গিরিশচন্দ্র বেকার। নটকুল চুড়ামণি, বঙ্গের গ্যারিক এখন বেকার। পেশাদারি মঞ্চের সমস্ত নট-নটী যাঁর কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছে, সেই নাট্যাচার্য আর কোনও রঙ্গমঞ্চে পা দেবেন না। যিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী নাট্যকার, বাংলা ভাষার শেক্সপীয়র, তিনি নীরোগ আর স্বাস্থ্যবান থাকলেও আর লিখবেন নাটক।
এ কি বিনোদিনীর অভিশাপ?
পূর্ণ যৌবনে বিনোদিনীকেও তো বিদায় নিতে হয়েছে। বাংলা তথা ভারতের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী এবং শ্রেষ্ঠ নাট্যপুরুষ, দুজনেই থিয়েটার থেকে নির্বাসিত। এ যেন নিয়তির বিচিত্র পরিহাস।
মাতৃহীন শিশুটিকে আর বাঁচানো গেল না, তিন বছর বয়সও পূর্ণ হল না তার। এর পর গিরিশ একেবারেই উদাসীন হয়ে গেলেন, থিয়েটারের কথা যেন মুছে ফেললেন মন থেকে। এখন তিনি গুরুভাইদের সঙ্গেই বেশি সময় কাটান। রামকৃষ্ণদেবের দেহত্যাগের পর তাঁর কথা অনেকেই ভুলে গেছে, অধিকাংশ পত্রপত্রিকাতে তাঁর মৃত্যুসংবাদও প্রকাশিত হয়নি, কিন্তু তাঁর গুটিকতক তরুণ ভক্ত কিছুতেই তাঁকে ভুলতে পারছে না। বাড়ি ফিরে গেলে পাছে তারা পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাই তারা একটা আস্তানায় জড়ামড়ি করে রয়ে গেছে। কাশীপুরের সেই বাগানবাড়ি ছেড়ে দিতে হয়েছিল, অত টাকা ভাড়া দেবে কে, গৃহী ভক্তদের মধ্যে দু-তিনজন ছাড়া আর সবাই সাহায্যের হাত গুটিয়ে নিয়েছে। তরুণরা বরানগরের গঙ্গার ধারে মাত্র এগারো টাকা ভাড়ায় একটি একেবারেই ভাঙাচোরা, পোভড়া বাড়ি নিয়েছে। লোকে বলে ওটা ভূতের বাড়ি। নরেন, রাখাল, শশী, তারক, বাবুরাম প্রমুখ দশ-বারোজন থাকে সেখানে। নিদারুণ দারিদ্র্য, পান্তা ভাতে নুন জোটে না এমন অবস্থা, তবু তারা আছে মহানন্দে। রামকৃষ্ণের ভালবাসার স্মৃতিই তাদের সম্বল। অন্য লোকেরা ভাবে, এই সব হাবাতে গরিব ছোঁড়াগুলো ওখানে পড়ে আছে কেন, চাকরিবাকরির সন্ধান করলেই পারে? রামকৃষ্ণদেব তো কারুকে সংসার ত্যাগ করতে বলেননি। কিন্তু ওরা যে কোথা থেকে ত্যাগের মন্ত্র পেয়ে গেছে তা কেউ জানে না।
গিরিশ প্রায়ই আসেন এখানে। হাসি-ঠাট্টা, গল্প, তর্ক হয়। নরেন, রাখাল, কালী এরা সবাই পড়াশুনা করা ছেলে, বরানগরের এই বাড়িতেও বাইবেল, কোরান, বেদ-উপনিষদ, ত্রিপিটক পাঠ চালিয়ে যাচ্ছে, এদের সঙ্গে কথা বললে গিরিশ বুদ্ধিচচার আনন্দ পান। নরেনরা বরানগর ছেড়ে কখনও কলকাতায় এলে বাগবাজারে গিরিশের বাড়িতে তামাক খাওয়ার জন্য থামে, তখনও চলে আড্ডা আর গান। বয়েসের অনেক তফাত। তবু নরেনের সঙ্গে গিরিশের এখন তুই-তোকারির সম্পর্ক।
গিরিশ মাঝে মাঝে বলেন, আমাকে পুরোপুরি তোদর দলে নিয়ে নে, নরেন। আমিও বরানগরের মাঠে গিয়ে থাকব।
মঠের মতন কিছুই না, একটা সংস্কারহীন জীর্ণ বাড়ি, সাপখোপের আস্তানা, মাঝে মাঝে ওপর থেকে ছাদের ইট কাঠ ভেঙে পড়ে, তবু মুখে মুখে ওরা বলে, বরানগরের মঠ।
নরেন রাজি হয় না। মাঝে মাঝে তাদের ডিক্ষে করে চাল জোগাড় করতে হয়। শুধু ভাতের সঙ্গে দুটো লঙ্কা পেলে খাওয়া হয়ে যায়। গিরিশ এ কৃত সহ্য করতে পারবে না।
মহেন্দ্রলালের সংস্পর্শে এখন বিজ্ঞানের দিকেও ঝোঁক এসেছে গিরিশের। সময় পেলেই গণিতচর্চা করেন। মহেন্দ্রলালের বিজ্ঞান সভার এখন নিয়মিত সদস্য, প্রতিটি বক্তৃতা শুনতে যান। সভা আরম্ভ হওয়ার তিন-চার ঘণ্টা আগে গিয়ে বসে থাকেন, কখনও মহেন্দ্রলালের সঙ্গে হাত মিলিয়ে টেস্টটিউব, বিকার, গ্যাস বানর এইসব সাফ করেন। তখন তাকে দেখে কে বলবে, এই সেই বিখ্যাত নট-নাট্যকার গিরিশ ঘোেষ। মানুষের জীবনে কখনও কখনও এমন ভূমিকা বদল হয়। এই ভূমিকা বদলে গিরিশ যেন বেশ তৃপ্ত। পাদপ্রদীপের আলো আর তার চোখ ধাঁধায় না।
একবার ঠিক করলেন গুরুর জন্মস্থান দেখে আসবেন। গরুর গাড়ি ছাড়া অন্য কোনও যানবাহনে কামারপুকুর-জয়রামবাটি পৌঁছবার উপায় নেই। একেবারেই গণ্ডগ্রাম, বাড়ি মানে কুঁড়েঘর। গিরিশ এমনভাবে গ্রামবাংলা দেখেননি কখনও আগে। এমন আদিগন্ত মাঠ, এমন বিস্তীর্ণ আকাশ, এমন অমলিন প্রকৃতি, সেইরকমই সরল মানুষজন। সারদামণি এখন এখানে রয়েছেন, গিরিশ তাঁর অতিথি হলেন। নিজের হাতে রান্না করেন সারদামণি, গিরিশকে খেতে বসিয়ে পাখার হাওয়া করতে করতে গল্প করেন কতরকম। বাল্যকালের মাতৃহীন গিরিশ, কখনও মাতৃস্নেহ পাননি, তাঁর চোখে জল আসে।
হঠাৎ একদিন খাওয়া থামিয়ে বলেন, তুমিই তো আমার মা। আমার নিজের মা।
সারদামণি হাসেন।
গিরিশ দৃঢ়ভাবে বললেন, না, না, শুধু ভাবের কথা নয়। আমি তোমারই সন্তান, মাঝখানে কিছুদিন অন্যের সংসারে রয়েছিলাম।
সারদামণি বললেন, বেশ তো, তুমি আবার এইখানেই থাকো।
মাত্র এক সপ্তাহের জন্য গিয়েছিলেন গিরিশ, রয়ে গেলেন ৮ মাস। এখন তো তাঁর কোনও পিছুটান নেই। কলকাতা মন থেকে মুছে গেছে, এ জীবন অতি চমত্তার। তিনি দেখতে পান, পুকুরঘাটে বসে সারদামণি নিজের হাতে তাঁর জন্য বালিশের ওয়াড়, বিছানার চাদর কাচছেন। রাত্রে সেই বিছানায় শুয়ে গিরিশের মনে হয়, তাঁর সর্বাঙ্গে মায়ের স্নেহের স্পর্শ। সমস্ত শরীর মন জুড়িয়ে যায়।
এখানে এসে একদিনও মদ্যপানের ইচ্ছেও জাগেনি।
দু মাস বাদে গিরিশ কলকাতায় ফিরলেন এক নতুন সংকল্প নিয়ে। নাটক-ফাটক কিছু নয়। তিনি আবার কলম ধরবেন তাঁর গুরু এবং মাতা ঠাকুরানির জীবন ও আদর্শ শিক্ষার কথা রচনার জন্য। এটাই হবে তাঁর জীবনের ব্রত।
কলকাতা মানেই ধুলো, ধোঁয়া, কলকাতা মানেই মানুষজন। পাওনাদার, উমেদার, চাটুকার, সুযোগ সন্ধানীদের উৎপাত। গিরিশ এখন পারতপক্ষে গুরুভাইরা ছাড়া অন্য কার সঙ্গে দেখা করতে চান না। থিয়েটারের লোকা এলে দূর দূর করে দেন। কোন্ রঙ্গমঞ্চে এখন কী নাটক চলছে তারও খবর রাখেন না তিনি।
একদিন একজন অতিথি এলেন, ইনি বিশেষ সম্রান্ত বংশীয়, এঁকে উপেক্ষা করা যায় না। পাথুরেঘাটার বিখ্যাত প্রসন্নকুমার ঠাকুরের নাতি নগেন মুখুজ্যে।
একটুক্ষণ কুশল সম্ভাষণের পর নগেন্দ্রভূষণ বললেন, বাংলার মঞ্চগুলির কী দশা হয়েছে এখন। কুরুচিপূর্ণ নাটক, কুৎসিত অঙ্গভঙ্গির নাম অভিনয়? ছি ছি ছি, গিরিশবাবু, আপনি কিছু দেখেন না, কিছু বলেন না?
গিরিশচন্দ্র গম্ভীরভাবে বললেন, আমার কাছে নাটকের কথা তুলবেন না মশাই, অন্য কথা বলুন।
নগেন্দ্রভূষণ মাথা নেড়ে বললেন, না, না, আপনি ও কথা বললে শুনব কেন? আপনি বাংলা থিয়েটারের অভিভাবকস্বরূপ। আপনার শাসন করা উচিত। এতে যে বাঙালি জাতিরই সুনাম রছে। ইংলিশমান কী লিখেছে দেখেছেন?
গিরিশচন্দ্র বললেন, নগেন্দ্রবাবু, আপনি বোধ হয় জানেন না, বাংলা থিয়েটারের সঙ্গে আমি সব সম্পর্ক ত্যাগ করেছি।
নগেন্দ্রভূষণ বললেন, আমি সব জানি। না জেনে কি এসেছি? আপনি সম্পর্ক তাগ করতে চাইলেইবা তা মানা হবে কেন? বাংলা থিয়েটারের সম্মান রক্ষার দায়িত্ব আর কে নিতে পারে, আপনি ছাড়া? সাহেবরা আমাদের প্রতি তাচ্ছিল্য দেখাবে, এ আমার সহ্য হয় না। আমার মাতামহ বলতেন, ইংরাজদের নিন্দে করবে না, তাদের সমকক্ষ হবার চেষ্টা করবে। বাংলা থিয়েটার তো ওদের সমকক্ষই হয়ে উঠেছিল। আবার তার মান উচ্চে তুলতে হবে।
—আমাকে এসব কথা না বলে, অর্ধেন্দুকে গিয়ে বলুন। সাহেবদের সঙ্গে টক্কর দিতে সে-ই পারে।
—অর্ধেন্দুশেখরের কি মাথার ঠিক আছে? কখন কোথায় থাকেন কেউ বলতে পারে না। হঠাৎ হঠাৎ কলকাতা ছেড়ে উব। ও হয়ে যান। ওসব লোক দিয়ে হবে না। গিরিশবার, আপনাকে আবার হাল ধরতে হবে। আপনার এসব প্রতিভা আমরা নষ্ট হতে দেব কেন? একটা নতুন থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করে, লাভ-লোকসানের চিন্তা না করে, অতি যত্নের সঙ্গে, অতি উচ্চমানের এমন একটা নাটক এখন মঞ্চস্থ করা দরকার, যা দেখে সাহেবদেরও তাক লেগে যাবে। সে কাজ আপনি ছাড়া আর কেউ পারবে না।
–নতুন থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা করবে কে?
–আমি! গ্রেট ন্যাশনলের জমিটা খালি পড়ে ছিল না এতদিন? সেখানে আমি সম্পূর্ণ আধুনিক পদ্ধতিতে একটা রঙ্গালয় গড়া শুরু করেছি। নাম দিতে চাই মিনার্ভা। কেমন হবে নামটা? এবং আমার ইচ্ছে আছে, সে থিয়েটারেব উদ্ধোধন হবে একটি ইংরেজি নাটকের বঙ্গানুবাদ দিয়ে। তেমন নাটক রচনা ও পরিচালনার যোগ্যতা আর কার আছে বলতে পারেন?
গিরিশচন্দ্র চুপ করে রইলেন। তাঁর বুকের মধ্যে মত্ত সমুদ্রের ঢেউ ঝাপটা মারছে। এমন কথা অনেক দিন তাকে কেউ বলেনি। অনেকেই যেন তাঁকে বাতিল বলে ধরে নিয়েছিল। কিন্তু থিয়েটার যে তাঁর রক্ত-মজ্জায় মিশে আছে। হঠাৎ যেন দপ করে জ্বলে উঠল তাঁর অহমিকা।
তবু তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, স্টার থিয়েটার আমাকে চুক্তিতে বেঁধে ফেলেছে। অন্য থিয়েটারে যোগ দেওয়া আমার নিষেধ। আমি তাদের কথা দিয়েছি, সত্য ভ্রষ্ট হতে পারব না আমি।
নগেন্দ্রভূষণ উত্তেজিতভাবে বললেন, আপনি হেলাফেলার মানুষ নন, আপনি গিরিশ ঘোষ, আপনাকে দিয়ে কেউ দাসখত লেখাতে পারে? চুক্তি দিয়ে আপনার হাত-পা বেঁধে ফেলবে, এমন চুক্তি আইনে টিকতে পারে না। কই, চুক্তিপত্রখানা একবার আনুন দেখি।
গিরিশচন্দ্র বললেন, আবার মামলা-মোকদ্দমা? না, না, ওর মধ্যে আমি নেই। এই বেশ আছি। সুখে আছি। স্বস্তিতে আছি।
নগেন্দ্রভুষণ জোর দিয়ে বললেন, সেখানা একবার দেখতে দিন না মশাই তাতে আপত্তি কীসের?
দেরাজ থেকে চুক্তিপত্রটি বার করে দিলেন গিরিশচন্দ্র। নগেন্দ্রভূষণ সেটিতে দ্রুত চোখ বোলালেন, মৃদু হাস্য ফুটে উঠল তাঁর ওষ্ঠে।
তিনি বললেন, আপনি বুঝি এ চুক্তিপত্র কখনও পড়েও দেখেন নি?
গিরিশচন্দ বললেন, পড়ার দরকার কী, মুখের কথাই তো যথেষ্ট।
নগেন্দুভূষণ বললেন, না। মুখের কথা যথেষ্ট হলে চুক্তি পত্রে স্বাক্ষর করার প্রয়োজন কী ছিল? এই চুক্তির শর্ত অক্ষরে অক্ষরে মেনে চললে আপনাকে সত্যভ্রষ্ট হতে হবে না নিশ্চয়ই? ওরা পাকা কাজ করেছে। ওরা জানত, এমন চুক্তি আইনে টিকবে না। তাই তলায় আর একটি শর্ত যোগ করেছে। আপনি যদি এ চুক্তি কখনও ভঙ্গ করেন, তা হলে আপনাকে পাঁচ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে দিলে আপনার আর কোনও পায় থাকবে না।
গিরিশ অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে বললেন, সত্যি এমন কথা লেখা আছে?
নগেন্দ্রভূষণ কাগজখানা তুলে ধরলেন গিরিশের চোখের সামনে।
গিরিশ অস্ফুট স্বরে বললেন, পাঁচ হাজার টাকা। সেও তো অনেক টাকা, আশার সঞ্চয় কিছুই নেই!
নগেন্দ্রভূষণ বললেন, আজ বিকেলেই আপনার নাম করে স্টার থিয়েটারে আমি পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি। তারপর থেকে আপনি মুক্ত। আপনার সঙ্গে অন্য কথাবার্তা পরে হবে, আপনি নাটক রচনা করাতে বসে যান তো গিরিশবাব, আমরা বাংলা নাটকের মুখ রক্ষা করতে চাই, এইটাই হবে আমাদের প্রধান উদ্দেশা।
অনেক দিন পর আজ সন্ধ্যায় গিরিশ একটি মদের বোতল আনালেন। মাঝখানে কিছুদিন সুরা পান বন্ধ রেখে শরীর বেশ স্নিগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিলেন, আর কোনওদিন ও জিনিস স্পর্শই করবেন না। কিন্তু আজ মন বড় চঞ্চল হয়ে উঠেছে।
দোতলায় তাঁর শয়নকক্ষে নতুন করে লেখার সরঞ্জাম সাজিয়ে রেখেছিলেন গিরিশ। কয়েক দিস্তে বন্ড পেপার, দোয়াত-কলম, ব্লটিং পাড়, ইরেজার। আর ডিকটেশন নয়, আবার নিজের হাতে গুরু ও গুরুমাতার দিব্যজীবনের কথা লিখবেন বলে মনস্থ করেছিলেন, শুরু করা হয়নি। সেখানে বসে সুরা দিয়ে আচমন করলেন গিরিশ। মনের মধ্যে দোলাচল।
একবার ভাবছেন, কী হবে আর মঞ্চের জগতে ফিরে গিয়ে? থিয়েটার মানেই তো আবার সেই প্রতিদিন উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা। ঈর্ষা ও কলহ। রাত্রি জাগরণ ও প্রমোস। প্রতিদিন টানটান রাখতে হয় স্নায়ু, মাথায় রাখতে হয় অন্য মঞ্চগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতার কথা, নাম না জানা হাজার হাজার দর্শকের হাততালির জন্য দুরু দুরু বক্ষে প্রতীক্ষা। থিয়েটারের জগতে স্নেহ, ভালবাসা, মমতা সবই কৃত্রিম। চাটুকাররা তাঁকে ঘিরে থাকবে, স্ত্রীলোকেরা ভাল পার্ট পাবার জন্য তাঁর গায়ে পড়ে সোহাগ দেখাবে।
তার চেয়ে এই জীবনই কি ভাল নয়? লোকজনের ভিড় এড়িয়ে এই শান্ত, নিরিবিলি সময়, এখন নিজের দিকে ফিরে তাকানো যায়। মাঝে মাঝে গুরুভাইদের সঙ্গে দেখা হলে উচ্চমার্গের আধ্যাত্মিক আললাচনায় চমত্তার সময় কাটে। এই তো বেশ! সকালে নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম ভাঙে, রাত্রে তাড়াতাড়ি আহারাদি সেরে শুয়ে পড়া যায়, শরীরের ওপর কোনও অত্যাচার হয় না। এই শান্তিময় জীবন ছেড়ে আবার সেই উত্তাল ঝাময় জীবনে ঝাঁপ দেওয়া কি ঠিক হবে?
এখনও দোয়াতে কলম ডােবাননি গিরিশ, এক একবার সূরায় চুমুক দিচ্ছেন, তারপর তামাক টানছেন। হঠাৎ নরেনের জন্য উতলা বোধ করলেন। গুরু রামকৃষ্ণ তাঁকে বলেছিলেন, তুই যা করছিস করে যা! গুরু আর সশরীরে নেই, নরেনই ছিল শিষাদলের নেতা, এ সময় নরেন থাকলে পরামর্শ নেওয়া যেত। কিন্তু অনেক দিন নরেনের কোনও পাত্তা নেই। বরানগরের মঠ ছেড়ে সে যে কোথায় উধাও হয়ে গেছে কেউ জানে না। সংসারে ফিরে যায়নি নরেন, কিন্তু গুরুত্ৰাতাদের ছেড়েই বা সে কোথায় গেল?
বেশ কিছুক্ষণ দ্বিধার মধ্যে থাকার পর গিরিশের শিল্পী সত্তাই জয়ী হল। তাঁর রক্তে রয়েছে উন্মাদনা, কোনও শান্তির আশ্বাসই তাঁকে প্রকৃত শান্তি দিতে পারবে না। সাধারণ, নিয়ম মানা জীবন কোনও শিল্পীর জন্য নয়। শিল্প যে সর্বক্ষণ জ্বালিয়ে মারে। ফরাসিদেশের নট-নাট্যকার মলিয়ের মঞ্চের ওপরেই মারা গিয়েছিলেন, গিরিশ প্রায়ই ভাবতেন, ওই রকম মৃত্যই তাঁরও নিয়তি।
সাদা কাগজের ওপর গিরিশ প্রথমে লিখলেন, ম্যাকবেথ।
নগেন্দ্রভূষণ যখন ইংরিজি নাটকের বঙ্গানুবাদের কথা বলেছিলেন, তখনই গিরিশের মাথায় এই নামটি এসেছিল। ইংরেজদের যদি চ্যালেঞ্জ জানাতে হয়, তা হলে শেক্সপীয়ার দিয়েই শুরু করা উচিত। অল্প বয়েসে গিরিশ একবার এই নাটকের অনুবাদ করেছিলেন, সে অনুবাদ শিশেষ সুবিধের হয়নি। আবার তিনি বাংলায় ম্যাকবেথ লিখবেন।
দু তিন পৃষ্ঠা লেখার পর উঠে দাঁড়ালেন গিরিশ। সিংহের মতন পায়চারি করতে লাগলেন ঘরের মধে। তাঁর নাসারন্ধ্র থেকে উষ্ণ নিশ্বাস বেরুচ্ছে, চ দুটি যেন খুলছে। ওরা তাঁকে বাতিলের দলে ঠেলে দিতে চেয়েছিল? মঞ্চের সঙ্গে তাঁর নাড়ির টান ছিন্ন করে দেবে ভেবেছিল? ওদের সবাইকে তিনি এবার দেখিয়ে দেবেন তব কবজির জোর! গিরিশ ঘোষ মরে গেছে। শুধু নাটক লেখা ও পরিচালনা নয়, আবার তিনি অভিনেতা হিসেবে আবির্ভূত হবেন। দেখুক সবাই, শুধু বলে নয়, সারা ভারতে এখন তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। রান্ত্রির প্রথম প্রহরেও গিরিশের ঘরে লহে গ্যাসের বাতি। তাঁর প্রথম পকের ছেলে সুরেন্দ্র উঁকি মেরে দেখল, পাশে গড়াচ্ছে শূন্য মদের বোতল, গিরিশ ভূতগ্রস্তের মতন খসখস করে অতি দ্রুত কী সব লিখে চলেছেন।
পা টিপে টিপে সে পাশে এসে দাঁড়াল। তারপর বিস্মিতভাবে বলল, বাবা, তুমি আবার নাটক লিখছ?
গিরিশ মুখ তুলে ছেলের দিকে চেয়ে বললেন, হ্যাঁ। নাটক, নতুন নাটক। শিগগিরিই মঞ্চে নামাব। তুই তাতে পার্ট করবি, দানি।
মিনার্ভা থিয়েটার যেমন অতি রমণীয়ভাবে সজ্জিত হয়েছে, তেমনই ম্যাকবেথের প্রস্তুতিতেও কোনও খুঁত রাখা হয়নি। ইংরেজ চিত্রকর দিয়ে দৃশ্যপট আঁকানো হয়েছে। পোশাক-আশাক অবিকল বিলাতি। অন্তরালে বিলাতি বাজনা। সৌভাগ্যক্রমে অর্ধেন্দুশেখরকে পাওয়া গেছে দলে, তিনি তো একাই একশো। অর্ধেন্দুশেখর বড় পার্ট চান না, একই নাটকে তিন-চারটি ছোট ছোট বিভিন্ন বকম ভূমিকায় তাঁর জুড়ি নেই। ম্যাকবেথে তাঁর ভূমিকা পাঁচটি চরিত্রে, তার মধ্যে তিনি জোর করে একজন ডাকিনীও সাজতে চেয়েছেন। পুরনো আমলের আরও অনেককে পাওয়া গেছে। লেডি ম্যাকবেথের ভূমিকা অতি কঠিন, সে পার্ট প্রথমে দেওয়া হয়েছিল প্রমদাসুন্দরীকে। সে পাকা অভিনেত্রী, কিন্তু ইদানীং সুলাঙ্গিনী হয়েছে, হাঁসের মতন থপথপ করে হাঁটে, মেমসাহেব হিসেবে তাকে একেবারেই মানায় না। তখন তিনকড়ি নামে এই নতুন মেয়েটিকে নিয়ে মহড়া দেওয়া হল কয়েকদিন। মেয়েটি ঠিক নতুন নয়, অন্য থিয়েটারে কয়েকবার খুচরো পার্ট করেছে, রোগা, লম্বা চেহারা, অনেকে ঠাট্টা করে তার নাম দিয়েছে তেঠেঙে, তবু গিরিশ বললেন, লেডি মাকবেথের কিছুটা পুরুষালি চেহারা হলে ক্ষতি নেই। শেষ পর্যন্ত তিনকড়িই মনোনীত হল সেই ভূমিকায়।
এর মধ্যে দু’ রাত্রি অভিনয় হয়ে গেছে, বেশ উতরে গেছে তিনকড়ি। নতুন নাটকে প্রথম দু একটি শো-তে সমালোচকদের ডাকা হয় না, প্রথম দিকে কিছু ভুল-ভ্রান্তি থাকেই। এই শনিবারেই প্রকৃতপক্ষে জনসমক্ষে সম্পূর্ণ আত্মপ্রকাশ, সমস্ত পত্র-পত্রিকার সম্পাদক ও নাট্য সমালোচকদের আহ্বান জানানো হয়েছে, আমন্ত্রিত হয়েছেন শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, এই শো নষ্ট হলে অপমানের একশেষ হতে হবে।
তিনকড়ির অসুস্থতার সংবাদ শুনে গিরিশ যখন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিলেন, তখন অর্ধেন্দুশেখর বললেন, গুরু, আমাদের এই নাটকে একটা ছুড়ি একটা ছেলের পার্ট করছে। আগেও ছুটকো-ছাটকা পার্ট করেছে। কিন্তু ঘুড়িটার একটা গুণ কী জানো, পুরো নাটকটাই প্রায় ওর মুখস্থ। আমি শুনেছি, ও প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সব পার্ট মুখস্থ বলতে পারে। প্রায় শুতিধর বলা যায়। একবার তাকে ট্রায়াল দিয়ে দেখবে নাকি?
গিরিশ মুখ ঝামটা দিয়ে বলেছিলেন, থামো তে! মুখস্থ থাকলেই পার্ট করা যায়? তাও লেডি ম্যাকবেথ! আমি মরছি নিজের জ্বালায়।
গিরিশ ভাবছিলেন, বনবিহারিণী, কুসুমকুমারীর মতন পাকা অভিনেত্রীদের বয়েস হয়ে গেছে, মঞ্চ থেকে প্রায় বিদায় নিয়েছে, তাদেরই কারুকে ফিরিয়ে আনরেন কি না। অথবা প্রমদাসুন্দরীকেই লেডি ম্যাকডাফের ভূমিকা থেকে সরিয়ে এনে লেডি ম্যাকবেথ সাজাবেন? তাহলে ও ভূমিকাটা কে করবে?
আবার মুখ তুলে বললেন, ঠিক আছে, ডাকো তো ঘুড়িটাকে, একবার দেখি।
অর্ধেন্দুশেখর একটি মেয়েকে নিয়ে এলেন, সে লেডি ম্যাকডাফের ছেলে সাজে। পাতলা দোহারা চেহারা, মাজা মাজা রং, চক্ষু দুটি টানা টানা, সে পরিষ্কার দৃষ্টিতে তাকাতে পারে।
গিরিশ জিজ্ঞেস করলেন, কী নাম তোর?
মেয়েটি বলল, নয়নমণি।
গিরিশ বিরক্তির সঙ্গে মাথা ঝাঁকানি দিয়ে বললেন, আসল নাম কী বল। পাঁচী, বুচি, খেত্তি, ডেকচি, পটল, আকাশী, পীরানি, এই সবই তো নাম হয়। ভাল ভাল নাম আমরা দিয়ে দিই। বনবিহারিণী, বিনোদিনী, প্রমদাসুন্দরী, কুসুমকুমারী এসব আমার দেওয়া নাম।
মেয়েটি জোর দিয়ে বলল, নয়নমণিই আমার নাম।
গিরিশ বললেন, বটে। জন্মেছিস কোথায়? সোনাগাছি, হাড়কাটার গলি, গোয়াবাগান, উল্টোডিঙ্গি, কোথায়?
নয়নমণি বলল, ওসব কোথাও না। আমি জন্মেছি, অনেক অনেক দূরে।
গিরিশ এবার মুখ তুলে মেয়েটির বাঙ্গ ভাল করে খুঁটিয়ে দেখলেন। তারপর বললেন, হাড়ের ওপর মাংস নেই, খেতে পাস না বুঝি? ঠিক আছে, সাজিয়ে গুজিয়ে নিলে এই চেহারাতেই চলবে। তুই নাকি আমার পুরো ম্যাকবেথ মুখস্থ বলতে পারিস? মুখস্থ করেছিস কেন?
নয়নমণি বলল, ইচ্ছে করে করিনি। মহড়ার সময় আড়াল থেকে শুনি। শুনতে শুনতে আমার মুখস্থ হয়ে যায়।
গিরিশ বললেন, বল দিকি ডার্কিনীর সংলাপ।
নয়নমণি সঙ্গে সঙ্গে শুরু করল।
…দিদি
লো, বল না আবার মিলব কবে তিন বোনে—
যখন ঝরবে মেঘা ঝুপুর ঝুপুর
চক চকাচক হানতে চিকুর
কড় কড়াকড় কড়াৎ কড়াৎ ডাকবে যখন ঝনঝনে…
…এলো চুলে মালার মেয়ে,
বসে উদোম গায়
ভোর কোচরে ছেচা বাদাম চাকুম চুকুম খায়…
শুনতে শুনতে গিরিশের ভূরু উঠে গেল অনেকখানি, কুঞ্চিত হল ললাট। তিনি আবার বললেন, আমি আগে কখনও এদের কারুকে অন্যের পার্ট মুখস্থ বলতে শুনিনি। লেডি ম্যাকবেথের জবানী বল তো খানিকটা শুনি।
নয়নমণি বলল :
আয় আয় আয় রে নরকবাসী পিশাচনিচয়
ডাকিছে জিঘাংসা তোরে আয় ত্বরা করি;
হর নারী-কোমলতা হৃদি হতে মম
আপাদমস্তক কর কঠিনতাময়…
গিরিশ বললেন, তুই বললি পিশাচনিচয়অ, কঠিনতাময়অ, তোর জন্ম কোথায় ঠিক করে বল তো?
নয়নমণি আবার বলল, অনেক দূরে। আমি উচ্চারণ ঠিক করে নেব।
গিরিশ জিজ্ঞেস করলেন, মেমসাহেবরা কেমন করে হাঁটে জানিস? হেটে দেখাতে পারবি? এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো পর্যন্ত হেঁটে যা তো!
নয়নমণি থুতনিটা ঈষৎ উঁচু করে, গর্বিত ইংরেঞ্জ রমণীর অবিকল ভঙ্গিতে হেঁটে গেল।
গিরিশচন্দ্র এবার অর্ধেন্দুশেখরকে জিজ্ঞেস করসেন, এ মেয়েকে পেলে কোথায়!
অর্ধেন্দুশেখর বললেন, আস্তাকুড় থেকে কুড়িয়ে এনেছি বলতে পারে। এ মেয়ের অনেক গুণ আছে, ভাল গাইতে পারে। নাচতেও জানে। এ পর্যন্ত ভাল পার্ট পায়নি। ছোট ছোট রোল করছে তিন-চার বছর।
গিরিশচন্দ্র বললেন, এ যে দেখছি ছাই চাপা আগুন! উচ্চারণে একটু দোষ রয়ে গেছে, কিন্তু ওর হটা দেখেই বুঝতে পেরে গেছি, ও বড় অভিনেত্রী হবে। যদি মাথা না বিগড়ে যায়।
তারপর নয়নমণির দিকে ফিরে বললেন, এই, তোর বাঁধা বাবু আছে?
নয়নমণি বলল, আছে?
গিরিশ আবার জিজ্ঞেস করলেন, বলছি, তোর বাঁধা বাবু আছে? আমার সঙ্গে আজ সারা রাত কাটাতে পারবি?
নয়নমণি চুপ করে রইল।
গিরিশ এখন অস্থির হয়ে আছেন, নীরবতা তাঁর সহ্য হল না। প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললেন, কথাটা বুঝলি না? রাত কাটাতে হবে মানে আমার সঙ্গে বিছানায় শুয়ে তোকে ঢলানি করতে হবে না। আজ সারা রাত মহড়া দেব, তুই থাকতে পারবি?
নয়নমণি নতমুখে বলল, পারব।
তিন দিনের মধ্যে পুরো তৈরি হয়ে গেল নয়নমণি। গিরিশ খুবই সন্তুষ্ট। তবু একটু ভয় রয়ে গেছে। মহড়ার সময় ভাল করা আর মঞ্চে শত শত দর্শকের সামনে সব ঠিকঠাক করে যাওয়া এক কথা নয়। এত বড় পার্ট যে ও আগে করেনি। তাও এরকম শক্ত ভূমিকা।
রামকৃষ্ণদেবের ছবির সামনে প্রণাম ও ধ্যান শেষ করে গিরিশ নয়নমণিকে ডাকলেন।
লেডি ম্যাকবেথ রূপিণী নয়নমণিকে বোধ হয় এখন তার নিজের জননীও চিনতে পারবে না। কালো ভেলভেটের লম্বা গাউনে এখন আর তাকে কৃশ মনে হয় না, মুখমণ্ডল গোলাপি বর্ণ, মাথাব দীর্ঘ চুল ঘোড়ার লেজের মতন গুচ্ছ করে বাঁধা। ওষ্ঠ-অধর বেদানার কোয়ার মতো রক্তিম। দীর্ঘ অক্ষিপল্লব, তার দৃষ্টি যেন সুদূর।
গিরিশ বললেন, নয়ন, তুই আমার মান রাখতে পারবি তো? আমার গুরুর ছবিকে প্রণাম কর।
নয়নমণি প্রথমে হাঁটু গেড়ে বসে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে রইল একটুক্ষণ। কী যেন সে বলতে লাগল ফিসফিসিয়ে। পরে সে গিরিশের পাবন্দনা করে উঠে দাঁড়াল, দু’হাত জোড় করে নমস্কার জানাল রামকৃষ্ণদেবের ছবিকে।
গিরিশ তার মাথায় হাত রাখলেন।
ডায়নামো বসিয়ে বিজলি বাতির ব্যবস্থা হয়েছে। মঞ্চ একেবারে আলোয় আলোময়। এত আলো আগে কখনও ছিল না, মুখের প্রতিটি রেখা পর্যন্ত দেখা যায়। উইংসের পাশ থেকে বিজলি বাতির ওপর বিভিন্ন রঙিন কাগজ মুড়ে ফোকাস করা হবে, এই সব ব্যবস্থাই নতুন। এত বেশি আলো বলে গিরিশ অভিনয় ধারারও বদল করেছেন। এখন থেকে কণ্ঠস্বরের ওঠা-নামা ছাড়াও মুখের অভিব্যক্তি, চক্ষুর বিভিন্ন ভঙ্গিও প্রাধান্য পাবে।
এত মুহুর্মুহু করতালি গিরিশ আশাই করেননি। আজ দর্শকদের মধ্যে অনেক সাহেব রয়েছে, তারাও হাততালি দিচ্ছে। গিরিশ আগে লোকমুখে শুনেছিলেন, ইংলিশম্যান পত্রিকার সম্পাদক তাঁর সহকর্মীদের বলেছিলেন, বাঙালি থেন অফ কডর? এ যে হাসির ব্যাপার। চলো, নেটিভদের থিয়েটারে ম্যাকবেথ দেখে একটু হেসে আসি!
কিন্তু এখন তো সাহেবরা হাসছে না, মুগ্ধ হয়ে হাততালি দিচ্ছে। গিরিশ লক্ষ করলেন, নয়নমণি অভিনন্দিত হচ্ছে বারবার। মহড়ার চেয়েও ভাল অভিনয় করছে নয়নমণি, এ মেয়েটি যেন জন্ম-অভিনেত্রী।
শেষ দৃশ্যে ড্রপসিন পড়ার পর দর্শকরা উঠে দাঁড়িয়ে এমন সহর্ষ চিৎকার করতে লাগল যে আবার পদা তুলে সমস্ত অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সার বেঁধে দাঁড়াল, গিরিশ সামনে এসে নমস্কার জানিয়ে সকলকে ধন্যবাদ জানালেন। তার পরেও দর্শকরা এনকোর এনকোর বলতে লাগল, তখন গিরিশ নয়নমণিকে এগিয়ে দিলেন সামনে, একে একে অন্য সবাই একবার করে সামনে এল। এক জমিদার মেডেল ঘোষণা করলেন লেডি ম্যাকবেথের নামে।
নগেন্দ্রভূষণ দমদমের এক বাগান বাটিতে বিরাট খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। অদ্য রজনীর সার্থকতায় সবাই অভিভূত। আনন্দের শেষ নেই। কিন্তু গিরিশচন্দ্র ক্লান্ত, বিষম ক্লান্ত, গত তিন রাত তাঁর ঘুম হয়নি। অভিনয়ের সময় মঞ্চে তাঁর দাপট দেখে কেউ বুঝতে পারেনি যে ভেতরে ভেতরে তিনি কতখানি ক্লান্ত হয়ে আছেন। অন্য থিয়েটারের লোকজনও আজ গোপনে টিকিট কেটে এই থিয়েটার দেখতে এসেছে, নাটকের বাঁধুনি, পাত্র-পাত্রীদের সাজসজ্জা, মঞ্চের নতুন রূপ তো আছেই, এই প্রৌঢ় বয়েসেও অভিনেতা হিসেবে গিরিশের তেজ দেখে তারা হতবাক।
গিরিশ আর পান-ভোজনের আসরে যেতে পারলেন না, শুয়ে পড়লেন বাড়ি ফিরে।
সমস্ত পত্রপত্রিকাতেই ম্যাকবেথের প্রশস্তি বেরুল, শুধু তাতে ফাঁক রয়ে গেল একটি। হ্যান্ডবিলে লেডি মাকবেথের চবিত্রাভিনেত্রী হিসেবে নাম ছিল তিনকড়ি দাসীর, সমস্ত প্রশংসা বর্ষিত হল তার নামে। নয়নমণির কথা কেউ জানেই না।
তিনকড়ি দুদিন পরেই সুস্থ হয়ে ফিরে এসে দাবি জানাল, পরবর্তী অভিনয়ে সে তার ভূমিকা স্থাড়বে না। তার দাবি নায্য। কিন্তু নগেন্দ্রভূষণ, অর্ধেন্দু ও আরও কয়েকজনের মতে নয়নমণির অভিনয় অনেক জীবন্ত হয়েছে, তাকে মানিয়েছেও খুব, সুতরাং তিনকড়ির বদলে তাকেই রাখা হোক। এই নিয়ে একটা কলহের উপক্রম হল।
মধ্যস্থ হয়ে নগেন্দ্রভূষণকে গিরিশ বললেন যে, এই অবস্থায় তিনকড়িকে বঞ্চিত করা ঠিক হবে না, তাতে একটা কুদৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে। তিনকডিই লেডি ম্যাকবেথ করুক, নয়নমণিকে পরে অন্য সুযোগ দেওয়া যাবে এখন। সে যাতে মনে আঘাত না পায়, গিরিশ নিজে তাকে বুঝিয়ে বলবেন।
অর্ধেন্দুশেখর বললেন, মনে আঘাত পাবে? ও ছুঁড়িটা তো পাগলি! নিজের জন্য কিছুই চায় না।
তবু গিরিশ নয়নমণিকে ডেকে পাঠালেন গ্রিনরুমে। নরম কণ্ঠে বললেন, আয়, বোস। তুই গান জানিস শুনলুম, আমাকে একটা গান শোনাবি?
গিরিশকে চমৎকৃত করে নয়নমণি জয়দেবের গীতগোবিন্দ থেকে খানিকটা গেয়ে শোনাল। তার সংত উচ্চারণে ভুল নেই।
গিরিশ একটুক্ষণ মুগ্ধভাবে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, কোথায় ছিলি তুই এতদিন? তুই তো লেখাপড়া জানিস মনে হচ্ছে। কে তোকে এসব শোনাল?
নয়নমণি মুখ নিচু করে বলল, আমি নিজে নিজেই শিখেছি। গিরিশ বললেন, বাঃ! তুই সেদিন আমার মুখ রক্ষা করেছিস। সব কাগজে এ নাটকের খুব সুখ্যাতি বেরিয়েছে। ইংলিশম্যান কাগজ পর্যন্ত লিখেছে, বিলেতের স্টেজের তুলনায় আমাদের প্রোডাকশান কোনও অংশে খারাপ হয়নি। দুটো প্যারাগ্রাফ লিখেছে তোর অভিনয় সম্পর্কে, যদিও নাম পেয়েছে তিনকড়ি। দ্যাখ, থিয়েটারে এরকম হয়। নাটক ভাল হল কি না, সেইটাই বড় কথা, সবাই মিলে সেই চেষ্টাই করতে হয়।
নয়নমণি বলল, আমি ছোট পার্টই করব। ম্যাকড়াক্ষের ছেলের পার্ট।
গিরিশ বললেন, আ, তুই ছোট পার্ট করবি? মাঝে মাঝে তিনকড়ির বদলে তোকে যদি নামাই, কিছুদিন তিনকড়ি করুক, তারপর…
নয়নমণি বলল, আমার ছোট পার্টই ভাল। তিনকড়ি দিদির এ পার্ট আমার দেখতে খুব ভাল লাগে, কী সুন্দর গলা।
গিরিশ হেসে উঠে বললেন, এমন কথা কখনও শুনিনি! তুই কে রে? ঠিক আছে, তুই এখন ছোট পার্টই কর, “রের নাটকে তোর জন্য আমি বড় রোল লিখব। ইচ্ছে আছে শেক্সপীয়ারের সব নাটক আমি একে একে বাংলায় মঞ্চে নাবি। হ্যামলেটে তুই হবি ওফেলিয়া। নগেনবাবুকে বলব, এ মাস থেকেই তোর কিছু মাইনে বাড়িয়ে দিতে–
নয়নমণি বলল, বেশি মাইনে নিয়ে আমি কী করব? কুড়ি টাকা পাই, তাতেই আমার বচ্ছন্দে চলে যায়!
গিরিশ আরও জোরে হেসে উঠে বললেন, এ মেয়ে দেখছি সত্যি পাগল! পাগলদেই আমার বেশি পছন্দ।