1 of 2

৪৫. তিনজন বিদেশিনীকে নিয়ে অমরনাথ শিখরে

শেষ পর্যন্ত ঠিক হল, তিনজন বিদেশিনীকে নিয়ে অমরনাথ শিখরে যাওয়া বেশ কঠিন, তাতে অনেক গোলযোগের সম্ভাবনা। তা ছাড়া এই মহিলাদের নিরাপত্তা এবং স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করাও সম্ভব না। পথ অতি দুর্গম। ইওরোপ-আমেরিকাতে শৈলচূড়াতেও অনেক আরাম-বিলাসের ব্যবস্থা থাকে, কিন্তু এখানকার এই পথ শুধু তীর্থযাত্রীদের জন্য, এ পথের যাত্রীরা যত বেশি কষ্ট সহ্য করে, ততই পূণ্যফল বাড়ে।

স্বামী বিবেকানন্দ একাই যাবেন ঠিক করলেন। বিদেশিনীরা পথের বিঘ্ন অগ্রাহ্য করেও পর্বতারোহণে আগ্রহী ছিলেন, স্বামীজির কথায় তাদের মধ্যে দুজন নিবৃত্ত হলেও নিবেদিতা জেদ ছাড়লেন না। তিনি যাবেনই। তিনি এ দেশে এসেছেন স্বামীজির প্রেরণায়, স্বামীজির পাশে পাশে থাকতে চান, তাঁর প্রতিটি কর্ম থেকে নিতে চান নতুন নতুন শিক্ষা, তিনি পহলগাও-তে পড়ে থাকবেন কেন? কিন্তু তিনটি রমণীর এক সঙ্গে থাকা, আর একা এক যুবতীর পক্ষে এক সন্ন্যাসীর সঙ্গিনী হওয়ায় অনেক তফাত। লোকে আরও নানারকম কু কথা বলবে। সাধুদের দল আপত্তি তুলতে পারে। একমাত্র নাগা সম্প্রদায় ছাড়া অন্য সাধু-সন্ন্যাসীর এখনও বিবেকানন্দর সঙ্গে এই বিধর্মী রমণীদের উপস্থিতি মেনে নিতে পারেনি।

নিবেদিতা কোনও যুক্তি মানবেন না। তিনি চোখ ছলছল করে বসে রইলেন।

তাঁবুর বাইরে আগুন জ্বালানো হয়েছে, সেই আগুন ঘিরে বসেছেন সবাই। অন্য সব তাঁবুগুলি নীচের দিকে, সেখানেও সাধুরা ধুনি জ্বালিয়ে গান গাইছে, এখান থেকে দেখা যায় সেই সব আগুনের মালা, শোনা যায় খোল-করতালের ধ্বনি। কাল ভোরে যাত্রা শুরু হবে। স্বামীজি একটা চুরুট টানতে টানতে নিবেদিতাকে অনেকক্ষণ ভাল বোঝাবার চেষ্টা করলেন, তারপর এক সময় অধৈর্যভাবে বললেন, লোকনিন্দার কথা না হয় অগ্রাহ্য করা গেল, তুমি এই পাহাড়ি পথে উঠতে পারবে? বারো-চোদ্দো হাজার ফুট উঁচুতে আগে উঠেছ কখনও? তোমাদের দেশে তো এত উঁচু পাহাড়ই নেই।

নিবেদিতা বললেন, আমি আগে যা যা করিনি বা পারিনি, এখন সে রকম অনেক কিছু পারার জন্য প্রস্তুত হয়েছি।

স্বামীজি বললেন, তোমার পায়ে এই তো শোখিন জুতো। এই জুতো পরে বরফের ওপর দিয়ে হাঁটা যায়? খালি পায়ে চলার তো তোমাদের অভ্যেস নেই।

নিবেদিতা বললেন, দরকার হলে খালি পায়ে যাব।

জো ম্যাকুলাউড নিবেদিতার সব ব্যাপারেই প্রশ্রয় দিতে চান। তিনি বললেন, স্বামীজি, কয়েক দিন আগেও আপনার শরীর অসুস্থ ছিল। আপনি যদি এই হিমগিরিতে উঠতে পারেন, তা হলে ও পারবে না কেন? আপনার সেবার জন্যও তো একজন কারুর সঙ্গে যাওয়া দরকার।

স্বামীজি গম্ভীরভাবে বললেন, সন্ন্যাসীদের কারুর সেবার প্রয়োজন হয় না।

জো মাকলাউড বললেন, কিন্তু এখানে কয়েকজন বড় বড় সাধুকে যে দেখলাম, শিষ্যদের দিয়ে পা টেপাচ্ছেন, তামাক সাজাচ্ছেন!

এই সময় নিবেদিতার সমর্থনে আর একজন এগিয়ে এল। এই লোকটির নাম শেখ শহীদুল্লা, সরকারের পক্ষ থেকে তীর্থযাত্রীদের সব রকম ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তার ওপর। এখানে ইংরেজি জানা লোক পাওয়া দুষ্কর, শহীদুল্লা গড়গড় করে ইংরেজি বলতে পারে। এই কয়েক দিনে তার সঙ্গে এই তিন বিদেশিনীর বেশ ভাব হয়ে গেছে। বছর ত্রিশেক বয়েস, সে অতি সুদর্শন ও সপ্রতিভ যুবক। আগামীকাল সে পুরো দলটির ছড়িদার হিসেবে যাবে।

শহীদুল্লা বিনীতভাবে বলল, বিবেকানন্দজি, আপনি এত আপত্তি করছেন কেন? এই মেমসাহেব চলুক না আমাদের সঙ্গে। কত দূরদেশ থেকে এসেছেন, আমাদের এই তীর্থস্থান দর্শন করতে চান, এ তো আমাদের পক্ষে আনন্দের কথা। ওঁর কোনও অসুবিধে হবে না। আমরা দেখাশুনা করব। বিবেকানন্দ জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ওর দায়িত্ব নিতে পারবে?

শহীদুল্লা বলল, অবশ্যই।

বিবেকানন্দ নিবেদিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, মনে থাকে যেন, তুমি সর্বসময় আমার দেখা পাবে। না। এই শহীদুল্লার ওপরেই তোমাকে নির্ভর করতে হবে।

জো ম্যাকলাউড নিবেদিতার দিকে নিজের রুমালটি এগিয়ে দিয়ে বলল, চোখ মুছে ফেল, মার্গারেট, শেষ পর্যন্ত তোমার সঙ্কল্পেরই জয় হল।

অশ্রুসজ্জল নেত্রেই এবার হাসলেন নিবেদিতা। তার মুখখানি যেন শিশির ভেজা ফুল্ল কুসুম।

শ্রীমতি প্যাটারসন আগেই ফিরে গেছেন, অপর দুই মার্কিনি মহিলা থাকবেন কোথায়? অমরনাথ শিখর থেকে ফিরে আসতে অন্তত ছ-সাতদিন লাগবে। বিবেকানন্দ প্রস্তাব করলেন, এদের শ্রীনগরেই ফিরে যাওয়া উচিত, সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করুন।

ওঁরা দুজনেই বললেন, তা কখনও হয়? আপনারা ওই বিপুলসঙ্কুল পথে যাবেন, আর আমরা শ্রীনগর শহরে গিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকব? আমি এই তাবুতেই থেকে যাব, আপনারা পাহাড় থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে আপনাদের অভ্যর্থনা জানাব।

কিন্তু কাল সকালে তীর্থযাত্রীরা সবাই চলে গেলে এই পহলগাঁও যে একেবারে ফাঁকা হয়ে যাবে। দুজন বিদেশিনী শুধু এখানে থাকবেন কী করে!

জো ম্যাকলাউড জোর দিয়ে বললেন, এই ফাঁকা জায়গাতেই তাদের থাকতে ভাল লাগবে। ভয়ের কী আছে?

পরদিন ভোরবেলা স্নান করে শুদ্ধ হয়ে শুরু হল যাত্রা। যাত্রীদের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। ছড়িদার শহীদুল্লার সঙ্গে জনা দশেক কর্মচারী। নিবেদিতার তাঁবু আর মালপত্র বহন করে নিয়ে যাবার জন্য নিযুক্ত হল তিনজন ভৃত্য। পথের ধারে দাঁড়িয়ে আছে, দ্বারিকা, তাকে দেখে বিবেকানন্দ কৌতূহলী চোখে তাকাতেই সে বলল, ভাই নরেন, আমার আর অমরনাথ দর্শন হল না। সঙ্গে স্ত্রীকে এনেছি, সে ভয় পাচ্ছে, তাঁর মাথা ঘুরে যাবে, কিংবা কিছু একটা হবে। তাকে ফেলে তো আর যেতে পারি না।

বিবেকানন্দ কিছু না বলে হাসলেন। সাংসারিক লোকের বন্ধন। যাদের নিজেদের মনের জোর নেই, তারাও মা-ছেলের নামে দোষ দেয়।

নিবেদিতা আর বিবেকানন্দ রয়েছেন যাত্রী দলের প্রায় শেষের দিকে। কিছুক্ষণ চলার পরেই নিবেদিতা দেখলেন, স্বামীজি তার পাশে নেই। কিছু না বলেই এগিয়ে গেছেন। একটা বাঁক ঘোরার মুখে তার চোখে পড়ল, উপরের পাকদণ্ডিতে একদল সাধুর মাঝখানে রয়েছেন বিবেকানন, তিনি ওদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে দু হাত তুলে আওয়াজ তুলছেন, হর হর বোম বোম।

প্রথম বিশ্রামস্থল চন্দনবাড়ি, সেখানে পৌঁছবার আগেই বৃষ্টি নামল। সেই সঙ্গে ঝোড়ো বাতাস। পহলগাঁওতে ঠাণ্ডা বিশেষ ছিল না, এটুকু পথ উঠতেই শীতের কাপুনি লেগে গেল। মালবাহকেরা নিবেদিতার মাথার ওপর বড় ছাতা মেলে ধরেছে, নিবেদিতা দেখার চেষ্টা করলেন স্বামীজি বৃষ্টিতে ভিজছেন কি না। তাকে দেখা গেল না। অধিকাংশ যাত্রীই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই মহানন্দে লাফাতে লাফাতে চলেছে।

চন্দনবাড়ি উপত্যকায় তাঁবু ফেলতে হবে, তখনও বিবেকানন্দ দেখা নেই। শহীদুল্লা হন্তদন্ত হয়ে এসে বল, কোনও চিন্তা করবেন না, আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। মিস নোবল, অন্য সব তাঁবুর চেয়ে আপনার তাবু একটু দূরে রাখাই ভাল। তাতে আপনার কেউ ব্যাঘাত ঘটাবে না।

শহীদুল্লার নির্দেশে বেশ সুচারুভাবে তাঁবু প্রতিষ্ঠিত হল। তার পেছন দিকেই পাহাড়ের পর পাহাড়। ফাঁক দিয়ে দেখা যায় সন্ধ্যার আকাশ, কয়েক দিন পরই রাখিপূর্ণিমা, বৃষ্টি থেমে গিয়ে এখন ঝলমল করছে, জ্যোৎস্না।

পোশাক বদল করে নিবেদিতা অধীরভাবে অপেক্ষা করতে লাগলেন। তিনি একবারও আসবেন না? কিছুক্ষণ সঙ্গ দেবেন না? নিবেদিতা কী দোষ করেছেন। শুধু নারী হওয়াই কি তাঁর অপরাধ?

তাবুর মধ্যে বসে থাকা অসহ্য বোধ হল। নিবেদিতা বেরিয়ে এলেন। দূরের তাঁবুগুলো থেকে একটা কোলাহল ভেসে আসছে। কিছু কিছু দোকানপাটও বসে গেছে এর মধ্যে। এই দোকানিরাও সঙ্গে সঙ্গে যায়। ভিখারি ও চোর-জোচ্চোরও কিছু মিশে থাকে, শহীদুল্লা আগেই সে ব্যাপারে সাবধান করে দিয়ে গেছে।

নিবেদিতা ভাবলেন, তিনি অন্য যাত্রীদের থেকে সবসময় দুরত্ব বজায় রাখবেন কেন? সবসময় কেন মনে রাখতে হবে যে তিনি বিদেশিনী, শ্বেতাঙ্গিনী। সাধারণ মানুষের সঙ্গে না মিশলে কী করে তিনি ভারতাত্মার সন্ধান পাবেন?

বাজার উজাড় করে জো মাকলাউড অনেক রকম ফল আর প্রচুর চিড়ে, খই, গুড় কিনে নিবেদিতার সঙ্গে দিয়ে দিয়েছেন। একটা ঝোলায় করে সেই সব কিছু কিছু নিয়ে একজন ভৃত্যের সঙ্গে তিনি এগিয়ে গেলেন অন্য তাঁবুগুলোর দিকে। প্রথম একটি তাঁবুতে একজন বড় দরের সাধুকে ঘিরে তাঁর চেলারা বসে গান গাইছে। সাধু মহারাজ তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে আছেন পা ছড়িয়ে, পিঠের ওপর কম্বল চাপা দেওয়া থাকলেও তাঁর পায়ের ঊরু পর্যন্ত উন্মুক্ত, সেখানে গরম তেল মালিশ করছে একজন অল্পবয়েসী শিষ্য। নিবেদিতাকে সেখানে এসে দাঁড়াতে দেখে সবাই হঠাৎ চুপ করে গেল।

নিবেদিতা বাংলা ও সংস্কৃত কিছুটা শিখলেও হিন্দি একেবারেই জানেন না। ভাঙা-ভাঙা বাংলা-সংস্কৃত মিলিয়ে বললেন, আমি মাননীয় সন্ন্যাসীকে পাদ্যার্ঘ দিতে এসেছি, তিনি গ্রহণ করলে ধন্য হব।

সবাই নিস্তব্ধ, সালুটি নিবেদিতার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ছিলিম টানতে লাগলেন।

নিবেদিতা এগিয়ে এসে ফলাহার সমেত একটি পাত্র রাখলেন সাধুর পায়ের কাছে। তারপর হাঁটু গেড়ে বসে ভক্তিনম্র ভঙ্গিতে মাটিতে মাথা ছুঁইয়ে প্রণাম করলেন।

সাধু ও তাঁর শিষ্যগণ কখনও কোনও মেমসাহেবকে এমন অবস্থায় দেখেননি। রাজার জাতের রমণী হয়েও মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে জানে! সাধুটি আর দ্বিধা করলেন না, নিবেদিতার মাথার কিছুটা পরে হাত রেখে আশীর্বাদ জানালেন।

এইভাবে পরপর কয়েকটি সাধুর শিবিরে গিয়ে অর্ঘ্য নিবেদন করলেন নিবেদিতা। তিনি যে শুধু এক বিলেত ফেরত সন্ন্যাসীর সঙ্গে হুজুগে মেতে আসেননি, সমস্ত সাধু-সন্ন্যাসীদের প্রতিই তার শ্রদ্ধা আছে, এই ধারণাটা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে। নিবেদিতা অনেকেরই মন জয় করে নিলেন। কিন্তু যিনি তাঁর হৃদয়ের রাজা, তিনি দূরে দূরেই থাকবেন।

তাঁবুতে ফিরে আসার পর নিঃসঙ্গতা যেন তাকে আবার পেয়ে বসল। ভারতের মাটিতে পা দেবার পর প্রথম কয়েকটি দিন হোটেলে থাকতে হয়েছিল, তারপর থেকে ওলি বুল ও জো ম্যাকলাউডের সঙ্গে সঙ্গে রয়েছেন, দুজনেই তাঁকে খুব স্নেহ করেন, বিশেষত জোর সঙ্গে এমনই একটা নিবিড় সম্পৰ্ক হয়েছে যে সমস্ত সুখ দুঃখের কথা তাঁকে বলা যায়। এত দিনের ভ্রমণে আজই প্রথম নিবেদিতাকে সম্পূর্ণ একাকী থাকতে হবে।

হঠাৎ বিবেকানন্দ সেই তাঁবুতে প্রবেশ করলেন, তাঁর হাতে জপের মালা। ভেতরে এসে তিনি তাঁবুর চারপাশটা দেখলেন, একজন ভৃত্যকে ডেকে বললেন, ওরে, এই কোণে ফাঁক হয়ে রয়েছে কেন, এখান দিয়ে যে ঠাণ্ডা হওয়া ঢুকবে। টেনে বেঁধে দে এক্ষুনি। বোতলে গরম জল ভরে দিদিমণিকে কম্বলের মধ্যে দিবি।

মালা জপ করতে করতে বিবেকানন্দ কাজকর্মের তদারক করলেন। তারপর নিবেদিতার দিকে ফিরে বললেন, তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়। কাল আবার ভোরে বেরুতে হবে।

বড় জোর মিনিট পাঁচেকের জন্য অবস্থান। নিবেদিতাকে তিনি একটা কথা বলার সুযোগ দিলেন না।

এরপর কি সহজে ঘুম আসে? চোখে জল এসে যায় বারবার। এই যে ইচ্ছাকৃত ব্যবধান রচনা, এ তো অবহেলারই নামান্তর। স্বামীজি কি তাকে কষ্ট দিয়ে দিয়ে পরীক্ষা করতে চান? অন্ধকার তাবুর মধ্যে শুয়ে থেকে নিবেদিতা মনে মনে বললেন, ঠিক আছে, আমি দেখতে চাই, উনি আমাকে কত কষ্ট দিতে পারেন?

নিবেদিতা খুব আশা করেছিলেন সকালবেলা যাত্রা শুরু করার আগে বিবেকানন্দ নিশ্চয়ই একবার আসবেন। তিনি এলেন না। নিবেদিতা ভোর থেকেই তৈরি হয়ে বসেছিলেন প্রতীক্ষায়। মালবাহকরা বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল, তাবু গোটাব? সব জিনিসপত্র বার করে নেব? নিবেদিতা বলছিলেন, একটু পরে, একটু পরে।

শহীদুল্লা এক সময় এসে বলল, এ কী, এখনও গুছিয়ে নেননি! অনেকে যে এরই মধ্যে এগিয়ে পড়ছে।

নিবেদিতা আর কিছু বললেন না। শহীদুল্লার নির্দেশে দ্রুত সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। শহীদুল্লা বলল, মিস নোবল, ব্রেকফাস্ট করে নিয়েছেন তো? পথে আর সময় পাবেন না।

নিবেদিতা মাথা নেড়ে বললেন, ঠিক আছে।

কাল রাত্তিরেও কিন্তু খাননি, আজ সকালে তাঁর কিছু খাওয়ার ইচ্ছে হয়নি। স্বামীজি কী খাচ্ছেন, কোথায় বসে, কাদের সঙ্গে? নিবেদিতা ঠিক করেছেন, স্বামীজি নিজে এসে না বললে তিনি এই পুরো যাত্রাপথে কিছুই খাবেন না।

বেশ চড়া রোদ উঠেছে, তুষারমণ্ডিত পাহাড়ে যেন সেই রোদ ঠিকরে পড়ে। কাল সন্ধেবেলা এই উপত্যকা একটা অস্থায়ী নগরীর রূপ নিয়েছিল, সেই দোকানপাটের আর একটুও চিহ্ন নেই। কত তাঁবু ছিল। এখন সব ফাঁকা। পড়ে আছে কিছু শুকনো শালপাতা, কিছু উচ্ছিষ্টের ভগ্নাংশ। যাত্রীর দল চলেছে এঁকে বেঁকে, যেন সুবৃহৎ, এক সরীসৃপ।

বিষণ্ণ মনে মাটির দিকে চেয়ে চেয়ে পথ চলছেন নিবেদিতা। হঠাৎ জলদমন্দ্রে ডাক শুনলেন, মার্গট!

চমকে মুখ তুলে নিবেদিতা দেখলেন, একটা বড় পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বিবেকানন্দ, চোখাচোখি হতেই তিনি স্মিতহাস্যে বললেন, গুড মর্নিং। কাল রাতে ভাল ঘুম হয়েছিল?

নিবেদিতা মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি ভাল করে ঘুমিয়েছিলেন?

বিবেকানন্দ বললেন, কতক্ষণে অমরনাথের দর্শন হবে, এই বাসনায় আমি ছটফট করছি। এই অবস্থায় কি ঘুমোনো যায়? আর কোনও তীর্থস্থান সম্পর্কে আমার এমন উতলা ভাব হয়নি। শোনো, আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি একটা কারণে। সামনের পথটা দেখ–

পথটা ঢালু হয়ে কিছুটা নেমে গেছে, তারপর অনেকখানি তুষারাবৃত, একটা বরফের নদী বলে মনে হয়। কিছু কিছু যাত্রী এর ওপর দিয়ে যেতে গিয়ে আছাড় খাচ্ছে, কেউ কেউ যাচ্ছে হামাগুড়ি দিয়ে।

বিবেকানন্দ বললেন, ওই দেখো, এক বুড়ি কেমন দিব্যি খালি পায়ে এই বরফের উপর দিয়ে হেঁটে চলেছে। আমি চাই, তুমিও এই পথটুকু খালি পায়ে হেঁটে পার হও। তুমি সকলের সমান হও। তোমার কষ্ট হবে খুব জানি, কোনওদিন অভ্যেস নেই, তবু—

নিবেদিতা নিচু হয়ে পা থেকে জুতো খুলে ফেলে ছুড়ে দিলেন দূরে। তারপর বললেন, আমি আর জুতো পরবই না।

বিবেকানন্দ বললেন, আমি তা বলিনি। অন্য সময় পরতে পারো। শুধু এই পথটা।

নিবেদিতা দৃঢ়ভাবে বললেন, আমি আর জুতো পরতে চাই না।

বিবেকানন্দ একজন মালবাহককে জুতো জোড়া তুলে নেবার ইঙ্গিত করে সেই বরফের নদীতে পা দিলেন।

হঠাৎ নিবেদিতার মনটা ভাল হয়ে গেল। বাচ্চা বয়সে বরফ নিয়ে কত খেলা করেছেন। এটাও যেন খেলা। বরফের মধ্যে পড়ে গেলেও তো ক্ষতি নেই, ব্যথা লাগে না। যারা আছাড় খাচ্ছে, তারাও মহানন্দে হো হো করে হাসছে।

বিবেকানন্দর হাতে রয়েছে একটা লম্বা লাঠি, নিবেদিতার কিছুই নেই, তবু তিনি বেশ সাবলীলভাবে হাঁটতে লাগলেন। বরফ কোথাও ঝুরো ঝুরো, কোথাও পাথরের মতন শক্ত এই পিচ্ছিল। ব্যালে নর্তকীর মতন দু’হাত দুদিকে ছড়িয়ে নিবেদিতা লঘু পায়ে এগোচ্ছেন, বিবেকানন্দ জিজ্ঞেস করলেন, বাঃ, তুমি বেশ পেরে যাচ্ছ তো! পায়ে লাগছে না?

নিবেদিতা বললেন, মাত্র কয়েকটা শতাব্দী আগে আমরা সবাই তো খালি পায়েই হাটতাম!

বিবেকানন্দ প্রথম যে বৃদ্ধাকে দেখিয়েছিলেন, সেই বৃদ্ধাটি মাঝপথ পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়ে পড়েছেন, মুখখানা ভয়ে ফাঁকাসে হয়ে গেছে। নিবেদিতা জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি ওর হাত ধরব? আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি।

বিবেকানন্দ বললেন, হঠাৎ করে কারুকে ধরতে যেয়ো না। ছোওয়া-ছুয়ির ব্যাপার আছে। কখনও সে রকম হলে আগে জিজ্ঞাস করে নেবে। এ বুড়ি মাগি নিজেই পেরে যাবে মনে হয়, এখন একটু দম নিচ্ছে।

খানিক বাদে নিবেদিতার মনে হল, এই বরফের নদীটা অনেক চওড়া, কিংবা অন্তহীন হল না কেন? ততক্ষণ স্বামীজি তাঁর সঙ্গে থাকতেন। বরফ শেষ হবার পর আবার খাড়াই পাহাড়ি পথ। বিবেকানন্দ আর কিছু না বলে হনহনিয়ে এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে।

এর পর স্বামীজি সারা দিনে দুবার মাত্র অল্প সময়ের জনা দেখা করে গেলেন নিবেদিতার সঙ্গে। বেশির ভাগ সময়টাই কাটালেন অন্য সাধুদের সঙ্গে। প্রচুর কষ্টসাধ্য চড়াই পথ ভেঙে সন্ধেবেলা নিবেদিতা পৌঁছলেন বারো হাজার ফুট উচ্চে, ওয়াবজান নামক এক স্থানে। খটাখট শব্দে তাঁবু খাটানো চলতে লাগল। আজ সকলেই খুব ক্লান্ত। নিবেদিতা কোথাও বিবেকানন্দকে খুঁজে পেলেন না। তাঁর খালি আশঙ্কা হয়, স্বামীজি এত ধকল সহ্য করতে পারবেন তো? কিছুদিন আগেও মাঝে মাঝেই উনি অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। কিন্তু এই পথে স্বামীজি তাকে সেবা করার সুযোগ দিতে চান না।

সন্ধেবেলা কিংবা রাত্রিরেও বিবেকানন্দ একবারও তাঁর খোজ নিতে এলেন না।

নিবেদিতা একা একাই তাবুর বাইরে ঘুরে বেড়ালেন। এখানকার দৃশ্য ভাণী মনোহর। অনেক নীচে দেখা যায় শেষনাগ হ্রদ। নিস্তরঙ্গ, নীল জল পড়ে আছে দর্পণের মতন। চতুর্দিকে গোল হয়ে ঘিরে আছে তুষারশুভ্র শিখরগুলি। আর আকাশে বিন্দুমাত্র মেঘ নেই। চরাচর ধুয়ে যাচ্ছে জ্যোৎস্নায়।

সুন্দরের মহিমা কি একা একা উপভোগ করা যায়? স্বামীজি কিছুতেই কেন কাছে আসবেন না? তার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটিয়ে গেলে কী দোষ হত! তিনি কি ভাবছেন না যে এখানে নিবেদিতার সঙ্গে দুটো কথা বলার মতনও কোন লোক নেই।

পরদিন সকালেও এলেন না বিবেকানন্দ। যাত্রা শুরু করার একটু পরেই এক জায়গায় হইচই শুনে নিবেদিতা কৌতূহলী হলেন। তিনি দেখলেন, পথের ডান পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটি নদী, একদল লোক সেখানে স্নান করছে। কেউ কেউ স্নান সেরে উঠে এসে শীতে হি হি করে কাপছে, কেউ কেউ জলে নামার আগে সাহস সঞ্চয় করার জনা ঠাকুর-দেবতাদের নাম উচ্চারণ করছে। সেই স্নানার্থী জনতার মধ্যে বিবেকানন্দকে দেখতে পেলেন নিবেদিত।

তিনি ব্যাকুল হয়ে ছুটে গিয়ে বললেন, আপনি এ কী করছেন! এই ঠাণ্ডার মধ্যে আপনি জলে নামবেন?

বিবেকানন্দ সংক্ষিপ্তভাবে বললেন, হ্যাঁ।

নিবেদিতা বললেন, আপনার শরীর ভাল নেই। ঠাণ্ডা জলে স্নান করার ফল মারাত্মক হতে পারে। আমার অনুরোধ, না, না, আমি মিনতি করছি, আপনি জলে নামবেন না।

বিবেকানন্দ বললেন, তুমি আমাকে এ অনুরোধ কোরো না। অন্যানা সাধুরা যেসব রীতিনীতি পালন করছেন, আমিও তা মেনে চলব ঠিক করেছি। আমার কোনও ক্ষতি হবে না। তুমি এগোও।

নিবেদিতা তবু দাঁড়িয়ে আছেন দেখে বিবেকানন্দ আদেশের সুরে বললেন, এত পুরুষ স্নান করছে, এখানে তোমার থাকাটা ভাল দেখায় না। তুমি যাও।

বুকভরা অভিমান নিয়ে নিবেদিতা আবার চলতে শুরু করলেন। উনি নিজের শরীরের কথা চিন্তা করবেন না? যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন! নিবেদিতার আর হাঁটতে ইচ্ছে করছে না।

খানিক বাদে একটি কিশোর ছুটতে ছুটতে এসে বলল, আপনাকে এক সাধু অপেক্ষা করতে বলেছেন। আপনি একটু দাঁড়ান।

সেই কিশোরের ভাষা বুঝতে না পারলেও বক্তব্য বোঝা গেল, অন্য যাত্রীদের পাশ কাটিয়ে নিবেদিতা এক জায়গায় দাঁড়ালেন। কোন সাধু তাকে অপেক্ষা করতে বলেছেন?

এই শীতের মধ্যেও বিবেকানন্দ কোনও উষ্ণ বস্ত্র পরেননি, গায়ে ভিজে কাপড় জড়ানো। উৎফুল্ল মুখে হন হন করে এগিয়ে এসে বললেন, এই দ্যাখো, মার্গট, স্নান করে আমার কোনও ক্ষতি হয়নি। বরং বেশ চাঙ্গা বোধ করছি। এখন এক ছিলিম তামাক পেলে বেশ হত।

নিবেদিতা বললেন, আপনি এক্ষুনি ভিজে কাপড় ছাড়ুন।

বিবেকানন্দ বলেন, ওসব পরে হবে। কালকের চড়াই পথ বেশ খারাপ ছিল। শুধু রুক্ষ পাথর, মাঝে মাঝে খুব খারালো। তোমার পায়ের অবস্থা কী, দেখি।

নিবেদিতা সঙ্কুচিতভাবে বললেন, আমার পা ঠিক আছে।

বিবেকানন্দ বললেন, তোমার পায়ের পাতা দুটো দেখাও

নিবেদিতা বললেন, কিছু হয়নি, আমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।

বিবেকানন্দ বললেন, তুমি দেখাবে, না আমি জোর করে দেখব?

অগত্যা নিবেদিতাকে বসে পড়ে পায়ের পাতা দেখাতেই হল। তা ক্ষত-বিক্ষত এবং রক্তাক্ত।

বিবেকানন্দ বললেন, আমি ঠিক অনুমান করেছিলাম। সেই হাঁটি হাঁটি পা পা বয়েস থেকে তোমাদের জুতো পরার অভ্যেস। আমি কি তোমাকে পাথরের ওপর খালি পায়ে হাঁটতে বলেছি? তুমি জেদ করে জুতো পরোনি। আমরা সন্ন্যাসী, তুমি তো সন্ন্যাসিনী নও, তোমার শারীরিক নিগ্রহের প্রয়োজন নেই। আমি শহীদুল্লাকে বলেছি, সে তোমার জন্য ঘোড়া কিংবা ডুলির ব্যবস্থা করবে।

নিবেদিতা বললেন, না, না, আমার সেসব কিছু লাগবে না। আমি পায়ে হেঁটেই যেতে পারন!

বিবেকানন্দ বললেন, তোমার পায়ের ওই সাংঘাতিক শ্রবস্থা, এর পর তুমি যদি অসুস্থ হয়ে পড়? না, তোমার আর হেঁটে যাওয়া চলবে না। কেউ কেউ তো ঘোড়ায় বা ডুলিতেও যাচ্ছে।

এক দৃষ্টিতে বিবেকানন্দর মুখের দিকে চেয়ে থেকে নিবেদিতা বললেন, আপনি আমার অনুরোধ শুনবেন না, তবু আপনার নির্দেশ মানতে হবে আমাকে?

বিবেকানন্দ বললেন, হ্যাঁ, এ দেশ সম্পর্কে তোমার যে এখনও অনেক কিছু জানতে বাকি আছে।

নিবেদিতা বললেন, আমি ডুলিতে চড়ব না। ঘোড়া নিতে রাজি আছি, যদি আপনি এক্ষুনি ডিজে কাপড় ছেড়ে গায়ে একটা কম্বল অন্তত জড়িয়ে নেন।

সারা দিন নিবেদিতা ঘোড়ায় চড়েই গেলেন। দুপায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে নিয়েছেন, জুতোও পরতে হয়েছে। এ বার যেতে হবে পঞ্চতরণীর নিকে, কখনও চড়াই, কখনও উতরাই, রাস্তা বেশ সরু। দিনের বেলা ঠাণ্ডা অনেক কম আসে। রাস্তার ধারে ধারে অনেক ফুল ফুটে আছে। বেশ কিছু ফুল নিবেদিতার চেনা লাগে, ইওরোপেও এইসব ফুল দেখা যায়, মাইকেলমাস ডেইজি, অ্যানিমোন, ফরগেট মি নট, কলাম্বাইন, লিলি অফ দা ফিলড আর অজস্র বন্য গোলাপ। এই ফুলগুলোর স্থানীয় নাম জানতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কারুকে তো জিজ্ঞেস করার উপায় নেই, কেউ তাঁর ভাষা বোঝে না। বিবেকানন্দ আবার ভিড়ে মিশে গেছেন।

কোনও যাত্রী অসুস্থ হয়ে বসে পড়ছে কিনা তা দেখার জন্য ছড়িদার শহীদুল্লাও একটা ঘোড়ায় করে ঘুরছে। এক সময় সে নিবেদিতার পাশাপাশি চলতে লাগল। নিবেদিতা তাকে পেয়ে খুশিই হলেন, তবু এঁর সঙ্গে দুটো কথা বলা যাবে।

নিবেদিতা জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি প্রতি বছরই এই তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে ওপরে যান?

শহীদুল্লা বলল, গত চার বছর ধরে যাচ্ছি। আমি নিজে ইচ্ছে করেই সরকারের কাছ থেকে এই দায়িত্ব চেয়ে নিয়েছি।

নিবেদিতা বললেন, পথ বেশ বিপদসঙ্কুল। মাঝে মাঝে তীর্থযাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ প্রাণও হায় নিশ্চয়ই?

শহীদুল্লা বলল, হ্যাঁ, অনেক বুড়োবুড়ি তো আসে। প্রতি বছরই বেশ কয়েকজন আর ফেরে না। দু বছর আগে একসঙ্গে বারোজন একটা ধসে পড়ে মারা যায়। বিপদ তো আছেই।

নিবেদিতা বলল, হিন্দুরা এখানে আসে পুণ্য সঞ্চয়ের আশায়। তারা বিশ্বাস করে, এখানে মৃত্যু হলেও তারা স্বর্গে যাবে। মিস্টার শহীদুল্লা, আপনি বিপদের ঝুঁকি নিয়েও এখানে আসেন কেন?

শহীদুল্লা একটু হেসে বলল, আমি নিষ্ঠাবান মুসলমান। হিন্দুদের মৎন দেব-দেবী মানি না। দেব-দেবীর ব্যাপারটাই বুঝি না। তবু এই পথে আসতে ভাল লাগে। এমনকী জানেন, প্রতিবার ফিরে যাবার পর মনে হয়, হিন্দুদের মতন আমিও কিছু পুণ্য অর্জন করলাম।

নিবেদিতা বললেন, আপনার ওপর সবাই খুব ভরসা করে। দু-দিন ধরে দেখছি তো, যে কোন খুঁটিনাটি ব্যাপারে যাত্রীরা আপনার কাছে দৌড়ে আসে।

শহীদুল্লা বলল, কত দুর-দুরান্ত থেকে মানুষ আসে। এখানে তো আপনজন কেউ নেই। পথঘাটও চেনে না। আমি এখানে জন্মেছি, সব চিনি, প্রত্যেকটি পথের বাঁক পর্যন্ত জানি। এইসব যাত্রীরা আমাদের অতিথি, মানুষের কিছু সেবা করতে পারলে মনটা ভাল হয়ে যায়।

নিবেদিতা বললেন, আপনি খুব উত্তম ব্যক্তি।

একটুক্ষণ চুপ করে থাকার পর শহীদুল্লা ইতস্তুত করে বলল, মিস নোবল, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব? আপনার মৎন কারুকে আগে এ-পথে দেখিনি। আপনি এত কষ্ট করতে এসেছেন কেন!

নিবেদিতা জিজ্ঞেস করলেন, কোনও শ্বেতাঙ্গ আগে আসেনি এই পাহাড় শিখরে?

শহীদুল্লা বলল, হ্যাঁ এসেছে। সাহেবকেরা অভিযান-প্রিয় হয়, পাহাড় জয় করতে ভালবাসে। সে রকম কয়েকজন এসেছে। গত বছরই দুজন ফরাসি সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তারা ইংরিজিও জানে কিছুটা, আমার সঙ্গে কথা হয়েছিল। তারা বলল, এখানকার সৌন্দর্য দর্শনের জন্যই তাদের আগমন। ফটোগ্রাফিতেও তাদের শখ আছে। অমরনাথ গুহায় বরফের লিঙ্গটি সম্পর্কে তারা কোনও আগ্রহ প্রকাশ করেনি। ফুলের ছবি তুলেছে, পাহাড়ের ছবি তুলেছে। এরকম কেউ কেউ আসে। কিন্তু আপনার মতন সঙ্গীবিহীন কোনও মেমসাহেবকে কখনও এখানে আসতে দেখিনি।

নিবেদিতা বললেন, আমি একা আসিনি।

শহীদুল্লা বলল, বলতে চাইছি, আপনার নিজের জাতের কেই সঙ্গে নেই। আপনি এক হিন্দু সন্ন্যাসীর সঙ্গে এসেছেন, হিন্দুরা এক টুকরো পাথর কিংবা মাটি দিয়ে গড়া মুর্তিকেও দেবতাজ্ঞান করে। তারা বিশ্বাস করে, তাই হয়তো সত্যি সত্যি দেখে। বাল্যকাল থেকেই পারিবারিক শিক্ষা ও সংস্কার অনুযায়ী তাদের এই বিশ্বাস জন্মায়। আপনি খ্রিস্টান হয়েও কি তা বিশ্বাস করতে পারবেন? তা কি সম্ভব? আপনি অমরনাথে কি শিব দর্শন করতে চলেছেন?

নিবেদিতা বলেন, স্বামী বিবেকানন্দকে আমি গুরু মেনেছি। তাঁর প্রদর্শিত পথেই আমি চলতে চাই। বেদান্তের দর্শনে আমি আকৃষ্ট হয়েছি। তবে, আপনি ঠিকই বলেছেন, শিলাখন্ড কিংবা মাটির মূর্তি দেখে কী করে দৈবদর্শন হয়, তা এখনও আমি স্পষ্ট বুঝি না। সে অনুভূতি আমার এখনও আসেনি। কিন্তু আমার গুরু নিশ্চিত আমাকে অনুপ্রাণিত করবেন, তিনি আমার চক্ষু খুলে দেবেন।

শহীদুল্লা বলল, হিন্দুত্বে বিশ্বাসী না হলে এইসব দেব-দেবীর কোনও মূল্য নেই। আপনার গুরু কি আপনাকে হিন্দুত্বে দীক্ষা দেবেন? আমি যতদূর জানি, কোনও বিধর্মীর পক্ষেই হিন্দু হওয়া সম্ভব নয়। হিন্দু ধর্ম ছেড়ে মানুষ বেরিয়ে যেতে পারে, কিন্তু নতুন কেউ হিন্দু ধর্মে প্রবেশ করতে পারবে না, ওদের এই এক অদ্ভুত নিয়ম।

নিবেদিতা বললেন, আমার গুরু বলেছেন, জীব মাত্রই শিব, জীব সেবা মানেই শিব সেবা। আমি সেই পথটাই গ্রহণ করতে চাই। আর কোন ধর্মে আমার প্রয়োজন নেই।

শহীদুল্লা বলল, জানি না, কোনও মায়ের পক্ষে নিজের ধর্মীয় সংস্কার ত্যাগ করা সম্ভব কি না। আর বেশি দেরি নেই, এবার আমাদের থামতে হবে রাত্রির জন্য। মিস নোবল, এর পরের অংশটুকুই কিন্তু সবচেয়ে কষ্টকর। আপনাকে ঘোড়াও ছাড়তে হবে।

সন্ধের আগেই স্থাপিত হয়ে গেল একটি তাবু নগরী। এখানকার পাহাড়ে গাছপালা নেই, কিন্তু আগুন জ্বালার জন্য কাঠ দরকার। মালবাহক ও ভৃত্যরা অনেক খুঁজে খুঁজে জুনিপার গাছের ডাল কেটে আনল। নিবেদিতার তাবুর সামনেও তৈরি হল একটি অগ্নিকুণ্ড। সারা দিন স্বামীজির সঙ্গে দেখা হয়নি। আজ আর নিবেদিতা বৃথা প্রতীক্ষায় বসে থাকতে চান না, তিনি স্বামীজিকে খুঁজে বার করে জিজ্ঞেস করবেন, কেন তিনি এত দূরে দূরে থাকছেন? দিনের বেলাতেও কেন স্বামীজির সঙ্গ থেকে তাঁকে বঞ্চিতা হতে হবে?

নিবেদিতা খুঁজতে বেরুলেন। এখানে উপত্যকাটি সুপরিসর নয় বলে তাবুগুলি ঘেঁষাঘেঁষি করে আছে, চতুর্দিকে গিসগিস করছে মানুষ, এর মধ্য থেকে কারুকে শনাক্ত করা দুষ্কর। নিবেদিতা তবু ঘুরতে লাগলেন। শত শত অগ্নিকুণ্ড থেকে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে বাতাস। নানান ভাষায় চেঁচামেচি করছে মানুষ।

ঘুরতে ঘুরতে নিবেদিতা এক জায়গায় দেখলেন, গোল হয়ে কয়েক শত গেরুয়াধারী বসে আছে, তাদের মাঝখানে ধুনির সামনে দাঁড়িয়ে এক জটাজুট সমন্বিত বৃদ্ধ সাধক একঘেয়ে সুরে বেদগান করে যাচ্ছেন। তার কাছাকাছি বসে আছেন বিবেকানন্দ। দুর থেকেই নিবেদিতা বুঝলেন, বিবেকানন্দকে বেশ ক্লান্তু দেখাচ্ছে। চোখের দৃষ্টি অবসন্ন। ওখানে তিনি বসে আছেন কেন? তিনি স্বয়ং বেদজ্ঞ, যে সাধুটি গান গেয়ে শোনাচ্ছেন, তাঁর গলায় সুর নেই, এমন কিছু আহামরি ব্যাপার হচ্ছে না, এখন স্বামীজি একটু বিশ্রাম নিলেই তো পারতেন। তিনি এমন একটা বেষ্টনীর মধ্যে বসে আছেন যে নিবেদিতার পক্ষে লোকজন ডিঙিয়ে সেখানে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তিনি ডাকলেও স্বামীজি শুনতে পাবেন না। তবে কি স্বামীজি নিবেদিতাকে এড়াবার জন্য ইচ্ছে করে ওইখানে গিয়ে বসেছেন?

একটা দীর্ঘনিশ্বাস সেখানকার বাতাসে রেখে ফিরে এলেন নিবেদিতা।

আজও তিনি কিছুই খেলেন না। আজ ঘুমোবারও কোনও প্রশ্ন নেই। রাখি পূর্ণিমার রাত, জ্যোতস্নালোকে রাত্রি দু প্রহরে আবার যাত্রা শুরু হবে, যাতে কাল প্রভাতেই অমরনাথ দর্শন করা যায়।

এখানে ডান্ডি আর ঘোড়া রেখে দিয়ে আবার পদব্রজে যাত্রা। প্রথমেই দু হাজার ফুট খাড়া ঢড়াই, সরু পাকদণ্ডি, এখানে অনেকে পা পিছলে পড়ে যায়, প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। নিবেদিতা আজ আগে আগে বেরিয়ে প্রথম দিকে চলে এলেন, আজ স্বামীজিকে ধরবেনই, শেষ পথটুকু তার সঙ্গে যাবেন। কিন্তু তিনি আজ সামনে নেই, নিবেদিত যে একটু একটু করে পিছিয়ে আসবেন, তা সম্ভব নয়, অপ্রশস্ত পথ বলে অন্য যাত্রীরা ঠেলে সামনে নিয়ে যায়।

কয়েকবার চড়াই আর উতরাই-এর পর খানিকটা সমতল স্থান একেবারে বরফে ঢাকা। যাত্রীরা জয়ধ্বনি করে উঠল। এই তুষারবর্ত্ম দেখেই বোঝা যায়, অমরনাথ গুহা অদূরেই। এই বরফ শেষ হবার পর আর বড় জোর এক মাইল।

অন্য যাত্রীদের পথ ছেড়ে দিয়ে নিবেদিতা একটা পাথরের স্তুপের পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। দলে দলে যাত্রীরা, কেউ লাফাচ্ছে, কেউ ছুটছে, নিবেদিতা তীক্ষ্ণ চোথে খুঁজতে লাগলেন স্বামীজিকে। হাজার হাজার মানুষ পার হয়ে গেল, কই স্বামীজিকে তো এখনও দেখা যাচ্ছে না। আশঙ্কায় বুক ধকধক করতে লাগল নিবেদিতার। শেষ পর্যন্ত কি অসুস্থ হয়ে পড়লেন? আর হাঁটতে পারছেন না?

নিবেদিতা ব্যাকুল হয়ে লোকজনদের জিজ্ঞেস করছেন স্বামীজির খবর। অনেকেই বুঝতে পারছে না, কেউ বুঝলেও সঠিক কিছু বলতে পারছে না। সবাই গুহায় যাবার জন্য ব্যস্ত, শহীদুল্লা অনেক আগেই সেখানে পৌঁছে গেছে। নিবেদিতা আবার ভাবলেন, তিনি খুঁজতে যাবেন কি না, কিন্তু যাত্রীদের ভিড় ঠেলে বিপরীত দিকে যাওয়া প্রায় অসম্ভব, সবাই সামনের দিকে ঠেলছে।

প্রায় সমস্ত যাত্রী চলে যাবার পর দেখা গেল বিবেকানন্দ আস্তে আস্তে আসছেন। চোখ-মুখ বিবর্ণ, পথশ্রম সহ্য করতে পারছেনই না, হাঁপাচ্ছেনে। নিবেদিতা দৌড়ে কাছে গিয়ে বললেন, আপনি বসুন। একটু বিশ্রাম নিন।

বিবেকানন্দ দাঁড়িয়ে পড়ে দম নিলেন। তারপর ক্লান্ত কন্ঠে বললেন, দেরি করা যাবে না, শুভ সময় পেরিয়ে যাবে। আমি নদীতে স্নান করে আসছি।

নদী মানে বরফ গলা স্কুল। অসম্ভব ঠাণ্ডা। নিবেদিতা শিউরে উঠে বললেন, এতখানি হেঁটে এসেছেন, এখন স্নান করা মোটেই উচিত নয়। তাতে হৃদরোগ হয়ে যেতে পারে। স্নানের দরকার নেই।

বিবেকানন্দ বললেন, কত মানুষ স্নান করল দেখোনি? আমি স্নান করে শুদ্ধ হয়ে যাব ঠিক করেছি।

নিবেদিতা বিবেকানন্দর হাত ধরে কাতরভাবে বললেন, আমি মিনতি করছি, এখন স্নান বাদ দিন।

বিবেকানন্দ তাঁর হাতের ওপর নিবেদিতার নবনীত-কোমল হাতখানির দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকালেন। তারপর শুষ্ক স্বরে বললেন, আমাকে ধোরো না, মার্গট। তোমাকে ব্রহ্মচর্য দীক্ষা দিয়েছি মনে নেই? এরকম ভাবে আমাকে ছুঁয়ে আমার শঙ্কট বাড়িয়ো না।

নিবেদিতা সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে নিলেন। তাদের দেশে কোন পুরুষ মানুষের হাত ছুঁয়ে কিছু অনুরোধ জানানো অতি সাধারণ ব্যাপার। এ দেশে তা যে অশোভন, তা তিনি জানতেন না। তিনি অপরাধিনীর মতন মুখ নিচু করলেন।

বিবেকানন্দ বললেন, তুমি এগোও আমি আসছি।

নিবেদিতা ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন গুহার দিকে। গুহাটি বিশাল, তার মধ্যে একসঙ্গে বহু লোক ঢুকে পড়েছে, ঠেলাঠেলি চলছে, তুষার লিঙ্গটির সামনে কেউ কেউ আনন্দে পাগলের মতন হয়ে চিৎকার করছে, অনেকে মেঝেতে শুয়ে পড়ে মাথা ঠুকছে, সবাই যেন দৈবদর্শনে আপ্লুত। বহু কন্ঠে হর হর ব্যোম ব্যোম রবে কানে যেন তালা লেগে যায়।

নিবেদিতা এক পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। খানিক বাদে বিবেকানন্দ এলেন, পরনে শুধু একটা কৌপিন, খালি গা, মুখচোখ রক্তিমবর্ণ, ভাবোন্মাদের মতন ছুটে গেলেন তুষার লিঙ্গের কাজে, বারবার সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে লাগলেন ও উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে রইলেন।

তুষার লিঙ্গটি দেখে নিবেদিতা খানিকটা নিরাশই হয়েছেন। মনে মনে আরও অলৌকিক কিছু কল্পনা করেছিলেন, কিন্তু এ তো গুহার ছাদ থেকে চুইয়ে পড়া জল জমে শক্ত বরফের একটা প্পিন্ড হয়েছে, লম্বা ধরনের আকৃতি, বহু মন্দিরে যেরকম পাথরের শিবলিঙ্গের পূজা হয়, অনেকটা সেইরকম। প্রকৃতির খেয়ালে নানা জায়গায় বরফের নানা আকার হয়। অনেক গুহার মধ্যে স্ট্যালাগমাইট জমে জমে অবিকল মানুষের তৈরি শিল্পকর্ম মনে হয়, কিন্তু তার মধ্যে তো অলৌকিক কিছু নেই। এই বরফের পিণ্ডকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করারই বা কী কারণ থাকতে পারে। এরই জন্য এত কষ্ট সহ্য করে আসা! নিবেদিতার মনে একটুও ভক্তিভাব জাগল না।

তিনি দেখলেন, সেই তুষার লিঙ্গের সামনে দাঁড়িয়ে স্বামীজি যেন একটু একটু দুলছেন। মনে হল, এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবেন। দৌড়ে গিয়ে ওকে ধরা উচিত, কিন্তু–। বিবেকানন্দ কোনক্রমে নিজেকে সামলে নিয়ে টলতে টলতে বেরিয়ে গেলেন গুহা থেকে। বাইরে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে নিশ্বাস নিতে লাগলেন জোরে।

নিবেদিতা পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কষ্ট হচ্ছে? বুকে ব্যথা?

বিবেকানন্দ কথা বলতে পারলেন না, দুবার মাথা নাড়লেন। আরও কিছুণ দম নেবার পর বললেন, আর একটু হলে গুহার মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতাম।

নিবেদিতা বললেন, শহীদুল্লাকে ডাক? নিশ্চয়ই দলে কোন চিকিৎসক আছে।

বিবেকানন্দ এবার জোর দিয়ে বললেন, সে কষ্ট না! ওঃ কী দেখলাম! স্বয়ং মহাদেব আমাকে দেখা দিলেন! কী জ্যোতির্ময় উল্লাসন! জীবন সার্থক হল!

বারবার এই কথাই বলতে লাগলেন বিবেকানন্দ, নিবেদিতা চুপ করে রইলেন।

আজ রাখি বন্ধনের দিন, যাত্রীরা চেনা-চেনা নির্বিশেষে পরস্পরকে রাখি পরাচ্ছে। অনেকে সকাল থেকে উপবাসে থেকে এখন খেতে বসে গেছেন যত্রতত্র। চতুর্দিকে আনন্দের কোলাহল। পূর্বপরিচিত নাগা সাধুটি একটি বড় পাথরের ওপর বসে ফলাহার করছেন, তিনি হাতছানি দিয়ে বিবেকানন্দাকে কাছে ডাকলেন। তাঁর শিষ্যরা বিবেকানন্দর হাতে অনেক খাবার তুলে দিলেন। তিনি তাঁর কিছুটা নিবেদিতাকে দিয়ে বললেন, তুমিও খাও!

নিবেদিতা যে দিনের পর দিন না খেয়ে রয়েছেন, তা বিবেকানন্দ জানেন না। তার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হল। স্বামীজি নিজে তাঁকে খেতে বলেছেন বলেই তিনি এখন আহার্য মুখে নিলেন।

ফেরার পথে কষ্ট কম! হতিয়ার তালাও-এর সংক্ষিপ্ত পথ দিয়ে তারা পহলগাঁও-এ পৌঁছে গেলেন পরদিন দুপুরের মধ্যেই। পূর্ব-প্রত্যাগত যাত্রীদের মুখে মেমসাহেব ও বাঙালি সাধুর নিরাপত্তার খবর আগেই পেয়ে গিয়েছিলেন জো ম্যাকলাউড আর ওলি বুল। তারা অভ্যর্থনার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন লিদার নদীর ধারে, দুই শ্রান্ত পর্বত-পথিককে তাঁরা সামলে নিয়ে গেলেন তাবুতে।

গরম গরম চাপাটি ও চা খেয়ে খানিকটা চাঙ্গা হবার পর বিবেকানন্দ পরম পরিতোষের সঙ্গে একটা চুরুটু ধরালেন।

দুই আমেরিকান রমণী উদগ্রীব হয়ে আছেন ওঁদের অভিজ্ঞতা শোনার জন্য। কিছুক্ষণ ধূমপান করার পর বিবেকানন্দ বলতে শুরু করলেন, আমি অপূর্ব আনন্দ উপভোগ করেছি। তুষার লিঙ্গ যে সাক্ষাৎ শিব। সেই দেবদর্শনের মধ্যে তিনি যেন আমাকে নিজের মধ্যে টেনে নিতে চাইছিলেন। তাঁর পরই আমাকে ইচ্ছামৃত্যু বর দিলেন। গুহার মধ্যে পরিবেশটাও কী সুন্দর, কোনও বামুন পাণ্ডার উপদ্রব নেই, কোনও ব্যবসা নেই, খারাপ কিছুই নেই, শুধু নিরবচ্ছিন্ন পুজার ভাব। আর কোন তীর্থক্ষেত্রে আমি এত আনন্দ উপভোগ করিনি।

বিবেকানন্দ বেশ কিছুক্ষণ নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার পর জো নিবেদিতাকে জিজ্ঞেস করলেন, মার্গারেট, তোমার কেমন লাগল? এ বার তোমার কথা বলো!

নিবেদিতা খানিকটা সঙ্কুচিতভাবে বললেন, সত্যি কথা বলব? যে পথ দিয়ে আমি গিয়েছি, তার দৃশ্য-সৌদর্য অপূর্ব। এত বড় বড় তুষারমণ্ডিত শৃঙ্গ তো জীবনে দেখিনি। কী মহিমময় রূপ। পথের ধারে ধারে ফুটে আছে কত রকম বাহারি ফুল। চমৎকার সব ছোট ছোট পার্বত্য নদী, নির্মল জলের হ্রদ। এইসব দেখার জন্যই পথের সব কষ্ট সহ্য করাও সার্থক। জীবনের একটা বিশেষ অভিজ্ঞতা হল। কিন্তু, কিন্তু এই গুহার মধ্যে তুষারের স্তম্ভটি দেখে আমার কোনও উদ্দীপন হয়নি, কোনও দৈবপ্রেরণা বোধ করিনি। প্রকৃতির খেয়াল ছাড়া এই বরফের জমাট স্তম্ভটির আর কী যে বিশেষত্ব, তা বুঝতে পারলাম না। স্বামীজি তাঁর অভিজ্ঞতার কোনও অংশও আমাকে দেননি।

বিবেকানন্দ বলেন, তোমার এখনও চক্ষু ফোটেনি, তাই তুমি দেখতে পাওনি। তোমার মন প্রস্তুত নয়, তাই তুমি কিছু উপলব্ধি করতে পারেনি।

নিবেদিতা বললেন, আমি তা স্বীকার করছি। কিন্তু আপনি আমাকে উদ্বুদ্ধ করবেন, আমাকে শেখাবেন। গুহার মধ্যে আপনার যখন অধ্যাত্ম অনুভূতি হল, তখন আমাকেও যদি অনুপ্রাণিত করতেন! আমি ওখানে গিয়ে হতাশ হয়েছি!

বিবেকানন্দ ধমকের সুরে বললেন, মার্গারেট, তুমি ছেলেমানুষের মতন কথা বলছ!

নিবেদিতা বকুনি সহ্য করতে পারেন না। পৃথিবীর যে একমাত্র মানুষটির কাছে তিনি নিজেকে নিবেদন করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন, তাঁর কাছ থেকে কোনও কঠোর বাক্য শুনলে নিবেদিতার হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যায়। তিনি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। জো ম্যাকলাউড তাঁকে জড়িয়ে ধরলেও সে কান্না থামে না। জোর বুকে মুখ লুকিয়ে নিবেদিতা শিশুর মতন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।

জো বিবেকানন্দর দিকে তাকিয়ে চোখের ইঙ্গিত দিলেন, নিবেদিতাকে কিছু সান্ত্বনার কথা শোনার জন্য। বিবেকানন্দ বললেন, ও এখন কিছু বুঝতে পারছে না। কিন্তু এই তীর্থযাত্রা নিষ্ফল হতে পারে না। পরে কখনও এর সুফল ও নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *