০৩. শুক্লযজুর্বেদ – তৃতীয় অধ্যায়

তৃতীয় অধ্যায়

 মন্ত্রঃ– সমিধাগ্নিং দুবস্যত ঘৃতৈর্বোধয়তাতিথি। আস্মিন্ হব্যা জুহোতন৷৷৷৷৷ সুসমিদ্ধায় শশাচিষে ঘৃতং তীব্রং জুহোতেন। অগ্নেয় জাতবেদসে৷৷২৷৷ তং বা সমিদ্ভিরঙ্গিবো ঘৃতেন বধয়ামসি। বৃহচ্ছোচা যবিষ্ঠ্য৷৷৩৷৷ উপ ত্বাগ্নেহবিষ্মতীঘৃতাচীর্যন্তু হত। জুষস্ব সমিধো মম।৪৷ ভূর্ভুবঃ স্ব দৌরিব ভূয়া পৃথিবীব বরিগ্ন। তস্যাস্তে পৃথিবি দেব্যজনি পৃষ্ঠেইগ্নিমন্নাদমন্নাদ্যায়াদধে।৫৷৷ আয়ং গৌঃ পৃশ্নিরক্রমীদসদ মাতরং পুরঃ। পিতরং চ প্রযন্তস্বঃ।।৬৷ অন্তশ্চরতি বোচনাস্য প্রাণাদপানতী। ব্যখান মহিষো দিব৷৷৷৷ ত্রিংশদ্ধাম বিরাজতি বা পতঙ্গায় ধীয়তে। প্রতি বস্তার দ্যুভিঃ।৮। অগ্নিৰ্জোতিজ্যোতিরগ্নিঃ স্বাহা। সূর্যোজ্যোতি জ্যোতিঃ সূর্যঃ স্বাহা। অগ্নিৰ্বৰ্চ্চো জ্যোতির্বর্চঃ স্বাহা। সূর্যো বর্চো জ্যোতির্বর্চঃ স্বাহা। জ্যোতিঃ সূর্যো সূর্যঃ জ্যোতিঃ স্বাহা।৯। সজুদেবেন সবিত্রা সজু রাবেত্যা। জুষাণো অগ্নিবেতু স্বাহা। সজুর্দেবেন সবিত্রা সজুরূষসেন্দ্রবত্যা। জুষাণঃ সূর্যো বেতু স্বাহা।১০৷ উপপ্রযন্তো অধ্বরং মন্ত্রং বোচেমাগ্নয়ে। আরে অস্মে চ শৃন্বতে৷৷১১। অগ্নিমূর্ধা দিবঃ ককুৎপতিঃ পৃথিব্যা অয়। অপাং রেংসি জিতি৷১২৷৷ উভা বামিন্দ্রাগ্নী আহুধ্যা উভা রাধসঃ সহ মাদয়ধ্যৈ। উভা দাতারাবিষাং রয়ীণামুভা বাজস্য সাতয়ে হুবে বাম্৷১৩৷ অয়ং তে যযানিঋত্বিয়ো যতো জাতো অরোচথাঃ। তং জান্নগ্ন আরোহাথা নো বৰ্থয়া রয়িম্।১৪৷৷ অয়মিহ প্রথমো ধায়ি ধাতৃভিহোতা যজিষ্ঠো অধ্বরেদ্বীড্যঃ। যমপ্নবানো ভৃগবো বিরুরুচূর্বনেষু চিত্রং বিং বিশেবিশে৷১৫৷৷ অস্য প্রত্মামনু দ্যুতং শুক্রং দুদুহে অহয়ঃ। পয়ঃ সহস্রসামৃষি৷৷১৬৷ তনূপা অগ্নেহসি তন্বং মে। পাহ্যায়ুদা অগ্নেহস্যয়ুর্মে দেহি বৰ্চোদা অগ্নেহসি বৰ্চো মে দেহি। অগ্নে যন্মে তন্বা ঊনং তম আপৃণ৷৷১৭৷৷ ইন্ধানাস্থা শতং হিমা দ্যুমন্তং সমিধী মহি। বয়স্কন্তো বয়স্কৃতং সহস্বন্তঃ সহস্কৃতম্। অগ্নে সপত্নদম্ভনমদাসো অদাভ্য। চিত্রাবসসা স্বস্তি তে পারমশীয়৷৷১৮৷৷ সং ত্বমগ্নে সূর্যস্য বৰ্চসাগথাঃ সমৃষীণাং স্তুতেন। সং প্রিয়েণ ধাম্না সমহমায়ুসং বচসা সং প্রজয়া সং রায়ম্পোষেণ গ্মিষীয়৷১৯৷৷ অন্ধ স্থান্ধো বো ভক্ষীয় মহ স্থ মহো বো ভক্ষীয়োর্জ স্থাৰ্জং বো ভক্ষীয় রায়ম্পোষ স্থ রায়ম্পোষং বো ভক্ষীয়৷৷২০৷ রেবতী রমধ্বমস্মিন্যোনাবস্মিন গোষ্ঠেহস্মিল্লোকেহস্মিন। ক্ষয়ে। ইহৈব স্ত মাপগাত৷৷২১৷৷ সংহিতাসি বিশ্বরূপূর্জা মাবিশ গৌপত্যেন। উপ স্বাগ্নে দিবেদিবে দোষাবস্তর্ধিয়া বয়ম্। নমো ভরন্ত এমসি৷৷২২। রাজন্তমধ্বরাণাং গোপামৃতস্য দীদিবি। বর্ধমানং স্বে দমে৷৷২৩৷৷ স নঃ পিতেব সূনবেগ্নে সূপায়নো ভব। সচম্বা নঃ স্বস্তয়ে।।২৪৷৷ অগ্নে ত্বং নো অন্তম উত ত্রাতা শিববা ভবা বরুথ্যঃ। বসুরগ্নিবসুশ্রবা অচ্ছা নক্ষি দুমত্তমং রয়িং দাঃ ॥২৫৷৷ তং ত্বা শশাচিষ্ঠ দীদিবঃ সুন্নায় নূনমীমহে সখিভ্যঃ। স নো বোধি শ্রুধী হবমুরূষ্যা ণো অঘায়তঃ সমস্মাৎ৷৷২৬৷ ইড় এহ্যদিত এহি কাম্যা এত। ময়ি বঃ কামধরণং ভূয়াৎ৷৷২৭৷৷ সোমানং স্বরণংকৃণুহি ব্ৰহ্মণস্পতে। কক্ষীবন্তংব। ঔশিজঃ৷৷২৮৷৷ যো রেবানো অমীব বসুবিৎ পুষ্টিবর্ধনঃ। সনঃ সিষত্রু যস্তুরঃ।২৯৷৷ মা নঃ শংসো অরুষো ধূৰ্তি প্ৰণ মর্তস্য। রক্ষা ব্ৰহ্মণস্পতে৷৩০৷৷ মহি ক্রীণামবোহস্তু দুক্ষং মিত্রস্যাৰ্যৰ্মঃ। দুরাধর্ষং বরুণস্য।৩১। নহি তেষামমা চন নাধ্বসু বারণেষু। ঈশে রিপুরঘ শংসঃ ৩২৷৷ তে হি পুত্ৰাসো অদিতেঃপ্র জীবসে মত্যায়। জ্যোতির্যচ্ছন্ত্য জস্রম্ ॥৩৩৷৷ কদাচন স্তরীরসি নেন্দ্র সশ্চসি দাশুষে। উপোপেনু মঘবন্ ভূয় ইনু তে দানং দেবস্য পৃচ্যতে৷৷৩৪৷৷ তৎসবিতুর্যরেণ্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি। ধিয়ো যো নঃ প্রচোদ্দয়াৎ ॥৩৫৷ পরিতে দুড়ভো রথোহশ্ম অশ্নোতু বিশ্বতঃ। যেন রক্ষসি দাশুষঃ।৩৬৷৷ ভূর্ভুবঃ স্বঃ সুপ্রজাঃ প্রজাভিঃ স্যাং সুবীরা বীরৈঃ সুপোষঃ পোষৈঃ। নর্ষ প্রজাং মে পাহি। শংস্য পশূন্মে পাহ্যথর্য পিতুং মে পাহি।।৩৭৷৷ আ গন্ম বিশ্ববেদসমস্মভ্যং বসুবিত্তমম্। অগ্নে সম্রাড়ভি দ্যুম্নমভি সহ আ যচ্ছ৷৷৩৮অয়মগ্নিগৃহপতিৰ্গাৰ্হপত্যঃ প্রজায়া বসুবিত্তমঃ। অগ্নে গৃহপতেহভি দুম্নমভি সহ আ যচ্ছস্ব৷৷৩৯৷৷ অয়মগ্নিঃ পুরীষ্যো রয়িমান্ পুষ্টিবর্ধনঃ। অগ্নে পুরীষ্যাভি দ্যুম্নমভি সহ আ যুচ্ছ৷৷৪০৷৷ গৃহা মা বিভীত মা বেপধমূর্জং বিভ্রত এমসি। উর্জং বিভ্রঃ সুমনাঃ সুমেধা গৃহানৈমি মনসা মোদমানঃ।।৪১। যেষামধ্বেতি প্রবসন্যে সৌমনসোবহুঃ। গৃহানুপহুয়ামহো তে নো জানন্তু জানতঃ ৪২। উপহুতা ইহ গাব উপহৃতা অজাবয়ঃ। অথথা অন্নস্য কীলাল উপহুতো গৃহেষু নঃ। ক্ষেমায় বঃ শান্ত্যৈ পদ্যে শিবংশগ্মং শংযোঃ ॥৪৩ প্রঘাসিনো হবামহে মরুতশ্চ রিশাদসঃ। করম্ভেণ সজোষসঃ॥৪৪৷ যদগ্রামে যদরণ্যে যৎ সভায়াং যদিন্দ্রিয়ে। যদেনশ্চমা বয়মিদং তদধযজামহে স্বাহা।।৪৫৷ মো যুণ ইন্দ্রাত্র পৃৎসু দেবৈরস্তি হি আ তে শুষ্মিন্নবয়াঃ। মহশ্চিদ্যস্য মীচুষো যব্যা হবিষ্মতো মরুততা বন্দতে গী।৪৬। অক্রকর্ম কর্মকৃতঃ সহ বাঁচা ময়োভুবা। দেবেভ্যঃ কর্ম কৃত্বাস্তং প্রেত সচাভুবঃ৷৪৭৷ অবভৃথ নিচুম্পূণ নিচেরুরসি নিচুম্পুণঃ। অব দেবৈৰ্দেকৃত-মেনোইয়াসিষমব মমৈত্য কৃতং পুরুবেণা দেব বিষম্পাহি।৪৮। পূর্ণা দর্বি পরা পত সুপূর্ণা পুনরা পত। বম্নেব বিক্ৰীণাবহা ইষমূৰ্জং শতক্রতো৷৪৯৷ দেহি মে দদামি তে নি মে ধেহি নি তে দধে। নিহারং চ হরাসি মে নিহারং নি হরাণি তে স্বাহা।।৫০ অক্ষুণ্ণমীমদন্ত হ্যব প্রিয়া অধূষত। অন্তোষত স্বভানবো বিপ্রা  নবিষ্ঠয়া মতী যোজা দ্বিন্দ্ৰ তে হরী।৫১৷ সুসদৃশং ত্বা বয়ং মঘবন্দিী মহি। প্র নূনং পূর্ণবন্ধুরঃ স্তুতে যাসি বশ অনু যোজা ন্বিন্দ্ৰ তে হরী।৫২৷৷ মনো ৰামহে নারাশংসেন স্তোমেন। পিতৃণাং চ মন্মভিঃ।৫৩৷৷ আ ন এতু মনঃ পুনঃ ক্ৰত্বে দক্ষায় জীবমে। জ্যোক্‌ চ সূর্যং দৃশে।৫৪৷ পুনর্নঃ পিতরো মনো দদাতু দৈবব্যা জনঃ। জীবংব্রাতং সচেমহি৷৷৫৫।বয়ং সোম ব্রতে তব মনস্তষু বিভ্রতঃ প্রজাবন্তঃ সচেমহি।।৫৬৷৷ এষ তে রুদ্র ভাগঃ সহ স্বাম্বিকিয়া তং জুষস্ব স্বাহৈষ তে রুদ্র ভাগ আখুস্তে পশু।৫৭৷৷ অব রুদ্রমদীমহ্যব দেবং এ্যম্বক। যথা নো বস্যসস্কর্যথা নঃ শ্রেয়সস্করদ্যথা। নো ব্যবসায়য়াৎ।৫৮৷৷ ভেষজমসি ভেষজং গবেহশ্বায় পুরূষায় ভেষজম্। সুখং মেষায় মেষ্যৈ।৫৯৷৷ ত্র্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধ নম্। উর্বারুকমিব বন্ধনান্মাত্যোর্মুক্ষীয় মাহমৃতাৎ। ত্র্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পাতবেদন। উর্বারুকমিব বন্ধনাদিতে মূক্ষীয় মামুতঃ৷৷৬০৷৷ এতত্তে রুদ্রাবসং তেন পরো মুজতোহতীহি। অবততধম্বা পিনাকাবসঃ কৃত্তিবাসা । অহিংসন্নঃ শিবোহতীহি।৬১। এ্যায়ুষং জমদগৈঃ কশ্যপস্য ত্ৰায়ুষমূ। যদ্দেবেষু এ্যায়ুষং তন্নে অস্তু এ্যায়ুষমূ৷৬২৷ শিবো নামাসি স্বধিতিস্তে পিতা নমস্তে অস্তু মা মা হিংসীঃ। নি বর্তয়াম্যাথুষেইন্নাদ্যায় প্রজননায় রায়পোষায় সুপ্রজাস্তায় সুবীর্যায়।।৬৩৷৷

.

মন্ত্ৰার্থঃ– ১। হে চিত্তবৃত্তিনিবহ! তোমরা ভক্তিভাবের দ্বারা জ্ঞানস্বরূপ দেবতার সেবা করো। অতিথিস্বরূপ (অর্থাৎ অধুনা আগত) সেই জ্ঞানাগ্নিকে সত্ত্ববাদির দ্বারা প্রবর্ধিত করো। এমন প্রবর্ধিত জ্ঞানাগ্নিতে হবনীয় সমূহ দেব উদ্দেশে প্রদান করো (১)।

২। হে আমার চিত্তবৃত্তিনিবহ! তোমরা, সুন্দররূপে দীপ্ত অর্থাৎ প্রবর্ধিত, দীপ্তিমান, সর্বজ্ঞ (সেই) জ্ঞানস্বরূপ দেবতাকে অতিশয়রূপে শুদ্ধসত্ত্ব প্রদান করো; (অর্থাৎ, শুদ্ধসত্ত্বভাবের দ্বারা তার পূজা করো)। [সুসমিদ্ধায়–সুষ্ঠু সম্যক্ দীপ্তায়, প্রবর্ধিতায়; শোচিষে-দীপ্তিবিশিষ্টায়; জাতবেদসে-জাতপ্রজ্ঞায়, সর্বজ্ঞায়]।(১)।

৩। সর্বত্রগতিশীল হে জ্ঞানাগ্নি! সেই প্রখ্যাত আপনাকে ভক্তিভাব ইত্যাদির দ্বারা এবং শুদ্ধসত্ত্বভাবের দ্বারা আমরা (সাধকগণ) বর্ধিত করছি। প্রবর্ধিত হে জ্ঞানাগ্নি! আপনি বৃহৎ কিরণের দ্বারা আমাদের হৃদয়ে প্রদীপ্ত হোন। [অঙ্গিরঃ–হে সর্বত্রগ জ্ঞানাগ্নে! সমিদ্ভিঃ–ভক্তিভাবাদিভিঃ; ঘৃতেন–শুদ্ধসত্ত্বভাবেন চ; যবিষ্ঠ্য-যুবতম, সম্পূর্ণাবয়ব, প্রবর্ধিত হে জ্ঞানাগ্নে!; শোগ–শোচিষা, কিরণেন]।(১)।

 ৪। অভীষ্টপূরক হে জ্ঞানাগ্নি! হবনীয়বিশিষ্ট ও শুদ্ধসত্ত্বভাবযুক্ত সমিক্সপ আমার চিত্তবৃত্তিনিবহকে আপনি অনুগ্রহ করুন (তারা সৎপথাবলম্বী হোক)। [হত–অভীষ্টপূরক; হবিষ্মতীঃ–হবনীয়বিশিষ্টা; ঘৃতাচীঃ–শুদ্ধসত্ত্বভাবান্বিতাঃ সমিধ রূপা মে চিত্তবৃত্তয়ঃ] (১)।

৫। ভূলোকস্থ দেবভাবসমূহ, ভুবনলোকস্থ দেবভাবসমূহ, এবং স্বর্গস্থিত দেবভাবসমূহ আমার হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোন। [ভূঃ–ভূলোকস্থিতদেবভাবাঃ; ভূবঃভূবলোকস্থিতদেবভাবাঃ;  স্বঃস্বলোকস্থিতদেবভাবাঃ] (১)। দেবার্চনার স্থানভূত, পৃথিবীর তুল্য হে আমার চিত্তবৃত্তিঃ! তুমি আকাশের ন্যায় অনন্ত ও পৃথিবীর ন্যায় শ্রেষ্ঠ। এবষ্কৃত তোমাতে, শুদ্ধসত্ত্বভাব এবং ভক্তিরস ইত্যাদি লাভ করবার নিমিত্ত, শুদ্ধসত্ত্বভাবপোষক জ্ঞানস্বরূপ দেবতাকে সম্যক্‌রূপে স্থাপন করছি। [দেবযজনি–দেবযজনস্থানভূতে; পৃথিবি–পৃথ্বীস্বরূপে হে মম চিত্তবৃত্তে! পৃথিবীর– পৃথিবীব–অন্তরীক্ষপ্রদেশে যথানন্ততয়া বহুঃ পৃথিবী যথা সর্বেষাং আধারভূতয়া শ্রেষ্ঠা; অন্নাদ্যায় শুদ্ধসত্ত্বভক্তিরসাদীন লন্ধুং]।(২)

৬। প্রসিদ্ধ সর্বত্রগ বিচিত্রকর্মোপেত জ্ঞানসূর্য সর্বতোভাবে (সকল স্থানে) পরিক্রমণ করেন; আমাদের মাতৃস্থানীয়া এই পৃথিবীকে তিনি প্রথমেই প্রাপ্ত হন, এবং স্বর্গে সঞ্চরণ করে আমাদের পরম আশ্রয়স্থান পিতৃলোকও তিনি প্রাপ্ত হন। [গৌঃ–সর্বত্রগঃ, জ্ঞানকিরণঃ, পৃশ্নিঃ– বিচিত্র কর্মোপেতঃ, জ্ঞানজ্যোতিঃ; স্বঃ–সূর্যদেবঃ; জ্ঞানসূর্য; মাতরং–অস্মাকং উৎপত্তিভূতাং মাতৃস্থানীয়াং পৃথিবীং; পিতরং–পিতৃলোকং, অস্মাকং পরমাশ্রয়-স্থানরূপং] (১)।

৭। এই জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেবের দীপ্তি, প্রাণাপান-বায়ুর প্রযোজক হয়ে, দ্যাবাবৃথিবীর মধ্যে (শরীরের মধ্যে), বিচরণ করছে। (প্রাণব্যাপার সম্পাদন করছে); কর্মফলদাতা সেই অগ্নি, দুলাককে (স্বর্গের স্বরূপতত্ত্ব) প্রকাশ করেন। ৬ [মহিষঃ কর্মফলদাতা স জ্ঞানাগ্নি; অস্য–জ্ঞানস্বরূপস্য অগ্নেঃ] (১)

৮। সাধকগণ কর্তৃক শব্দরূপে ও গতি-রূপে (অথবা–সর্বত্রগতিশীল শব্দের মতো) ধ্যেয়, সেই ভগবান্ সকল কালে সকল স্থানে বিদ্যমান আছেন; তার জ্যোতিঃ দ্বারা প্রতি গৃহ প্রতি দিন উদ্ভাসিত হয়ে থাকে। [স ভগবান্ বাক্‌পতঙ্গায়–শব্দরূপায় গতিরূপায় চ, যদ্বা–সর্বত্রগায় শব্দরূপায়, ধীয়তে–মন্যতে সাধকৈরিতি শেষঃ; ত্রিশৎ–ত্রিংশৎসু মুহূর্তাখ্যেযু, সর্বেষু কালেষু ইতি যাবৎ; তস্য দুঃভিঃ–জ্যোতির্ভি]।(১)।

৯। যিনিই অগ্নিদেব, তিনিই দৃশ্যমান্ জ্যোতীরূপ; আবার যিনিই দৃশ্যমান্ জ্যোতিঃ, তিনিই অগ্নিদেব; স্বাহা মন্ত্রে তাকে হবিঃ প্রদান করছি; অনুষ্ঠান সুহুত (শুভ) হোক। (যঃ অগ্নিঃ–অগ্নিদেব; স এব জ্যোতিঃদৃশ্যমান্ জ্যোতিঃ-স্বরূপ; যঃ চ জ্যোতিঃ–দৃশ্যমান জ্যোতিরূপঃ; তস্মৈ স্বাহা স্বাহামন্ত্রেণ হরিদামি, সুহুতমস্তু ইতি প্রার্থনা] (১)। যিনিই সূর্যদেব, তিনিই দৃশ্যমান্ জ্যোতীরূপ; আবার যিনিই দৃশ্যমান্ জ্যোতিঃ, তিনিই সূর্যদেব; স্বাহা-মন্ত্রে তাঁকে হবিঃ প্রদান করছি। অনুষ্ঠান সুহুত (শুভ) হোক। [যঃ সূর্য–সূর্যদেব]।(২) যিনিই অগ্নিদেব, তিনিই তেজঃ; আবার যিনিই দৃশ্যমান্ জ্যোতীরূপ, তিনিই তেজঃ; স্বাহা-মন্ত্রে তাকে হবিঃ প্রদান করছি–অনুষ্ঠান সুহুত (শুভ) হোক। [বৰ্চঃ-তেজঃ] (৩)। যিনিই সূর্যদেব, তিনিই তেজঃ; আবার যিনিই দৃশ্যমান্ জ্যোতিরূপ, তিনিই তেজঃ; স্বাহা-মন্ত্রে তাকে হবিঃ প্রদান করছি–অনুষ্ঠান সুহুত (শুভ) হোক(৪)। যিনিই দৃশ্যমান্ জ্যোতীরূপ, তিনিই সূর্যদেব; আবার যিনিই সূর্যদেব, তিনিই দৃশ্যমান্ জ্যোতীরূপ; স্বাহা-মন্ত্রে তাঁকে হবিঃ প্রদান করছি-অনুষ্ঠান সুহুত (শুভ) হোক (৫)।

১০। জ্ঞানপ্রদাতা সবিতা দেবতার সাথে অগ্নিদেব প্রীত হোন; ঐশ্বর্যশালিনী রাত্রিদেবতার সাথে অগ্নিদেব প্রীত হোন; আমাদের প্রতি প্রীতিযুক্ত অগ্নিদেব আমাদের কর্মকে প্রাপ্ত হোন; স্বাহা-মন্ত্রের উচ্চারণে তাকে হবিঃ অর্পণ করছি–সুহুত (শুভ) হোক। [সবিত্রা দেবেন–জ্ঞানপ্রেরকেণ দেবেন সহ; সজুঃ–প্রীতঃ ভবতু ইতি, শেষঃ]।(১)। জ্ঞানপ্রদাতা সবিতা দেবতার সাথে সূর্যদেব প্রীত হোন; ঐশ্বর্যশালিনী উষা-দেবতার সাথে সূর্যদেব প্রীত হোন; আমাদের প্রতি প্রীতিযুক্ত অগ্নিদেব আমাদের কর্মকে প্রাপ্ত হোন; স্বাহা-মন্ত্র উচ্চারণে তাকে হবিঃ অর্পণ (পূজা) করছি–(কর্মানুষ্ঠান) সুহুত (শুভ) হোক। [উষসেন্দ্রবত্যা–ঐশ্বর্যশালিন্যা উযোদেবতয়ো সহ] (২)

১১। হিংসা-প্রত্যবায় ইত্যাদি রহিত কর্ম সম্যক্ অনুষ্ঠান করে, আমরা যখন জ্ঞানলাভের জন্য পরিত্রাণকারক মন্ত্র রূপ শব্দব্রহ্ম উচ্চারণ করি, দূরে বা নিকটে যেখানেই থাকুন, জ্ঞানস্বরূপ দেবতা তা শ্রবণ করেন। (ভাব এই যে, কর্মফল ও মন্ত্রফল অবশ্যম্ভাবী)। [অধ্বরং–হিংসাপ্রত্যবায়াদিরহিতং কর্ম; অগ্নয়ে–অগ্ন্যর্থং, জ্ঞানলাভায়; মন্ত্রং– পরিত্রাণকারকং শব্দব্রহ্ম; বোচেম–উচ্যাম]।(১)

১২। দ্যুলোকের মস্তক-স্থানীয়, ভূলোকের শ্রেষ্ঠপালক, সর্বব্যাপী সেই জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেব, আপনার করুণা-ধারা বর্ষণের কারণ পরম্পরা বৃদ্ধি করেছেন।(বহু কারণে বহু রকমে তিনি করুণা বিতরণ করে থাকেন–এটাই ভাবার্থ)। [দিবঃ মূর্ধা দ্যুলোকস্য শিরঃসমানঃ; ককুৎপতি–শ্রেষ্ঠ পালকঃ] (১)

১৩। শক্তি-জ্ঞান-প্রদায়ক হেইন্দ্রাগ্নিদেবতা। আপনাদের উভয়কে আহ্বান করতে (পূজা করতে) ইচ্ছা করেছি; আপনাদের আরাধনারূপ ধনের দ্বারা আপনাদের আনন্দিত করব–সঙ্কল্প করেছি; আপনারা উভয়ে (ইহলোকে) প্রাণশক্তিপ্রদ অন্নের এবং (পরলোকে) পরমার্থপ্রদ ধনের দাতা হন; অতএব, আপনাদের উভয়কেই, জয়দানের জন্য, আহ্বান (পূজা) করছি।[ইন্দ্রাগ্নীশক্তিজ্ঞানপ্রদায়কৌ হে দেবৌ বাজস্যজয়স্য,ইহলোকে শক্তিপ্রাণপ্রদস্য পরলোকে পরমার্থপ্ৰদস্য]।(১)

১৪। হে জ্ঞানস্বরূপ দেব! এই হৃদয় রূপ গৃহই (কর্ম প্রভাবে) দীপ্তিযুক্ত হয়ে, আপনার উৎপত্তি স্থান হয়। সেখানে হতে উৎপন্ন হয়েই, আপনি দীপ্তিমান্ হন। সেই স্থানের স্বরূপ  জেনে, আপনি আমাদের এই হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোন; এবং আমাদের পরমার্থ প্রাপ্তি রূপ ধনকে পরিবর্ধিত করুন। [অগ্নে–হে জ্ঞানস্বরূপ দেব!; ঋত্বিয়ঃকর্মপ্রভাবেন দীপ্তিযুক্তঃ সন্; যোনিঃ উৎপত্তিস্থানং; আরোহ–তগৃহং প্রাপয়, হৃদয়সিংহাসনে অধিরোহণং কুরু](১)

১৫। এই জ্ঞানস্বরূপ দেবতা, আমাদের সকল কর্মে মুখ্যস্থানীয় হোন (অর্থাৎ, আমাদের সকল কর্মেই জ্ঞানের প্রাধান্য থাকুক); আমাদের মধ্যে দেবভাবের আহ্বতা, আমাদের দ্বারা শ্রেষ্ঠকর্মের সম্পাদক, আমাদের হিংসাপ্রত্যয় ইত্যাদি রহিত সকল কর্মে সম্পূজিত, সেই দেবতা, জ্ঞানিগণ কর্তৃক চিত্তে ধৃত আছেন (অর্থাৎ, জ্ঞানিগণ জ্ঞানদেবতাকে চিরকাল হৃদয়ে ধারণ করে রেখেছেন)। বিচিত্রকর্মোপেত, অশেষশক্তিযুত, সেই জ্ঞানদেবতাকে, আত্ম-উৎকর্ষসম্পন্ন সাধকগণ (অথবা, অপ্নবান ঋষি ও ভৃগুবংশীয় ঋষিগণ), জনহিতসাধনের জন্য, হৃদয়-রূপ গৃহে দীপ্তিমান্ রেখেছেন (জ্ঞানসঞ্চয়ে জনহিত-সাধনই সাধকবর্গের একমাত্র লক্ষ্য)। [অয়ংজ্ঞানস্বরূপে দেবঃ; হোতা–আত্মাসু দেবভাবানাং আহ্বতা; অধ্বরেষু হিংসাপ্রত্যবায়শূন্যে কর্মেষু; অপ্নবানঃ-এতৎ-নামীয় ঋষি, আত্মোৎকর্ষসম্পন্নাঃ; ভৃগবঃ– ভৃগুবংশীয় ঋষয়ঃ, সাধবঃ; বিশেবিশে–জনহিতসাধনায়; বিরুরুচুঃ দীপয়ন্তি স্ম] (১)।

১৬। সেই জ্ঞানদেবতার অবিনশ্বর দীপ্তির অনুসরণ করে, পাপ-ক্লেদবিমুক্ত সর্বত্যাগী ঋষিগণ শুদ্ধসত্ত্ব রূপ অমৃতকে লাভ করেন। (জ্ঞানের অনুসরণেই সাধকেরা মোক্ষলাভে সমর্থ হন)। [অস্য–অগ্নেঃ, জ্ঞানদেবস্য; শুক্রং–শুভ্রং, সত্ত্বং, শুদ্ধসত্ত্বরূপং]। [এই মন্ত্রটির বিভিন্ন বিপরীত অর্থ প্রচারিত আছে। ভাষ্যকারই দুতিন রকম অর্থ আমনন করেছেন। মন্ত্রের অন্তর্গত অস্য পদটিতে একবার অগ্নি আরবার পবমান সোমবলে ধরা হয়েছে।(১)। হে জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেব! আপনি এই দেহের পালক হন; অতএব আপনি আমার এই দেহকে রক্ষা করুন। [অগ্নে–হে জ্ঞানস্বরূপ দেব!; তনূপা দেহস্য পালকঃ] (১)।

১৭। হে জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেব! আপনি আয়ুঃদাতা হন; অতএব, আপনি অকাল-মরণ পরিহার করে, আমায় পূর্ণ আয়ুষ্কাল প্রদান করুন।(২)। হে জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেব! আপনি তেজের (শক্তির) দাতা হন; অতএব, আমায় তেজঃ (শক্তির) প্রদান করুন। [বৰ্চোদাঃ–তেজসো দাতা]। (৩)। হে জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেব! আমার দেহের যে অঙ্গ (চক্ষুঃ ইত্যাদি) হীনবল (শক্তিরহিত), আমার সেই অঙ্গকে আপনি সর্বতোভাবে পরিপূর্ণ করুন। (আমি যেন অন্ধ খঞ্জ বধির বা কোন রকম বিকলাঙ্গ হয়ে না থাকি)।(৪)। [এই কণ্ডিকার মন্ত্র চারটির মধ্যেই অগ্নিদেবতার স্বরূপ উপলব্ধ হয়ে থাকে। প্রথমতঃ, অগ্নিকে তপাঃ অর্থাৎ দেহের রক্ষক বলা হয়েছে। সাধারণতঃ অগ্নি দেহকে ভস্মস্মাৎ করে। ভাষ্যকার বলেন–এখানে জঠরাগ্নির প্রতি লক্ষ্য আছে। কিন্তু তারপর? এ কোন্ অগ্নি, যিনি আয়ুঃ ও শক্তি দান করেন, যিনি সকল অঙ্গের পূর্ণতাসাধক? এখন কি আর তাকে জঠরাগ্নি বা জ্বলন্ত অগ্নি বলা যাবে? অগ্নি নামে এখানে যে ভগবানকেই আহ্বান করা হয়েছে, তা-ই প্রতিপন্ন হয়]

১৮। হে জ্ঞানদেব! দীপ্তিমন্ত্র, অন্নদাতা, শক্তিপ্রদ, শত্রুকে সংহারকারী, হিংসার অতীত, আপনাকে নিরন্তর পূজা করি (হৃদয়ে যেন প্রতিষ্ঠিত রাখি); তাতে আমরা দীপ্তিমান্, অন্নবস্ত, শক্তিযুক্ত এবং (শত্রু কর্তৃক) অহিংসিত হই। (দেবতার আরাধনায় দেবতার গুণশক্তি লাভ হয়–এটাই ভাবার্থ। [দ্যুমন্তং –দীপ্তিমন্তং; বয়স্কৃতং–অন্নকর্তারং; সহস্কৃতং শক্তিপ্রদাতারং; শপত্নিদম্ভনং, শত্ৰুণাং হিংসিতারং) (১)। বৈচিত্র্যবিশিষ্ট হে দেবীগণ (রাত্রিদেবতা)। আমাদের কর্মসমূহে আপনাদের মঙ্গল-রূপ সর্বতোভাবে পরিব্যাপ্ত হোক। (আপনারা মঙ্গলরূপে ব্যাপ্ত হোন)। [চিত্রাবস্যে–বৈচিত্র্যবিশিষ্টাঃ দেবতাঃ, রাত্রিদেবতা ইতি যাবৎ] (২)। [দেবভাবের আরাধনার পর দেবীভাবে আরাধনারও এক নিগূঢ় লক্ষ্য আছে। স্নেহকরুণা মাতৃভাবে (দেবীভাবে) সম্যক্ প্রকাটিত হয়। দেবীগণমাতৃগণবিচিত্র অভিনব মাতৃত্বশক্তিসম্পন্না। তাই তাদের আহ্বান করা হয়েছে]।

১৯। হে জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেব! আপনি জ্যোতিঃ-আধার সূর্যদেবের তেজের সাথে সঙ্গত আছেন, জ্ঞানিগণের স্ততিমন্ত্রের সাথে আপনি সঙ্গত আছেন, অন্তরস্থ অতি প্রিয় আহবনীয়ের (ভক্তির সাথে আপনি সঙ্গত আছেন; আপনার অনুগ্রহে অকালমৃত্যুরহিত পূর্ণ-আয়ুঃ কালের সাথে আমার সঙ্গতি হোক (আপনার অনুগ্রহে আমি যেন পূর্ণ আয়ুঃকাল প্রাপ্ত হই), বিদ্যা ও ঐশ্বর্য প্রভৃতি তেজের সাথে আমার সঙ্গতি হোক (আমি যেন বিদ্যা ঐশ্বর্য প্রভৃতির তেজঃ প্রাপ্ত হই), পুত্র ইত্যাদির (লোক-অনুরাগিতার) সাথে আমার সঙ্গতি হোক (আমি যেন উপযুক্ত সন্তান-সন্ততি লাভ করি, অথবা আমার যেন লোকানুরাগ বৃদ্ধি পায়), আর পরমার্থরূপ ধনের পুষ্টির সাথে যেন আমি সঙ্গত হই (আমাতে যেন পরমার্থরূপ ধর্ম বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়)। [ঋষিণাং–জ্ঞানিনাং; বৰ্চসা–বিদ্যৈশ্বর্যাদি-প্রযুক্ততেজসা, জ্যোতিষা, প্রজয়া–পুত্ৰাদিকয়া, লোকানুরাগিতয়া; রায়স্পোষেণ–পরমার্থ-রূপস্য ধনস্য পুষ্ট্যা] (১)।

২০। হে জ্যোতিঃস্বরূপ দেবগণ! আপনারা অন্নস্বরূপ (আয়ুঃ বর্ধক) হন; আপনাদের সম্বন্ধীয় আয়ুঃ আমার সেব্য হোক (উপভোগে আসুক, অর্থাৎ আমি যেন আপনাদের কৃপায় দীর্ঘায়ুঃ ও সৎকর্মশীল হই); আপনারা পূজনীয় (শ্রেষ্ঠস্থানীয়) হন; আপনাদের সম্বন্ধীয় শ্রেষ্ঠত্ব আমার সেব্য হোক (আপনাদের কৃপায় আমি যেন শ্রেষ্ঠত্ব প্রাপ্ত হই); আপনারা বল-প্রাণ স্বরূপ হন; আপনাদের সম্বন্ধীয় বল-প্রাণ আমার সেব্য হোক (অর্থাৎ আপনাদের কৃপায় আমি যেন বল-প্রাণ প্রাপ্ত হই); আপনারা পরম ধনের পুষ্টিস্বরূপ (পুষ্টিসাধক) হন; আপনাদের সম্বন্ধীয় পরমধনের পুষ্টি আমার সেব্য হোক (অর্থাৎ আপনাদের কৃপায় আমি যেন পরমধনের–গুণশক্তির অধিকারী হই। [অন্ধ-অন্নরূপাঃ, প্রাণপ্রদাঃ, আয়ুবধকা; অন্ধঃ–অন্নং, আয়ুঃ; শক্তিং; মহ–পূজ্যরূপাঃ, শ্রেষ্ঠস্থানীয়াঃ; ঊর্জবলপ্রাণরূপাঃ, বলং]।(১)। [ভাষ্যকারের ভাষ্যে এবং ব্যাখ্যাকারদের ব্যাখ্যায় প্রকাশ, এই মন্ত্র গাভীগণকে সম্বোধন করে প্রযুক্ত হয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য এই যে, এই অধ্যায়ের পূর্বোক্ত কণ্ডিকায় অগ্নি প্রভৃতি দেবগণেরই সম্বোধন ছিল। হঠাৎ এখানে গাভীগুলিকে টেনে আমার কোনই প্রয়োজন নেই]।

২১। পরমার্থবিশিষ্ট হে দেবতা! আমাদের এই আরব্ধ কর্মে (অনুষ্ঠিত যজ্ঞে) আপনারা আনন্দ রূপে বিরাজমান্ হোন; জ্ঞানকিরণ আধার (আমাদের) এই হৃদয়ে, পরিদৃশ্যমান্ এই সংসারে, আমাদের লক্ষীভূত মোক্ষরূপ সেই নিবাসস্থানে, আপনারা আনন্দরূপে চিরবিদ্যমান্ হোন; এখানেই (হৃদয়ে, সংসারে বা মোক্ষস্থানেই) আপনারা (আমাদের সঙ্গে সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে) থাকুন; অন্য আর কোথাও যাবেন না। [রেবতীঃ–হে। রেবত্যঃ, হে পরমার্থযুক্তাঃ দেবতাঃ যোনৌ-যজ্ঞে, কর্মে; গোষ্ঠে-জ্ঞানকিরণাধারে, হৃদয়ে, ক্ষয়ে–মোক্ষরূপে, নিবাসস্থানে]।(১)। [ভাষ্যে ও ব্যাখ্যাদিতে প্রকাশ, পূর্বৰ্মন্ত্রের মতো এই মন্ত্রেও গাভীগুলিকে সম্বোধন করে প্রযুক্ত হয়েছে। সে পক্ষে এ মন্ত্রের প্রচলিত অর্থ এই যে, হে ধনবতী গাভীসকল! দৃশ্যমান এই যজ্ঞযোনিতে অর্থ অগ্নিহোত্র-হবিদোহন-স্থানে তোমরা ক্রীড়া করো; (কেননা, এখনই দুগ্ধ দোহন করা হবে); তারপর, যজমানের যে গোষ্ঠ অর্থাৎ গোচারণ স্থান আছে, সেখানে গিয়ে তোমরা বিচরণ করো (চড়ে বেড়াও); সর্বদা যজমানের দৃষ্টির মধ্যে থাকো, রাত্রিতে তাঁর গৃহে ফিরে এসো। যজমানের গৃহেই থাকো; অন্যত্র আর কোথাও গমন করো না। [লক্ষ্য করুন, ভাষ্যকার রেবতী পদে গাভীসকল অর্থ আমনন করেছেন। ঐ পদের উৎপত্তি মূল–রয়ি। রয়ি শব্দে ধন (পরমধন) বোঝায়। রয়ি আছে–এই অর্থে মতুপ প্রত্যয়ে রেবতী পদ নিষ্পন্ন হয়। এখন, এ থেকে গাভীসকল অর্থ কি করে এসে থাকে, বোঝা যায় না। রমধ্বং পদে আনন্দরূপে বিদ্যামান্ বা ক্রীড়ামা হোন ভাব পাওয়া যায়। সুতরাং রেবতী রমধ্বং পদদুটিতে ভাব আসে-হে পরমার্থ বিশিষ্ট দেবগণ (দেবীগণ)! আপনারা আমাদের মধ্যে আনন্দরূপে ক্রীড়া করুন।–এটাই সমীচীন। কর্মকাণ্ডের প্রয়োজনে গাভীর প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করে ভাষ্যে যা বলা হয়েছে, অধ্যাত্মিক ভাবের বিচারে আমরা তা স্বীকার করি না]

২২। হে দেবী! আপনি সকর্মের মধ্যে বিরাজিতা হন; সর্বময়ী (বিশ্বরূপা) আপনি বলপ্রাণপ্রদানে এবং জ্ঞানের অধিপত্য দানে আমাতে অধিষ্ঠিত হোন। (প্রার্থনার মর্ম এই যে, হে দেবি! আমায় জ্ঞানশক্তি প্রদান করুন, আমার মধ্যে চিরবিদ্যমান্ থাকুন)। [ত্বং সংহিতা–সংযুক্তা, সৎকর্মমধ্যে বিরাজিতা; বিশ্বরূপী বহুরূপৈযুক্তা, সর্বময়ী; গৌপত্যেন জ্ঞানকিরণবিতরণেন; জ্ঞানাধিপত্যা-দানেন চ] (১) হে অগ্নিদেব! আমরা (যাজ্ঞিকগণ) প্রতিদিন দিবারাত্রি সর্বক্ষণ (অথবা রাত্রিতে প্রকাশমা) আপনাকে অন্তরের সাথে (অথবা সঙ্কল্পপবিরহিতচিত্তে) অর্চনা করতে করতে আপনার সমীপে উপস্থিত হতে সমর্থ হই (অর্থাৎ, আপনাকে প্রাপ্ত হই)। [দিবেদিবে প্রত্যহং দোষাবস্তুঃরাত্রৌ দিবা চ প্রকাশমানং, রাত্রৌ প্রকাশমানং] (২) [এই কণ্ডিকার প্রথম মন্ত্রে দেবীকে–স্নেহকরুণা দানকত্রীকে এই দ্বিতীয় মন্ত্রে জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেবে সম্বোধন করা হয়েছে]।

২৩। দীপ্তিশালী, যজ্ঞের রক্ষণকারী, সত্যের প্রকাশকারী আমার হৃদয়রূপ গৃহে ক্রমবর্ধমান জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেবের নিকট যেন গমন করতে পারি।(এ যেমন যজ্ঞাগ্নি প্রজ্বলিত আছে দেখে যাঞ্জিকবর্গ যজ্ঞাহুতি প্রদানের জন্য অগ্নির সমীপবর্তী হন, এবং যার যেমন সামর্থ্য, তিনি তেমন উপচার-সহযোগে যজ্ঞাহুতি প্রদান করেন; আর সেই সব যজ্ঞাহুতির ফলে, অগ্নিদেব ক্রমশঃই যেমন বর্ধমান হয়ে ওঠেন; অন্তরে যজ্ঞাগ্নি জ্বলে উঠলে, সাধক ভক্ত তেমনই যজ্ঞাহুতির উপচার-সমূহ ডালি দিয়ে আনন্দে ভগবৎ আরাধনায় প্রবৃত্ত হন। সে আহুতির ফলে, জ্ঞানাগ্নি বৃদ্ধি পায়; তার দ্বারা মানুষ মুক্তির সমীপস্থ হয়)।(১)।

২৪।পিতা যেমন পুত্রের অনায়াসলভ্য, হে অগ্নিদেব, আপনি তেমনই আমাদের অনায়াসলভ্য হোন; সর্বদা আমাদের মঙ্গল-বিধানের জন্য (পিতার মতো জ্ঞানদাতা হয়) উপস্থিত থাকুন। [সুনবে পুত্ৰায়; সুপায়নঃ–অনায়াসলভ্যঃ, সুগমঃ] (১)। [এ অগ্নি, সেই অগ্নি, যিনি জ্ঞানরূপে প্রতিভাত হচ্ছেন। এই কণ্ডিকায় এই বোঝাচ্ছে, তুমি পুত্রের মতো হও, তাকে পিতার মতো দেখো; তবে তিনি তোমার সমীপস্থ হয়ে তোমার মঙ্গল-বিধান করবেন। হও গুণময়, হও সচ্চরিত্র, হও সদাচারসম্পন্ন, হও সততায় বিভূষিত। পিতা তিনি, স্নেহময় তিনি, তিনি নিশ্চয়ই তোমায় ক্রোড়ে তুলে নেবেন; তোমার অজ্ঞান-অন্ধকার দূর করবেন। জ্ঞান-পক্ষে অর্থ হয়,-জ্ঞানময়ের অঙ্গীভূত জ্ঞান-বিভূতি আমাতে পিতার মতো প্রতিষ্ঠিত হোক। আমি তাতে আশ্রয় পেয়ে তরে যাই]।

২৫। হে জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেব! আপনি সর্বদা আমাদিগের সমীপবর্তী হোন (অর্থাৎ, আমরা যেন সর্বদা জ্ঞান-সান্নিধ্য লাভ করি); এবং আমাদের পরিত্রাণকর্তা, মঙ্গলদাতা ও হিতসাধক হোন (আপনার কৃপায় আমাদের সর্ববিধ মঙ্গল সাধিত হোক)। [শিবঃ-মঙ্গলপ্রদ; বরুথ্যঃ–হিতসাধকঃ] (১)। জ্ঞানস্বরূপ সেই অগ্নিদেবতা আমাদের আশ্রয়দাতা এবং ধনদানে প্রসিদ্ধ হন। হে জ্ঞানদেবতা! আপনি আমাদের মধ্যে পরিব্যক্ত হোন; এবং আমাদের অতি দীপ্তিপ্রদ সেই পরমধন প্রদান করুন। [বসুঃ–আবাসস্থানপ্রদঃ, আশ্রয়দাতা, বহুশ্রবাঃ–প্রসিদ্ধধনদাতা, দাতৃত্বপ্রসিদ্ধিসম্পন্ন; দ্যুমত্তমং–অতিদীপ্তিযুক্তং]।(২)।

২৬। হে দীপ্তিমান্ (জ্ঞানদেব)! আপনি সকলকে দীপ্তিদান করেন; দীপ্তিদানগুণবিশিষ্ট আপনাকে আমাদের সুখের জন্য এবং আমাদের সাথে আপনার সখ্যভাবসমূহ রক্ষার জন্য প্রার্থনা করছি। [শোচিষ্ঠ–হে দীপ্তিমান; দীদিবঃ–সর্বস্য দীপয়তঃ; সুন্নায়–সুখাৰ্থং] (১)। সেই আপনি আপনাদের এই সেবকদের (সকর্মে) প্রবুদ্ধ করুন, আমাদের আহ্বান করুন; এবং সকল রকম শত্রু হতে আমাদের রক্ষা করুন। [অস্মান–ভবৎসেবকান; বোধি–বুধ্যস্ব সৎকর্মণি ইতি; ধি-শৃণু; আঘয়তঃ–শত্রোঃ ]।(২)।

২৭। হে বনীয়! এখানে (আমার হৃদয়ে বা কর্মে) আগমন করুন। হে অনন্তস্বরূপ! এখানে (আমাদের হৃদয়ে বা কর্মে) আগমন [. করুন। [ইডে–হে স্তবনীয়ে; অধিতে–অনন্তস্বরূপে] (১)। হে সকলের কাময়িতব্য (কামনার ধন)! আপনারা এখানে (আমার হৃদয়ে বা কর্মে) আগমন করুন। আপনাদের অভীষ্টফল-প্রদায়কত্ব এই প্রার্থনাকারীর অভীষ্টফলের ধারক হোক (আপনারা অভীষ্টফলদাতা, আমায় অভীষ্ট-ফল দান করুন)। [কামধরণং-অভীষ্টফলপ্রদায়কত্ব; ময়ি–প্রার্থনাকারিণঃ]।(২)।

২৮। হে ব্ৰহ্মণস্পতি দেব! জ্ঞানাগ্নি দ্বারা বিশুদ্ধীকৃত হলে পাপাত্মা যেমন দেবসন্নিকর্ষ লাভ করে, আমার মতো (পাপী) প্রার্থনাকারীকেও II (যজ্ঞানুষ্ঠাতাকেও) তেমনই (জ্ঞানাগ্নি দ্বারা সংস্কৃত করে): দেবানুগ্রহলাভের অধিকারী (উপযুক্ত) করুন। [সোমানং-যজ্ঞানুষ্ঠাতারং, প্রার্থনাকারিণং মাং; স্বরণং–দেবেষু প্রকাশবন্তং, দেবানুগ্রহপ্রাপকং; কক্ষীবন্তং–পাপযুক্তং জনং, পাপাত্মানং ইব; ঔশিজঃ–অগ্নিসংস্কারজাতঃ, জ্ঞানাগ্নিনা বিশুদ্ধী কৃতঃ](১)।

২৯। যিনি (যে ব্ৰহ্মণস্পতি দেবতা) ধনবান, রোগশান্তিকারক, ধনদাতা, পুষ্টিবর্ধক এবং যিনি শীঘ্রফলদাতা, তিনি (সেই দেবতা) আমাদের (সত্বর) অনুগ্রহ করুন। [রেবান্ধ নবান; অমীবহা রোগাণাং হন্তাঃ; বসুবিৎ–ধনদাতা; সিষ–সেবং, অনুগৃহাতু।(১১)

৩০। মানুষের স্বাভাবিক (মনুষ্য-সুলভ) শত্রু-স্বরূপ হিংসা অভিশাপ ইত্যাদি আমাদের যেন স্পর্শ করতে না পারে (আমরা যেন হিংসাদ্বেষপরায়ণ না হই)। হে ব্ৰহ্মণস্পতি দেব! আমাদের (সেই সব শত্রু হতে) রক্ষা করো (নির্লিপ্ত রাখো)। [অররুষঃশত্রুরূপস্য; ধূর্তিঃ হিংসা] (১)। [সায়ণ-ভাষ্যে এ মন্ত্রের যে অর্থ প্রচলিত আছে, তাতে সাধারণ মানুষ-শত্রুকে লক্ষ্য আছে। কিন্তু যজুর্বেদের ভাষ্যকার বলেন, যারা যজ্ঞকর্ম করে না, তাদেরই এখানে শত্রু বলে অভিহিত করা হয়েছে। মন্ত্রের দুরকম দুটি অনুবাদ দেখলেই ভাষ্যানুসারী দুরকম অর্থের স্বরূপ উপলব্ধ হবে।(১)। উপদ্রবকারী মানুষের হিংসাযুক্ত নিন্দা আমাদের স্পর্শ না করে, হে ব্ৰহ্মণস্পতি! আমাদের রক্ষা করো।(২) যারা যাগবিমুখ কখনই দেবতার উদ্দেশ্যে বা পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কিছুমাত্র ব্যয় করে না, সেই নাস্তিক মানুষের নৃশংস বুদ্ধি ও ধূর্ততা আমাদের যেন স্পর্শ না করে। হে ব্ৰহ্মণাস্পতে! আমাদের রক্ষা করো। আর যে অর্থ প্রচলিত আছে, তা থেকে বোঝা যায়, এখানে এই মন্ত্রে বলা হয়েছে, মানুষই মানুষের পরম শত্রু। মানুষরূপ সেই পরম শত্রু আমাদের চারদিকে ঘিরে আছে; তাদের হিংসাদ্বেষে আমরা দারুণ জর্জরিত; তাদের শাপবাক্যে কুৎসা রটনায় আমরা বিব্রত। সুতরাং প্রার্থনা এই যে,–হে ভগব, এমন করুন, তারা যেন হীনবল হয়, আমাদের স্পর্শ করতে না পারে; এবং তাদের উপদ্রব থেকে আমাদের রক্ষা করুন। এই অর্থ উপলক্ষে কেউ বা ভারতবর্ষে আর্যের ও অনার্যের দ্বন্দ্বের প্রসঙ্গ উপস্থিত করেন; তারা বলেন যে, অনার্যদের উৎপীড়নে বাধ্য হয়ে মধ্য-এশিয়া থেকে আগত আর্যদের এমন প্রার্থনা করতে হয়েছিল।]।

৩১। মিত্রস্থানীয় মিত্ৰদেবের, গতিকারক অর্যমা দেবের, অভীষ্টবর্ষণশীল বরুণদেবের–এই তিন দেবতার সম্বন্ধীয় (অথবা সত্ত্বরজস্তমত্রিগুণসাম্যবিধায়ক) মহৎ দ্যোতমান্ অ-তিস্করণীয় (করুণাপূর্ণ) রক্ষা আমরা যেন প্রাপ্ত হই। [মিত্রস্য মিত্রস্থানীয়স্য দেবস্য; অণঃ–গতিকারকস্য দেবস্য; বরুণস্য–অভীষ্টবর্ষণশীলস্য দেবস্য; ত্ৰীণাং-ত্রয়াণাং দেবাণাং সম্বন্ধি, সত্ত্বরজস্তমগুণসাম্যসাধনসম্বন্ধি; দুরাধর্ষ–তিরস্কতুমশক্যং, করুণাপূর্ণং ইতি যাবৎ](১)।

৩২। মিত্র ইত্যাদি দেবগণের অনুগ্রহপ্রাপ্ত জনগণের দেহরূপ গৃহের অভ্যন্তরে, পাপপ্রবর্ধক কাম ইত্যাদি রিশত্রুগণ উপদ্রব করতে সমর্থ হয় না; বারণে (দুর্গমস্থানে) কিম্বা গতি-পথে (জীবন-যাত্রা-মধ্যে) শত্রু তাঁদের কখনও হিংসা করতে পারে না। [অমাচন–গৃহে অপি, দেহরূপগৃহাভ্যন্তরে ইতি ভাবঃ; অঘশংসঃ–পাপস্য প্রশংসক, পাপবর্ধকঃ; বারণেষু– চৌরব্যাঘ্ৰভয়সঙ্কুলেষু, রিপুশপরিপূর্ণেযু, দুর্গমেষু স্থানেষু; অধ্বসু–মার্গে, সংসারযাত্রাকালেষু]।(১)

৩৩। অনন্তের অঙ্গীভূত সেই মিত্রাবরুণ ইত্যাদি দেবগণ, মানুরে জীবনরক্ষার জন্য (উপাসকের পরিত্রাণের জন্য), অক্ষয় জ্যোতিঃ (দিব্যকিরণ) নিশ্চয় বিতরণ করেন। (দেবভাবের অধিকারী জন দেবানুগ্রহে নিশ্চিত পরাগতি লাভ করে থাকেন)। [অদিতে–অনন্তস্য; পুত্রাসঃ– পুত্রস্থানীয়াঃ; অঙ্গীভূতাঃ; তে-পূর্বোক্তাঃ মিত্ৰার্যামবরুণাঃ দেবাঃ]।

৩৪। পরমৈশ্বর্যযুক্ত হে দেব! আপনি কদাচ আপনার উপাসকের প্রতি কুপিত হন না; (প্রার্থনা এই,–আমার প্রতি কুপিত হবেন না); পরন্তু আপনার উপাসককে অনুগ্রহ করেন, সংশোধন করে দেন; (আমাকে সংশোধন করে দেবেন; অর্থাৎ আমার কৃত অপকর্ম ইত্যাদির জন্য আমার প্রতি ক্রোধান্বিত না হয়ে, আমার ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন করে নেবেন–এই প্রার্থনা)। হে ঐশ্বর্যসম্পন্ন! স্বপ্ৰকাশ আপনার বহু রকমের কৃপা-বিতরণ শীঘ্রই উপাসককে প্রাপ্ত হয়; (সে অনুগ্রহ আমাকে শীঘ্র প্রাপ্ত হোক–এই প্রার্থনা)। [ইন্দ্র-হে পরমৈশ্বর্যযুক্ত দেব!; মঘব–হে ঐশ্বর্যবান্!; দেবস্য–স্বপ্ৰকাশস্য; দানং-কৃপাবিতরণং] (১)।

৩৫। যিনি (জ্ঞানের উন্মেষকারী যে সবিতৃদেব) আমাদের বুদ্ধিকে সৎকর্মের অনুষ্ঠানে প্রকৃষ্টরূপে নিয়োগ করেন, সেই দ্যোতমান্ জ্ঞানপ্রেরক সবিতৃদেবের (পরব্রহ্মের) শ্রেষ্ঠ সর্বপাপনাশক জ্যোতিকে আমরা ধ্যান করি। (ব্রহ্মের অনুচিন্তনে যেন আমাদের চিত্ত নিয়ত নিরত হয়)। [যঃ–জ্ঞানস্য প্রেরকো যঃ সবিতৃদেবঃ; নঃ–অস্মাকং; ধিয়ঃ বুদ্ধীঃ; কর্মাণি; প্রচোদ্দয়াৎ–প্রকর্ষেণ প্রেরয়তি, সৎকর্মানুষ্ঠানায় নিয়োজয়তি ইতি যাবৎ; তস্যদেবস্য–দ্যোমানাত্মকস্য; সবিতুঃ জ্ঞানপ্রেরকস্য ব্ৰহ্মণো; বরেণ্যং–শ্রেষ্ঠং, সর্বেঃ সংভজনীয়ং; তৎ–প্রসিদ্ধং, জগদ্ব্যাপ্তং; ভর্গঃ-সর্বপাপানাং তর্জনসমর্থং তেজোমণ্ডলং দূরিতনাশকং জ্যোতি; বয়ং ধীমহি–ধ্যায়ামঃ]। [কিবা প্রাচ্যে, কিবা পাশ্চাত্যে, ব্রাহ্মণ মাত্রের নিত্য উচ্চারিত গায়ত্রী নামক এই মন্ত্রের অর্থ-বিষয়ে, বহু পণ্ডিতের মস্তিষ্ক আলোড়িত হয়েছে। যোগীশ্বর যাজ্ঞবল্ক্য গায়ত্রী-মন্ত্রের ব্যাখ্যা করেছেন; তন্ত্রশাস্ত্রে গায়ত্রী-মন্ত্রের ব্যাখ্যা আছে; পুরাণ গায়ত্রী-মন্ত্রের ব্যাখ্যায় বিনিযুক্ত রয়েছেন; স্মাৰ্তভট্টাচার্য রঘুনন্দন গায়ত্রীর ব্যাখ্যা করে গেছেন। সায়ণাচার্যের ব্যাখ্যা, মহীধরের ব্যাখ্যা, বিভিন্ন তন্ত্রের ব্যাখ্যা, বিষ্ণুস্বামীর ব্যাখ্যা–এ সব ব্যাখ্যা তো আছেই। পরন্তু পাশ্চাত্যদেশের যে পণ্ডিত যখনই ভারতের শাস্ত্রগ্রন্থের প্রতি দৃষ্টিপাত করেছেন, এই মন্ত্রটির ব্যাখ্যার প্রতি তখনই তিনি প্রলুব্ধ হয়েছেন।… সবিতা দেবতার স্বরূপ উপলব্ধি বিষয়ে প্রত্যেক ব্যাখ্যায় নানা প্রতিবাক্য প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু যিনি অবাঙমনসোগোচরঃ, যিনি বাক্যের অতীত, মনের অগোচর, ভাষায় তার কি কোনও পরিচয় দেওয়া যায়? সুতরাং সবিতা দেবতা বলতে, কার প্রতি লক্ষ্য আছে তা বোঝাতে গিয়ে, সকল ব্যাখ্যাকারেরই গবেষণা পর্যদস্ত হয়েছে। যিনি নামরূপের অতীত, অথচ যার নাম রূপে বিশ্ব ব্যেপে আছে, সবিতা-দেবতা নামে এখানে তিনিই নির্দিষ্ট হয়েছেন। তাঁকে পরব্রহ্মই বলি, হিরণ্যগর্ভই বলি, আর সবিতা দেবতাই বলি–বিশ্বরূপে বিদ্যমান্ বিশ্বনাথই এখানকার লক্ষ্য। সবিতা-দেবতা পদে, কেউ বা সূর্যদেব অর্থ নির্দেশ করেন। তাঁর জ্যোতিঃ বলতে, সূর্যের রশ্মি মাত্র তাদের কল্পনায় আসে। এতে সূর্যের জ্যোতিঃধারক এক ধর্মসম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়ে গেছে। যাই হোক, সেই জ্যোতির মধ্যে দিয়েই তারা যে পরম জ্যোতিঃ প্রাপ্ত হবেন, রূপের অনুধ্যানেই যে রূপময়ের কৃপা প্রাপ্ত হতে পারবেন, তারই আশা করা যায়। সত্ত্বভাব-সম্পন্ন হয়ে, সৎ-বুদ্ধির পরিচালনায়, তার সন্ধানে ফিরলেই রূপের মধ্যেই অরূপের সাক্ষাৎকার মিলবে]।(১)

৩৬। হে জ্ঞানদেব (অগ্নে)! দিব্যজ্যোতিঃ দান-রূপ যে রথে আপনি আপনার উপাসকদের পরিত্রাণ করেন, আপনার সেই অপ্রতিহতগতিবিশিষ্ট জ্ঞানজ্যোতিঃ (রহ) এই সাধনাবিমুখ আমাদের পরিত্রাণকল্পে সর্বতোভাবে সর্বদিকে অবস্থিত হোক। [যেন-রথেন, দিব্যজ্যোর্তিদানরূপেণ; দুভঃ–অপ্রতিহতগতিবিশিষ্টং; রথং–যানং, জ্ঞানজ্যোতিঃ ইতি ভাবঃ; অস্মা–সাধনাবিমুখা জনা; বিশ্বতঃ–সর্বাসুদিক্ষু, সর্বেতোভাবেন] (১)

৩৭। হে দেব! আপনি ত্রিলোকাত্মর্ক (ভূঃ-লোক, ভুবঃ-লোক স্বঃ-লোক সকলই আপনাতে অধিষ্ঠিত); আপনার প্রসাদে বন্ধু-ভৃত্য ইত্যাদি আত্মীয় স্বজনের দ্বারা আমি যেন সৎকর্মসমন্বিত প্রশংসনীয় আত্মীয়স্বজন-বিশিষ্ট হই (অর্থাৎ, আমার আত্মীয় স্বজন সকলেই সকর্মশীল হোন; তাদের সৎকর্মের জন্য আমার মুখ উজ্জ্বল হোক)। আর পুত্রের দ্বারা (অথবা, বীরত্বের দ্বারা) আমি যেন সৎ-মার্গগামী শোভনপুত্ৰযুত (অথবা, সৎকর্মের সাধনে সামর্থ্যসম্পন্ন) হই; আর, সংসারের লোকসকলের পালন-কার্যে আমি যেন শ্রেষ্ঠ লোকপালক হই (অর্থাৎ, লোক-পালন জনহিতসাধনই যেন আমার জীবনের ব্রত হয়)। [অতস্তৎপ্রসাদাং অহংপ্রজাভিঃ–বন্ধুভৃত্যাদিরূপাভিঃ কৃত্বা; সুপ্রজাঃ–অনুকূলত্বেন শোভনাঃ প্রজা যস্য তাদৃশঃ সকর্মসমন্বিতঃ প্রশংসনীয় আত্মীয়স্বজনবিশিষ্টঃ তথা বীরৈঃ-পুত্রৈঃ, সৎকর্মসাধনসামর্থ্যেঃ; সুবীরঃ– সন্মার্গাবলম্বিশোভনপুত্ৰযুতঃ, সকর্মসাধনসামর্থ্যসম্পন্নঃ; পৌষৈঃ–সর্বেষাং পালনকার্যৈঃ, সুপোষঃ–শ্রেষ্ঠলোকপালকঃ]।(১) হে নরহিতসাধক দেব! আমার আত্মীয়-স্বজনকে (আশ্রিত জনকে) আপনি পালন করুন (পরিত্রাণ করুন)। [নৰ্য্য–হে নরহিতসাধন দেব!; পাহি–পালয়, পরিত্রাণং কুরু]।(২)। হে সর্বজন-প্রশংসিত দেব! আমার আশ্রিত জীবজন্তুকে আপনি রক্ষা করুন; অথবা, –আমার পশুভাব হতে আমাকে পরিত্রাণ করুন। [শংস্য–হে সর্বজনপ্রশংসিত দেব!; পশূন আশ্রিতা জন্তু) (৩)। হে সততগমনশীল (সর্বব্যাপি) দেব! আমার অন্ন (সৎকর্মসাধনশীল জীবন) রক্ষা করুন। [অথৰ্য্য–হে সততগমনশীল দেব, সর্বব্যাপি ইতি ভাবঃ; পিতুং–অন্নং, সৎকর্মসাধনশীলজীবনং]।(৪)। [এই কণ্ডিকার মন্ত্র চারটির সম্বোধ্য-জ্ঞানদেবতা–যিনি অগ্নিদেব নামে অভিহিত হন]।

৩৮। সম্যক্ দীপ্যমান্ (স্বপ্রকাশ) হে জ্ঞানদেব (অগ্নে)! সর্বতত্ত্বজ্ঞ পরমধনপ্রদাতা আপনাকে লক্ষ্য করে (আপনার কৃপা লাভ করে) আমরা অসৎপথ হতে প্রত্যাবৃত হচ্ছি। হে দেব! পরমধন (জ্ঞানকিরণ) এবং সৎকর্মের সম্পাদনে সামর্থ্য আপনি আমাদের প্রদান করুন। [সম্রাট সম্যদীপ্যমান্, স্বপ্রকাশ; বিশ্ববেদসং–সর্বতত্ত্বজ্ঞং; বসুবিত্তমং–শ্রেষ্ঠধনযুতং, পরমধনস্য লব্ধারং; দ্যুম্নংজ্ঞানকিরণং, পরমং ধনং] (১)।

৩৯। সেই স্বপ্রকাশ, সাধকবর্গের হৃদয়-রূপ গৃহের অধিপতি রূপে অবস্থিত, জ্ঞানদেবতা (অগ্নিদেবতা) আমার এই হৃদয়রূপ গৃহের অধিপতি হোন; সেই দেবতা, আমার পুত্র-পৌত্র ইত্যাদিকে (সংসারের সকল লোককে) অনুগ্রহের জন্য পরমধনপ্রদাতা হোন। হে জ্ঞানদেব (অগ্নে!) পরমধন (জ্ঞানকিরণ) এবং সকর্মসাধনে সামর্থ্য আপনি আমাকে প্রদান করুন। [গার্হপত্য–গৃহপতিরূপেণ অবস্থিতং, সাধকামাং হৃদয়রূপগৃহস্য পালকরূপেণ বিদ্যমান; গৃহপতিঃ–মদীয়স্য হৃদয়রূপগৃহস্য অধিপতিঃ ভবতু ইতি শেষঃ; স দেবঃ প্রজায়াং– পুত্রপৌত্রাদিকায়াঃ, জনসাধারণায় অনুগ্ৰহাৰ্থং ইতি যাবৎ] (১)

৪০। সেই স্বপ্রকাশ জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেব পশুভাবাপন্ন অজ্ঞজনের হিতসাধক, জ্ঞানধনদাতা (সাধন-প্রবৃত্তির উন্মেষকারী) এবং সত্ত্বভাবর্ধক হন। অজ্ঞান-জনের হিতসাধক হে জ্ঞানদেব! আমাদের আপনি জ্ঞানকিরণ ও সৎকর্মসাধনের সাধর্থ প্রদান করুন। [পুরীষ্যঃ–পশব্যাং, পশুভাবাপন্নস্য নির্বোধস্য জনস্য হিতসাধক; পুষ্টিবর্ধনঃ সত্ত্বভাববর্ধকঃ; পুরীষ্য–অজ্ঞানজনস্য হিতসাধক] (১)।

৪১।সৎ-অসৎ-ভাবসমূহের আশ্রয়স্থানীয় হে আমার চিত্তবৃত্তিনিবহ! তোমরা ভীত হয়ো না, শত্রুভয়ে বিকম্পিত হয়ো না; (যেহেতু, সেই জ্ঞানদেবতা– তোমাদের রক্ষক আছেন); তোমরা বলপ্রাণ-প্ৰাপনার্থ বিচঞ্চল হয়েছিলে; আমিও (তোমাদের পরিচালক পরিরক্ষকস্থানীয় আমিও) বলপ্রাণ-প্ৰাপনার্থ বিচঞ্চল হয়ে, নানা মার্গে বিচরণ করে, পরিশেষে সেই জ্ঞানদেবের কৃপায়, সুবুদ্ধিযুক্ত পরমপ্রজ্ঞাসম্পন্ন দুঃখরহিত অন্তরের সাথে, হর্ষযুক্ত অবস্থায়, সৎ-ভাবের আশ্রয়স্বরূপ তোমাদের পুনরায় প্রাপ্ত হচ্ছি। (গৃহাঃ–সদসদ্ভাবানাং আশ্রয়স্থানীয়াঃ হে মম চিত্তবৃত্তয়া; ঊর্জংবলপ্রাণপ্রাপনার্থং; সুমেধাঃ সুপ্রজ্ঞাসম্পন্নঃ; সুমনাঃ–সুবুদ্ধিযুতঃ; গৃহান্সভাবানাং আশ্রয়স্বরূপান]।(১)

৪২। স্বগৃহ-স্বধর্ম-পরিত্যাগকারী অসৎমার্গ-গমনশীল জন, জন্মসহজাত সৎ ভাবসমূহকে কখনও কখনও স্মরণ করে; আর, সেই সৎ-ভাবসমূহের প্রতি সময়ে সময়ে প্রীতিযুক্ত হয়। অসৎমার্গগামী আমরা, আদিভূত জন্মসহজাত সৎ-ভাব-সমূহকে এক্ষণে হৃদয়ে আহ্বান করছি; সেই সৎ-ভাবনিবহ, তাদের বিজ্ঞাতা আমাদের প্রাপ্ত হোন (আমরা বিপথগামী হয়েছি বুঝতে পেরে, এখন তাদের স্মরণ করছি; তারা আমাদের মধ্যে অধিষ্ঠিত হোন)।[প্রবসন–দেশান্তরং গচ্ছ, স্বগৃহং স্বধর্মং পরিত্যাগকারী, অসন্মার্গগমনশীলো জনঃ] (১)

৪৩। ইহসংসারে (আমাদের হৃদয়ে) জ্ঞানকিরণসমূহ আরাধিত হোক; সেই অজ অর্থাৎ অনন্তের সম্বন্ধীয় সত্ত্বভাবসমূহ আমাদের কর্তৃক আরাধিত (সংসারে প্রতিষ্ঠিত) হোক। আর, আমাদের পরিত্রাণকারক ব্রহ্মস্বরূপ রস আমাদের হৃদয়ে আরাধিত (প্রতিষ্ঠিত) হোক। হে দেবগণ (সত্ত্বভাবনিবহ)। আমাদের রক্ষার (পরিত্রাণের) এবং সকল রকম অনিষ্ট-প্রশমনের জন্য আপনাদের আরাধনা করছি। (আপনাদের কৃপায়) আমাদের ঐহিক ও পারত্রিক মঙ্গল সাধিত হোক। গাবঃ- জ্ঞানকিরণনিবহাঃ; উপহৃতাঃ–আরাধিতা; অজাবয়ঃজন্মরহিতস্য অনন্তস্য সম্বন্ধিনঃ সত্ত্বভাবাদয়াঃ; কীলালঃরসবিশেষ; ব্রহ্মা ইতি যাবৎ; গৃহেষুহৃদয়তেষু; শিবং মঙ্গলং, ঐহিকং সুখং; শগ্মং–মঙ্গলং, পারত্রিকং সুখং; শমোঃ শম্যাঃ–মঙ্গলং ভবতু–অস্মাকং মঙ্গলং ভবতু, তেষাং কৃপয়া ইতি শেষঃ] (১)

৪৪। পাপগ্রাসক, মঙ্গলসাধক (শত্ৰুকৃত-হিংসাক্ষয়কারক), সত্ত্ববাবলম্বী জনের প্রতি পরমপ্রীতিসম্পন্ন, মরুৎ-দেবগণকে আমরা আহ্বান করছি। পাপনাশক শুভপ্রদ সত্ত্বভাবপোষক সেই দেবগণ (আমাদের পরিত্রাণ করুন–এই প্রার্থনা)। [প্রঘাসিনঃ–পাপগ্রাসকান, জ্যোতীরূপান; মরুতঃ–মরুদ্দেবা-বিবেকরূপান্ জ্ঞানান্মেষকা (১)। [এই মন্ত্রটি চাতুর্মাস্য যাগের প্রথম মন্ত্র। মন্ত্রের দেবতা–মরুৎ। ছন্দঃ–গায়ত্রী। ভাষ্যে প্রকাশ–এই কণ্ডিকার এবং এর পরবর্তী কণ্ডিকাগুলির মন্ত্রগুলি চাতুর্মাস্য যাগে প্রযুক্ত হয়। চাতুর্মাস্য যাগ–চার-পর্বে বিভক্ত। সেই চার পর্বের নাম–বৈশ্বদেব, বরুণ-প্রবাস, সাকমেধ এবং শুনাশীরীয়। তার মধ্যে প্রথমে বরুণ-প্রবাস নামক দ্বিতীয় পর্বের বিষয় উল্লিখিত হয়েছে। এই পর্বের অনুষ্ঠানে দক্ষিণ ও উত্তর উভয় বেদীতে হবিঃ আহুতি দেবার বিধি আছে। এই উপলক্ষে প্রতিস্থাতা অর্থাৎ ঋত্বিক, যজমান-পত্নীকে বেদীর সম্মুখে এনে তার ব্যভিচার দোষের বিষয় জিজ্ঞাসা করবেন। যজমান-পত্নী উত্তর প্রদান করলে, ঋত্বিক তাকে অগ্নির সম্মুখে এনে প্রঘাসিনঃ প্রভৃতি মন্ত্র পাঠ করাবেন। এটাই হলো–মন্ত্র প্রয়োগের বিধি। এমন বিধির অনুসরণেই কর্মকাণ্ডের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। ভাষ্য অনুসারে মন্ত্রের যে অর্থ হয়, তা এই,–আমরা মরুৎ-দেবগণকে আহ্বান করি। সেই মরুৎ-দেবগণ প্রঘাস নাম হবিঃ ভক্ষণ করেন। তারা শত্রু-কৃত হিংসা ক্ষয় করেন অর্থাৎ শত্রুনাশ করেন। সেই মরুৎ-গণ যবাকু (যবের ছাতু) মিশ্রিত হবিঃ-ভক্ষণে প্রীত হন জেনে, আমরা তাদের আহ্বান করছি। প্রচলিত ব্যাখ্যা ইত্যাদিতেও এই ভাব পরিব্যক্ত দেখতে পাই]।

৪৫। অর্চনাকারী আমরা গ্রামের মধ্যে বাসকালে সর্বতোভাবে যে পাপের অনুষ্ঠান করেছি, অরণ্যবাসকালে আমরা সর্বতোভাবে যে পাপের অনুষ্ঠান করেছি, সভায় অবস্থিতির সময়ে আমরা সর্বতোভাবে যে পাপের অনুষ্ঠান করেছি, ইন্দ্রিয়ের প্রাবল্যের কারণে আমরা সর্বতোভাবে যে পাপের অনুষ্ঠান করেছি, অথবা অন্যত্র যে কোনও স্থানে অবস্থিতিককালে আমাদের দ্বারা যে সকল পাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে; আমরা (আহুতির দ্বারা) সে সকল পাপই বিনষ্ট করছি। আমাদের অনুষ্ঠান সুহুত (শুভ বা সুসম্পন্ন) হোক। [ইন্দ্রিয়ে–ইন্দ্রিয় প্রাবল্যে; যৎ এন–যৎ পাপং; তদিদং-তৎ ইদং সর্বং পাপং; অবয়জামহে বিনাশয়ামঃ (১)

 ৪৬। হে পরমৈশ্বর্যসম্পন্ন দেব! আরমান্ এই সংগ্রামে (সৎ-অসৎ বৃত্তির দ্বন্দ্বে) আপনি দেবভাব সমূহকে নিয়ে আমাদের পরিত্যাগ করবেন না। অপিচ, হে অশেষবীর্যসম্পন্ন (শত্রুবীর্যশোষক) ইন্দ্রদেব! আপনার রক্ষা আমাদের সম্বন্ধে নিশ্চয়ই বিদ্যমান আছে; (অর্থাৎ, সৎ-অসৎ বৃত্তির দ্বন্দ্বে আমাদের পরিত্যাগ না করে আপনি অবশ্যই রক্ষা করবেন)। অভীষ্টপ্রদ সত্ত্ব-প্রবর্ধক আপনার করুণা সুপ্রতিষ্ঠিত (সর্ববিদিত); অতএব, আপনার করুণা লাভের জন্য আপনার সখীভূত প্রীতিদায়ক বিবেকরূপী দেবগণকে স্তুতি দ্বারা বন্দনা করছি। [পৃৎসু-সংগ্রামেষু, সদসত্ত্যোদ্বন্দ্বে ইতি ভাবঃ শুষ্মি–হে অশেষবীর্যসম্পন্ন, শত্ৰুবীর্যশোষক ইন্দ্রদেব!; মীচুষঃ-অভীষ্টপ্ৰদস্য; হবিষ্মতঃ– সত্ত্বপ্রবর্ধক্য; মরুতঃ–তব সখীভূতান্ প্রীতিদায়কং বিবেকরূপান্ জ্ঞানোন্মেষকান্ দেবান্]।(১)।

৪৭। সৎকর্মর্কারিগণের উচ্চারিত সুখের আধারভূত স্তুতিমন্ত্রের সাথে আমরা সৎকর্মের অনুষ্ঠান করেছি। হে সৎস্বরূপ! আমরা যে কর্মের অনুষ্ঠান করেছি, সেই কর্ম প্রকৃষ্টরূপে (আপনার কাছে) গমন করুক (ভগবানকে প্রাপ্ত হোক)। (ভাব এই যে, আমাদের কর্মের প্রভাবে যেন আমরা ভগবানকে প্রাপ্ত হই)। [কর্মকৃতঃ–সকর্মকারিণঃ সত্ত্বভাবসম্পন্নানাং জনানাং বা উচ্চারিতেন; ময়োভুবা–সুখস্য আধারভূতেন; সচাভুবঃ–হে সৎস্বরূপ দেব! প্রেত–প্রকৃষ্টরূপেন গচ্ছত, ভগবন্তং প্রাপ্লুত] (১)।

৪৮। সর্বতোভাবে পিপক্লেদপরিশূন্য (শুদ্ধসত্ত্বপোষণকারী) স্থিতপ্রজ্ঞা (মহত্ত্ব ইত্যাদি গুণসম্পন্ন) হে দেব! যদিও আপনি চঞ্চলগতিবিশিষ্ট (সহসা কেহ আপনাকে ধারণা করতে পারে না); তথাপি কৃপাপূর্বক আমাদের ধারণাধীন হোন (আমাদের মধ্যে প্রজ্ঞানরূপে অবস্থিত হোন)।(ভাব এই যে, মহত্ব ইত্যাদি গুণসম্পন্ন দেবতা উচ্চ-নীচ নির্বিশেষে সকলেরই প্রতি করুণা বিতরণ করেন। সুতরাং অকিঞ্চন হলেও আমরা তার করুণা-লাভে বঞ্চিত হবো না)। [অবভৃথ–হে পরিস্নাত, সর্বতোভাবেন পাপক্লেদপরিশূন্য, শুদ্ধসত্ত্বপোষক দেব; নিচুম্পূণ–হে মন্দগমনশীল, স্থিতপ্রজ্ঞ, মহত্ত্ব ইত্যাদি গুণোপেত, নিচেরুঃ– চঞ্চলগতিবিশিষ্টঃ, কোহপি ত্বং ধারয়িতুং ন সমর্থঃ; নিচুম্পুণঃ–মন্দগতিবিশিষ্ট, অস্মাকং ধারণাধীনঃ]।(১)। দেবতা-বিষয়ে জ্ঞানতঃ আমাদের যে সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে; অপিচ, মনুষ্য সম্বন্ধে মনুষ্যস্বভাবসুলভ আমাদের যে ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটেছে; সে সব ত্রুটি-বিচ্যুতি (এতৎ দ্বারা সৎকর্মের অনুষ্ঠানে) অপনীত হোক। (অর্থাৎ–দেবতা বা মনুষ্য-বিষয়ে আমরা জ্ঞানকৃত বা অজ্ঞানকৃত যে সব পাপানুষ্ঠান করেছি। আমাদের সে সব পাপ দূর হোক)। [দেবৈঃ–জ্ঞানকৃতৈঃ– অস্মাভিরনুষ্ঠিতৈঃ; দেবকৃতং-দেববিষয়ে কৃতং; যৎ এনঃ–দুষ্কৃতং, ত্রুটিবিচ্যুতিমিতি ভাবঃ; মর্তৈঃমনুষ্যৈঃ, মনুষ্যস্বভাবসুলভৈঃ, অজ্ঞানকৃতৈরিত্যর্থঃ; মর্তকৃতং–মনুষ্যবিষয়ে কৃতং] (২)। হে দেব! বহু অনিষ্টসাধক সংসাররূপ বন্ধন হতে আমাদের পরিত্রাণ করুন। (অথবা, যাতে আমরা কঠোর সংসার-বন্ধনে আবদ্ধ না হই, তার উপায়-বিধান করুন)। [দৈব–হে দীপ্তিদানাদিগুণযুক্ত; পুরুরার–বহু অনিষ্টজনকাৎ] (৩)।

৪৯। হে আমার সত্ত্বসাধনভূত চিত্তবৃত্তিনিবহ! তোমরা সৎ ভাবসমূহে পূর্ণ হও; এবং উৎকৃষ্ট (সৎ-ভাব ইত্যাদি দ্বারা নির্মল) হয়ে ভগবানের প্রতি প্রধাবিত হও। (অতঃপর) সুপর্ণা হয়ে (ভগবৎপ্রসাদে মোক্ষপ্রাপ্তিসামর্থ্য লাভ করে) প্রত্যাবৃত হও। [দর্বি সত্ত্বসাধনভূতা হে মম চিত্তবৃত্তি; ত্বং পূর্ণা–পরিপূর্ণ সৎ-ভাবনিবহৈরিতি যাবৎ; সুপূর্ণা–সুষ্ঠু পূর্ণা– ভগবৎপ্রসাদেন মোক্ষফল প্রাপ্তিসামনে ইতি ভাবঃ] (১)। হে অশেষসকর্মসহযুক্ত দেব! আপনি এবং আমি পরস্পর আমাদের শুদ্ধসত্ত্বভাবের এবং অভীষ্টফলের বিনিময় করি। (ভাবার্থ-আমি আপনাকে শুদ্ধসত্ত্ব প্রদান করি, এবং তার বিনিময়ে আপনি আমাকে অভীষ্টরূপ মোক্ষফল প্রদান করুন)। [শতক্রতো–অশেষসৎকর্মসহযুত হে দেব!; বিক্ৰীণাবহা-বিক্ৰীণাবহৈ, পরস্পর সত্ত্ববিনিময়রূপং কর্ম করবামহে]।(১)

৫০। হে ভগবন্! অর্চনাকারী আমাকে পরমধন (জ্ঞানধন) দান করুন; তাহলে, আমি আপনাকে আমার হৃদয়ের সত্ত্বভাব (ভক্তিভাব) সমর্পণ করতে সমর্থ হবো। আমাকে সর্বদা জ্ঞানদান-রূপ অনুগ্রহ করুন; তাহলে, আমিও আপনাকে সত্ত্বভাব প্রদান করতে পারব। (ভগবানের করুণা ভিন্ন ভগবানের পূজায় সামর্থ্য আসে না–এটাই ভাবার্থ। হে দেব! আমাকে অমূল্যধন (জ্ঞানরত্ন) দান করুন, তাহলে, সত্ত্বভাবরূপ ধন আমিও নিয়ত দান করতে সমর্থ হবো এই রকম প্রার্থনায় স্বাহা-মন্ত্রে। প্রদত্ত আমার আহবনীয় মঙ্গলপ্রদ হোক। (ভাব এই যে, ভগবৎ কৃপাই সকল মঙ্গলের মূলীভূত। সেই কৃপার ফলে আমাদের মঙ্গল সাধিত হোক)। [নিহারং-অমূল্যধনং, জ্ঞানরত্নং বা সত্ত্বরূপং ধনং, ভক্তিভাবং] (১)।

৫১। হে ভগবন্ ইন্দ্রদেব! আপনার সম্বন্ধীয় জ্ঞান-ভক্তি রূপ বাহক দুজনকে শীঘ্র আমাদের কর্মরূপ-রথে যোজনা করে দিন; (ভাব এই যে, হে দেব? আপনার কৃপায় আমাদের কর্ম জ্ঞানভক্তি যুত হোক); সেই কর্মের দ্বারা সকল দেবতা আমাদের সত্ত্বভার গ্রহণ করে (আমাদের সত্ত্বভাবের সাথে সম্মিলিত থেকে), হর্ষ পেয়ে, প্রীতিযুক্ত হয়ে, নিশ্চিত আমাদের হৃদয়ে উদিত হন; আর, স্বতঃপ্রকাশশীল তারা, জ্ঞান-রূপ ধারণ করে ঔৎকর্ষসম্পন্ন বুদ্ধিপ্রদানের দ্বারা, সৎকর্মের সাধনে আমাদের উদ্বুদ্ধ করেন। (ভাব এই যে, জ্ঞানভক্তিবিশিষ্ট সঙ্কর্মের সাথে দেবতাগণের অভিন্ন সম্বন্ধ। তার দ্বারাই দেবতাগণ হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আমাদের সৎকর্মসম্পন্ন করুন–এটাই প্রার্থনা)। [ইন্দ্র হে পরমৈশ্বর্যসম্পন্ন দেব! হরী রশ্মী, জ্ঞানভক্তিরূপৌ বাহকৌ; স্বভানবঃ–স্বয়ংদীপ্তিযুক্তাঃ স্বতঃপ্রকাশশীলাঃ; নবিষ্ঠয়া–নবতময়া, ঔৎকর্যসম্পন্নয়া; মতী–মত্যা, বুদ্ধিপ্রদানেন]।(১)

৫২। হে বহুকর্মকারী শ্রেষ্ঠধনযুত ইন্দ্রদেব (মঘব)! প্রিয়দর্শন (সুসংদশং, বিশ্বস্য দ্রষ্টারং) আপনাকে আমরা পূজা করছি (বন্দিীমহি; হৃদয়ে ধারণ করছি) আমাদের পূজায় প্রীত হয়ে (স্তুতঃ, স্তুতিভিঃ প্রীতঃ সন্) আপনি আমাদের কর্মরূপ রথে আসন গ্রহণ করে (পূর্ণবন্ধুরঃ, আমাদের আবাসস্বরূপ হয়ে), প্রার্থনাকারী আমাদের উদ্দেশ্যে (আমাদের হৃদয়ে, আ-প্রসি) নিশ্চয়ই আগমন করুন। হে পরমৈশ্বর্যশালী দেব (ইন্দ্র)! আপনি আপনার জ্ঞান-ভক্তিরূপ বাহক দুজনকে (হরী) আমাদের কর্মরূপ রথে সংযোজিত করুন (যোজ)। (ভাব এই যে, আপনার অনুগ্রহে আমাদের কর্ম যেন জ্ঞানভক্তি সমন্বিত হয়, অর্থাৎ আমারা যেন জ্ঞান ও ভক্তির অধিকারী হই)।(১)।

৫৩। পিতৃলোকের (দেবত্বপ্রাপ্ত পিতৃগণের) অভিপ্রেত এবং লোকতৃপ্তিপ্রদ স্তোত্রের দ্বারা আমরা যেন সর্বদা (অতি সত্বর) আমাদের হৃদয়স্থিত দেবতাকে (অন্তরাত্মাকে) পরিতৃপ্ত করি। (ভাব এই যে,হে জীব! তুমি সর্বাগ্রে অন্তরশুদ্ধি করো। সেই কর্মই পিতৃলোকের অভিপ্রেত হয়)। [মনঃ–অন্তরস্থিতং দেবং, সত্ত্বভাবং অন্তরাত্মানং] (১)।

৫৪। আর, আমাদের চিত্ত, সৎকর্মের সাধনে উৎসাহ-সম্পন্ন হয়ে চিরজীবী হবার জন্য এবং জ্ঞানসূর্যকে (ভগবানকে) চিরদর্শনের জন্য আমাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হোক। (ভাব এই যে, উৎসাহের সাথে সকর্মসাধনের দ্বারা জ্ঞানার্জনের ও অক্ষয়জীবনলাভের জন্য আমাদের চিত্ত উদ্বুদ্ধ হোক)। [জ্যো–চিরং; জীবষে–জীবিতুং; সূর্যং-জ্ঞানসূর্যং, ভগবন্তং]।(১)

৫৫। হে পিতৃগণ (আমাদের নিত্যশুভানুধ্যায়ী হে দেবগণ)! আপনাদের অনুকম্পায়, দেবভাবাপন্ন সাধুপুরুষ আমাদের বিশুদ্ধ অন্তঃকরণকে পুনঃপ্রদান করুন; অর্থাৎ সাধুসংসর্গে আমরা যেন আমাদের সহজাত সত্ত্বভাবকে পুনরায় প্রাপ্ত হই); আর, আমরা যেন সারাজীবন ভগবানের উদ্দেশ্যে বিহিত কর্মের সেবা করি; (সাধুসঙ্গলাভে বিশুব্ধ-চিত্ত হয়ে আমরা যেন বিহিত কর্মের অনুষ্ঠান-সামর্থ্য লাভ করি, হে পিতৃগণ, তা ই বিধান করুন–এই প্রার্থনা)। [পিতরঃ–দেবত্বপ্রাপ্তা অস্মাকং নিত-শুভানুধ্যায়িনঃ হে পিতৃগণাঃ!; দৈবব্যা জনঃ–দেবসম্বন্ধীয় পুরুষঃ দেবভাবসম্পন্নঃ সাধুরিতি ভাবঃ; জীবং–প্রাণভূতং, জীবনব্যাপিনং] (১)

৫৬। হে সোম (শুদ্ধসত্ত্ব)! আপনার সম্বন্ধীয় কর্মে (সত্ত্বভাবের উদ্বোধনায়) যেন আমরা, এই দেহের মধ্যে আমাদের চিত্তকে ধারণ করে, লোকানুরাগসম্পন্ন হয়ে, সর্বদা আপনার সাথে সম্বন্ধযুক্ত থাকি। (ভাব এই যে,হে শুদ্ধসত্ত্বরূপ দেব! আমাদের চিত্ত আপনার ভাবের ভাবান্বিত হোক; আপনি আমাদের শুদ্ধসত্ত্বসমন্বিত ও লোকানুরাগপরায়ণ করুন)। [সোম-হে শুদ্ধসত্ত্ব!; তব ব্রতে–তৎসম্বন্ধী কর্মনি, সত্ত্বভাবোদ্বোধনায় ইতি যাবৎ; প্রজাবন্তঃ লোকানুরাগসম্পন্না ভবন্তশ্চ] (১)। [ভাষ্যকার এখানে সোম অর্থে সোমরসরূপ মাদকদ্রব্য বলেননি। পরন্তু আমরা সোম-সম্বন্ধে যে মত পোষণ করে আসছি, এ মন্ত্র সেই মতেরই পরিপোষক। সোম যে শুদ্ধসত্ত্বং, সোম বলতে যে জ্ঞানভক্তি প্রভৃতির দিব্য আলোককে বোঝায়, সর্বত্র সেই ভাবই অব্যাহত দেখা যায়। সোম বলতে লতার রসঅর্থ গ্রহণ করলে, দুএক স্থলে সে অর্থ গ্রহণ করা যেতে পারলেও, সর্বত্র সে অর্থের সঙ্গতি থাকে না। অথচ সোম শব্দের শুদ্ধসত্ত্ব প্রতিবাক্য গ্রহণ করলে, সোমকে সকল সামগ্রীর সারভূত বলে স্বীকার করলে, আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করে দেখেছি, সোম-পদের অর্থের সর্বত্র সঙ্গতি থাকতে পারে]।(১)।

 ৫৭। পাপসমূহের বিনাশসাধননিমিত্ত রৌদ্রভাবাপন্ন হে দেব! আপনার সহজাত (আপনার সাথে অভিন্নসম্বন্ধযুত) জগৎ-রূপা পৃঙ্খীদেবতার সাথে সেই সত্ত্বভাবের অংশ (যা আমাদের হৃদয়ে সঞ্চিত আছে। সেই সমস্ত) আপনি গ্রহণ করুন; স্বাহা-মন্ত্রে তা আপনাকে অর্পণ করছি–সুহুত হোক। (ভাব এই যে,–এই জগৎ-রূপিণী দেবতার সাথে রুদ্রদেবতার অভিন্ন সম্বন্ধ। পৃঙ্খীদেবতার সাথে তিনি আমাদের প্রদত্ত সত্ত্বভার গ্রহণ করেন, তার সাথে সম্মিলিত হন)। [রুদ্র–পাপানাং বিনাশসাধনত্বাৎ রৌদ্রভাবাপন্ন হে দেব!; স্বস্রা–সহজাতয়া অভিন্নসম্বন্ধযুতয়া; অম্বিকয়া–জগদ্ৰপয়া, পৃথ্বীদেবতয়া; এষ ভাগঃ–সোমস্য ভাগঃ, সত্ত্বভাবস্য অংশ]।(১)। পাপনাশক হে দেব! এই যে শুদ্ধসত্ত্বভাব, তা-ই আপনার গ্রহণীয়। সত্ত্বভাবাপহারক চৌর পশু বলে অভিহিত হয়। (ভাব এই যে, সত্ত্বভাবাপহারক পশুভাবাপন্ন জনই আপনার বধার্য হয়ে থাকে)। [আখুঃ–চৌরঃ, সত্ত্বাপহারকঃ; পশুঃ–পশু ইতি খ্যাত, পশুভাবপন্নঃ, বধাহ ইতি ভাবঃ] (২)। [কণ্ডিকার মন্ত্র দুটি সাকমেধ-যজ্ঞের অন্তর্ভুক্ত এ্যম্বক-হবিঃ-দান বিষয়ে প্রযুক্ত হয়। ত্র্যম্বক হবিঃ–যজ্ঞাংশের নাম। এটি রুদ্র-যাগ নামেও অভিহিত হয়। প্রথম মন্ত্রটি অবদান হোমে এবং দ্বিতীয় মন্ত্রটি ইন্দুরের গর্তে হুতাবশিষ্ট প্রক্ষেপ উপলক্ষে উচ্চারিত হয়ে থাকে। সে পক্ষে মন্ত্র দুটির প্রচলিত অর্থ–(১) হে রুদ্রদেব! আমাদের প্রদত্ত এই যে, ভজনযোগ্য পুরোডাশ-ভাগ, অম্বিকা-নাম্নী আপনার ভগিনীর সাথে তা সেবন করুন। স্বাহা অর্থাৎ এই প্রদত্ত হবিঃ সুহুত হোক!(২) হে রুদ্রদেব! এই পুরোশভাগটিও আপনার ভজনীয়। আপনার যে মূষিক ও পশু, তাদের এটি সমর্পিত হচ্ছে।–আখুকর বলতে ইন্দুরের গর্তের মাটি বুঝিয়ে থাকে। আমরা ঐরকম অর্থের উপযোগীতা অনুভব করি না]।

৫৮। ত্রিলোকদর্শী দীপ্তিদান ইত্যাদি গুণযুক্ত সেই রুদ্রদেবতার স্বরূপ অবগত হয়ে তার সম্বন্ধীয় সত্ত্বভাবকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা করি; (আমাদের) সেই কর্মের দ্বারাই তিনি আমাদের পাপ অবরোধক শক্তি সম্পন্ন (বসনশীল) করেন; (আমাদের) সেই কর্মের দ্বারাই তিনি আমাদের শ্রেয়ঃ সম্পন্ন (আমাদের শ্রেয়ঃ সাধন) করেন; প্রাপ্ত করান।(ভাব এই যে,রুদ্রদেবতার স্বরূপ অবগত হয়ে আমরা যখন তার সম্বন্ধীয় সত্ত্বভাবকে হৃদয়ে ধারণ করতে সমর্থ হই, তখনই আমাদের সব রকম মঙ্গল সাধিত হয়)। [ত্র্যম্বকং–ত্রিনেত্রং, ত্রিলোকদর্শিনাং; অব–অবগত্যা, তৎস্বরূপং অনুসৃত্যা; অব–তৎসম্বন্ধী সত্ত্বভাবং রক্ষণং, অন্নং; করৎ কুর্যাৎ; যথা–যেন কমণা; ব্যবসায়য়াৎসর্বেষু কার্যেষু নিশ্চয়যুক্তান সর্বকার্যেষু সিদ্ধিপ্রাপ্ত)।(১)। [পূর্ব কণ্ডিকার মন্ত্র অনুসারে ইন্দুরের গর্তে হিবঃ-শেষ অর্পণ করা হলে, এই কণ্ডিকার এবং এর পরবর্তী কণ্ডিকার মন্ত্র জপ করতে হবে কমকণ্ডের এটাই বিধি]

৫৯। হে দেব! আপনি ঔষধের মতো সর্ব-উপদ্রবনিবারক হোন; জ্ঞানকিরণ-দানে আমাদের ভবব্যাধিনাশক হোন; সৎকার্য-সাধনের সামর্থ্য প্রদান করে ঔষধস্বরূপ শক্তিপ্রদায়ক হোন; এবং মেষের মতো অজ্ঞজনকে (দুবুদ্ধিসম্পন্ন জনকে) বিতাড়নের দ্বারা (শাসনপ্রভাবে পাপনাশের দ্বারা) পরমার্থপ্রদ হোন। ভাব এই যে,–হে দেব! আমাদের অজ্ঞানতা দূর করে আমাদের পরম সুখ প্রদান করুন।(১)। [ভেষজং–সর্বোপদ্রবনিবারক; গবে অশ্বায় চ–জ্ঞানকিরণদানায় চ, যদ্বা–গবাদিপশুবিষয়ে; ভেষজং–ঔষধস্বরূপাঃ, ভবব্যাধিনাশক; পুরুষায়–সকার্যসাধন সামর্থ্যপ্রদানায়, যদ্বা-লোকায়; ভেষজং ঔষধস্বরূপঃ শক্তিপ্রদায়কঃ; মেষায় –মেষবৎ অজ্ঞাজনায়, দুর্বুদ্ধিসম্পন্নয়; মেষ্যৈ–বিতাড়নয়া, শাসনপ্রভাবেন পাপনাশেন] (১)

৬০। হে দেব! মর্ত্যধর্মহীন (সকল লোকের তৃপ্তিসাধক), প্রাণিসমূহের পোষণকর্তা, ত্রিলোকদর্শী (ত্রিকালজ্ঞ) আপনাকে আমরা অর্চনা করছি; পরিপক্ক ফল যেমন আপনিই বৃন্তচ্যুত হয়, আপনার প্রসাদে যেন সেইভাবে মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্তি পাই; পরন্তু মুক্তিস্থান (মোক্ষপথ) হতে যেন কখনও বিচ্যুত না হই। (প্রার্থনার মর্ম এই যে, হে দেব! আপনার কৃপায় যেন মোক্ষপ্রাপ্তি ঘটে)। [সুগন্ধিং-মর্ত্যধর্মহীনং, অমৃতস্বরূপং, সর্বোং লোকানাং তৃপ্তিসাধকং; ত্র্যম্বকং–ত্রিলোকদর্শিনং, ত্রিকালজ্ঞং; উবারুকমিব-ফলবিশেষঃ যথা অত্যন্তপঃ সন্ বন্ধনাৎ স্বস্ব বৃন্তাৎ বিষুজ্যতে তদ্ব; মৃত্যোঃ –মরণস্য, যমস্য]।(১)। হে দেব! মর্ত্যধর্মহীন (অমৃতস্বরূপ) পরমার্থপরিজ্ঞাপক (জ্ঞানদাতা) ত্রিলোকদর্শী (ত্রিকালজ্ঞ) আপনাকে আমরা অর্চনা করছি; পরিপক্কফল যেমন আপনিই বৃন্তচ্যুত হয়, আপনার প্রসাদে, সেইরকম মায়ানমাহের বন্ধন হতে যেন মুক্তি পাই; পরন্তু মুক্তিস্থান (ভগবানের নিকট) হতে যেন বিচ্যুত না হই। (প্রার্থনার মর্ম এই যে,হে দেব! যাতে সকল রকম বন্ধন হতে মুক্ত হয়ে পরাগতি লাভ করি, তা-ই করে দেন)। [পরিবেদনং–ভর্তুর্লম্ভয়িতারং পরমার্থপরিজ্ঞাপকং, জ্ঞানপ্রদাতারং; অমুতঃ–ভগবৎসাশাৎ, মুক্তিস্থানা] (২)।

 ৬১। হে ভগবন! পূর্বোক্তরূপ অনুগ্রহ-দানই আপনার রক্ষাকার্য; (এই রকমেই আপনি আমাদের রক্ষা করুন); এই রকম রক্ষাকার্যের দ্বারা পাপসম্বন্ধযুত কর্মের অতীত ভাব (সত্ত্বভাব) আমাদের প্রদান করুন; (আপনার অনুকম্পায় আমরা যাতে অসৎসম্বন্ধবিরহিত সত্ত্বভাব প্রাপ্ত হই, তা-ই করুন এই প্রার্থনা)। আর হে দেব! আপনি অবততধন্বা অর্থাৎ আমাদের শত্রুশে ধনুতে জ্যা রোপণ করে এবং আমাদের রক্ষা জন্য পিনাকবসঃ অর্থাৎ ধনুকধারী হয়ে, আমাদের নিকট আগমন করুন; হে অভিপ্রেতবাসধারিন্ (হে শূন্যবাসপরিহিত) আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি উপেক্ষা করে; আমাদের পক্ষে মঙ্গলপ্রদ হোন অর্থাৎ কল্যাণরূপে আমাদের মধ্যে আগমন করুন। (ভাব এই যে, সেই সর্বব্যাপী ভগবান্ আমাদের শত্রনাশের দ্বারা ও আমাদের রক্ষার দ্বারা সব রকম মঙ্গল-সাধন করুন)। [এতৎ–পূর্বোক্তরূপং অনুগ্রহদানং এব; মজুবতঃ–পাপসম্বন্ধযুতস্য কর্মণঃ; পরঃ–অতীতং ভাবং, সত্ত্বভাবং; কৃত্তিবাসা–হে অভিপ্রেতবাসধারিণ! যদ্বা–হে শূন্যবাসপরিহিত!; শিবঃ–অস্মৎসম্বন্ধে মঙ্গলপ্রদঃ] (১)।

৬২। যেমন জমদগ্নির অর্থাৎ ভীষণ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ জনের (অথবা ঐ নামধারী অবতারের) ত্রিকালস্থায়িত্ব, তেমনই কশ্যপের অর্থাৎ পাপজনক শত্রুর ও (অথবা ঐ নামধারী ঋষির) ত্রিকালস্থায়িত্ব। কিন্তু হে ভগবন্! দেবগণে (দেবভাবে) যে ত্রিকালস্থায়িত্ব, আপনার কৃপায়, আমাদের তেমনই ত্রিকালস্থায়িত্ব হোক। (ভাব এই যে,–পাপ-পুণ্যের সৎ-অসৎবৃত্তির দ্বন্দ্ব অবিচ্ছিন্ন-প্রবাহে প্রবাহিত হয়েছে; কিন্তু দেবভাবসমূহের যে চিরস্থায়িত্ব; হে ভগব, আমাদের সম্বন্ধে তা-ই বিহিত করুন)। [য়ুষং–ত্রিকালস্থায়িত্বং; দেবেষু–দেবভাবেষু, দীপ্তিদানাদি গুণেষু] (১)

৬৩। হে মম অন্তরস্থ সত্ত্বভাব। আপনি নামে (কর্মপরিচয়ের দ্বারা) শিব (শান্তিপ্রদ) হন; যিনি কামনাবিনাশক (বন্ধনছেদক), তিনি আপনার জনকস্থানীয় হন; (ভাব এই যে, নিষ্কাম কর্মের দ্বারা শান্তস্বরূপ দেবভাব সঞ্জাত হয়); আপনাকে আমি নমস্কার করছি; আমার প্রতি কখনও বিরূপ হবেন না। (ভাব এই যে, নিষ্কাম কর্মের প্রভাবে আমি যেন শান্তস্বরূপ দেবভাব প্রাপ্ত হই, হে আমার অন্তরস্থ সত্ত্বভাব, আপনি তা-ই বিহিত করুন)। [স্বধিতিঃ–বন্ধকছেদকঃ; মা–মাং; মা হিংসীঃ–মা বিরূপো ভব]।(১)। হে আমার কামনা! অক্ষয়-জীবন-লাভের জন্য, সত্ত্বভাব-রূপ অন্ন গ্রহণের জন্য, জনহিত-সাধনের জন্য, পরমার্থ রূপ ধনের পুষ্টির জন্য, পারিপার্শ্বিক জনগণের সুমঙ্গল বিধানের জন্য, সৎকার্য-সম্পাদনের সামর্থ্য প্রাপ্তির জন্য, তোমাকে আমি নিরোধ করছি। (ভাব এই যে, নিষ্কাম কর্মের দ্বারা আত্ম-উৎকর্ষ সাধনে ও পরহিত-বিধানে আমি প্রবুদ্ধ হচ্ছি)। [আয়ুষে–জীবনায়, অক্ষয়জীবনলাভায়; অন্নাদ্যায় সত্ত্বভাবরূপান্নগ্রহণায়; প্রজনোয়জনহিতসাধনায়, অপরেষাং শ্রীবৃদ্ধিহেতবে; রায়ং–পরমার্থরূপস্য ধনস্য; সুপ্রজাস্বায়–পারিপার্শ্বিকজনস্য সুমঙ্গলবিধানাথায়; সুবীর্যায়–সকর্মসম্পাদনসামর্থ প্ৰাপনায়](২)। [কণ্ডিকার আত্ম-উদ্বোধনমূলক মন্ত্র দুটির প্রথমটিতে হৃদয়স্থিত সত্ত্বভাবকে ও দ্বিতীয়টিতে কামনাকে সম্বোধন আছে]।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *