগল। তার জন্য কি কেউ আসবে? স্বয়ং স্বামীজি আসবেন, এমন প্রত্যাশাই করা যায় না। তিনি কারুকে পাঠালেই বা মার্গারেট চিনবে কী করে?
প্রথমে চেনা সত্যিই খুব শক্ত হল। আরও অনেক ইংরেজ মহিলা নামছে সিঁড়ি দিয়ে, তীরের লোকরা হাতছানি দিচ্ছে, হঠাৎ সে গম্ভীর গলায় ডাক শুনল, মার্গট!
গেরুয়া বস্ত্র লুঙ্গির মতন পরা, গায়ে একটা মোটা চাদর, মুণ্ডিত মস্তক, মুখ ভর্তি কাঁচা পাকা দাড়ি। শুধু গভীর চক্ষু দুটি দেখে চেনা যায়। স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ, কিন্তু এ কী চেহারা হয়েছে তাঁর?
মার্গারেট পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেল, স্বামী বিবেকানন্দ দ্রুত পিছিয়ে গিয়ে বললেন, থাক থাক। তারপর বললেন, এসো, তোমার জন্য গাড়ি রয়েছে।
এক বছর পর দেখা, কোনও উচ্ছ্বাস নেই, কোনও রকম হাস্য-পরিহাস করলেন না। শুধু জিজ্ঞেস করলেন, সমুদ্র পীড়ায় কষ্ট পাওনি তো?
সঙ্গে আর একজন শিষ্য রয়েছে, মার্গারেটের মালপত্র বয়ে নিয়ে তিন জনে উঠলেন অপেক্ষমাণ একটি ঘোড়ার গাড়িতে। মার্গারেট কাতর নয়নে বারবার দেখছে তার আরাধ্য স্বামীজিকে। লন্ডনে স্বামীজির মাথায় প্রচুর চুল ছিল, তার ওপর পাগড়ি পরলে তাঁকে পুরুষ সিংহের মতন দেখাত। ন্যাড়া মাথায় চেহারাটাই যেন সম্পূর্ণ বদলে গেছে। তার ওপর দাড়ি, তাও কাঁচা-পাকা? কতই বা বয়েস ওঁর, বড় জোর চৌতিরিশ-পঁয়তিরিশ, মার্গারেটের চেয়ে মাত্র তিন চার বছরের বড়। মুখের চামড়াতেও শুষ্ক ভাব।
গাড়ি কিছুক্ষণ চলার পর স্বামী বিবেকানন্দ সামান্য হেসে বললেন, বুড়ো হয়ে গেছি, তাই না? গত বছর দার্জিলিং-এ থাকার সময় দাড়ি রাখার শখ হয়েছিল। কেমন, মানিয়েছে না?
মার্গারেট নিঃশব্দে দুদিকে মাথা নাড়ল। এ রকম দাড়ি তার পছন্দ নয়।
স্বামীজি বললেন, বুড়ো সাজলে অনেক সুবিধে পাওয়া যায়। দাড়িতেও বেশ পাক ধরেছে।
গত বছর দেশে ফেরার কিছুদিন পরেই স্বামীজি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সংবর্ধনার প্রাবল্য, অজস্র মানুষের সঙ্গে অবিরাম কথা বলা, মিশনের কাজ, এত ব্যস্ততার মধ্যে বিশ্রামের একটুও সময় ছিল না। হঠাৎ একদিন শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। শরীরে অনেক দিনের ক্লান্তি জমেছিল তো বটেই, চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে বললেন, তাঁকে মারাত্মক বহুমূত্র রোগে ধরেছে। এই রোগের তেমন কোনও চিকিৎসা নেই, ভাত রুটি একেবারে বাদ দিয়ে শুধু মাংস খেতে হবে, জল খাওয়াও যতদূর সম্ভব কম, আর মস্তিষ্কের পরিপূর্ণ বিশ্রাম।
কলকাতার গরমও তাঁর একেবারে সহ্য হচ্ছিল না, তা ছাড়া কলকাতায় অবস্থান করলে লোকজনের সর্বক্ষণ আনাগোনা লেগেই থাকবে। শিষ্য-শুভার্থীদের অনুরোধে তিনি চলে গিয়েছিলেন দার্জিলিং। সেখানকার স্নিগ্ধ বাতাস ও অনুপম প্রাকৃতিক পরিবেশে খানিকটা সুস্থ বোধ করছিলেন, কিন্তু সেখানেও কি একটানা বেশি দিন থাকার উপায় আছে? খেতড়ির রাজা অজিত সিং এর মধ্যে কলকাতায় আসার অভিপ্রায় জানিয়েছেন। মহারানি ভিক্টোরিয়ার রাজত্বের ষাট বৎসর পূর্তি উপলক্ষে বিলেতে মহা সমারোহে এক দরবার হবে, সেখানে ভারতের দেশীয় রাজারা অনুগত ভৃত্যের মতন উপস্থিত হয়ে মহারানির পায়ে নজরানা দেবেন। অজিত সিংও যাচ্ছেন এবং তাঁর ইচ্ছে তাঁর গুরু স্বামী বিবেকানন্দকেও সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার। বিলেত দেশটা অচেনা, সেখানে অনেক রকম আদরকায়দা মানতে হয়, গুরু সব জানেন, গুরু সঙ্গে থাকলে রাজা ভরসা পাবেন। অজিত সিং-এর কোনও অনুরোধ উপেক্ষা করা স্বামী বিবেকানন্দর পক্ষে সম্ভব নয়, প্রধানত এর সদিচ্ছায় এবং আনুকূল্যেই তিনি পাশ্চাত্য বিজয়ে গিয়েছিলেন। বিপদে আপদে অনেকবার ইনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। স্বামীজি ইচ্ছুক হলেও চিকিৎসকরা কিছুতেই রাজি হলেন না, শরীরের যা অবস্থা তাতে সুদীর্ঘ সমুদ্র ভ্রমণের ধকল তিনি সহ্য করতে পারবেন না। কিন্তু যাত্রার আগে অজিত সিংয়ের সঙ্গে দেখাও হবে না? স্বামীজি পাহাড় থেকে নেমে এলেন, অজিত সিংকে ভরসা ও আশীর্বাদ দিয়ে ফিরে গেলেন আবার। দার্জিলিং যাওয়া-আসা সহজসাধ্য নয়, যেটুকু বা শরীরের উন্নতি হয়েছিল, এই পরিশ্রমে তাও মিলিয়ে গিয়ে আবার অবসন্ন ভাব ফিরে এল।
মাস দেড়েক দার্জিলিং-এ কাটিয়ে কলকাতায় ফিরে আসার পরও সুস্থ হলেন না। মে মাসের সাঙ্ঘাতিক গরমে কোনও রকম কর্মে উদ্যম থাকে না, আলমবাজার মঠে হৈ হট্টগোল লেগেই আছে, খুঁটিনাটি ব্যাপারেও সকলে এসে তাঁর মতামত চায়, বাধ্য হয়ে তিনি আবার চলে গেলেন আলমোড়ায়।
এখন এই শীতকালে তিনি বেশ ভাল আছেন, অন্তত সকলকে তাই বলছেন। কাজ তো করতেই হবে। পাহাড়চূড়ায় বসে থাকলে চলবে কেন? নতুন মঠ গড়তে হবে। অনেক কাজ।
ঘোড়ার গাড়িটি গড়ের মাঠ পেরিয়ে চলে এসেছে এসপ্লানেড অঞ্চলে। স্বামীজি মার্গারেটকে বললেন, সাহেবপাড়ায় তোমার জন্য একটা হোটেল ঠিক করা আছে। সেখানে কিছুদিন থাক। এই পরিবেশে নিজেকে খানিকটা সইয়ে নাও। ইতিমধ্যে বাংলা শেখার চেষ্টা করো। আমি তোমার জন্য একজন বাংলার মাস্টার পাঠিয়ে দেব।
হোটেলের ভেতরেও গেলেন না, বাইরে থেকেই বিদায় নিলেন স্বামীজি।
স্নান সেরে, সারা দিন ঘুমিয়ে ও বিশ্রাম নিয়ে বিকেলবেলা বাইরে বেরিয়ে এল মার্গারেট। প্রথমটায় সে বিস্মিতই বোধ করল। আবর্জনা ভরা, পূতিগন্ধময় শহর তো নয়! হোটেলের সামনের প্রশস্ত পথটি বেশ পরিচ্ছন্ন। সুদৃশ্য বড় বড় বাড়িগুলি দেখলে লল্ডন শহরের কথাই মনে পড়ে। ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ ও নগরের হর্মাসারির মাঝখানে যে বিশাল ময়দান, গাছপালায় ভরা, মাঝে মাঝে পুকুর ও সরু সরু পায়ে চলা রাস্তা, এটা যেন হাইড পার্কের মতন।
অর্ধনগ্ন, কালো কালো মানুষেরা কোথায়? এই অঞ্চলে যারা চলাফেরা করে, তারা পরিচ্ছন্ন, সুদৃশ্য পোশাক পরা, অধিকাংশই শ্বেতাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গিনী, কিছু কিছু স্থানীয় মানুষও দেখা যায়, তাদের গাত্রবর্ণ বাদামি বা খয়েরি, পরিধেয় দেখলে মনে হয় বেশ অবস্থাপন্ন। একটু এগিয়ে মার্গারেট দেখতে পায় পথের দু ধারে কত সব মনোহারী দোকান, রকমারি জিনিসপত্রে ঠাসা, লন্ডনেও এ রকম দোকান খুব বেশি নেই।
একটা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে মার্গারেট কাছাকাছি দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখতে যায়। কয়েকজন ইংরেজের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, তারা পথনির্দেশ দেয়, কেউ কেউ সঙ্গেও আসে, ইডেনের বাগান, মিউজিয়াম, এশিয়াটিক সোসাইটি, সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল, বটানিক্যাল গার্ডেন। সবই ইংরেজদের বানানো।
পরপর কয়েক দিন কাটল, স্বামী বিবেকানন্দর সঙ্গে তার আর দেখা হল না। এইভাবে হোটেলেই থাকতে হবে নাকি মার্গারেটকে? সে কি সাহেব পাড়ায় স্বজাতির লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করার জন্য ভারতে এসেছে?
বাংলার একজন মাস্টার আসে প্রতিদিন সকালে, তার কাছে নিবিষ্টভাবে বাংলা ভাষা শিক্ষা করছে মার্গারেট, কিন্তু অন্য সময় তার মন বড় অস্থির হয়ে থাকে।
স্বামী বিবেকানন্দ থাকেন এই চৌরঙ্গি অঞ্চল থেকে অনেক দূরে। গত বস্ত্র ভূমিকম্পে আলমবাজারের মঠ বাড়িটি ধ্বংস হয়ে গেছে, এখন তিনি গঙ্গার অপর পার বেলুড়ে নীলাম্বর মুখুজ্যের একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে আছেন, সেটাই সাময়িক মঠ। কাছেই অনেকখানি জমি কেনার জন্য বায়না দেওয়া হয়ে গেছে, সেখানে তৈরি হবে প্রস্তাবিত বিশাল মঠ ভবন।
মাঝে মাঝে তিনি বাগবাজারে বলরাম বসুর বাড়িতে আসেন। সেখানেই একদিন ডেকে পাঠালেন মার্গারেটকে। সেই দিনই মার্গারেট প্রথম দেখল নেটিভ পাড়া। ঘিঞ্জি ঘিঞ্জি গলি। গা ঘেঁষাঘেঁষি শ্রীহীন বাড়ি, কোথাও পথের পাশে শুয়ে আছে ষাঁড়। আবর্জনার স্তুপের ওপর লড়াই করছে পারিয়া কুকুর। এই সব দেখে মার্গারেট একটু একটু আতঙ্কিত হলেও একটা ব্যাপারে সে আশ্বস্ত হল, সাধারণ মানুষের ব্যবহার বেশ সম্ভ্রমপূর্ণ।
বলরাম বসুর বাড়ির বৈঠকখানায় একটি হুকো হাতে নিয়ে তামাক টানছেন স্বামী বিবেকানন্দ। অন্যদের সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত ছিলেন। মার্গারেটকে প্রবেশ করতে দেখে চোখের ইঙ্গিতে বললেন, বসো।
মার্গারেটের জন্য একটি চেয়ার দেওয়া হল। মার্গারেটের চোখের মণির রং নীল, চুলের রং বাদামি স্বর্ণাভ। সে দীর্ঘাঙ্গিনী, হাতির দাঁতের মতন গায়ের রং, সাদা সিল্কের স্কার্ট-ব্লাউজ পরা। উত্তর কলকাতার কোনও বাঙালি পরিবারে এ রকম একজন বিদেশিনী অতিথির আগমন একটা অভিনব ঘটনা।
স্বামীজি কয়েকটি মামুলি কুশল প্রশ্ন করলেন তাকে। জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাংলা শিক্ষা কেমন চলছে? হোটেলে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?
মার্গারেট বলল, মিসেস মুলার হোটেলে এসেছিলেন। তিনি এখানে একটা বাড়ি ভাড়া করেছেন। আমাকে কাল থেকে সেই বাড়িতে নিয়ে যেতে চান।
স্বামীজি একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। মিসেস মুলারকে তিনি আড়ালে বলেন ‘ক্ষাপতান মাগি’। ইনি বিলেতে থাকার সময় অশেষ উপকার করেছেন, এখানে এসেও টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করছেন অনেক, তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা সত্ত্বেও তাঁর ব্যবহার আর সহ্য করা যাচ্ছে না। এই বাতিকগ্রস্ত মহিলাটি সব ব্যাপারেই কর্তৃত্ব ফলাতে চান, যাকে তাকে হুকুম করেন, ধমক দেন, তাঁর ধারণা টাকা-পয়সা দিয়ে পৃথিবীর সব কিছু কেনা যায়। আর খুব বেশি দিন এর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা যাবে বলে মনে হয় না।
স্বামীজি বললেন, ঠিক আছে, তুমি মিসেস মুলারের সঙ্গে গিয়েই থাকো। হোটেলে অনেক খরচ। তবে, মনে রেখো, এখানে কাজ করতে গেলে মিসেস মুলারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকলে চলবে না। তুমি কতকাল ওঁর ডানার আশ্রয়ে থাকবে? কারুর কারুর সঙ্গে দূর থেকে বন্ধুত্ব করাই ভাল।…যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, তার সবই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়।
মার্গারেট জিজ্ঞেস কবল, আমি কবে থেকে স্কুল শুরু করব?
স্বামীজি বললেন, হবে, হবে, ব্যস্ততার কিছু নেই।
ফেরার পথে মার্গারেট বেশ ক্ষুন্ন বোধ করল। স্বামীজির ব্যবহার এত নিরুত্তাপ কেন? একবারের জন্যও অন্তরঙ্গ সুরে কথা বললেন না! এ দেশের সমাজে প্রকাশ্যে কোনও নারীর সঙ্গে সখ্য দেখানো চলে না? তিনি সন্ন্যাসী ও মার্গারেট বিদেশিনী, এটাও বড় বাধা। কিন্তু তিনি যে চিঠিতে লিখেছিলেন, আমাকে আমরণ তোমার পাশেই পাবে?
কয়েক দিন পরই ওলি বুল ও জোসেফিন ম্যাকলাউড বম্বে থেকে ট্রেনে এসে পৌঁছলেন কলকাতায়। এঁদের অভ্যর্থনা করার জন্য স্বামীজি একদল শিষ্য নিয়ে হাজির হলেন স্টেশনে। এরা অবশ্য আগে থেকেই চিঠিপত্র লিখে নিজেদের সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন। প্রখ্যাত অ্যাটর্নি মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে এঁদের পরিচয় আছে, তিনি যে ভগবদগীতার ইংরিজি অনুবাদ করেছেন, তাও এঁরা পড়েছেন। মোহিনী বাবুই তাঁদের নিয়ে গেলেন সবচেয়ে উৎকৃষ্ট হোটেলে।
দুই মহিলাই বিশেষ ধনবতী। জো ম্যাকলাউড প্রতি মাসে পঞ্চাশ ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন স্বামীজিকে, একসঙ্গে অগ্রিম দিয়েছেন তিনশো ডলার। ওলি বুলও অর্থের ব্যাপারে উদার হস্ত। বেলুড় মঠের জমি কেনার জন্যও অনেক টাকা দিয়েছেন। এরা কিন্তু সাহেব পাড়ায় হোটেলে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ভোগের তোয়াক্কা করলেন না। এরা এসেছেন স্বামী বিবেকানন্দর কর্মপ্রণালী দেখতে, পরদিনই চলে এলেন বেলুড়ে নীলাম্বর মুখুজ্যের বাড়িতে। বাড়িটি বেশ, দু একর জমির মধ্যে রয়েছে বাগান, একটি পুকুর, পাশেই কুলুকুলু প্রবাহিনী গঙ্গা।
ফেব্রুয়ারি মাস, রোদ্দুরে এখনও তেমন উত্তাপ নেই, হু হু করে বইছে বাতাস। বাগানে ফুটে আছে অজস্র ফুল, সেই বাগানে বসে চা পান ও অনেক পুরনো গল্প হল। স্বামীজির শিষ্যরা এই দুই বিদেশিনীকে দুপুরে খিচুড়ি রেঁধে খাওয়ালেন। বিকেলে স্বামীজি বললেন, চল, এবার তোমাদের সেই জমিটা দেখাতে নিয়ে যাই, যেখানে আমরা মঠ বানাব ঠিক করেছি।
জো বিস্মিত হয়ে বলল, আবার জমির দরকার কী? এই বাড়ির চার পাশে কত জায়গা, পরিবেশটাও সুন্দর, এখানেই মঠ বানালে হয় না?
স্বামীজি বললেন, প্রথম থেকেই আমি ছোটখাটো কিছুতে বিশ্বাসী নই। আমি যে মঠের কথা কল্পনা করেছি, সেখানে আমার গুরুভাই ও অন্তরঙ্গ শিষ্যদের বসবাসের সংস্থান রাখতে হবে, ধ্যানের জন্য রাখতে হবে পৃথক স্থান, আমার গুরুর জন্মোৎসবে হাজার হাজার মানুষ যোগ দিতে আসবে, ভবিষ্যতে এটা একটা তীর্থস্থানের মতন হয়ে উঠবে, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। চলো, আমার সঙ্গে গিয়ে দেখলেই বুঝবে।
জোয়ারের সময় নৌকোতেই যাওয়া যায়, কিন্তু এখন ভাটা, কাদার মধ্য দিয়ে পাড়ে ওঠা যাবে না, সুতরাং এখন ওপর দিয়ে হেঁটে যেতেই হবে। প্রায় আধ মাইল দূরত্ব, পথ ঝোপজঙ্গলে ভরা, দুই রমণীর পোশাকে লেগে যাচ্ছে চোরকাঁটা, দু জনেরই প্রতিটি পদক্ষেপ পড়ছে ভয়ে ভয়ে, সাপ খোপ থাকা কিছুই বিচিত্র নয়। এক জায়গায় পার হতে হবে একটা নালা, তার ওপরে নড়বড়ে সাঁকো, সাঁকো মানে শুধু একটা তালগাছের গুড়ি ফেলে রাখা। স্বামীজি ঈষৎ বিব্রতভাবে বললেন, এই রে, এটা কি পার হতে পারবে।
জো বলল, কেন পারব না?
আগেই সে তরতর করে পেরিয়ে চলে গেল। ওলি বুলও ভয় না পেয়ে পার হলেন আস্তে আস্তে। স্বামীজি হাসতে হাসতে বললেন, তোমরা আমেরিকানরা সব বাপারে অদম্য।
ওরা যে সত্যিই কত অদম্য, তা বুঝতে পারা গেল আরও পরে।
বায়না করা জমিটার মাঝখানে একটা ভাঙাচোরা একতলা বাড়ি, তার জানলা-দরজা নেই বলতে গেলে, অনেক দিন সেখানে কেউ বাস করে না, আর চারপাশে ফাঁকা জমির মধ্যে দু চারটে বড় বড় গাছ। সব ঘুরে ফিরে দেখার পর জো বলল, স্বামী, এই বাড়িটা তো খালি, আমরা দুজনে এখানে এসে থাকতে পারি না? তা হলে তোমার কাছাকাছি এসে থাকা হবে।
স্বামীজি বললেন, পাগল নাকি! এটা তো একটা পোড়ো বাড়ি, এখানে কেউ থাকতে পারে নাকি?
জো বলল, কেন পারব না? সব সারিয়ে টারিয়ে ঠিকঠাক করে নেব। জো তাকাল ওলির দিকে, তিনি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। স্বামীজি প্রায় স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এরা বলে কী? বোস্টন এবং নিউ ইয়র্কে তিনি এদের দুজনেরই বিলাসবহুল বাসস্থান দেখেছেন। কলকাতার হোটেলের নিশ্চিত আরাম ছেড়ে এরা এখানে থাকতে চায়!
আমেরিকান জেদ কোনও বাধাই গ্রাহ্য করে না। পরদিনই মিস্ত্রি লেগে গেল, শুরু হল সেই বাড়ির মেরামতির কাজ। নালটার ওপরে বসে গেল মজবুত সাঁকো। দুই রমণী কলকাতার বিভিন্ন দোকান ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করলেন মেহগনি কাঠের আসবাবপত্র। দু জনেই প্রায় প্রত্যেক দিন এসে বাড়ির কাজকর্ম পরিদর্শন করেন, স্বামীজির সঙ্গে অনেক সময় কাটিয়ে যান।
এই সব সংবাদ টুকরো টুকরোভাবে মার্গারেটের কাছে পৌঁছয়। স্বামীজি দুই আমেরিকান নারীকে নিয়ে ব্যস্ত আছেন, তার খোঁজখবর নেবার সময় পান না। শ্রীমতী বুলকে মার্গারেট চেনে না, তবে শুনেছে যে মহিলার বয়েস হবে পঞ্চাশের কাছাকাছি। খুবই স্নেহশীলা, ধীরস্থিরভাবে কথা বলেন। আর জো ম্যাকলাউডকে সে দেখেছে দু-একবার লন্ডনের বক্তৃতা সভায়, চল্লিশের কাছাকাছি বয়েস, বেশ রূপসী এবং সাজগোজ পছন্দ করে খুব। তার সব পোশাক নাকি প্যারিস থেকে তৈরি হয়ে আসে। জো ম্যাকলাউড স্বামীজির কাজে সাহায্য করে বটে, কিন্তু নিজে সে ভক্ত বা শিষ্য হতে চায় না। নিজেকে সে মনে করে স্বামীজির বন্ধু।
অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই বেলুড়ের সেই বাড়িটিতে গৃহপ্রবেশ হল। নতুন রং করায় ঝকঝকে দেখাচ্ছে বাড়িটিকে, ভিতরটা পশ্চিমি ও ভারতীয় রীতির সংমিশ্রণে সাজানো। দু খানা ঘর, বৈঠকখানা, পেছন দিকে রান্নার ব্যবস্থা আছে পর্যন্ত। বাড়ির সামনের ঘাট ধাপে ধাপে নেমে গেছে গঙ্গা পর্যন্ত।
স্বামীজি বললেন, তোমরা বাংলাকে এত ভালবেসে ফেলেছ, তোমাদের আমি এবার বাংলা নাম দিতে চাই। জো মাকলাউড সব সময় প্রাণোচ্ছল, তাই তার নাম রাখা হল জয়া। আর ওলি বুলকে মনে হয় মাতৃসমা, তাঁর নতুন নাম হল ধীরামাতা।
এরা দু’জনে বাড়িটিতে প্রতিষ্ঠিত হবার পর স্বামীজি বললেন, তোমাদের এখানে আর একটি মেয়েকে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানাবে? মেয়েটির নাম মিস মার্গারেট নোবল, সে পিতৃপরিচয়ে আইরিশ, তোমাদের চেয়ে বয়সে অনেকটা ছোট, সে আমাদের কাজে আত্মনিয়োগ করার জন্য চলে এসেছে।
দুজনেই সাগ্রহে সম্মতি জানাল।
উগ্রচণ্ডী মিসেস মুলারের সংস্পর্শ থেকে মার্গারেটকে সরিয়ে আনতেই চাইছিলেন স্বামীজি। তিনি এ বার মার্গারেটকে ডেকে বললেন, তুমি বেলুড়ে ওদের সঙ্গে থাকবে? তোমার ভাল লাগবে। দেখো, মিসেস বুলের বাড়ি যেন আগাগোড়াই ভালবাসা, শুধু ভালবাসা।
বেলুড়ে চলে এসে মার্গারেট সর্বপ্রথম স্বচ্ছন্দ বোধ করল। এমন খোলামেলা পরিবেশ, সামনে এত বড় একটা নদী। নৌকার মাঝিরা গান গাইতে গাইতে যায়, একটা মস্ত ঝাঁকড়া আমগাছে কত রকম পাখি এসে বসে, এ সব দেখলেই মন ভাল হয়ে যায়। আমেরিকান মহিলা দুটির ব্যবহারে কোনও খাদ নেই। ওরা মার্গারেটকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছে।
সবচেয়ে বড় কথা, এখানে প্রতিদিন অনেকক্ষণ স্বামীজির সঙ্গে দেখা হয়। ভোরবেলাতেই স্বামীজি অন্য বাড়িটি থেকে এখানে চা খেতে চলে আসেন। তিনিই ওদের ডেকে জাগান। আমগাছটির তলায় বসে চায়ের আসর। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়। স্বামীজি এক একদিন তাদের রামায়ণ-মহাভারত, এক একদিন ভারতের ইতিহাসের নানান কাহিনী শোনান।
জয়া এবং ধীরামাতার মতন মার্গারেটেরও তো একটা বাংলা নাম দিতে হবে। স্বামীজি মার্গারেটের মুখে একদিন এই অনুরোধ শুনে বললেন, তুমি তো এ দেশের জন্য মন-প্রাণ নিবেদন করে বসে আছ, তোমার আর ফেরা হবে না। তাই তোমার নাম নিবেদিতা।
ওলি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি সত্যিই আর ইংল্যান্ডে ফিরবে না?
নিবেদিতা স্বামীজির দিকে তাকিয়ে বলল, উনি সঙ্গে নিয়ে গেলে যাব। ওকে ছেড়ে আমি আর কোথাও যাব না।