1 of 2

৪০. নয়নমণির উদ্দেশে গানের কলি

‘রাধার কী হৈল অন্তরে ব্যথা। বসিয়া বিরলে থাকয়ে একলে, না শুনে কাহারো কথা…।’ কুসুমকুমারী মাঝে মাঝেই নয়নমণির উদ্দেশে এই গানের কলি গেয়ে ওঠে। অন্য সখীরা হাসে। সবাই কিছুকাল ধরে নয়নমণির ব্যবহারে এক গভীর পরিবর্তন লক্ষ করেছে। সে যেন হারিয়ে ফেলেছে তার মানসিক ভারসাম্য।

ক্লাসিক থিয়েটার খোলার পর অমরেন্দ্রনাথ তার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ওপর নানান নিয়ম কানুনের শাসন চাপিয়ে দিয়েছিল। তা ঠিক সময়ে যাওয়া-আসা, পার্ট মুখস্থ করা, মহড়ার সময় হাসি-মস্করা বন্ধ রাখা এই রকম কিছু কিছু নিয়ম তো মানতেই হবে। কিন্তু নিয়ম ভাল, নিয়মের বাড়াবাড়ি ভাল নয়। থিয়েটারের মেয়েরা রাস্তায় আলোবাতাস গায়ে লাগাতে পারবে না, বাইরের লোকের সঙ্গে কথা বলতে পারবে না, নাচের রিহার্সালে সবকটি মেয়েকে সারাদিন উপবাসে থাকতে হবে, কেউ কারুকে টাকা ধার দেবে না, এসব আবার কী? নয়নমণি অন্যদের মুখপাত্রী হয়ে অমরেন্দ্রনাথের এরকম কিছু কিছু নির্দেশের প্রতিবাদ জানিয়েছে। অমরেন্দ্রনাথের মুখের ওপর কথা বলার সাহস শুধু সেই দেখিয়েছে। নাচের রিহার্সালের সময় একদিন একটি মেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল, সারাদিন সে বেচারি কিছু খায়নি। দুর্বল শরীর অবসন্ন হয়ে গিয়েছিল তার। নয়নমণি দ্রুত গিযে সে মেয়েটিকে কোলে নিয়ে নৃত্য শিক্ষক নেপা বোসকে তেজের সঙ্গে বসেছিল, দুটো ডাল-ভাত খেয়ে এলে নাচতে পারবে না, এর কী মানে আছে? আমি তো রোজ কিছু না কিছু খেয়ে আসি, আমার নাচের সময় কি পা এলিয়ে যায়?

অমরেন্দ্রর যতই রুক্ষ মেজাজ হোক, নয়নমণিকে সে টিঁট করতে পারেনি। নয়নমণি যে কারুর তোষামোদ করে না, থিয়েটারের চাকরি আঁকড়ে থাকার জন্য সে লালায়িতও নয়, যখন তখন সে ছেড়ে চলে যেতে পারে। তাকে বাদ দিলে ক্লাসিকেরও এখন চলবে না। থিয়েটারের সব মেয়েরা নয়নমণিকে তাদের নেত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছিল, তাদের যে কোনও অভিযোগ নয়নমণিকেই জানাত।

বেশ চলছিল, হঠাৎ কী হল নয়নমণির? সে এখন আর হাসে না। কারুর সঙ্গে পারতপক্ষে কথা বলে না, অন্যদের থেকে খানিক দূরে সরে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। অন্য মেয়েরা তাদের দুঃখের কথা নয়নমণিকে জানাতে গেলে সে তাকিয়ে থাকে উদাসীনভাবে, উত্তর দেয় না।

অমরেন্দ্রও নয়নমণির এই আকস্মিক পরিবর্তন লক্ষ করেছে। কিন্তু অভিনয়ের সময় তার কোনও ভুল হয় না, ঠিক ঠিক সময়ে মঞ্চে ঢোকে, নাচে-গানে মাতিয়ে দেয়, প্রতিটি শো-তে অন্তত সাতবার ক্ল্যাপ পায়। অন্য সময় সে যদি এক কোণে চুপচাপ বসে থাকে, তাতে বলার কিছু নেই।

সহ-অভিনেত্রীরা কৌতুক-ভাঁড়ামি করে তাকে হাসাবার চেষ্টা করেছে, সে হাসে না। তার আঁচল ধরে টেনে, খোঁপা খুলে দিয়ে খুনসুটি করলে সে রাগে না। হ্যাঁ লা, তোর কী হয়েছে, কী হয়েছে, বারবার এ কথা জিজ্ঞেস করলে, সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কিছু না।

কারুর সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ-মনোমালিন্য হয়েছে? সবাই জানে, নয়নমণি বাবু রাখে না। কত খানদানি লোক কত অর্থ-অলঙ্কারের প্রলোভন দেখিয়েছে, তবু এ পর্যন্ত সে কারুর রক্ষিতা হয়নি। তার শয়নকক্ষে পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। কোনও পুরুষ মানুষের সঙ্গেই যার সম্পর্ক নেই, সে কলহ করবে কার সঙ্গে?

ব্রজদুলাল নামে একটি অকিঞ্চিৎকর অভিনেতা গঙ্গামণির বাড়িতে যাতায়াত করে। ব্রজদুলাল জানে সে থিয়েটারে কোনওদিন বড় পার্ট পাবে না, তার কণ্ঠস্বরে ওঠা-নামা নেই, কখনও কাটা-সৈনিক, কখনও বড় জোর দু’লাইনের ডায়ালগ পায়, তবু থিয়েটারের সঙ্গে সে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। মহড়ার সময় সে সর্বক্ষণ বসে থাকে, অন্যদের ফুট-ফরমাশ খাটে, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গেই সর্বক্ষণ কাটায়, নিজের বাড়িতে ফেরে না। থিয়েটার তার নেশা, থিয়েটারেই সে মরবে। এই ব্রজদুলাল নয়নমণির কৃপা পাওয়ার অনেক চেষ্টা করেছে, নয়নমণি যখন যে থিয়েটার বদলেছে, সেও সেখানে যায়। অবশ্য এতদিনে সে জেনে গেছে যে, কোনওদিনই সে নয়নমণির নেকনজরে পড়বে না, কোনও দিনই নয়নমণির শয্যায় তার স্থান হবে না। তবু নয়নমণির সান্নিধ্যে থাকাতেই সে ধন্য। কুসুমকুমারীরা বিদ্রুপ করে বলে, দৈবাৎ যদি নয়নমণি কোনও দিন ওই বেজা ভেড়ুয়াটাকে আদেশ দেয়, যা আমার জন্য অমুকবাবুকে ডেকে নিয়ে আয়, তাতেও বেজাটা লাফাতে লাফাতে গিয়ে সেই বাবুকে ধরে আনবে, তাকে নয়নমণির ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে, বন্ধ দরজার বাইরে বসে কেত্তন গাইবে।

ব্রজদুলাল গঙ্গামণির বাড়িতে প্রায় প্রতিদিনই যায়, ওখানকার সব খবর সে রাখে। তার কাছ থেকেও নয়নমণির এই ভাবান্তরের কোনও কারণ জানা যায় না। কী হল ওই মেয়ের?

কী যে হয়েছে, তা নয়নমণি নিজেও স্পষ্ট জানে না।

ভরতের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ভূমিসূতা ওরফে নয়নমণি পুরুষ মানুষদের প্রতি সম্পূর্ণ বিমুখ হয়েছিল। তার জীবনে পুরুষ মানুষের কোনও প্রয়োজন নেই। তার জীবনের একমাত্র অবলম্বন পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ। শয়নকক্ষে সে শ্রীকৃষ্ণের একটি মূর্তি রেখেছে, প্রতিদিন সকালে সে সেই মূর্তির সামনে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। তার সমস্ত ব্যথা-বেদনা-আনন্দ সে ওই মূর্তিকেই নিবেদন করে। শ্রীকৃষ্ণের মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে তার শরীরের জ্বালাও জুড়োয়।

এক একদিন মাঝরাতে তার ঘুম ভেঙে যায়, সমস্ত শরীরে ছটফটানি ভাব আসে, দারুণ নিঃসঙ্গত যেন তাকে ভুতের মতন চেপে ধরে, সে তখন দ্রুত বিছানা ছেড়ে নেমে গিয়ে বাতি জ্বালে, শ্রীকৃষ্ণের মূর্তির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ব্যাকুল কণ্ঠে বলে, প্রভু, তুমিই আমার প্রাণসর্বস্ব, আমার সব জ্বালাযন্ত্রণা তোমার নয়ন স্পর্শে ঘুচিয়ে দাও! আমি তোমারই দাসী, আমি আর কারও পানে এ জীবনে চাইব না।

মূর্তির চোখদুটি নয়নমণিকে দেখে। যেন দুটি অদৃশ্য হাত এই ভূমিসুতাকে ভূমি থেকে তুলে নিয়ে বক্ষে জড়ায়।

কোনও কোনওদিন ভরতকে স্বপ্নে দেখলেও তার এমন অবস্থা হয়। শ্রীকৃষ্ণই তাকে ভরতের কথা ভুলিয়ে দেন। যাদুগোপালের পরিবারের সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, তাদের গৃহে সে কখনও কখনও যায়, সেখানে ক্কচিৎ কখনও ভরতের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়, নয়নমণি তা শুনতে চায় না। ভরত নিরুদ্দিষ্ট, একজন নিরুদ্দিষ্ট মানুষকে নিয়ে কেন মিছিমিছি কষ্ট পাওয়া। সে তো ইচ্ছে করেই নিরুদ্দেশে গেছে সকলকে ছেড়ে।

শ্রীকৃষ্ণের মূর্তির কাছে সব রকম সান্ত্বনা পেত নয়নমণি, হঠাৎ একদিন তার ব্যতিক্রম হল। মাস দু-এক আগের কথা, এক সকালে চক্ষু বুজে ধ্যান করছে নয়নমণি, এক সময় সে দারুণ চমকে উঠল। শ্রীকৃষ্ণের মূর্তির বদলে তার চক্ষু জুড়ে রয়েছে অন্য একজন পুরুষ!

এক সময় ভরতের মুখচ্ছবি এসে প্রায়ই শ্রীকৃষ্ণকে আড়াল করে দিত। ভরতকে সে আত্মনিবেদন করেছিল, সেখান থেকে মানসিক বন্ধন ছাড়িয়ে শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে নিজেকে সমর্পণ করা সহজ হযনি। যতই দূরত্ব তৈরি হোক, বন্ধন কিছুতে যেতে চায় না।

ধ্যানের তীব্রতা বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত সে সেই মায়াপাশ থেকে মুক্ত হয়েছে। ভরত এখন অস্পষ্ট হয়ে গেছে, দিনমানে তার কথা প্রায় মনেই পড়ে না, মাঝে মাঝে সে শুধু স্বপ্নে ফিরে আসে। সে মনে মনে তখন বলে, হে নিরুদ্দিষ্ট, তুমি আর এসো না, এসো না, আমার দায়িত্বের বোঝা নিয়ে তুমি ব্যতিব্যস্ত হয়েছিল, সে সব এখন ঘুচে গেছে। আমি আর ভূমিসূতা নই, তার মৃত্যু হয়েছে, আমি এখন নয়নমণি। থিয়েটারের নটী।

এতদিন পর আবার কোন পুরুষ মানুষ এল?

অস্পষ্ট থেকে প্রতিবিম্বটি ক্রমে ক্রমে স্পষ্ট হয়। ভরতের মতন একজন সাধারণ যুবক নয়, এ দেবদুর্লভ কান্তি, গৌরবর্ণ, দীর্ঘকায়, ভ্রমরকৃষ্ণ চুল নেমে এসেছে ঘাড় পর্যন্ত, সারা মুখে চিক্কণ দাড়ি টানা টানা দুটি চক্ষুর কী গভীর, মর্মস্পর্শী দৃষ্টি। নবাব বাদশাদের মতন কারুকার্যময় একটা আচকান পরিহিত। সমস্ত শরীরে পুরুষোচিত দীপ্তি, অথচ হাতের আঙুলগুলি কী কোমল। বীণানিন্দিত তার কণ্ঠস্বর।

চিনতে এক মুহূর্তও দেরি হয় না, ইনি কবিবর রবীন্দ্রবাবু। রাজা-রানী’র মহড়ার সময় উনি এসেছেন ক্লাসিকে। তখন সবাই বলাবলি করেছিল, এমন সুপুরুষ, এমন মানী ব্যক্তির মতন ব্যবহার দেখাই যায় না।

একজন বিখ্যাত ব্যক্তির চেহারা মনে পড়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তবু কেন নয়নমণির বুক কেঁপে উঠল? চক্ষে এল অশ্রু।

পরপর কয়েকদিন ধ্যানের সময় শ্রীকৃষ্ণের বদলে রবীন্দ্রবাবুর মুখ মনে পড়ায় নয়নমণির খুবই কষ্ট হতে লাগল। ওই মুখ, ওই মানুষটির দৃষ্টি তার সারা শরীর অবশ করে দিচ্ছে। এ এক অন্যরকম অনুভূতি।

রবীন্দ্রবাবুকে সে দেখেছে মাত্র তিনবার, তাও তৃতীয়বার কোনও কথাই হয়নি। দু’বার তিনি মহড়ার সময় উপস্থিত ছিলেন, উচ্চারণ ও অভিব্যক্তি বুঝিয়ে দিয়েছেন, আর একবার তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমার নাম নয়নমণি? হাতের একটি ভঙ্গি দেখাবার জন্য তিনি সামান্য স্পর্শ করেছিলেন নয়নমণির মুখ। থিয়েটার করতে গেলে ছোঁয়াছানির কোনও বাছ-বিচার চলে না অন্য অভিনেতারা ঠেলাঠেলি করে, নাচের শিক্ষক সাপটে ধরে, পরিচালক কখনও কখনও চড় মারে। এসব ধর্তব্যের মধ্যেই নয়। কিন্তু ওই অপরূপ মানুষটি যে একবার একটুক্ষণের জন্য মুখখানি ছুঁলেন, তাতেই নয়নমণির সমস্ত শরীর ঝনঝনিয়ে উঠেছিল। এ যেন বহুদিন পর সত্যিকারের এক পুরুষ মানুষের স্পর্শ। নয়নমণির সেই শিহরন কেউ বুঝতে পারেনি।

তৃতীয়বার তিনি ছিলেন দর্শকের আসনে। রাজারানী তিনি সবান্ধবে দেখতে এসেছিলেন তৃতীয় রাতে। নয়নমণি সে কথা জানতও না। অভিনয়ের সময় মঞ্চে আলোর খেলা চলে, প্রেক্ষাগৃহ থাকে অন্ধকার, নয়নমণি দর্শকদের দিকে তাকায়ও না। রবীন্দ্রবাবু বসেছিলেন প্রথম সারির ঠিক মাঝখানে, হঠাৎ নয়নমণির চোখ পড়ে গেল সেদিকে। অন্ধকারের মধ্যেই যেন নিজস্ব আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে বসে আছেন কবি। এবং তিনি এক দৃষ্টিতে নয়নমণিকেই দেখছেন।

তারপর অন্যান্য দৃশ্যে যতবার নয়নমণি ঘুরে ফিরে আসে, রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টির সঙ্গে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। তিনি কি আর কারুকে দেখছেন না। শুধু নয়নমণির দিকেই চেয়ে আছেন? একি সত্য হতে পারে, না, না সত্য নয়। তবু, শারীরিক স্পর্শের মতনই, সেই দৃষ্টির সংযোগে নয়নমণির সারা শরীরে সুখানুভূতি হচ্ছিল।

অভিনয় সাঙ্গ হলে রবীন্দ্রবাবু গ্রিনরুমে এসেছিলেন, অমরেন্দ্রনাথ ও আর দু’একজনের সঙ্গে কথা বলেছেন, নয়নমণি কিছুতেই ওঁর সামনে আসতে পারেনি। কী যে সঙ্কোচ তাকে পেয়ে বসেছিল। যেন ওঁর সামনে গেলে সে চক্ষু তুলে কথাই বলতে পারবে না।

আর দেখা হয়নি। শুধু বারবার তিনি ফিরে আসছেন ধ্যানে। শুধু বিখ্যাত ব্যক্তি নন, উনি একজন পুরুষ। পুরুষের মতন পুরুষ, মনশ্চক্ষে ওঁকে দেখলেই নয়নমণির সেইরকম রোমাঞ্চ হয়। ছি ছি, এ কী লজ্জার কথা। শ্রীকৃষ্ণের সামনে বসে সে অন্য পুরুষের কথা ভাবছে। অথচ মনকে যে দমন করা যায় না। বারবার মন ওঁকে ফিরিয়ে আনে। কেন আনে? আর কোনওদিনও সশরীরে দেখা হবে কি না সন্দেহ, আকাশের রবির মতনই উনি সুদূর।

তবু দিন দিন আকর্ষণের তীব্রতা বেড়েই যায়। দিনে রাতে যখন তখন মনে পড়ে তাঁর কথা। মনে পড়লেই শরীরে সেই রোমাঞ্চ। শরীরের এ কী বেহায়াপনা!

এ কথা সে কারুকে বলতেও পারে না। মনের সব কথা বলার মতন ঘনিষ্ঠ সাথি তো তার কেউ নেই। গঙ্গামণিকেও এই কথা বলা চলে না। ওঁর সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে ইচ্ছে করে, জানবে কার কাছে! পত্রপত্রিকায় মাঝে মাঝে রবীন্দ্রবাবুর নাম দেখা যায়, সেই ছাপার অক্ষরের দিকে নয়নমণি তৃষিতভাবে তাকিয়ে থাকে। যেন সেই নামের মধ্যেই ফুটে ওঠে অবয়ব। এই নামটি দেখার জন্য নয়নমণি অনেক পত্রপত্রিকা কেনে। ‘সাহিত্য’ নামে একটা কাগজে কে একটা লোক ওকে গাল দিয়েছে দেখে নয়নমণির সর্ব অঙ্গ জ্বলে উঠেছিল। পত্রিকাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল আঁস্তাকুড়ে। এখন মনে মনে রবীন্দ্রবাবুকে সে জীবন দেবতা করে নিয়েছে, তাঁর কোনও নিন্দে সে সহা করতে পারবে না।

অপ্রত্যাশিতভাবে একদিন সে ওঁর সম্পর্কে কিছু কথা শুনতে পায়।

মহড়া শেষ হবার পরেও কিছুক্ষণ গুলতানি চলে। যাদের বাড়ির টান নেই, তারা থেকে যায়। কিছু খাবার দাবার আসে। ‘আলিবাবা’ নাটক খুব জমে গেছে, ক্লাসিকের এখন দারুণ রবরবা। এই ‘আলিবাবা’ যখন প্রথম মঞ্চস্থ হল, তখন দর্শকই আসতে চায়নি, গিরিশবাবু নেই, অর্ধেন্দুশেখর নেই, উটকো অমর দত্তর অভিনয় কে দেখতে চায়। প্রথম দু-একটা নাটকে কিছু কৌতূহলী লোক এসেছিল, ‘আলিবাবা’য় দর্শকরা সব ভোঁ ভোঁ। এমনও দিন গেছে, দশ বারো জনের বেশি টিকিট কাটেনি। অথচ অভিনয় বন্ধ রাখা যায় না, তখন ব্রজদুলালের মতন কর্মীরা রাস্তায় গিয়ে পথিকদের কাছে হাত জোড় করে বলেছে, ‘আলিবাবা দেখবেন আসুন, বিনা পয়সায়, দয়া করে আসুন।’ সেই বিনা পয়সার দর্শকরাই মুগ্ধ, বিমোহিত হয়ে অন্যদের কাছে গল্প করেছে। থিয়েটারের সবচেয়ে ভাল প্রচার, লোকের মুখে মুখে প্রচার। কাগজের বিজ্ঞাপনের চেয়েও প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য। ক্রমে এ নাটকের খ্যাতি ছড়াল, দর্শকদের ভিড় বাড়তে লাগল। এখন এমন অবস্থা, প্রতিটি শো হাউজ ফুল। বহু লোক টিকিট কাটতে এসেও নিরাশ হয়ে ফিরে যায়। ক্লাসিকের সবাই এখন খুব খুশিতে আছে।

এক সঙ্গে দুখিলি পান মুখে দিয়ে কুসুমকুমারী বলল, আমাদের রাজা রানীর সময় রোববাবু নামে একজন নাট্যকার আসতেন মনে আছে? ও বাবা, তাঁর কী গুমোর! আমাদের অমরবাবু গেসলেন ‘আলিবাবা’ দেখার জন্য নেমন্তন্ন করতে, তিনি আসতে পারবেন না। তাঁর সময় নেই। হিংসে, বুঝলি হিংসে। তিনি নিজের নাটক ছাড়া অন্যের নাটক দেখবেন না। রাজা-রানী তো চলল না মোটেও। ওর নাটক আবার কে নেবে? অমন কত নাট্যকার এল গেল, ঢের দেখেছি।

ব্রজদুলাল বলল, তুই বলছিস কী রে কুসোম! রোববাবু কি শুধু নাট্যকার নাকি? উনি কোবতে টবতে লেখেন, দু’দশ লাখ গানও বেঁধেছেন শুনেছি, কিন্তু ওসব কিছু না। ওসব হল এলেবেলে খেয়াল, আসলে ঠাকুররা তো মস্ত জমিদার। সে জমিদারির বেশির ভাগটা উনিই দেখাশুনো করেন শুনেছি। ইচ্ছে করলে ওঁর মতন মানুষ এ রকম তিনটে থিয়েটার কিনতে পারেন।

চোখ গোল গোল করে কুসুমকুমারী বলল, শখের নাট্যকার, তাই বলো! রাজা রানীর সময় যখন আসতেন, আমি দুটো অন্য কথা বলতে গেলুম, পাত্তাই দিলেন না।

ব্রজদুলাল হাসতে হাসতে বলল, কথা বলার সময় তুই চোখ ঘুরিয়েছিলি? পুরুষ মানুষ দেখলেই তো তোর খাই খাই ভাব হয়। এরা বনেদি লোক, ওসব পছন্দ করে না।

কুসুমকুমারী বলল, সোমত্থ ব্যাটাছেলেরা তো তাই-ই চায়। হ্যাঁ গা, অতবড় জমিদার তো রাঁড় রাখেননি?

ব্রজদুলাল বলল, কে জানে, তা কে খবর রাখে! আমাদের ঢোল বাজায় যে গুপী, তার বাপ ঠাকুরদের জমিদারি সেরেস্তায় কাজ করে। গুপীর বাপের কাছে শুনিছি, রোববাবু বাঙালদেশে জমিদারি দেখতে গিয়ে বজরায় থাকেন, মাটিতে পা দেন না। সেই বজরায় সাহেব সুবোরা আসে, আরও সব জমিদার, ইযার বক্সিরা আসে, খানা-পিনা হয়, সেখানে কি আর বাইজী নাচে না? জমিদাররা ইচ্ছে করলেই প্রত্যেক রাতে একটা করে নতুন মাগি আনাতে পারে। বাঁধা মাগি রাখতে যাবে কোন দুঃখে। রোববাবুর বিয়ে করা বউয়ের ঘরে পাঁচটি ছেলেমেয়ে, আরও কত ছেলেমেয়ে কত জায়গায় ছড়িয়ে আছে কে জানে! আহা হা আমি যদি ভাগ্য করে অমন কোনও জমিদারের ঘরে জন্মাতুম, তা হলে ভ্রমরের মতন নিত্যি নতুন ফুলে ফুলে মধু খেতুম।

কুসুমকুমারী বলল, মর মুখপোড়া!

নয়নমণি যথারীতি খানিকটা দূরে সরে বসে আছে। এ সব কথা তার কানে যায়, আগুনের ছ্যাঁকা লাগার মতন সে শিউরে শিউরে ওঠে। খুব রাগ হলেও সে এসব কথার প্রতিবাদ করে না। ওদের কথা বিশ্বাসও করে না সে। সে দেখেছে, বেশির ভাগ মানুষই অন্যের নিন্দে করে সুখ পায়। মুক্ত মনে অন্যের প্রশংসা করতে পারে ক’জন? প্রশংসাবাক্য যেন খুবই মূল্যবান জিনিস, কেউই প্রাণে ধরে খরচ করতে চায় না। প্রশংসার ভাষাতে বৈচিত্র্য নেই, কিন্তু নিন্দের সময় কতরকম রং-বেরঙের বাক্যচ্ছটা ফুটে বেরোয়।

শ্রীকৃষ্ণের নামেও তো কত অপবাদ আছে, সত্যিকারের ভক্ত কি তা মনে রাখে? নয়নমণি নিজের অভিজ্ঞতায় বিচার করে, রবীন্দ্রবাবুকে সে যতটুকু দেখেছে, তাতেই তার মনে হয়েছে ওর গুণের পরিমাপ করা ব্রজদুলালের মতন পরের মুখে ঝাল খাওয়া মানুষদের পক্ষে সম্ভব নয়। উনি জমিদার হলেও অন্য জমিদারদের সঙ্গে ওর তুলনা চলে না, জমিদারও তো কম দেখেনি নয়নমণি।

রবীন্দ্রবাবুর সান্নিধ্যে যাবার উপায় নেই, সে ওঁর অনেকগুলি বই কিনিয়ে আনাল। বেশির ভাগই কবিতার বই। নয়নমণি কিছু কিছু গল্প-উপন্যাস পাঠ করেছে। কবিতা সে ঠিক বোঝে না। বৈষ্ণব পদকর্তাদের কিছু গান তার মুখস্থ আছে, এ ছাড়া অন্য কবিতা বিশেষ পড়েনি। অমর দত্ত আর ক্ষীরোদপ্রসাদ একদিন তর্কের সময় মাইকেল নামে একজন কবির নাম করছিলেন বারবার। থেমে থেমে অন্য মেয়েদের তুলে নিতে হয়, কোনও কোনওদিন সে একাই যায়। যাত্রাপথেও গাড়ির মধ্যে বসে সে রবীন্দ্রবাবুর বই পড়ে, কবিতার বই বারবার পড়া যায়, পঙতিগুলো মুখস্থ হলে বেশি রসগ্রহণ করা যায়। সে সময় নয়নমণি বাইরের দৃশ্য খেয়াল করে না।

একদিন নয়নমণির মনে হল, গাড়িটা যেন বড় বেশিক্ষণ ধরে যাচ্ছে। আজ মঞ্চে অভিনয় নেই, পরবর্তী নাটকের মহড়া হবার কথা, সবে মাত্র বিকেল পেরিয়ে সন্ধে হয়েছে। পর্দা সরিয়ে নয়নমণি একবার বাইরে তাকাল, এ তো প্রতিদিনের পরিচিত পথ নয়, সম্পূর্ণ অচেনা রাস্তা। নয়নমণি একবার মুখ বাড়িয়ে সহিসকে ডাকার চেষ্টা করল, ঘোড়ার পায়ের কপ কপ শব্দের জন্য সে শুনতে পেল না। সহিস অবশ্য বেশ পরিচিত এবং বিশ্বস্ত, ভয়ের কিছু নেই।

খানিক বাদে গাড়ি থামল, সহিস এসে দরজা খুলে দিতে নয়নমণি জিজ্ঞেস করল, আজ কোথায় নিয়ে এলে?

অঞ্চলটি ফাঁকা ফাঁকা। কিছুদুর অন্তর অন্তর এক একটি বাড়ি। গাড়িটি থেমেছে একটি মস্ত লোহার গেটের সামনে, ভেতরে বাগানের মধ্য দিয়ে সুরকি ঢালা পথ, সেই পথের দু’ধারে জ্বলছে গ্যাসের বাতি।

গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে নৃত্যশিক্ষক নেপা বোস, সে সব সময় জবরজং পোশাক পরে থাকে, তার পায়জামার রং হলুদ, কুর্তার রং টকটকে লাল, মাথায় আবার একটা মুসলমানি ফেজ। সহিস কিছু বলার আগেই সে বলল, এসো এসো নয়নমণি, তোমারি কুশলে কুশল মানি।

গাড়ি থেকে নেমে নয়নমণি ভূ কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করল, আজ রিহার্সাল হবে না?

নেপা বলল, হবে না কেন, এখানে হবে। কালুবাবুর হুকুম। এটা কালুবাবুর বাগানবাড়ি।

মানিকতলার দিকে অমর দত্তর একটি বাগান বাড়ি আছে, এ-কথা শুনেছে নয়নমণি। কিন্তু আগে কোনওদিন সেখানে মহড়া হয়নি। বাড়িটি ভারী সুন্দর, মালিকের শৌখিনতার প্রমাণ পাওয়া যায়। চার দিকে বাগান, তার মধ্যে একটি দ্বিতল গৃহ, প্রবেশ পথের বাইরে বর্শা হাতে দুটি পুতুল-দারোয়ান ঠিক জীবন্ত বলে মনে হয়।

লাল মখমলের পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকলে দেখা যায় একটি প্রশস্ত হলঘর, সেখানে ঝুলছে রঙিন ঝাড়লণ্ঠন, দেয়ালে দেয়ালে বিলাতি ছবি। বাড়ির অন্দর একেবারে নিস্তব্ধ, আর কোনও জন মনুষ্যের সাড়া পাওয়া গেল না।

নয়নমণি জিজ্ঞেস করল, আর কেউ এখনও এসে পৌঁছয়নি?

নেপা বলল, আর কে আসবে না আসবে তা তো আমি জানি না। আমাকে কালুবাবু শুধু তোমার জন্যই বাইরে দাঁড়াতে বলেছিলেন।

ওপরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল অমর দত্ত। কোঁচানো ধুতির ওপর শুধু একটা বেনিয়ান পরা, মাথার চুল অবিন্যস্ত, চক্ষু দুটি দেখলেই বোঝা যায় সে প্রকৃতিস্থ নয়, এখনও হাতে একটি মদের বোতল।

অমরকে এই অবস্থায় নয়নমণি কখনও দেখেনি। রঙ্গালয়ে সে কঠোর নিয়মশৃঙ্খলা মানে, সেখানে মদ্যপান নিষিদ্ধ, নিজেও কখনও পান করে না। প্রথম প্রথম এই নবীন নায়ক ও নাট্য পরিচালককে বেশ ভাল লেগেছিল নয়নমণির, থিয়েটারের জগতে এই যুবকটিকে মনে হত ব্যতিক্রম। ক্রমশ অবশ্য অমর দত্তর অন্য সব গুণপনার কথাও সে জেনেছে। উচ্চ বংশের ছেলে হলেও সে অল্প বয়েসেই বখাটে। লেখাপড়ায় মন ছিল না, কুসঙ্গে পড়ে উচ্ছ্বন্নে যাবার কিছু বাকি রাখেনি। পনেরো বছর বয়েসেই তার বিয়ে হয়েছে, কিন্তু বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে সুখে সংসার করলে যে সমাজে মান থাকে না। ভাল করে দাড়ি গোঁফ গজাবার আগেই সে এক রক্ষিত রেখেছে এই মানিকতলার বাগানবাড়িতে। ব্রজদুলাল সব খবর রাখে, তার কাছ থেকেই শোনা গিয়েছিল যে অমরের মা নাকি দুঃখ করে বলেছিলেন, ঘরে অমন সুন্দরী সতী-লক্ষ্মী বউ, তাকে ফেলে অমর এক বাঁদর মাগি নিয়ে আছে।

অমরের অভিনয়-প্রতিভা আছে, এটা স্বীকার করতেই হবে। ‘আলিবাবা’র প্রভূত জনপ্রিয়তার পর অনেকেই স্বীকার করেছে যে, এবার বাংলা নাট্যজগৎ জয় করে নেবে এই ছোকরাটি।

বয়েসে ছোট বলে নয়নমণি কখনও অমরকে সমীহ করে কথা বলেনি। অমরও যতই তেজ দেখায়, কিছুতেই পুরোপুরি বশ্যতা স্বীকার করাতে পারেনি এই মেয়েটিকে। দুজনের ঝগড়া ও কথা কাটাকাটির মধ্যে বেশ একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। কিন্তু রবিবাবু মন জুড়ে থাকার পর নয়নমণি আর অমরকে তেমন পছন্দ করতে পারে না।

নয়নমণি বলল, আর কে কে আসবে? আমাকে এত সাত তাড়াতাড়ি আনালেন কেন?

অমর নীচে নেমে ধপাস করে একটা সোফায় বসে পড়ে বলল, আর কেউ আসবে না। আজ শুধু তুমি। তুমি আর আমি। হ্যাঁ নেপা বোস থাকবে, তা থাকুক, মনে করো, ও একটা খাঁচার পাখি। নেপা বোস নতুন ড্যান্সের তালিম দেবে, তুমি নেচে দেখাবে। শুধু আমি দেখব, দেখে পছন্দ করব!

নয়নমণি বলল, এ আবার কী ধরনের রিহার্সাল? কোন নাটক?

অমর বলল, নাটক যাই হোক না। নাচ তো থাকবেই। নাচ না থাকলে লোকে টিকিট কাটে। এবার তোর একখানা উলঙ্গিনী ডান্স জুড়ে দেব।

নয়নমণি নেপা বোসকে বলল, নাটকের ঠিক নেই, আগেই নাচ? ও আমি পারব না। আগে পার্টটা বুঝে নিতে হবে না? আমার বাড়ি ফিরে যাবার ব্যবস্থা করুন।

অমর জড়িত গলায় ধমক দিয়ে বলল, অ্যাই ছুঁড়ি, ওর দিকে ফিরে কথা বলছিস কেন? আমি মালিক। আমার দিকে তাকা। আমার হুকুম, তোকে নাচতে হবে!

নয়নমণি কঠিন মুখ করে বলল, কারুর হুকুম মানার জন্য আমি থিয়েটারে যোগ দিইনি। মালিককে একা একা নাচ দেখাবার কোনও শর্ত ছিল না।

অমর বলল, তুই সব সময় শর্ত শর্ত করিস কেন রে? এ কী পাটকলের নোকরি নাকি? থিয়েটারে পরিচালকের মেজাজ আর মর্জি সবচেয়ে বড় কথা। মাঝে মাঝে এ বাড়িতে রিহার্সাল হবে। কুসুম, ভূষণ, রানি, ক্ষেমী, বীণা এরা সবাই এসেছে। একা একা এসেছে।

নয়নমণি বলল, শুধু মেয়েরা রিহার্সাল দিতে আসে? পুরুষদের দরকার নেই?

অমর বলল, আরে রোজ রোজ সন্ধের পর কি ব্যাটাছেলের মুখ দেখতে ভাল লাগে? পুরো পুরো রিহর্সাল তো বোর্ডে হয়ই। এখানে তোরা মাঝে মাঝে এসে আমার মেজাজ শরিফ করে দিবি। বুঝলি? নে এবার আঁচলটা গুজে কোমরে বেঁধে নে।

নয়নমণি বলল, অমরবাবু, আপনি নেশা করেছেন, এখন আপনি আর আপনাতে নেই। কুসুম-ভূষণরা কী করে আমি জানি না, আপনি সজ্ঞানে থাকলে আমাকে এমন মন্দ প্রস্তাব দিতেন না। কাল আপনার সঙ্গে কথা হবে।

নেপা বোস বলল, দু একখানা নাচ নেচেই দাও না নয়ন! সেই যে একটা হংসনাচের কথা তোমায় বলেছিলাম।

নয়নমণি কোনও কথা না বলে নৃত্যশিক্ষকটির দিকে শুধু খর চক্ষে তাকাল।

অমর বোতলে আর একটা চুমুক দিয়ে দর্পের সঙ্গে বলল, কী আমি মাতাল? আমি মদ খাই বটে। কিন্তু মাতাল হই, এ কথা কোনও শুয়োরের বাচ্চাও বলতে পারবে না। জ্ঞান টনটনে আছে। নাচতে নেমে ঘোমটা! থিয়েটারে এসে সতী-সাধ্বী সেজে থাকতে চাস!

টলমলে পায়ে উঠে এসে সে নয়নমণির একটা হাত খপ করে ধরে বলল, তোর বিষ দাঁত আমি ভেঙে দেব! নাচবি কি না বল!

ঠাণ্ডা গলায় নয়নমণি বলল, আমার ওপর কক্ষনও জোর করবেন না, অমরবাবু। হাত ছাড়ুন। আমার অনিচ্ছায় কেউ আমার গায়ে হাত দিলে আমি সহ্য করতে পারি না। এ ব্যাপারে আমার একটা কঠিন শপথ আছে।

অমর ব্যর্থ ভাবে জিজ্ঞেস কল, কী শপথ, শুনি শুনি।

তার চোখে চোখ রেখে নয়নমণি বলল, তাকে আমি খুন করে ফেলব!

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অমর নেপার দিকে তাকিয়ে বলল, ওগো, বলে কী? খুন করে ফেলবে? এ মাগির এত তেজ হয় কী করে? আমি থিয়েটারের মালিক, আমার কথা শুনবে না?

তারপর সে এক অদ্ভুত কাণ্ড করল। ধপ করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে দু’হাত জুড়ে কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বলল, নয়ন, অমন কোরো না। কেউ আমার কথা না শুনলে আমার বড় রাগ হয়। সেই রাগ থেকে বুকে কষ্ট হয়। সবাই যদি শোনে, নয়ন আমার হুকুম অগ্রাহ্য করেছে, তা হলে আমার মান কোথায় থাকবে? একটুখানি নাচ, লক্ষ্মীটি, অন্তত দু’চার পাক, তাতে আমার কথা থাকে—

অমর নয়নমণির পা জড়িয়ে ধরতে যেতেই সে ত্রস্তে সরে গেল। ঝোঁক সামলাতে না পেরে অমর পড়ে গেল উপুড় হয়ে। তারপর মেঝেতে গড়াগড়ি দিতে দিতে শিশুর মতন অভিমানে বলতে লাগল, একটু নাচ, তোর পায়ে ধরছি, আমার মাথার দিব্যি, ওই হংস-নাচখানা শুধু দেখা, আর কোনওদিন বলব না। শুধু আজকের দিনটা।

নেপা বোস হো-হো করে হেসে উঠল। নয়নমণিও না হেসে পারল না।

ন্যাপা বোস জিজ্ঞেস করল, কী গো, এ পাগল তো থামবে না দেখছি। একটু নাচবে নাকি? ঘুঙুর বেঁধে দেব?

নয়নমণি দুদিকে মাথা নেড়ে বলল, না।

অমর জোর করুক বা কেঁদে ভাসাক, তবু নয়নমণি তার নাচের মর্যাদা নষ্ট করবে না। সে সোজা বেরিয়ে গেল বাইরে।

সে রাতে বাড়ি ফিরে নয়নমণি ভাল করে স্নান করল। সে মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে, অমর দত্ত আর একদিন ওরকম বাড়াবাড়ি করলে সে ক্লাসিক ছেড়ে দেবে। এই ধরনের ঘটনায় তার মনের মধ্যে যে অশান্তির ঝড় বইতে থাকে, তা সহজে থামে না। কেন পুরুষরা মনে করে যে মেয়েদের ওপর জোর করে সব কিছু আদায় করা যায়!

আত্মস্থ হবার জন্যে সে শ্রীকৃষ্ণের মূর্তির সামনে বসল। চোখ বুজতেই সে দেখতে পেল রবিবাবুর সৌম্য সুন্দর মুখখানি। নয়নমণির ঠোঁট নড়তে লাগল, কোনও মন্ত্রের বদলে সে বলতে লাগল, রবিবাবুর কবিতা;

আমার হৃদয় প্রাণ।
সকলি করেছি দান
কেবল শরমখানি রেখেছি।
চাহিয়া নিজের পানে
 নিশিদিন সাবধানে
সযতনে আপনারে ঢেকেছি।…

অনেকক্ষণ এই ভাবে বসে থাকার পর নয়নমণি ভাবল, রবিবাবুর কাছাকাছি সে যেতে পারবে না, কিন্তু তাঁকে একটা চিঠি লেখা যায় না? এই অধীনার চিঠিখানি যদি তিনি একবার হাতে তুলে নেন, সেটাই তো হবে তাঁর স্পর্শ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *