এখন আর সরলাকে বাড়ি থেকে বেরুবার জন্য কারুর অনুমতি নিতে হয় না। তার নিজস্ব গাড়ি ও কোচোয়ান আছে। তার জনক-জননী শুধু নন, মাতৃকুল ঠাকুর পরিবারের সবাই ধরে নিয়েছে, এ মেয়েকে কিছুতেই বাগ মানানো যাবে না। এমন তেজস্বিনী, এমন স্বাধীনচেতা যুবতী এ সমাজে আগে কেউ দেখেনি।
হিন্দু রমণী বা অন্তরালবর্তিনী, উচ্চ বংশের মহিলা বা খানদানি মুসলমান রমণীদের মতন বোরখা পরেন না বটে, কিন্তু পরপুরুষদের মুখ দেখান না, আত্মীয়দের সামনেও এক গলা ঘোমটা দিয়ে থাকেন, পথে-ঘাটে তাঁদের একা চলাফেরার তো প্রশ্নই ওঠে না। ব্রাহ্মরা নারীদের পর্দাপ্রথা ঘোচাবার জন্য কিছুটা উদ্যম নিয়েছেন বটে, তাও খুব সীমিত গণ্ডিতে, পরিবারের কোনও পুরুষ-সঙ্গী ছাড়া ব্রাহ্ম রমণীরাও গৃহ থেকে নির্গত হন না। সরলার মা ব্রাহ্ম, বাবা হিন্দু, সরলা ব্রাহ্ম সমাজের প্রভাবে আলোকপ্রাপ্তা হলেও হিন্দু রীতিনীতির প্রতিও তার বেশ ঝোঁক আছে। তাদের পরিবার বঙ্কিমচন্দ্র এবং বাল গঙ্গাধর তিলকের ভক্ত, স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে সরলা বেশ উৎসাহী ও কৌতূহলী।
পঁচিশ বছর বয়েস হয়ে গেল, সরলা এখনও কুমারী, পুরুষদের সঙ্গে সে অসংকোচে মেশে, কিন্তু কোনও বিশেষ পুরুষ বেশি ঘনিষ্ঠ হতে চাইলে সে মাঝখানে একটি অদৃশ্য দেওয়াল তুলে দেয়, কারুর গদগদ বাক্য শুনলে সে প্রাণ খুলে হাসে। মা ও বাবা তার বিয়ে দেবার জন্য অনেক চেষ্টা করে এখন হাল ছেড়ে দিয়েছেন। সরলা কখনও বলে না যে সে চিরকুমারী থাকবে, সে বলে, সেরকম যোগ্য পুরুষ কোথায়? মাতামহ দেবেন্দ্রনাথ একখানা তলোয়ারের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তেমন পুরুষ কে আছে যে সেই তলোয়ার হাতে তুলে নিয়ে তার জীবন সঙ্গিনী হতে পারবে?
সরলার ব্যর্থ-প্রণয়ীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ তিক্তভাবে মন্তব্য করে, ভগবান ভুল করে ওকে মেয়ে হিসেবে গড়েছেন! ও তো আসলে ব্যাটাছেলে!
সরলা যে একা একা যেখানে সেখানে যায়, যার তার সঙ্গে মেশে, এতেও কিন্তু কেউ ঠিক নৈতিক আপত্তি জানাতে পারে না। সে বিদূষী ও বুদ্ধিমতী, তার সম্ভ্রমবোধ কোনও অংশে কম নয়। সে একা একা দূর প্রবাসে চাকরি করে এসেছে।
ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হয়েও সরলা মহীশূরে চাকরি করতে গিয়েছিল নিছক ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার স্পৃহায়। পুরুষরা লেখাপড়া শেখে জীবিকা অর্জনের জন্য। সরলাও লেখাপড়া শিখেছে, তা সে কাজে লাগাবে না কেন? মেয়েরা উচ্চশিক্ষা লাভ করেও নিছক ঘরের বউ হয়ে থাকবে, তা হলে সে শিক্ষার প্রয়োজন কী? স্বামীরা সগর্বে, কোনও বন্ধুকে বলবে, আমার স্ত্রী গ্র্যাজুয়েট, ভাল সংস্কৃত জানে, আর স্ত্রী সেই সময় অন্দরমহলে বসে কোলের সন্তানকে দুধ খাওয়াবে, এতেই রমণী জীবনের চরম সার্থকতা?
মহীশূরের মহারানি গার্লস কলেজে অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট-এর চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিল সরলা। কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে বেশ মানিয়ে নিয়েছিল। রাজ সরকার থেকে তাকে দেওয়া হয়েছিল একটি সুন্দর ছোটখাটো দোতলা বাড়ি, নীচে ড্রয়িংরুম ও খাবার ঘর, ওপরে দুটি শোবার ঘর, তার একটিকে সে ড্রেসিংরুম বানিয়েছিল, সংলগ্ন স্নানে ঘর ও টানা বারান্দা। সব ঘরেই ওয়াল পেপার লাগানো। দু’জন সেপাই সে বাড়ি পাহারা দেয়, এ ছাড়া একজন দক্ষিণ ভারতীয় আয়া, একজন রান্নার ঠাকুর ও কলকাতা থেকে আনা একটি ভৃত্য থাকে সেখানে। সরলা তো নিতান্ত শিক্ষয়িত্ৰী নয়, সে ব্রাহ্ম সমাজে প্রখ্যাত নেতা ও জমিদার দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতনি, সে পরিচয় রাজ পরিবারেব সবাই জানে, সে জন্য তার বিশেষ খাতির।
সেখানে কয়েকটি বিশিষ্ট মুসলমান ও পার্শি পরিবারের সঙ্গে সরলার ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। ভারতের বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে মিশে তার দৃষ্টি অনেক প্রসারিত হয়েছে, মহীশূরের ব্রাহ্মণরা এখনও সংস্কৃত ভাষায় কথা বলে, তাদের রক্ষণশীলতার মধ্যে ফুটে ওঠে প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্য। বেশ ভালভাবেই গুছিয়ে নিয়েছিল সরলা, তবু এক বছরের বেশি সে চাকরিতে টিকতে পারল না।
আত্মীয়-পরিজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একা কোনও যুবতীর কোথাও থাকাটা ভারতীয় সমাজ এখনও মেনে নিতে পারে না। বিশেষত যদি সেই যুবতী হয় সরলার মতন রূপে গুণে অদ্বিতীয়া। মধুলোভী ভ্রমরের মতন যুবকেরা ঘুরঘুর করতে লাগল তার চারপাশে। তারা ঠারেঠোরে প্রেমের কথা বলে, প্রকারান্তরে বিবাহের প্রস্তাব আসে। এই সব যুবকদের কী ভাবে প্রতিহত করতে হয়, তা সরলা জানে, সে ভয় পায় না। কিন্তু কেউ যদি জোর-জবরদস্তি করে? ব্যভিচারী, গুণ্ডা প্রকৃতির কেউ যদি তাকে সবলে হরণ করতে চায়?
একদিন মাঝরাত্তিরে তুমুল কাণ্ড হল।
দারুণ গ্রীষ্মের রাত, সরলার মাদ্রাজি আয়াটি তার ঘরে না শুয়ে সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে ঘুমিয়েছে, বেশি বাতাস পাবে বলে। পাহারাদার সেপাই দু’জনও ঘুমে ঢুলছে। হঠাৎ আয়াটি হাউ-মাউ করে চেঁচিয়ে উঠল, তার একটা হাত মাড়িয়ে কে যেন ঢুকে পড়েছে পাশের ঘরে। সেই চিৎকারে জেগে উঠে সরলা বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে, কী হয়েছে?
আয়াটি তখনও ভয়ে অস্থির। সে হাত তুলে ড্রেসিংরুমটি দেখিয়ে বলতে লাগল এখানে কেউ ঢুকেছে, ভূত কিংবা ডাকাত, বিকট তার চেহারা।
এ রকম অবস্থাতেও বুদ্ধি হারায়নি সরলা। সে চট করে সেই দরজার শেকল বন্ধ করে দিল বাইরে থেকে। তারপর বান্দায় গিয়ে চিৎকার করতে লাগল, পাহারাওয়ালা, পাহারাওয়ালা, বাড়িতে চোর ঢুকেছে!
সেই চিৎকারে সেপাই দু’জন জেগে উঠল তো বটেই, রাস্তা থেকে ছুটে এল কয়েকটি পুলিশ। ঘরের মধ্যে সত্যিই কেউ বয়েছে, সে দিশেহারা হয়ে পেছনের জানলা ভেঙে লাফিয়ে পড়ল রাস্তায়। পালাতে পারল না, ধরা পড়ে গেল। তখন দেখা গেল, সে চোর কিংবা ডাকাত নয়, সে একটি কুখ্যাত লম্পট। শহরে একটি অবস্থাপন্ন ঠিকাদারের অকালকুষ্মাণ্ড, বহু নারীর সে সর্বনাশ করেছে। এরকম একটি জীব তাকে স্পর্শ করতে চেয়েছে, এ কথা জেনে সরলার শরীর ঘৃণায় কাঁপতে থাকে।
সে রাতে অন্য একটি পরিবারে আশ্রয় নিল সরলা। পরদিনই এ খবর রাষ্ট্র হয়ে গেল, বিভিন্ন সংবাদপত্রে সে বিবরণ প্রকাশিত হয়ে সরলাকে আরও লজ্জায় ফেলে দিল। কলকাতার পত্রপত্রিকাগুলি এ জন্য দায়ী করল সরলাকেই। ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকা এই মর্মে মন্তব্য করল যে, অমন মানী বংশের যুবতী কন্যার ধেই ধেই করে বিদেশে চাকরি করতে যাবার প্রয়োজনটাই বা কী? খাওয়া-পরার অভাব নাই, কেন খামোখা নিজেকে এমন বিপদগ্রস্ত করা! এ খালি বিলাতি সভ্যতার অনুকরণ।
এর পর আর থাকা যায় না, ফিরে আসতে বাধ্য হল সরলা। মাঝখানে তার জ্বর-জারি হয়েছিল, এখানে স্বাস্থ্য টিকছে না, এই অজুহাতে তবু কিছু মান রক্ষা হল। সরলাও অনুভব করল যে, জীবিকার সঙ্গে প্রয়োজনের একটা সম্পর্ক থাকা চাই। তাকে কোনও দিন অর্থ-চিন্তা করতে হয়নি, জানকীনাথ তাঁর কন্যার জন্য ভাল মাসোহারার ব্যবস্থা করে রেখেছেন, তবু যে সরলা অত দূরে চাকরি করতে গিয়েছিল, তা খানিকটা জেদ আর অনেকটাই শখের বশে। এর কোনওটাই বেশি দিন টেকে না।
কলকাতার অনেকে চাপা বিদ্রুপের স্বরে বলেছে, কী রে, চাকরির শখ মিটল? খুব তো স্বাধীন হতে গিয়েছিলি!
এখন চাকরি না করলেও সরলা চুপচাপ ঘরে বসে থাকতে রাজি নয়। স্বাধীন থাকার ইচ্ছেও তার ঘুচে যায়নি।
‘ভারতী’ পত্রিকার অনেকখানি ভার নিয়েছে সে। নিজে লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, প্রয়োজনে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে তাগাদা দেয়। নিজেও লিখতে শুরু করল নানা প্রবন্ধ। বাবা কংগ্রেসের নেতা, সরলার অন্তরেও দেশপ্রেমের শিখা দিন দিন উজ্জ্বল হচ্ছে। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বাঙালিদের কিছু কিছু দুর্বলতা তাকে পীড়া দেয়। বাঙালিরা যেন স্বভাবগতভাবেই কাপুরুষ। অত্যাচারের প্রতিরোধ করতে বাঙালিরা সাহস করে এগিয়ে আসতে পারে না, কেউ অপমান করলেও মুখ বুজে সহ্য করে যায়। বাঙালিরা মুখেই যত বাক্যবাগীশ, জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতার তোড় ছোটাতে পারে, কিন্তু কেউ লাঠি উঁচিয়ে ধরলেই তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে।
বাঙালিদের এই কাপুরুষতার কারণ কি শারীরিক দুর্বলতা? ট্রেনে চেপে বোম্বাই থেকে কলকাতা পর্যন্ত আসতে আসতেই কত তফাত চোখে পড়ে। মধ্যবর্তী স্টেশনগুলিতে কত তাগড়াই চেহারার মানুষ দেখা যায়, জব্বলপুর-এলাহবাদ-পাটনার কুলিরাও জোয়ান, তারা জোর গলায় এক একটা স্টেশনের নাম হাঁক পাড়ে। আর বাংলায় ঢোকার পরই দেখা যায়, রোগা ডিগডিগে পুরুষ সব, এমন কী কুলিদের গলার স্বরও মিনমিনে।
একই দেশের মানুষ, অথচ এত বৈপরীত্য কেন? বাঙালিরা শরীরচর্চায় পরাঙ্মুখ, শুধু সেটাই কি কারণ? বাঙালিদের শরীরচর্চায় উৎসাহিত করতে হবে ঠিকই। পল্লীতে পল্লীতে ব্যায়ামাগার খোলা দরকার, কিন্তু তার আগে এই জাতের মন থেকে ভয় ভাঙাতে হবে। কিছু দুঃসাহসী, বেপরোয়া যুবকের দল না থাকলে সে জাতির কাপুরুষতার অপবাদ ঘুচতে পারে না। মার খেয়েও মনের জোরে যারা রুখে দাঁড়ায়, তারা অনেক সময় সবলের বিরুদ্ধেও জয়ী হয়।
‘ভারতী’ পত্রিকায় সরলা একটা রচনা লিখল, তার নাম ‘বিলিতি ঘুষি বনাম দেশি কিল’। এই রচনায় পাঠকদের প্রতি একটা আহ্বান জানানো হল, আপনারা যদি কোনও প্রতিবাদের ঘটনা দেখে থাকেন বা তাতে অংশ নিয়ে থাকেন, তা হলে সেই সব ঘটনা লিখে পাঠান। ট্রেনে-স্টিমারে, পথে-ঘাটে গোরা সৈন্য বা ইংরেজ সিভিলিয়ানরা অনেক সময় অপমান করে, লাথি-ঘুষি মারে, এমন কী কোনও দেশি লোকের সামনে তাদের স্ত্রী-ভগিনী কন্যাদের প্রতি অশোভন ইঙ্গিত করে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেশি লোকরা সেই সব অপমান গিলে ফেলে বাড়িতে গিয়ে ফোঁসে, কিংবা বেশি বাড়াবাড়ি কিছু হলে আদালতে নালিশ করে। কেউ কি সাহেবদের সেই বেয়াদপির তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করতে পারে না? দেখা গেল, কোথাও কোথাও সে রকম ঘটনাও ঘটে, বাঙালিরা একেবার নির্জীব হয়ে যায়নি, কোথাও কোনও দুর্বিনীত মাতাল গোরা সৈনিককে কোনও যুবক টানতে টানতে কোতোয়ালিতে নিয়ে গেছে, বরিশালে একজন রায়ত এক ইংরেজ তার স্ত্রীকে ধাক্কা দিয়েছিল বলে তাকে উত্তম-মধ্যম দিয়ে জেল খাটাতেও দ্বিধা করেনি। যশোরে একটি কলেজের ছাত্র এক সাহেবের হাত থেকে উদ্যত ছড়ি কেড়ে নিয়েছে। ‘ভারতী’ পত্রিকায় এই সব বৃত্তান্ত ছাপা হতে অনেকে অবশ্য ঠোঁট বেঁকাল। ‘ভারতী’ একটি বিশুদ্ধ সাহিত্য পত্রিকা, কত উচ্চাঙ্গের রচনা সেখানে প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে এসব কী? এগুলো কি সাহিত্য পদবাচ্য হতে পারে? সরলা এ সমালোচনায় কান দেয় না, সে বলে, নাই বা হল উচ্চাঙ্গের সাহিত্য, তবু এই সব বৃত্তান্ত পাঠ করে অন্য অনেকে উদ্বুদ্ধ হবে, আরও অনেকে প্রতিবাদ জানাবার সাহস সঞ্চয় করতে পারবে।
সরলাকে কেন্দ্র করে তার একটি অনুরাগীবৃন্দ আবার গড়ে উঠেছে। ঘোষাল পরিবার এখন কাশিয়াবাগান ছেড়ে চলে এসেছে সার্কুলার রোডে। এ বাড়িটাও বেশ বড়, সামনে প্রশস্ত চত্বর, পেছন দিকে একটা পুকুর, তার পাশে একটি চৌকো জমি ঝোপঝাড়ে ঢাকা। সেইখানে সরলা স্থাপন করেছে একটি ব্যায়ামাগার, পাড়ার ছেলেরা প্রতিদিন বিকেলে মার্তাজা নামে এক মুসলমান ওস্তাদের কাছে লাঠি খেলা, তলোয়ার চালনা শেখে। সরলা নিজে দাঁড়িয়ে সেই প্রশিক্ষণ দেখে, এক এক সময় সে নিজের হাতে তলোয়ার তুলে নেয়। এই অস্ত্রটি তাকে চুম্বকের মতন টানে, কল্পনায় সে যেন প্রহরণধারিণী ভারতমাতার মূর্তি দেখতে পায়।
সরলার অনুরাগীদের মধ্যে যারা বুদ্ধিজীবী, যারা শারীরিক ব্যায়ামট্যায়াম পছন্দ করে না, তাদেরও সরলা নিভৃতে ভাবের কথা বলার সুযোগ দেয় না। এক সঙ্গে সে একাধিককে কাছাকাছি রাখে। এদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় সে বিস্মিতভাবে লক্ষ করে যে অনেকেই দেশ সম্পর্কে উদাসীন, মাতৃভূমি যে বিদেশি শাসকদের অধীনে রয়েছে, সে বোধটাও যেন নেই। যে পরাধীন জাতি পরাধীনতার জ্বালাও অনুভব করে না, তাদের কি উদ্ধার পাবার কোনও উপায় আছে? অনেকেই একটা ছোট গণ্ডিতে আবদ্ধ, বাংলার বাইরে পা বাড়ায় না, বোম্বাই-মাদ্রাজকে বলে বিদেশ।
বৈঠকখানা ঘরের দেওয়ালে সরলা ভারতের একটা বড় মানচিত্র টাঙিয়ে রেখেছে। বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে থেমে গিয়ে সেই মানচিত্রের দিকে মুখ ফিরিয়ে আবার বলে, ওই দেখো, ওই আমাদের দেশ, ওদিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হয় না, ঠিক যেন মাতৃমূর্তি? তোমরা নিজেরা একা একা তাকিয়ে থেকে দেখো।
এর পর সে বন্ধুদের ওই মানচিত্রকে প্রণাম করতে শেখাল। ঘরে ঢুকে তারা প্রথমে মানচিত্রের দিকে ফিরে দুই হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত। এরকম কিছুদিন চলার পর সরলা একদিন সেইসব বন্ধুদের সবার হাতে লাল রঙের রাখি বেঁধে দিয়ে বলল, তোমাদের সকলকে একটা শপথ করতে হবে। আমরা সবাই তনু-মন-ধন দিয়ে দেশের সেবা করার জন্য দীক্ষিত হলাম। মাতৃভূমির সম্মান রক্ষার জন্য যদি বিপদ বরণ করতে হয়, তাতেও পিছু-পা হব না। এই রাখিই আমাদের ব্যাজ।
ক্রমশ এই রাখিবন্ধনের দলটিতে সংখ্যাবৃদ্ধি হতে লাগল। এই বিষয়টি সরলা নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু মুখে মুখে খবর রটেই যায়। একটি তরুণী মেয়ে ঘরসংসারের চিন্তা না করে এসব কী কাণ্ড করছে, অনেকে বুঝতেই পারে না। শুভার্থীরা শঙ্কিত হয়ে ভাবে, এবার বুঝি এ মেয়েটির পেছনে পুলিশের চর লেগে যাবে।
যুব সমাজের মুখে মুখে এখন সরলা ঘোষালের নাম। কলেজের ছাত্ররা সুরেন বাড়ুজ্যের বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গ্যারিবল্ডির জীবনী পাঠ করে। ইতালিতে গুপ্ত সমিতি গঠন করে সে দেশের যুবকেরা স্বাধীনতার লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। এ দেশে সেরকম গ্যারিবল্ডি কোথায়? বড় বড় নেতারা কংগ্রেসের অধিবেশনে শুধু বিভিন্ন দাবিদাওয়ার আবেদন-নিবেদন জানান, স্বাধীনতার কথা তো উচ্চারণ করেন না! সরলা ঘোষাল কি হবেন সেই প্রেরণাদাত্রী?
মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় নামে একটি যুবক প্রায়ই আসে সরলার কাছে। সাহিত্যচর্চায় তার খুব উৎসাহ, ভবানীপুর অঞ্চলে তাদের একটি সাহিত্য সমিতি আছে। সে একদিন সরলার কাছে প্রস্তাব দিল, তাদের সমিতির সাংবৎসরিক উৎসবে সরলাকে সভানেত্রী হতে হবে। সরলা তো আকাশ থেকে পড়ল! এ রকম আবার হয় নাকি? পুরুষদের আহুত সভায় সভাপতির আসনে বসবে এক নারী, এ কখনও সম্ভব? এমন কেউ কখনও শোনেনি। যদি বা লোকনিন্দা বা অপবাদ অগ্রাহ্য করাও যায়, তবু সাহিত্য সভার সভাপতিত্ব করার কী এমন যোগ্যতা আছে সরলার? সে এখনও সে রকম কিছু সাহিত্য রচনা করেনি। বরং তার মা স্বর্ণকুমারী একজন প্রধান লেখিকা, তিনি রাজি হলে তবু মানায়। কিন্তু মণিলাল নাছোড় বান্দা, সরলাকেই তাদের চাই, তাদের ক্লাবের সব সদস্য মিলে সেই সিদ্ধান্তই নিয়েছে।
কয়েক দিন এই নিয়ে পীড়াপীড়ি চলার পর সরলার মাথায় একটা বিশেষ পরিকল্পনা এসে গেল। বোম্বাই রাজ্যে বাল গঙ্গাধর তিলক শিবাজী উৎসবের প্রবর্তন করে বিশেষ সার্থক হয়েছেন। গণেশ পূজা যেমন জনপ্রিয় হয়েছে, তেমনি বীর যোদ্ধা শিবাজীকেও জনসাধারণ আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে। সরলার মাথায় মাঝে মাঝে ঘোরে, বাংলার কোনও বীরপুরুষকে সেইরকম আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা যায় না? বাংলার সাধারণ মানুষ শিবাজীর বিষয়ে কিছুই জানে না। শিক্ষিত লোকেরাও শিবাজীকে উচ্চ চক্ষে দেখে না। ইংরেজ ঐতিহাসিকরা শিবাজীকে আখ্যা দিয়েছে ‘পাহাড়ি ইঁদুর’, আফজল খাঁ হত্যা প্রসঙ্গটিকে শিবাজীর বীরত্বের বদলে হীন বিশ্বাসঘাতকতার নিদর্শন, এ দেশের শিক্ষিত লোকেরাও তাই মনে করে। তিলক অবশ্য তাঁর পত্রিকায় আফজল খাঁ হত্যার যৌক্তিকতা প্রমাণ করেছেন জোরালো ভাষায়, সরলা সেটাই মানে। তবু একজন বাঙালি বীর কি পাওয়া যাবে না! কতকাল হল বাঙালিরা যুদ্ধ করতে ভুলে গেছে। বাঙালির ইতিহাসও তো লেখা হয়নি এ পর্যন্ত। বঙ্কিমচন্দ্র পর্যন্ত এ নিয়ে আফশোস করে গেছেন।
হঠাৎ সরলার মনে পড়ল, প্রতাপাদিত্যর কথা। শিবাজী মহারাজার তুলনায় প্রতাপাদিত্য নিতান্তই এক ছোট জমিদার, বারভূঁইয়ার অন্যতম। খুল্লতাতকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার কলঙ্ক আছে তাঁর নামেও। কিন্তু অন্য দিকে বাংলার এক ক্ষুদ্র জমিদার হয়েও তিনি মোগল বাদশাহের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে স্বাধীন হতে চেয়েছিলেন, নিজের নামে সিক্কা টাকা চালিয়েছেন, এই যে সাহস, এই যে পৌরুষ, এটাকেই যদি বেশি করে দেখানো যায়? বাঙালি জানবে যে প্রবল শক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করার মতন বীর্যবান বাঙালি ছিল। প্রতিবাদের এই তেজটাই তো বড় কথা। এখনকার ইংরেজ শাসকরাও তো মহা শক্তিমান, সব অস্ত্রশস্ত্র তাদের হাতে, তবু কি তাদের অত্যাচারের প্রতিবাদ করবে না এ দেশের মানুষ? চিরকাল এমন মুখ বুজে সহ্য করে যাবে?
মণিলালকে সরলা বলল, তোমাদের সভায় আমি যেতে পারি, কিন্তু একটা শর্ত আছে। সাহিত্য পাঠ-টাঠ আপাতত বন্ধ থাক। তোমরা একটা ‘প্রতাপাদিত্য উৎসব’ করতে পারবে? ১লা বৈশাখ প্রতাপাদিত্যের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল, উৎসব হোক সেই দিনটাতে। প্রতাপাদিত্যের জীবনীর উপাদান সংগ্রহ করো, বই জোগাড় করো, তারপর তাঁর বীরত্ব ও সাহসিকতার দিকটা বেশি উজ্জ্বল করে কেউ লিখুক একটা প্রবন্ধ। সেই প্রবন্ধটি পাঠ করে সাধারণ মানুষকে তাঁর কথা জানানো হোক। সভায় আর কোনও বক্তৃতা হবে না। চতুর্দিকে লোক লাগিয়ে খুঁজে খুঁজে বার করো, কোন্ বাঙালির ছেলে তলোয়ার খেলতে জানে, কুস্তি, বক্সিং জানে, লাঠি চালায়। কবিতা আর গল্প পাঠের বদলে সেই সব ছেলেদের অস্ত্র শিক্ষার প্রদর্শন হোক। যারা যারা বিশেষ কৃতিত্ব দেখাবে, তাদের প্রত্যেককে আমি একটি করে সোনার মেডেল দেব! সেই মেডেলের পেছনে লেখা থাকবে, দেবাঃ দুর্বলঘাতকাঃ!
মণিলালের দলবল তাতেই রাজি। দেখা গেল, বাঙালি একেবারে নির্জীব নয়, লাঠি-ছোরা-তলোয়ার চালাতেও বেশ কিছু ছেলে দক্ষ। মঞ্চের ওপর প্রতাপাদিত্যের একটি তৈলচিত্র, তার সামনে একটি তলোয়ার। সরলা শুভ্র সিল্কের শাড়ি পরে এসেছে। শরীরে কোনও অলঙ্কার নেই, একটা ওড়নায় মাথার অর্ধেকটা ঢাকা, সে একটা রক্তজবা ফুলের মালা সেই তৈলচিত্রে পরিয়ে দিয়ে উদ্বোধন করল সভার। তার পর দর্শকদের দিকে ফিরে নমস্কার জানিয়ে বসল পাশের চেয়ারে, একটি কথাও উচ্চারণ করল না। শুরু হল লাঠি খেলা, অসি খেলা।
ভবানীপুরের ক্লাব-প্রাঙ্গণে দর্শকের ভিড়ে যেন তিল ধারণের জায়গা নেই। এ রকম দৃশ্য কলকাতার মানুষ আগে কখনও দেখেনি। বাঙালির হাতে অস্ত্র, আর তাদের উৎসাহ দিচ্ছে মঞ্চে উপবিষ্ট এক বড় ঘরের কুমারী তরুণী!
পরের দিন সংবাদপত্রগুলিতে লেখা হল, ‘কলিকাতার বুকের ওপর যুবক-সভায় এক মহিলা সভানেত্রীত্ব করিতেছেন দেখিয়া ধন্য হইলাম!’ এমন যে রক্ষণশীল পত্রিকা ‘বঙ্গবাসী’, সেখানেও বেরুল, ‘মরি মরি কী দেখিলাম? এ কী সভা! বক্তিমে নয়, টেবিল চাপড়া-চাপড়ি নয়—শুধু বঙ্গবীরের স্মৃতি আবাহন, বঙ্গ যুবকদের কঠিন হস্তে অস্ত্রধারণ ও তাদের নেত্রী এক বঙ্গললনা—ব্রাহ্মণকুমারীর সুকোমল হস্তে পুরস্কার বিতরণ। দেবী দশভুজা কি আজ সশরীরে অবতীর্ণ হইলেন? ব্রাহ্মণের ঘরে কন্যা জাগিয়াছে, বঙ্গের গৌরবের দিন ফিরিয়াছে।‘
এর পর আরও অনেক জায়গায় প্রতাপাদিত্য উৎসব অনুষ্ঠিত হতে লাগল। সরলা বাংলার ইতিহাস ঘেঁটে আরও কয়েকজন শৌর্যবান পুরুষকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টায় মন দিল। রাজস্থান, পঞ্জাবে অনেক বীরের আত্মদানের কাহিনী আছে, সরলা খুঁজে পেতে চায় বাঙালির দৃষ্টান্ত। শিবাজী কিংবা বিশেষ কোনও একজনকে সারা ভারতের মানুষ মেনে নেবে কি না, কিংবা মানতে কতদিন সময় লাগবে কে জানে! তার চেয়ে দেশের বিভিন্ন অংশে স্থানীয় বীরপুরুষদের আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেও অনেক কাজ হবে। সাধারণ মানুষকে সচেতন করাটাই বড় কথা।
সরলার চোখ পড়ল প্রতাপাদিত্যের পুত্ৰ উদয়াদিত্যের দিকে। এঁর সম্পর্কে অনেকেই প্রায় কিছুই জানে না। উদয়াদিত্য স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারেননি। কিন্তু আক্রমণোদ্যত বিশাল মোগল বাহিনীকে দেখেও তিনি ভয়ে পালাননি। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সম্মুখসমরে তিনি প্রাণ দিয়েছেন। সেই সাহসিকতার মূল্য নেই? এখন আবার অনেককেই তো দেশের জন প্রাণ দিতে হবে। যারা প্রাণ দেবে, তারাও হবে পরবর্তীদের কাছে প্রেরণাস্বরূপ।
এবারে ‘উদয়াদিত্য উৎসবের’ ব্যবস্থা করতে হবে বেশ বড় আকারের। পাছে কেউ মনে করে যে প্রত্যেকটি উৎসবে সভানেত্রীর আসন গ্রহণ করে সরলা নিজের খ্যাতি-প্রতিপত্তি বাড়াচ্ছে, তাই মাঝে মাঝে সে আড়ালে থাকে। মঞ্চে ওঠে না কিংবা উৎসবের ধারে কাছেও যায় না। যদিও পরিকল্পনা সব তারই এবং টাকাপয়সাও সে নিজেই দেয়। কলেজ স্ট্রিটের অ্যালবার্ট হল সভাসমিতির জন্য বিখ্যাত, ‘উদয়াদিত্য উৎসব’ হবে সেখানেই। অ্যালবার্ট হলের ট্রাস্টি এখন নরেন সেন, তাঁর কাছে ভাড়ার টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হল। উদয়াদিত্যের কোনও প্রতিকৃতি পাওয়া যায় না, তাই ঠিক হল মঞ্চে রাখা হবে শুধু একটা তলোয়ার। সবাই তাতেই পুস্পাঞ্জলি দেবে। এক অবাঙালি জমিদারের কাছ থেকে হাতলে হীরে-জহরত বসানো একটি বড় তলোয়ারও সংগ্রহ করা হয়েছে। শ্ৰীশ সেন নামে উৎসাহী যুবকের ওপর সব ব্যবস্থাপনার ভার, সে প্রতিদিন এসে সরলার কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে যায়। সভাপতি হবেন ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, তিনি উত্তম বক্তা, তিনি আসতে সাগ্রহে রাজিও হয়েছেন।
মিটিং শুরু হবে বিকেল চারটের সময়, দুপুর বারোটায় শ্রীশ সেন দৌড়তে দৌড়তে এসে এক দারুণ দুঃসংবাদ দিল। নবেন সেন ভয় পেয়ে অ্যালবার্ট হলে তালাবন্ধ করে দিয়েছেন, এ মিটিং তিনি হতে দেবেন না। তিনি শুনেছেন, ছেলেরা তলোয়ার পূজা করবে, এ তো ভয়াবহ রাজদ্রোহাত্মক কাজ। সুতরাং মিটিং বন্ধ।
সরলার ফর্সা মুখখানি ক্রোধে অগ্নিবর্ণ ধারণ করল। শাণিত গলায় সে বলল, কী, মিটিং হবে না, মানে? সব সংবাদপত্রে জানানো হয়েছে, রাশি রাশি হ্যান্ডবিল বিলি হয়েছে, দেয়ালে পোস্টার পড়েছে, মিটিং হবে না? উনি সই করে অগ্রিম টাকা নিয়েছেন, এখন মিটিং বন্ধ করার কী অধিকার আছে। আমি ওঁর নামে মামলা করব।
কিন্তু মামলা-মোকদ্দমার নিষ্পত্তি তো একদিনে হয় না। আজকের অনুষ্ঠান বন্ধ রাখা ছাড়া তো গতি নেই।
সরলা বাড়ির ভেতর থেকে এক মুঠো টাকা নিয়ে এসে বলল, আপনারা কাছাকাছি কোনও থিয়েটার হল যে-কোনও উপায়ে ভাড়া করুন। যত টাকা লাগে আমি দেব। মিটিং হবেই হবে।
শ্ৰীশ অন্য হল ভাড়া করতে ছুটে গেল, সরলা চিঠি লিখতে বসল নরেন সেনকে। ইন্ডিয়ান মিরার পত্রিকার সম্পাদক নরেন সেন বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা হিসেবে পরিচিত। কতবার অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন, এখন বৃদ্ধ বয়েসে তাঁর ভীমরতি হয়েছে নাকি? একদল যুবক তলোয়ার পূজো করতে চায়, পুলিশ যদি ধরপাকড় করতে চায় ওই ছেলেদের ধরবে, উদ্যোক্তা হিসেবে সরলাকে নজরবন্দি করতে পারে, জেনেশুনেই তারা এই ঝুঁকি নিয়েছে, আর অ্যালবার্ট হলের ট্রাস্টি হিসেবে নরেন সেন এইটুকু দায়িত্ব নিতে পারেন না?
রাগের মাথায় সরলার চিঠির ভাষায় আগুন ছুটতে লাগল। “…আজ আপনি তাদের এ পূজা যদি বন্ধ করেন, সংবাদপত্রের সূত্রে সমস্ত ভারতবর্ষে ঢি ঢি পড়ে যাবে। সবাই বলবে, বাঙালি যুবকেরা খড়্গপূজা করতে চেয়েছিল, একজন নেতৃস্থানীয় বাঙালি বৃদ্ধ হিন্দু তাতে বাধা দিয়েছেন, তাঁর অতিমাত্রায় রাজভক্তি তাতে রাজদ্রোহিতার গন্ধ পেয়ে থরহরি কম্পমান হয়েছে, তাঁর তথাকথিত হিন্দুত্বের আজ তিনি সম্পূর্ণ ফেইল করেছেন। এই তো একদিকে দেশের লোকের ধিক্কার–আর একদিকে আপনি মামলায় ফেঁসে যাবেন…ছেলেরা আপনার নামে ক্ষতিপূরণের মামলা আনতে পারে। আইনত আপনিই দায়ী…।”
লোক মারফত সেই চিঠি পেয়ে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলেন নরেন সেন। সরলা ঘোষালের জনপ্রিয়তার কথা তিনি জানেন। অনেক যুবক তার কথায় ওঠে-বসে। সরলার উস্কানিতে তারা কখন কী হামলা করবে তার ঠিক নেই। এদিকে তলোয়ার পূজাও তো সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার, এ যে ইংরেজের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের ইঙ্গিত। ইতালিতে, আয়াল্যান্ডে যা চলেছে, তা কি ভারতে কখনও সম্ভব? সরলা ছেলেমানুষ, সিপাহি বিদ্রোহের দিনগুলির কথা সে জানে না। নরেন সেনের তখন চোদ্দো বছর বয়েস ছিল, সিপাহিদের বিদ্রোহ দমন করার জন্য ইংরেজরা যে কী চরম নিষ্ঠুর পন্থা অবলম্বন করেছিল, তার ভয়াবহ স্মৃতি এখনও অনেকের মনে রয়ে গেছে।
অনেক ভেবেচিন্তে দূত মারফত চাবি পাঠিয়ে দিয়ে তিনি সংক্ষিপ্ত চিঠিতে জানালেন যে, যুবকেরা উৎসব করতে চায় করুক, তবে এ বাবদ কোনও রকম গণ্ডগোল হলে তার সব দায়িত্ব সরলা ঘোষালকে নিতে হবে।
নিজে একজন মানী-গুণী ও সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি হয়েও যে দায়িত্ব নিতে ভয় পান, সেই দায়িত্ব তাঁর কন্যাসমা একটি পঁচিশ বছরের যুবতীর কাঁধে চাপিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চান নরেন সেন।
এদিকে শ্ৰীশ এর মধ্যে অ্যালবার্ট হলের কাছাকাছি হ্যারিসন রোডের ওপর আলফ্রেড থিয়েটার ভাড়া করে এসেছে দ্বিগুণ টাকায়। থিয়েটারের মালিক একজন মারোয়াড়ি ব্যবসায়ী, তাকে জানানো হয়েছে উৎসবে অঙ্গ হিসেবে তলোয়ার পূজোর কথা। মালিকের তাতে আপত্তি নেই, সে বলেছে, আপনার পূজা করেন, নাচেন, কুঁদেন, সে আপনারা জানেন। আমার ভাড়ার টাকা ঠিকঠাক পেলেই হল।
সে মারোয়াড়ি আর টাকা ফেরত দেবে না। দুটো হলের মধ্যে কোথায় হবে উৎসব? উদ্যোক্তারা জরুরি মিটিং-এ বসল। হাতে আর বেশি সময় নেই। অ্যালবার্ট হলের কথা লোকজনকে জানানো হয়ে গেছে, সেখানেই ব্যবস্থা করা উচিত। কিন্তু নরেন সেনের ব্যবহারে সকলেই কুপিত হয়ে আছে। নরেন সেন যে হল দিতে আপত্তি করেছিলেন, সেটাও জনসাধারণের জানা উচিত। তখন ঠিক হল, আলফ্রেড থিয়েটার হলেই হবে অনুষ্ঠান, অ্যালবার্ট হলের সামনে ভলান্টিয়ার দাঁড় করিয়ে রাখা হবে, তারা দর্শক-শ্রোতাদের থিয়েটার হলে পৌঁছে দেবে।
যথাসময়ে বিপুল জনসমাগমে শুরু হল অনুষ্ঠান। সরলা নিজে গেল না, তার উদ্বোধনী ভাষণ লিখে পাঠিয়ে দিল। বাড়িতে সে বসে রইল উদ্বিগ্ন প্রতীক্ষায়। সত্যিই কি পুলিশ হামলা চালাবে? তার অনুবর্তী যুবকেরা কারারুদ্ধ হবে? সরলাও ওদের সঙ্গে যেতে রাজি আছে। সরলা যেন মনে মনে চায়, একটা কিছু ঘটুক, ইংরেজ সরকারের টনক নড়ক, দমননীতি শুরু হোক। তাতে যুব সম্প্রদায় আরও বেশি উত্তেজিত হবে। ব্রিটিশ সরকারের অস্ত্র আইনে ভারতীয়রা কোনও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করতে পারে না। এখন প্রকাশ্যে অস্ত্র পূজা তো সরকারি আইনেরই বিরুদ্ধতা। এত বড় একটা দেশ, কোটি কোটি মানুষ, তারা আত্মরক্ষার জন্যও অস্ত্র ধারণ করতে পারবে না? শাসকরা সব সময় অস্ত্র উঁচিয়ে রাখবে, আর তার তলায় বধ্য পশুর মতন মাথা নিচু করে থাকবে এ দেশের মানুষ?
একা বৈঠকখানা ঘরে ভারতের মানচিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে সরলা। এক সময় সে সেই মানচিত্রের মধ্যে যেন দেখতে পায় অসংখ্য মানুষের চেহারা। তাদের পোশাক কতরকম, হিন্দু, মুসলমান, শিখ, বৌদ্ধ…এত মানুষ যদি সঙ্ঘবদ্ধ হয়, দেশকে মাতৃভূমি হিসেবে চিনতে শেখে, মাতৃভূমিকে পরাধীনতার অপমান থেকে মুক্ত করার জন্য একসঙ্গে রুখে দাঁড়ায়, তা হলে শাসক সম্প্রদায় বিচলিত হবে না?
আবেগে সরলার চোখে জল এসে যায়। আঁচল দিয়ে বারবার চক্ষু মোছে তবু জলের ধারা থামে না। এই অবস্থায় তাকে কেউ দেখে ফেললে কী ভাবে? সে একা একা কাঁদছে কেন? আর তো কোনও মেয়ের এরকম হয় না।
দুঃখে নয়। এ সরলার আনন্দাশ্রু। কল্পনায় সে দেখতে পাচ্ছে জাগ্রত ভারত। অস্ফুট কণ্ঠে সে গাইতে লাগলঃ
গাও সকল কণ্ঠে সকল ভাবে
নমো হিন্দুস্থান!
হর হর হর—–জয় হিন্দুস্থান!
সৎশ্রী আকাল হিন্দুস্থান!
আল্লা হো আকবর—হিন্দুস্থান!
নমো হিন্দুস্থান!