অনেকদিন পর দুই বন্ধুতে দেখা। কলেজ জীবন থেকে বহুদুর সরে এসে দুজনেই এখন প্রতিষ্ঠিত। দ্বারিকা এখন ছোটখাটো জমিদার, তবে খুলনা জেলায় সে তার জমিদারি সন্দর্শনে বছরে একবার, দু’বার যায় মাত্র, অধিকাংশ সময়েই কলকাতায় থাকে। দ্বারিকার সাহিত্য সাধনার শখ ছিল, সেইজন্য সে ‘নবজ্যোতি’ নামে একটি পত্রিকার মালিক হয়েছে, সেখানে সে অমিত্রাক্ষর ছন্দে নিজের কবিতা প্রকাশ করে।
যাদুগোপালেরও উচ্চাকাঙক্ষা মিটেছে অনেকখানি। সে বিলাতে ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়েছিল ঠিকই, পাশ করে ফিরে এসে হাইকোর্টের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ঠাকুরবাড়ির একটি কন্যাকে বিবাহের সাধও মিটেছে তার। রানি রাসমণির বাড়ির কাছাকাছি একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে সে এখন প্র্যাকটিস জমাতে ব্যস্ত। দ্বারিকানাথের তুলনায় যাদুগোপালেরই কবিত্ব শক্তি অনেক বেশি ছিল কিন্তু সে আর একেবারেই কবিতা রচনা করে না, আইনের কচকচির মধ্যে কবিতার স্থান কোথায়? বন্ধুদের সঙ্গে রসালাপের সময় অবশ্য সে এখনও মাঝে মাঝে গান গেয়ে ওঠে।
মেডিক্যাল কলেজের বিপরীত দিকে প্রতাপ চাটুজ্যের গলিতে বঙ্কিমচন্দ্র একটি বাড়ি করেছেন। সেই বাড়ির সদরের সামনে বিকেলবেলা দুই বন্ধু মুখোমুখি হয়ে গেল। শীতকাল শেষ হয়ে গিয়েও হঠাৎ ক’দিন আবার একটু ঠাণ্ডা পড়েছে। দ্বারিকানাথের তসরের পাঞ্জাবির ওপরে একটি বহুমূল্য কাশ্মীরি শাল জড়ানো। তার মুখে বেশ পুরুষ্টু গোঁফ। যাদুগোপালের অঙ্গে বিলাতি পোশাক।
বঙ্কিমবাবু কয়েকদিন ধরে বেশ অসুস্থ, তাঁর বহু ভক্ত, বন্ধু ও শুভার্থীরা উদ্বিগ্ন হয়ে খবর নিতে এসেছে, বৈঠকখানা ও বাড়ির অন্দরে খুব ভিড়।
কুশল আদান-প্রদানের পর যাদুগোপাল জিজ্ঞেস করল, কী রে দ্বারিকা, তুই কি তোর পত্রিকার জন্য লেখার তাগাদা দিতে এসেছিস নাকি? অসুস্থ মানুষটাকেও ছাড়বি না।
দ্বারিকা শুষ্ক মুখে বলল, নারে ভাই, উনি অনেকদিনই লেখা ছেড়ে দিয়েছেন জানিস না? আমার কাগজে উনি একটাও লেখা দেননি।
যাদুগোপাল বলল, তোকে উনি কত স্নেহ করতেন, ছাত্র বয়েস থেকেই তোর এখানে যাতায়াত ছিল, তবু তোকে লেখা দেননি।
দ্বারিকা বলল, আরে আমি তো কোন ছাড়। চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর উনি একটাও উপন্যাস লিখলেন? কত জন পীড়াপীড়ি করেছেন। জম্মভুমি পত্রিকার সম্পাদক ওঁকে একটি নতুন উপন্যাসের জন্য পাঁচশো টাকা দিতে চেয়েছিলেন। আমি সেদিন উপস্থিত ছিলাম। বঙ্কিমবাবু অরাজি হওয়ায় সেই সম্পাদক আরও টাকা বাড়াতে চাইলেন। কিন্তু ওঁর সেই এক গোঁ, গড়গড়ার নল টানতে টানতে বলতে লাগলেন, না, আমার দ্বারা হবে না।
যাদুগোপাল বলল, পাঁচশো টাকা তো কম নয়। এর আগে অত টাকা কেউ দিয়েছে উপন্যাসের জন্য?
দ্বারিকা বলল, পাঁচশো কী বলছিস। জন্মভূমি’র সম্পাদক চলে যাবার পর আমি বললাম, জ্যাঠামশাই, আপনাকে আমি এক হাজার টাকা দেব। প্রাচীন ভারত নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার কথা আপনি এক সময় বলতেন, সেটা লিখে দিন, তাতে আমার কাগজ দাঁড়িয়ে যাবে। উনি কী উত্তর দিলেন জানিস? সেই একই ভাবে গড়গড়ার নন্স মুখে দিয়ে টানতে টানতে বললেন, দ্বারিকা, তুই যদি কালীঘাটে নিয়ে গিয়ে আগকে বলি দিতে চাস, তাতেও রাজি আছি। কিন্তু আমাকে আর লিখতে বলিস না।
যাদুগোপাল বলল, বয়েস তো ওঁর বেশি নয়, পঞ্চান্ন ছাপ্পান্ন হবে বোধহয়, এর মধ্যেই সাহিত্য সম্রাট অবসর নিতে চাইলেন কেন? রাজা-বাদশারা তো কেউ অবসর নিতে চান না?
দ্বারিকা বলল, ওঁর মন ভেঙে গেছে। স্বর্ণকুমারী দেবী কতবার এসেছেন, ওঁর নাতিদের জন্য কত খেলনা দিয়েছেন, তবু ভারতী’র জন্য লেখা পাননি। রবিবাবু এসেছেন ‘সাধনা’র জন্য, সুরেশ সমাজপতি এসেছেন ‘সাহিত্য পত্রিকার জন্য। এমনকী বঙ্কিমবাবুর বেয়াই দামোদরবাবু কত ঝুলোঝুলি করেছেন ‘নব্যভারতে একটা কিছু লেখার জন্য, সবাইকেই উনি বলেছেন, আমি আর পেরে উঠব না। ওঁর মেয়ের মৃত্যুর পরই উনি যেন গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেকে।
যাদুগোপাল বলল, ওঁর ছোটমেয়ে উৎপলকুমারী আত্মহত্যা করেছে শুনেছি। ভেরি স্যাড!
দ্বারিকা গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, আত্মহত্যা নয়। ভেতরের খবর তো সব আমি জানি। আরও জঘন্য, আরও কুৎসিত ব্যাপার! ওঁর জামাই মতীন্দ্রটা তো একটা নরপশু। মদ, জুয়া, গাঁজা, পরদার গমন, কোনও গুণেরই ঘাটতি নেই। ওর নজর আবার গেরস্থ ঘরের বউদের দিকে। বন্ধু বান্ধবও জুটেছে সেই রকম, টাকা উড়িয়েছে দু’হাতে। উৎপলার কাছে বারো হাজার টাকার গয়না ছিল, মতীন বারবার সেই গয়নাগুলো চাইত। উৎপল দেবে কেন, ওই গয়নাই তো তার শেষ সম্বল। মতীন তখন করল কী এক বদ বন্ধুর সঙ্গে মতলব এঁটে ডাক্তারের কাছ থেকে বিষ নিয়ে এল, ওষুধের সঙ্গে মিশিয়ে খাইয়ে দিল বউকে। ভেবেছিল, বউ অজ্ঞান হয়ে গেলে গয়নাগুলো নিয়ে চম্পট দেবে। বিষ খেয়ে উৎপলা মরেই গেল দেখে মতীন তখন তার গলায় কাপড় বেঁধে কড়িকাঠে টাঙিয়ে দেয়। তাইতে লোক প্রথমে ভেবেছিল আত্মহত্যা। পরে মেয়েটার শরীর কেটে কুটে পোস্ট মর্টেমে বিষ পাওয়া গেছে।
যাদুগোপাল বলল, কিন্তু আদালতের রায়ে তো আত্মহত্যাই বলেছে?
দ্বারিকা বলল, মেয়ে যখন মারাই গেছে, তখন আর পরিবারের কুৎসা বাইরে ছড়াতে চান নি বঙ্কিমবাবু। আদালতে কেস কনটেস্ট করেননি। মতীনের ঠাকুদাও নাতিকে বাঁচাবার জন্য কাকুতি-মিনতি কবেছিলেন।
যাদুগোপাল অস্ফুট স্বরে বলল, কুন্দনন্দিনী!
দ্বারিকা বলল সেই কথাই মনে পড়ে, তাই না? উনি নিজেও আফশোস করে অনেকবার বলেছেন, আমি কুন্দনন্দিনীকে বিষ খাইয়ে মেরেছি, আর আমার অদৃষ্টেই আমার নিজের মেয়ে বিষ খেয়ে মরল। দ্যাখ যাদু, এতবড় একজন লেখক, আরও কত কিছু লিখতে পারতেন, কিন্তু জীবন থেকে শান্তিটাই চলে গেল। কিছুদিন ধরেই বলতে শুরু করেছেন, উনি আর বাঁচবেন না, বাঁচতে চান। কত লোক ওঁর মনে আঘাত দিয়েছে। নিজের পৈতৃক ভিটে কাঁঠালপাড়াতেও আর যেতে চান না। রাগ করে বলেছেন, এখানে আর পা দেব না। দাদারা ভাল ব্যবহার করেননি, নিজের উপার্জনের টাকায় দাদাদের সংসার বহুকাল টেনেছেন, তবু কৃতজ্ঞতা বলে কোনও বস্তু নেই। সঞ্জীবচন্দ্রের ছেলেটি তে ওকে জ্বালিয়েছে সারাজীবন। নৈটির ভট্টাচার্যরা ওর পেছনে লেগেছিল। এক ব্যাটা ভট্টাচার্য তো সামান্য এক টুকরো জমির জন্য মামলা করে প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে বঙ্কিমবাবু একজন ঠক, প্রতারক। এক সাবের জন্যই তো মন ভেঙে গেছে।
যাদুগোপাল বলল, আমি লোকমুখে শুনেছি, উনি ইদানীং অনেককে বলতেন ধর্ম অনুশীলন করে ধর্ম প্রচারই ওঁর এখন প্রধান কাজ। সেই ধর্ম ও ওকে শান্তি দিতে পারল না। দ্বারিকা, আমি একটা কাজে এসেছি, তোকে একটু সাহায্য করতে হবে। ইংলন্ড প্রবাসী আমার গুটিকতক বন্ধু বঙ্কিমবাবুর উপনাস ইংরাজিতে অনুবাদ করে সেখানে প্রকাশ করতে চায়। আমাদের দেশে যে কত উৎকৃষ্ট সাহিত্য রচিত হয়েছে, তা ইংরেজরা পড়ক, এই ওদের উদ্দেশ্য। লেখকের তো অনুমতি চাই। আমি যখন বঙ্কিমবাবুকে বলব, তুই পাশে থাকবি।
দ্বারিকা বলল, অনুমতি পাবি না।
যাদুগোপাল বিস্মিত হয়ে বলল, কেন? এতে তো ওর কোনও পরিশ্রম নেই, অন্য লোকে অনুবাদ করবে, উনি শুধু সম্মতি জানাবেন। কিছু টাকাও পাবেন।
দ্বারিকা বলল, জানিস তো মানুষটা কেমন জেদি। কিছুদিন ধরে ওঁর ধারণা হয়েছে, সাহেবরা ওঁর লেখা অনুবাদ হলেও পড়তে চাইবে না, পড়লেও বুঝবে না। এর আগে দু’একজন অনুমতি চেয়েছে, উনি রাজি হননি। উনি নিজে দেবী চৌধুরানী’ অনুবাদ করেছিলেন, এখন সে পাণ্ডুলিপি ফেলে রেখেছেন, আর ছাপতে চান না।
যাদুগোপাল বলল, ইংলন্ডে প্রকাশক পাওয়া শক্ত। আমার বন্ধুরা নিজেদের খরচে ছাপবে বলেছে। ‘
দ্বারিকা বলল, তা হোক না। সাহেবদের পড়াবার ব্যাপারে ওঁর আর কোনও আগ্রহ নেই। উনি নিজেই তো একবার ইংল্যান্ডে যেতে চেয়েছিলেন, সে ইচ্ছে কবে ঘুচে গেছে, ইংরেজদের ওপর খুব
বাড়ির ভেতর থেকে তোক বেরিয়ে আসছে দলে দলে। দোতলায় বঙ্কিমের শয়নকক্ষে এখন কারুকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। এখন সেখানে রয়েছেন ডাক্তার মাহেন্দ্রলাল সরকার।
অশান্তি ও মানসিক অবসাদের জন্য বঙ্কিমচন্দ্র কিছুদিন ধরে বহুমূত্র রোগে ভুগছেন। চাপা স্বভাবের মানুষ, নিজের বিষয়ে কিছু বলতে চান না, রোগের কথা অনেক দিন কারুকে জানাননি। কিন্তু এই শীতকালে রোগের প্রকোপ খুব বেড়ে গেল, রাত্তিরে ঘুমোত পারেন না, মুহুর্মুহু উঠে জল খান আর প্রস্রাব করতে যান। তাঁর স্ত্রী বিচলিত হয়ে পড়লেন। চিকিৎসার কথায় বঙ্কিম বিশেষ গা করেন না। স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত বললেন, ঠিক আছে, তোমাদের মনে যাতে আক্ষেপ না থাকে, ডাকো ডাক্তার।
সাধারণ ওষুধে বিশেষ কিছু উপকার হল না। চলছিল একই রকম, হঠাৎ একদিন অসহ্য যন্ত্রণায় তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। এবার বড় বড় চিকিৎসকদের ডাকা হল, তাঁরা বললেন, মূত্রনালীর মধ্যে বড় একটা ফোঁড়া হয়েছে, অপারেশান না করলে যন্ত্রণা আরও বাড়বে। শহরের বিশিষ্ট শল্য চিকিৎসক ওব্রায়েনকে কল দিয়ে তার পরামর্শ নেওয়া হল। ডক্তর ওব্রায়েন বললেন, তিনি অবিলম্বে অস্ত্রোপচার করে ফোঁড়াটি বাদ দিতে চান।
বঙ্কিম রাজি হলেন না। তিনি শয্যাশায়ী হয়ে থাকলেও তাঁর মতের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস কারুর নেই। তিনি বললেন, আমার আর পরিত্রাণ নেই, আমি জেনে গেছি। অস্ত্রাঘাত করো বা না করো, ফল একই হবে। তবে মিছেমিছি আর কেন অস্ত্রাঘাতে যাতনা বাড়াও।
ডাক্তার ওব্রায়েন নিরস্ত হয়ে ফিরে গেছেন। তারপর ডাকা হয়েছে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারকে।
মহেন্দ্রলাল বঙ্কিমের বন্ধু স্থানীয়। দুজনের চরিত্রগত আর আদর্শগত প্রভেদ অনেক, তবু কোথাও একটা মিল আছে। দুজনেই দেশের মানুষের উন্নতির কথা চিন্তা করেছেন। সমাজ জীবনে ধর্মের ভূমিকা নিয়ে দুজনের মধ্যে তর্ক বেঁধেছে প্রায়ই, কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে যে বিজ্ঞান চেতনা জাগানো দরকার এ বিষয়ে বঙ্কিম মহেন্দ্রলালের সঙ্গে একমত। মহেন্দ্রলালের বিজ্ঞান সংস্থার জন্য চাঁদা তোলায় সাহায্য করেছেন বঙ্কিম। এ দেশের ধনীরা পুতুলের বিয়ে কিংবা পোষা বাঁদরের বিয়েতে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে অথচ বিজ্ঞান সংস্থা পরিচালনায় সাহায্যের জন্য মুষ্টি খোঙ্গে না, এ নিয়ে তীব্র বিদ্রুপের কশাঘাত করেছেন।
অসহ্য যন্ত্রণায় বঙ্কিম কয়েকদিন ধরেই তন্দ্রাচ্ছন্নের মতন রয়েছেন, কিছু খেতে চান না, কারুর সঙ্গে কথাও বলেন না। মহেন্দ্রলাল আসার পর অবশ্য উঠে বসেছিলেন, কথাও বললেন অনেকক্ষণ, কক্ষের মধ্যে তখন আর কারুকে থাকতে দেননি।
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর যাদুগোপাল বলল, আমি চলি রে, দ্বারিকা। আর থাকতে পারছি না। আর একদিন আসব।
দ্বারিকা তার হাত ধরে টেনে বলল, ধৈর্য হারাচ্ছিস কেন? একটু অপেক্ষা কর, ডাক্তার চলে গেলে আমি ঠিক একবার ওপরে গিয়ে ওঁকে প্রণাম করে তসব। তখন তুই তোর প্রস্তাবটা পেড়ে দেখি, যদি রাজি হন।
আর কিছু পরে ওপর থেকে নেমে এলেন মহেন্দ্রলাল। যাদুগোপাল তাঁকে দেখেছে কয়েকটি বক্তৃতা সভায়, তাও বেশ কয়েক বছর আগে। এক সময় মহেন্দ্রলালের চেহারায় যে তেজ ও দার্ট ছিল তা যেন ফ্যাকাসে হয়ে এসেছে কিছুটা। চুলে পাক ধরেছে, চোখের নীচে ক্লান্তির রেখা। তবু পুরুষ সিংহের ভাবটি হয়েছে ঠিকই, সিঁড়ি দিয়ে নামলেন দপদপিয়ে। বঙ্কিমের চেয়ে তিনি বয়েসে বছর পাঁচেকের বড়, এখনও তাঁর কণ্ঠস্বর গমগম করে।
বৈঠকখানা ঘরে এসে ওয়েস্টকোটের পকেটে দুটি হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন লোকের জমায়েতটি দেখলেন। তারপর, এটা যেন তাঁর নিজের বাড়ি এই ভঙ্গিতে বললেন, আপনারা অপেক্ষা করছেন কেন? বাড়ি যান। রুগির সঙ্গে আজ আর দেখা হবে না। আমি বলে এসেছি, লোকজনের সঙ্গে কথা বলা নিষেধ। উনি এখন ঘুমোবেন।
দ্বারিকা তাঁর মায়ের চিকিৎসার জনা মহেন্দ্রলালকে বাড়িতে নিয়ে গেছে বেশ কয়েকবার। তাই সে এগিয়ে গিয়ে বলল, নমস্কার ডাক্তার সরকার, আপনার ব্যাগটা দিন গাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছি।
মহেন্দ্রলাল গম্ভীর ভাবে বললেন, তার দরকার নেই, আমি নিজেই নিতে পারব। আমার তল্পিবাহক লাগে না।
দ্বারিকা ও যাদুগোপাল ডাক্তারের সঙ্গে সঙ্গে গেল বাইরে বগিগাড়ি পর্যন্ত। দরজাটা খুলে দিয়ে দ্বারিকা ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞেস করল, কেমন দেখলেন একটু বলুন। উনি অপারেশান করাতে রাজি হয়েছেন?
মহেন্দ্রলাল অপ্রসন্ন ভাবে বললেন, রুগি যে নিজেই ডাক্তার। বলে কি না কাটা ছেড়া করলে ফোঁড়ার দূষিত পুজ রক্তে মিশে যাবে, তাতে আরও রোগ বৃদ্ধি পাবে। যে অপারেশন করবে সে যেন তা বোঝে না!
দ্বারিকা বলল, আপনি জোর করে বোঝালেন না? সবাই তো বলছে, অপারেশান ছাড়া গতি নেই। আপনার কথা শুনরেন, আপনাকে তো সবাই ভয় পায়।
মহেন্দ্রলাল বললেন, রুগি নিজে না চাইলে আমি কক্ষনও জোর করি না। তাও এরকম বিখ্যাত মানুষ। অপারেশানের সময় অন্য রকম কিছু হয়ে গেলে তখন তোমরাই তো আমাকে দুষবে।
—আপনি ওষুধ দিয়েছেন?
–না দিইনি। যা চলছে তাই চলুক। অ্যালোপাথির সঙ্গে হোমিওপ্যাথি মিশিয়ে আর লাভ কী?
—ডাক্তারবাবু, ওঁকে আমি আমার বাবার চেয়েও বেশি শ্রদ্ধা করি। ওকে কেমন দেখলেন, আপনি সত্যি করে বলুন।
মহেন্দ্রলাল চশমার ওপর দিয়ে দ্বারিকার থমথমে মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ধমকের সুরে বললেন, যদি অতুই শ্রদ্ধা করো, তা হলে ওই সব সন্ন্যাসী-ফ্যাসীগুলোকে আটকাতে পারো না?
যাদুগোপাল অস্ফুট স্বরে বলল, সন্ন্যাসী?
মহেন্দ্রলাল বললেন, তিব্বত থেকে এক সন্ন্যাসী এসে চাটুজ্যের কানে কী যেন ফুসমন্তুর দিয়ে গেছে। এই সন্ন্যাসীগুলোর কি খেয়ে দেয়ে আর কাজ নেই? হিমালয়ের গুহা করে তপস্যা করছিলি, বেশ তো তাই কর না, তোদর আবার এই ধুলো-ময়লা-পাপে ভর্তি শহরবাজারে নেমে আসার কী দরকার? চাটুজ্যেকে সে কী যেন বুঝিয়ে গেছে। তাতেই ওর ধারণা হয়েছে যে ওর আর বেশিদিন আয় নেই। আরে বাপু, তোরাই যদি জন্ম-মৃত্যুর নিদান দিবি, তা হলে আমরা ডাক্তাররা রয়েছি কী করতে? এতবড় একজন রাইটার, এতগুলো বছর কাটল সরকারি চাকরির জোয়াল টেনে, ন রিটায়ার করার পর কোথায় খোলা মনে লিখবে, বা সরস্বতীর সেবা করবে, তা না হঠাৎ হাত গুটিয়ে বসে রইল। ছি ছি ছি!
গাড়িতে উঠতে উঠতে মহেন্দ্রলাল আবার বলেন, দেখো বাপু, অনেক রকম ডাক্তারি শাস্ত্র তো ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখলুম এতগুলো বছর, তাতে একটা সার কথা বুঝেছি। যে মানুষ নিজে বাঁচতে চায় না, কোনও ডাক্তারের বাপেরও সাধ্য নেই তাকে বাঁচাবার।
মহেন্দ্রলাল চলে যেতেই দ্বারিকানাথ বন্ধুর কাঁধে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠল। একেবারে শিশুর মতন কান্না।
যাদুগোপাল ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, আরে করিস কী, করিস কী, এ তে যে গৃহস্থ বাড়ির অকল্যাণ হবে!
দ্বারিকা জলভরা নয়নে বলল, বঙ্কিম নেই, এ আমি সহ্য করতে পারব না রে যাদু, কিছুতেই পারব না।
যাদুগোপাল বলল, উনি তো এখনও আছেন আমাদের মধ্যে, সেরে যে উঠবেন না তা কি কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে? তুই এখানে দাঁড়িয়ে কান্না শুরু করলি, ওঁর বাড়ির লোক কী ভাববে?
যাদুগোপালের নিজের গাড়ি নেই, সে দ্বারিকানাথকে জোর করে টেনে নিয়ে তার গাড়িতে উঠিয়ে দিল। দ্বারিকা শক্ত ভাবে আঁকড়ে রইল যাদুগোপালের হাত, বন্ধুকে সে এখন ছাড়বে না। অগত্যা যাদুগোপালকেও উঠতে হল সেই গাড়িতে।
বেলা পড়ে এসেছে। রাস্তায় গ্যাসের বাতি জ্বেলে দিয়ে যাচ্ছে পুরসভার কর্মী। হাজার হাজার কয়লার উনুনের ধোঁয়া বাতাসে যেন জমাট বেঁধে আছে। কোচোয়ানকে কিছু নির্দেশ দেবার আগেই সে অদুরের হাড় কাটার গলিতে ঢুকে পড়ল।
যাদুগোপাল বাইরে তাকিয়ে বলল, গাড়িটা একটু থামাতে বল দ্বারিকা, আমি এখানে নেমে যাব।
দ্বারিকা বলল, বসন্তমঞ্জুরীকে তোর মনে আছে? একবারটি চুল তার কাছে। তোকে দেখলে সে বড় খুশি হবে! কতদিন তোকে দেখেনি।
দ্বারিকার সনির্বন্ধ অনুরোধ এড়াতে পারল না যাদুগোপাল! মধ্যে বেশ কয়েক বছর দেখা না হলেও দ্বারিকা সম্পর্কে কিছু খবরাখবর তার কানে এসেছে। অনেকে দ্বারিকাকে মদ্যপ, উচ্ছ্বল এবং হুজুগে মানুষ বলেই জানে, কিন্তু সেটাই তার প্রকৃত পরিচয় নয়। বসন্তমঞ্জরীর সঙ্গে দ্বারিকার সম্পর্কের জন্য যাদুগোপাল মনে মনে বন্ধুকে শ্রদ্ধাই করে।
লোভী ও জাত্যভিমানী পিতার জন্য বসন্তমঞ্জরীর ভুল বিবাহ এবং জীবনটা নষ্ট হতে বসেছিল, তাকে উদ্ধার করেছে দ্বারিকা। কিন্তু তাকে নিছক রক্ষিতা করে রাখেনি, তাকে অনেক বেশি মর্যাদা দিয়েছে। বসন্তমঞ্জরীকে সে বিয়ে করতে চেয়েছিল, কিন্তু দ্বারিকার মা বেঁচে থাকতে তা সম্ভব নয়। মায়ের ভয়ে সে বেশ্যাপল্লীর একটি নারীকে নিজের স্ত্রীর আসনে বসাতে পারে না বটে, কিন্তু মায়ের শত অনুরোধেও সে এখনও অন্য কোনও মেয়েকে বিয়ে করেনি। বসন্তমঞ্জরী তার স্ত্রীরই মতন।
নৈতিকতার বাধায় যাদুগোপাল এসব পঙ্গীতে কখনও প্রবেশ করে না। তবু বসন্তমঞ্জরীকে একবার দেখার কৌতূহল হল তার। অল্প বয়সে এই বসন্তমঞ্জরী তাদের কৃষ্ণনগরের বাড়িতে খেলা করতে আসত।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে দ্বারিকা বলল, বাসির একটা অদ্ভুত শক্তি আছে জানিস? ও ভবিষ্যৎ দেখতে পায়।
যাদুগোপাল বিস্মিত না হয়ে বলল, এখনও পায় বুঝি? বাচ্চা বয়েসেই ও বিচিত্র সব কথা বলত। একবার শীতকালে আমাদের ঠাকুর দালানে খেলা করতে করতে ও ‘ঝড় আসছে ‘ঝড় আসছে বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল। আকাশে মেঘের চিহ্নমাত্র ছিল না, শীতকালে ঝড়ই বা উঠবে কেন? কিন্তু সত্যি সত্যি ঘণ্টা খানেকের মধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছিল দারুণ ঝড়-বৃষ্টি। আমার দিদিমা এখনও সেই গল্প করেন। দিদিমার মতে, কোনও কোনও পশু-পাখি নাকি ঝড় বা ভূমিকম্পের কথা আগে থেকে টের পেয়ে যায়।
দ্বারিকা বলল, কী জানি। কোনও কোনও মানুষও বোধহয় পায়। একদিন আমাকে বলল, তুমি মাংস খেয়ো না। তোমার আজ অণীচ! শুনে মি বঙ্গম, চুপ কর, ও কি অলক্ষুণে কথা। ওমা, পরদিনই তার এল, দেশের বাড়িতে আমার এক কাকা মারা গেছেন। এরকম আরও কয়েকবার হয়েছে।
যাদুগোপাল জিজ্ঞেস করল, ও কি নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে পায়?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্বারিকা বলল না, ও নিজের কথা কিছু বলে না।
দুই বন্ধু যখন দরজার কাছে এসে দাঁড়ান্স তখন বসন্তমঞ্জরী মেঝেতে বসে একটা তানপুরা নিয়ে। তন্ময় হয়ে গান গাইছে।
হরি
হরি আর কি এমন দশা হব
কবে বৃষভানুপুরে আহীর গোপের ঘরে
তনয়া হইয়া জনমিব…
ওরা দুজনে চুপ করে বসে গানটা শুনল। ভাঙা ভাঙা গলা বসন্তমঞ্জরীর, এ গান যেন সে শুধু নিজের জন্য গাইছে। তারপর মুখ ফিরিয়ে ওদের দেখে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। কত বৎসর পর যাদুগোপালকে দেখল সে, চিনতে তার একটুও দেরি হয়নি। যাদু কাকা!’ বলে ছুটে এসে তার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে লাগল হু হু করে।
যাদুগোপাল তাকে কাঁদতে দিল। যাদুগোপাল যে ওর পুরো বাল্যকালটা সঙ্গে নিয়ে এসেছে।
খানিক পরে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যাদুগোপালের মামা বাড়ির সকলের খোঁজ নিতে লাগল, কিন্তু নিজের মা বাবার প্রসঙ্গ উচ্চারণ করল না।
নিজেই গেলাস ও ব্র্যান্ডির বোতল বার করে নিল দ্বারিকা। প্রতিদিন সে মদ্যপান করে, আজ তার গুরু বঙ্কিমের পীড়ার সংবাদ শুনে মন খারাপ, আজ তো সে বেশি করে পান করবেই। যাদুগোপাল এসব স্পর্শ করে না, তাকে সে অনুরোধও জানাল না। সত্যিই দ্বারিকা বঙ্কিম-ভাবনায় খুব বিচলিত হয়ে আছে। বারবার বলছে সেই কথা।
যাদুগোপাল একবার বলল, বছর তিনেক আগে বিদ্যাসাগর মশাই চলে গেলেন, একবার শেষ দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আমি তখন এলাহাবাদে।
দ্বারিকা বলল, তিনি বড় কষ্ট পেয়ে গেছেন। খুব হিক্কা হত, সেই সঙ্গে প্রলাপ। শেষ মুহূর্তের কিছু আগে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, দু’চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল অনবরত… কী বলতে চাইছিলেন কে জানে।
হঠাৎ সচকিত হয়ে দ্বারিকা বলল, সে দিনটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে, ১৩ই শ্রাবণ, আমরা দু’জনে একটা থিয়েটার দেখতে গিয়েছিলাম, ফিরে এসে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করেছি হৃদে বসে। বাসি গান গাইছিল, এক সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, একজন মহাপুরুষ আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন ওই আকাশে, ওই যে যাচ্ছেন। পরদিনই শুমি রাত প্রায় আড়াইটের সময় বিদ্যাসাগর মশাই শেষ নিশ্বাস ফেলেছেন। তুই কী করে বলেছিলি রে বাসি?
বসন্তমঞ্জরী বলল, কী জানি! কেমন যেন দেখতে পেলাম একটা জ্যোতি, অন্য কোনওদিন তেমন দেখি না—
দ্বারিকা বলল, বাসি, বঙ্কিমচন্দ্রের খুব অসুখ। সবাই খুব ভয় পাচ্ছে। তুই বলতে পারিস তিনি আর বাঁচবেন কি না।
বসন্তমঞ্জরীর মুখে একটা পার ছায়া পড়ল। সে ব্ৰস্ত ভাবে বলে উঠল, না, না, না, আমি কী করে বলব? আমি ওসব জানি না। আমি তো তেনাকে কখনও চক্ষেও দেখিনি।
যাদুগোপাল জিজ্ঞেস করল, তুমি তো বিদ্যাসাগর মশাইকেও কখনও দেখনি।
বসন্তমঞ্জরী হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলল, হ্যাঁ দেখেছি। তাকে একবার দেখেছি।
দ্বারিকা বলল, তা ঠিক। ওকে নিয়ে আমি একবার ফরাসডাঙায় গিয়েছিলুম, তখন বিদ্যাসাগর মশাই-ও স্বাস্থ্য ফেরাবার জন্য ফরাসডাঙায় ছিলেন, বোক্স প্রাতঃভ্রমণে বেরুতেন, আমরা দুজনে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছি।
যাদুগোপাল বলল, বঙ্কিমচন্দ্র কে তা তুমি জানো?
বসন্তমঞ্জরী বলল, বাঃ জানব। না? এই তো সেদিন ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ পড়া শেষ করলুম। বড় দুঃখের বই। কৃষ্ণচরিত্র বারবার পড়ি।
যাদুগোপাল চমকৃত হল। বসন্তমঞ্জরীর পড়াশুনো এতটাই এগিয়েছে যে সে বঙ্কিমের প্রবন্ধগ্রন্থ পর্যন্ত পাঠ করে! এই মেয়ের এমন ভাগ্য বিড়ম্বনা!
এবার বসন্তমঞ্জরীই প্রশ্ন করল, হ্যাঁ গো, তোমাদের সেই বন্ধু ভরত কোথায়?
যাদুগোপাল বলল, তাই তো, আসামের সেই ছোকরাটা কোথায় গেল। বহুদিন তার পাত্তা নেই, তুই জানিস নাকি রে দ্বারিকা?
দ্বারিকা বলল, না। ইরফানের কাছে শুনেছি, কোন একটা মেয়ের জন্য নাকি তার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ইরফানের সঙ্গে আমার দেখা হয় মাসে মাসে। ইরফানের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখে না ভরত। কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।
বসন্তমঞ্জরী আবিষ্টর মতন বলল, অনেক দূরে চলে গেছে।
দ্বারিকা বলল, এটাও আশ্চর্য, জানিস যাদু, বাসি ভরতকে দেখেছে মাত্র একবার, তাও একটুখানি, তবু ও ভরতের কথা প্রায়ই জিজ্ঞেস করে। প্রথম প্রথম আমার বেশ হিংসে হত। এখন অবশ্য মনে হয়, ছ সাত বছর যার দেখা নেই, সে রকম একজন হারিয়ে যাওয়া মানুষকে হিংসে করাটাও ছেলেমানুষী!
আর কিছুক্ষণ পর আড়া ভঙ্গ হল। যাদুগোপালের বাড়ি ফেরার তাড়া আছে। দ্বারিকা এর পরও প্রতিদিন বঙ্কিমের স্বাস্থ্যের খবর নিতে যায়। একদিন পাওয়া গেল সুসংবাদ। অস্ত্রোপচারের দরকার হয়নি, মূত্রনালির ফোঁড়াটি নিজে নিজেই ফেটে গেছে, বঙ্কিম অনেকটা সুস্থ বোধ করছেন।
দ্বারিকার খুশি আর ধরে না। একদিন সে বঙ্কিমের শয্যার কাছে গিয়ে তাঁর পা জড়িয়ে ধরে বসে রইল অনেকক্ষণ। বঙ্কিম বালিশে ঠেস দিয়ে বসেছেন, তাঁর এই ভক্তটির পাগলামি দেখে মৃদু হেসে বললেন, কী রে, তুই কি এখনও আমাকে দিয়ে উপন্যাস লেখাবার আশা ছাড়িসনি?
দ্বারিকা বলল, আপনাকে আবার লিখতেই হবে। আমার কাগজে না হয়, ভারতী’ কিংবা সাহিত্যে লিখুন। বাংলাভাষা আপনার কাছ থেকে আরও অনেক কিছু প্রত্যাশা করে।
একজন লোক বঙ্কিমের কতকগুলি ছবি নিয়ে এসেছে। ফটোগ্রাফ নয়, বড় আকারের ছাপানো ছবি। বাজারে এই ছবি এক একখানা বিক্রি হচ্ছে দু’ আনা দামে। বঙ্কিম সে ছবি সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহ দেখালেন না, দ্বারিকাকে বললেন, তুই একটা নিয়ে যা।
দ্বারিকা একটির বদলে দুটি ছবি নিল। ভাল ফ্রেমে বাঁধিয়ে একখানা সে রাখল তার মানিকতলার বাড়িতে। আর একটি সে নিয়ে এল বসন্তমঞ্জরীর কাছে। খুব আবেগের সঙ্গে বলল, বাসি, এটা তোর ঘরের দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখবি, রোজ প্রণাম করবি একবার করে।
ছবিখানার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বাসির চোখ জলে ভরে গেল। ছবিতে দেখা যাচ্ছে প্রাক প্রৌঢ়ত্বের বঙ্কিমকে। গৌরবর্ণ, তীক্ষনাসা, শাণিত চক্ষু, মাথার কাঁচা-পাকা কুঞ্চিত চুল কপালের ওপর এসে পড়েছে খানিকটা।
বসন্তমঞ্জুরীর ঘরে কোনও ছবি নেই। দেয়ালের একটি পেরেকে ঝুলছে একটা বাংলা ক্যালেন্ডার। তার একটি মাত্র পৃষ্ঠা। শুধু চৈত্র মাসটা বাকি। সেখানে এসে বসন্তমঞ্জরী ধরা গলায় বলল, বছর শেষ হয়ে আসছে। প্রত্যেক বছরই এই সময় কেমন যেন ভয় হয়, পরের বছর বাঁচব
শুধু তো বত্সরের শেষ নয়, চৈত্র ফুরোলেই যে শতাব্দীরও শেষ, শুরু হবে তেরোশো সাল। মহাকাশের গায়ে আর একটি আঁচড় পড়বে। কত কিছু হারিয়ে যায়, অভ্যুদয় হয় কত অপ্রত্যাশিত নবীনের।
বঙ্কিমের সেই ক্ষতস্থানে গজিয়ে উঠল আরও কতকগুলি ছোট ছোট বিক্ষোটক। আবার প্রচণ্ড যন্ত্রণা, তারপর যন্ত্রণারোধও চলে গেল, তিনি চলে গেলেন চেতন-অচেতনের মাঝখানে। চৈত্রের পৃষ্ঠা ছিড়তে বাকি রয়ে গেল, তার মধ্যেই ঘটে গেল ইন্দ্রপতন। বঙ্কিমের আর নতুন শতাব্দী দেখা হল না।