1 of 2

৩৬. বিপদ যখন আসে

কথায় বলে, বিপদ যখন আসে, তখন একা আসে না। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে যখন গ্রামাঞ্চলে হাহাকার পাড়ে গেছে, তারই মধ্যে ভুমিকম্প দারুণ তাণ্ডব ঘটিয়ে গেল। দুর্ভিক্ষের প্রকোপ উত্তর-পশ্চিম ভারতেই বেশি, আর ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা উত্তর-পূর্ব ভারত, বিশেষত বাংলাদেশ এবং আশেপাশের রাজ্যগুলিতেই ছড়িয়ে রইল। স্মরণকালের মধ্যে বাংলায় এত বড় ভূমিকম্প আর হয়নি।

রাজশাহী, ঢাকা, মৈমনসিং-এর বহু বাড়ি একেবারে বিধ্বস্ত, নদীর জল ফুলে উঠে প্লাবিত হল অনেক গ্রাম, অসংখ্য মানুষ হতাহত ও গৃহচ্যুত হল। মাঠে মাঠে হাজার হাজার গরু-মহিষ-ছাগলের মৃতদেহ পচে গলে দুর্গন্ধ ছড়াতে লাগল। প্রথম দিনের ভাঙচুরের পরও কয়েকদিন ধরে মাঝেমাঝেই ভূমি কেঁপে ওঠে, আরও গভীর বিপদের আশঙ্কায় সমস্ত মানুষ দিশেহারা। যারা প্রবাসে রয়েছে, তারা দূরের আত্মীয়স্বজনের কোনও সংবাদ পাচ্ছে না, ট্রেন চলাচলও বন্ধ।

ত্রিপুরায় রাজবাড়িটি একেবারে তাসের বাড়ির মতন ভেঙে পড়েছে। পিতৃবিয়োগের পর মহারাজ রাধাকিশোর নানা বাধা বিঘ্নের মধ্যেও সবে রাজ্যপাট গুছিয়ে নিচ্ছিলেন, এই নিদারুণ বিপদে তিনি মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। সেই বিশাল অট্টালিকার আনাচে কানাচে কত নারী-পুরুষ যে ছিল তার হিসেব নেই। অনেকেই চাপা পড়েছে, দ্রুত উদ্ধারকার্যে যখন সংজ্ঞাহীন ও মুমূর্ষদের বার করে আনা হচ্ছে, অন্তঃপুরের অসূর্যস্পশ্যা রানিরা এই প্রথম খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে কান্নাকাটি করছেন, তখন কয়েকজনের খেয়াল হল যে, প্রাক্তন মহারাজের ছোট রানি মনোমোহিনীর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।

রাজার মৃত্যু হলে রানিদেরও সুখের দিন অস্তমিত হয়। ভূতপূর্ব মহারাজ বীরেন্দ্রকিশোর মাণিক্যের শেষ জীবনে প্রিয়তমা মহিষী ছিলেন মনোমোহিনী, এঁর গর্ভে মহারাজের পাঁচটি পুত্র-কন্যা জন্মেছে। নতুন রাজা বাধাকিশোরের সঙ্গে মনোমোহিনীর সম্পর্ক তেমন ভাল নয়, পারতপক্ষে তিনি এর সঙ্গে বাক্যালাপ করেন না। তবু তিনি যখন শুনলেন মনোমোহিনী ও তাঁর সন্তানদের জীবিত বা মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়নি, তখন তিনি সেপাই সান্ত্রীদের হুকুম দিলেন যেভাবেই হোক ওদের খুঁজে বার করতে হবে। ইট-কাঠ-পাথর সরাতে সরাতে এক সময় শোনা গেল একাধিক শিশুকণ্ঠের কান্না। উদ্ধার প্রচেষ্টা আরও ত্বরান্বিত করার পর দেখা গেল এক আশ্চর্য দৃশ্য।

সমগ্র প্রাসাদটি প্রায় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেলেও দু-একটি কক্ষ যেন দৈববলে অক্ষত আছে। সেই রকম একটি কক্ষে মনোমোহিনী তাঁর ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বসে আছেন, এত বড় একটি কাণ্ড ঘটে যাওয়ার পরেও তাঁর মুখে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। উদ্ধারকারীদের একজন একটি ক্রন্দনরত শিশুকে কোলে তুলে নেবার চেষ্টা করতেই মনোমোহিনী ধমক দিয়ে বলে উঠলেন, খবরদার, ওদের গায়ে কেউ হাত ছোঁয়াবে না। আমরা এখানেই থাকব।

উদ্ধারকারীদের শত অনুরোধেও কর্ণপাত করলেন না মনোমোহিনী, তিনি কিছুতেই বেরিয়ে আসতে চান না। এতো বড় অদ্ভুত কথা। ওরকম ধ্বংসস্তুপের মধ্যে তিনি থাকবেন কী করে!

এ সংবাদ পেয়ে স্বয়ং রাধাকিশোর ছুটে এলেন। মনোমোহিনী মণিপুরের মেয়ে। তাঁর উদ্ধার ব্যবস্থায় কোনও ত্রুটির কথা জানাজানি হলে এ রাজ্যের মণিপুরিরা ক্ষেপে যাবে। তা ছাড়া রাধাকিশোর কারুর সঙ্গেই পূর্বতন মনোমালিন্য বজায় রাখতে চান না। রাজাকে সকলের প্রতিই সমদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হয়।

মনোমোহিনী রাজা রাধাকিশোরের চেয়ে বয়েসে অনেক ছোট। পাঁচটি পুত্র কন্যার জননী হলেও তাঁকে এখনও সদা যুবতীর মতনই দেখায়। তবু রাধাকিশোর হাতজোড় করে মনোমোহিনীকে জননী সম্বোধন করলেন। মিনতিপূর্ণ স্বরে বললেন, মা তুমি এখানে থাকতে চাও কেন? যে-কোনও মুহূর্তে এ কক্ষের দেওয়াল ভেঙে পড়তে পারে। নয়া হাভেলিতে আমি আস্তানা বানাচ্ছি। এখানে যে-কটি বাড়ি অক্ষত আছে সেগুলিতে রানিরা আপাতত থাকবেন, আমার গর্ভধারিণীও রয়েছেন, আপনিও চলুন।

সন্তানদের আগলে ঠিক যেন একটি বাঘিনীর মতন ঘরের এককোণে বসে আছেন মনোমোহিনী। জ্বলজ্বল করছে চোখ দুটি। তেজের সঙ্গে বলে উঠলেন, আমি মরিনি। আমার সন্তানদেরও কেউ মারতে পারবে না।

রাধাকিশোর চমকিত হয়ে বললেন, পরম করুণাময় ঈশ্বর আপনাদের রক্ষা করেছেন। আপনার সন্তান, ওরা আমার ভ্রাতা-ভগিনী, ওদের কে ক্ষতি করবে?

মনোমোহিনী ওপরে ঘরের ছাদের দিকে চেয়ে বললেন, আমার স্বামী, দেবতার মতো আমার পতি, তিনি স্বর্গ থেকে আমাদের রক্ষা করেছেন। চতুর্দিকে সব ভেঙে পড়ল, আমি মনে মনে শুধু তাঁকে ডেকেছি, তাই এই ঘরের কোনও ক্ষতি হয়নি। আমি এই ঘর ছেড়ে কোথাও যাব না। তুমি নতুন রাজপ্রাসাদ বানাও, সেখানে রাজত্ব করো গে! আমি আমার স্বামীর প্রাসাদেই থাকব।

শত অনুরোধ-উপরোধেও মনোমোহিনীকে টলানো গেল না। রাধাকিশোর ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলেন। তক্ষুনি রাজমিস্তিরি লাগানো হল সেই অংশটি মেরামত করার জন্য।

কুচবিহার রাজ্যের ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে প্রচুর। তবে সেখানকার রাজপ্রাসাদটি অনেকখানি রক্ষা পেয়েছে। মহারানি সুনীতি দেবী আর্তদের সেবা ও ক্ষতিপূরণের জন্য উদার হস্তে অর্থব্যয় করতে লাগলেন।

নাটোরে ঠাকুরবাড়ির দলবল কয়েকদিন আটকে থাকার পর কিছুটা ঝুকি নিয়েই একটি ট্রেনে চেপে বসল। পথের বিপদ এখনও কাটেনি, তবু পরীক্ষামূলকভাবেই ট্রেনটি ছাড়া হয়েছে। কলকাতার প্রিয়জনদের জন্য সবাই উদ্বিগ্ন, যদিও এর মধ্যে একটা তার এসেছে জোড়াসাঁকোর বাড়ি থেকে। কিন্তু টেলিগ্রাম-চিঠিতে বড় কোনও দুঃসংবাদ জানানো হয় না।

স্নেহ নিম্নগামী। মা নেই, বাবা, ভাই-বোন, এমনকী নিজের স্ত্রীর চেয়েও রবির বেশি দুশ্চিন্তা হচ্ছে ছেলে-মেয়েদের জন্য। দুরন্ত সব শিশু, ওদের কিছু হয়নি তো? ট্রেন যখন শিয়ালদা স্টেশন পৌঁছল, তখন দেখা গেল বহু লোক সেখানে উদ্বিগ্নভাবে অপেক্ষা করছে, ট্রেনের যাত্রীদের কাছ থেকে তারা দূরের জেলাগুলির অবস্থা জানতে চায়।

সত্যেন্দ্রনাথের জন্য একটি গাড়ি এসেছে। তিনি রবিকে বললেন, তুইও আমার সঙ্গে চল। বালিগঞ্জের বাড়িতে গেলেই সব খবর পাওয়া যাবে, তুই ওখানে বিশ্রাম নিয়ে নিবি।

সার্কুলার রোডে বিবি রয়েছে অধীর অপেক্ষায়। নাটোর থেকে তাকে চিঠি লেখারও সময় পাওয়া যায়নি। রবি তার সঙ্গে গিয়ে প্রথম দেখা না করলে তার খুব অভিমান হবে।

একটু দ্বিধা করেও রবি মেজদাদাকে বলল, না, আপনারা বরং এগিয়ে যান। আমি একটা ভাড়া গাড়ি নিয়ে আগে জোড়াসাঁকো যাচ্ছি।

পথে যেতে যেতে চোখে পড়ে বহু পরিচিত বাড়ির ভগ্নদশা।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িটি আঘাতপ্রাপ্ত হলেও ক্ষতির পরিমাণ তেমন সাংঘাতিক কিছু নয়। দেয়াল জুড়ে বড় বড় ফাটল, গুঁড়ো গুঁড়ো হয়েছে কার্নিশ, একদিকের বারান্দার রেলিং হেলে পড়েছে, কয়েকটি ঘরের সিলিং থেকে টালি খসে পড়ে আহত হয়েছে কয়েকজন।

রবির গাড়ি থামতেই রথী দৌড়ে এসে খবর দিল, মায়ের মাথায় লেগেছে, ওপর থেকে টালি পড়ে মাথা কেটে গেছে, কত রক্ত বেরিয়েছিল—

একতলার একটি ঘরে শুইয়ে রাখা হয়েছে মৃণালিনীকে। মাথায় ব্যান্ডেজ। রবি দ্রুত পায়ে সেখানে গিয়ে স্ত্রীর দিকে দু’ এক পলক তাকিয়েই কোলে তুলে নিলেন কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রকে।

এদিককার ভূমিকম্পের বেশ কাটতে না কাটতেই পশ্চিম ভারত থেকে এল এক নিদারুণ চমকপ্রদ সংবাদ।

দুর্ভিক্ষপীড়িত মহারাষ্ট্রে গত বছর থেকেই শুরু হয়েছিল প্লেগ। এর মধ্যে তা মহামারীর আকার ধারণ করেছে। গত এক বছরে, সরকারি হিসেবেই এই রোগে কবলিত হয়ে প্রাণ হারিয়েছে পঞ্চাশ হাজার মানুষ। এই রোগ দমন করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে সেখানকার প্রাদেশিক সরকার। এবং প্লেগ দমনের নামে সরকার যে-সব কাণ্ডকারখানা শুরু করেছে, তাতে অনেকের মনে হচ্ছে এই সরকারি অত্যাচার সহ্য করার চেয়ে প্লেগ রোগে মৃত্যুবরণ করাও সম্মানজনক।

রোগের বিস্তার রোধ করার জন্য সরকার প্রয়াস নেবে, এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু কলেরা-বসন্তেও কম লোক মারা যায় না। এত জনবহুল দেশে এক-একবার দুর্ভিক্ষেও পঞ্চাশ হাজারের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হয়, কিন্তু সে সব সময় তো সরকারের এত তৎপরতা দেখা যায় না। এ দেশের মানুষ মরলে বিদেশি শাসকদের তা নিয়ে বেশি মাথা ব্যথা থাকবে কেন?

কিন্তু প্লেগ রোগ সাদা মানুষ আর কালো মানুষে কোনও ভেদাভেদ করে না। এই রোগ শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে যেতে পারে যে-কোনও সময়ে। মধ্যযুগে ইউরোপে প্লেগের তাণ্ডবের ইতিহাস সাহেবরা জানে। তাই প্লেগ নামটা শুনলেই তাদের আতঙ্ক হয়। সুতরাং ইংরেজ সরকার প্লেগ নিবারণের জন্য উঠেপড়ে লাগল আত্মরক্ষার কারণে।

এ কথা ঠিক, ভারতীয়রা, বিশেষত দরিদ্র ভারতীয়রা বড়ই নোংরা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করে। পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে তাদের সচেতনতা নেই। আবর্জনার স্তুপের পাশে বসে তারা অনায়াসে খাবার খেতে পারে, দুর্গন্ধ যেন তাদের নাকে লাগে না। এবং এ কথাও ঠিক, নোংরা-আবর্জনার মধ্যেই প্লেগের বীজাণু হু হু করে বেড়ে যায়।

সরকার প্লেগ দমনের জন্য সামরিক বাহিনী নামিয়ে দিল। তারা মহল্লায় মহল্লায় হানা দিয়ে প্রত্যেক বাড়িতে ঢুকে ভাঙচুর করতে লাগল। ধনী-নির্ধন, উঁচু-নিচু জাতের পরোয়া করে না তারা, পায়ে বুট জুতো পরা, কোমরে ঝোলানো তলোয়ার কিংবা পিঠে বন্দুক, যমদুতের মতন চেহারার এক-একটি গোরা সৈন্য সরাসরি ঢুকে পড়ে অন্দরমহলে, লাথি মেরে খাট-বিছানা উলটে দেয়, ভাতের হাঁড়ি, জলের কলসি, চাল-গমের জালা চূর্ণ বিচূর্ণ করে। ভীত-সন্ত্রস্ত নারী-পুরুষদের অস্ত্রের গুঁতোয় লাইন করে দাঁড় করায় উঠোনে, তাদের নোংরা বস্ত্র ছোঁবে না বলে সবাইকে উদোম হতে বলে। কারুর সামান্য জ্বর বা শরীর খারাপ দেখলেই তাকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যাম্পে।

ইংরেজরা ভারতীয়দের সমশ্রেণীর মানুষ বলেই গণ্য করে না। সুতরাং তাদের মান-সম্ভ্রম, ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনও মূল্যই নেই তাদের কাছে। গোরা সৈন্যরা এ দেশের লোকদের ধর্মবোধ, সংস্কার, প্রথারও তোয়াক্কা করে না, এমনকী নারীদের আব্রু রক্ষার জন্য আকুল মিনতিও তারা কানে তোলে না। অন্তঃপুরের নারীদের হাত ধরে তারা টানাটানি করে তো বটেই, অনেক সময় পুরুষদের পাশাপাশি তাদেরও উলঙ্গ অবস্থায় দাঁড় করিয়ে দেয়। নারীদের ওপর অত্যাচারের আরও অনেকরকম বীভৎস কাহিনী শোনা যেতে লাগল। একটা ত্রাহি ত্রাহি রব উঠে গেল চতুর্দিকে।

বালগঙ্গাধর তিলক তার ‘মারাঠা’ ও ‘কেশরী’ পত্রিকায় প্লেগ দমনের নামে ইংরেজ সৈন্যদের অত্যাচারের তীব্র প্রতিবাদ জানাতে লাগলেন। তিনি নিজে স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে নানান ঘিঞ্জি এলাকায় সাধারণ মানুষকে রোগ প্রতিষেধকের ব্যবস্থা বোঝাতে লাগলেন, সরকারের সাহায্য অবশ্যই কাম্য, কিন্তু এ দেশের মহামারীর সময় এ দেশের মানুষকেই সেবা ও প্রতিকারের ব্যাপারে অগ্রণী হতে হবে। সরকার যে প্লেগ কমিটি গঠন করেছে, তার সভাপতি হওয়া উচিত এ দেশেরই কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তির।

সরকার তিলকের প্রতিবাদ বা পরামর্শে কর্ণপাত করল না। অত্যাচার চলতেই লাগল। প্লেগ কমিটির চেয়ারম্যান ডব্লু সি র‍্যান্ড একজন দুঁদে অফিসার, সে সেনাবাহিনীকে বলগাছাড়া স্বাধীনতা দিয়ে দিয়েছে, অত্যাচার বেড়েই চলল। অনেক রক্ষণশীল পরিবারের মহিলাদের অঙ্গে পরপুরুষের ছোঁয়া লাগলেই কুল নষ্ট হয়, সেরকম মহিলাদের বিবস্ত্র করে বাড়ি থেকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে যায় সৈনিকেরা। প্লেগে যারা আক্রান্ত হয়নি, এমন কয়েকজন আত্মহত্যা করে বসল অপমানে, লাঞ্ছনায়। মহারাষ্ট্রের যুব সম্প্রদায় ফুঁসতে লাগল ক্রোধে।

তারপর এক রাতে ঝলসে উঠল আগ্নেয়াস্ত্র।

সেদিন মহারানি ভিক্টোরিয়ার রাজত্বের হীরক জয়ন্তী। সারাদিন ধরে উৎসব চলছে। পুণার গণেশখিণ্ডে গভর্নরের বাড়িতে রাত্রের খানাপিনার আসরে নিমন্ত্রিত হয়েছে বড় বড় কিছু অফিসার, তাদের মধ্যে র‍্যান্ডও আছে। রাত আটটা থেকে সেই গভর্নর প্যালেসের অদূরে একটা ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে বসে আছে চারজন যুবক। এদের মধ্যে রয়েছে দামোদর ও বালকৃষ্ণ চাপেকর নামে দুই ভাই এবং রানাডে ও শাঠে নামে তাদের দুটি বন্ধু। দামোদরদের আর এক ভাই বাসুদেও দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার ধারে একটা গাছের আড়ালে। অত্যাচারী, উদ্ধত, দুর্মুখ র‍্যান্ডকে আজ ওরা চরম শাস্তি দেবে।

এই যুবকের দলটি ঝোঁকের মাথায় আসেনি। এদের পরিকল্পনা নিখুঁত। ওদের মধ্যে একজন কয়েকদিন ধরে ছায়ার মতন র‍্যান্ড সাহেবের গাড়ির পেছন পেছন ঘুরে তার গতিবিধি লক্ষ করেছে। ঘোড়ার গাড়িটির রং, তার চালককে চিনে রেখেছে, অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করেছে প্রচুর, পিস্তল ও তলোয়ার, দু রকমই রেখেছে সঙ্গে।

রাত বারোটার পর গভর্নরের বাড়ি থেকে অতিথিরা নির্গত হতে লাগল। একটার পর একটা গাড়ি চলে যাচ্ছে ঝোপের পাশ দিয়ে, কথা আছে যে র‍্যান্ডের গাড়ি দেখলেই বাসুদেও একটা সঙ্কেত দেবে। অধীর উত্তেজনায় ছটফট করছে ওরা, হঠাৎ একটা গাড়ি দেখে মনে হল ঠিক র‍্যান্ডের গাড়ির মতন। অথচ বাসুদেও কোনও সঙ্কেত দেয়নি। চাপেকরদের মধ্যম ভ্রাতা বালকৃষ্ণ আর ধৈর্য রাখতে পারল না, সে লাফিয়ে গিয়ে গাড়িটার পেছনে উঠে ভেতরে গুলি চালাল।

সে গাড়িতে র‍্যান্ড ছিল না, ছিল লেফটেনান্ট আয়ার্স্ট ও তার পত্নী। বালকৃষ্ণের পিস্তলের গুলিতে আয়ার্স্ট তৎক্ষণাৎ মারা গেল, তার পত্নীর আর্ত চিৎকার বুঝতে না পেরে কোচোয়ান আরও জোরে ছুটিয়ে দিল গাড়ি। কাজ সম্পন্ন হয়েছে ভেবে হাসিমুখে বালকৃষ্ণ ফিরে আসছে, এমন সময় দূর থেকে শোনা গেল বাসুদেওর সঙ্কেত ধ্বনি। ঠিক ওইরকম আর একটি গাড়ি আসছে। ভাইকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বাঘের মতন ঝাঁপিয়ে পড়ল দামোদর, গাড়ির পেছনের পর্দা সরিয়ে পিস্তলটা একেবারে র‍্যান্ডের ঘাড়ে ঠেকিয়ে ট্রিগার টিপল অকম্পিত হাতে। র‍্যাণ্ড কোনওরকম বাধা দেবার সময়ই পেল না।

আরও অনেকগুলি গাড়ি এসে পড়ে হই-হল্লা, আর্তনাদ ও খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেলেও ধরা পড়ল না কেউ। এর মধ্যে আততায়ীরা উধাও হয়ে গেছে।

সংবাদপত্রে এই চাঞ্চল্যকর বিবরণ পাঠ করে সারা ভারত স্তম্ভিত। ব্রিটিশ ভারতে এই প্রথম রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড! র‍্যান্ড ও আয়ার্স্টের মতন দু’জন উচ্চপদস্থ অফিসারকে খুন করার স্পর্ধা দেখিয়েছে দুর্বল ভারতবাসী? স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, বেশ কয়েকজন মিলে কিছুদিন ধরে ষড়যন্ত্র করেছে এবং তারা পলায়ন পথের কোনও চিহ্ন রেখে যায়নি। সমগ্র মহারাষ্ট্র জুড়ে তোলপাড় করেও তাদের ধরা গেল না। কুড়ি হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হল তাদের সম্পর্কে খবরাখবরের জন্য।

হত্যাকারীদের না ধরতে পেরে পুলিশ গ্রেফতার করল তিলককে। তাঁর দুটি পত্রিকায় তীব্র উত্তেজক রচনা প্রকাশ করে তিনিই ওদের উস্কানি দিয়েছেন। এই অপরাধের তিনিই আসল হোতা। তিলক বোম্বাই সরকারের আইনসভায় একজন সম্মানিত সদস্য, তবু তাঁকে জামিন দেওয়া হল না। সাধারণ অপরাধীদের মতন তিনি কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেন।

কলকাতার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সমাজের ওপর মহলের মানুষেরা এই হত্যাকাণ্ডের তাৎপর্য ঠিক ধরতে পারলেন না। বাঙালি পত্রপত্রিকায় প্রতিবাদ রচনা কিংবা সভা-সমিতিতে জ্বলন্ত ভাষণই স্বাদেশিকতার চূড়ান্ত মনে করে, রক্তারক্তি কাণ্ড তাদের পছন্দ নয়। মহাশক্তিধর ইংরেজদের বিরুদ্ধে সামান্য অস্ত্র তুলে ধরা তো বাতুলতা। এ দেশটা কি আয়ার্ল্যান্ড হয়ে গেল নাকি? প্রায় সকলেই এই সাহেব হত্যার তীব্র নিন্দা করলেন। স্বদেশি আন্দোলনে এরকম হঠকারিতার কোনও স্থান নেই।

তবে তিলকের গ্রেফতারের সংবাদে সবাই বিচলিত। তিলক তো নিজে পিস্তল বা তলোয়ার ধরেননি, তিনি কলম ধরেছেন মাত্র। লেখনী চালাবার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়াটা কিছুতেই বরদাস্ত করা যায় না। তিলক জাতীয় কংগ্রেসের একজন বিশিষ্ট নেতা, তাঁর অপমান সকলের অপমান।

আরও সংবাদ এল যে, তিলককে পূণা থেকে বোম্বাই পাঠানো হয়েছে, সেখানে হাইকোর্টে তাঁর পক্ষ সমর্থনে কোনও উকিল ব্যারিস্টার পাওয়া যাচ্ছে না। রাজরোষের ভয়ে সবাই গুটিয়ে আছে। তিলক গোপনে কলকাতায় তাঁর পুরনো বন্ধু শিশিরকুমার ও মতিলাল ঘোষের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছেন।

অমৃতবাজার পত্রিকা অফিসে এক সন্ধ্যায় মতিলাল একটা ঘরোয়া আলোচনা সভার ব্যবস্থা করলেন। আদালতে তিলকের পক্ষ সমর্থনের জন্য উপযুক্ত কৌঁসুলি দাঁড় করাতেই হবে। সারা ভারতের কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে উকিল ব্যারিস্টাররাই সংখ্যাগুরু, তাঁদের মধ্যে কারুকে পাওয়া যাবে না? মতিলাল এরই মধ্যে বোম্বাইতে বদরুদ্দিন তায়েবজির কাছে জরুরি তার পাঠিয়েছেন। আলোচনা সভায় উপস্থিতদের মধ্য থেকে সুরেন্দ্রনাথ বললেন, ইংরেজ বিচারপতির সামনে শুধু ভারতীয় ব্যারিস্টার নিয়োগ করলে কাজ হবে না, বেসরকারি ইংরেজ ব্যারিস্টার দাঁড় করাতে হবে। কলকাতা থেকে এরকম দুজন খ্যাতনামা ব্যারিস্টার পাঠালে ভাল হয়, কিন্তু এঁদের টাকার খাই খুব বেশি। সুতরাং মামলা চালাবার জন্য চাঁদা তোলা দরকার। আশুতোষ চৌধুরী, জানকীনাথ ঘোষাল, আনন্দমোহন বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ সবাই মোটা চাঁদার প্রতিশ্রুতি দিলেন তৎক্ষণাৎ। আশুতোষ চৌধুরী আফশোস করে বললেন, তারকনাথ পালিত মশাইকে আজকের সভায় আসার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলাম। তাঁর মতন দানবীর একাই অনেক টাকা দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি বলেছেন, এরকম রাজদ্রোহমূলক ব্যাপারে আমাকে জড়িয়ে না। মতিলাল বললেন, এর মধ্যে তো রাজদ্রোহের কিছু নেই। তিলক দেশের মানুষের আত্মসম্মান জাগাবার জন্য লেখনী ধারণ করেছেন, তিনি কখনও খুনে-ডাকাতদের উস্কানি দেবার কথা চিন্তাও করেন না। কোথাকার কোন এক বদমাস কী রাগে কে জানে র‍্যান্ড সাহেবের ওপর গুলি চালিয়ে দিয়েছে, তার সঙ্গে তিলকের নাম জড়িয়ে দেওয়াটা সরকারের অনুচিত-কর্ম হয়েছে।

শিশিরকুমার গুলি শব্দটার উল্লেখেই যেন শিহরিত হলেন। তিনি একেবারেই হিংসার পক্ষপাতী নন।

সুরেন্দ্রনাথ বললেন, এ রকম ঘটনায় রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষতি হবে। ইংরেজের অত্যাচার আরও বাড়বে। আইনসঙ্গত পথে, আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে আমাদের কিছু কিছু দাবি আদায় করা দরকার।

ওই পত্রিকার একজন কর্মচারী অতিথিদের জন্য চা-জলপানের ব্যবস্থা করছিলেন, তিনি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, স্যার, আমি কিছু বলতে পারি? আমি মাত্র গত কাল বোম্বাই থেকে ফিরেছি। সাহেব দু’ জনের হত্যাকারীরা এখনও ধরা পড়েনি বটে, কিন্তু সারা মহারাষ্ট্রে লোকের মুখে একটি কাহিনী চালু হয়ে গেছে। কিছুদিন আগে পুণায় এক শিবাজী উৎসবে একটা ঘটনা ঘটেছিল। তিলক ছিলেন সেদিনকার উৎসবের সভাপতি, বিভিন্ন বক্তা স্বাধীনতা বিষয়ে বলছিলেন। হঠাৎ দর্শকদের মধ্য থেকে এক ছোকরা উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, এই সব ফাঁকা বক্তৃতা দিয়ে যারা স্বাধীনতা আনতে চায়, তারা সব হিজড়ে! …দুঃখিত স্যার, আমি দুঃখিত, কথাটা উচ্চারণ করে ফেলেছি, নপুংসক, নপুংসক! তখন সভায় একটা গোলমাল শুরু হয়ে গেল, কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক ধাক্কাতে ধাক্কাতে সেই যুবকটিকে বার করে দিতে গেল। তিলক মঞ্চ থেকে তাদের নিষেধ করে ইঙ্গিতে ছেলেটিকে কাছে ডাকলেন। নিচু গলায় বললেন, ওহে, তুমি তো সবাইকে নপুংসক বলে দিলে! কিন্তু এদেশে যদি সত্যিকারের পুরুষ মানুষ কেউ থাকত, তা হলে ওই অত্যাচারী ইংরেজ অফিসাব র‍্যান্ড কি দাপটে ঘুরে বেড়াতে পারত? স্যার, এখন অনেকেই বলছে, সেই ছেলেটিই র‍্যান্ড ও অন্য সাহেবটিকে খুন করেছে। সে সাধারণ ডাকাত বা বদমাস নয়। আর তিলকেরও প্ররোচনা আছে ঠিকই।

অনেকেই আপত্তিকর শব্দ করে উঠলেন। কয়েকজন ভ্রু কুঞ্চিত করে বসে রইলেন নিঃশব্দে। তাঁদের খটকা লেগেছে। রাজনীতিতে তিলক খুবই যে উগ্রপন্থি, তাতে কারুর সন্দেহ নেই। ঘরোয়া আলোচনায় তিনি বক্তৃতার রাজনীতি সম্পর্কে অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছেন বহুবার। তিনি কি আয়ার্ল্যান্ডের পথে চলতে চান?

অনেকের কাছে ঘুরে ঘুরে আরও চাঁদা তোলার প্রস্তাব নিয়ে সভা শেষ হল। সকলে বেরিয়ে এলেন বাইরে, গাড়িতে ওঠার আগে জানকীনাথ ঘোষাল সহাস্যে আশুতোষ চৌধুরীকে বললেন, আমার মেয়ে সরলা কী কাণ্ড করেছে জানো? কাগজে র‍্যান্ড হত্যার খবর দেখে সে আনন্দে চিৎকার করে বলে উঠেছিল, বেশ হয়েছে, বেশ হয়েছে! আমার দেশের ছেলেরা সত্যিকারের মুরোদ দেখিয়েছে। ইংরেজরা এবার বুঝুক, এ দেশের ছেলেরাও অস্ত্র ধরতে জানে। সরলার ধারণা, তিলক নিশ্চিত আছেন এর পেছনে। তিলকের কারাবাসেও সে খুশি। আমায় সে বলল, বাবা, তোমরা তিলককে সাহায্য করতে যাচ্ছ কেন? মামলা চলুক, তাতে দেশের মানুষ ঘটনার প্রকৃত বিবরণ জানবে। তিলকের দীর্ঘ কারাদণ্ড হবেই, তাতে দেশের মানুষ আরও রাগে ফুঁসবে! আরও কয়েকটা র‍্যান্ড নিকেশ হবে!

আশু চৌধুরী বললেন, কী সর্বনেশে কথা। আপনার মেয়ে সম্পর্কে আমার শ্যালিকা, কিন্তু তার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে আমার ভয় হয়!

সুরেন্দ্রনাথ বললেন, ঘোষালমশাই, মেয়েকে সামলান! শুনেছি তো সে এখন ছেলে-ছোকরাদের লাঠিখেলা, তলোয়ার চালনা শেখায় উৎসাহ দিচ্ছে। এরপর কি সে তাদের হাতে পিস্তলও তুলে দেবে নাকি? এসব ছেলেমানুষি করতে করতেই বড় রকমের বিপদ ডেকে আনবে।

রবি পাশেই দাঁড়িয়ে, তিনি কোনও মন্তব্য করলেন না।

রবি গাড়ি আনেননি, তিনি আশু চৌধুরীর গাড়িতে উঠলেন। বাড়ি ফেরার পথে প্রাণখুলে করা যাবে। খুব বেশিক্ষণ রাজনীতির আলোচনা রবির ঠিক সহ্য হয় না। তিলকের তিনি অনুরক্ত, তিলককে সাহায্য করার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন ঠিকই, তারকনাথ পালিতের কাছ থেকেও চাঁদা আদায় করে ছাড়বেন, কিন্তু এখন অন্য কথা বলা যাক।

রাত নটা বেজে গেছে, অসহ্য গুমোট গরম। সবাই হা পিত্যেশ করে রয়েছে বৃষ্টির জন্য! এই রকম গ্রীষ্মের সময় সব রাস্তাতেই পচা জঞ্জালের দুর্গন্ধ নাকে আসে। অবস্থাপন্ন ব্যক্তিরা অনেকেই দার্জিলিং-এ হাওয়া বদলাতে চলে গেছেন।

আশু চৌধুরী বললেন, রবি, তোমার ‘পঞ্চভূত’ বইখানি পড়লাম। বড় সরেস ও উত্তম হয়েছে। বাংলা ভাষায় এরকম গ্রন্থ আগে কেউ লেখেনি। রবি, আমার মাঝে মাঝেই মনে হয়, কবিতার চেয়েও তোমার গদ্য রচনার হাত যেন বেশি ভাল। সেদিন খামখেয়ালী সভায় তুমি যে দুটি গল্প পাঠ করে শোনালে, একটি তো ‘মানভঞ্জন’, আর একটির নাম কী যেন?

রবি বললেন, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’

আশু চৌধুরী বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, অনবদ্য, অনবদ্য! অতিশয় রোমান্টিক, কিন্তু এমন একটা মিষ্টি এলিমেন্ট মিশিয়েছ, আউটস্ট্যান্ডিং।

রবি বললেন, এখন বেশি গদ্য লিখতেই আমার ভাল লাগছে। হাতে আসছেও বেশ।

আশু বললেন, তোমার প্রথম প্রেমিকা, কবিতা, তাকে ভুলে গেলে নাকি?

রবি হেসে বললেন, তাকে কখনও ভুলতে পারি! কবিতা যে আমার নিশ্বাস-প্রশ্বাসের মতন। যেদিন কবিতা চলে যাবে, সেদিন আর আমি বেঁচে থাকব না।

আশু বললেন, তোমার নতুন কবিতা একটা শোনাবে নাকি? তোমার তো বেশ মনে থাকে…

আশু চৌধুরীকে কবিতা শোনাবার জন্য রবি উদগ্রীব হয়ে থাকেন। ইনি যে সত্যিকারের সাহিত্য রসিক। আশু চৌধুরী তারিফ করেন বেশি, কখনও সামান্য বিরূপ সমালোচনা করলেও তাতে ঝাঁঝ থাকে না।

রবি শুরু করলেন

সে আসি কহিল, ‘প্রিয়ে, মুখ তুলে চাও।’
        দুষিয়া তাহাবে রুষিয়া কহিনু, ‘যাও!’
        সখী ওলো সখী, সত্য করিয়া বলি,
        তবু সে গেল না চলি।

দাঁড়ালো সমুখে, কহিনু তাহারে, ‘সরো’
        ধরিল দু’হাত, কহিনু, ‘আহা কী করো!’
        সখী, ওলো সখী, মিছে না কহিব তোরে
        তবু ছাড়িল না মোরে।

আশু চৌধুরী বললেন, একী, এ যে গল্পের মতন। যদিও ছন্দ মিল সবই আছে।

রবি জিজ্ঞেস করলেন, এ রকম করে লিখলে কবিতা হয় না?

আশু চৌধুরী বললেন, কেন হবে না? তুমি যা লিখবে তা-ই কবিতা হবে। সুরেশ সমাজপতি কী বলবেন জানি না, আমার এ ধরনের নতুন এক্সপেরিমেন্ট ভাল লাগে। বাকিটা শুনি।

রবি আবার শুরু করতে না করতেই আশু চৌধুরী বাইরে মুখ বাড়িয়ে বললেন, একটু থামো তো রবি। পথের অবস্থাটা দেখো, এরকম কেন? তেমন বেশি তো রাত হয়নি।

রবি কবিতায় তন্ময় হয়েছিলেন, রাস্তার দিকে লক্ষ করেননি। এখন তাকিয়ে কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হল। চিৎপুরের রাস্তায় একটাও গ্যাসের বাতি জ্বলছে না, চতুর্দিক অন্ধকারে শুনশান, কোনও মানুষ নেই। শুধু এই গাড়ির দুটি ঘোড়ার পায়ের কপ কপ আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দও নেই।

রবি বললেন, এদিকে আর কোনও গাড়িও যাচ্ছে না। এ সময় অনেক গাড়িঘোড়া চলে।

আশু চৌধুরী ওপরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, রমজান মিঞা, রাস্তা এমন ফাঁকা কেন।

কোচোয়ান বলল, কিছুই তো বুঝতে পারছি না হুজুর।

তক্ষুনি পাশের গলি থেকে একদল লোক হই হই করে বেরিয়ে ছুটে গেল বিপরীত দিকে। তাদের চিৎকার কেমন যেন হিংস্র ধরনের।

আশু চৌধুরী বললেন, ব্যাপার ভাল ঠেকছে না। রমজান, তুমি জোরসে চালাও।

কোনও বাধা বিঘ্ন ছাড়াই জোড়াসাঁকোতে রবিকে নামিয়ে দিয়ে আশু চৌধুরী চলে গেলেন নিজের গৃহের দিকে।

ওপরে এসে রবি পোশাক পরিবর্তন করতে না করতেই শুনতে পেলেন, তাঁদের বাড়ির সামনে এবং অদূরে বড় রাস্তায় কীসের যেন হুড়োহুড়ি পরে গেছে, বহু লোক একসঙ্গে উত্তেজিতভাবে চ্যাঁচামেচি করছে।

রবি বারান্দায় বেরিয়ে এসে দাঁড়ালেন। একজন দারোয়ান বলল, কত্তাবাবু, দরজা-জানলা সব বন্ধ করে দিন। মোছলমান ব্যাটারা ধেয়ে আসছে, তারা সব হিন্দুর মন্দির ভাঙবে, হিন্দুদের বাড়ি আগুনে পোড়াবে!

রবি দু তিনবার জিজ্ঞেস করলেন, কারা আসছে? কারা আসছে?

উত্তর পেয়েও তিনি কিছু বুঝতে পারলেন না। মুসলমানরা আক্রমণ করতে আসবে কেন? হঠাৎ কী ঘটল? এ পল্লীতে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি থাকে, নাখোদা মসজিদ বেশি দূরে নয়, জীবিকা সূত্রেও অনেক মুসলমানের বাস, কখনও তো কোনও অশান্তি হয়নি।

দেখতে দেখতে বহু লোক জড়ো হয়ে গেল। সবাই মুসলমানদের আক্রমণের আশঙ্কায় সশস্ত্র হচ্ছে। ঠাকুর বাড়ির দারোয়ান-চাকর-কোচোয়ান-ভিস্তিওয়ালা সবাই লাঠি-সোঁটা-তলোয়ার নিয়ে টহল দিতে লাগল, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন মুসলমানও আছে, তারাও আক্রমণকারী মুসলমানদের রুখবার জন্য প্রস্তুত। অনেক দূরে বহু লোকের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে ঠিকই, দুমদাম গুলির শব্দও স্পষ্ট বোঝা যায়।

রবি ভাবলেন, লোকে কি ভুল করে মুসলমানদের কথা বলছে? নাকি, পুণার হত্যাকাণ্ডের প্রভাবে এখানেও ইংরেজদের ওপর আক্রমণ শুরু হয়ে গেল? গুলি চালাচ্ছে কারা?

সারা রাত আশঙ্কা ও প্রহরায় কেটে গেল, কিন্তু আক্রমণকারীরা এতদূর এল না। সকাল থেকে গুজবে কান পাতা দায়। তার থেকে আসল সত্যটা কোনও রকমে বার করা গেল, শহরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে, সত্যিই। দিনের বেলাও কেউ বাড়ি থেকে এক পা বেরুতে সাহস করল না, মাঝে মাঝেই গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে, গোরা সৈনিকরা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে ঘোড়া ছুটিয়ে। এই কিছুদিন আগে ভূমিকম্প হয়ে গেল, তারপর আবার দাঙ্গা? হা ভগবান!

গুজব সৃষ্টিকারীরা রটনা করছে যে শত শত হিন্দুর বাড়ি এর মধ্যে ভস্মসাৎ হয়ে গেছে, বহু হিন্দুর প্রাণ গেছে, তাদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা অনেক ইত্যাদি। প্রকৃত ঘটনা অবশ্য তা নয়। দাঙ্গার উৎপত্তির কারণটিও সামান্য।

টালা অঞ্চলে মহারাজ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের কয়েক বিঘে জমির একটা সম্পত্তি আছে। কিছু গরিব মুসলমান সেখানে বস্তি বানিয়ে আছে অনেক দিন ধরে। যতীন্দ্রমোহন এখন সেই জমিতে দালান কোঠা তুলতে চান, কিন্তু বস্তিবাসীরা বলেছে তারা এতকাল ভাড়া দিয়ে এসেছে, তারা উঠে যেতে বাধ্য নয়। মহারাজের পক্ষ থেকে ওদের উচ্ছেদ করার জন্য হাইকোর্টে মামলা করা হল, এবং যতীন্দ্রমোহন আদালত থেকে ডিক্রিও পেয়ে গেলেন। মামলা চলার সময় বস্তিবাসীদের উকিল একটা বুদ্ধি বার করেছিল। রাতারাতি ওই বস্তির মধ্যে একটা মসজিদ বানিয়ে ফেললে সেটা ধর্মস্থান হয়ে গেল, তখন আর সেটা কেউ ভাঙতে পারবে না। রাতারাতি পাকা মসজিদ তোলা সব নয়, তাই একটা কুঁড়ে ঘরকেই মসজিদ বলে ঘোষণা করে দিয়ে সেখানে নামাজ পড়তে শুরু করে দিল মুসলমানেরা। কিন্তু আদালতের ডিক্রি বলে মহারাজ যতীন্দ্রমোহনের লোকজন পুলিশ সঙ্গে নিয়ে এসে বস্তিবাড়ি সব ভেঙে দিল, মসজিদ নামাঙ্কিত কুঁড়ে ঘরটিকেও রেয়াত করল না।

অমনি একদল লোক রটিয়ে দিল যে হিন্দুরা মুসলমানদের একটা মসজিদ ভেঙে দিয়েছে, মুসলমানের ধর্ম বিপন্ন। কাছাকাছি অঞ্চলের মুসলমানরা ছুটে এল, সেখানে সত্যিকারের কোনও মসজিদ ছিল কি না তা সরেজমিনে কেউ দেখল না। ধর্ম বিপন্ন এটুকু শোনাই উত্তেজিত হবার পক্ষে যথেষ্ট। ধর্ম বিপন্ন হলে প্রাণ বিপন্ন করতেও দ্বিধা নেই।

শুরু হল ভাঙচুর, একদল মুসলমান টালার বিশাল জলের ট্যাঙ্ক আক্রমণ করতে এলে পুলিশ গুলি চালাল, পড়ে গেল দু’ চারটে লাশ। এতে উত্তেজনার ওপর আবার ক্রোধের ইন্ধন জোগানো হল। আরও বহু মুসলমান এসে জড়ো হল সেখানে, দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল উত্তর কলকাতা থেকে হ্যারিসন রোড পর্যন্ত।

দু’দিনের বেশি অবশ্য এই দাঙ্গা প্রশ্রয় পেল না। সরকার প্রথম থেকেই কঠোরভাবে দমন করবার জন্য ফোর্ট উইলিয়াম থেকে এক রেজিমেন্ট সৈন্য নামিয়ে দিল পথে। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে দাঙ্গাকারীদের দেখামাত্র গুলি করা হবে, এই ঘোষণা করে দেওয়া হল এবং সত্যি সত্যি গুলি চলল কয়েকবার। শেষ পর্যন্ত সরকারি হিসেব মতন, নিহতের সংখ্যা এগারো জন, আর কুড়ি জন গুরুতর আহত, সম্পত্তি ক্ষয়ক্ষতির এখনও পূর্ণ তালিকা হয়নি।

দাঙ্গা থামল বটে, কিন্তু অনেকের মনে তা একটা স্থায়ী দাগ রেখে গেল। ভাবলেই মন খারাপ লাগে। এত সামান্য কারণে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক বিষিয়ে তোলা যায়? আদালতের আদেশে একটা নকল মসজিদ ভাঙলেও তার প্রতিশোধ হিসেবে হিন্দু মন্দির ভাঙার প্ররোচনা কারা দেয়? হিন্দু ও মুসলমান এতকাল ধরে মিলে মিশে কাজ কারবার চালাচ্ছে, একটা তুচ্ছ গুজব শুনলেই তারা পরস্পবের দিকে সান্দেহেব নেত্রে তাকাবে? যে-এগারো জনের প্রাণ গেল, তারা কীসের জন্য প্রাণ দিল?

লোকের মুখে এখন খালি দুর্ভিক্ষের কথা, দাঙ্গার কথা, প্লেগের কথা, ভূমিকম্পের কথা। কে কোথায় কী দেখেছে, তার বাস্তব বা কাল্পনিক বর্ণনা। পুণা হত্যাকাণ্ডের সেই অপরাধীরা কি ধরা পড়ল? তারা কি কলকাতায় এসে লুকিয়ে আছে?

কিন্তু মানুষ প্রতিনিয়ত সমস্যার কথা শুনতে চায় না। আপদ-বিপদ যেমন আছে, তেমন কি আনন্দও নেই, ফুর্তি নেই? গান বাজনা বন্ধ হয়ে যাবে? ধনী ও অভিজাতরা এই সব সমস্যাও বেশিদিন গায়ে মাখে না। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে এখন প্রায়ই একটা খামখেয়ালী সভা বসে। এক একবার এক একজন এই সভার সব ব্যয়বহন করেন। বন্ধু বান্ধব ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আমন্ত্রিত হয়ে আসেন, সাহিত্যপাঠ, সঙ্গীত, কৌতুক ও নানারকম উপাদেয় দ্রব্যের ভূরিভোজন হয়।

দাঙ্গা-টাঙ্গা চুকে যাবার কিছুদিন পরেই রবির খুড়তুতো ভাইপো সমরেন্দ্রনাথ খামখেয়ালী সভার একটা আসর বসাতে চাইলেন। প্রতিটি সভারই পরিকল্পনা করে দেন রবি। এবারে তিনি একটু খুঁতখুঁত করতে লাগলেন। শহরের যা অবস্থা, নিমন্ত্রিতরা এসে যদি ওই দাঙ্গা-ভূমিকম্প নিয়েই কথা বলতে শুরু করে, তা হলে আনন্দটাই মাঠে মারা যাবে।

সমরেন্দ্রনাথের ছোটভাই অবনীন্দ্র রবিকে সমর্থন করে বলে উঠল, না, না ওসব চলবে না। রবিকা, তুমি সবাইকে বারণ করে দিয়ো।

রবি বললেন, আয় তবে আমন্ত্রণ পত্ৰটা আমি লিখে দিই। তাতেই বরং নির্দেশ নামা থাকবে।

রবি লিখলেন, শুন সভ্যগণ যে যেখানে থাকো

সভা খামখেয়াল, স্থান জোড়াসাঁকো;         
বার রবিবার, রাত সাড়ে সাত
নিমন্ত্রণকর্তা সমরেন্দ্রনাথ।
তিনটি বিষয় যত্নে পরিহার্য
দাঙ্গা, ভূমিকম্প, পুণা হত্যাকার্য।
এই অনুরোধ রেখে খামখেয়ালী
সভাস্থলে এসো ঠিক Punctually।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *