মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্যের মৃত্যুর পর ত্রিপন্যায় শুরু হয়ে গেল রাজনীতির খেলা। কুচক্রী ও সুযোগসন্ধানীরা ঘোঁট পাকাতে লাগল সিংহাসনের অধিকার নিয়ে। অশান্তির আগুন জ্বললে সেই আগুনে অনেকে নিজেদের মাংস-রুটি বানায়।
যুবরাজ হিসেবে রাধাকিশোরেরই সিংহাসন প্রাপ্য। কিন্তু কুমার সমরেন্দ্রনাথ তাঁর দাবি আবার তুললেন, তাঁর পক্ষেও অনুচরশলাকার কম নেই। বহুদিন পর আবার মহারানি ভানুমতীর নামে জয়ধ্বনি দেওয়া হতে লাগল, স্বর্গীয় মহারাজের পাটরানির সন্তানই সিংহাসনের ন্যায্য অধিকারী, এই নিয়ে শোরগোল তোলা হল। মহারাজ বীরচন্দ্রও মৃত্যুর আগে উত্তরাধিকারী নির্বাচনের ব্যাপারে স্পষ্ট ব্যবস্থা করে যাননি, হঠাৎ এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে, সে চিন্তাও তিনি করেননি। রাধাকিশোর নামে যুবরাজ ছিলেন বটে, কিন্তু সমরেন্দ্রনাথের প্রতি মহারাজ যথেষ্ট পক্ষপাতিত্ব দেখাতেন, পাত্রমিত্রদের বুঝিয়ে দিতেন যে ভানুমতীর গর্ভের সন্তানই তাঁর প্রিয় সন্তান। কলকাতার সফরে অধিকাংশ সময় তিনি সমরেন্দ্রনাথকেই সঙ্গে আনতেন। এখন সমরেন্দ্রনাথের সমর্থকরা বলতে লাগল, রাধাকিশোরকে এক সময় যুবরাজ করা হয়েছিল, তাতে কী হয়েছে? তা কি বদলানো যায় না? পরলোকগত মহারাজ সমরেন্দ্রনাথকেই বেশি পছন্দ করতেন, তিনি ওঁকেই সিংহাসনে বসাতেন।
একালের রাজকুমাররা তলোয়ার হাতে নিয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নিজেদের ক্ষমতার প্রশ্ন মিটিয়ে ফেলে না। তারা মামলা-মোকদ্দমায় যায়, দল ভাঙাভাঙির খেলায় মেতে থাকে, অর্থ ব্যয় হয় জলের মতন, রাজ্যে চলতে থাকে অরাজকতা, ভারতের এই সব দেশীয় রাজ্যরূপী মেষশাবকগুলিকে গ্রাস করার জন্য উদ্যত হয়ে আছে ব্রিটিশ সিংহ।
যুবরাজ রাধাকিশোর তাঁর পিতার মতন জবরদস্ত পুরুষ নন। তাঁর পিতার চরিত্রে ছিল অনেক বৈপরীত্য, তিনি ছিলেন এক দিকে কবি ও শিল্পী, অন্য দিকে চতুর রাজনীতিবিদ, ভোগী কিন্তু অসংযমী নন, সাধারণ মানুষের প্রতি উদার, আবার নিজের অধিকার রক্ষার জন্য নিঠুর স্বার্থপর। সেই তুলনায় রাধাকিশোর সরল ও একরঙা মানুষ। তিনি বুদ্ধিমান কিন্তু তাঁর জাগতিক জ্ঞান কম।
বীরচন্দ্র মাণিক্যের মৃত্যু হয়েছে কলকাতায়, সেই খবর পেয়েই রাধাকিশোর ত্রিপুরার সিংহাসনের দখল নিয়েছেন। এদিকে সমরেন্দ্রনাথও পিতার শেষকৃত্যের পর সদলবলে ধেয়ে এসেছেন, তাঁদের ধাক্কায় সিংহাসন টলটলায়মান।
রাধাকিশোরের কোনও বন্ধু নেই। তাঁর বাবা কলকাতার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করাননি, ত্রিপুরাতেই কিছু কিছু রাজকার্য নিয়ে তাঁকে ব্যস্ত থাকতে হত। এই সংকটের সময় তিনি বুঝলেন যে কলকাতার সাহায্য ছাড়া ত্রিপুরায় টেকা যাবে না। হাই কোর্ট কলকাতায়, ইংরেজ রাজত্বের রাজধানী কলকাতায় সব রকম ক্ষমতার কলকাঠি নড়ে। কলকাতায়, ত্রিপুরার পক্ষে জনমত সৃষ্টি করার জন্য ইংরিজি জানা ভাল লোক দরকার। রাধাকিশোর এই সময় শশিভূষণ মাস্টারের অভাব অনুভব করলেন, তাঁকে পেলে অনেক সুবিধে হত, কিন্তু তিনি কোথায় কে জানে! রাধারমণ ঘোষকে তিনি ঠিক বিশ্বাস করতে পারেন না, তিনি পরম বৈষ্ণব অথচ দারুণ ধূর্ত, এই ধরনের লোকদের বোঝা শক্ত। রাধারমণ দুই প্রতিদ্বন্দ্বী কুমারের মধ্যে যে ঠিক কার পক্ষে, তা প্রকাশ করছেন না, ওঁকে বিদায় করে দেওয়াই ভাল।
কলকাতার গণ্যমান্য লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা চিন্তা করে রাধাকিশোরের প্রথমেই মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামে এক কবির কথা। এই কবি প্রায় তাঁরই সমবয়েসী, চল্লিশ হতে এখনও তিন চার বছর বাকি আছে। রাধাকিশোর রবীন্দ্রবাবুর কাছে দূত হিসেবে পাঠালেন মহিমকে।
মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্যের মৃত্যতে রবি প্রায় আত্মীয়বিয়োগের মতনই আঘাত পেয়েছিলেন। মহারাজ কত পরিকল্পনা করেছিলেন, একটি সমগ্র বৈষ্ণব পদাবলী সংকলন, বাংলা বই ছাপার উত্তম প্রেস স্থাপন, সব বন্ধ হয়ে গেল, এ রকম সাহিত্য অনুরাগী রাজা আর ক’জন হয়। মহারাজের পুত্রদের তিনি চেনেন না, ত্রিপুরার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল। ওখানে সিংহাসনের দাবিদাররা গণ্ডগোল পাকাচ্ছে, এ সংবাদ একটু একটু তাঁর কানে আসে, সংবাদপত্রেও দেখতে পান, কিন্তু এ ব্যাপারে রবি উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন।
হঠাৎ একদিন রাধারমণ ঘোষ জোড়াসাঁকোর বাড়িতে উপস্থিত হলেন সকালবেলা। রবি লেখাপড়ার টেবিলে বসেছিলেন, খবর পেয়ে বৈঠকখানা ঘরে নেমে এলেন। বীরচন্দ্র মাণিকোর এই সচিবটির বৈষ্ণব সাহিত্যে অগাধ জ্ঞান, এর সঙ্গে কথা কয়ে আনন্দ পাওয়া যায়। গত বছর কার্শিয়াঙে ইনি খুব খাতিরযত্ন করেছেন। ইনি কোনও প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন নিশ্চয়ই, রবি সাদব-সম্ভাষণের পূব কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
রাধারমণ শীর্ণকায় মানুষ, ধুতির ওপর শুধু একটি উত্তরীয় গায়ে জড়ানো। হাত জোড় করে নমস্কারের পর বলে উঠলেন :
কলি ঘোর তিমিরে গরাসন
জগজন
ধরম
করম বহু দূর
অসাধানে চিন্তামণি বিহি মিলাওল আনি
গোরা
বড় দয়ার ঠাকুর…
রবিবাবু, দেশে চলে যাচ্ছি, কাল সন্ধেবেলা আপনার কথা বারবার মনে পড়ল। তাই একবার সাক্ষাৎ করতে এলাম, হয়তো আর দেখা হবে না।
রবি বললেন, বসুন, বসুন, ঘোষমশাই। ত্রিপুরা থেকে কবে এলেন, কবে ফিরছেন সেখানে?
রাধারমণ বললেন, এসেছি পক্ষকাল আগে। আর ফিরছি না সেখানে। ত্রিপুরার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঘুচে গেছে।
রবি অবাক হয়ে বললেন, সে কী? আপনাকে ছাড়া ওখানকার কাজকর্ম চলবে কী করে?
রাধারমণ বললেন, চলবে না কেন, কোনও একজন মানুষের জন্য কোনও কাজই থেমে থাকে। আপাতত অবশ্য সেখানে অরাজকতা ছাড়া আর কিছুই চলছে না। সিংহাসন সর্বক্ষণ টলমল করছে।
–আপনি কি কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে এলেন?
–আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করিনি, আবার ছাড়িয়েও দেয়নি, এমনিই চলে এলাম বলতে পারেন।
–কিন্তু ত্রিপুরার এই দুঃসময়ে আপনার চলে আসা কি উচিত হল? আপনি অনেক কিছু সামলাতে পারেন।
–রবিবাবু, আমার কতটা ক্ষমতা? আমি ত্রিপুবার মানুষ নই, বহিরাগত, তা নিয়ে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। মহারাজ বীরচন্দ্র ওই সব ছিদ্রান্বেষীদের আমল দিতেন না। এখন তিনি নেই, তারা আবার মাথাচাড়া দিয়েছে। আমাকে বখাস্তু করার আগেই মান-সম্মান নিয়ে চলে আসিটাই ঠিক নয়?
–শেষ পর্যন্ত কে বাক্তা হচ্ছে?
– আপাতত রাধাকিশোর বয়েছে, কতদিন থাকে তার ঠিক নেই। কথায় আছে না, বনগাঁয়ে শিয়াল রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য ছিলেন বাঘ, আপনি তো ভাল করেই জানেন। এখন শিয়ালদের রাজত্ব চলাবে। শিয়াল যদি রাজা হয়, তবে তার মন্ত্রী হবার মতন যোগ্যতা আমার নেই। মহারাজ ছিলেন স্বশিক্ষিত, কুমাররা শিক্ষার ধার ধারে না। কুমার সমরেন্দ্রনাথ তবু বাইরের লোকজনের সঙ্গে কিছু কিছু মেলামেশা কবেছে, দৃষ্টি কিছুটা প্রসার হয়েছে, রাধাকিশোর তো যাকে বলে কূপমণ্ডুক। পড়াশুনোয় ক-অক্ষর গোমাংস। ইংরিজি কিছুই বোঝে না। বর্তমান কালে এই লোক রাজ্য চালাবে? সামান্য ছুতোয় ইংরেজ সবকার মুকুট ছিনিয়ে নেবে।
-সেটা হবে খুবই দুঃখের কথা। স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পরিবর্ধন হচ্ছিল। এখানকার শিক্ষিত সমাজ হ্যাট-কোট পারে নকল সাহেব সাজতে ব্যস্ত, মুখে ইংরিজি বুলি, বাংলা ভাষায় কথা বলতেও তারা ঘৃণা বোধ করে। বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষক আর কে আছে? মাতৃভাষার প্রতি সম্মানবোধ না থাকলে জাতীয়তাবোধ কখনও দৃঢ় হতে পারে? কংগ্রেসের নেতারা ইংরিজি ভাষণে তুফান ছোটান, জনসাধারণের ক’জন তা বোঝে! মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্যের বাংলা ভাষা-প্রীতি দেখে আমি অভিভূত হয়েছিলাম।
রাধারমণ একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আর সে সব আশা করবেন না। কুমারদের সংস্কৃতি বোধ নেই। ইতিমধ্যেই রাজকোষ শুন্য। সিংহাসনের দাবিদারদের আঁচড়-আচড়ি, কামড়া-কামড়ি দেখে তিতিবিরক্ত হয়ে প্রজারাই ইংরেজ শাসন চাইবে। যাক, আপনার আর সময় ব্যয় করতে চাই না। আপনার কথা খুব মনে পড়ছিল, ভেবেছিলাম রসশাস্ত্র বিষয়ে কিছুক্ষণ আলাপচারিতা হবে, তা নয়, যত সব স্থূল বিষয় এসে গেল। এবার আমি বিদায় হই। আর বোধ করি দেখা হবে না।
রবি জিজ্ঞেস করলেন, কেন দেখা হবে না। আপনি কোথায় চলে যাচ্ছেন?
রাধারমণ বললেন, বাল্মীকির ভাষায় অভিশাপগ্রস্ত ব্যাধের মতন আমি এখন প্রতিষ্ঠাবিহীন। এখনকার বাজারের ভাষায় কর্মহীন। ত্রিপুরায় ফেরার আর প্রশ্ন নেই, কলকাতাতে থেকেই বা কী করব, আমার দেশের বাড়িতে গিয়ে চুপচাপ বাকি দিনগুলি কাটিয়ে দেব।
রবি বললেন, সে কী! আপনার মতন মানুষ কর্মহীন থাকবেন কেন? রাজস্ব বিষয়ে আপনার অগাধ জ্ঞান, যে-কোনও দেশীয় রাজ্য আপনাকে সাগ্রহে ডেকে নেবে। আপনার বয়েস এমন কিছু বেশি নয়, আপনার অভিজ্ঞতা, আপনার অর্থনীতি অবশ্যই কাজে লাগানো উচিত। মহীশূরের রাজা এরকমই একজন লোক খুঁজছেন শুনেছি।
রাধারমণ বললেন, অত দূরে, অন্য ভাষাভাষী রাজ্যে যাবার বাসনা আমার নেই।
রবি বললেন, বাংলাতেও অনেক বড় বড় জমিদার আছেন, কুচবিহারের রাজপরিবারের সঙ্গে আমাদের কুটুম্বিতা হযেছে, আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি–
বলতে বলতে রবি থেমে গেলেন। রাধারমণের দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে থেকে বললেন, আমি কী নিবোধ, এমন বতু কেউ হাতছাড়া করে। আমাদেরই নিজস্ব জমিদারি তদারক করার জন্য একজন বিশেষ অভিজ্ঞ মানুষের প্রয়োজন। ঘোমশাই, আপনি যদি আমাদের সঙ্গে যোগদান করতে রাজি হন, আমরা কৃতার্থ হব। আমি তা হলে আজই বাবামশাইয়ের সঙ্গে দেখা করে বলতে পারি।
রাধারমণ বললেন, আপনাদের মতন সুবিখ্যাত পরিবারের সঙ্গে যুক্ত হওয়া তো আমার পক্ষে ভাগের কথা। আমাকে যদি আপনারা যোগ্য মনে করেন—
সেইদিনই কথাবার্তা পাকা হয়ে গেল। দেবেন্দ্রনাথের অমত নেই। রবি অনেকখানি ভারমুক্ত হয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। জমিদারির কাজে তাঁকে এত জড়িয়ে পড়তে হয়েছে যে নিজস্ব লেখাপড়ার সময় যাচ্ছে কমে। মাঝে মাঝে জমিদারি পরিদর্শনে যেতে তাঁর ভাল লাগে, কিন্তু কলকাতাতেও প্রতিদিন সেরেস্তা হিসেব-নিকেশ বুঝে নিতে মেজাজ নষ্ট হয়। রাধারমণের ওপর ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে।
দিন তিনেক বাদেই রাধারমণ আবার রবির দর্শনপ্রার্থী হলেন। মুখখানি পাণ্ডুর, চিন্তাক্লিষ্ট।
রবি লঘু কণ্ঠে বললেন, ঘোমশাই, আগের দিন আপনি এসেই প্রথমে একটি পদ বলেছিলেন। আজ আপনাকে দেখে আমারও জ্ঞানদাসের একটি পদ মনে পড়ছে :
আজি কেনে তোমা এমন দেখি
সঘনে ঢুলিছে অরুণ আঁখি।
অঙ্গ মোড়া দিয়া কহিছ কথা
না জানি অন্তরে কী ভেল বেথা?
রাধারমণ এ রসিকতায় সাড়া দিলেন না। শুষ্ক কণ্ঠে বললেন, রবিবার, আমার ভুল হয়েছে। আমাকে ক্ষমা করুন।
রবি সচকিত হয়ে বললেন, কী ব্যাপার? কোনও গণ্ডগোল হয়েছে?
সবেগে মস্তিষ্ক চালনা করে রাধারমণ বললেন, না, না, কিছু হয়নি, সেদিন ভাল করে চিন্তা না করেই সম্মত হয়েছিলাম। সেটাই আমার ভুল। আপনাদের এখানে কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
রবি বললেন, আপনার সঙ্গে কেউ অসদাচরণ করেছে? কর্মচারীরা মাথার ওপর নতুন কারুকে দেখলে প্রথম প্রথম সহযোগিতা করতে চায় না, সে রকম কিছু হলে আমি অবশ্যই তার বিহিত করব।
রাধারমণ বললেন, সে সবই আমার জানা। তেমন কিছুই ঘটেনি। আমারই সিদ্ধান্তের ভুল। আমি এতকাল মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্যের অধীনে কাজ করেছি, রাজার মুখ্যসচিব ছিলাম আমি, এখন আমার পক্ষে আর অন্য কারুর অধীনে কাজ করা সম্ভব নয়।
রবি বললেন, আপনাকে আমরা ঠিক কর্মচারী হিসেবে দেখতে চাইনি তো। আপনি স্বাধীনভাবে—
রাধারমণ বলেন, আপনি আমার সঙ্গে যতই সদয় ব্যবহার করুন, তবু আপনাকে আমার মনিব হিসেবেই গণ্য করতে হবে। আপনি আমার প্রিয় কবি, আপনাকে আমার বন্ধু হিসেবেই পেতে চাই। মনিব কখনও বন্ধু হতে পারে না।
রবি চুপ করে গেলেন।
রাধারমণ বলেন, রবিবাবু, আমার অর্থের প্রয়োজন নেই। একা মানুষ, ঈশ্বরের ইচ্ছায় বাকি জীবনটা ভিক্ষা কিংবা দাসত্ব না করেও চলে যাবে। ভাবছি একবার মথুরা বৃন্দাবন দর্শন করে আসব। বিষয়চিন্তা মন থেকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলে যদি পরমার্থের চিন্তা করা যায়, তার চেয়ে আনন্দের আর কী আছে। আপনি প্রসন্ন মনে আমাকে বিদায় দিন।
রাধারমণকে পেয়ে অনেকখানি দায়িত্বমুক্ত হওয়া গেল ভেবে রবি কয়েক দিন বেশ উৎফুল্ল হয়ে ছিলেন। তা আর হল না। তবে রাধারমণ স্বেচ্ছায় বিদায় নিয়ে যাওয়ায় যে আর এক দিকে সুদূরপ্রসারী লাভের সম্ভাবনা দেখা দেবে, তা রবি টের পেলেন কয়েক দিন পরে।
সেদিন মহিমচন্দ্র এল ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের দুত হয়ে। বলেন্দ্রর সহপাঠী হিসেবে এ বাড়িতে তার অবাধ আনাগোনা। সে বলল, ত্রিপুরার নতুন রাজা কলকাতায় এসেছেন, তিনি রবীন্দ্রবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান। রবি অনুমতি দিলে তিনি নিজেই এখানে দর্শনপ্রার্থী হয়ে আসবেন।
রবি জিজ্ঞেস করলেন, নতুন রাজা, মানে কোন জন?
মহিমের আনুগত্য প্রথম থেকেই প্রথাগত দিকে। সে স্পষ্ট স্বরে বলল, যিনি ন্যায্য উত্তরাধিকারী, যিনি যুবরাজ ছিলেন, সেই মহারাজ রাধাকিশোর মাণিক্য বাহাদুর।
রবি কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। সিংহাসনে যিনি উপবিষ্ট, তিনিই রাজা। ভ্রাতৃ-বিরোধের পরিণতি যাই-ই হোক না কেন, এখন এঁকেই রাজা বলে গণ্য করতে হবে। স্বাধীন দেশের রাজা হিসেবে তিনি বিশেষ সম্মানের অধিকারী, তার সংবর্ধনাব উপযুক্ত ব্যবস্থা না করে হুট করে তাঁকে বাড়িতে আসতে বলা যায় না। ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসে রবি যে গোবিন্দ মাণিক্যের কথা লিখেছিলেন, এই রাধাকিশোর তো তাঁরই বংশধর। নিজস্ব যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক, বংশ-মর্যাদার জন্যই তিনি শ্রদ্ধেয়। রাজ-সন্দর্শনে একজন কবি যাবেন, এতে অসম্মানের কিছু নেই।
রবি বললেন, আমিই আজ সন্ধ্যাকালে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাব।
দেশীয় রাজাদের কুকীর্তি ও মুখামির বহু কাহিনী জনসাধারণের মধ্যে প্রচারিত। ইংরেজ শাসকদের দববাবে এই সব দেশীয় রাজারা উকট পোশাক পরে ভুত্যসুলভ আচরণ করে। বীরচন্দ্র মাণিক্য ছিলেন অনেকটাই বাতিক্রম, তাঁর ঢাল-তলোয়ারের জোর না থাকলেও নিজস্ব ব্যক্তিত্বের প্রভা ছিল। রাধাবমণের বিবরণ শুনে রবি ধরে নিয়েছেন যে ত্রিপুরার এই নবীন রাজাটি অশিক্ষিত এবং ব্যক্তিত্বহীন। তাই রবি ঠিক করেছিলেন, অল্প সময়ের জন্য শিষ্টাচার বিনিময় করেই ফিরে আসবেন।
সার্কুলার রোডের বাড়িতে মহারাজ রাধাকিশোর দোতলার দরবারকক্ষে কয়েকজন কর্মচারীর সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন, রবিকে দেখেই নিজের আসন ছেড়ে এগিয়ে এলেন। একটি রেশমি উত্তরীয় রবির গলায় পরিয়ে দিয়ে নমস্কার জানিয়ে বললেন, কবিবর, আপনার দর্শন পেয়ে ধন্য হলাম, আপনি কষ্ট করে নিজে এসেছেন, এ জন্য আমি কৃতার্থ।
অন্য সকলে ঘর থেকে সরে গেল, মুখোমুখি দুটি চেয়ারে বসার পর কয়েক মিনিট দুজনেই নীরব।
রবি দেখলেন, বীরচন্দ্র মাণিক্যের দশাসই শরীরের তুলনায় তাঁর এই পুত্রটি বেশ কৃশ, মুণ্ডিত মুখ, গোঁফ আছে বটে কিন্তু তা বনবিড়ালের লেজের মতন পক্ষই নয়, ধুতির ওপর গলাবন্ধ জামা পরা, অলঙ্কারের বাহুল্য নেই, ডান হাতের আঙুলে একটি অঙ্গুরীয়। চক্ষু দুটি স্নিগ্ধ, ওষ্ঠের ভঙ্গি দেখমেই মনে হয়, মানুষটি লাজুক প্রকৃতির।
একটু পরে ধীর স্বরে রাধাকিশোর বললেন, রবীন্দ্রবাবু, আপনার সঙ্গে আমার আগে পরিচয়ের সৌভাগ্য হয়নি। আমার পিতার সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা ছিল আমি জানি। পিতা আমার সঙ্গে আপনার পরিচয় কবিয়ে দেননি। একবারই আমি কলকাতায় এসেছিলাম কয়েক বছর আগে, আপনি পিতার সঙ্গে এই ঘরে বসেই কথা বলছিলেন, আমি প্রায় জোর করেই প্রবেশ করেছিলাম, আপনার সঙ্গে কথা বলতে উদ্যত হয়েছি, তখনই একজন ইংরেজ রাজপুরুষ এসে গেল, আমার আলাপ করা হল না। সে ঘটনা বোধ করি আপনার মনে নেই?
সত্যিই রবি মনে করতে পারলেন না। স্মিত হাস্য করলেন শুধু।
রাধাকিশোর বললেন, আমার পিতা আপনার ভগ্নহৃদয় কাব্যগ্রন্থটি পড়ে আপনার জন্য শিরোপা পাঠিয়েছিলেন। সেদিনের তুলনায় আজ আপনি বঙ্গের অগ্রগণ্য কবি। আপনাকে কী দিয়ে সংবর্ধনা জানা জানি না। শুধু এটুকুই জানাতে চাই, আমি আপনার রচনার বিশেষ অনুরক্ত। আপনার প্রতিটি রচনা সাগ্রহে পাঠ করি।
সাধারণত উচ্চ বংশের অশিক্ষিত সন্তানরা উদ্ধত, অহংকারী ও দুর্বিনীত হয়। কিন্তু এই যুবকটি অতিশয় নম্র ও ভদ্র। রবি ক্রমশ একে পছন্দ করতে লাগলেন। বীরচন্দ্র মাণিক্যের সামনে রবি কখনও সহজ হতে পারতেন না, বয়েসের ব্যবধান তো ছিলই, তা ছাড়া তাঁর ব্যক্তিত্ব অন্যদের কাছ থেকে খানিকটা ভয় ও সশ্রম আদায় করে নিত। কিন্তু সিংহাসনের অধিকারী হলেও এই যুবকটির সামনে রবি বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করছেন।
রাধাকিশোর আবার বললেন, কলকাতার সমাজ আমার কাছে অপরিচিত। আমি এতকাল আড়ালেই থেকেছি। ভাগ্যদোষে আমি লেখাপড়া তেমন কিছু শিখিনি। আমার পিতার মতন আমি গান ওনি না, ছবি আঁকতে পারি না, কাব্য রচনা করার শক্তিও নেই। কোনও যোগ্যতাই আমার নেই। আপনাকে শুধু এটুকুই জানাতে চাই, আমি সাহিত্য ভালবাসি। বাংলা ভাষার বই, বিশেষত আপনার ব৮ি৩ গ্রন্থগুলি পাঠ করে আমি অনেক কিছু শিখেছি। আপনার কাছে আমি ঋণী।
রবি এবার উৎসাহিত হয়ে বললেন, শুধু বাংলার মাধ্যমেই কি শিক্ষিত হওয়া যায় না। পৃথিবীর সব জাতিই মাতৃভাষার মাধ্যমে বিদ্যাচচাঁ করে।
রাধাকিশোর মুখ নিচু করে বললেন, বড় আশা নিয়ে এসেছিলাম, আপনার বন্ধুত্ব কামনা করব। আমার দুর্ভাগ্য। মহিমের মুখে শুনলাম, আমার পিতার সচিব রাধারমণ ঘোষমশাই আগেই আপনার আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি আপনাদের জমিদারি পরিচালনার ভার পেয়েছেন, আপনার দক্ষিণ হস্ত হবেন। ঘোষমশাই আমাকে পছন্দ করেন না। সিংহাসনে আমার অধিকার নিয়েও তিনি সন্দেহ পোষণ করেন। অথচ, আমি যৌবরাজ্য পদে অভিষিক্ত হয়েছি অনেক আগে।
রবি বললেন, কুমারদের মধ্যে আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ, সিংহাসন তো আপনারই প্রাপ্য।
রাধাকিশোর এবার আবেগমথিত স্বরে বললেন, আপনি, আপনি তা স্বীকার করেন?
রবির মনে হল, বর্তমান ত্রিপুরা ও কি রঘুপতির মতন কেউ আছে? যে কুটকুশলী নক্ষত্র রায়ের মতন অনুজ কোনও কুমারের মন বিষিয়ে দিয়ে গোবিন্দমাণিক্যের বিরুদ্ধে দাঁড় করাচ্ছে।
তিনি বললেন, আপনাদের ভ্রাতৃ-বিরোধের বৃত্তান্ত আমি জানি না। তবে এটা বলতে পারি, সিংহাসনে উপবিষ্ট রাজার প্রতি অবজ্ঞা দেখানো একটা পাপ। সে পাপের প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। পৃথিবীতে জন্মে সকলেই রাজা হয় না, কিন্তু রাজভক্ত হবার অধিকার সকলেরই আছে।
রাধাকিশোর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, রবিবাবু, রবিবাবু, আপনি আমাকে বন্ধু বলে মানবেন?
রবিও উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, বন্ধু।
তারপর পবর আলিঙ্গনাবদ্ধ হলেন।