1 of 2

০৭. রামবাগানে গঙ্গামণি

রামবাগানে গঙ্গামণি নিজে একটি বাড়ি কিনেছে। বাড়িটি ত্রিতল হলেও বিশেষ বড় নয়, ওপরতলায় একটি মাত্র ছোট ঘর। গঙ্গামণির যত না বয়েস হয়েছে, সে তুলনায় তার রূপ ঝরে গেছে অনেক বেশি। কোমরের পরিধি যদি বুককে ছাড়িয়ে যায় তা হলে সে রমণীর পক্ষে আর যা-ই। হোক মঞ্চে দাঁড়াবার কোনও যোগ্যতা থাকে না। গঙ্গামণি বুঝে গেছে যে থিয়েটারের জগৎ থেকে তার বিদায় নেবার দিন ঘনিয়ে এসেছে।

এক বছর আগেও সে ইচ্ছে মতন থিয়েটার বদল করতে পারত, স্টার কিংবা এমারাচ্ছে তার খাতির ছিল। মেদ বৃদ্ধি শুরু হবার পর সে কম কৃচ্ছ্রতা সাধন করেনি, মদ ছুঁত না, খাওয়া দাওয়াও সব প্রায় বন্ধ, প্রতিদিন গঙ্গাস্নানের পর আহিরীটোলার কালী মন্দিরে গিয়ে হাতে দিয়ে পড়ে থাকত কয়েক ঘণ্টা। কিছুতেই কিছু হবার নয়। সবাই বলত, ও তোর মায়ের পাত, তোর মা যে ছিলেন আড়াই মনি ঘণ্টেশ্বরী।

আগে সে যে কোনও নাটকে আট-দশখানা গান গাইত, বিল্বমঙ্গলে তার গান কী জনপ্রিয়ই হয়েছিল, এখন নেচে নেচে একখানা গান গাইতেই সে হাঁপিয়ে যায়। মাস দুয়েক ওজন কমাবার চূড়ান্ত চেষ্টার পর সে হাল ছেড়ে দিয়েছে। এখন সে আবার সব কিছু খায়। সর্বক্ষণ এটা খাব না, ওটা খাব না ভাবলে কি মনের সুখ থাকে? গঙ্গামণির স্বভাবটাই যে হাসিখুশি ধরনের। তার রান্নার খুব শখ, ঘনিষ্ঠ মানুষজনদের সে বেঁধে খাওয়াতে ভালবাসে। গিরিশবাবু প্রায়ই তার হাতের রান্না খাওয়ার জন্য আবদার করতেন।

জমানো টাকায় গঙ্গামণি এই বাড়িটি কিনেছে, যাতে ভবিষ্যতে একেবারে নিরাশ্রয় না হতে হয়। এর আগে গোয়াবাগানে একটি বাড়ি ভাড়া করে তাকে রেখেছিল এক বাবু, সেই বাবুটি কিছু না বলে কয়ে হঠাৎ একদিন সরে পড়েছে, সে নাকি চলে গেছে পাঞ্জাবে। আর কোনও ফুলবাবু তার প্রতি আকৃষ্ট হবে না, তা গঙ্গা জানে, সে আর ও সবের চেষ্টাও করেনি, নিজের বাড়িতে নিশ্চিন্তে খাবে দাবে ঘুমোবে। সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল।

গঙ্গামণির মনটি নরম। যে-ই সে বাড়ি কিনেছে, অমনি কোথা থেকে তার কতকগুলি পুষ্যি জুটে গেছে। গঙ্গামণি কারুকে ফেরায় না। কুসুমকুমারী (খোঁড়া), হরিমতী (ডেকচি), টুন্নামণি, কিরণশশী, (ছোট), এই রকম যারা ছোটখাটো পার্ট পায়, মাইনের টাকায় নিজস্ব বাড়ি রাখতে পারে না, অথচ বাঁধা বাবুও নেই, তারা এসে ধরেছিল। গঙ্গামণি তাদের একতলার ঘরগুলোয় থাকতে দিয়েছে। দোতলায় সে থাকে, তার নিজের ছেলেপুলে নেই বলে রাস্তা থেকে তিনটি হা-ভাতে ছেলে-মেয়েকে কুড়িয়ে এনে রেখেছে নিজের কাছে, আর আছে তার সাতখানা বেড়াল।

সন্ধে হলে গঙ্গামণি ওই অল্পবয়েসী ছেলে তিনটিকে নিয়ে নাচ-গান শেখাতে বসে। তার গানের গলা এখনও চমৎকার, এই শরীর নিয়েও সে নাচে। একটি ন বছরের ছেলের হাত ধরে নাচতে নাচতে সে গান ধরে;

গুটি গুটি ফিরবো বনে দুটি
লতা ছিঁড়ে তোর বাঁধবো ঝুটি
তোর কানে দোলাবো লো ঝুমকো ফুল
কত ডাকে বুলবুল
কোয়েলা দোয়েলা মিঠিমিঠি…

ছেলেমেয়ে তিনটিকে সে প্রায়ই বলে, একটু আড় ভাঙলে তোদের থিয়েটারে ঢুকিয়ে দেব। তখন নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াবি, কপালে যদি থাকে, অনেক রোজগার করবি। তাই তো বলি, মন দিয়ে শেখ!

