1 of 2

২৬. স্বামী বিবেকানন্দর এই দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ডে আগমন

স্বামী বিবেকানন্দর এই দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ডে আগমন। শিকাগো ধর্ম সম্মেলনে যোগ দেবার জন্য যখন ভারত থেকে জাহাজে ভেসেছিলেন, তখন ইওরোপের পথে আসেননি, গিয়েছিলেন জাপানের দিক দিয়ে। আমেরিকায় দিগ্বিজয় করার পর যখন তিনি প্রভূত খ্যাতি ও ভক্তবৃন্দ সংগ্রহ করেছেন, তখন তাঁকে একবার ইওরোপে আসতে হয়েছিল। উপলক্ষটি ছিল একটি বিবাহ-অনুষ্ঠানে যোগদান, বরপক্ষ এবং কন্যাপক্ষ এই দু তরফেরই অনুরোধে।

শ্ৰীমতী জো ম্যাকলাউড়ের দিদি বেটির সঙ্গে ধনকুবের শ্রীযুক্ত লোগেটের পরিণয়ের কথা পাকা হয়ে যাবার পর তাদের শখ হল, উৎসবটা হবে সভ্যতা ও বিলাসিতার কেন্দ্রস্থল প্যারিস নগরীতে। দুই বোনই স্বামীজির বিশেষ অনুরক্ত, তারা দীর্ঘদিন তাঁর সঙ্গহারা হয়ে থাকতে চায় না, শ্ৰীযুক্ত লেগেটও এই হিন্দু সন্ন্যাসীকে পছন্দ করেন। সুতরাং ওরা তিনজনেই স্বামীজিকে প্যারিসে যাবার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়েছিল।

একজন সন্ন্যাসীর পক্ষে কোনও বিবাহ অনুষ্ঠানে যোগদান করা সমুচিত নয়। তবু স্বামীজি প্যারিসে এলেন কেন? জো আর বেটি, এই দুই ভগিনীর পীড়াপীড়ি এড়াতে পারেননি বলে? প্যারিস তথা ইওরোপীয় সভ্যতার নিদর্শনগুলি স্বচক্ষে দেখার সাধ হয়েছিল তাঁর? পূর্বাশ্রমের নরেন্দ্রনাথের যে দেশ ভ্রমণ ও স্থাপত্য-ভাস্কর্য দর্শনের টান ছিল তা স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে এখনও রয়ে গেছে? এই কারণগুলি হয়তো একেবারে গৌণ নয়, তা ছাড়াও একটি অন্য উদ্দেশ্য ছিল। স্বামীজি ভেবেছিলেন, এই সুযোগে তিনি প্যারিস থেকে একবার ইংল্যান্ডেও ঘুরে আসবেন, ইংরেজ জাতির মধ্যে বেদান্তের ধর্ম প্রচার করা যায় কিনা, তা একবার পরীক্ষা করে দেখা দরকার। এর আগে বেশ কয়েকজন ব্রাহ্ম নেতা ইংল্যান্ডে বক্তৃতা করে গেছেন এবং সমাদরও পেয়েছেন, হিন্দু ধর্মের উদার দর্শনের কথা কেউ সেখানে বলবে না? ইংল্যান্ডে গিয়ে অবস্থানের সমস্যাও নেই। আমেরিকাতেই শ্রীমতী হেনরিয়েটা মুলারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, তিনি বলে রেখেছিলেন, লন্ডনে তাঁর গৃহের দ্বার স্বামীজিব জন্য সর্বদা উন্মুক্ত। আর শ্রীযুক্ত ই টি স্টার্ডি এক সময় আলমোড়ায় তপস্যা করে এসেছেন, হিন্দু সন্ন্যাসীদের প্রতি তাঁর বিশেষ আকর্ষণ আছে, তিনিও বার বার স্বামীজিকে চিঠি লিখেছেন লন্ডনে আসবার জানা।

প্যারিসে শ্রীযুক্ত লেগেট স্বামীজিকে রেখেছিলেন এক বিশাল রাজকীয় হোটেলে। সারা দিন খানাপিনার অন্ত নেই। সে রকম হোটেলে থাকতে স্বামীজি মোটেই স্বস্তি বোধ করেননি। এ রকম বিলাসবহুল অবস্থার মধ্যে দিন কাটালে যে তাঁর আরও সমালোচনা হবে, সে সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। শুধু আমেরিকান মিশনারিরাই যে তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়াচ্ছে তাই-ই নয়, ভারতেও তাঁর সম্পর্কে নানা রকম কটুক্তি শুরু হয়ে গেছে। তিনি যার তার সঙ্গে বসে হিন্দু সন্ন্যাসীর পক্ষে নিষিদ্ধ আহার্য গ্রহণ করেন, মহিলাদের দ্বারা সব সময় পরিবৃত হয়ে থাকেন, অর্থোপার্জনের জন্য লালায়িত, এই সব অভিযোগ শোনা যাচ্ছে তাঁর নামে। এমনকী কলকাতাতেও তাঁর কোনও কোনও গুরুভাই এবং আরও অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে। স্বামীজি বছরের পর বছর আমেরিকাতে পড়ে আছেন কেন? তিনি ভারতের প্রতিনিধি, ভারতে ফিরে এসে দরিদ্র, অস্ত্র মানুষদের জাগাবার চেষ্টা করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক! তিন বছর কেটে গেল, এখনও তার দেশে ফেরার কোনও স্বাক্ষণ নেই।

আমেরিকায় ছোটাছুটি করে প্রতিদিন বক্তৃতা দিতে দিতে ক্লান্ত অবস্থায় স্বামীজি এই ধরনের অভিযোগ শুনলে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠতেন। তিনি খাদ্যাখাদ্যের বাছবিচার করেন না তা ঠিক,  কেনই বা করতে যাবেন, কে মাথার দিব্যি দিয়েছে? যস্মিন দেশে যদাচার, এ কথা লোকে জানে না? আমেরিকায় কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, স্বামীজি আপনি স্বদেশে ফিরে যাচ্ছেন না কেন? তিনি মুখের ওপর বলে দেন, আমি কি শুধু ভারতের? আমি কি সারা পৃথিবীর নই? মানুষ নামে প্রাণীটি কি নিছক কোনও দেশের গণ্ডিতে আবদ্ধ? এই জগতের কাছ থেকে আমি দেহ পেয়েছি, দেশের কাছ থেকে ভাব পেয়েছি, আর মনুষ্যজাতি, যাদের মধ্যে আমি নিজেকে একজন বলতে পারি, এই তিনের জন্যই আমি কিছু করে যেতে চাই।

প্যারিসে অবস্থানের সময় ওই সব অভিযোগ-সমালোচনার কথা মনে রেখেই তিনি আলাসিঙ্গাকে একটা ক্রুদ্ধ চিঠিতে লিখলেন :

তোমরা যে মিশনারিদের বাজে কথাগুলোর ওপর এতটা গুরুত্ব আরোপ করো, তাতে আমি আশ্চর্য হচ্ছি। অবশ্য আমি সবই খাই। যদি কলকাতার লোকেরা চায় যে আমি হিন্দু-খাদ্য ছাড়া আর কিছু না খাই, তবে তাদের বলো, তারা যেন আমায় একজন রাঁধুনি ও তাকে রাখবার উপযুক্ত খরচ পাঠিয়ে দেয়। এক কানাকড়ি সাহায্য করার মুরোদ নেই, এদিকে গায়ে পড়ে উপদেশ ঝাড়াএতে আমার হাসিই পায়।

অপরদিকে যদি মিশনারিরা বলে, আমি সন্ন্যাসীর কামিনীকাঞ্চন ত্যাগ রূপ প্রধান দুই ব্রত ভঙ্গ করেছি, তবে তাদের বলল যে, তারা মস্ত মিথ্যেবাদী। মিশনারি হিউমকে পরিষ্কার রূপে লিখে জিজ্ঞেস করবে ..তিনি আমার কী কী অসদাচরণ দেখেছিলেন… তিনি স্বচক্ষে তা দেখেছিলেন কি ..এই রূপ করলেই প্রশ্নের সমাধান হয়ে যাবে আর তাদের দুষ্টামি ধরা পড়বে! …আমার সম্বন্ধে এইটুকু জেনে রেখো, কারও কথায় আমি চলব না। আমার জীবনের ব্রত কী, তা আমি জানি।…আমি যেমন ভারতের, তেমনি সমগ্র জগতের।

আমি এখানে কঠোর পরিশ্রম করেছি আর যা কিছু টাকা পেয়েছি সব কলকাতা ও মাদ্রাজে পাঠিয়েছি। এখন এত করবার পর তাদের আহাম্মকের মতন হুকুমে আমাকে চলতে হবে?…আমি হিন্দুদের কি ধার ধারি?…বাঙালিরা রামকৃষ্ণ পরমহংসের কাজে সাহায্যের জন্য কটা টাকা তুলতে পারে না। এদিকে ক্রমাগত বাজে বকছে!…তোমরা কি বলতে চাও, তোমরা যাদের শিক্ষিত হিন্দু বলে থাকে, সেই জাতিভেদ চক্রে নিষ্পিষ্ট, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, দয়ালেশশূন্য, কপট, নাস্তিক কাপুরুষদের মধ্যে একজন হয়ে জীবনধারণ করবার ও মরবার জন্য আমি জন্মেছি?…আমি কাপুরুষদের সঙ্গে আর বাজনৈতিক আহাম্মকির সঙ্গে কোনও সংস্রব রাখতে চাই না। আমি কোনও প্রকার বাজনীতিতে বিশ্বাসী নই।…

বিবাহ-উৎসব শেষ হতেই স্বামীজি প্যারিস ছেড়ে চলে এসেছিলেন লন্ডনে। সেবারে বেশিদিন থাকেননি, কিন্তু ইংরেজ জাতি সম্পর্কে তাঁর মনোভাবের বেশ পরিবর্তন ঘটেছিল। তিনি সিপাহি বিপ্লবের দু দশক পরে কলকাতায় কলেজের ছাত্র ছিলেন, সদ্য জাগ্রত স্বদেশি চেতনার আঁচ তার গায়ে লেগেছিল, নিজে সারা ভাবতবর্ষ ঘুরে ঘুরে দেখেছেন ইংরেজের শাসনে দেশের চরম দুর্দশা, কোটি কোটি মানুষ শোযত, নিষ্পেষিত, অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত। শাসক শ্রেণীর ঔদ্ধত্যের অনেক পরিচয় তিনি পেয়েছেন, সুতরাং এদের সম্পর্কে তাঁর বিরূপ মনোভাব থাকা স্বাভাবিক। ইংল্যান্ডে এসে তিনি ইংরেজ জাতির অন্য একটি রূপ দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন।

আমেরিকার তুলনায় ইংল্যান্ডে বর্ণবিদ্বেষ অনেক কম। একা একা রাস্তায় ঘুরলেও ফেউ-এর মতন এক পাল ছেলে-মেয়ে জুটে ব্ল্যাকি ব্ল্যাকি বলে তাড়া করে না। আমেরিকায় ছোট কিংবা মাঝারি হোটেলে কালো চামড়ার লোকদের ঢুকতে দেওয়া হয় না, এমনকী নাপিতের দোকানেও চুল কাটতে প্রত্যাখ্যান করে, ইংল্যান্ডে সে সব সমস্যা নেই। স্বামীজির বক্তৃতা সভায় যে-সব নারী পুরুষ আসে, তারা ধৈর্যশীল শ্রোতা, যে কোনও বিষয়ই তারা গভীরভাবে অনুধাবনের চেষ্টা করে, সেই তুলনায় আমেরিকানরা ছটফটে। অধিকাংশ আমেরিকানই কুপমণ্ডুক, ইংরেজরা পৃথিবী সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। এই সব দেখে স্বামীজির মনে হয়, ভারত শাসনের জন্য যে-সব ইংরেজদের পাঠানো হয়, তারা বেশির ভাগই ছ্যাঁচড়া ধরনের। তারা ইংরেজ জাতির কুলাঙ্গার।

সেবারে বেশি দিন থাকতে পারেননি স্বামীজি, এবার এসেছেন অনেকটা প্রস্তুতি নিয়ে। দেশে ফেরার আগে আমেরিকাতে এবং ইংল্যান্ডে কয়েকটা বেদান্তের কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত করে যেতে চান! তাঁর অনুপস্থিতিতে এ-দেশীয় শিষ্যরাই সেই সব কেন্দ্র চালাবে। দেশ থেকেও কয়েকজন গুরুভাইকে আনিয়ে নিতে হবে, শরৎ এর মধ্যেই চলে এসেছে, তা ছাড়াও কালী বেদান্তী বা শশীকে আমেরিকায় পাঠাতে পারলে ভাল হয়। খানিকটা ইংরিজি ও সংস্কৃতজ্ঞান আছে এমন লোক দরকার, তা ওদের আছে, ওরা শাস্ত্র পাঠ করে শোনাতে পারবে।

আমেরিকায় শেষ দিকে খুবই ভাল কাজ হয়েছে। প্রতিকূল মনোভাবাপন্ন লোকের সংখ্যা কমে গেছে তো বটেই, এমন কয়েকজনকে পাওয়া গেছে, যারা সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে বেদান্তের মানব ধর্ম প্রচারের কাজ করতে চায়।

সবচেয়ে সুন্দর সময় কেটেছে সহস্রদ্বীপে। আমেরিকা ও কানাডার মধ্যবর্তী সীমান্তে সেন্ট লরেন্স নদীর বক্ষে অজস্র দ্বীপ আছে, লোকে বলে থাউজ্যান্ড আয়ল্যান্ডস। সেখানকার একটি দ্বীপে স্বামীজির এক ছাত্রী শ্রীমতী ডাচারের একটি দোতলা বাড়ি আছে। দ্বীপটি নির্জন, চতুর্দিকে নিবিড় অরণ্য, এক পাশের পাহাড় যেখানে ঢালু হয়ে নেমে এসেছে, তার গায়ে সেই বাড়িটি, যেন তপোবনের মধ্যে একটি আধুনিক কুটির। সেই দ্বীপ-ভবনে স্বামীজি প্রায় দেড় মাস ছিলেন, সঙ্গে জনা দশেক ভক্ত শিষ্য, একদল চলে যায়, আবার একদল আসে, সকাল থেকে চলে উপাসনা, শাস্ত্র পাঠ, উপদেশ, বনের মধ্যে ভ্রমণ, হাস্য পরিহাস, এক সঙ্গে সবাই মিলে আহার। স্বামীজি এক-একদিন অন্যদের নিজের হাতে বেঁধেও খাইয়েছেন। আমেরিকার বিভিন্ন শহর ঘুরে ঘুরে বক্তৃতা দেবার বদলে এই পরম রমণীয় দ্বীপ-উদ্যানে, ভক্তদের সঙ্গে দেড় মাস সময় কাটিয়ে স্বামীজি খুব শান্তি পেয়েছিলেন। তাঁর এখানকার বক্তৃতা ও উপদেশও অতি উচ্চস্তরের, কারু কারু মনে হত, এ যেন দেববাণী।

এই সহস্রদ্বীপে থাকার সময়েই স্বামীজি তাঁর ভক্তদের দীক্ষা দিতে শুরু করেন। ল্যান্ডসবার্গ ও মেরি লুই হলেন কৃপানন্দ ও অভয়ানন্দ। আমেরিকান নারী-পুরুষেরা নিজেদের নাম বর্জন করে ভারতীয় নাম গ্রহণ করতে লাগল, এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা। দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়ির পূজারি ব্রাহ্মণ সেই রামকৃষ্ণ, যাঁকে তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত নিজের দেশেরই মুষ্টিমেয় লোক চিনত, সেই রামকৃষ্ণ হলেন এই সব আমেরিকানদের গুরু।

এবারে স্বামীজি লন্ডনে এসে তাঁর আদর্শ প্রচারে মন দিলেন। শ্রীমতী মূলার এবং শ্রীযুক্ত স্টার্ডির উৎসাহে বক্তৃতাস্থানের ব্যবস্থা হয়ে গেল, প্রথম থেকেই উৎসাহী লোক আসতে লাগল দলে দলে। সংবাদপত্রগুলি মনোযোগ দিল তাঁর দিকে। একটি পত্রিকায় লিখল, রাজা রামমোহন এবং কেশবচন্দ্র সেন ছাড়া আর কোনও এত উৎকৃষ্ট ভারতীয় বক্তাকে ইংল্যান্ডের বক্তৃতা মঞ্চে দেখা যায়নি।

ক্রমশ ছোট জায়গা থেকে বড় জায়গায় চলে আসতে হল। তাতেও মানুষ ধরে না, অনেকে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকে। শ্রোতারা মন দিয়ে শোনে, প্রশ্ন করে। দু একটা লোক যে কিছু উৎকট প্রশ্ন করে বসে না তা নয়, কিন্তু অধিকাংশ শ্রোতার মুখ দেখে বা কথা শুনে বোঝা যায়, তাদের মধ্যে সত্যিকারের একটা অন্বেষণ আছে, তারা তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থায় তৃপ্ত নয়।

ক্রমে দিনে দুবার বক্তৃতার ব্যবস্থা হল। সকালে লন্ডনের বাড়িতে খানিকটা ক্লাস নেবার মতন, আর সন্ধ্যায় কোনও প্রকাশ্য মঞ্চে বক্তৃতা। এক একদিন এক এক বিষয়। বিষয়টিও তাৎক্ষণিকভাবে ঠিক হয়, পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই তিনি অনর্গল বলে যান, তাতে ইতিহাস, শাস্ত্র, দর্শন যেমন থাকে, তেমনই বর্তমান পৃথিবীর অবস্থাও বাদ যায় না। আমেরিকায় যেমন তিনি আমেরিকানদের ধনতান্ত্রিক উন্মত্ততার কথা বলতে ছাড়েননি, এখানেও তিনি ইংরেজদের যুদ্ধনীতি এবং শোষণের শাসনের সমালোচনা করতে পিছপা হন না।

লাল রঙের একটা ঝোলা কোট পরা, কোমরে একটি কোমরবন্ধ, দীপ্তিমান মুখ, গভীর কণ্ঠস্বর, বক্তৃতামঞ্চে তিনি যেন অন্য মানুষ। শ্রোতা তাঁর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে, কেউ কেউ তাঁর মুখে গৌতম বুদ্ধের মুখের সাদৃশ্য খুঁজে পায়।  

সারদানন্দ এর মধ্যে অনেকটা সড়গড় হয়ে উঠেছেন। হঠাৎ বিদেশে আসার প্রাথমিক জড়তা কেটে গেছে, বাড়িতে একা একা ইংরেজিতে বক্তৃতা দেওয়া অভ্যেস করেন। কখনও মহেন্দ্রকে বলেন, তুই শোন, মাঝে মাঝে হুঁ দিয়ে যাবি, আমার কিছু ভুল হলে বলবি। কখনও সখনও স্বামীজি এসে পড়েন, সারদানন্দকে উৎসাহ দেন, কাছে এসে সারদানন্দের ডান হাতখানি ধরে বলেন, এমন আড়ষ্টভাবে থাকবি কেন, সহজভাবে হাত নাড়বি, সব সময় ব্যাকরণ শুদ্ধির কথা মাথায় রাখলে চলবে না, মনের ভাব গড় গড় করে বলে যাওয়াটাই বড় কথা। সব ইংরেজের বাচ্চা কি সঠিক ইংরিজি বলে!

সারদানন্দ স্বামীজির প্রতিটি বক্তৃতা সভায় একেবারে সামনের সারিতে বসে থাকেন, স্বামীজির চিবুক তুলে কথা বলা, মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত ছোঁড়া, কণ্ঠস্বরের ওঠানামা লক্ষ করেন খুব মনোযোগ দিয়ে। এই তেজোদ্দীপ্ত, বাগবিভূতিসম্পন্ন সন্ন্যাসীটিই যে তাঁর পূর্ব পরিচিত নরেন, সেই বিস্ময়ের ঘোর এখনও কাটতে চায় না।

স্বামী বিবেকানন্দর মধ্যে যেন স্পষ্ট দ্বৈতসত্তা আছে। এক এক সময় তিনি যেন একেবারে ছেলেমানুষ হয়ে যান। উত্তর কলকাতার গলির আড্ডাবাজ ছোকরার মতন, সেই রকমই মুখের ভাষা। একদিন বক্তৃতা শুরু হবার আগে স্বামীজি সেজেগুজে পায়চারি করছেন ঘরের মধ্যে। নির্দিষ্ট সময়ের আরও মিনিট দশেক দেরি আছে, এখনও কেউ আসেনি। শ্রীমতী মুলার ও শ্রীযুক্ত স্টাডি অন্যত্র গেছেন, ওঁরা থাকলে বাংলায় কথা বলা যায় না। স্বামীজি সারদানন্দকে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ রে শরৎ, এখানে কী রকম কাজ হবে বুঝছিস?

সারদানন্দ বললেন, অনেকেরই তো দিন দিন আগ্রহ বাড়ছে দেখছি। কয়েকজন প্রত্যেকটা বক্তৃতা শুনতে আসে। সবাই বলে, এ দেশে সময়ের দাম আছে। তবু তো এরা সময় ব্যয় করে আসছে। তবু যেন একটু দ্বিধার ভাব আছে।

স্বামীজি বললেন, আমেরিকায় তুই এরকম সভা দেখলে চমকে যেতিস। এক দিন বক্তৃতা শুনেই কেউ কেউ পায়ের ওপর আছড়ে পড়েছে। ওদের স্বভাবটাই এরকম। এ দেশে সব কাজ ধীরে ধীরে হয়। কিন্তু ইংরেজ বাচ্চা কোনও কাজে হাত একবার দিলে আর সহজে ছাড়ে না। আমেরিকানরা চটপটে, কিন্তু অনেকটা খড়ের আগুনের মতন।

কথা বলতে বলতে তিনি চলে গেলেন জানলার ধারে। স্বচ্ছ কাচের জানলা দিকে দেখা যায় পথের জনস্রোত। বৃষ্টি পড়ছে ঝিরঝির করে। এদেশে সকলেই ছাতা নিয়ে বেরোয়। এক দঙ্গল মহিলাকে দেখে স্বামীজি হঠাৎ একটা গান বানিয়ে গাইতে লাগলেন :

ছাতি হাতে, টুপি মাথায় আসচে যত ছুঁড়ি
মুখে মেখেছে তারা ময়দা ঝুড়ি ঝুড়ি…

এমনভাবে মাথা নেড়ে নেড়ে ব্যঙ্গের সুরে তিনি গানটা গেয়ে চললেন, যেন এই সময় তিনি স্বামী বিবেকানন্দ নন, স্কটিশচার্চ কলেজের ছাত্র নরেন। সারদানন্দ ও মহেন্দ্র তো একেবারে হেসে কুটিকুটি। দাদার সামনে ওরকম ভাবে হাসতে নেই বলে মহেন্দ্র ছুটে বেরিয়ে গিয়ে মুখে রুমাল চাপা দিল।

স্বামীজি সারদানন্দকে বললেন, দ্যাখ, দ্যাখ, মাগিরা মুখে পাউডার মেখেছে যেন কোদাল দিয়ে চাঁচা যায়!

সারদানন্দ বললেন, ওই বুঝি কারা এসে পড়ল।

স্বামীজি ট্যাঁক ঘড়ি খুলে দেখে বললেন, এখনও চার-পাঁচ মিনিট বাকি আছে। তারপর সারদানন্দকে কনুইয়ের খোঁচা দিয়ে বললেন, তুইও গানটা গা না!

সকালের অধিবেশনে মহিলারাই বেশি আসে, সন্ধ্যায় পুরুষদের সংখ্যা বেশি। এই সব শ্রোতারা আসে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে। উঁচুতলার মহিলারাও আসে খানিকটা অভিনবত্বের সন্ধানে, খানিকটা হুজুগে, কেউ কেউ নিঃসঙ্গতা-অশান্তিবোধের তাড়নায়। জোসেফিন ম্যাকলাউড দিদির বিয়ের পর আমেরিকায় ফিরে গিয়েও স্বামীজির জন্য ব্যাকুলতা বোধ করে। স্বামীজি তাকে নিয়মিত চিঠি লেখেন, তবু সে একদিন হুট করে লন্ডনে চলে এল। স্বামীজির খাওয়া দাওয়া কিংবা থাকার অসুবিধে হচ্ছে কি না সে ব্যাপারে সে চিন্তিত। স্বামীজি এখন শ্রীমতী মুরের আতিথ্য গ্রহণ করেছেন, সেখানে তার মাথা গলানো শোভন নয়, তাই সে লন্ডনের একটি বড় দোকানে টাকা জমা দিয়ে রাখল, সেখান থেকে প্রতিদিন এক ঝুড়ি বাছাই করা সেরা ফল পাঠানো হয় স্বামীজিকে, প্রেরণকারীর নাম জানানো হয় না। তার দিদি শ্রীমতী লেগেটও একবার দেখতে এল স্বামীজিকে। সে এখন এতই একজন বড় ব্যবসায়ীর পত্নী যে তার আগমনে সাড়া পড়ে যায় লন্ডনের ধনী মহলে, স্বামীজি সম্পর্কেও এই মহলের কৌতূহল বৃদ্ধি পায়।

সমস্ত মহিলা-শ্রোতাই অবশ্য ধনী শ্রেণীর অন্তর্গত নয়। স্কুল শিক্ষিকা, নার্স, মধ্যবিত্ত গৃহবধু, ব্যর্থ প্রেমিকা, গৃহ-বিচ্ছিন্ন উদভ্রান্ত রমণীরাও আসে শান্তি ও সান্ত্বনা পাবার আশায়। এরা অনেকেই নিয়মিত আসে, তবে একজনকে বিশেষভাবে চোখে পড়ে। সেই তরুণীটির নাম শ্রীমতী মার্গারেট নোল।

বক্তৃতা দিতে উঠে স্বামীজি দর্শকদের মধ্যে চোখ বুলিয়ে দেখে নেন, মার্গারেট এসেছে কি না। চোখাচোখি হলে স্বামীজি একটু হাসেন। এই হাসির একটা বিশেষ অর্থ আছে। মার্গারেটের সঙ্গে বেশ পরিচয় হয়ে গেছে বটে, তবু মার্গারেটের মন এখনও সংশয়পূর্ণ, স্বামীজির অনেক বক্তব্যই সে মেনে নিতে পারে না। তবু সে আসে, যেন চুম্বকের টানে এসে উপস্থিত হয়।

মার্গারেট স্বামীজির চেয়ে চার বছরের ছোট। এখনও তিরিশ বছর পূর্ণ হয়নি। তবু তার জীবনে অনেক হাহাকার ও শুন্যতা রয়ে গেছে। মার্গারেটের জন্ম আয়াল্যান্ডে, তার পিতা ও পিতামহ দু জনেই ছিলেন ধর্মযাজক। তার যখন দশ বছর বয়েস, তখন বাবা মারা যান। অর্থ সঞ্চয় কিছু ছিল না, তিনটি ছোট ছোট ছেলে-মেয়েকে নিয়ে মার্গারেটের মা আশ্রয় নেন বাপের বাড়িতে। সেইজন্য মাত্র সতেরো বছর বয়েসেই জীবিকার জন্য শিক্ষিকার চাকরি নিতে হয় মার্গারেটকে। সে তার ভাই-বোনদের শিক্ষার দায়িত্ব নেয়।

এই তরুণী শিক্ষয়িত্রীটির জীবনে অচিরেই দেখা দিল প্রেম। এক ওয়েবাসী যুবকের সঙ্গে তার পরিচয় হল, পেশায় সে ইঞ্জিনিয়ার, সুঠাম, সুন্দর চেহারা। দু’ জনের রুচিরও বেশ মিল আছে। তাদের এই বন্ধুত্ব ও প্রেম যখন বিবাহের পরিণতির দিকে এগোচ্ছে, ব্যবস্থা প্রায় পাকা, তখন বিনা মেঘে বজ্রপাত হল, সামান্য দু এক দিনের অসুখে সেই যুবকটি চলে গেল ইহলোক ছেড়ে।

সেই আঘাত সামলানো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কেন এমন হয়? মানবজীবনের নিয়ন্তা যদি কেউ থাকে, তবে এ কী রকম তার বিচার? কোনও সান্ত্বনা বাক্যই মার্গারেটের সহ্য হত না। সেই স্থান ত্যাগ করে অন্য স্কুলে চাকরি নিয়ে চলে গেল মার্গারেট।

আরও দু একবার চাকরি বদল করার পর মার্গারেট চলে এল লন্ডনে। বাচ্চাদের সংস্পর্শে তার হৃদয় কিছুটা জুড়োয়, পড়াতে সে ভালও বাসে। মার্গারেটের মধ্যে যে একটা জন্মগত সংগঠন ক্ষমতা আছে, তা সে নিজেই উপলব্ধি করে এ সময়। পরিচিত ব্যক্তিরা তার মতামতকে গুরুত্ব দেয়। কিছুদিন পর সে সাহস করে সঙ্কল্প নিল, নিজেই একটা ইস্কুল খুলবে, যেখানে শিশুদের শাসনের কোনও ব্যবস্থা থাকবে না। তাদের মনস্তত্ব পর্যবেক্ষণ করে, যার যেদিকে ঝোঁক সেদিকে চালনা করার চেষ্টা করা হবে। শিক্ষার এই এক আধুনিক পদ্ধতি। কিছু বন্ধু বান্ধব তাকে সাহায্য করতে রাজি হল।

মফস্বল থেকে লন্ডনে এসে পড়ায় মার্গারেটের জীবনে বেশ একটা পরিবর্তন এল। পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর এখন লন্ডন, দুনিয়ায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি ইংরেজ জাতির রাজধানী শুধু নয়, জ্ঞান ও বিদ্যাচচরিও কেন্দ্র, বহু দেশের বুদ্ধিজীবীরা এখানে সমবেত হন। এখানকার তরুণ সমাজ যুক্তি ও বিজ্ঞানসম্মতভাবে চিন্তা করে, বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিত তাদের মস্তিষ্কে থাকে।

এরকম কয়েকটি গোষ্ঠীর সঙ্গে পরিচয় হল মার্গারেটের, ক্রমশ সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। সেসেমি ক্লাব নামে একটি সংগঠনে সাহিত্য পাঠ, বক্তৃতা ও বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক হয়, মার্গারেট প্রথমে সেই ক্লাবের সদস্যা ও পরে সেক্রেটারি হয়ে যায়। এই ক্লাবে সে বার্নার্ড শ’, হাক্সলি প্রমুখ। বিখ্যাত ব্যক্তিদের ডেকে বক্তৃতার ব্যবস্থা করে, নিজেও বিতর্কে অংশ নেয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সে লেখালেখিও শুরু কবেছে।

এই সব কাজে ব্যস্ত থেকে সে প্রথম প্রেমের ব্যর্থতার আঘাত সইয়ে নিল অনেকখানি। কিছুদিন পর তার জীবনে এল আবার প্রেম। সেসেমি ক্লাবেরই সদস্য একটি যুবকের সঙ্গে মনের মিল হল তাব। সেই যুবকটিরও অবস্থা অনেকটা মার্গারেটেরই মতন, তারও এক পূর্ব-প্রণয়িনী ছিল, কিছু দিন আগে সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে। ব্যর্থতাবোধ ও বেদনাই দু জনকে কাছে টেনে আনে। দু জনে একসঙ্গে মিলে মিশে কাজ করতে বেশি উৎসাহ পায়। মার্গারেটের পরের বোনটি এর মধ্যে লেখাপড়া শেষ করে চাকরি পেয়েছে, ছোট ভাইটি কলেজে পড়ছে, মার্গারেটের দায়িত্ব অনেকটা কমে গেছে। এখন সে তার প্রেমিককে স্বামীত্বে বরণ করে নিজস্ব সংসার বাঁধার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে, এই সময় এল আবার দারুণ আঘাত। সেই যুবকটি হঠাৎ একদিন অদৃশ্য হয়ে গেল। না, এবারও মৃত্যু টেনে নেয়নি, সে যুবকটি ছিল চঞ্চলমতি। সে মার্গারেটের মতন এক রমণীরত্নের মূল্য বুঝল না, সে ফিরে গেল তার আগেকার প্রেমিকার কাছে, বিয়েটাও সেরে ফেলল দ্রুত।

এবারে মার্গারেট সব কিছু ছেড়েছুড়ে পালিয়ে গেল লন্ডন থেকে। অন্য বন্ধুবান্ধবদের কাছে সে মুখ দেখাতে চায় না। হ্যালিফ্যাক্সে শ্ৰীমতী কলিনস নামে তার এক বান্ধবী ছিল। সেখানে গিয়ে সে। শয্যা নিল।

আবার যে সে ফিরল, সে শুধু ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলির টানে। নিজের বুকে যতই দুঃখ-দহন থাক, ওই সব কচি কচি মুখগুলিকে তো স্নান করা যায় না! তারা যে মিস নোবলকে খুব ভালবাসে। স্কুলটাকে চালাতেই হবে, মার্গারেট লন্ডনে এসে আবার স্কুলের কাজে ও ক্লাব পরিচালনার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল। উইম্বলডনে সে স্কুল নিয়ে ব্যস্ত থাকে সারা দিন, আর বিকেলের পর লন্ডনের বিভিন্ন অঞ্চলে সভা-সমিতিতে যোগদান করে। নিজের বুকের ক্ষতটির কথা সে কারুকে জানতে দেয় না।

মার্গারেটের এই রকম মানসিক অবস্থার মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দর সঙ্গে দেখা।

এক বছর আগে স্বামীজি প্রথমবার ইংল্যান্ডে এসেছেন, কিছু কিছু জায়গায় বক্তৃতার ব্যবস্থা হয়েছে। মার্গারেট একদিন লন্ডনের সমাজের এক বিশিষ্ট মহিলা, লেডি ইসাবেল ফার্গুসনের কাছ থেকে একটি আমন্ত্রণপত্র পেল। সেই মহিলার বাড়ির বৈঠকখানায় স্বামী বিবেকানন্দ নামে কে একজন হিন্দু সন্ন্যাসী ধর্ম সম্পর্কে বক্তৃতা দেবে। মার্গারেট এর সম্পর্কে কিছুই জানে না, ভারতবর্ষ সম্পর্কেই তার জ্ঞান খুব কম। তবে ভারত সম্পর্কে তার একটা সহানুভূতির ভাব আছে, তার পিতৃভূমি আয়াল্যান্ড ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হবার জন্য লড়াই চালাচ্ছে। ভারতও ব্রিটিশ শাসনের অধীন, এই সূত্রে একটা যোগ আছে।

নভেম্বর মাসের এক রবিবারের বিকেল। বেশ শীত পড়ে গেছে, ওয়েস্ট এডের সেই বৈঠকখানার ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালতে হয়েছে, সেদিকে পিঠ দিয়ে বসে আছেন ভারতীয় সন্ন্যাসীটি, লাল রঙের আলখাল্লা ও কোমরবন্ধ পরা, শিরদাঁড়া সোজা, বিশেষভাবে চোখে পড়ে উজ্জ্বল দুই চক্ষু। শ্রোতারা বসে আছে অর্ধ বৃত্তাকারে, সব মিলিয়ে পনেরো-যোলোজন। শ্রোতারা প্রায় সকলেই সকলের পরিচিত, কেউই ধর্ম-তৃষ্ণা নিয়ে আসেনি, এরা সন্ধিগ্ধমনা বুদ্ধিজীবী। স্বয়ং গৃহকত্রীর ধারণা, ধর্ম বিশ্বাস একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার, শাশ্বত জীবনবোধের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই। ডারউইনের মতন বৈজ্ঞানিকরা জীবসৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে অকাট্য প্রমাণ উপস্থিত করেছেন, সেখানে বিধাতার কোনও ভূমিকা নেই, প্রকৃতির নিয়মের মধ্যে স্থান নেই কোনও সৃষ্টিকর্তার।

প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মধ্যে আদর্শ বিনিময়ের সময় এসেছে, এই প্রসঙ্গে বক্তৃতা শুরু করলেন স্বামীজি। ইংরিজির সঙ্গে সঙ্গে তিনি এক একবার উচ্চারণ করছেন সংস্কৃত মন্ত্র, তার একটি অক্ষরেরও মানে বুঝতে পারছে না কেউই, কিন্তু সেগুলির শব্দ ঝঙ্কার শুনতে ভাল লাগে। মাঝে মাঝে স্বামীজি চোখ বন্ধ করে বলে উঠছেন, শিব! শিব!

জানলার বাইরে ঘনিয়ে এসেছে অন্ধকার, ঘরের মধ্যে আলো জ্বালা হয়নি, ফায়ার প্লেস থেকে আসছে আগুনের আভা, স্বামীজির কথা শুনতে শুনতে মার্গারেট কল্পনায় দেখতে পেল, ভারতবর্ষের গ্রামে সূর্যাস্তের সময় কোনও বটবৃক্ষের নীচে কিংবা গ্রামে কুয়োর ধারে বসে সন্ন্যাসীরা যেন ঠিক এমনভাবেই উপদেশ দেয়।

বক্তৃতা শেষ হবার পর চা-পান। মার্গারেট সেই সন্ন্যাসীর সঙ্গে একটিও কথা না বলে উঠে গেল। দরজার বাইরে কয়েকজন বলাবলি করছে, এই হিন্দু সন্ন্যাসী তো এমন কিছু নতুন কথা শোনায়নি। এঁকে নিয়ে মাতামাতি করার কী আছে? ‘সমস্ত ধর্মই সমভাবে সত্য’, এটা একটা নিছক গালভরা কথা। তা হলে এতগুলি ধর্মের আলাদা আলাদা অস্তিত্বের কী দরকার? ধর্ম প্রচারেরই বা কী অর্থ হয়? ‘বিভিন্ন রূপে সেই এক অদ্বিতীয় সত্তার বিভিন্ন প্রকাশ, সেই অদ্বিতীয় সত্তাই যে কী বস্তু তা সঠিকভাবে আগে কেউ বোঝাতে পারেননি, ইনিও কিছু বললেন না। নাঃ, এই ভারতীয় যোগী মৌলিক কিছু বলতে পারেননি।

মার্গারেটও অন্যদের সঙ্গে একমত হল। আজকের বক্তৃতা শুনে তার নতুন কোনও সত্যের উপলব্ধি হয়নি।

একা একা তাকে ফিরতে হল নিজের বাড়িতে। কাল সোমবার, কাল থেকে আবার অনেক কাজ। তাড়াতাড়ি কিছু রান্না করে নিতে হবে নিজের জন্য। রান্না ঘরে টুকিটাকি কাজ সারছে মার্গারেট, তার ছোট্ট বাড়িটিতে কোনও শব্দ নেই, বারবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল সন্ন্যাসীটির বসে থাকার ছবিটি। কণ্ঠস্বরে গভীর আত্মবিশ্বাস, একই সঙ্গে সারল্য-মাখা তেজোদ্দীপ্ত মুখ, এই মানুষটি তার দেখা অন্য কোনও মানুষের মতন নন। তাঁর মুখখানি মনে পড়লেই মা মেরির কোলেও বসে-থাকা শিশু যিশুর কথা মনে আসছে কেন?

সারা সপ্তাহ ধরে নানা কাজের ফাঁকে ফাঁকে হিন্দু সন্ন্যাসীর মুখখানি ঘুরে ফিরে আসতে লাগল তার মানসপটে। মার্গারেট নিজেই বেশ বিস্মিত। পরের শনিবার তার মনে হল, একবার শুনেই ওই সন্ন্যাসীটির সব কথা উড়িয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। উনি নতুন কিছু বলেননি বটে, তবে এক ঘণ্টা ধরে অনেকগুলি দিক ছুঁয়ে গেছেন তো বটে, এমন বক্তাই বা ক’জন পাওয়া যায়! সংবাদপত্রের নোটিশ দেখে সে নিজেই খুঁজে খুঁজে স্বামীজির পরবর্তী বক্তৃতা সভাতে উপস্থিত হল।

সেদিনের বক্তৃতার বিষয়বস্তুতেও মার্গারেট সন্তুষ্ট হল না। তার মধ্যে তো অনেক যদি এবং কিন্তু আছে। তবু আগাগোড়া সে সম্মোহিতের মতন চেয়েছিল ওই মানুষটির দিকে। এমন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একজন মানুষকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। কাছাকাছি বসে ওর কণ্ঠস্বর শোনারও একটা শিহরন আছে।

সভার শেষে মার্গারেট কোনও কথা বলল না বটে, কিন্তু সে অন্যদের কাছে খবর নিয়ে জানল, স্বামীজি রিডিং অঞ্চলের একটি বাড়িতে থাকেন। সেই ঠিকানা সংগ্রহ করে একটা চিঠি লিখে ফেলল সে। অচিরেই সেই চিঠির উত্তর এল, সে উত্তর পড়ে মার্গারেট চমৎকৃত। আলাপ-পরিচয় না হলেও স্বামীজি তাকে চেনেন, তাকে সম্বোধন করেছেন আপনজনের মতন। মার্গারেটের সংশয়ের উত্তরে স্বামীজি লিখেছেন : পবিত্রতা, ধৈর্য ও অধ্যাবসায় দিয়ে সকল বাধাবিঘ্ন দূর করা যায়। সব বড় বড় ব্যাপারই ধীরে ধীরে হয়ে থাকে।…আমার ভালবাসা জানবে। ইতি বিবেকানন্দ।

স্বামীজি তাকে ভালবাসা জানিয়েছেন? মার্গারেট যাঁর উক্তিগুলিকে মেনে নেয়নি, বক্তৃতা সভার পর যাঁকে অভিনন্দন জানায়নি, তিনি অযাচিতভাবে ভালবাসা জানাতে দ্বিধা করেন না! এত সহজে তিনি মানুষকে আপন করে নিতে পারেন?

স্বামীজি তো সেবার ফিরে গেলেন আমেরিকায়। আবার সভনে ফিরে এলেন কয়েক মাস পরেই। এবারে মার্গারেট তাঁর প্রায় প্রতিটি বক্তৃতা সভায় যায়, এখনও ধর্ম-দর্শনে তার আস্থা হয়নি। পাদ্রির মেয়ে হয়েও গিজার আড়ম্বরপূর্ণ ধর্মানুষ্ঠানে তার অভক্তি জন্মে গেছে, নতুন করে অন্য কোনও ধর্মীয় রীতিনীতি সম্পর্কে তার আগ্রহ জাগেনি, এখন সে দ্বিধা কাটিয়ে উঠেছে, এখন সে মাঝে মাঝে তর্ক করে। স্বামীজি সহাস্যে তাকে প্রশ্রয় দেন। মিনমিনে স্বভাবের মানুষজন তিনি দু চক্ষে দেখতে পারেন না। এই তরুণীটির তেজ ও দৃপ্ত ভঙ্গিমা তাঁর বেশ পছন্দ হয়। তর্ক করুক, তবু তো নিয়মিত আসে! তিনি নিজে তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে বছরের পর বছর অবিশ্বাস নিয়ে তর্ক করেননি? তর্ক করতেন, এবং বার বার ছুটে ছুটে সেই শ্রীরামকৃষ্ণের কাছেই তো যেতেন!

মার্গারেটও বুঝতে পেরেছে যে, এই হিন্দু সন্ন্যাসীটির জীবন বার্তা সে মানতে পারুক বা না পারুক, তবু সে ওঁর সান্নিধ্য থেকে বেশিক্ষণ দূরে থাকতে পারবে না। এখন স্বামীজির ঘনিষ্ঠ মানুষজন, শ্ৰীমতী মুলার, স্টার্ডি দম্পতি ও সেভিয়ার দম্পতি, ওঁদের সঙ্গেও তার পরিচয় হয়েছে, সে এদের সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে।

স্থান সঙ্কুলানের জন্য পিকাডিলি অঞ্চলে রয়েল ইনস্টিটিউট অব পেইন্টার্স ইন ওয়াটার কালার্স-এর গ্যালারিটি ভাড়া নেওয়া হয়েছে, সেখানে বক্তৃতা হয় প্রতি রবিবার সন্ধ্যায়। জনসমাগম দিন দিন বাড়ছে। স্বামীজি সেখানে ‘ধর্মের প্রয়োজন’, ‘সার্বজনীন ধর্ম’, ‘ভক্তিযোগ’, ‘ত্যাগ’ এই সব বিষয়ে ভাষণ দিতে লাগলেন। শুনতে শুনতে মার্গারেটের মনে হয়, স্বামীজি একেবারেই বিশ্বাস করেন না যে, মানুষ আজন্ম পাপী বা দুর্বল। মানুষের ওপর তাঁর অগাধ বিশ্বাস। মানুষের যা কিছু মহৎ ও পবিত্র শুধু তারই সঙ্গে উচ্চাবিত তাঁর আহ্বান। স্বামীজি ইদানীং ত্যাগের কথা খুব বলছেন। একদিন প্রশ্নোত্তরের সময় তিনি অকস্মাৎ বজ্র ধমকের সুরে বলে উঠলেন, জগৎ আজকের দিনে যা চায়, তা হচ্ছে এমন বিশজন নরনারী যারা ওই রাস্তায় দাঁড়িয়ে সাহস ভরে বলতে পারবে যে, ভগবান ছাড়া তাদের আপনার বলবার আর কেউ নেই। কে প্রস্তুত? কে পারবে সব কিছু ছেড়েছুড়ে মানুষের সেবার কাজে বেরিয়ে আসতে!

এই কথাগুলি মার্গারেটের বুকে বিষমভাবে বাজে। ত্যাগ একটা চমৎকার শব্দ। ত্যাগের জন্য তো কেউ আগে এমনভাবে ডাকেনি। সংসার বাঁধার স্বপ্ন মার্গারেটের কাছ থেকে বারবার পিছলে সরে গেছে, তার আর ওই সাধ নেই। সব কিছু ছেড়ে বেরিয়ে আসা তার পক্ষে অতি সহজ। স্বামীজির এই আহ্বানে সাড়া দিতে তার কোনও দ্বিধা নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *