মাস চারেক পর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে বক্তৃতার চুক্তি থেকে কোনওক্রমে মুক্তি পেলেন বিবেকানন্দ, তাঁর কয়েকজন বিশেষ বন্ধুর সহায়তায়। তাঁর শরীর ও মন কিছুতেই আর মানতে পারছিল না। কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি এই চুক্তি বাতিল করার ব্যাপারে মধ্যস্থতা করলেন বটে, কিন্তু বিবেকানন্দকে এ জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হল, যা কিছু অর্থ সঞ্চিত হয়েছিল, তা প্রায় সবই গেল।
তাঁর আহার বাসস্থান সম্পর্কে অনিশ্চয় অবস্থাটা অবশ্য অনেকটাই ঘুচে গেছে। কিছু কিছু শুভার্থী এখন বিবেকানন্দকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিতে চান। কোনও বিখ্যাত ব্যক্তিকে নিজের বাড়িতে আতিথ্য দিয়ে প্রতিবেশীদের কাছে গর্ব করার বাপার এটা নয়। বরং তার বিপরীত। এ এমনই এক সমাজ, যেখানে বিধর্মী বা আশ্বেতকায়দের কোনও বাড়িতে স্থান দিলে প্রতিবেশীরা ঠোঁট বেঁকায়, সে বাড়ির বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের স্কুলের বন্ধুরা যা-তা বলে ক্ষেপায়, ভেংচি কাটে। অবশ্য আমেরিকান সমাজেরই শুধু দোষ দেওয়া যায় না, ভারতীয় হিন্দুরাই কি স্বগৃহে কোনও বিধর্মীকে স্থান দেয়? এ ব্যাপারে তারা আরও গোঁড়া। কোনও আত্মীয়ও যদি ধর্মান্তর গ্রহণ করে, তাকে গৃহ থেকে বিতাড়িত হতে হয়। আমেরিকায় কিছু কিছু লোক এই ধরনের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উল্লাস বোধ করে। মিঃ পামার সেই ধরনের এক ব্যক্তি।
বিবেকানন্দ অশ্বেতকায় তো বটেই, এ দেশের রাস্তাঘাটের বহু মানুষ কালো ও বাদামি রঙের পার্থক্যও বোঝে না। তারা তাঁকে নিগ্রো বলে ভুল করে। ভারতীয়দের সম্পর্কে এদের কোনও ধারণাই নেই এবং নিগ্রোরা এদের চোখে অতি নিম্নস্তরের মানুষ। নিগ্রোরাও বিবেকানন্দকে স্বগোত্রীয় মনে করে। বক্তৃতামঞ্চে আসা-যাওয়ার পথে একদল শ্বেতাঙ্গ যখন বিবেকানন্দকে খাতির করে নিয়ে যায়, নিগ্রোরা তা দেখে কৌতূহল বোধ করে।
একবার বিবেকানন্দ দক্ষিণাঞ্চলের একটি শহরে বক্তৃতা দিতে গেছেন, রেল স্টেশনে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য উদ্যোক্তাদের অনেকে উপস্থিত। একটি নিগ্রো কুন্সি দুর থেকে অবাক হয়ে দেখছিল, এক সময় সে সাহস করে কাছে এসে বলল, মিস্টার, আপনার সম্মানে নিগ্রো সমাজ গর্বিত, আমি একবার আপনার করমর্দন করে ধনী হতে চাই।
বিবেকানন্দ তার হাত চেপে ধরে বললেন, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। আপনি আমার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছেন, এ জন্য আপনাকেই ধন্যবাদ।
অন্যদের কাছ থেকে সরে এসে বিবেকানন্দ সেই কুলিটির সঙ্গে কথাবার্তা বলতে লাগলেন।
সেবারে সেই শহরে থাকার জায়গা নিয়ে বিবেকানন্দকে অনেক ঝঞ্জাট পোহাতে হয়েছিল। দক্ষিণের শ্বেতাঙ্গরা নিগ্রোদের মনুষ্যেতর প্রাণী মনে করে। শুধু গায়ের রঙের জন্য নয়, এরা যে ক্রীতদাস। কোনও ভাল হোটেল-রেস্তোরাঁ বা স্কুল-কলেজে তাদের প্রবেশাধিকার নেই। নিগ্রোরা খ্রিস্টান হলেও তাদের গিজা আলাদা। বিবেকানন্দকেও নিগ্রো মনে করে অনেক হোটেলওয়ালা তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছে। আবার এমনও হয়েছে, কোথাও বক্তৃতার পর সংবাদপত্রে তাঁর ছবি ও প্রশংসা ছাপা হবার পর সেই হোটেলওয়ালা এসে ক্ষমা চেয়েছে তাঁর কাছে।
এক শ্বেতাঙ্গ বন্ধু বলেছিলেন, স্বামীজি, হোটেলে গিয়ে আপনি বলেন না কেন যে আপনি হিন্দু এবং ভারতবাসী, তা হলে ওরা আপনাকে নিগ্রো বলে ভুল করত না!
বিবেকানন্দ আহত বিস্ময়ে বলেছেন, কী, অপরকে ছোট করে আমি বড় হব? আমি তো পৃথিবীতে সে জন্য আসিনি! যার ইচ্ছে আমাকে নিগ্রো মনে করুক, আমার কিছু আসে যায় না।
বিবেকানন্দের বক্তৃতা সভাগুলিতে অবশ্য নিগ্রো শ্রোতাদের দেখা পাওয়া যেত না। ওদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার সুযোগও তিনি পাননি।
ডেট্রয়েট বিবেকানন্দ বারবার প্রতিপক্ষের সম্মুখীন হয়েছেন, অনেকভাবে তাঁকে নাজেহাল করার চেষ্টা হয়েছে। সেই সব দেখেই প্রাক্তন সেনেটর মিস্টার পামার বিবেকানন্দকে খাতির করে নিয়ে গেছেন নিজের গৃহে। তাঁর ভাবখানা এই, আমার বাড়িতে এই হিন্দু সন্ন্যাসী যতদিন ইচ্ছে অতিথি হয়ে থাকবে, দেখি তো কে কী বলে!
পামার মানুষটি বেশ মজার। বয়েস হয়ে গেছে ষাটের ওপর, অঢেল টাকা পয়সার মালিক। তাঁর ব্ল্যাঞ্চ এ অঞ্চলে বিখ্যাত। পারবেন জাতীয় বহু তেজী অশ্ব এবং স্বাস্থ্যবতী জার্সি গাভীগুলি দেখবার মতন। পামার দিলখোলা, মজলিশি মানুষ, বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে মদ্যপানে খুব উৎসাহ, অধ্যাত্ম ব্যাপারে তেমন কিছু আকর্ষণ নেই।
একটা গিজার বক্তৃতায় বিবেকানন্দকে দেখে অনেকটা অভিনবত্বের কারণেই এই বিদেশিটিকে তাঁর বেশ পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। বিশাল বাড়ি, সংলগ্ন উদ্যান, অনেক পরিচারক-পরিচারিকা, বিবেকানন্দর কোনওই অসুবিধে হবার কথা নয়, অসুবিধে শুধু একটাই, প্রায় কখনও নির্জনে থাকার উপায় নেই। পামার নিজে গল্প করতে ভালবাসেন, তা ছাড়া রোজই তাঁর বাড়িতে পার্টি লেগে থাকে। সেই সব খাটিতে খাদ্য ও মদ্য অফুরান। পামার তাঁর যত চেনাগুনো বন্ধুদের ডেকে ডেকে এই তরুণ সন্ন্যাসীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে চান।
একদিন সেরকম এক পার্টিতে এক সাংবাদিক উপস্থিত। সে পামারকে জিজ্ঞেস করল, আপনি নাকি হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করছেন?
পামার বললেন, যদি হিন্দু হই, তাতে তোমার আপত্তি আছে নাকি?
সাংবাদিকটি বলল, না, না, আমি আপত্তি করতে যাব কেন? হিন্দু হলে আপনি কি ভারতবর্ষে চলে যাবেন?
পামার বললেন, তাও যেতে পারি।
সাংবাদিকটি বলল, কিন্তু আপনার যে এই এতগুলো ঘোড়া আর গরু, ওদের একদিনও না দেখে আপনি থাকতে পারেন না, ওদের কী হবে?
পামার বললেন, ওগুলোও সব ভারতে নিয়ে যাব, তাতে কে আটকাবে আমাকে?
এসব যদিও কথার কথা, কিন্তু পরের দিন একটি পত্রিকায় ছাপা হয়ে গেল যে, মিঃ পামার হিন্দুত্ব গ্রহণ করে ভারতে চলে যাচ্ছেন খুব শিগগিরই। তবে তাঁর দুটি শর্ত আছে, তার পারবেন ঘোড়াগুলো জগন্নাথদেবের রথ টানবে, আর তাঁর জার্সি গাভীগুলোকে হিন্দুর গো-মাতা হিসেবে গণ্য। করতে হবে।
এই পামারের বাড়িতে থাকার সময়েই বিবেকানন্দর খাদ্য-পানীয় গ্রহণ সম্পর্কে আরও বদনাম রটে। পামারের বাড়িতে যে-ধরনের খাদ্য পরিবেশিত হয়, তা কোনও সন্ন্যাসীর উপযুক্ত বলে অনেকেই মনে করে না। মদ্যপায়ীরা মাংসের ভক্ত হয়, এবং মাংসও অনেক রকম। বিবেকানন্দ মাছ-মাংস আহার ও ঝাল-মশলা ছাড়েননি। আইসক্রিম ভালবাসেন ছেলেমানুষের মতন।
এসব বদনাম বিবেকানন্দ গ্রাহ্য করেন না, কিন্তু তাঁর অন্য শুভার্থীরা অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। শুধু শুধু বিৰুদ্ধপক্ষীয়দের হাতে এই ধরনের অস্ত্র তুলে দেওয়ার কী দরকার? প্রাক্তন এক গভর্নরের স্ত্রী মিসেস ব্যাগলি বিবেকানন্দকে খুব পছন্দ করেন। এই মহিলারও বয়েস ষাট পেরিয়ে গেছে, নানারকম সামাজিক সেবামূলক কাজের সঙ্গে জড়িত, ধর্ম সম্পর্কে উদার মনোভাবসম্পন্ন। মিসেস ব্যাগলি বিবেকানন্দকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসতে চাইলেন। পামারের তাতে ঘোর আপত্তি।
বিবেকানন্দ পড়লেন মুশকিলে। পামারের আন্তরিকতার কোনও ত্রুটি নেই, বক্তৃতা ব্যবসায়ীর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার ব্যাপারে পামার অনেকটা প্রভাব খাটিয়েছিলেন, কী করে এখন হুট করে চলে যাবেন। দু’পক্ষের টানাহ্যাঁচড়ার মধ্যে কয়েকদিন কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি পামারকেই দুঃখ দিতে বাধ্য হলেন। কোনও মহিলার দাবি তাঁর পক্ষে অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়।
এ দেশের নারীদের স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন বিবেকানন্দ। গোড়া থেকে নারীরাই তাঁকে সাহায্য করেছেন অনেকভাবে। এখনও তাঁর শুভার্থীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যাই বেশি। এঁদের অনেকের সঙ্গে তাঁর মা কিংবা বোনের মতন সম্পর্ক।
শিকাগোয় প্রথম তিনি আশ্রয় পেয়েছিলেন লায়ন পরিবারে। লায়নরা চিনি কলের মালিক ও বিশেষ ধনী। লায়ন-গৃহিণী এবং তাঁর কন্যা, এঁরা দুজনেই বিবেকানন্দর চিন্তায় প্রভাবিত হয়েছিলেন। ধর্ম মহাসভার দিনগুলিতে বিবেকানন্দের দারুণ জনপ্রিয়তার সময়ে অনেক সুন্দরী তরুণী তাঁকে সব সময় ঘিরে থাকত, তা দেখে শ্রীযুক্তা লায়ন উদ্বিগ্ন বোধ করতেন। সন্ন্যাসী হলেও বয়েসটা তত কম, এত যুবতীদের সংস্পর্শে মাথা ঘুরে যাওয়াটা বিচিত্র কিছু নয়। একদিন তিনি আড়ালে ডেকে সাবধান করে দিলেন বিবেকানন্দকে।
বিবেকানন্দ হেসে বললেন, আপনি আমার মায়ের মতন, তাই আমার জন্য ভয় পাচ্ছেন। আমি এক সময় গাছতলায় শুয়ে থেকেছি, কোনও চাষার দেওয়া অম্নে জীবনধারণ করেছি। আবার এ কথাও সত্যি যে, আমিও কখনও কখনও কোনও মহারাজের বাড়িতে অতিথি হয়েছি এবং যুবতী দাসীরা ময়ুর পুচ্ছের ঝালর দেওয়া পাখায় সারারাত আমাকে বাতাস করেছে। সুতরাং প্রলোভনও আমি ঢের দেখেছি, আমাকে নিয়ে ভাবনার কিছু নেই।
এই শিকাগোতেই তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা হয়েছিল হেল পরিবারের সঙ্গে। শ্ৰীযুক্তা হেল প্রকৃতই বিবেকানন্দের মাতৃসমা। এঁর দুই মেয়ে ও এক ছেলে, ছেলেটি কাজের সুত্রে অন্যত্র থাকে। এই পরিবারেই রয়েছে শ্রীযুক্তা হেলের বোনের দুই মেয়ে, এই চারটি যুবতীই বিক্বোনন্দকে খুব ভালবাসে, তিনিও এদের বোন বলে সম্বোধন করেন।
মিশনারিরা এ বাড়িতেও বেনামি চিঠি পাঠিয়ে ভয় দেখিয়েছিলেন, এতগুলি যুবতী মেয়ের সঙ্গে ওই লোকটাকে বাড়িতে ঠাই দেওয়া একেবারেই উচিত নয়, কিছু একটা কেলেঙ্কারি ঘটে যেতে পারে।
শ্রীযুক্তা হেল চিঠিখানা অগ্রাহ্য করে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। এই বাড়িই বিবেকানন্দর স্থায়ী ঠিকানা, এখানে তাঁর কিছু কিছু জিনিসপত্র রাখা থাকে, তিনি অন্য যেখানেই যান, আবার ফিরে এসে এ বাড়িতে ওঠেন। এমনই সহজ ও সাবলীল সম্পর্ক যে, বিবেকানন্দর মাঝে মাঝে মনে হয়, তিনি বোধহয় পূর্ব জন্মে এই পরিবারেরই কেউ ছিলেন।
বস্টনের কাছে কেমব্রিজে থাকেন শ্রীমতী ওলি বুল। ইনি একজন ধনী বিধবা, এঁর স্বামী ছিলেন নরওয়েতে প্রসিদ্ধ বেহালাবাদক। কেমব্রিজের জ্ঞানী-গুণী বুদ্ধিজীবীদের সমাজে প্রৌঢ়া শ্ৰীমতী ওলি বুলের বিশেষ একটি স্থান আছে, প্রায়ই তাঁর বাড়িতে নানা বিদ্বজ্জনের সমাবেশ ঘটে, খানাপিনার সঙ্গে সঙ্গে নানারকম উচ্চাঙ্গের আলোচনা হয়। শ্রীমতী ওলি বুল এখানে ইউরোপীয় প্রথার প্রবর্তন করেছিলেন। ইউরোপে অভিজাত সমাজের নারীরা শুধু সংসার বা তুচ্ছ আমোদ-প্রমোদে মণ্ড থাকেন না, তাঁরা কবি-শিল্পী-বিজ্ঞানীদের পৃষ্ঠপোষক হন, স্বগৃহের আসরে গুণীজনদের মাঝখানে এইসব মহিলারা মধ্যমণি হয়ে থাকেন।
শ্রীমতী ওলি বুলের বৈঠকখানায় বিবেকানন্দ কয়েকবার বক্তৃতা দিয়েছেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও জীবন দর্শনে শ্রীমতী ওলি বুল মুগ্ধ হয়ে যান, এবং বিবেকানন্দকে জানিয়ে দেন, তাঁর বাড়ির দরজা এই হিন্দু সন্ন্যাসীর জন্য সর্বদা উন্মুক্ত, বিবেকানন্দ যখন ইচ্ছে এখানে এসে থাকতে পারেন।
বেসী স্টার্জেস ও জোসেফিন ম্যাকলাউড দুই বোন। এরাও ধনী পরিবারের কন্যা, এদের বাবা-মা তাঁদের সব ছেলে-মেয়েদের নাম রেখেছিলেন বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামে। ইংল্যান্ডের রানির নামে বেসী, আর জোসেফিন ছিল নেপোলিয়ানের স্ত্রীর নাম। বেসীর স্বামী মারা গেছে কিছুদিন আগে, সম্প্রতি নিউ ইয়র্কের ধনী শসা ব্যবসায়ী ফ্রান্সিস লেগেটের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়েছে, লেগেটও বিপত্নীক, সুতরাং দু’জনের বিবাহে বাধা নেই।
বেসীর ছোট বোন জোসেফিন ম্যাকলাউড কাকে বিয়ে করবেন, সে বিষয়ে এখনও মনস্থির করতে পারেনি। সুস্বাস্থ্যের অধিকারিণী ও দারুণ প্রাণোচ্ছল এই রমণীটির পাণিপ্রার্থীর অভাব নেই, জোসেফিন কারুকেই তনু মন সঁপে দিতে পারে না। দু’একজনের সঙ্গে এনগেজমেন্ট হবার পরেও ভেঙে দিয়েছে। সব সময় তার মনে হয়, সংসার, স্বামী, পুত্র কন্যা, সুখ-সম্ভোগ, এসবই কেমন যেন ধরাবাঁধা জীবন, এ ছাড়া কি আর কিছু নেই? যেন আড়ালে রয়েছে অন্য এক জীবন।
বেসীর ডাকনাম বেটি আর জোসেফিনের ডাকনাম জো, এই নামেই তারা বন্ধুমহলে পরিচিত। সমাজের ওপর মহলে এই দুই বোনেরই খুব সমাদর। এরা দুজনেই কিছুদিন ফ্রান্সে কাটিয়ে এসেছে, প্যারিসের শিল্পী, লেখক, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংস্পর্শে এসে সাংস্কৃতিক রুচি উন্নত হয়েছে। আমেরিকানরা ফরাসি সংস্কৃতি ও আদরকায়দাকে সমীহ করে, সুতরাং তাদের চোখে এই দুই বোন অন্যদের চেয়েও বেশি আকর্ষণীয়া।
বেটি আর জো নিয়মিত ছবির প্রদর্শনী দেখতে যায়, কোনও কনসার্ট বা থিয়েটার বাদ দেয় না, বিখ্যাত ব্যক্তিদের বক্তৃতাও শুনতে যায় আগ্রহের সঙ্গে। একদিন ডােরা নামে ওদের বান্ধবী স্বামী বিবেকানন্দ নামে একজন হিন্দু সন্ন্যাসীর বক্তৃতার আসরে নিয়ে গেল। বেটি কিংবা জো আগে এই সন্ন্যাসীর নাম শোনেনি, ছবি দেখেনি, হিন্দু ধর্মটা কী ব্যাপার তাও জানে না। নিউইয়র্কের একটি অনভিজাত পল্লীতে নিতান্তই ঘরোয়া ব্যবস্থাপনা, একটা ভাড়া করা ঘরে কয়েকখানি মাত্তর চেয়ার পাতা, মোট পনেরো কুড়িজনেরও বসার ব্যবস্থা নেই, শ্রোতাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী। দু-তিনজন মাত্র পুরুষ। মনে হয়, কোনও মহিলা সমিতিই উদ্যোগ নিয়েছে। কয়েকজন মেঝেতেই বসে পড়েছে, বাইরের সিঁড়িতে কয়েকজন, দুই বোন কোনওক্রমে ঘরের মধ্যে গিয়ে মাটিতেই বসল।
একটু পরে স্বামী বিবেকানন্দ সে ঘরে ঢুকে দাঁড়ালেন এক কোণে। উজ্জ্বল কমলালেবু রঙের এক আলখাল্লা পরা, মাথায় পাগড়ি, হাত দুটি বুকের ওপর আড়াআড়ি, তাঁর চোখের দৃষ্টিতে কোনও আড়ষ্টতা নেই। জো’র বুকটা ধক করে উঠল। বিদ্যুৎ ঝলকের মতন তার মনে হল, এই লোকটিই তার জীবনে এ পর্যন্ত দেখা শ্রেষ্ঠ মানুষ। জো-র বয়েস সাঁইত্রিশ, এই সন্নাসীর বয়েস বত্রিশ।
বিবেকানন্দ যখন বক্তৃতা শুরু করলেন, জো’র মনে হল এঁর প্রথম বাক্যটি সত্য, দ্বিতীয় বাক্যও সত্য, তৃতীয় বাক্যও সত্য। ইনি সত্যপথভ্রষ্টা।
একটাও বাক্য বিনিময় হল না, তবু জো যেন এক ঘোরের মধ্যে রইল। বাড়িতে ফিরেও সে ঘোর কাটে না। এর পর আবার কোথায় বিবেকানন্দর বক্তৃতা আছে, সে খবর নিয়ে জো দিদিকে বলল, আমি আবার শুনতে যাব।
এরপর পরপর ছ-সাত জায়গায় বক্তৃতা শুনতে গেল ওরা। বেটি বারবার যেতে চায় না। তার অন্য ব্যস্ততাও আছে, কিন্তু জো নাছোড়বান্দা, সে যাবেই। ছোট বোনকে একা ছেড়ে দিতে পারে না, বেটিও সঙ্গে যায়। কোনওবারই এরা বক্তাকে কোনও প্রশ্নও জিজ্ঞেস করে না, আলাপও করতে চায় না। বিবেকানন্দ কয়েকটি জায়গায় এদের দেখার পর মুখ-চেনা হয়ে গেছে, নিজেই একদিন ভদ্রতাবশত এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা বুঝি দুই বোন?
জো মুখ নিচু করে রইল, বেটি বলল, হ্যাঁ।
বিবেকানন্দ আবার জিজ্ঞেস করলেন, অনেক দূর থেকে আসেন বুঝি?
বেটি বলল, খুব বেশি দূর নয়, আমরা থাকি হাডসন নদীর উজানে ডব্স ফেরি নামে একটা জায়গায়, এখান থেকে মাইল তিরিশেক হবে!
বিবেকানন্দ বললেন, সে তো অনেক দূর! বাঃ চমৎকার।
ব্যস, এই পর্যন্ত, আর কিছু না।
জো বিবেকানন্দর সঙ্গে কথা বলে না বটে, কিন্তু বিবেকানন্দর ভাষণের প্রতিটি শব্দ সে মনে গেঁথে নিতে চায়। সব মনে রাখা সম্ভব নয়, বেদান্ত বা ভগবৎ গীতা সম্পর্কে অনেক শব্দই অপরিচিত। জো নিজের পয়সা খরচ করে একজন স্টেনোগ্রাফার নিয়োগ করল, সে ওদের সঙ্গে এসে সব কিছু লিখে নেবে।
মিঃ গুডউইন অতি দক্ষ স্টেনোগ্রাফার, প্রতি মিনিটে দু’শো শব্দ লিখে নিতে পারে, সে আদালতে কাজ কবে, অন্য সময় কারও ব্যক্তিগত কাজে নিযুক্ত হলে অনেক পয়সা নেয়। এক সপ্তাহ কাজ করার পরই গুডউইন বলল, সে এই কাজের জন্য কোনও পয়সা নেবে না। জো জিজ্ঞেস করল, সে কী! কেন? গুডউইন বলল, যদি বিবেকানন্দ নিজের জীবনটাই দান করে দিতে পারেন, তা হলে আমি কি অন্তত এইটুকুও ছাড়তে পারব না?
ফ্রাঙ্ক লেগেট একদিন তাঁর ভাবী স্ত্রী ও হবু শ্যালিকাকে ডিনার খেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ওয়ালডর্ফ হোটেলে। টেবিলে বসে লেগেট লক্ষ করলেন, দুই বোনই কেমন যেন ছটফট করছে আর মাঝে মাঝে পরস্পরের চোখের দিকে তাকাচ্ছে। ঠিক আটটা বাজতেই দু’জনে উঠে দাঁড়াল, বেটি বলল, দুঃখিত, আমরা আর থাকতে পারছি না, আমাদের আর এক জায়গায় যাবার কথা আছে।
ডিনার টেবিল ছেড়ে এইভাবে হঠাৎ উঠে যাওয়াটা অসভ্যতা বলে গণ্য হতে পারে। ফরাসি সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত এই দুই বোনের কাছ থেকে এ রকম ব্যবহার আশা করাই যায় না। লেগেট ভু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাবে, জানতে পারি কি?
বেটি বলল, একজনের বক্তৃতা শুনতে।
লেগেট আরও কৌতূহলী হয়ে বললেন, সেখানে কি আমার পক্ষেও যাওয়া সম্ভব?
বেটি আর জো-র ভয় ছিল, লেগেটের মতন একজন বাস্তববাদী ব্যবসায়ী বোধহয় এক হিন্দু সন্ন্যাসীর মুখে ধর্মকথা শুনতে যাবার মতন ব্যাপার পছন্দ করবেন না। সেই জন্যই আগে যে তারা অনেকবার গিয়েছে, তা বিন্দুবিসর্গ জানায়নি লেগেটকে। সেদিনকার বক্তৃতার স্থানটি ছিল ওয়ালড় হোটেলের প্রায় উল্টোদিকের এক বাড়িতে। বসার জায়গা নেই, দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে লেগেট শুনলেন সম্পূর্ণ বক্তৃতা। দুই বোন বারবার তাকিয়ে দেখছে, লেগেটের মুখে কোনও বিরক্তির রেখা ফুটছে কি না!
অনুষ্ঠান শেষ হবার পর লেগেট এগিয়ে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বিনীতভাবে বিবেকানন্দকে বললেন, আপনি যদি এক সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে ডিনার খেতে আসেন, তা হলে আমি ধন্য হব। আমার কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিতে চাই।
লেগেটের বাড়িতে ডিনার পার্টিতে তাঁর বন্ধু বলতে মাত্র দু’জন আমন্ত্রিত, তাঁর ভাবী স্ত্রী ও শ্যালিকা। সেখানেই বেটি আর জো-র সঙ্গে প্রকৃত পরিচয় হল বিবেকানন্দর। একবার জড়তা কেটে যাবার পর দুই বোন কথার বন্যা বইয়ে দেয়। বিবেকানন্দও হাসি-ঠাট্টা-গল্প-তত্ত্বকথায় অত্যল্প কালের মধ্যেই ওদের অন্তরঙ্গ হয়ে উঠলেন। জো’র ধারণা, বিবেকানন্দকে সে প্রথম যেদিন দেখেছে, সেইদিনই তার নবজন্ম হয়েছে। সে বিবেকানন্দকে আর ছাড়তেই চায় না। এ বাড়িতে ঘন ঘন বিবেকানন্দর ডাক পড়তে লাগল।
এই রকম আরও অনেক রমণীই বিবেকানন্দর ভক্ত হয়ে তাঁকে সাহায্য করতে লাগল নানাভাবে। তাঁর আহার বাসস্থানের চিন্তা আর রইল না।
ব্যবসায়ী কম্পানির সঙ্গে বক্তৃতার চুক্তি ছিন্ন করার পরও বক্তৃতা দেওয়া থেকে নিষ্কৃতি পেলেন না বিবেকানন্দ। অনেকেই তাঁর কথা শুনতে চায়, বন্ধুদেরও ইচ্ছে যত বেশি মানুষের কাছে সম্ভব, তিনি ভারতের আত্মিক সম্পদের কথা প্রচার করুন। তবে এখন আর টিকিট কাটার ব্যবস্থা নেই, শুভার্থীরাই কেউ হল ভাড়া ও অন্যান্য ব্যবস্থা করে। দরজার কাছে একটা বাক্স রাখা থাকে, শ্রোতাদের যার যা ইচ্ছে ওর মধ্যে দিয়ে যায়। তাতেই চলে যায় দৈনন্দিন খরচ।
বিরুদ্ধপক্ষীয়রা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে সমানে, বিবেকানন্দ তা নিয়ে বিচলিত না হলেও, একটা ব্যাপার তাঁর মনকে পীড়া দেয়। প্রথম থেকেই একটা অভিযোগ উঠেছে, বিবেকানন্দ লোকটি প্রকৃতপক্ষে কে? ভারতে ক’জন তাঁকে চেনে? হিন্দু ধর্মের পক্ষ নিয়ে কথা বলার তিনি কতটা অধিকারী? ভারতের কোনও পত্র-পত্রিকাতেও তো তাঁর সম্পর্কে বিশেষ উল্লেখ দেখা যায় না। বিবেকানন্দর যারা ঘনিষ্ঠ, যারা ভক্ত, তাদের মধ্যেও কেউ কেউ এই ব্যাপারটা নিয়ে কখনও কখনও সন্দেহ প্রকাশ করে।
বিবেকানন্দ মাদ্রাজে আলাসিঙ্গাকে বারবার চিঠি লিখে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, তোমরা ওখানে একটা সভা ডেকে আমার কার্যাবলি সম্পর্কে কিছু প্রস্তাব গ্রহণ করে এখানে কিছু সংবাদপত্রে ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে তার অনুলিপি পাঠাও। কলকাতার গুরুভাইদের কাছেও সেই সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ভারতে যে আঠারো মাসে বছর! বিবেকানন্দ চিঠির পর চিঠি লিখছেন, তবু কোনও সাড়াশব্দ নেই। অবশ্য বিবেকানন্দর প্রতি আলাসিঙ্গার আনুগত্য তুলনাহীন। ব্যবস্থাপনায় দেরি হলেও মাদ্রাজে একটি জনসমাবেশে বিবেকানন্দকে সমর্থন জানানো হল। তারপর আরও দুটি সভা হল কুম্ভকোনম ও বাঙ্গালোরে। রামনাদের রাজা এই তরুণ সন্ন্যাসীর কীর্তিকে প্রশংসা করে একটি ব্যক্তিগত চিঠি লিখলেন। খেতড়ির রাজা অজিত সিং স্বামীজির ভক্ত ও বন্ধু, তিনি দরবার ডেকে স্বামীজির আমেরিকা-বিজয়ের কাহিনী ঘোষণা করলেন এবং সকলের সহর্ষ অনুমোদনের কথা জানিয়ে দিলেন বিবেকানন্দকে।
কলকাতাতেও টাউন হলে অনুষ্ঠিত হল বিবেকানন্দর সংবর্ধনা সভা। সভাটি এক হিসেবে অভূতপূর্ব, কারণ এর আগে রাজা-মহারাজা কিংবা ইংরেজ রাজপুরুষদেরই সভা ডেকে সংবর্ধনা জানানো হয়েছে, এক তরুণ সন্ন্যাসীকে এভাবে নাগরিক সংবর্ধনা আগে কখনও জানানো হয়নি। সভাপতিত্ব করলেন রাজা প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়। আরও অনেক রাজা-মহারাজা, জব্যরিস্টার, তর্কবাগীশ-ন্যায়রত্ন, সমাজের মাথা মাথা ব্যক্তিরা উপস্থিত। এদের মধ্যে প্রায় কেউই আগে কখনও বিবেকানন্দ তথা নরেন্দ্রনাথ দত্তের পরিচয় জানতেন না, কিন্তু এ দেশেরই একটি ছেলে সুদূর আমেরিকায় গিয়ে ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতির ধ্বজা উড়িয়েছেন প্রবল বিক্রমে, এই সংবাদ জেনে তাঁরা অভিভূত। খ্রিস্টান বা মুসলমানদের মতন হিন্দুদের কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থা নেই, একক অভিযানে গিয়েছেন বিবেকানন্দ।
যথা সময়ে এই সব সভা-সমিতির সংবাদ আমেরিকায় পৌঁছল। ভারতের সংবাদপত্রে এই সভাগুলির বিবরণ ছাপা হলে জনসাধারণের মধ্যে বিবেকানন্দের কৃতিত্বের কথা প্রচারিত হল। আমেরিকাতেও অনেকে বুঝে গেল, এই মানুষটি ভারতের প্রতিনিধি হবার যোগ্য, সমালোচকদেরও মুখ বন্ধ হল খানিকটা।
ফ্র্যাঙ্ক লেগেটের একটি বাগানবাড়ি আছে নিউ হ্যামপশায়ারে, সেখানে তিনি বেটি আর জো-কে সঙ্গে নিয়ে ছুটি কাটাতে যাবেন কয়েকদিনের জন্য, দুই বোনের ইচ্ছে, স্বামীজিকেও আমন্ত্রণ জানানো হোক।
একটা হ্রদ, তার চতুর্দিকে ঘন সবুজ অরণ্য, পটভূমিকায় পাহাড়ের সারি। সেই স্থানের অপরূপ সৌন্দর্য দেখে মোহিত হয়ে গেলেন বিবেকানন্দ। কাছাকাছি আর কোনও বাড়ি নেই, আর কোনও মানুষজনের দেখা পাওয়া যায় না। এই স্নিগ্ধ নির্জনতায় বিবেকানন্দর ক্লান্ত শরীর ও মস্তিষ্ক বহুদিন পর জুড়িয়ে গেল।
সুদৃশ্য একটি কাঠের দোতলা বাড়ি সমেত এত বড় সম্পত্তি, তবু লেগেট বিনয় করে এর নাম। দিয়েছেন, মাছ ধরার তাঁবু। এখানে এসে লেগেট ব্যবসা ও টাকা পয়সার চিন্তা ভূলে একটা ছিপ নিয়ে হ্রদের ধারে বসে সারাদিন মাছ ধরার চেষ্টায় কাটিয়ে দেন। বিবেকানন্দ দৃই বোনাকে নিয়ে অরণ্যে ঘুরে বেড়ান, কখনও একটা ক্ষুদ্র নৌকো নিয়ে ভেসে পড়েন হ্রদের জলে, তিনি নিজেই দাঁড় বাইতে পারেন, কলকাতায় হেদোর পুকুরে তাঁর নৌকো চালানোর অভিজ্ঞতা এখানে কাজে লেগে যায়। কখনও ওদের তিনি সংস্কৃত গ্রন্থ পাঠ করে শোনান। কিছু না বুঝলেও জো সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ শুনতে ভালবাসে, সেই শব্দ ঝংকার তার
দুই বোন নানা রকম নতুন নতুন বান্না করে বিবেকানন্দকে খাওয়ায়। নারীদের যতের আধিক্যে ইদানীং তিনি বেশ মোটা হয়ে গেছেন, তাঁর ওজন প্রায় দু’মণ। তাঁর উচ্চতা পাঁচ ফুট সাড়ে আট ইঞ্চি, তাই মেদস্ফীতি তেমন বোঝা যায় না।
একদিন সকালবেলা বিবেকানন্দ একখানা বই হাতে নিয়ে নিজের ঘর ছেড়ে বাগানের দিকে যাচ্ছেন, জো জিজ্ঞেস করল, স্বামীজি, কোথায় চললেন? একটু পরেই যে ব্রেকফাস্ট দেবে।
বিবেকানন্দ আঙুল তুলে বললেন, জো, আমি ওই পাইন গাছটার তলায় বসে কিছুক্ষণ গীতা পাঠ করব। ব্রেকফাস্ট তৈরি হলে আমায় ডেকো। আজ অনেক কিছু খাওয়াবে তো?
বিবেকানন্দ গিয়ে বসলেন পাইন গাছটার নীচে, জো চলে গেল রান্নাঘরে তদারকি করতে। একটুক্ষণ গীতা পাঠ করলেন তিনি, তারপর এক সময় মনে হল, এ দেশে কী করছি আমি? কোথা থেকে কোথায় চলে এলাম। সমুদ্র পাড়ি দেবার সময় কত রকম অনিশ্চয়তা ছিল, তারপর এ দেশে এসে যেমন প্রচুর সম্মান, ভালবাসা, স্নেহ, যত্ন পেয়েছি, তেমনি কত বাধা, কত অপমান, কত গ্লানি সইতে হয়েছে। নাপিতের দোকানে পয়সা দিয়ে চুল কাটতে গেছি, তারা ঢুকতে দেয়নি, আবার কত মানুষ অযাচিতভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে সাহায্যের হাত, ঘূর্ণিবায়ুর মতন পার হয়ে এলাম কত শহর-জনপদ। এ দেশের মানুষ বেদান্তের বাণী আগে শোনেইনি, এখন কিছু কিছু নারী-পুরুষ বুঝতে শুরু করেছে, তবু আমি এই যে পাগলের মতন বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছি, এতে সত্যিই কি পরমার্থ সাধিত হবে?
তিনি আরও ভাবতে লাগলেন, এই জীবনের পরিণতি কোথায়! সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসব্রত নিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম পরিব্রাজক হয়েই কাটিয়ে দেব সারাজীবন, কিন্তু এ দেশে এসে বিভিন্ন পরিবারে আশ্রয় গ্রহণ করতে হচ্ছে। মানুষের মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কোন পথে সেই মুক্তি? এ দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা দেখে বারবার মনে পড়ে ভারতের কোটি কোটি নিরন্ন, হতভাগা মানুষের কথা। মনে পড়ে কোন পথে তাদের মুক্তি? ক্ষুধার্ত মানুষের অন্নের ব্যবস্থা না করে তাকে ধর্মকথা শোনানোও পাপ। আমার স্থান এখানে নয়, স্বদেশে। দুঃখী, বঞ্চিত মানুষদের সেবা করাই পরম ধর্ম। শুধু সেবা নয়, সেই মানুষগুলোকে জাগাতে হবে, তারা মানুষ হিসেবে নিজেদের বেঁচে থাকার অধিকার দাবি করবে…
কিছুক্ষণ পর জো বিবেকানন্দকে ডাকতে এসে আতকে উঠল। পাইন গাছে ঠেস দিয়ে একেবারে নিস্পৃন্দের মতন বসে আছেন স্বামীজি। বইখানা পড়ে গেছে হাত থেকে, আলখাল্লার বুকের কাছটা ভিজে গেছে তাঁর চোখের জলে। আরও কাছে গিয়ে জোর মনে হল, স্বামীজির নিশ্বাস পড়ছে না, বুকে কোনও স্পন্দন নেই।
দৌড়ে গিয়ে সে লেগেটকে বলল, স্বামীজি আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বেটি তাই শুনে শুরু করে দিল কান্না। তিনজনে পাইন গাছের কাছে এসে বিবেকানন্দকে একই অবস্থায় দেখতে পেল। সত্যিই মনে হয়, ওই শরীরে প্রাণ নেই। দু হাতে মুখ ঢেকে জো আর বেটি বসে পড়ল মাটিতে। লেগেট বললেন, উনি আমাদের ভাব-সমাধির কথা বলেছিলেন, এটা সে রকম কিছু নয় তো? একবার শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে দেখব?
জো আর্ত চিৎকার করে বলল, না, না!
সে একবার স্বামীজির মুখে শুনেছিল, কারুর ভাব-সমাধি হলে তখন তাকে স্পর্শ করতে নেই!
একটু পরে সেই নিস্পন্দ শরীরে যেন সামান্য প্রাণের লক্ষণ দেখা গেল। নিশ্বাস পড়তে লাগল আস্তে আস্তে। অর্ধ নিমীলিত চক্ষু আর একটু উন্মুক্ত হল। মৃদু, খুবই মৃদু স্বরে তিনি যেন নিজেকেই প্রশ্ন করলেন, আমি কে? আমি কোথায়?
তিনবার এই বকম বলে তিনি আচ্ছন্নের মতন উঠে দাঁড়ালেন। তারপর পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তিনি দেখতে পেলেন সামনে তিনটি পাংশু মুখ।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা অমন করে চেয়ে আছ কেন? কী হয়েছে?
জো কেঁদে উঠে আপ্লুত স্বরে বলল, স্বামীজি। স্বামীজি। আমরা এত ভয় পেয়েছিলাম।
বিবেকানন্দ বললেন, ইস, আমি দুঃখিত। তোমাদের ভয় দেখাতে চাইনি, কিন্তু কী করব, আমার চেতনা মাঝে মাঝেই সীমা ডিঙিয়ে যাচ্ছে। তবে একটা কথা জেনে রাখো, আমি আমার দেহটা এ দেশে ফেলে বেখে যাব না।
একটু থেমে তিনি আবার হেসে বললেন, কই গ্যে, ব্রেকফাস্ট তৈরি হয়েছে? বড় ক্ষিদে পেয়ে গেছে। চলো, চলো, খাবার টেবিলে চলো।