তারপর একটা বেড়ালছানাকে কোলে তুলে আদর করতে করতে বলে, তোদের আমি থিয়েটারে ঢোকাতে পারব না। আমি চক্ষু যুঁজলেই তোদের গতি হবে রাস্তায়।

তিনতলার ঘরখানি সে দিয়েছে নয়নমণিকে। এ মেয়েটিকে গঙ্গামণি বিশেষ পছন্দ করে। এতদিনের থিয়েটার-জীবনে গঙ্গামণি এমন মেয়ে দেখেনি। গঙ্গামণির পাকা চোখ, এমারাল্ড থিয়েটারে থাকার সময় যখন অর্ধেন্দুশেখর একদিন এই নয়নমণিকে এনে একটা ছোট পার্ট দিয়েছিলেন, তখনই বোঝা গিয়েছিল এ মেয়ে কালে কালে হিরোইন হবে। নাচতে জানে, গান জানে, থিয়েটারের বই-খবরের কাগজ গড়গড়িয়ে পড়তে পারে, তবু সে সব সময় আড়ালে থাকতে চায়। এ আবার কেমন ধারা স্বভাব! শুধু কি গুণ থাকলেই হয় রে বাপু, এ লাইনে ওপরে উঠতে গেলে ম্যানেজার-মালিকের গা ঘেঁষাঘেঁষি করতে হয়, পা টিপে দিতে হয়, অনেক সময় গতর খাটাতেও হয়। লাইনটাই যে এ রকম। যে বিয়ের যে মন্তর! এ মেয়েটা সে সব কিছুই করে না, কোথায় যে সুরুৎ করে লুকিয়ে পড়ে, টের পাওয়াই যায় না। মহেন্দ্রলাল বোসের মতন অত বড় নাম করা হিরো, তিনি একদিন বললেন, বরানগরের এক বাগানে এক বড়মানুষ মোচ্ছবের ব্যবস্থা করেছেন, আকট্রেসদের সবাকার সেখানে নেমন্তন্ন, নাচতে গাইতে হবে! সবাই গেল, শুধু নয়নমণি গেল না! মহেন্দ্রলালকে চটালে ও কোনও দিন বড় পার্ট পাবে?

গঙ্গামণিকে এ পদ্ধতিতেই ওপরে উঠতে হয়েছিল। কিন্তু নয়নমণি যে এ সব কিছুই করতে রাজি হয় না, সেই জন্যই ওকে গঙ্গামণির বেশি ভাল লাগে। চুপচাপ থাকে মেয়েটা, বিশেষ কথাই বলে না, তবু ভেতরে ভেতরে এত তেজ! মেয়েমানুষের তেজ কি কেউ সহ্য করে? ছুঁড়ে আস্তাকুড়ে ফেলে দেয়। ওই তো বিনোদিনী কত দেমাক দেখিয়েছিল, এখন কোথায় গেল সে।

এক একদিন রাতের দিকে গঙ্গামণি ওপরে উঠে আসে।

একখানি ছোট ঘর ছাড়া স্নানের জায়গা নেই, রান্নার জায়গা নেই। গঙ্গামণি কতবার বলেছে, তোকে একতলার ঘর দিচ্ছি, সেখানে ও সব সুবিধে আছে, নয়নমণি তবু যাবে না, এই ছাদের ঘরেই সে থাকতে চায়। কলসি ভরে ওপরে জল টেনে আনে, একটা তোলা উনুনে রান্না করে। ঝড় বাদলার সময় কতই না কষ্ট হয়, কিন্তু কে শোনে কার কথা!

একতলার ঘরগুলির সঙ্গে তিনতলার এই ঘরখানির অনেকটা তফাত! যে সব রাতে থিয়েটার থাকে না, সে সব রাতে কুসুম, ডেকচি, টুনাদের ঘরে ছেলে-ছোকরারা ফুর্তি করতে আসে। ঘুঙুরের আওয়াজ আর হাসির হর-রা ছোটে। ঝনঝন শব্দে কাচের গেলাস ভাঙে। গঙ্গামণি আপত্তি করে না। সে নিজেও তো কিছুদিন আগে পর্যন্ত ওই রকম জীবনই কাটিয়েছে, সে আপত্তি করবে কোন মুখে? তা ছাড়া ফুর্তির সঙ্গে সঙ্গে মেয়েগুলো যদি দুটো বাড়তি পয়সা রোজগার করে তো করুক না! যে সব মেয়ে শ্বশুর-শাশুড়ি-স্বামীর সংসারে থাকার ভাগ্য করে আসেনি, সমাজ যাদের বংশানুক্রমে পতিত করে রেখেছে, সে সব মেয়েদের রূপ-যৌবনই তো আসল। আর এ রূপ-যৌবন তো পদ্মপাতার ওপর জলের ফোঁটা, কখন শেষ হয়ে যায় তার ঠিক নেই, তারপর আর কেউ পুঁছবে না। ওরা দুটো পয়সা জমাতে পারলে আখেরে কাজে লাগবে।

নয়নমণির ঘরে কখনও কোনও পুরুষ মানুষ আসে না। থিয়েটারে কোনও পুরুষের সঙ্গেই তার বিশেষ সখ্য নেই, দুনিয়ার আর কারুকেই যেন সে চেনে না। সারাদিন আপন মনে থাকে। তার ঘরের বিছানায় সব সময় ফর্সা ধপধপে চাদর পাতা। দেয়ালে কোনও ছবি নেই, শুধু ঘরের এক কোণে একটি বেশ বড় মাটির মুর্তি রয়েছে, বংশীধারী কৃষ্ণ। সেই মূর্তিই যেন নয়নমণির একমাত্র পুরুষ সঙ্গী। গঙ্গামণি এক একদিন এসে দেখেছে, সেই মূর্তির সামনে নয়নমণি আপনমনে বিভোর হয়ে নেচে চলেছে।

একতলার মেয়েদের কাছ থেকে ঘর ভাড়া হিসেবে গঙ্গামণি পাঁচ-দশটাকা নেয়। ভাড়াটেরা খুব বেশি উচ্চণ্ডে হলে তাড়িয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু মিনি-মাগনার আশ্রিতরা একেবারে কাঁঠালের আঠার মতন সেঁটে থাকে। কিন্তু ওপরতলার এই মেয়েটিকে গঙ্গামণির এমনই মনে ধরেছে যে সে তাকে নিজের মেয়ের মতন কাছে রাখতে চেয়েছিল। পয়সার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু ও মেয়ের আত্মসম্মান জ্ঞান অতি টনটনে, কিছুতেই বিনা পয়সায় থাকবে না, জোর করে দশটা করে টাকা সে গঙ্গামণির খাটের ওপর রেখে আসে। গঙ্গামণি প্রস্তাব দিয়েছিল, ওপরে রান্নাঘর নেই, নয়নমণির রান্না করারই বা কী দরকার, সে দোতলায় গিয়ে খাবে। তাতেও রাজি নয় নয়নমণি। তাকে এত করে কাছে টানতে চাইলেও সে কাছে আসে না।

এই প্রত্যেকটি ব্যাপারের জনাই গঙ্গামণি আরও বেশি পছন্দ করে নয়নমণিকে। নিজের জীবনে সে যা যা পারেনি, এই মেয়েটি সেইগুলিই অবলীলাক্রমে পেরে যাচ্ছে দেখে সে বিস্মিত হয়ে যায়। নয়নমণি যেন তার চোখ খুলে দিয়েছে, নিজের ব্যর্থতাগুলি সে এখন যাচাই করে দেখছে। পুরুষমানুষদের বাদ দিয়েও যে কোনও মেয়ে একা একা বেঁচে থাকতে পারে, এ ধারণাই যে তার ছিল না। গঙ্গামণির জীবনে কতবার পুরুষ বদল হয়েছে, সে তার ইচ্ছে অনুযায়ীও নয়, পুরুষরাই একজনের কাছ থেকে আরেক জনের কাছে তাকে ছুঁড়ে দিয়েছে, তার ভাল লাগা বা মা লাগার প্রশ্নই ছিল না, সে ধরে নিয়েছিল, এটাই তার নিয়তি। বাচ্চা বয়েসে থিয়েটারে নামার পর এক সময় তার মা বেশি টাকার লোভে লাহোরের এক ব্যবসায়ীর কাছে তাকে বেচে দিতে চেয়েছিল, সেই একবারই প্রতিবাদ জানিয়ে খুব কান্নাকাটি করেছিল গঙ্গামণি, থিয়েটারের নেশা তার রক্তে ঢুকে গিয়েছিল। থিয়েটার সে ছাড়তে পারবে না। থিয়েটার সে ছাড়ল না বটে, কিন্তু সে আমলে অভিনয় করে কটা পয়সাই বা পাওয়া যেত? কোনও নাটক দর্শকদের মনোরঞ্জনে ব্যর্থ হলে ম্যানেজারবাবু তার হাতে এক টাকা দু টাকা গুঁজে দিয়ে বলতেন, এই দিয়ে এ মাসটা চালিয়ে নে। থিয়েটারের মেয়েদের বাঁচিয়ে রাখত বাঁধা বাবুরা। স্রোতের ধাক্কায় বাসি ফুলের মতন ভাসতে ভাসতে কেটে গেল অনেকখানি জীবন।

যারা বঞ্চিত, তারা চোখ মেলে বেশিদূর তো দেখতে পায় না, তাই নিজেদের মধ্যেই কাড়াকাড়ি করে। থিয়েটারের মেয়েবাও ভারী কুঁদুলে হয়, পরম্প আকচা-আকচি, লাগানি-ভাঙানি, কামড়াকামড়ি করেই তারা মরে। গঙ্গামণি নিজেও এই খেলায় মেতেছিল। পুরনো স্টারে থাকবার সময় সুকেশিনী নামে একটা উনুনমুখী তাঁকে এমন হিংসে করত যে মনে হত যেন দৃষ্টি দিয়েই তাকে পুড়িয়ে ফেলবে, তা গঙ্গামণি একবার এমন প্যাঁচ কষল যে সে একেবারে থিয়েটারের জগৎ থেকে হারিয়েই গেল। বিনোদিনী কি গঙ্গামণিকে বিদায় করে দেবার কম চেষ্টা করেছিল? বিনোদিনীকে সরিয়ে দিয়েছে বনবিহারিনী, তার সঙ্গে সঙ্গে তাল দিয়েছিল গঙ্গামণি।

কিন্তু এ মেয়েটা কোনও কূটকচালের মধ্যে না গিয়েও কী করে পারে? লেডি ম্যাকবেথের পার্টে নয়নমণি সাতখানা ক্ল্যাপ পেয়েছিল, তিনকড়ি মাত্র তিনবার পেয়ে নাম সার্থক করেছে। নয়নমণি তবু ওই পার্ট স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিল? বাইরের লোক না জানুক, সব কটা থিয়েটারের লোক তো জেনেছে, তারা নড়েচড়ে বসে জিজ্ঞেস করছে, এ মেয়েটা কে? তিনকড়িও নতুন এসেছে, কিন্তু তার পেছনে একজন বড় মানুষ আছে, তাকে সরানো সহজ নয়। কিন্তু প্রমদাসুন্দরী নয়নমণিকে সুনজরে দেখেনি, তার চোখ টাটাচ্ছে, নয়নমণিকে ঠেকনো দেবার কেউ নেই জেনে গিয়ে সে নয়নমণিকে আর ওপরে উঠতে দেবে না ঠিক করেছে। এই নিয়ে নয়নমণিকে যতবার সাবধান করতে যায় গঙ্গামণি, ততবারই মেয়েটা হাসে। সেই হাসির শব্দ শুনলেই গঙ্গামণির বুকের মধ্যে ধকধক শব্দ হয়। সে কেন সারাজীবনে অমন ভাবে হাসতে পারেনি? সে কেন উঠতে পারেনি ঈর্ষা, হিংসা, ললাভের উর্ধ্বে? আহা, আবার যদি নতুন করে জীবনটা শুরু করা যেত।

একদিন পরে এসে নয়নমণিকে একা একা সেই ঠাকুরের মূর্তির সামনে নাচতে দেখে গঙ্গামণি ভয় পেয়ে গিয়েছিলু! মেয়েটা নাচছে তো নেচেই চলেছে, কোনওদিকে হুঁশ নেই, বাহ্যজ্ঞানই নেই। থিয়েটারের যেমন তেমন নাচ নয়, এ নাচ অন্যরকম, গঙ্গামণি আগে কখনও দেখেনি। সে ঘরের মধ্যে ঢুকে নয়নমণির হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, হা লা, নয়ন, তুই যে ঘরের মধ্যে কেই ঠাকুরের মূর্তি রেখেছিস, তাতে আমাদের পাপ হবে না?

নয়নমণি তার সরল বিস্ময়মাখা ডাগর চোখদুটি গঙ্গামণির মুখের ওপর নাস্ত কয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, কেন গো, দিদি, পাপ হবে কেন?

গঙ্গামণি বলেছিল, ঠাকুর রাখলে নিত্য পূজো করতে হয়। সে ভাগ্য করে কি আমরা জন্মেছি? কোনও পুরুত মশাইও আমাদের বাড়িতে আসবে না।

নয়নমণি আবার দু হাতে নাচের মুদ্রা দেখিয়ে বলেছিল, এই তো আমাদের পুজো। ঠাকুর এই পুজোতে খুশি হবেন না!

গঙ্গামণি থুতনিতে আঙুল দিয়ে বলেছিল, শোনো মেয়ের কথা! এই নাকি পুজোর ছিরি! নেচে নেচে পুজো হয়!

নয়নমণি হাসতে হাসতে গঙ্গামণিকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, পুরুত ঠাকুর যখন মন্দিরে পুজো করেন, তখন ভাল করে দেখনি? এক হাতে ঘন্টা আর এক হাতে পঞ্চ প্রদীপ নিয়ে নেচে নেচে আরতি করেন, তা সেটাও তো নাচই হল।

–দুর মুখপুড়ি! পুরুত ঠাকুরের সঙ্গে আমাদের তুলনা! আমরা কি মন্ত্র-তন্ত্র জানি, না তাতে আমাদের অধিকার আছে?

—আমি গান করি। তুমিও তো ভাল গান জানো। সেই গানই তো আমাদের মন্ত্র!

–আমাদের ও সব করতে নেই রে, আমরা যে পতিত। আমাদের জীবন পাপের জীবন, তুই তার ওপর আবার কেন পাপের বোঝা বাড়াচ্ছিস?

—ও দিদি, ভগবান কি সকল মানুষের জন্য নয়? শুধু বামুনকায়েতদেরই ভগবান? তবে তাঁর সৃষ্টিতে এত সব অন্য জাতের মানুষ এল কী করে? আমাদের কেষ্ট ঠাকুর কি গয়লার ঘরে মানুষ হননি? ভগবানের চোখে মানুষের উচ্চ-নীচ কিছু নেই।

কথা বলার সময় নয়নমণি এমন করে হাসে যে তার ওপর রাগ করা যায় না।

আর একদিন সে একটা চমকপ্রদ কথা বলেছিল।

মঞ্চে যখন একসঙ্গে পা ফেলে হাসে-কাঁদে, নাচে-গায়, তারা সবাই সকলের পূর্ব পরিচয় জানে। কে কোথা থেকে এসেছে, কার মায়ের কী পেশা ছিল তা আর জানতে বাকি নেই। কিন্তু নয়নমণি কিছুতেই তার আগের কথা বলতে চায় না, শত প্রশ্ন করলেও সে শুধু বলে আমি রাস্তার মেয়ে, আমাকে একজন রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনে থিয়েটারে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে।

গঙ্গামণি একদিন তাকে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করেছিল, তুই রাস্তায় কোথা থেকে এলি? রাস্তায় তো জন্মাসনি! তোর মা কোথায় গেল? তোর এই কাচা বয়েস, তোর খোঁজে তোর আপনজন কেউ কখনও আসে না কেন?

নয়নমণি হাসতে হাসতে বলেছিল, আমি টুপ করে আকাশ থেকে খসে পড়েছি। কিন্তু আমি তোমাদের মতন পতিত নই। আমি ভগবানের সন্তান। তোমরা সব সময় নিজেদের পতিত পতিত বলো কেন গো?

গঙ্গামণি বলেছিল, আমরা তো তোর মতন আকাশ থেকে খসে পড়িনি। আমার মা ছিল, মা থিয়েটারে সখী সেজেছিল কিছুদিন। কিন্তু আমার বাপ নেই। তাই জন্ম থেকেই পতিত।

নয়নমণি বলেছিল, কী যে বলো! বাবা আর মা, এই দুজন না থাকলে কি পৃথিবীতে কেউ জন্মাতে পারে নাকি?

গঙ্গামণি বলেছিল, সে একটা পুরুষ মানুষ ছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু সে মিনসেটা যে নিজের পরিচয়টা আমাকে দেয়নি। আমার মাকে ফেলে পালিয়েছিল।

নয়নমণি বসেছিল, তা হলে তোমার বাবা একজন ছিল ঠিকই। সে তোমার মাকে বিয়ে করেনি। সমাজের কাছে তোমাকে নিজের সন্তান বলে পরিচয় দেয়নি। তুমি যখন আমেছিলে, তখন কি এ সব কিছু জানতে? তোমার বাবা আর মায়ের বিয়ে হয়নি, এই জেনে কি তুমি পৃথিবীতে এসেছিলে? আসনি, তাই না? তা হলে তোমার তো কোনও দোষ নেই। বাপ-মা যদি বিয়ে না করে, সমাজের চোখে কোনও দোষ করে, তার জন্য সন্তান দায়ি হতে যাবে কেন? সন্তান কেন সারাজীবন বে-জন্ম হয়ে থাকবে? দিদি, তুমি নিজেকে আর কক্ষনও পতিত বলবে না, পাপী বলবে না।

নয়নমণিকে জড়িয়ে ধরে সেদিন কেঁদে ফেলেছিল গঙ্গামণি। এমন কথা অল্প বয়েসে তাকে কেন কেউ বলেনি। তা হলে সে লম্পটদের খেলার সামগ্রী হত না, মাথা উঁচু করে একা দাঁড়াতে পারত। এ জীবনটা বৃথা গেল!

গঙ্গামণি সব সময় নয়নমণিকে আগলে রাখতে চায়। তার নিজের জীবনে সে যা পারেনি, এই মেয়েটা যেন তা পারে। এই মেয়েটা ওর তেজ নিয়ে বাঁচুক। প্রমদাসুন্দরী হতচ্ছাড়িট; যদি নয়নমণির কোনও ক্ষতি করার চেষ্টা করে, তা হলে সে প্রমদার চোখ গেলে দেবে। তাতে পুলিশ যদি তাকে ফাটকে পুরে দেয় তো দিক।

একদিন বিকেলে তিনজন ভদ্রলোক সোজাসুজি উঠে এল দোতলায় গঙ্গামণির কাছে। এদের মধ্যে নীলমাধবকে চেনে গঙ্গামণি, স্টার থেকে কয়েকজনকে দল ভাঙিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বীণা থিয়েটারে। আর দুজন নতুন, তাদের মধ্যে একজনের হাতের আঙুলে দুটো হিরে আর একটা পোখরাজের আংটি দেখে মনে হয় বেশ শাঁসালো মক্কেল।

নীলমাধব বলল, গঙ্গা, তুই বাড়ি কিনে আখড়া খুলেছিস শুনে দেখতে এলুম। তা বেশ বাড়িটি। শুনলুম, তোর এক পুরনো বাবু বেশ সস্তাতেই দিয়েছে। এক বাক্স সন্দেশ এনেছি তোর জন্য, আমাদের চা খাওয়াবিনি?

দৃশ্যটি পরিচিত। যখনই কোনও দলের নাটক বেশ জমে ওঠে, তখনই অন্য দলের দালালরা দু চারজন অভিনেতা-অভিনেত্রীকে বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে অন্য স্টেজে নিয়ে যেতে চায়। গঙ্গামণির জীবনে এ রকম অনেকবার ঘটেছে। বিশেষত বিল্বমঙ্গল পালায় পাগলিনীর ভূমিকায় গান গেয়ে তার যখন খুব নাম হয়েছিল, তখন দুতিনটে দলে টানাটানি পড়ে গিয়েছিল তাকে নিয়ে।

কিন্তু এখন তো গঙ্গামণির কোনও দাম নেই,কেউ তাকে ডাকে না, মিনাভও তাকে দুটি করে দিয়েছে। হঠাৎ কি আবার তার কপাল খুলল? এদের পালাতে কোনও মোটাসোটা মেয়েছেলের ভূমিকা আছে বুঝি? অনেক সময় এ রকম দু-একটা হাসির দৃশ্য লাগে। সে রকম যদি নেচেদে লোক হাসাবার মতন ছোট ভূমিকা হয়, তাতে গঙ্গামণি রাজি হবে না, তার অত পয়সার দরকার নেই!

চা খেতে খেতে পুরনো কালের গল্প হতে লাগল। আগন্তুকরা আসল কথাতে আর আসেই না।

গঙ্গামণি নিজেই একসময় নীলমাধবকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কোন বোর্ডে আছেন গো এখন?

নীলমাধব বলল, আমরা বেশ কয়েকজন এমারান্ডে যাব ঠিক করেছি। আবার চাঙ্গা করে তুলব। তুই তো এমারাল্ড ছিলি এক সময়, তোর নিশ্চয়ই টান আছে এখনও? এখন এমারাল্ড নাম হলেও এ তো আমাদের সেই পুরনো স্টার, এর ওপর আমাদের মায়া যায় কখনও?

গঙ্গামণি জিজ্ঞেস করল, কার বই?

নীলমাধব বলল, রবিবাবুর লেখা। তুই বোধহয় এর নাম শুনিসনি?

গঙ্গামণি দু দিকে মাথা নাড়ল। থিয়েটার করা ছাড়লেও সব স্টেজের খবরাখবর সে রাখে। সে জানত, এমারাচ্ছে অতুলকৃষ্ণ মিত্তির এখন নাটক লিখছে। রবিবাবুর নাম সে শশানেনি।

নীলমাধব বলল, জ্যোতিবাবু মশাইয়ের কথা মনে আছে? সরোজিনী…

গঙ্গামণি কপালে দু হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করে বলল, তাঁর কথা মনে থাকবে না? সাক্ষাৎ যেন রাজপুত্তুর। অমনটি আর দেখিনি।

নীলমাধব বলল, এই রবিবাবু সেই জ্যোতিবাবুরই ভাই, ঠাকুরবাড়ির ছেট রাজপুর। এর ‘রাজা-রানী’ কিছুদিন জমেছিল, এখন নামানো হবে ‘রাজা বসন্ত রায়। খুব জমবে, অনেক গান আছে।

গঙ্গামণি জিজ্ঞেস করল, আমার কটা সিন আছে?

এবার নীলমাধব অন্য দুজন সঙ্গীর মুখের দিকে তাকাল। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ইয়ে, গঙ্গা, এই নাটকে ঠিক তোর যোগা কোনও রোল নেই, তোকে তো ছোটখাটো এলেবেলে পার্ট দেওয়া যায় না। আমরা ভেবে রেখেছি, পরের নাটকে তোর জন্য বড় রোল থাকবে, অনেকগুলো গান, অডিয়েন্স তোকে দেখলেই গান আশা করবে!

গঙ্গামণি একটু বিস্মিত ভাবে জিজ্ঞেস করল, এই যে বললে, এ নাটকেও অনেক গান আছে

নীলমাধব তাকে বাধা দিয়ে বলল, সে ব্যাটাছেলের, সে ব্যাটাছেলের গান। আর একটা অল্পবয়েসী মেয়ের, মানে, তার চেহারাটা মানানসই হওয়া চাই। তাই বলছিলুম কী, গঙ্গা, তোর বাড়িতে মিনার্ভা বোর্ডের একটা মেয়ে থাকে, নয়নবালা না কী যেন নাম, সে তো ভাল আকটিং করে, তিনকড়ির বদলে এক নাইটে লেডি ম্যাকবেথের পার্ট করল, তাকে দেখে থ হয়ে গেছি! নতুন মেয়ে, গিরিশবাবুর সঙ্গে টক্কর দিয়ে লড়ে গেল! ও মেয়ের মধ্যে আগুন আছে রে! শুনেছি তার বেশ গানের গলাও আছে। সে মেয়েটাকে একবার ডাকবি? একটু কথা বলব–

ও হরি! এই ব্যাপার। এরা গঙ্গামণির জন্য আসেনি! এতক্ষণ ধানাই পানাই করছিল, আসলে এরা নয়নমণিকে ধরতে এসেছে।

এক বছর আগে হলেও গঙ্গামণি দপ করে জ্বলে উঠত, এই লোকগুলোকে ঝেটিয়ে বিদায় করে দিত।

কিন্তু এখন গঙ্গামণির মুখে হাসি ফুটে উঠল। একটুর জন্য দুর্বল হয়ে পড়েছিল সে, এই লোকগুলোকে দেখে সে ভেতরে ভেতরে থিয়েটারের টানে নেচে উঠেছিল, ফুট লাইটের টান যে বড় মায়ার টান, ভেবেছিল বুঝি ফিরে এসেছে তার যৌবন! কিন্তু ও যে আর ফেরার নয়। উইংসের পাশে দুরুদুরু বক্ষে আর তার দাঁড়ানো হবে না এ জীবনে, তা তো সে মেনেই নিয়েছে!

আর কোনও মেয়ের নাম শুনলে সে মুখ ঝামটা দিয়ে বলে দিত, তা তার কাছেই যাও না, আমার কাছে মরতে এসেছ কেন? কিন্তু এ যে নয়নমণি! তার যদি উন্নতি হয়, তাতে গঙ্গামণির সুখের পরিসীমা থাকবে না!

সে বলল, ও মেয়ে বড় খেয়ালি! নীলমাধব বলল, একবার তাকে ডাক না। মিনার্ভায় সে কত পায়? বড় জোর কুড়ি-পঁচিশ? আমরা তাকে একশো টাকা দেব, বছরে পাঁচশো বোনাস, থিয়েটারের গাড়ি এসে তাকে নিয়ে যাবে, পৌঁছে দেবে–

সিঁড়ি ভেঙে দৌড়ে ওপরে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে গঙ্গামণি বলল, ও নয়ন, শিগগির একটা ভাল শাড়ি পরে নে। তোর কপাল ফিরে গেছে। অন্য থিয়েটারের বাবুরা বাড়ি বয়ে তোকে চাপ দিতে এসেছে, অনেক টাকা দেবে, বড় পার্ট দেবে। তুই হিরোইন হবি।

নয়নমণি আড়ষ্ট হয়ে গিয়ে বলল, ও দিদি, আমি অন্য থিয়েটারে যাব কেন? গিরিশবাবু বকবেন যে!

গঙ্গামণি ধমক দিয়ে বলল, আ মর, এ ছুঁড়িটার দেখছি কিছুতেই জ্ঞানগম্যি হল না। গিরিশবাবু আবার কী বলবেন? থিয়েটারে নাচতে এসেছিস, কোনও বোর্ডের কাছে বাধা থাকতে নেই। যে বড় পার্ট দেবে, তার কাছেই চলে যেতে হয়। পার্টটাই বড় কথা, তাতেই তো মানুষে চেনে। তাই না? দর্শকরাই ভগবান। যত ক্ল্যাপ পাবি, তত তোর দর বাড়বে। মিনার্ভায় ছেলে সেজে কতদিন কাটাবি? গিরিশবাবুর কথা বলছিস, দেখবি তিনিই কবে ফুরুৎ করে উড়ে গেছেন। আজ মিনার্ভায়, কাই হয়তো চলে যাবেন অন্য থিয়েটারে। কতবার যে উনি কম্পানি বদলেছেন তা কি আমরা জানি না? নে, নে, ওঠ, মুখটা ধুয়ে নে।

গঙ্গামণি একপ্রকার জোর করেই নয়নমণির আটপৌরে শাড়ি ঘুড়িয়ে অন্য শাড়ি পরাল। চুল আঁচড়িয়ে স্নো মাখিয়ে দিল মুখে। তারপর তার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে এল নীচে।

এ ঘরে চেয়ার নেই, গঙ্গামণির বিছানাটি মন্তু বড়, তারই এক প্রান্তে বসেছে তিন বাবু। নয়নমণিকে এনে গঙ্গামণি বসাল বিছানার অন্য প্রান্তে।

নয়নমণি যখন ঘরে ঢুকছে, তার কয়েক পা হাঁটা দেখেই নীলমাধব তার পাশের লোকটিকে বলল, একটু শেখালেই নাচতে পারবে, কী বলিস?

সে লোকটি দুবার মাথা নাড়ল।

নীলমাধব তার অভিজ্ঞ চোখে নয়নমণির চোখ, নাক, ঠোঁট, বসার ভঙ্গি সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। তারপর বলল, লেডি হ্যামলেট যখন সেজেছিলে, তোমাকে চেনাই যায়নি। ফাটিয়েছ সেদিন! হ্যান্ডবিলে তোমার নাম দেয়নি, তোমার নামটা কী গো?

যেন বিয়ের পাত্রী দেখতে এসেছে ওরা, পাত্রীকে বেশি কথা বলতে নেই, তাই গঙ্গামণি আগ বাড়িয়ে বলল, নয়নমণি, ওর নাম নয়নমণি! বেশ নামটা না? আমি বলে রাখলুম দেখো, কালে কালে এ মেয়ে অডিয়েন্সের নয়নমণি হবেই।

নীলমাধব বলল, ও সব মণি টনি চলবে না। নামটা বদলাতে হবে। হাল ফ্যাসানের নাম রাখতে হবে পান্নারানি; কিংবা কুহকিনী নামটা কেমন?

গঙ্গামণি ফিক করে হেসে বলল, ও তোমাদের এখন আর মণি পছন্দ নয়! তা যা বলেছ, এখন মণিদের দিন গেছে, রানিদের দিন এসেছে।

নীলমাধব একটু বিরক্ত ভাবে বলল, আহা, গঙ্গা, তুই-ই তো সব কথা বলছিস! ওকে কিছু বলতে দে! ওগো মেয়ে, শোনো, আমরা একটা নতুন নাটকের জন্য তোমাকে চাইতে এসেছি। রবিঠাকুরের ‘বউ ঠাকুরানীর হাট’ নামে একটা নভেল আছে, সেটা ভেঙে নাটক করেছি, হিস্টোরিক্যাল, তবে নতুন ধরনের, মেইন ফিমেল পার্ট দুটো, একটাতে বনবিহারিনীকে নেব ঠিক করেছি, আর একটাতে তুমি, প্র্যাকটিক্যালি তুমিই হিরোইন…

নয়নমণি মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে গেল। বউ ঠাকুরানীর হাট! এই উপন্যাসটি সে পড়েছে, সে অনেক বছর আগে, যেন অন্য জীবনে!

নীলমাধব বলল, টাকাকড়ির কথা শুনেছ নিশ্চয়ই। সামনের শুক্রবার শুভদিন আছে, সেই দিন থেকে রিহার্সাল ফেলব। ঠিক বেলা এগারোটায় থিয়েটারের গাড়ি এসে তোমাকে নিয়ে যাবে। তোমার যদি এ বাড়িতে থাকতে অসুবিধে হয়, অন্য বাড়িরও ব্যবস্থা আছে। এই যে রাজেন্দ্রবাবু • এসেছেন, উনিই টাকা ঢালছেন এই নাটকে। রাজেন্দ্রবাবুর গঙ্গার ধারে একটা ফাঁকা বাড়ি আছে, তুমি সেখানে থাকতে পারো। রাজেন্দ্রবাবু অতি দিলদার মানুষ, তোমার গা একেবারে সোনা দিয়ে মুড়ে দেবেন। তিন-চারজন দাস-দাসী থাকবে…।

গঙ্গামণির মনে পড়ল, তার প্রথম যৌবনে তার মায়ের কাছে এসে এই ধরনের বাবুরা ঠিক এই কিম প্রস্তাবই দিত। আনন্দে ভূগোমগো হ৯ চোখ চকচক করে উঠত তার মায়ের। মা তবু দরদাম করত, দর বাড়িয়ে তাকে সঁপে দিত কোনও বাবুর হাতে। আজ তার সেই ভূমিকা।

সে বলল, গঙ্গার ধারে বাড়ি? সে বাড়িতে ও একলা থাকবে, না আরও কেউ আছে?

নীলমাধব বলল, একলা, পুরো বাড়ি। দারোয়ান গেটে পাহারা দেবে। কী রাজেন্দ্রবাবু, বলুন না।

হিরে-পোখরাজের আংটি পরা রাজেন্দ্রবাবু কিছু না বলে হেঁ হেঁ করে হাসল।

নীলমাধব বলল, তা হলে এই কথাই রইল। মিনার্ভার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে নাও। শুকুরবাই ও বাড়িতে চলে যাবে। আর হ্যাঁ, তোমার জন্য দুশো টাকা অ্যাডভান্স এনেহি। টাকার জন্য চিন্তা কোরো না, রাজেন্দ্রবাবু খুশি হলে তোমার কোনও অভাব থাকবে না।

প্রণয়িনীর হাতে গোলাপ ফুল তুলে দেবার ভঙ্গিতে রাজেন্দ্রবাবু পকেট থেকে নগদ দুশো রুপোর টাকা ভরা একটা মখমলের থলি বার করে খুঁজে দিল নয়নমণির হাতে।

নয়নমণি থলিটা সন্তর্পণে বিছানায় নামিয়ে রাখল। তারপর হাত দিয়ে ঠেলে ঠেলে সরিয়ে দিল অনেক দূরে। মুখ নিচু করে বলল, সোনার গয়না আমার সহ্য হয় না। আমি সোনা পরি না। আমি মিনার্ভা ছেড়ে যাব না।

নীলমাধব দারুণ অবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, কী বললে? মিনার্ভা ছেড়ে যাবে না? মিনার্ভা তোমায়ভ কী দেয়? তোমার এত সুন্দর চেহারা, তোমাকে ছেলে সাজিয়ে রেখেছে।

নয়নমণি বলল, আমি গিরিশবাবুর পায়ের কাছে বসে পার্ট শিখব! আমার টাকার দরকার নেই!

এরপর আর বেশিক্ষণ কথাবার্তা চলল না। এই পাতলা চেহারার মন্ত্র মেয়েটি যে তার জেদ ছাড়বে না তা বুঝতে দেরি হয় না। নীলমাধবরা রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেল।

নয়নমণি বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়েছে দেয়াল ঘেঁষে।

গঙ্গামণি কোমরে দু হাত দিয়ে চোখ পাকিয়ে বলল, ছা ছা ছা ছা! তুই হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলন্সি? ঘরে বয়ে এসে টাকা দিতে চাইল, দুশো টাকা, বাপের জন্মে কেউ একসঙ্গে অত টাকা আমায় দেয়নি, কত সোনা-দানা দেবে বলল, মেয়ের এত দেমাক, তাতেও মন উঠল না? গিরিশ ঘোষের চন্নমের্ত খেলেই তোর চলবে? ওঁর কোনও মায়াদয়া নেই, তা তুই কি জানবি? আজ মাথায় তুলে নাচবে, কাল ছুঁড়ে ফেলে দেবে! একদিন এই গঙ্গামণিকেও গিরিশবাবু কোলে বসিয়েছিল, আজ চিনতে পারে না। রূপ-গুণ থাকতে থাকতে গুছিয়ে নিবি, তা না। নিজের পায়ে নিজে কুড়ল মারলি…

নয়নমণি এ সব ভৎসনায় কানও দিল না। গঙ্গামণি একটু থামতেই ফুরফুর করে হেসে সে বলল, ও দিদি, ওই রাজেনবাবু না ফাজেনবাবু লোকটা কী রকম ঘামছিল দ্যাখোনি? এই শীতের মধ্যে…ঘরে নিশ্চয়ই ওর দজ্জাল বউ আছে…আর তোমার ওই নীলমাধববাবু, শিকারী বেড়ালের মতন খোঁচা খোঁচা গোঁপ…

গঙ্গামণির মুখ থেকে রাগ মুছে গেল, ছলছল করে এল চক্ষুদুটি। দৌড়ে এসে নয়নমণিকে বুকে জড়িয়ে ধরিয়ে বলল, তুই কী করে পারলি রে? কী করে পারিস!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *