1 of 2

০৪. দুপুরগুলোই সরলার কাছে মনে হয় সবচেয়ে দীর্ঘ

সারা দিনের মধ্যে দুপুরগুলোই সরলার কাছে মনে হয় সবচেয়ে দীর্ঘ, সময় আর কাটতেই চায়। এত বড় বাড়ি একেবারে শুনশান। পড়াশুনো করতেই বা কতক্ষণ ভাল লাগে? যখন সময়ের টানাটানি থাকে কিংবা কিছু বিঘ্ন ঘটে, তখন পড়াশুনোয় মন বসে বেশি। আর সময় যখন অফুরন্তু, তখন মনে হয় পরে পড়লেই তো হয়।

দুপুরে ঘুমোত পারে না সরলা, দোতলায় তার নিজস্ব ঘরে মাদুর পেতে গুচ্ছের বই খুলে বসে। ওপর মহলে কোনও পুরুষ মানুষ নেই, জানকীনাথ গেছেন মফস্বলে, দাদা বিলেতে, জামাইবাবু কিছুদিন দিদির সঙ্গে এখানে ছিলেন, এখন তিনিও বদলি হয়ে গেছেন রাজশাহিতে। এই গরমে বাড়িতে কোনও অন্তর্বাস পরে না মেয়েরা, সরলার অঙ্গে শুধু একটা আটপৌরে শাড়ি জড়ানো, চুল খোলা, দু চোখে গাঢ়ভাবে কাজল টানা। স্নান করার পর প্রত্যেক দিন সুমা কাজল লাগানো তার শখ। সংস্কৃত বই পড়তে পড়তে এক সময় সে কোনও ইংরিজি কাব্যের বই টেনে আনে, খাতা খুলে দু-এক লাইন বাংলা কবিতা লেখে, হঠাৎ উঠে চলে যায় পাশের ঘরে। ঘরের তো অভাব নেই, সাত-আটখানা ঘর ফাঁকা পড়ে আছে। যে ঘরে দিদি-জামাইবাবু থাকতেন, সেই ঘরের পালঙ্কের ওপর শুয়ে ছটফট করে সরলা। দিদি তার বন্ধু, মন কেমন করে দিদির জন্য। বিবিও তার বন্ধু, কিন্তু বিবি এখন আর এ বাড়িতে বিশেষ আসে না।

এ ঘরে দেয়াল জোড়া একটা আয়না। দিদির খুব আয়নার শখ, দিদি এই বেলজিয়াম গ্লাসের দমি আয়নাটা লাগিয়েছিল, কী পরিষ্কার সব কিছু দেখা যায়। ঠিক যেন পালঙ্কের ওপর শুয়ে থাকা আর একটি সরলাকে এই সরলা দেখছে।

সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সরলা ভাবে, সত্যি সত্যি কেমন দেখতে আমাকে? বিকেলে যে ছেলেগুলো আসে, তারা সুন্দরী সুন্দরী বলে বলে সরলার কান ঝালাপালা করে দেয়। কেউ বলে অপ্সরী, কেউ বলে সরস্বতী, কেউ বলে রাজকন্যার মতন। সরলা ফিক করে হেসে ফেলে। রাজকনাই বটে, বন্দিনী রাজকন্যা। সরলা দু হাত ছড়িয়ে মুখে করুণ ভাব এনে রাজকন্যা সাজে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, প্রাণেশ্বর? কে তুমি অদৃশ্য প্রাণেশ্বর, উদ্ধারিলে মোরে?

বলতে বলতেই আবার তার হাসি পায়। এখনও পর্যন্ত কেউ তো তার প্রাণেশ্বর ময়! যেসব দিন কোনও আনুষ্ঠানিক চায়ের আসর থাকে না, সেইসব বিকেলেও কয়েকজন যুবক আসে। জানকীনাথের ভাষায়, তারা সব সরলার সিউটার। সত্যিই তারা আসে সরলার সাহচর্য পাবার জন্য, তার মনোরঞ্জনের জন্য তারা উপহার আনে কতরকম, ফুল ছাড়া সরলা অন্য কিছুই গ্রহণ করে না। তাদের মিষ্টি মিষ্টি স্তুতিবাক্যও বিশ্বাস করে না, সে জানে, ওরা তাকে অত সুন্দরী সুন্দরী বলে, বিবিকে দেখলেও গদগদভাবে ওই একই কথা বলবে। সরলা নিজে তো জানে, বিবি তার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর।

কেউ কেউ যখন একটু নিভৃতি পেয়ে সরলার কাছে উচ্ছ্বাস দেখাতে আসে, তখনও সরলা হেসে ফেললে তারা হকচকিয়ে যায়। সরলাও বোঝে যে এমনভাবে হেসে ফেলা উচিত নয়। কিন্তু সে যে হাসি সামলাতে পারে না।

একদিন ওদের একজন এমন নিরালা দুপুরে উঠে এসেছিল দোতলায়। বিশেষ পরিচিতদের মধ্যে কারুর যে ওপরে আসার নিষেধ আছে তা নয়, তবু দুপুরবেলা মেয়েরা যখন অন্দরমহলে কিছুটা অসংবৃত অবস্থায় থাকে, তখন কোনওভাবে জানান দিয়ে আসাটাই প্রথা। কিন্তু যোগিনী চাটুজ্যে যে হয় অতি সরল অথবা পাগল!

বড় মামা দ্বিজেন্দ্রনাথের বড় মেয়ে সরোজার বিবাহ হয়েছে মোহিনী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি সম্মানিত ব্যক্তি, সূরোজার খুড়তুতো, মাসতুতো মিলিয়ে আঠেরো কুড়িজন ভাই বোনের সকলেরই তিনি জামাইবাবু। এই মোহিনী জামাইবাবুর চারটি ভাই আছে, তাদের সর্বত্র অবাধ গতি। এদের মধ্যে সজনী আর যোগিনী দুজনেরই পছন্দ সরলাকে, দুজনেরই কেমন যেন পাগলাটে স্বভাব। সরলাকে তুষ্ট করার জন্য সজনী যখন-তখন বেসুরো গলায় গান গেয়ে ওঠে, সবাই হেসে গড়াগড়ি দিলেও সে থামতে চায় না। যোগিনী আবার উল্টো রকমের, সে প্রায় কথাই বলতে চায় না, চুপ করে মুগ্ধ নয়নে সরলার দিকে চেয়ে বসে থাকে। অন্য কেউ কথা বলতে গেলেও সে উত্তর দেয় না। তাই নিয়ে বারবার হাসি-ঠাট্টা করলে সে হঠাৎ অতি উৎসাহী হয়ে বলে ওঠে, তাস খেলবে? তাস খেলবে? এক প্যাকেট তাস নিয়ে সে সশব্দে ফ্যাটাতে থাকে, তাস খেলায় সে খুবই তুখোড়, এই খেলা দিয়ে সে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চায়।

যোগিনী চাটুজ্যেকে অকস্মাৎ দোতলার ঘরে দেখে খুবই অবাক হয়ে গিয়েছিল সরলা। সেদিনও সে দিদির ঘরের এই পালঙ্কেই শুয়ে ছিল। যোগিনী চাটুজ্যে বেশ সুপুরুষ, সচরাচর সে সাহেবি পোশাক পরে, কিন্তু ধুতি ও আচকানে তাকে আরও ভাল মানায়, সেদিন তার দেশি বেশ, হাতে একটি মখমলের কৌটো, মুখখানা বিহু ধরনের।

সরলা প্রথমে ভেবেছিল, ওই মখমলের কৌটোর মধ্যে বুঝি তাস আছে, যোগিনী তাস খেলতে এসেছে। কিন্তু দরজার কাছে যোগিনী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে। তার কৌটোটি খুলে বার করল একটি আতরের শিশি। দ্রুত এগিয়ে এসে সেই শিশিটা সরলার এক হাতের মুঠোয় দিয়ে বলল, সরলা, সরলা, যে কথা আমি এতদিনেও তোমায় বলতে পারিনি, আজ তা বলতে এসেছি, এই যে আতরটুকু, গাজিয়াবাদ থেকে আনিয়েছি, বড় সাধ হল তোমাকে দিই, এ যেন আমারই বুকের নির্যাস, তুমি অঙ্গে মাখরে…

মিতবাক যোগিনী চাটুজ্যের যেন সব সঙ্কোচের বাঁধ ভেঙে গেছে, অনর্গল কথা বেরিয়ে আসছে।

একজন রূপবান প্রেমিক উপহার এনেছে আতরের শিশি, সরলা উদ্ভিযৌবনা কুমারী, নিলা দুপুর, তৃতীয় কোনও ব্যক্তি এসে পড়ার সম্ভাবনা নেই। প্রেমের এমন উপযুক্ত পরিবেশ, তবু সরলা হঠাৎ উত্থিত একটা ফোয়ারার মতন হেসে লুটোপুটি খেতে খেতে বলতে লাগল, ওকী, ওকী, তুমি অমন শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছ কেন?

সেই হাসিতে চুপসে গিয়ে পিছু হটতে লাগল যোগিনী। আবার দরজার কাছে গিয়ে এমন বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে রইল, যেন সে গ্রহান্তরের কোনও প্রাণীকে দেখছে। সরলার হাসি আর থামেই না।

সেদিনের পর যোগিনী আবার দিন সাতেক গুম মেরে গিয়েছিল, যদিও এ বাড়িতে আসা বন্ধ করেনি। সেদিন যোগিনী মনে খুব আঘাত পেয়েছিল, সরলা বুঝতে পারে, কিন্তু সরলার যে ওই ধরনের কথা শুনলেই ন্যাকামি মনে হয়। আজও সে কথা মনে পড়ায় তার হাসি পেয়ে যাচ্ছে।

ওদের আর এক বন্ধু অবিনাশ চক্রবর্তীও নিয়মিত আসে। এর মাথায় বাবরি চুল, কাঁধে সব সময় থাকে মিল্পের চাদর, ঢুলু ঢুলু চক্ষুটি দেখলেই মনে হয় কবি কবি। অবিনাশ নিজে অবশ্য কবি নয়, তার বাবা ছিলেন নামজ়াদা কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী। অবিনাশ যখন ছোট ছিল, তখন তার বাবা তাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলেন, তার মধ্যে একাধিকবার সম্বোধন ছিল, ‘বাছনি আমার। এখন অবিনাশকে অনেকেই আড়ালে ‘বাছনি আমার’ বলে ডাকে। সরলার দাদা যখন এখানে ছিল, তখন এক একদিন ওপরে এসে দুষ্টুমি করে বলত, ও সল্লি, সক্সি, নীচে যা, ‘বাছনি আমার বাবু তোর জন এসে বসে আছেন।

অবিনাশের সঙ্গে যোগিনীর প্রতিযোগিতা হয়, কে কত দেরিতে উঠতে পারে। রাত্রি আটটা, নটা বেজে যায়, তবু ওবা বাড়ি যেতেই চায় না। সরলা হাই তোলে, অস্থিরতা দেখায়, সেসব বোঝার পাত্র ও নয়। যোগিনী যদি যাবার জন্য উঠে দাঁড়ায়, অবিনাশ বলে, তুমি এগোও, আমি আর একটু বসি। অমনি যোগিনীও বসে পড়ে। আবার যোগিনী যদি বলে, আজ খুব মেঘ কবেছে, শীঘ্র বাড়ি ফিলতে হবে, অবিনাশ তখন বলে, তা হলে আর দেরি কোরো না। যোগিনী বলে, তুমি আমার সঙ্গে চলো, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে যাব! অবিনাশ বলে, আমার জন্য এক ঘণ্টা পরে গাড়ি আসবে।

পৈত্রিক সম্পত্তি পাবার মতন অবিনাশ নিজেকে কবিত্বশক্তিরও অধিকারী মনে করে এবং লেখারও চেষ্টা কবে। সে কথাও বলে কবিতার ভাষায়। একদিন সরলা আপন মনে নিবিষ্ট হয়ে পিয়ানোতে বিথোফোনের মুনলাইট সোনাটা বাজাচ্ছে, সেদিন আর কেউ তখনও আসেনি, অবিনাশ আগে আগে উপস্থিত হয়ে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে সেই বাজনা শুনল। তারপর হঠাৎ ছুটে এসে সরলার একখানি হাত চেপে ধরে বলল, মরি মবি! কী সুন্দর, কী অপুর্ব! এ যেন স্বর্গের সুধাস্রোত নেমে এল মতে, এ সুরের লহরী গুঞ্জরিত হচ্ছে কাননে কাননে, পুষ্পে পুষ্পে সরলা, থেমো না, আরও বাজাণ্ড, আরও বাজাও…

সরলা বলল, হ্যাঁ বাত্তাব, কিন্তু আমার হাতখানা না ছাড়লে বাজাই কী করে?

হাতখানা ছেড়ে দিল বটে, কিন্তু সরলার বাজনার সঙ্গে চলতে লাগল তার অবিরাম কথার স্রোত, অহো, অহো, কী মধুক্ষরা সুর, তুমি মানবী নও, তুমি দেবী, তোমার ওই চম্পক বর্ণ অঙ্গুলি, ডালিম নিন্দিত গাল, বেদানার কোয়ার মতো ওষ্ঠ, বসে আছ অরার রূপ ধরি সরলা সুন্দরী…

মুনলাইট সোনাটা ভুলে গিয়ে সরলা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসতে লাগল।

এই সময় এসে উপস্থিত সজনী। ওদের এই অন্তরঙ্গ দৃশ্য দেখে সে স্থির থাকতে পারল না, নিজের ভাইয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা সে মেনে নিয়েছে, কিন্তু অবিনাশকে সে সরলার কাছ ঘেঁষতে দেবে না। সে প্রায় ছুটে এসে বলল, ও সরলা, তুমি বাজাচ্ছ, আমি একটা গান গাই? আমার গানের সঙ্গে তুমি বাজাও!

সজনীর গানের সম্ভাবনাতে সবাই শঙ্কিত হয়ে ওঠে। অবিনাশ বলল, ভ্রাতঃ সজনী, তুমি বাগানে গিয়ে গান কর না কেন? সরলা আমাকে বড় অপূর্ব সুর শোনাচ্ছিলেন।

সজনী বলল, দ্যাখো অবিনাশ, প্রথমত আমি তোমার ভাই-টাই হই না। দ্বিতীয়ত, তুমি বললেই বা আমি বাগানে যাব কেন হে? আমি এখানেই গাইব। আমার ইচ্ছে!

অবিনাশ বলল, তোমার ইচ্ছে হলে তুমি গাইতেই পার। অবশাই পার! তবে কি জান, সরলা তো ক্লাসিকাল সুর বাজাচ্ছিলেন, তার সঙ্গে তোমার গান যে মিলবে না ভাই।

সজনী বলল, কেন মিলবে না? ক্লাসিকাল মানে ওস্তাদি তো, আমি ওস্তাদি গানও জানি!

অবিনাশ বলল, ওই ক্লাসিকাল আর এই ক্লাসিকাল এক নয়! দা ইস্ট ইজ ইস্ট অ্যান্ড দা ওয়েস্ট ইজ ওয়েস্ট, দা টোয়েন শ্যাল নেভার মিট! এ মিলতে পারে না।

সজনী বলল, আলবাত মিলবে!

অবিনাশ বলল, আমি ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল শিস দিয়ে শোনাচ্ছি, তুমি মেলাও তো দেখি ভাই।

অবিনাশ শিস দিতে শুরু করল আর হাঁ করে রইল সজনী।

সরলা মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসি থামিয়ে বলল, আপনারা বরং এক কাজ করুন না। দুজনেই আগে বাগানে গিয়ে দুই ক্লাসিকালে মেলামেলি হয় কিনা আগে দেখুন। তারপর না হয় এখানে–

দুজনেই তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে বলল, সেই ভাল, সেই ভাল! দুজনে কাঁধ ধরাধরি করে চলে গেল বাগানে।

সরলা এক এক সময় ভাবে, সজনী, যোগিনী কিংবা অবিনাশের অন্য অনেক গুণ আছে, তিনজনই মোটামুটি সুপুরুষ, কৃতবিদ্য, ভাল বংশে জন্ম। কিন্তু এখানে এসে সব সময় প্রেম প্রেম ভাব করে কেন? পুরুষরা কি ভাবে, শুধু প্রেমের কথা বলে মেয়েদের মন জয় করা যায়? মেয়েরা যে পুরুষ মানুষদের পৌরুষ ও ব্যক্তিত্বের প্রতিই বেশি আকৃষ্ট হয়। এরা এ দেশের মানুষের কথা, পরাধীন দেশের গ্লানি, ইংরেজ শাসনের ঔদ্ধত্য, এসব বিষয়ে কখনও কোনও কথা বলে না। আলোচনায় এসব প্রসঙ্গ উঠলেও চুপ করে থাকে, যেন ওদের নিজস্ব কোনও মতামতই নেই!

এদের চেয়ে অনেক চৌকস ছিল আর একজন। তার কয়েকটা কথা সরলার মনে দাগ কেটে আছে।

জামাইবাবু ফণিভূষণ মুখোপাধ্যায় রাজশাহি কলেজে অধ্যাপনা করেন, একবার সরলা তার মায়ের সঙ্গে গিয়েছিল দিদি-জামাইবাবুর কাছে। সেই প্রথম সরলার পূর্ববঙ্গ ও উত্তরবঙ্গ ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল, কী ভাল কেটেছিল কয়েকটা দিন। কী সুন্দর, পরিষ্কার, ছিমছাম শহর রাজশাহি। এই রাজশাহিই তো এককালের পৌণ্ড্রবর্ধন বা বরেন্দ্রভূমি ছিল। কতরকম আদিবাসী আছে সেখানে।

স্যার তারকনাথ পালিতের ছেলে লোকেন পালিত বিলেত থেকে আই সি এস হয়ে এসে রাজশাহিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেট। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ঝকঝকে চেহারার তরুণ, দেশ-বিদেশের সাহিত্য সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান। সরলা রবিমামার কাছে এই লোকেন পালিতের অনেক গল্প শুনেছে। রাজশাহিতে এসে ভাল করে পরিচয় হল। কোর্টে কয়েক ঘণ্টার জন্য সে সরকারি কাজ করে এসে সারা দিনের অধিকাংশ সময়ই এ বাড়িতে কাটায়। তার সঙ্গে কথা বলতে বসলে গল্পের আর শেষ হয় না।

সরলা একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি তো ম্যাজিষ্ট্রেট। শুনেছি, ম্যাজিস্ট্রেটদের ইংরেজ সমাজের সঙ্গে মিশতে হয়। তাদের পার্টিতে গিয়ে খানা খেতে হয়, নাচতে হয়। আপনি তো যান না দেখি? ইংরেজদের সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব হয়নি?

লোকেন বলেছিল, ইংরেজদের সঙ্গে আমাদের সমান সমান বন্ধুত্ব হওয়া কি কিছুতে সম্ভব? পার্টিতে বাধ্য হয়ে যাই মাঝে মাঝে। যেতে ভাল লাগে না। ইংলন্ডে যখন ছাত্র ছিলাম, বেশ কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল, তারা খাঁটি ইংরেজ, স্কুটুসমান, ঘণ্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিতাম, গান গাওয়া হত। একদিন তারা সবাই মিলে একটা গান গাইল :

Rule Britannia! Britannia rules the waves!
Britons never shall be slaves

সেদিন বুকের মধ্যে ধক করে উঠেছিল। সেদিনই মনে হয়েছিল, ওরা রাজার জাত, আমরা শ্লেভস, ওদের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব হওয়া অসম্ভব।

ফণিভূষণ ছাত্রদের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, স্বর্ণকুমারী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে থাকেন না, আজ্ঞা হয় হিরন্ময়ী আর সরলার সঙ্গে লোকেনের। কত রকম খেলা, কত জায়গায় তিনজনে বেড়াতে যাওয়া।

একদিন লোকেন ওদের দুই বোনকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, প্রেম আর বন্ধুত্বের মধ্যে কী তফাত বলতে পার?

হিরন্ময়ীর কর্ণমূল রাঙা হয়ে গেল। প্রেম যেন বইয়ের পৃষ্ঠার একটা জিনিস। সে বলল, যাঃ, তা আবার মুখে বলা যায় নাকি?

সরলা বলল, কেন বলা যাবে না?

হিরন্ময়ী বলল, তুই বাপু পারিস তো বল, আমি ওসব মুখে উচ্চারণ করতে পারব না।

সরলা বলল, বন্ধুত্ব আর প্রেম প্রায় কাছাকাছি। তফাত হচ্ছে, প্রেমের দুটি ডানা থাকে, বন্ধুত্বের তা থাকে না। ‘ফ্রেন্ডশীপ ইজ লাভ উইদাউট ইটস উইংস’!

লোকেন বলল, বাঃ, চমৎকার বলেছ তো?

হিরন্ময়ী জিজ্ঞেস করল, তোমার হাতে ওটা কী? বইয়ের মতন?

লোকেন বলল, এটাকে বলে স্পেকট্রোস্কোপ। এর মধ্যে একশো খানা বিলিতি ছাপা ছবি আছে। পরপর দুখানা একই ছবি। একটার ওপর আর একটা রাখলে অমনি সেই ছবিখানা একেবারে জ্বলজ্বলে হয়ে ওঠে। আচ্ছা এক কাজ করা যাক, হিরন্ময়ী তো বলছে, প্রেম আর ভালবাসার তফাতের কথা মুখে বলতে পারবে না। লিখে বোঝাতে পারবে? চটপট তোমরা দুজনেই দশ বারো লাইন লিখে ফেল, যারটা ভাল হবে, তাকে আমি এই দুর্লভ জিনিসটা উপহার দেব।

দুই বোন দুদিকে মুখ ফিরিয়ে লিখতে বসে গেল। সরলা তখন সবে এস্ট্রান্স পাস করেছে, তার তাড়াতাড়ি লেখা হয়ে গেলেও সে দিদিকে সময় দিল। দুজনের কাগজ একসঙ্গে গম্ভীর মুখে পড়ে গেল লোকেন। তারপর বলল, আমি মাজিস্ট্রেট হিসেবে রায় দিচ্ছি, সরলারটিই বেশি ভাল হয়েছে। পুরস্কারটি তারই প্রাপ্য। এই নাও।

সরলা বলল, তুমি যে দিচ্ছ, সেটা লিখে দাও!

লোকেন বলল, দ্যাখো, ভেতরে লেখা আছে।

সরলা পাতা উল্টে দেখল, টু সরলা, ফ্রম আ ডিয়ার ফ্রেন্ড!

সে তাকাল দিদির দিকে। হিরন্ময়ী বলল, কী লেখা রয়েছে, দেখি, দেখি!

তার পরই রেগে গিয়ে বলল, একী, একী, ভারী অন্যায়, আমি খেলব না। তুমি আগে থেকেই সরলার নাম লিখে রেখেছ, ওকেই দেবে ঠিক করেছিলে–

লোকেন হাসতে হাসতে বলল, আমি যে জানতাম।

সরলা বলল, তবু এটা অন্যায়। এটা দিদিকেই দাও।

হিরন্ময়ী অবশ্য বোনের ওপর রাগ করেনি। ছোট বোনকে সে প্রাণের অধিক ভালবাসে। এখনও ছেলেপুলে হয়নি হিরন্ময়ীর, স্বভাবটা ছেলেমানুষের মতন রয়ে গেছে।

এক একদিন বিকেলে তিনজনে বেড়াতে যায়। শহর ছাড়িয়ে চলে যায় দূরে। গাড়িতে নয়, হটিতেই ভাল লাগে। এখানে এখনও প্রচুর বনজঙ্গল আছে। জঙ্গলের ধার ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে এক এক সময় হিরন্ময়ী পিছিয়ে পড়ে। সরলা আর লোকেন গল্পে একেবারে মশগুল, হিরন্ময়ীর দিকে নজরই নেই।

হিরন্ময়ী এক সময় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, আমি আর যাব না, তোমরা যাও, আমি বাড়ি ফিরছি…

লোকেন বলল, কেন, এর মধ্যে ক্লান্ত হয়ে গেলে?

হিরন্ময়ী বলল, না, ভাই, ক্লান্ত আমি হইনি। তোমরা দুটিতে গল্প করছ, তোমরাই বেড়াও, আমার থাকার দরকার কী?

লোকেন বলল, আপনার থাকার অবশ্যই দরকার আছে বইকী! আমরা তিনজনে এক সঙ্গে আছি, এখন আমরা বন্ধু। শুধু দুজনে বেড়ালে যদি সেটা প্রেম বলে মনে হয়?

হিরন্ময়ী বলল, মনে হয় তো হলই বা! কী রে সলি, তোর ডানা দুটো বার করবি নাকি?

সরলা এসে হিরন্ময়ীর হাত ধরে বলল, না, দিদি, তুমি যেতে পারবে না, আমরা এক সঙ্গে গান

লোকেন বলল, না, না, গান গেয়ো না। বেশি আওয়াজ শুনলে এই জঙ্গল থেকে বাঘ বেরিয়ে আসতে পারে!

সরলা বলল, বাঘ না ছাই? চিড়িয়াখানার বাইরে আবার বাঘ আছে নাকি?

লোকেন বলল, বিশ্বাস করছ না, সত্যি এখান থেকে মাঝে মাঝে বাঘ বোরোয়।

সরলা বলল, আসুক তো বাঘ! সত্যিকারের বাঘ দেখলে আমার হাসি পেয়ে যাবে।

লোকেন বলল, ইস, ‘ভারী সাহস তো তোমার। বাঘ দেখলে শুকিয়ে যাবে সব হাসি।

বাঘ বেরুল না, কিন্তু একটু পরেই পেছন থেকে সরলা, সরলা বলে একটা ডাক শোনা গেল। ওরা পেছন ফিরে দেখল, প্যান্ট-কোট পরা এক ব্যক্তি ছুটতে ছুটতে আসছে।

হিরন্ময়ী বলল, ওমা, এ যে যোগিনী!

লোকেন বলল, দেখতে পাচ্ছি জলজ্যান্ত এক পুরুষ মানুষ, তুমি বলছ যোগিনী।

হিরন্ময়ী বলল, ওর নাম যোগিনী, তা আমি কী করব? মোহিনী জামাইবাবুর ভাই—

সরলা হাসতে শুরু করে দিয়েছে।

যোগিনী কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, তোমাদের ঠিক পেয়ে গেছি। কলকাতায় মন ভাল লাগছিল না, আজই এসে পৌঁছেছি কিছুক্ষণ আগে..ফণীদাদা বললেন, তোমরা এই দিকে বেড়াতে এসেছ…কেমন আছ, সরলা?

যোগনী চাটুজ্যে পৌঁছবার পর কেমন যেন সুর কেটে গিয়েছিল, আর জমেনি। লোকেনও এ বাড়িতে আসা কমিয়ে দিয়েছিল। লোকেন সরলার ডানা দুটি দেখতে পেল না, বন্ধু হয়েই রইল।

নির্জন দুপুরে যখন কোনও কিছুই ভাল লাগে না, তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে সরলার। দুখানা জুড়ি গাড়ি আছে বাড়িতে, ইচ্ছে করলেই সে বেরুতে পারে, কিন্তু মায়ের অনুমতি নেবার প্রয়োজন। স্বর্ণকুমারীর মহল তিনতলায়। তিনিও দুপুরে ঘুমোন না, নিজস্ব লেখালেখি পত্রিকা সম্পাদনার কাজ করেন। সংসার পরিচালনায় বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তাঁর, দাস-দাসীরা কেউ ওপরে ওঠে না। অপরাহুে পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত বাড়ির লোকদের সঙ্গে কথা বলার নির্ধারিত সময়, তখন তিনি নীচে নেমে আসেন।

সরলা মায়ের মহলে এসে দেখল, স্বর্ণকুমারী মস্ত বড় টেবিলে অনেক কাগজপত্র ছড়িয়ে, খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু লিখছেন। সরলা দুবার ডাকল, মা মা।

স্বর্ণকুমারী মুখ তুললেন না।

সরলা বলল, মা, আমি একবার জোড়াসাঁকো যাব? একটা গাড়ি নিতে পারি?

স্বর্ণকুমারী এবারে লেখা বন্ধ করে মেয়ের মুখের দিকে ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন।

সরলা বলল, মা, বাড়িতে ভাল লাগছে না। একবার ও বাড়িতে যেতে চাই।

স্বর্ণকুমারী বললেন, সরলা, তুমি দেখলে আমি লিখছি। এ সময় কি এরকম একটা সাধারণ কথা আমাকে না বললে চলত না? বিকেলবেলা বলতে পারতে!

সরলা বলল, আমার যে এখন যেতে ইচ্ছে করছে?

স্বর্ণকুমারী বললেন, ইচ্ছে করলে যাবে। তার জন্য কি আমার লেখা নষ্ট করাটা ঠিক?

সেমিজ, সায়া পরে নিয়ে, শাড়ি বদল করে বেরিয়ে পড়ল সরলা। তার বুকখানি অভিমানে ভরা। মাকে সে কোনওদিনই নিজের করে পেল না। জানল না, কাকে বলে মাতৃস্নেহ। সরলা দেখেছে, জ্যোতিমামা কিংবা রবিমামা লিখতে বসেন, তখন বিবি কিংবা সে কাছে গিয়ে ডাকলে ওরা একটুও বিরক্ত হন না। লেখা থামিয়ে গল্প জুড়ে দেন। ওদের চেয়েও কি মায়ের সাহিত্যসাধনা বেশি গুরুত্বপূর্ণ?

সরলা হঠাৎ ঠিক করল, সে ও বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। প্রতিটি দিন একঘেয়ে হয়ে আসছে। মায়ের কাছ থেকে সে দূরে সরে যেতে চায়। দেখা যাক, মা তার অভাব কোনওদিন বোধ করেন কিনা। ইচ্ছে করলেই সে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে থাকতে পারে, কিংবা বিরক্তিতলায় বিবিদের সছে। কিন্তু সে-ই বা কতদিন। আরও দূরে যেতে হবে। সে চাকরি নিয়ে বিদেশে চলে যাবে। ছেলেরা বিদেশে যায়, সে কেন পারবে না?

সরলার মন নেচে উঠল। হ্যাঁ, সে বিদেশেই চলে যাবে। মা বাবার মত পাওয়া যাবে কি? না পাওয়া গেলেও সে জোর করে…হ্যাঁ, জোর করেই কিছু কিছু প্রথা ভাঙতে হয়। তবে, একজনের মত নিতেই হবে, এই বংশের যিনি পেট্রিয়ার্ক, গোষ্ঠীপতি, তাঁর মতামত অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা সরলার এখনও নেই।

সৌভাগ্যবশত আজই চুচড়া থেকে হঠাৎ কোনও প্রয়োজনে এসেছেন দেবেন্দ্রনাথ। সরলা গিয়ে তাঁকে প্রণাম করে নিজের অভিপ্রায় জানাল।

দেবেন্দ্রনাথ কিছুটা বিস্মিত হলেও ক্রুদ্ধ হলেন না। ধীর স্বরে বললেন, সময় প্রবাহে কত রকম পরিবর্তনই তো দেখছি। এর প্রতিরোধ করতে যাওয়া বিড়ম্বনা মাত্র। তোমার যদি এরকম অভিপ্রায় হয়ে থাকে, আমার আশীর্বাদ পাবে। কোথায় যাবে?

সরলা বলল, এখনও কিছু ঠিক হয়নি।

দেবেন্দ্রনাথ বললেন, ঠিক হলে আমাকে জানিও। যাবার আগে দেখা করে যেয়ো। সরলা, তুমি নাকি বিবাহ করতে চাও না? বিবাহের বয়েস পার হতে চলল যে।

সরলা বলল, সবাই শুধু আমাকেই এই কথা বলে কেন? বিবিরও তো এখনও বিয়ে হয়নি।

দেবেন্দ্রনাথ বললেন, সে তো মেমসাহেব! তাঁদের কি বিবাহের বয়েস থাকে। বিবি আমার কাছে তোমার মতন দেখা করতেও আসে না। শোনো সরলা, কুমারী থাকা ঠিক নয়। তুমি যদি কোনও পুরুষকে বিবাহ করতে না চাও, তবে আমি একখানা তলোয়ারের সঙ্গে তোমার বিয়ে দেব।

সরলা বাড়ি ফিরল যেন একটা পাখির মতন উড়তে উড়তে। হঠাৎ সব কিছু কী রকম বদলে গেল! দেবেন্দ্রনাথের সম্মতি যে এত সহজে পাওয়া যাবে সে কল্পনাই করেনি। এর পর অন্য কারুর আপত্তি টিকবে না। তলোয়ারের সঙ্গে বিয়ে? সে তো দারুণ ব্যাপার! আগেকার কালে নাকি অরক্ষণীয়া কন্যাদের কোনও ঘাটের মড়ার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হত, কিংবা কোনও গাছের সঙ্গে। তার চেয়ে উত্তর ভারতের এই রীতি অনেক ভাল। তলোয়ারের সঙ্গে বিয়ে হবে, সারা জীবন তার বিছানার পাশে সেই তলোয়ার থাকবে। আর কোনও পুরুষ হাত বাড়াতে সাহস করবে না।

ফিরে এসেই সরল সোজা চলে এল বাবার নিজস্ব কাজের ঘরে। এ ঘরের দেওয়ালে একটি ঢাল ও দুটি তলোয়াব ঝোলানো আছে। একটি তলোয়ার সে নামিয়ে নিল, কোষমুক্ত করে তলোয়ার ডান হাতটা উঁচু করতেই শরীরে যেন সে একটা তরঙ্গ অনুভব করল। ফিসফিস করে বলল, কে বলে অবলা তুমি নারী?

দুটো দিন কেটে গেল ঘোরের মধ্যে। কারুকে কিছু জানাল না সরলা, শুধু মনে মনে কল্পনা করতে লাগল, দূর বিদেশে কোনও গৃহে সে একলা, সারা দিন কাজকর্ম করবে, বিকেল সন্ধেগুলো ন্যাকা পুরুষদের সঙ্গে কাটাতে হবে না। সে গানবাজনা নিয়ে থাকবে। শয্যায় থাকবে এই তুলোয়ার।

তৃতীয় দিনে সরলার মনটা আবার নরম হল। এ বাড়ি ছেড়ে যাবার জন্য সে বদ্ধপরিকর, কিন্তু সারা জীবন তলোয়ারের মতন একটি বোব পদার্থের সঙ্গে কাটাতে হবে? যদি কখনও পুরুষকে মনে হয় পুরুষশ্রেষ্ঠ, যদি সে রকম কেউ তার সঙ্গ চায়, তাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হবে সে? জীবন শুধু শুষ্কই থাকবে? তা হলে কি গান, কবিতাও একদিন শুকিয়ে যাবে না হৃদয় থেকে? এ যেন রে অভিশপ্ত প্রেতের পিপাসা— সলিল রয়েছে পড়ে, শুধু দেহ নাই–

না, না, অবিবাহের শপথ নিতে পারবে না সরলা। ভবিতব্যের দ্বার উন্মুক্ত থাক। একদিন সেই দ্বারে এসে যদি দাঁড়ায় তার হৃদয়বল্লভ, তাকে সে ফেরাবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *