প্রয়োজনে মানুষ কী না করে। নদিয়ার এক গ্রাম্য কন্যা বসন্তমঞ্জরী এখন নিপুণ অশ্বরোহিণী। একা সে ঘোড়া ছুটিয়ে পাহাড়ে উঠে যায়। দ্বারিকার বাল্যকালে মাতুলালয়ে একটু আধটু ঘোড়ায় চড়া অভ্যেস ছিল, এখানে এসে কয়েকদিনেই ভাল রকম রপ্ত করে নিয়েছে। বসন্তমঞ্জরী পারবে কিনা সে ব্যাপারে গোড়ার দিকে তার বেশ সংশয় ছিল, কিন্তু বসন্তমঞ্জরী একটুও লজ্জা বা ভয় পায়নি, মাথার ঘোমটা খুলে ফেলে প্রথম দিন থেকেই দুলকি চালে চলতে শিখেছে, এখন টগবগিয়ে যায়।
একটি সাদা ঘোড়ায় চেপে দ্বারিকার পাশাপাশি যেতে যেতে সে হেসে বলে, আগের জন্মে আমি বোধ করি রাজপুতানী ছিলাম।
এটা অবশ্য রাজপুতানা নয়, পঞ্জাব। ঘুরতে ঘুরতে তারা অনেক দূর চলে এসেছে।
পঞ্জাবে আব্রুর বাড়াবাড়ি নেই, নাৱীরা অনেক পরিমাণে স্বাধীন। তারা শাড়ি পরে না, ঢিলা পাজামার ওপর তার ঢলঢলে শেমিজের মতুন একটা পোশাক পরে, পায়ে দড়ি বাধা এক ধরনের জুকে। লম্বা-চওড়া পঞ্জাবি রমণীরা পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ক্ষেতি-জমির কাজ করে, হাট বাজারেও তাদের দেখা যায়। এখানকার পথে ঘাটে দস্যু-তস্করদের উপদ্রব প্রায় নেই-ই, বলতে গেলে, পরদেশিদের পঞ্জাবিরা সন্দেহের চক্ষে দেখে না, বরং সহজেই বাড়িতে ডাকে, অতিথিদের আপ্যায়ন করে। হিন্দু, শিখ ও মুসলমান এই তিন সম্প্রদায়ের মানুষই এখানে মিলে-মিশে আছে, তাদের আকার-প্রকারে বিশেষ তফাতও করা যায় না। পথে যেতে যেতে দোকানি ও সরাইওয়ালাদের কাছ থেকে গল্প শোনা যেতে লাগল যে, কয়েকদিন আগেই এই সড়ক দিয়ে এক হিন্দু সাধু গেছেন তাঁর দলবল নিয়ে, কাশ্মীরের দিকে। গেরুয়াধারী সেই সাধুটি বড় বিচিত্র, তিনি মুসলমান রমণীর কাছ থেকে জল চেয়ে পান করেছেন, মুসলমান মিঠাইওয়ালার কাছ থেকে মিঠাই কিনে খেয়েছেন পেট ভরে। অজ্ঞাতসারে নয়, জেনে শুনে, সবাইকে দেখিয়ে তিনি মিঠাইওয়ালাকে বলেছেন, তাদের মুসলমানি মিঠাই কী আছে, তাই বেশি করে দাও! সেই সাধু সম্পর্কে আরও অনেক গল্প ছড়িয়েছে লোকমুখে।
রাওয়ালপিণ্ডি থেকে মারী পার হয়ে এগোতে লাগল দ্বারিকা। পার্বত্যপথ বেশির ভাগ সময়ই নির্জন, সন্ধ্যার কাছাকাছি সময় তারা কোনও সরাইখানা দেখলে থামে। মাঝে মাঝে সরকারি ডাক বাংলোও পাওয়া যায়। ইংরেজদের প্রকৃতির সৌন্দর্যসন্ধানী চোখ আছে। ডাকবাংলোগুলি নির্মিত হয় মনোহর স্থানে, টিলার ওপরে কিংবা নদীর বাঁকে।
বসন্তমঞ্জরীর মনোভাবের তো ঠিকঠিকানা নেই, কখনও দিনের পর দিন সে ম্লান হয়ে থাকে, কথা বলতে চায় না, আবার কখনও সে হাসি-গানে মেতে ওঠে। এখন কয়েকদিন সে বেশ খোশমেজাজে আছে। অশ্বপৃষ্ঠে ভ্রমণ সে উপভোগ করছে খুব। প্রথম দু’একদিন নিশ্চিন্ত তার গায়ে ব্যথা হয়েস্থিল, তাও সে স্বীকার করবে না।
এই পথ দিয়ে বড় সাধু-সন্ন্যাসী যায়। এই সময়ে সকলেই চলেছে পুণ্যার্থ অমরনাথ দর্শন মানসে। সাধুদের মধ্যে কারুকে কারুকে দেখে ভক্তির বদলে ভয় জাগে। যদিও এখন গ্রীষ্মকাল, কিন্তু সামান্য বৃষ্টিপাতেই খুব শীত বোধ হয়, সেই শীতের মধ্যেও কোনও কোনও সাধু প্রায় নগ্নদেহে সামান্য কোপিনধারী, কেউ কেউ একেবারে উলঙ্গ। মাথায় দীর্ঘ জটা ধুলো-কাদায় মাথা, মুখমণ্ডল দাড়িতে ঢাকা থাকলেও চোখ দুটি যেন উগ্র, মায়ামমতা শূন্য।
দ্বারিকা নিষ্ঠাবান হিন্দু, সে সাধুসন্ন্যাসীদের দেখলেই প্রণাম জানায় ও ফলমুল দান করে। হাজার হাজার বছর ধরে একই রকমভাবে এই সন্ন্যাসীর দল সমস্ত রকম জাগতিক সুখ অগ্রাহ্য করে ভ্রাম্যমাণ, কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনার মধ্য দিয়ে তারা মুক্তির পথ খুঁজে চলেছে। বসন্তমঞ্জরী কিন্তু ওই সব সাধুদের দেখলেই চোখ বুজে ফেলে। তার শরীর কেপে ওঠে। দ্বারিকা কারণ জিজ্ঞেস করলে সে কাতর কন্ঠে একবার বলেছিল, দেবতার সঙ্গে দেখা করতে যাবেন তো, ওই সাধুরা অমন বীভৎস সেজে থাকেন কেন? দেবতারা কি তাতে খুশি হন। এই জগত কত সুন্দর, পথের ধারে ফুটে থাকা সামান্য ফুলও কেমন নিখুঁত রূপের পাপড়ি মেলে থাকে, তবে মানুষ কেন সুন্দর হবে না?
দ্বারিকা বলে, সুন্দরের বাহ্য রূপ আমরা মানবিক চোখ দিয়ে দেখি। আর দেবতারা দেখেন অত্মরের রূপ। এই সন্ন্যাসীরা আত্মনিগ্রহের আগুনে পুড়িয়ে পুড়িয়ে নিজেদের বিশুদ্ধ থেকে বিশুদ্ধতর করে তুলছেন, আমাদের মতন সাধারণ মানুষের পক্ষে তা সম্বব নয়। আমরা তাই সাধুদের ওপরেই বরাত দিই, সাধুসেবা করলেই আমাদের পুণ্য হয়।
তবু দ্বারিকা যখন কোনও বিশিষ্ট সাধুকে পাদ্যার্ঘ্য দেয় তখন বসন্তমঞ্জরী কাছে আসে না, জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দূরে, দৃষ্টি মাটির দিকে নিবদ্ধ। তীর্থযাত্রীর দল যখন হঠাৎ হঠাৎ জোর গলায় ধ্বনি দেয়, হর হর বোম বোম, তখনও সে কুঁকড়ে যায়। সে এমনই স্পর্শকাতর যে উচ্চনিনাদও সহ্য করতে পারে না। সে রকম কোনও বড় লল দেখলে সে থেমে গিয়ে পথের ধারে বসে পড়ে কিংবা বনের মধ্যে চলে যায়। অতি সামান্য কোনও ছিরছিরে ঝর্না দেখতে পেলে সে আর যেতেই চায় না, তখন তার দৃষ্টিতে ঝরে পড়ে মুগ্ধতা। ছেটি ছোট ঘাসফুল তুলে দু’হাতের অঞ্জলি ভরে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে।
ক্রমে তারা এসে পৌঁছল বাবমুল্লা নামে একটি স্থানে। এখান থেকে নদীপথে কাশ্মীর উপত্যকায় যাওয়া যায়। বসন্তমঞ্জরীর যদিও অশ্বারোহণে উৎসাহের ভাটা পড়েনি, কিন্তু দ্বারিকা ক্লান্তিবোধ করছে। একটা নৌকো ভাড়া করালে বেশ ধীরে সুস্থে দু’পাশের দৃশ্য উপভোগ করতে করতে যাওয়া যাবে। এখানে বজরার মত বড় বড় নৌকো পাওয়া যায়, তার মধ্যেই রান্নাবান্নার ব্যবস্থা আছে, রাত্রিবাসেরও কোনও অসুবিধে নেই।
নিজস্ব কর্মচারীদের আগেই ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে দ্বারিকা, কাশ্মীর রাজ্যে ভ্রমণকারীদের জন্য নানা রকম সুবন্দোবস্থা আছে। এ রাজ্যের রাজা হিন্দু, প্রজারা অধিকাংশ মুসলমান। মুসলমানরাও হিন্দুদের ঠাকুর-দেবতা ও শাস্ত্র সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। তীর্থযাত্রীদের পথ প্রদর্শক প্রায় সবাই মুসলমান, তারা নানা রকম গল্প শোনায়। এক দল মুসলমান বালক মেষপালক অমরনাথ শৃঙ্গের এক গুহার মধ্যে প্রকৃতির খেয়ালে গড়ে ওঠা একটি তুষারপিণ্ড দেখে ভেবেছিল, এ তো হিন্দুদের শিবলিঙ্গের সদৃশ। তাদের জন্যই অমরনাথের সেই গুহা এখন বিখ্যাত হিন্দু-তীর্থ।
নৌকোয় যাত্রা অতিশয় আরামদায়ক। নদী বেশ স্রোতস্বিনী, সারা দিন ধরে শোনা যায় জলের কল্লোল। দু’দিকের তীর প্রায় বনরাজিতে ঢাকা, মাঝে মাঝে চোখে পড়ে ছোট ছেটি গ্রাম। দ্বিতীয় দিন থেকেই দেখা যেতে লাগল ধবল তুষারমণ্ডিত একটি পর্বত শিখর। সারাদিন রৌদ্র-ছায়ায় সেই পর্বতগুলির কত রকম রং বদল হয়।
বসন্তমঞ্জরী বেশ খুশির মেজাজে আছে। মাঝে মাঝে সে গুনগুন করে আপন মনে গান গায়। এক একটি পাহাড়ের দিকে সে হাত জোড় করে প্রণাম জানিয়ে বলে, ঠিক মন্দিরের মতন, নয় গো? আহা, সত্যিই যেন আমরা দেবস্থানে এসে পড়েছি। এখানকার মানুষগুলিও কত সুন্দর।
নৌকোর চালক তিনজন, একজনের পত্নীও সঙ্গে রয়েছে, সেই রান্না করে। সরু চালের ভাত, লাউ-কুমড়োর ঘন্ট, মুগের ডাল, আর খাটি গব্য ঘৃত। জেলেদের কাছ থেকে টাটকা নদীর মাছও পাওয়া যায়। ভোজনবিলাসী দ্বারিকা নিজে দরাদরি করে প্রয়োজনের চেয়েও অনেক বেশি মাছ কিনে ফেলে। বসন্তমঞ্জরী প্রায় কিছুই খেতে চায় না, তার যেন পাখির আহার। দ্বারিকা তাকে পীড়াপীড়ি করলে সে বলে, এত ভাল লাগছে সবকিছু এত ভাল, এই সময় আমার বিশেষ কিছু খেতে ইচ্ছে করে না। বেশি খেলে ঘুম পাবে, তা হলে কত কিছু দেখতে পাব না। ওগো, তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এসে আমার জীবন ধন্য করলে।
রান্নাঘরের স্ত্রীলোকটির সঙ্গে ভাব জমাবার চেষ্টা করে বসন্তমঞ্জরী, কিন্তু ভাষার ব্যবধান বড় বাধা। বসন্তুমঞ্জরীর কোনও কথাই সে বোঝে না, সজল চোখে চেয়ে থেকে মিটিমিটি হাসে। দুধে-আলতা গায়ের রং, টিকোলো নাক, দীর্ঘ অক্ষিপল্লব, গাঢ় ভুরু। এখানকার গরিব ঘরের মেয়েরা যেন রানির মত রূপসী। কিন্তু রূপ সম্পর্কে তাদের একটুও সচেতনতা নেই। রোজ স্নান করে না। প্রসাধনের কোনও বালাই নেই, ভাল করে চুলও বাঁধে না। বসন্তমঞ্জরী সাজসজ্জা করতে ভালবাসে, সে যখন সোনা-বাঁধানো চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ায়, আমিনা নামে সেই রমণীটি অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে থাকে। বসন্তমঞ্জরী বলল, এসো, আমি তোমার চুল বেয়ে নিই। আমিনা লজ্জা পেয়ে আপত্তি জানালে বসন্তমঞ্জরী জোর করে তাকে কাছে টেনে আনে। খুব ভাল করে তার খোঁপা বেঁধে দিয়ে, তার পর চিরুনিটা গুঁজে দিয়ে বলে, এটা তুমি নাও।
পুরুষরা তবু ভাঙা ভাঙা উর্দুতে কথাবার্তা চালাতে পারে। দ্বারিকা এক সময় ফার্সি পড়েছিল, উত্তর ভারত পরিক্রমার সময় হিন্দি ও খাড়ি বোলি শুনতে শুনতে অনেকটা শিখে নিয়েছে, তার বুঝতে অসুবিধে হয় না। নৌকোর চালকরা মার্তণ্ড মন্দির, শঙ্করাচার্যের মন্দির, শাহ্ হামদান, চশমাশাহী এই সব বিখ্যাত স্থানগুলির ইতিহাস শোনায়। কিংবদন্তীর ইতিহাস। হরিপর্বত কী করে তৈরি হয়েছে জানেন? হিন্দুদের খুব বড় দেবী দুর্গামাঈ-এর সঙ্গে এক দৈত্যের লড়াই হয়েছিল, দুর্গামাঈ দৈত্যের দিকে একটা মস্ত বড় পাথর ছুড়ে মারলেন, তাতেই সেই দৈত্য চাপা পড়ে গেল। সেই পাহাড়টাই হল হরিপর্বত। তার পরে এখন দুর্গ আছে। বাদশা আকবর বানিয়েছেন সেই দুর্গ। আর ঝিলম নদীর ধারে যে পাথর মসজিদ আছে, সেটা কে বানিয়েছেন জানেন তো? বেগম নুরজাহান। ভারী সুন্দর সেই মসজিদ। কিন্তু কোনও আওরতের বানানো মসজিদে নামাজ পড়তে নেই।–মার্তণ্ড মন্দিরের জায়গাটাকে লোকে বলে মাটন। আসলে মার্তণ্ড মানে সুর্যদেব। ওই মন্দির আগে আরও অনেক বড় ছিল, খুব আফশোসের কথা, অনেক কাল আগে সিকান্দর বাতসিখান এই মন্দির বিলকুল চুরমার করতে চেয়েছিল। খোদাতাল্লার দুনিয়ায় এত জায়গা খালি পড়ে আছে, আরও কত মসজিদ বানানো যায়, হিন্দুদের মন্দির ভাঙতে হবে কেন? তাদের প্রাণে দুঃখ লাগবে না?
প্রায় এক বছর ধরে বহু বিখ্যাত স্থান দর্শন করেছে দ্বারিকা, তার মধ্যে কাশ্মীর রাজ্য যে সবচেয়ে সুন্দর শুধু তাই-ই নয়, এখানকার মানুষদের এমন সাবলীল ও আন্তরিক ব্যবহারের তুলনা নেই। নৌকা চালকরা শেষ অপরাহ্ন নৌকো থামিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে নামাজ আদায় করতে বসে, তারা নিজ ধর্মপরায়ণ, অথচ অন্য ধর্ম সম্পর্কে বিন্দুমাত্র বিদ্বেষের স্থান নেই তাদের মনে।
দ্বারিকা সঙ্গে ব্রান্ডির বোত্তল এনেছে, একটু একটু ব্র্যান্ডিতে চুমুক দেয় আর চুরুট টানে, বসন্তমঞ্জরী মৃদুস্বরে গান গায়। দুপাশে গিরিবর্ত্ম, পশ্চিম দিগন্ত রক্তিম হয়ে আসে, মাথার ওপর দিয়ে কুলায় ফিরছে পাখির ঝাঁক। গ্রীষ্মের বাতাসে ভেসে আসে অরণ্য ফুলের গন্ধ।
এক সময় গান থামিয়ে বসন্তমঞ্জরী অক্ষুটস্বরে বলল, লাল রঙের চুল!
দ্বারিকা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, কী বললে?
বসন্তমঞ্জরী বলল, দ্যাখো দ্যাখো একজন মেয়েমানুষের মাথার চুলের রং যেন জবা ফুলের মতন লাল। এমনটি আগে কখনও দেখিনি।
দ্বারিকা একটা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আধ-শোওয়া হয়েছিল, উঠে বসে ফিরে তাকাল।
নদীর এক প্রান্তে তিনটি নৌকোর একটি বহর নোঙর করে আছে। একটি বড় নৌকোর সামনের দিকে টেবিল-চেয়ার পা। চারজন বিদেশিনী মহিলা সেখানে বসে চা পান করছে। তাদের মধ্যে একজন বয়সে প্রৌঢ়া, অন্য তিনজনই যুবতী। সেই যুবতীদের মধ্যে একজনের মাথার চুল সত্যি সত্যি রক্তাভ।
দ্বারিকা বলল, মেমসাহেব। ওদের চুল নানা রকম হয়। হলদে, সোনালি, বরফের মতন সাদা। ইংরেজদের মেয়েরা এখন কাশ্মীরে বেড়াতে আসছে।
বসন্তমঞ্জরী বলল, আমি এত কাছ থেকে মেমসাহেব দেখিনি আগে। আচ্ছা, এরা বেশি ফর্সা, না কাশ্মীরিরা বেশি ফর্সা?
দ্বারিকা বলল, ইংরেজদের চোখে আমরা সবাই কালো। তুইও কালো, কাশ্মীরিরাও কালো।
বসন্তুমঞ্জরী বলল, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে, মেমসাহেবদের চেয়েও কাশ্মীরিদের মেয়েদের গায়ের রং বেশি ভাল। ফ্যাটফেটে সাদা নয়, কাঁচা হলুদের মতন।
দ্বারিকা বলল, তাদের সঙ্গে একজন পুরুষ রয়েছে দেখছি। ওই যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাল্লাদের সঙ্গে কথা বলছে। গেরুয়া লালখাল্লা পরা। কী আশ্চর্য, সাহেবের বাচ্চাও গেরুয়া ধরেছে নাকি?
বসন্তমঞ্জরী বলল, ওই লোকটিও কি সাহেব?
দ্বারিকা বলল, সাহেব না হলেও, কোনও নেটিভ কি মেমসাহেবদের অত কান্থাকাছি ভিড়তে পারবে? তা ছাড়া, দ্যাখ, লোকটা পাইপে তামাক টানছে। ছোঃ, গেরুয়ার আর জাত রইল না।
দ্বারিকাদের নৌকো খানিকটা এগিয়ে যাওয়ায় ওদের আর দেখা গেল না।
পরের দিন এই নৌকো এসে পড়ল ঝিলম নদীতে। বিখ্যাত শ্রীনগর আর বেশি দূরে নেই। পীর পাঞ্জাল পর্বতমালা যেন চতুর্দিকে ঘিরে আছে। এই নৌকোর চালকদের এত ভাল লেগে গেছে যে এখন আর তীরে গিয়ে কোনও সরাইখানায় আশ্রয় নেবার ইচ্ছে নেই দ্বারিকার। এই নৌকাতে থেকেই দর্শনীয় স্থানগুলি ঘুরে আসা যাবে। এক সময় নদী ছেড়ে নৌকোখানি প্রবেশ করল ডাল হ্রদে।
দিন সাতেক শ্রীনগর অঞ্চলে কাটাবার পর সেই নৌকো নিয়েই যাওয়া হল ইসলামাবাদ। এই স্থানাটির আর একটি নাম অনন্তনাগ। কাশ্মীর রাজ্যটির অবস্থান অনেক উর্ধ্বে হলেও পূর্ব বাংলার মতনই নদী বহুল। এক নদী থেকে অন্য নদীতে পড়ে জলপথেই বেশ ঘোরা ফেরা যায়। ঘুরতে ঘুরতে দ্বারিকারা চলে এল লিদার নদীর প্রান্তে পহলগাম নামে ক্ষুদ্র একটি গ্রামে। সামান্য গ্রাম হলেও বৎসরের এই সময়টায়, শ্রাবণী পূর্ণিমার আশেপাশে বহু মানুষের ভিড়ে গমগম করে। অমরনাথ তীর্থযাত্রা শুরু হয় এখান থেকে।
পহলগামে ভদ্রগোছের কোনও যাত্রীনিবাস বা সরাইখানা নেই, তাঁবুতে অবস্থান করতে হয়, সে জন্য প্রচুর তাঁবু ভাড়া পাওয়া যায়। দ্বারিকা আগে অমরনাথ তীর্থ পর্যন্ত যাবার কথা ভাবেনি, কাশ্মীর উপত্যকার সৌন্দর্য দর্শনই তার এতদূর আসার উপলক্ষ ছিল। কিন্তু এখানে সহস্র সহস্র যাত্রীর উন্মাদনা দেখে তারও নেশা লেগে গেল। দুর্গম অমরনাথের গুহায় মহাদেবের তুষারলিঙ্গ দর্শনের অভিজ্ঞতা এ জীবনের এক চরম সম্পদ হয়ে থাকবে। এত কাছে এসেও কি এ সুযোগ ছাড়া যায়? বসন্তমঞ্জরীও বেশ উৎসাহের সঙ্গে সায় দিল।
অমরনাথ হুট করে কেউ একা একা যায় না। বিপদসঙ্কুল পথ, অনেক লোক অত উচুতে উঠতে পারে না, পথেই মারা যায়। যেতে হয় দল বেধে, ছড়িদারদের সঙ্গে। যাতে একজন কেউ বিপদে পড়লে অন্যরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। হর-পার্বতীর খোঁজে মহর্ষি মার্কণ্ডেয় তক্ষককে এই অমরনাথ প্রেরণ করেছিলেন, এবং পথে বিপদের কথা চিন্তা করে তাকে সর্বাবিঘ্ননাশন এক দন্ড দিয়েছিলেন। সেই থেকে দণ্ড বা ছড়ি নিয়ে একজন তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে যায়। আপাতত সেই যাত্রার আরও কয়েকদিন দেরি আছে।
পহলগামের সৌন্দর্য যেন শ্রীনগর বা অনন্তনাগের চেয়েও বেশি। রাত্রিবেলা অন্য তাবুর সকলে যখন ঘুমিয়ে পড়ে, দ্বারিকাও বেশি রাত জাগতে পারে না, তখন বসন্তমঞ্জরী আস্তে আস্তে বাইরে এসে দাঁড়ায়। তাবুর মধ্যে অন্ধকারে তার যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। বাহিরে কী অনাবিল মুক্ত বাতাস। দুধ রক্তের জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে সারা আকাশ। পর্বতশৃঙ্গগুলি যেন একযোগে তাকেই দেখছে। খরস্রোতা লিদার নলীর ছলছল শব্দ সব সময় শোনা যায় অন্তরাল-সঙ্গীতের মতন। সুন্দরের এমন বিকাশের মধ্যে বসন্তমঞ্জরীর আনন্দে কান্না পেয়ে যায়। স্বপ্ন-চালিতের মতো সে একা একা ঘুরে বেড়ায়।
দিনের বেলা দ্বারিকা অমরনাথ যাত্রার কাজে জিনিসপত্র জোগাড়যন্ত্রের জন্য ব্যস্ত থাকে। বেশ কয়েক দিনের শুকনো খাবার-দাবার সঙ্গে নিতে হবে। এবং কিছু ওষুধপত্র। মালবাহক পাওয়া দুষ্কর, এ সুযোগ বুঝে তারা প্রচুর দর হাঁকে। বসন্তমঞ্জরী কখনও জুতা-মোজা পরেনি। কিন্তু প্রবল তুষারের মধ্যে তাকে এখন এসব পরাতেই হবে। শীত বস্ত্র কিনতে হল অতিরিক্ত কিছু কিছু।
বসন্তমঞ্জরী খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। সে এমনই সুখে আচ্ছন্ন হয়ে আছে যে পানাহার যেন অবান্তর ব্যাপার। তার প্রায় পাগলিনীর মতন অবস্থা। যখন তখন পাহাড়গুলির দিকে চেয়ে হাটু গেড়ে বসে আর গান গায়। ভাত কিংবা রুটি সে মুখেই তুলতে চায় না, তবে দ্বারিকা লক্ষ করেছে, গরম গরম দুধ পেলে তবু সে খানিকটা চুমুক দেয়।
চৌপাট্টির একটা দোকানে মস্ত বড় কড়াইতে সর্বক্ষণ দুধ জ্বাল দেওয়া হয়। আগে থেকে এনে রাখলে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, তাই রাত্তিরে শুতে যাবার আগে দ্বারিকা নিজে গিয়ে বসন্তমঞ্জরীর জন্য বড় এক ভাঁড় গরম দুধ নিয়ে আসে।
সন্ধে হতে না হতেই এখানে বেশ শীত পড়ে যায়। এইটুকু পথ হেঁটে আসতেই দ্বারিকার কাঁপুনি ঘরে। বসন্তমঞ্জরীকে দুধ দিয়েই সে বিছানায় ঢুকে শড়ে।
একদিন তার ফিরতে দেরি হল। নলীর দু’পারেই তাঁবু খাটানো হয়েছে, দ্বারিকাদের তাঁবু কিছুটা ওপরের দিকে। হিমেল হাওয়ার জন্য রাত হলে কেউ আর তাঁবুর বাইরে থাকতে চায় না, বসন্তমঞ্জরী একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে আছে একটা পাথরের চাঁইয়ের ওপর। দূরে একটা কোলাহল শোনা যাচ্ছে, তীর্থযাত্রীদের হর হর বোম বোম জিগির নয়, ভেসে আসছে ত্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর। গান থামিয়ে সেই দিকে চেয়ে আছে বসন্তমঞ্জরী।
দ্বারিকা দ্রুত ফিরে এসে বলল, তুমি নিশ্চয়ই আমার জন্য চিন্তুা করছিলে? একটা বিশ্রী ব্যাপার হয়েছে এখানে। কোথা থেকে এক সাধু এসেছে, তার সঙ্গে তিন-চারটে ডবকা মাগি। বলে কিনা ওদের নিয়ে অরমনাথ যাবে। আমরা আসার সময় নদীর ধারে যে কয়েকটা মেমকে এক নৌকোয় বসে চা খেতে দেখেছিলুম মনে আছে? মনে হয় সেইগুলোনই এসেছে। সাধুটা নিশ্চয়ই ভন্ড, একটায় শানায় না, তিন-চারটে সাধনসঙ্গিনী চাই! ফুর্তি মারার কি জায়গার অভাব আছে যে এখানেই আসতে হবে? এখানকার অন্য সাধুরা মহা ক্ষেপে গিয়েছে, তারা কিছুতেই তাদের তাবুর পাশে ওদের থাকতে দেবে না। মাগিগুলোন আবার খ্রিস্টান। ইংরেজ মাগিরা এসে হিন্দুদের ধর্মস্থান অপবিত্র করবে, এ বড় আস্পর্ধার কথা নয়। আজ একটা হাঙ্গামা লাগল বলে। ওই পাইপফোকা নেটিভটা এমন ঠ্যাটা, অন্য জায়গা যাবে না, এখানেই তাঁবু ফেলতে চায়। সে নাকি কোতোয়ালিতে খবর নিয়েছে। ফট ফট করে ইংরিজি বলে। ইংরিজি ভাল জানে বলেই মেমদের সঙ্গে ফুর্তি করার সুবিধে হয়েছে।
বসন্তমঞ্জরী জিজ্ঞেস করল, তুমি সেই সাধুর সঙ্গে কথা বলেছ?
দ্বারিকা বলল, না। আমি ধারেকাছে যাইনি। ছড়িদার ইউসুফ বলল, ওই সাধুটা নাকি বলেছে যে, দেখি কে আমাকে এখান থেকে সরায়। এখানেই আমার তাবু ফেলা হবে। নাগা সাধুরা তাই শুনে গজরাচ্ছে। নাগা সাধুদের জানো তো, রেগে গেলে এরা ত্রিশুল দিয়ে লন্ডভন্ড করে দেবে। তাই আমি আর এদিকে গেলুম নাকো।
বসন্তমঞ্জরী হঠাৎ আর্তকন্ঠে বলে উঠল, না, না, ওঁর গায়ে কেউ হাত না দেয়। তুমি যাও, তুমি ওঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াও। উনি ভন্ড নন।
দ্বারিকা অবাক হয়ে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল। এরপর অস্ফুট স্বরে বলল, তুমি ওকে চেনো?
ধীরে ধীরে দু’দিকে মাথা দুলিয়ে বসন্তমঞ্জরী বলল, না, চিনি না। কিছুই জানি না। কিন্তু হঠাৎ যেন এক লহমার মতন মনে হল, আমি দেখতে পেলাম, তুমি আর ওই সাধু মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছ, উনি তোমার কাঁধে হাত রেখে হেসে হেসে কথা বলছেন। তুমি নিশ্চয়ই ওকে চেনো।
দ্বারিকা বলল, তুমি দেখতে পেলে মানে? কল্পনা? আমি তো এরকম কোনও সাধুকে চিনি না? তবে কি আমাদের ভরত? সে সাধু হয়ে এসেছে এখানে?
বসন্তমঞ্জরী দ্বারিকাকে দেখছে না, তার মুখখানি একটু পাশ ফেরানো, যেন বাইরে শুন্যতার মধ্যে সে সত্যিই কিছু দেখতে পাচ্ছে চোখের সামনে। সে এবার আরও জোরে মাথা নেড়ে বলল, না, না, তিনি নন। তোমার বন্ধু ভরতকে আমি দেখেছি, একে দেখিনি, তবু যেন দেখতে পেলাম।
দ্বারিকা বলল, কী বলছিস বাসি, পাগলের মতন কথা? এরকম ভাবে কিছু দেখা যায় নাকি? তোর জ্বর হয়েছে? তুই ভুল বকছিস।
বসন্তমঞ্জরী এবার ব্যাকুলভাবে দ্বারিকার হাত জড়িয়ে ধরে বলল, ওগো, আর দেরি কোরো না, তোমার পায়ে পড়ি, তুমি যাও, ওঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াও!
দ্বারিকা সেই কাতর অনুরোধ উপেক্ষা করাতে পারল না। আবিষ্টের মতন ফিরে গেল।
সমবেত সাধুদের মধ্যে উত্তেজনা এর মধ্যে অনেক বেড়ে গেছে। অনেক যাত্রী ও তাদের সঙ্গে গলা মিলিয়েছে। খ্রিস্টান মেমদের তারা কিছুতেই এখানে থাকতে দেবে না। পাইপ-ফোকা সাধুটি নাকি রাজ প্রতিনিধির কাছে খবর পাঠিয়েছে, কিন্তু পুলিশ এলেও সাধুরা প্রতিরোধ করবে, এই ধর্মস্থান তারা অপবিত্র করতে দেবে না।
ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল দ্বারিকা। লিদার নদীর ধারে এক জায়গায় গোটা তিনেক তাবু, তক্তা, দড়ি দড়া জড়ো করে রাখা হয়েছে, মজদুররা তাঁবু খাটাতে গিয়ে সাধুদের নির্দেশে হাত গুটিয়ে সরে দাঁড়িয়েছে। দুটি বড় বড় মশাল জ্বলছে সেখানে, সেই আলোয় দেখা যায় চারজন মেমসাহেবকে, পোশাক দেখলেই বোঝা যায় তারা বেশ উচ্চ বংশীয়, মুখে সামান্য উদ্বেগের চিহ্ন থাকলেও তারা ভয় পায়নি, পরস্পর কথা বলছে মৃদু স্বরে। একটু দূরে পায়চারি করছে এক সন্ন্যাসী, গেরুয়া আলখাল্লা পরা, মাথায় একটি কালো টুপি, মুখের রং গৌরবর্ণ হলেও ভারতীয় বলে চেনা যায়। তার বীরত্বব্যঞ্জক পদচারণা দেখে মনে হয়, সে যেন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত, কিছুতেই এখানকার ভূমি ছেড়ে যাবে না।
আর একটু কাছে গিয়ে দ্বারিকা আরও চমকে ওঠল। সেই সন্ন্যাসী এখন আর ধূমপান করছে না, অনুচ্চ স্বরে একটা গান গাইছে-
ভূতলে
আনিয়া মাগো, করলি আমায় লোহাপেটা
আমি তবু কালী বলে ডাকি, সাবাশ
আমার বুকের পাটা…
এই সন্ন্যাসী বাঙালি? থমকে দাঁড়িয়ে গিয়ে দ্বারিকা বলল, নরেন দত্ত!
তার মনে পড়ল, প্রেসিডেন্সি কলেজে কিছুদিন পড়েছিল, পরে অন্য কলেজে চলে যায়, সেই নরেন দত্ত দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণ ঠাকুরের শিষ্য হয়েছিল। কয়েক বছর পর আমেরিকায় বক্তৃতা দিয়ে খুব নাম করেছে। নামটা বদলে কী যেন হয়েছে? বিবেকানন্দ? ছাত্র বয়েসে হেদুয়ার পার্কে অনেকবার দেখা হয়েছে নরেনের সঙ্গে। বয়েসে নরেন কিছুটা বড় ছিল। এর গানের গলা শুনেই মনে পড়ে গেল। নরেন কলকাতায় ফেরার পর দ্বারিকার একবার দেখা করার ইচ্ছে হয়েছিল, হয়ে ওঠেনি। গত এক বছরের কোনও খবর রাখে না দ্বারিকা। নরেন সাহেবদের দেশে বেদান্তের ঝান্ডা উড়িয়ে এসেছে। এ জন্য তার প্রতি দ্বারিকার শ্রদ্ধার ভাব আছে।
বিবেকানন্দ গান থামিয়ে মুখ ফেরাতেই দ্বারিকা বলল, আমার নাম দ্বারিকা লাহিড়ী, এক সময় তোমার গান শুনেছি অনেকবার। তুমি সিমলে পাড়ায় থাকতে না? কাছেই মানিকতলায় আমার বাড়ি ছিল।
বিবেকানন্দ ঠিক চিনতে পারলেন না, স্মিত মুখে চেয়ে রইলেন।
দ্বারিকা বলল, এখানে গণ্ডগোল হচ্ছে, সাধুরা তোমার নামে অনেক কথা বলছে, আমি বুঝতেই পারিনি যে আমাদের সেই নরেন এখানে এসেছে। ভাই মাপ করো, তোমার সন্ন্যাস জীবনে অন্য নাম হয়েছে, এখন নরেন নামে ডাকা বোধহয় উচিত হবে না!
বিবেকানন্দ এবার এগিয়ে এসে দ্বারিকার কাঁধে হাত রেখে হেসে বললেন, না, না, তুমি আমাকে নরেন বলেই ডাকতে পারো। কতদিন পর বাংলা কথা শুনে ভাল লাগল।
দ্বারিকা কেঁপে উঠল। বিবেকানন্দর স্পর্শের জন্য নয়। বসন্তমঞ্জরী এই দৃশ্যটার কথা বলেছিল। সাধু তার পরিচিত, কাঁধে হাত রেখে হেসে কথা বলবে। কোন ঘটনা ঘটার আগে কেউ সেই দৃশ্য দেখতে পারে? ভবিষ্যৎদ্রষ্টা বলে সত্যিই কি কিছু হয়।
বিবেকানন্দ মেমসাহেবদের সঙ্গে দ্বারিকার আলাপ করিয়ে দিলেন। তাদের সবার বাংলা নাম, ধীরা মাতা, জয়া, নিবেদিতা। শুধু একজন মিসেস প্যাটারসন। জয়া নামের রমণীটি দ্বারিকাকে জিজ্ঞেস করল, সাধুরা আমাদের এখানে থাকতে দেবে না কেন বলছে? যাত্রীদের মধ্যেও তো আরও মহিলা রয়েছে দেখতে পাচ্ছি।
দ্বারিকা উত্তর না নিয়ে বিবেকানন্দর দিকে তাকাল। নিচু গলায় বাংলায় বলল, মহিলা বলে নয়, এরা খ্রিস্টান বলেই সাধুরা আপত্তি করছে।
বিবেকানন্দ বললেন, কী অদ্ভুত কথা! এখানে চতুর্দিকে মুসলমানরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, মুসলমানরা সব রকম ব্যবস্থা করছে, মুসলমান ছড়িদার অমরনাথে নিয়ে যাবে, তাতে আপত্তি নেই, খ্রিস্টানের বেলায় আপত্তি?
দ্বারিকা বলল, মুসলমানরা স্থানীয় মানুষ। হিন্দুদের সঙ্গে আত্মীয়তার মতন সম্পর্ক হয়ে আছে। এরা বিদেশিনী, তার ওপর খ্রিস্টান, এদের আচার-আচরণ বিষয়ে এখানকার কেউ কিছু জানে না।
বিবেকানন্দ বললেন, আমি অমরনাথ দর্শনে যাব। এদের এতদুর সঙ্গে নিয়ে এসেছি, এখন ফিরিয়ে দেব? কিছুতেই না। দেবমন্দিরে বিধর্মীর প্রবেশ নিষিদ্ধ হতে পারে। কিন্তু এটা তো একটা গ্রাম। এখানে সব ধর্মের মানুষেরই থাকার অধিকার আছে।
দ্বারিকা কুন্ঠিতভাবে বলল, ভাই নরেন, তা বলে সাধুদের সঙ্গে একটা সংঘর্যের পথে যাওয়া কি ঠিক হবে?
বিবেকানন্দ বললেন, সংঘর্ষ আমি চাই না, কিন্তু সত্যের প্রতিষ্ঠা চাই। কাশ্মীরে সুর্যপূজারী, বৌদ্ধ, হিন্দু, মুসলমান এক সঙ্গে থেকেছে। খ্রিস্টানরাই বা পারবে না কেন?
আরও একটুক্ষণ এই রকম কথাবার্তা বলার পর হঠাৎ একটু দূরে ঘন ঘন প্রবল জোকার শোনা যেতে লাগল। ওরা মুখ তুলে দেখল, এক দীর্ঘকায় নাগা স্যাসী, এগিয়ে আসছে এদিকে। তার পরনে সামান্য কৌপিন, সর্বাঙ্গে ছাই মাখা, হাতে একটা লম্বা ত্রিশুল, মাথায় কুন্ডলি পাকানো জটা।
দ্বারিকার বুক গুরুগুরু করে উঠল। এখন পুলিশ ডেকেও কোনও লাভ হবে না। পুলিশ দিয়ে এত ক্রুদ্ধ সন্ন্যাসীদের দমন করা যায়!
বিবেকানন্দ বুকের ওপর আড়াআড়ি ভাবে দু’হাত রেখে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন।
নাগা সন্ত্রাসী কাছে এসে বিবেকানন্দর আপাদমস্তক দেখলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ বোলালেন বিদেশিনীদের মুখে। তারপর আবার বিবেকানন্দর দিকে ফিরে একটা হাত তুললেন।
বিবেকানন্দ এবার হাত জোড় করে বলেন, প্রণাম সাধু মহারাজ।
নাগা সন্ন্যাসী হিন্দিতে গম্ভীরভাবে বললেন, তোমাকে দেখেই বুঝতে পেরেছি, তুমি যোগী। তোমার যোগবিভূতি আছে। কিন্তু যখন তখন তা প্রকাশ করতে যেয়ো না। প্রথা মাত্রই ভাল নয়, কিন্তু প্রথা ভাঙতে যাওয়ার আগে অনেক বিবেচনা করতে হয়। এখানকার সন্ন্যাসীরা এই ম্লেচ্ছ স্ত্রীলোকদের কাছাকাছি থাকতে চায় না। তুমি বা জেদ করছ কেন? এই দ্যাখ, পাহাড়ের উচ্চস্থানে অনেক জায়গা খালি পড়ে আছে। তুমি সেখানে গিয়ে তাঁবু স্থাপন করে না কেন? কিছুটা দূরত্ব রাখো।
বিবেকানন্দ একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, আপনার কথা শিরোধার্য। আমি তাঁবু সরিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু মহারাজ, আমি এদের সঙ্গে নিয়ে অমরনাথের পথে অবশ্য যাব।
নাগা সন্ন্যাসী বললেন, যেয়ো। আমি থাকব তোমার পাশে পাশে। এই শ্রীলোকদের বলো, ভক্তিভরে সাধুদের সেবা করতে। তাদের তন্ডুল ও ফল দান করলে তারা খুশি হবে।
বিবেকানন্দ বললেন, এরা ভক্তি নিয়েই এসেছে। নিশ্চয়ই সাধু-সেবা করবে।
সমস্যাটা এত সহজে মিটে যাওয়ায় সকলেই খুশি হল। কিন্তু দ্বারিকা বেশ চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ল। ফেরার পথে তার মুখে লেগে এই অসন্তোষের ক্লিষ্ট ভাব। তার স্ত্রী কি মায়াবিনী? বসন্তমঞ্জরী দিন দিন কেমন যেন অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তার শরীরটা কাছে থাকে, কিন্তু মনটা ধরাছোওয়া যায় না। এ রকম এক রমণীকে নিয়ে যে ঘর করবে কী করে?
বসন্তমঞ্জরী একই জায়গায় বসে আছে। দ্বারিকাকে দেখেই সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে বলল, তোমায় চিনতে পেরেছে, তাই না? আমি ঠিক বলিনি।
দ্বারিকা কঠোরভাবে বলল, বাসি, তুই এসব কী করে বলিস, আমি জানতে চাই। তুই জাদু জানিস?
বসন্তমঞ্জরী বলল, না, না। আমি কিচ্ছু জানি না। তবু মাঝে মাঝে এমন দেখতে পাই। বিশ্বাস কর, আমি মন্ত্র-টন্ত্র কিছুই শিখিনি, তবু হঠাৎ হঠাৎ এক একটা কথা মনে আসে। তুমি যখন চলে গেলে তখন আর একটা কথা মনে এল। আমার অমরনাথ যাওয়া হবে না। জুতো, মোজা, কম্বল যা কিনেছ, সব বিলিয়ে দাও।
দ্বারিকা জিজ্জেস করল, কেন অমরনাথ যাওয়া হবে না? আমি সব ব্যবস্থা করেছি। নরেননের দলের সঙ্গে সঙ্গে যাব।
বসন্তমঞ্জরী বলল, অমরনাথ যদি যাই, তবে আমি আর তোমার স্ত্রী থাকব না। আমি হারিয়ে যাব। আমি মহামায়ার মধ্যে মিলিয়ে যাব।
উঠে দাঁড়িয়ে দুহাত ছড়িয়ে সে বলল, এই যে এত নির্মল আকাশ, মহান মহান পাহাড়, এত ফুল, এত সুন্দর গন্ধ, এই সুন্দর আর আমার সহ্য হচ্ছে না। এস্থানে আর বেশিদিন থাকলে সত্যিই আমি হারিয়ে যাব। আমাকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে চলো। সেখানে পাহাড় নেই, এমন বন-জঙ্গলের পাগল করা গন্ধ নেই। সেখানে বাড়ির ঘাড়ে বাড়ি, মানুষের ঘাড়ে মানুষ, সব সময় চেচামেটি, রাস্তায় কাদা, গাড়ি ঘোড়ার কর্কশ শব্দ, সন্ধেবেলা উনুনের ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় জ্যোৎস্না রাত দেখা যায় না, মানুষ মানুষের সঙ্গে ঝগড়া, মারামারি করে, নিন্দে করে, আমাকে সেখানে ফিরিয়ে নিয়ে যাও। সেখানে গেলে আমি আবার সাধারণ হয়ে যাব, তোমার বউ হয়ে থাকব, তোমার পদসেবা করব। ওগো আমায় ফিরিয়ে নিয়ে চলো—