হিন্দুধর্ম
অবশ্য এখন যা হিন্দুধর্ম নামে পরিচিত তা যে সঠিক কী কী লক্ষণ দেখে বিচার ও আলাদা করা যাবে তা বলা দুরূহ। কোনো মূর্তিপূজা করেন না এমন মানুষও নিজেকে হিন্দু বলেন। কারোর প্রধান আরাধ্য কালী, কারোর বা বিষ্ণু, কারোর শিব, আবার কারোর রাম, হনুমান, রামকৃষ্ণ ইত্যাদি—তাঁরা সবাই হিন্দু বলেই নিজেদের দাবি করেন। তবু এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা-য় হিন্দুদের সাধারণ কয়েকটি লক্ষণের উল্লেখ করা হয়েছে : (ক) আত্নন্ ও ব্রহ্মণের তত্ত্বে বিশ্বাস, (খ) ইষ্টদেবতা ও ত্রিমূর্তিতে বিশ্বাস, (গ) বেদ-ব্রাহ্মণে বিশ্বাস, (ঘ) পুনর্জন্ম ও কর্মফলে বিশ্বাস।
অবশ্য আইন অনুযায়ী কেউ এসব বিশ্বাস ও অনুসরণ না করলেও সে হিন্দু হতে পারে—বরং বলা ভাল আইনের প্যাঁচে পড়ে সে হিন্দু হতে বাধ্য হবে। অথচ হিন্দু বাবা-মায়ের বহু সন্তানই আছেন যাঁরা হিন্দুধর্ম কেন, প্রচলিত অর্থের কোন ধর্মেই বিশ্বাস করেন না।
গণতান্ত্রিক অধিকারের বিচারে যে কেউ কোন বিশেষ ধর্ম—তা মনগড়া বা মিথ্যা হলেও—তাতে বিশ্বাস করতে পারেন এবং ঐ অনুযায়ী ধর্মাচরণ করতে পারেন। অন্যদিকে কোন ধর্মে বিশ্বাস না করা এবং এই ধরনের কোন ধর্মাবলম্বী বলে নিজেকে পরিচিত না করানোর গণতান্ত্রিক অধিকারও সবার আছে। কিন্তু আইন অনুযায়ী অবিশ্বাসীদের জন্য এই গণতান্ত্রিক অধিকার নেই। তবে আইনটি আপাতত কেরলেই সীমাবদ্ধ। অষ্টম কেরালা বিধানসভায় ১৭৬ নং বিল—ত্রিবাংকুর-কোচিন হিন্দু ধর্মীয় স্থান (তৃতীয় সংশোধনী) বিল, ১৯৯০-এ ২নং ধারার সংশোধন করে বলা হয়েছে,
“যে জন্মসূত্রে হিন্দু (অর্থাৎ তার বাবা-মা হিন্দু), অথবা যে হিন্দুধর্মে বিশ্বাস করে বা ধর্মান্তরিত হয়েছে, সে-ই হিন্দু,—সে ঈশ্বরে বিশ্বাস করুক বা না করুক, মন্দিরে পূজায় বিশ্বাস করুক বা না করুক।” (“Hindu’ means a person who is a Hindu by birth, or by conversion into Hindu religion or who professes the Hindu religion-whether or not such person believes in God and temple worship.”)
স্পষ্টত নিজস্ব বিশ্বাস-অবিশ্বাস, যুক্তিবোধ ও বিজ্ঞানমনস্কতা—এ সবের দাম এই আইনে নেই; হিন্দু পূর্বপুরুষদের বিশ্বাস অনুযায়ীই তার পরিচয় নির্ধারিত—হিন্দু দম্পতির সন্তানের হিন্দু (বা অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত) না হয়ে শুধু ‘মানুষ’ হওয়ার অধিকার নেই।
তথাকথিত হিন্দুধর্মের বৈচিত্র্য ও লক্ষণাদির বিভিন্নতাও উল্লেখযোগ্য। অন্য প্রায় কোন ধর্মেই এমন পরস্পরবিরোধী আচার অনুষ্ঠান ও কথাবার্তা দেখা যায় না। অনেকে একে হিন্দুধর্মের মহত্ত্ব ও সহিষ্ণুতা এবং পরিবর্তনশীলতার সঙ্গে সনাতনত্বের মিশ্রণ ইত্যাদি গালভরা নাম দেন। প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটি ঘটেছে, কোন একক ব্যক্তি-নেতৃত্ব থেকে হিন্দুধর্ম সৃষ্টি না হওয়ার কারণে। (খ্রীস্ট, ইসলাম, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, ইত্যাদি ধর্মের উৎসমূলে এই একক নেতৃত্বের ব্যাপারটি ছিল—যদিও পরবর্তীকালে এদের মধ্যেও নানা ধরনের বৈচিত্র্য, বিভেদ ও বিভিন্নতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে।) সৃষ্টি থেকে বহুজনের রচনা, বহু মতামত, বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও ব্যাখ্যা পদ্ধতি এই হিন্দু ধর্মে স্থান পেয়েছে।
অনেকের মতে সম্ভবত ১৮৩০ সালে ইংরেজরা প্রথম ‘হিন্দু” এই কথাটির দ্বারা ভারতীয় উপমহাদেশে বসবাসকারী বেশিরভাগ মানুষের পরিচয় দিতে শুরু করে এবং বিগত ২০০০ বছরেরও বেশি সময়ব্যাপী ভারতীয় সভ্যতাকে এই নামে অভিহিত করা শুরু করে। এই সভ্যতার মূল উৎস বৈদিক সভ্যতা। হিন্দু শব্দটিও এসেছে সিন্ধু নদীর নাম থেকে—সিন্ধু নদীর তীরবর্তী সভ্যতা তথা মনুষ্যগোষ্ঠীর নাম হিসেবে। তবে হিন্দু এই কথাটির উৎস হিসেবে ফার্সি ‘হিন্দু’ কথাটিরও উল্লেখ করা হয়। প্রাচীন মুসলিম আরবী ও ফার্শী সাহিত্যে ‘সিন্দ হিন্দ’ দেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। বর্তমানের আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান ও সিন্ধুপ্রদেশ ‘সিন্দ দেশ’ নামে এবং তার পূর্বদিকের অঞ্চলকে অর্থাৎ বর্তমান ভারত ভূখণ্ডকে ‘হিন্দ দেশ’ নামে অভিহিত করা হতো।
‘হিন্দু’ নামকরণটির উৎস যাই হোক না কেন, এটি স্পষ্ট যে বেদে বা উপনিষদে, কিংবা কোনো ‘দেবতা’র বা মুনিঋষির মুখ থেকে হিন্দু নামকরণটি হয়নি। হিন্দু হিসেবে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা তাঁদের এই নামটি পেয়েছেন বিদেশীদের কাছ থেকে।
এখনকার হিন্দুধর্ম সুনির্দিষ্ট তিনটি স্তর অতিক্রম করে এসেছে — বৈদিক, ব্রাহ্মণ্য এবং সবশেষে ‘হিন্দু’। ভারতীয় ভূখণ্ডেই মূলত এর বিকাশ — আরবে যেমন ইসলাম, ইউরোপে খ্রীস্ট, চীনে তাও ইত্যাদি। বৈদিক সভ্যতার শুরুও তখনকার বিচারে বহিরাগতদের দ্বারা, যাঁরা পরবর্তীকালে ‘আর্য’ নামে পরিচিত হন; প্রায় ২০০০-১৫০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে মধ্য এশিয়ার পারস্য (ইরানীয়) অঞ্চলের এক যাযাবর মনুষ্যগোষ্ঠী ভারতীয় অঞ্চলে প্রবেশ করেন, তাঁরাই এই নামে পরিচিত। (আরেক গোষ্ঠী যায় ইউরোপীয় অঞ্চলে।) *
[*ইরাণীয় অঞ্চল থেকে যাঁরা ধীরে ধীরে ভারতীয় ভূখণ্ডে এসেছিলেন তাঁরা একটি বিশেষ মনুষ্যগোষ্ঠীই—কিন্তু তাঁদের ‘আর্যজাতি’ নামে অভিহিত করা যথার্থ নয়। ঐ সময় প্রকৃতপক্ষে ‘আর্য”“ নামে আদৌ কোন জাতি যথাসম্ভব ছিলই না, এটি একটি ভাষা গোষ্ঠীর নাম। সংস্কৃত, ল্যাটিন ও গ্রীক —প্রধানত এ তিনটিই আর্যভাষা। ল্যাটিন থেকে সৃষ্টি হয়েছে ইটালিয়ান, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, রুমানিয়ান ইত্যাদি ভাষা। টিউটনিক (ইংরাজ, জার্মান, সুইডিস ইত্যাদি) ও শাতিক (রাশিয়ান, পোলিশ ইত্যাদি) — এ দুটি গোষ্ঠী আর্যভাষা গোষ্ঠীর উপবিভাগ। অন্যদিকে এশিয় অঞ্চলে সংস্কৃত থেকে প্রথমে পালি (বা মাগধি) ও কিছু প্রাকৃত ভাষা এবং পরে এদের থেকে হিন্দী, পাঞ্জাবী, বাংলা, মারাঠী, ইত্যাদি ভাষার সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশে যেমন তামিল, তেলেগু, কানাড়া, মালায়ালম, টুলু ইত্যাদি ভাষা অনার্য বা আর্য-সম্পর্ক রহিত, তেমনি হিব্রু, আরবি, ফিনিশ, হাঙ্গেরিয়ান, বাস্ক (Basque) ইত্যাদি ভাষা সহ চীনা, জাপানী, তিব্বতীয়, মঙ্গোলিয়া ইত্যাদি ভাষাও অনার্য। ‘আর্য’ কথাটিকে জাতি হিসেবে ও শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে গণ্য করার প্রবণতা পরবর্তীকালে বিকৃতি হিসবে ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে সৃষ্টি হয়েছে। হিটলার ও তার অনুগামীসহ ইয়োরোপের কিছু গোষ্ঠী যেমন এই কাজ করেছে, তেমনি ভারতীয় অঞ্চলের কিছু ব্যক্তিও উগ্র, জাত্যভিমানে ভুগে এমন ধারণার প্রচার করেছেন। বৈদিক তথা সংস্কৃত সাহিত্যে ‘আর্য’ বলতে সম্মানিত ব্যক্তিকে বোঝানো হত (Sir বা মহাশয়); মূল সংস্কৃতে এর অর্থ জন্ম স্বাধীন (Free-bom) বা সদাশয় ব্যক্তি।
তবে যাই-ই হোক না কেন, ভারতের বর্তমান হিন্দুদের পূর্বপুরুষ আর্যভাষীরা যে ইরাণীয় অঞ্চল থেকে এসেছিলেন তা মোটামুটি নিশ্চিত। (অবশ্য কেউ কেউ এব্যাপারে কিছু ভিন্ন মতও পোষণ করেন।) ‘ইরান’ (অন্য নাম ‘পারস্য’) কথাটিই এসেছে ‘আর্থনাম’ (অর্থাৎ আর্যদের দেশ) শব্দ থেকে। মূল আর্যভাষাগোষ্ঠীর লোকেরাই যাযাবরবৃত্তি করতে করতে নানা এলাকায় ছাড়িয়ে যায়।
আরেকটি দিকও যা নিশ্চিত তা হল, ‘আর্য’ কথাটি ভারতীয় হিন্দুদের একচেটিয়া নয়, বরং তাঁদের বাইরে এই ভাষাগোষ্ঠীর লোকেরাই বেশি সংখ্যায় আছেন। সংস্কৃতকে দেবভাষা হিসেবে কল্পনাও নিছকই কল্পনা এবং নিজ শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার একটি কৌশল।
সব মিলিয়ে ‘আর্যজাতি’ নামে কোন জাতি ছিল না। এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তাঁর “ভারতীয় জাতিবর্ণ প্রথা” গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, “আর্য নামক ধারণাটির সত্যই কোন সার্থকতা ভারত ইতিহাসের ক্ষেত্রে নেই।”
প্রকৃতপক্ষে তাঁরা ছিলেন, আর্যভাষী। কিন্তু ব্যাপকভাবে ভুল প্রয়োগের ফলে আর্য, আর্যজাতি, আর্যভাষা—সব একাকার হয়ে গেছে।]
তখন নব্যপ্রস্তর যুগ শেষ হয়ে গেছে, ব্রোঞ্জ ও লৌহ যুগের বিকাশ ঘটছে। বাড়ছে জনসংখ্যা ও চাহিদা, উন্নত হচ্ছে উৎপাদন পদ্ধতি। এসবেরই ফলশ্রুতিতে অথবা স্থানীয় অঞ্চলে অন্তর্বিরোধের ফলে, একটি গোষ্ঠী সুবিধাজনক নতুন জনপদ স্থাপনের জন্য পরিভ্রমণ করতে করতে ভারতীয় অঞ্চলের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করে। এরা সঙ্গে আনে পোষমানা ঘোড়া, রথ ও সুললিত ভাষা যা বৈদিক ভাষা বা আদি সংস্কৃত নামে পরিচিত। এসব গুলিই এ-অঞ্চলের আদি বসবাসকারী মানুষদের কাছে অপরিচিত ছিল। শুরুতে এই ভাষায় রচিত সাহিত্য ছিল মৌখিক অর্থাৎ শ্রুতি। খ্রীস্টপূর্ব ১৩০০-১২০০ সাল নাগাদ সম্ভবত বর্তমান পাঞ্জাব অঞ্চলের ঘটনাবলী নিয়ে এগুলি সুসংহত ও লিখিত হয়ে আদি বেদ, ঋগবেদের জন্ম দেয়। ঋগবেদে ‘আর্য’-দের উল্লেখ আছে, যাদের দেবতা ছিল সাদা (কিন্তু নিজেরা নয়—–অন্তত ইয়োরোপীয়দের মতো) এবং উল্লেখ আছে দাস বা দস্যুদের—-যারা ছিল কৃষ্ণকায়, অনাসা, অব্রাহ্মণ, অ-দেবায়ু, অ-ব্রত, ইত্যাদি। স্পষ্টতই এই শেষোক্তে দলটি ছিল ঐ অঞ্চলের আদি বাসিন্দা, যাদের রঙ ছিল কালো। অবশ্যই এদেরও ছিল নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস (প্রায়শই ঐতিহাসিক যুগের পূর্ববর্তী অর্থাৎ নব্যপ্রস্তরযুগীয়), আচার-অনুষ্ঠান। কিন্তু ধাতু ও ঘোড়ার ব্যবহারকারী, ‘শিক্ষিত’ রথারোহী যোদ্ধা-যাযাবর (পরবর্তীতে কৃষিজীবী) সংখ্যালঘু তথাকথিত আর্যগোষ্ঠীর কাছে এরা পরাজিত হয় এবং আর্য ভাষীদের সভ্যতাই প্রাধান্য লাভ করে; প্রতিষ্ঠিত হয় বৈদিক ধর্ম। (তবে এই অনার্য আদিবাসীদের সভ্যতাও অনুন্নত ছিল না। ঋগবেদেই তাদের নগরী আবৃত্তপুর-এর উল্লেখ আছে। ‘দাস’ কথাটিও ইন্দো-ইরাণীয় ভাষায় আদিতে ছিল শত্রু’-র সমার্থক,—পরবর্তীতে পরাজিত শত্রুদের সম্পর্কে সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।)
বৈদিক ধর্মের আগে ভারতীয় অঞ্চলের শক্তিশালী ধর্মবিশ্বাস ছিল -মোঅনজোদড়ো হরপ্পা অঞ্চলের অধিবাসীদেরও। কিন্তু আর্যদের শক্তি ও সংস্কৃতি এসব কিছুকে ছাপিয়ে যায়। তারা ক্রমশ শাসকগোষ্ঠী যেমন হয়, তেমনি এতদঅঞ্চলের লোকেদের সঙ্গে মিলে-মিশেও যায়— ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রেও যে সংমিশ্রণ ধীরে ধীরে ঘটেছে। সিন্ধুসভ্যতা বা হরপ্পা সংস্কৃতি (২৮০০-১৭০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ) আর্যদের দৈনন্দিন জীবন ও ধর্মাচরণে উল্লেখযোগ্য ছাপ ফেলে। সিন্ধু সভ্যতায় দেবীপুজা ও ষাঁড়ের ধর্মীয় প্রতীকী রূপ বহুল প্রচলিত ছিল। সম্ভবত তিনমাথা ওয়ালা এক দেবতার আরাধনাও করা হত। এসবগুলিও পরবর্তীকালে বৈদিক তথা হিন্দুধর্মে সামান্য পরবর্তিত আকারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। হরপ্পা সংস্কৃতিতে কোন মন্দিরের অস্তিত্ব যথা সম্ভব ছিল না। কিন্তু ধর্মাচরণের অন্যতম অঙ্গ হিসেবে সাধারণের যৌথ স্নানের ঘর ছিল—পরবর্তীকালে হিন্দুধর্মে যা স্নানের ঘাটে রূপান্তরিত হয়েছে। সিন্ধুসভ্যতার প্রায় প্রতি বাড়ীতে ছিল বাথরুম বা স্নানঘর। এ ধরনের কিছু চিহ্ন দেখে অনুমান করা হয় — স্বাস্থ্যের কারণের চেয়েও শরীরকে পরিষ্কার করাটা আধ্যাত্মিক পবিত্রতা তথা ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। হিন্দুধর্মেও এটি গভীরভাবে অনুসরণ করা হয়েছে। হরপ্পা সংস্কৃতিতে মৃত ব্যক্তিকে কবর দেওয়া হত—যা অবশ্য হিন্দুরা অনুসরণ করেননি। তবে গুজরাটের একটি হরপ্পা-এলাকায় এক সঙ্গে একজন পুরুষ ও একজন নারীকে কবর দেওয়া হয়েছে বলে দেখা গেছে। এসব থেকে অনুমান করা হয় হিন্দুধর্মের(?) সতীপ্রথার পূর্বতন রূপ সিন্ধু-সভ্যতায় সামান্য হলেও ছিল। এছাড়া বৈদিক ধর্ম বা সভ্যতায় পূর্বসূরী ঐ সভ্যতার পবিত্র প্রাণী, পবিত্রগাছ (যেমন অশ্বত্থ), ছোট ছোট মূর্তির পুজা ইত্যাদিও প্রচলিত ছিল- এগুলিও পরবর্তীকালে বাতিল করা হয় নি। অবশ্য ভারতীয় ভূখণ্ডে তথা পৃথিবীর প্রায় সব এলাকাতেই কম বেশী এধরনের ধর্মানুষ্ঠান প্রচলিত ছিল।
আর শুধু সিন্ধু সভ্যতার প্রভাব নয়, বেদ-রচিয়তারা যে ইরানীয় অঞ্চল থেকে ধীরে ধীরে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করে, ঐ ইরানীয় অঞ্চলের প্রাচীন ধর্মানুষ্ঠান ও ধর্মীয় বিশ্বাসের রেশও আর্যদের ধর্মবিশ্বাস ও অনুষ্ঠানাদিতে লক্ষ্য করা যায়। ইরানীয় অঞ্চলের জোরোঅ্যাস্ট্রিয়ানদের মধ্যে গলা দিয়ে সুতো গলিয়ে বা বেঁধে একটি শিশুর ধর্মীয় উত্তরণের প্রথা প্রচলিত ছিল। হিন্দুধর্মে এই সুতো পৈতে হিসেবে ঐ পদ্ধতি উপনয়ন হিসেবে গৃহীত হয়েছে। জোরোঅ্যাস্টিয়ানদের দেবতা আহুরা মাজদা-র সঙ্গে বৈদিক দেবতা বরুণের সাদৃশ্য প্রকট। বেদবর্ণিত সোমরস ও জোরোঅ্যাস্ট্রিয়ানদের ‘হোঅম’ প্রায় অভিন্ন।
ইরানীয় অঞ্চলের প্রাগৈতিহাসিক মানুষদের একটি দল ইয়োরোপে যায়। ইয়োরোপীয় অঞ্চলের কিছু প্রাচীন ধর্মানুষ্ঠানের সঙ্গেও ভারতীয় ‘আর্য’ তথা হিন্দুদের ধর্মানুষ্ঠানের মিল লক্ষ্য করা যায়। বিয়ের সময় অগ্নি সাক্ষী করা তথা আগুনের চারপাশে ঘোরা, মৃত্যুর পর শবদাহ পদ্ধতি এবং পূর্বপুরুষদের ‘শান্তির’ জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান বা আকাশের দেবতা হিসেবে এক ‘দেবতা’ (পুরুষ)-কে পূজা করা ইত্যাদি ধরনের নানা সাদৃশ্যই রয়েছে। যার অর্থ এসবের উৎস একই
এছাড়া পরবর্তীকালে স্থানীয় আদিবাসী গোষ্ঠীর ও অন্যান্য নানা অঞ্চলের মনুষ্যগোষ্ঠীর বিভিন্ন বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানাদি হিন্দুধর্মে অনুপ্রবেশ করে যা শুধু হিন্দু ধর্ম নয়, সব ধর্মের ক্ষেত্রেই কম বেশি সত্যি এবং এসব অনুষ্ঠান যে কৃত্রিম, আরোপিত ও মনুষ্যসৃষ্ট তা এই ধরনের সংযোজন-বিয়োজন থেকেও বোঝা যায়।
ভারতীয় উপমহাদেশীয় অঞ্চলে আসার পর, এখান থেকে আহরিত, এখানে প্রয়োজন অনুযায়ী বিকশিত বিশ্বাস, বিধি-নিষেধ, আচার-অনুষ্ঠান, নিয়ম-কানুন ধর্মাচরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। কালী বা শিবলিঙ্গের পূজা, পাথরের টুকরো বা গাছকে দেব-দেবী হিসেবে কল্পনা করা, ইত্যাদি এতদ অঞ্চলের আদিবাসীদের থেকে গ্রহণ করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। অন্যদিকে আর্যদের মধ্যেকার সুদক্ষ, বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা নতুনতর তত্ত্বের আবিষ্কার করেন, যেমন ব্রহ্মের তথা ঔপনিষেদিক ধারণাবলী।
আর্যরা প্রথমে আসে উত্তর-পশ্চিম ভারতে, তাদের মধ্যেকার সুদক্ষ যোদ্ধা ও নেতারা রাজা বা গোষ্ঠীপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়; এরা পরবর্তীকালে গঙ্গার অববাহিকা অঞ্চল ও উত্তরপূর্ব ভারতেও তাদের আধিপত্য বিস্তার করে। ঋগবেদ ও পরবর্তীকালে রচিত অন্যান্য বেদের মধ্যে এই ক্রমবর্ধমান আধিপত্য ও এই প্রচেষ্টাকে সফল করার জন্য, কল্পিত দেবদেবীর কাছে কাকুতি মিনতি, দেবদেবীর কাছে সোনা দানা, ও সুন্দরী নারী থেকে শুরু করে গরুঘোড়া অস্ত্র-শস্ত্রের জন্য প্রার্থনা করা ইত্যাদি ছড়িয়ে আছে। আর আছে নানা রোগকষ্ট, বিপদ-আপদ থেকে মুক্ত হওয়ার আশায় সংস্কৃত ‘মন্ত্র’ উচ্চারণ করার উপর বিশ্বাস। কল্পিত রাক্ষসদের বিনাশ করা থেকে গলার ব্রণ হলে তার চিকিৎসা, কুষ্ঠ-যক্ষ্মা-জণ্ডিস সারানো থেকে শুরু করে ‘স্বামীর স্ত্রীর মধ্যে পরস্পরের ক্রোধ অপনয়ন’ অব্দি, কিংবা সাপ বিছা কামড়ানোর চিকিৎসা থেকে ‘ভার্যার সহমরণের ঐচ্ছিক প্রবৃত্তি ও নিষেধ মন্ত্রাদি’ পর্যন্ত—অজস্র কারণের জন্য বৈদিক মন্ত্র লেখা আছে। যে হিন্দুরা বেদকে সনাতন, অভ্রান্ত ইত্যাদি হিসেবে বিশ্বাস করেন তাঁরাও কেউ আজকাল এভাবে বেদকে অনুসরণ করেন না—হিন্দু সংগঠনের নেতা থেকে শুরু করে ‘ক্যাডার’ অব্দি প্রায় সবাই-ই। অর্থাৎ এঁরা বেদে আস্থা না রেখে বা বেদবিরোধী হয়েও, বেদে বিশ্বাসী।
চারটি বেদ কোনো এক জনের দ্বারা স্বল্প সময়কালে রচিত হয় নি। বৈদিক বিশ্বাস ও নীতিমালা বহু শতাব্দী ধরে বহু জনের দ্বারা রচিত, পরিমার্জিত ও সংকলিত হয়ে একটি চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে। গৃৎ সমদ, বিশ্বামিত্র, বামদেব, অত্রি, ভরদ্বাজ, বশিষ্ঠ, কাধ থেকে শুরু করে ভৃগু, অথবা, অঙ্গিরা, ব্রহ্মা, বুদ্ধ, অজমীঢ়, নারায়ণ ইত্যাদি অজস্র ‘ঋষি’ ও তাঁদের পরিবারের লোকেরা এসব কবিতা লেখেন। লোপামুদ্রা, অপালা মৈত্রেয়ী, যমী, কাক্ষীবতী ঘোষা, সূর্যা, ঊর্বশী, বাক্, ব্রহ্ম-জায়া, যমী, ইন্দ্রানী, শ্রদ্ধা কামায়নী, পৌলোমী, শচী ইত্যাদি নানা মহিলা কবি বা ‘ঋষিকা’-ও নানা বেদমন্ত্র রচনা করেছেন। সমস্ত বেদ ও পরবর্তীকালের সংহিতা ও ব্রাহ্মণের রচনা ও সংকলন সম্ভবত খ্রীস্টপূর্ব ৮ম শতাব্দীতেই শেষ হয়ে যায়।
নিছক কল্পনা ও পূজা-প্রার্থনা-কাকুতি-মিনতিই নয়, বেদের মধ্যে প্রাচীন ভারতীয়দের বিজ্ঞান-চর্চারও প্রমাণ পাওয়া যায়। জৈমিনীয় উপনিষদ ব্রাহ্মণে ধাতু গলানো ও খাদ মেশানোর পদ্ধতির আভাস পাওয়া যায়। গোপথ ব্রাহ্মণ পূর্বভাগে সোনা, রূপা, লোহা, সীসা, টিন-এর কাজ সম্পর্কে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ধাতুগুলিতে রাসায়নিক ও খাদ মেশানোর কথা বলা হয়েছে। দশমিক গণনা পদ্ধতি, ভগ্নাংশ, পাটীগণিত বীজগণিত-জ্যামিতির নানাবিধ সূত্র ইত্যাদির আবিষ্কার ও উন্নতির পরিচয় বেদ, সংহিতা ও ব্রাহ্মণে উল্লেখযোগ্য ভাবে রয়েছে। জ্যোতিষ বেদাঙ্গ, সূর্যপ্রজ্ঞপ্তি ইত্যাদি জ্যোতির্বিদ্যার বইও লেখা হয়। কিন্তু এ-জাতীয় নানা বিজ্ঞান-চর্চার আকাশ ঢেকে ছিল আধ্যাত্মিকতা ও কল্পনার ধোঁয়াশা—তাই বেদ-সংহিতা-ব্রাহ্মণ বললে সাধারণভাবে কখনোই বৈদিক যুগের বিজ্ঞান-চর্চার ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে না। পরে একই ভাবে আয়ুর্বেদের নানা বস্তুবাদী চিন্তাকেও হতমান করা হয়।
খ্রীস্টপূর্ব ১০০০ সাল নাগাদ আর্যদের দ্বারা সিন্ধু ও গঙ্গার বিশাল উপত্যকা অঞ্চলে (উত্তর ভারত ও উত্তরপশ্চিম ভারত) ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। রাজা ও পুরোহিত গোষ্ঠী শাসকশ্রেণী হিসেবে সুসহংত হয়ে ওঠে। বিপুল সংখ্যক অনুগত প্রজা বা দাসেদের আনুগত্য সুনিশ্চিত করার জন্য ক্রমশ অনুভব করা যায় যে, বৈদিক তত্ত্বাবলী অসার হয়ে উঠেছে। শাসক ও শাসিতের সংঘাত এবং শাসকশ্রেণীর মধ্যেকার সংঘাত তথা রাজায় রাজায় ক্ষমতার লড়াই দেখা দিতে থাকে। এ সময় ধর্মের আবরণে এমন একটি তত্ত্বের প্রয়োজন হয়, যা চমকপ্রদ ও নতুন। আবিষ্কৃত হয় ব্রহ্মতত্ত্ব, রচিত হয় উপনিষদের শ্লোকগুলি। আর্যরা এ-দেশে আসার আগে এখানে ছিল অজস্র দেবতা (এক জায়গায় উল্লেখ আছে ৩,৩৯১টি দেবতা ছিল—তবে এরা ছিল প্রায়ই লৌকিক, পারিবারিক বা সীমাবদ্ধ ‘ক্ষমতার’ দেবতা)। বেদেও ইন্দ্র, বরুণ, সূর্য, পূষণ, মিত্র, বিষ্ণু ইত্যাদি নানা নামের দেবতায় বিশ্বাসের কথা প্রচার করা হয়। কিন্তু এসবে যখন আর কাজ হল না, তখন ধরা ছোঁয়ার বাইরে, নৈর্ব্যক্তিক, সর্বব্যাপী, সর্বশক্তিমান, অজর অমর ইত্যাদি গুণাবলী সম্বলিত ব্রহ্মের ধারণা প্রচার করা হয়। আগের দেবদেবী অনেকটাই ছিল যেন মানুষই। ইন্দ্ররা মদ খেত, রেগে যেত, সুন্দরী মেয়ের পেছনে ছুটত, শক্তিশালী শত্রুরা তাদের হারিয়ে দিয়ে বেইজ্জত ও নাজেহাল করত—ইত্যাদি ধরনের নানা মানবিক দিকের কথা বেদে উল্লেখ আছে। কিন্তু ধর্ম তথা দেবতার এ ধরনের ছবি সাধারণ মানুষকে আর ভুলিয়ে রাখার পক্ষে যথেষ্ট নয় বলে অনুভব করা গেল। এই দুর্বলতা কাটাতে শাসকদের দ্বারা (অনেকের মতে রাজা প্রবাহণের দ্বারা) ব্রহ্মের যে ধারণা, প্রচার করা হলো তা মানুষকে ভুলিয়ে রাখার পক্ষে উপযুক্ত বলে প্রমাণিত হলো। এই ব্রহ্ম নিরাকার, দুয়ে। সারাজীবন ‘সাধনা’ করেও তাকে জানা প্রকৃতই অসম্ভব—তবু ঐ লোভই দেখানো হল। মূলত এই তত্ত্বকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রচার করার জন্য সৃষ্টি হলো অতি উন্নত মানের, সুললিত, সুখশ্রাবী অসাধারণ সাহিত্য, উপনিষদ। খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যেই এই উপনিষদের রচনা ও সংকলন শেষ হয়। অস্ত্র শস্ত্র দিয়ে নয়, জোরজবরদস্তি করে নয়- নিছক একটি গাঁজা খুরি কল্পনা কিভাবে বহুশত বছর ধরে ও এখনো অব্দি, বিপুল সংখ্যক মানুষকে নিবীর্য ও অনুগত করে রাখতে পারে তার একটি বড় উদাহরণ এই ব্রহ্ম তথা উপনিষদের ব্রাহ্ম তত্ত্ব।
মোটামুটি এই সময়কালে (খ্রীস্টপূর্ব সপ্তম বা পঞ্চম শতাব্দী ও তারপরে) বৈদিক ধর্মের আরেকটি যে বিপুল রূপান্তর ঘটে তা হলো বর্ণভেদ প্রথার সৃষ্টি। আদি বেদে তার সুনিশ্চিত ও সুনির্দিষ্ট কোনো উল্লেখ নেই, পরবর্তীকালে সংহিতা ও ব্রাহ্মণে কিছু উল্লেখ আছে। তবে যজুর্বেদের আমলেই জাতিভেদ প্রথা স্পষ্টভাবে ও চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। শাসকশ্রেণীর প্রয়োজনেই ধর্মের নাম করে, ঈশ্বর এইভাবে সৃষ্টি করেছেন—একথা প্রচার করে; এবং করেছেন- এই সঙ্গে কর্মবিভাজনের সামাজিক প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র—এই চার বর্ণের তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইতোমধ্যেই ঈশ্বর-অলৌকিকত্ব সম্পর্কে বিশ্বাস সাধারণ মানুষের মনে সুদৃঢ় হয়ে গেছে। ঐ ঐশ্বরিক শক্তির প্রতিনিধি হলো সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাশালী ও ভীতিপ্রদ, সর্বাপেক্ষা সুবিধাভোগী ও শিক্ষিত বা মেধাসম্পন্ন গোষ্ঠী ব্রাহ্মণ। এরই ঘনিষ্ঠতম সহায়ক হলো যোদ্ধাগোষ্ঠী তথা ক্ষত্রিয়, আর এদের সহযোগী হলো বৈশ্য (জমিদার, ব্যবসায়ী, রাজকর্মচারী, গোপালক)। এবং এদের সবার অনুগত, দাসানুদাস হলো শূদ্র শ্রেণী—–সংখ্যায় যারা বিপুল। গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের শ্রমের দ্বারা উদ্বৃত্ত উৎপাদন না হলে তখনকার ঐ সমাজের পক্ষে ঐভাবে টিকে থাকা সম্ভবও ছিল না। এর ফলে সম্পদশালী ব্যক্তিদের বিপুল সংখ্যায় ক্রীতদাস রাখার দরকার হল না। দাসপ্রথা পুরোপুরি চালু না করেই, বর্ণভেদকে ধর্মীয় রূপ দিয়ে একই উদ্দেশ্য সফল করা হল—সামাজিক ও ব্যক্তিগত উৎপাদন ও সম্পদ বৃদ্ধি করা গেল। পূর্ববর্তী তিনটি বর্ণকে বলা হলো দ্বিজ (এদের উপনয়ন করা হত), এরা শ্রেষ্ঠতর। শ্রেষ্ঠতম অবশ্যই ব্রাহ্মণ। এই ব্রাহ্মণদের মস্তিষ্কে কী বুদ্ধি ছিল আর হাতে কী অসীম ক্ষমতা ছিল তার প্রমাণ ঐ সময়কার সমস্ত সাহিত্যেই ভালোভাবে রয়েছে। এই পুরোহিত শ্রেণী যে পুঁথিপত্র লিখল, তাতে নিজেরাই নির্লজ্জভবে জানাল ‘রাজার পক্ষে পুরোহিতের সহায়তা অবশ্য প্রয়োজনীয়, এমনকি দেবতাদের পক্ষেও ঠিক পথে চলার জন্য পুরোহিতের প্রয়োজন।’ (তৈত্তেরীয় সংহিতা ২/৫/১/১, ৫/১/১০/৩) ‘পুরোহিত ক্ষত্রিয়ের অর্থ আত্মা, কেননা পুরোহিতবিহীন রাজার অন্ন দেবতারা গ্রহণ করেন না।’ (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, ৩৮/৪, ৪০/১) ইত্যাদি ইত্যাদি। ক্ষত্রিয়রা ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের হয়েই রাজ্য শাসন করবে—এ রকমই ব্যাপার। শূদ্রদের তো বটেই, বৈশ্যদের সম্পর্কেও বলা হল, মানুষদের মধ্যে বৈশ্য ও পশুদের মধ্যে গরু ভোগের সামগ্রী। (তৈত্তেরীয় সংহিতা; ৭/১/১/৫) বৈশ্যরা অপরকে (অর্থাৎ সংখ্যালঘু ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়কে) করপ্রদান করে ও খাদ্য জোগায়। (শতপথ ব্রাহ্মণ; ৪/৩/৩/১০) ইত্যাদি ইত্যাদি। আর শুভ্র তথা দাসদের সম্পর্কে তো অসংখ্য কঠোরতা ও অপমান। শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে, ‘নারী, শূদ্র, কুকুর ও কালো পাখি হল অসত্য, পাপ ও অন্ধকার— তাই এদের প্রতি দৃষ্টিপাত করা উচিত নয়’। আপস্তম্ব ধর্মসূত্রে শূদ্রের পত্নীকে অন্য তিন বর্ণের পুরুষেরা যথেচ্ছ ভোগ করতে পারে বলে বলা হয়েছে। এবং এ ধরনের সহস্র সহস্ৰ অনুশাসন।
সমস্ত ক্ষমতা করায়ত্ত করলেও, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের নৈতিক মান ও শৃঙ্খলা রক্ষার কথাও বলা হয়। ত্যাগ স্বীকার করা, অধ্যয়ন করা, প্রয়োজনাতিরিক্ত ভোগ না করা—এসবের কথা জোর দিয়েই বলা হয়। কিন্তু এসব কথা তখনি বলা হয়, যখন তাদের শাসক গোষ্ঠী হিসেবে অবস্থান অতি সুরক্ষিত করা হয়ে গেছে। পাশাপাশি এই অবস্থান সুরক্ষার স্বার্থেও এমন সংযত, অনুচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন প্রয়োজন ছিল। এই চতুর্বর্ণপ্রথার বিধিনিষেধ, নিয়মকানুন অর্থাৎ তখনকার সমাজ ব্যবস্থার, শাসকশ্রেণীর স্বার্থবাহী সংবিধানের সংকলিত রূপ ছিল মনুসংহিতা। এর সৃষ্টি হয় আনুমানিক খ্রীস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে—যদিও ক্রমশ সংকলিত ও লিখিত রূপ পায় আরো পরে। (পি ভি কানে তাঁর History of Dharmasastra -এ এই সময়কালকে খ্রীস্টপূর্ব ২০০ থেকে ২০০ খ্রীস্টাব্দ বলে উল্লেখ করেছেন।)
খ্রীষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দী সময়কাল থেকে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর অঞ্চলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুস্থিতিও বিনষ্ট হতে থাকে। যৌথ সম্পত্তির ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিকাশ ঘটতে থাকে। ছোট ছোট জনগোষ্ঠী তার স্বাধীন অস্তিত্ব হারাতে থাকে বড় বড় রাজ্য তাদের অধিকার করে বৃহৎ সাম্রাজ্য গঠন করতে থাকে। এই অবস্থাকে বলা হয় ‘মাৎস্য ন্যায়’, যখন শক্তিশালীরা দুর্বলদের গ্রাস করে ফেলছে—যেন বড় মাছ গিলে ফিলছে ছোট মাছেদের। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও প্রতিযোগিতা বাড়ছে—মূলত গঙ্গা দিয়ে বাণিজ্যের প্রসার ঘটার ফলে। এই ধরনের ক্রমবর্ধমান সামাজিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা, কিছু মানুষের মধ্যে সমাজ ত্যাগ করে বিচ্ছিন্নভাবে তথাকথিত অধ্যাত্মিক জীবন যাপনের মানসিকতার সৃষ্টি করে।
এই মানসিকতা বৈদিক অনুপ্রেরণায় উৎসাহিত হয়। ফলে দেখা যায় খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী সময়কালে সমাজের বিপুল সংখ্যক অগ্রণী সক্ষম ব্যক্তি গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাস নেওয়াকে মানসিক শান্তি ও আধ্যাত্মিক মুক্তির উপায় হিসেবে কল্পনা করছেন ও গ্রহণ করছেন।
ব্যাপকভাবে এই সন্ন্যাস নেওয়ার (asceticism) প্রবণতা ছড়িয়ে পড়তে থাকায় সামাজিকভাবে শূণ্যতা সৃষ্টি হতে থাকে। বেদ সমাজের উচ্চশ্রেণীর মানুষের জন্যই নির্দিষ্ট করা ছিল। সন্ন্যাসের ব্যাপকতা এদের মধ্যেই শুরু হয়—সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের এ নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না। এর ফলে শাসকগোষ্ঠীর মধ্যেই এই শূন্যতা বিশেষ করে অনুভূত হতে থাকে। আর একে আটকাতে নেতৃস্থানীয় ব্রাহ্মণ পুরোহিতেরা উচ্চশ্রেণীর মানুষ তথা দ্বিজদের জন্য নতুন এক ধরনের প্রথার জন্ম দেন—যা চতুরাশ্রম হিসেবে পরিচিত। জীবনের চারটি ভাগের কথা প্রচার করা হয় — ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বাণপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। এ ধরনের শৃঙ্খলার ফলে, শুধুমাত্র বৃদ্ধ তথা অক্ষম ব্যক্তিদের জন্যই সন্ন্যাস গ্রহণের অনুমোদন দেওয়া হল। হয়তো সবাই তা মানেন নি, কিন্তু এই চতুরাশ্রমের সমর্থনে নানা ব্যাখ্যামূলক কথাবার্তা চালু হল এবং যুবক, তরুণ বা সক্ষম ব্যক্তিদের মধ্যে সন্ন্যাসের প্রবণতা অনেকটা আটকানো গেল। বর্ণভেদ ও চতুরাশ্রম —উভয়ে মিলে হিন্দু ধর্মের মূল্যবান, অবিচ্ছেদ্য বর্ণাশ্রম ধর্মের সৃষ্টি হল। এবং ধর্মের আবরণে সামাজিক শৃঙ্খলার নতুনতর দিকের জন্ম দেওয়া হল।
এবং বেদ পরবর্তী হিন্দুধর্মের ব্রাহ্মণ্য অধ্যয়েরও সূচনা হলো যার উন্মেষ ঘটেছিল সংহিতা ও ব্রাহ্মণ গ্রন্থের পর্যায়ে। মূলত নিজেদের রচনা করা এই সব সংবিধানিক নিয়মাবলীতে ব্রাহ্মণরা নিজেদের চূড়ান্ত ক্ষমতাশালী করে তুলল। ক্ষত্রিয় তথা রাজারা দেখল এই তথাকথিত আধ্যাত্মিকতার ধ্বজাবাহী, ধোঁয়াটে ধর্মতত্ত্ব প্রচারকারী গোষ্ঠী ছাড়া বিপুল সংখ্যক প্ৰজাকে দারিয়ে রাখা সম্ভব নয়। ব্রাহ্মণদের দ্বারা প্রজাদের মস্তিষ্ক আধ্যাত্মিক নেশায় আচ্ছন্ন করে রেখে ক্ষত্রিয়রা সহজেই রাজ্য শাসন করতে পারল। বর্ণভেদ প্রথায় এ অলস কাজের দায়িত্ব পেল শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ। অনুগত অন্যরা এবং ব্রাহ্মণদের মধ্যে নারীরাও অলৌকিক শক্তির অনুগ্রহ লাভের জন্য ক্রিয়াকর্ম করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে।
কিন্তু ব্রাহ্মণরা যতই হাজারো নিয়মকানুন করে নিজেদের ক্ষমতা ও আধিপত্যকে সুনিশ্চিত করতে থাকল, তার আংশিক প্রতিক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছু বিক্ষোভ, অসন্তোষ, অবিশ্বাসও সৃষ্টি হতে থাকল। এর আঁচ পেয়ে উন্নত মেধাসম্পন্ন ব্রাহ্মণরা আরেকটি তত্ত্ব আবিষ্কার করল যা হলো কর্মফল ও পুনর্জন্মবাদের তত্ত্ব। বেদে আত্মার ধারণা ছিল, কিন্তু তা সুসংহত ছিল না। জন্মান্তরবাদের তত্ত্ব আদি বেদে একেবারেই ছিল না। ভারতের আদিবাসী দ্রাবিড় ও মুণ্ডাদের মধ্যে তথা প্রাগার্য তপস্বী সম্প্রদায়ের মধ্যে টোটেম ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এ-জাতীয় কিছু চিন্তার আভাস ছিল। কিন্তু হিন্দুধর্মের ব্রাহ্মণ্যপর্বে এই যে তত্ত্বের অবতারণা করা হলো তা সম্পূর্ণ চতুর্বর্ণপ্রথার পরিপুরক হিসেবে ও তাকে শক্তিশালী করার জন্য। কঠ, মুন্ডক ইত্যাদি উপনিষদে স্পষ্টভাবে পুনর্জন্ম এবং তা আটকাতে ব্রহ্মজ্ঞান, আত্মাকে জানা, ধর্মানুসরণ ইত্যাদির কথা সুস্পষ্টভাবে বলা শুরু হল। (অনেকের মতে এই কর্মফল ও জন্মান্তরবাদের অপতত্ত্বটি যাজ্ঞবঙ্ক্যের মস্তিষ্ক-প্রসূত।)
সমগ্র ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় সমাজ এই তত্ত্বকে লুফে নিল। কল্পিত-অজ্ঞাত পূর্বজন্মে খারাপ কাজ বা পাপ করা হয়েছিল বলেই জীবনের দুর্দশা, দারিদ্র্য, বঞ্চনা ইত্যাদি, এসবের পেছনে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় তথা শাসকশ্রেণীর কিছু করার নেই, —এ ধরনের চিন্তা যদি আপামর জনসাধারণের মধ্যে গেঁথে দেওয়া যায়, তাহলে রাজার অস্তিত্ব আর ব্রাহ্মণদের আধিপত্য অতি সুনিশ্চিত হবে এতে আর আশ্চর্য কী! একইভাবে জীবনে নিপীড়িত, নিষ্পেষিত, হতদরিদ্র হয়েও ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের তথা প্রভুর অক্লান্ত সেবা করলে ও তাদের দান খয়রাত করলে, চরম ত্যাগ স্বীকার করলে, মৃত্যু পরবর্তী জীবনে অতীব সুখে দিনাতিপাত করা যাবে—এ ধরনের আশা যদি মানুষের মনে জাগিয়ে রাখা যায়, তবে জীবনের নানা দুর্দশা ভুলে থাকার পক্ষে তা বিরাট ফলপ্রসূ। বর্ণভেদ প্রথার সফল বিকাশের পক্ষে এই চরম মিথ্যাচার ও প্রতারণা অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ষোলো কলা পূর্ণ হয়েছে হিন্দুধর্মের।
কিন্তু মানুষের অনুসন্ধিৎসা থেমে নেই। যদিও তুলনায় অনেক কম ও আশানুরূপ নয়, তবু এ সময়কালেই ভারতীয় অঞ্চলে চিকিৎসাবিদ্যা, পদার্থ-রসায়ন বিদ্যা, অঙ্কশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিদ্যার কিছু বিকাশ ঘটেছে। কিন্তু ব্রাহ্মণদের স্বার্থবিরোধী ছিল এই প্রকৃত বিজ্ঞানচর্চা। তাই এগুলিকেও ধর্মের নাম করে বিকৃত করা হয়েছে। আয়ুর্বেদের সঙ্গে ধর্মীয় তত্ত্বাবলী মেশাতে বাধ্য করা হয়েছে, জ্যোতির্বিদ্যার সঙ্গে কর্মফল ও অলৌকিকত্ব মিশিয়ে জ্যোতিষবিদ্যার মতো অপবিজ্ঞানের জন্ম দেওয়া হয়েছে।
ব্রাহ্মণরা (এবং এখনকার হিন্দুরা) বেদকে শিরোধার্য করে সামনে রাখলেও, প্রকৃতপক্ষে তাকে মাথায় তুলেই রাখা হয়েছে— চোখে দেখা হয় নি। চতুর্বর্ণ, কর্মফল, পুনর্জন্ম—এ সবের কোনোটিই ঋগ্বেদে ছিল না। বেদের বহু শ্লোকও আর অনুসরণ করার দরকার হয় না। বেদোত্তর কালে দার্শনিক উপলব্ধির মতো গালভরা নাম দিয়ে, অলস মস্তিষ্কগুলি তাত্ত্বিক বিতর্ক আর কাল্পনিক তথ্যাবলীকে নিয়ে গুরুগম্ভীরভাবে সময় কাটাতে থাকে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রকৃত চর্চার চেয়ে এ ধরনের নিষ্ফল গবেষণার মাধ্যমে প্রকৃত সামাজিক অর্থনৈতিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু বিকশিত হয় নানা তত্ত্ব—যেমন, বেদান্ত, মীমাংসা, সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক।
পরবর্তীকালে এ ধরনের বিভাজন ও মতভেদ আরো হয়েছে। কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে যায় ব্রাহ্মণ্যধর্মের সামগ্রিক আবিলতা। ব্রাহ্মণদের চুড়ান্ত অনুশাসন ও সীমাহীন ক্ষমতা, শাসকশ্রেণীর মধ্যেকার ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্ব (মূলত ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের মধ্যে) এবং জনসাধারণের মধ্যেকার আংশিক বিক্ষোভ ও হতাশা, সামাজিক ও নৈতিক বিকাশকে অবরুদ্ধ করতে থাকে। ফলে আবারো প্রয়োজন হয়ে পড়ে নতুনতর মতাদর্শের—যা তখনকার পরিবেশে নতুনতর ধর্ম ছাড়া কিছুই নয়। এর ফলেই সৃষ্টি হয় প্রতিবাদী, বিকল্প ধর্মমত–বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম, খ্রীস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ ও ৫ম শতাব্দী সময়কালে। পরবর্তী কয়েকশত বছর ধরে এই নতুন ধর্মের নবীন নৈতিক ও মানবিক নির্দেশাবলী ক্রমশ জনপ্রিয় হতে থাকে। মৌর্যদের মত বেশ কিছু রাজাও তাদের গ্রহণ করেন। স্বাভাবিকভাবে ব্রাহ্মণ্যধর্ম এই সব ধর্মমতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ও প্রতিরোধে লিপ্ত হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ব্রাহ্মণ্য ধর্ম তার নিজের রূপান্তর ঘটাতেও বাধ্য হয়।
সূচনা হলো আধুনিক হিন্দুধর্মের। বেদ পরবর্তী কয়েক শত বছরে ঈশ্বরোপাসনা ও ধর্মাচরণ মূলত কুক্ষিগত হয়ে গিয়েছিল ব্রাহ্মণদের মধ্যে। অথচ ব্যাপক মানুষের কাছে, দৃঢ় বিশ্বাসের কারণে, এগুলি ছিল শান্তিদায়ী ও একান্ত কামা। কিন্তু বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মে যে উদারনীতির কথা প্রচার করা হলো, তার ফলে একদিকে ব্যবসায়ী গোষ্ঠী (বৈশ্য) অন্যদিকে সাধারণ বহু মানুষ দলে দলে আকৃষ্ট হতে থাকল। ফলে একই সঙ্গে জনগণের মধ্যে নিজের ক্ষমতা বজায় রাখা ও বর্ণভেদ প্রথাকে টিকিয়ে রাখার জন্য, ব্রাহ্মণ্যধর্মকেও উদার ও গণতান্ত্রিক হতে হলো। ব্রাহ্মণরা শুধু নয়, সাধারণ মানুষের অবরুদ্ধ ধর্মীয় আবেগের দ্বার খুলে দেওয়ার জন্য তাদেরও অনুমতি দেওয়া হলো প্রকাশ্য পূজা, ধর্মানুষ্ঠান ইত্যাদি করার।
এরই অন্যতম হলো দেবতার নামে মন্দির প্রতিষ্ঠা—ভারতবর্ষে সেই প্রথম, যে মন্দিরে আপামর জনসাধারণ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারবে (যদিও তার মূল নিয়ন্ত্রণ করবে ব্রাহ্মণরাই)। এর আগে ভারতে ঐ অর্থে মন্দির ছিল না—যা ছিল তা হলো বৌদ্ধদের চৈত্য। এর আগে ভারতে বৈদিক বা ব্রাহ্মণ্য পর্বে কোন দেবদেবীর মূর্তিও ছিল না। প্রকৃত পক্ষে উত্তর ভারতে অষ্টম শতাব্দীর আগে হিন্দুদের নিজস্ব কোন মন্দিরই ছিল না। পরবর্তীকালে চৈত্যের অনুরণে, চমক লাগানো স্থাপত্য তৈরি হলো, নাম দেওয়া হলো মন্দির। আর ব্রহ্ম বা নৈর্ব্যক্তিক দেবদেবী নয়, সাধারণ মানুষের ধরা-ছোঁয়া-দেখার মধ্যে নিজেদেরই মতো করে কল্পিত হলো দেবদেবীর মূর্তি, তাদের ‘প্রতিষ্ঠা’ করা হলো ঐ মন্দিরে। নানা জাঁকজমকপূর্ণ নিয়মকানুনের মধ্য দিয়ে, দৃষ্টি-শ্রুতি ও আবেগকে নাড়া দেওয়া নানাবিধ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, সাধারণ মানুষ যাতে ঈশ্বর-দেব-অলৌকিক শক্তির কাছে সরাসরি ‘হাজির’ হতে পারে তার ব্যবস্থা করা হলো। এখনো মাধ্যম থাকল ঐ ব্রাহ্মণরা, কিন্তু আগে যেমন পূজো করার একমাত্র অধিকার ছিল ব্রাহ্মণের, এখন ব্রাহ্মণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষও পুজো দিতে পারল। ব্রাহ্মণ্য পর্বের এই আংশিক গণতন্ত্রীকরণই হিন্দু ধর্মের সাম্প্রতিক রূপ যদিও সময়ে সময়ে আরো বিকশিত বিবর্তিত পরিবর্তিত হয়েছে। এরই ফলশ্রুতি নানা পুরাণ রচনা। মোটামুটি ৬০০-১২০০ খ্রীষ্টাব্দ সময়কালে এগুলি রচিত। বেদে যে কল্পিত উপায়াদির সাহায্যে ঐশ্বরিক শক্তিকে সন্তুষ্ট ও করায়ত্ত করার কথা বলা হয়েছিল, সেগুলি উচ্চবর্ণের মানুষেরা সাধারণ মানুষদের (বৈশ্য-শূদ্র-নারীদের।) ছুঁতে দিত না—পাছে তারাও ঐ ক্ষমতা পেয়ে যায়। (কারণ উচ্চবর্ণের মানুষেরা হয়তো সত্যিই বিশ্বাস করতো ঐ সব বেদমন্ত্রে গরু বাছুর, সম্পদ, অস্ত্র শস্ত্র, ফসল, সুন্দরী নারী, পুত্র ইত্যদি সব কিছু পাওয়া সম্ভব।) ফলে বেদকে সাধারণ মানুষদের ধরা ছোঁওয়ার বাইরেই রাখা হয়েছিল। তাই শূদ্র বেদ পড়ে বা শুনে ফেল্লে কঠোর শাস্তি থেকে তাকে হত্যা করারও নিয়ম করা হয়েছিল। ধর্মীয় বাতাবরণ ও আনুগত্যের মধ্যে রেখে ‘পুরাণ’ এই অভাব পূরণ করল। পুরাণ সবাই পড়তে পারে, শুনতে পারে। ফলে সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের মানসিক-আধ্যাত্মিক চাহিদা পূরণ হল।
‘পুরাণ’ রচনার তৎকালীন সামাজিক প্রয়োজনীয়তাও ছিল। এর ব্যাপক পঠন পাঠনের মধ্য দিয়ে শাসক শ্রেণী সাধারণ মানুষের মধ্যে সামাজিক অনুশাসনকে সুদৃঢ় ভাবে প্রচার ও প্রোথিত করতে পারল।
এই সময়কালের মধ্যে চতুর্বর্ণপ্রথা যেমন সুদৃঢ় হয়, তেমনি জাতিভেদ প্রথাও সুনিশ্চিতভাবে শক্তিশালী সামাজিক স্বীকৃতি পেল। এই জাতিভেদ প্রথা মূলত পেশা ভিত্তিক। এক একটি পরিবার যে ধরনের শ্রম করত ও উৎপাদন করত তাদের পুরুষাণুক্রমে ঐ কাজ করতে বাধ্য করা হল। এর ফলে সামাজিক শৃঙ্খলা (অন্তত ঐ সমাজের পক্ষে প্রয়োজনীয় শৃঙ্খলা) কিছুটা রক্ষিত হল বা উত্তরসূরীদের কাজ জোগাড় করে দেওয়ার (অর্থাৎ বেকার সমস্যা দূর করার) ঝামেলা থেকে শাসক গোষ্ঠীকে বাঁচাল। কিন্তু মানুষ হিসেবে বিপুল সংখ্যকের অবনমনও ঘটান হল— মানুষের প্রধান পরিচয় ও কর্ম হয়ে দাঁড়াল—তার নিজের ইচ্ছা, রুচি বা যোগ্যতা নয়, তার পূর্বপুরুষ কি কাজ করত সেটিই অর্থাৎ জন্মসূত্রেই এক একজনের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত করে দেওয়া হল। এছাড়া জাতিভেদের সাহায্যে বিপুল সংখ্যক মেহনতি মানুষদের মধ্যে বিভেদচিন্তাও ঢোকান গেল—যাতে তারা ঐক্যবদ্ধ ভাবে কিছু না করে ফেলতে পারে। সামাজিক ভাবে এসবের প্রয়োজন হয়তো হয়েছিল—কিন্তু তা প্রধানত ছিল শাসক গোষ্ঠীর প্রয়োজন—মূলত ব্ৰাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের তথা পুরোহিত রাজরাজড়ার প্রয়োজন।
কত দক্ষ ভাবে এ কাজ করা হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় অসংখ্য জাতি সৃষ্টি করার ও তাদের সুনির্দিষ্ট সামাজিক শ্রম করার দায়িত্ব দেওয়ার মধ্য দিয়ে। মনুসংহিতা, ধর্ম সূত্র ও পরবর্তীকলের পুরাণ-এ এর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। এ ধরনের সামান্য কয়েকটি উদাহরণ হল—
শূদ্র পুরুষ ও ক্ষত্রিয় নারীর মিলনজাত সন্তানদের বলা হয় চর্মকার,
ব্রাহ্মণ পুরুষ ও শূদ্রা নারীর সন্তান নিষাদ—কাজ শিকার করা ও অরণ্যে নির্বাসিত,
ক্ষত্রিয় পুরুষ ও বৈশ্যা নারীর সন্তান মাহিষ্য–কাজ দেওয়া হল চাষ বাস, চিকিৎসা, জ্যোতিষবিদ্যা ইত্যাদি;
ক্ষত্রিয় পুরুষ ও শূদ্রা নারীর সন্তান–উগ্র ক্ষত্রিয় বা আগুরি–মুখ্য জীবিকা পশু হত্যা, এছাড়া কৃষি ও পশুপালন;
উগ্র পুরুষ ও নিষাদ নারীর সন্তান–কুক্কুট, যাদের বৃত্তি অস্ত্র নির্মাণ;
বৈশ্য পুরুষ ও ব্রাহ্মণ নারীর সন্তান—চক্রী, কাজ তেল ব্যবসা ও তেল তৈরী;
ব্রাহ্মণ ও নিষাদের সন্তান—পৌষ্টিক, কাজ পাল্কি বওয়া;
বৈশ্য ও ক্ষত্রিয়ের সন্তান—মন্যু, কাজ চোর ধরা;
করণ জাতি—লেখক ও হিসাব রক্ষক, এরা বৈশ্য পুরুষ ও শূদ্রা নারীর সন্তান;
কায়স্থ—মনুস্মৃতির পরিবর্তীকালে চিহ্নিত, অত্যাচারী রাজকর্মচারী হিসেবে বিষ্ণুধর্ম সূত্রে উল্লেখিত; উশ্নঃ স্মৃতিতে এদের মধ্যে কাকের মত লোভ, যমের নিষ্ঠুরতা ও স্থপতির লুণ্ঠন-ইচ্ছার কথা বলা হয়েছে এবং কাক- যম-স্থপতির আদ্য অক্ষর নিয়ে কায়স্থ নাম দেওয়া হয়েছে;
ইত্যাদি ইত্যাদি অসংখ্য বিচিত্র জাতিভাগ ও দায়িত্ব বিভাজন। সমাজের শাসকগোষ্ঠীর মুখপাত্র স্থানীয়, দক্ষ ও বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন কয়েকজন ব্যক্তি এসব কাজ করেছেন এবং তাকেও ধর্মের নামে, ঈশ্বরের নামে চালানো হয়েছে। নিজের কাজের মধ্য দিয়ে, যোগ্যতা দিয়ে এই জন্ম-পরিচয় পাল্টানোর উপায় মানুষের প্রায় রইলই না।
অন্যদিকে মন্দির প্রতিষ্ঠা যেমন হাল আমলের, অর্থাৎ বৈদিক ও তার পরবর্তী কয়েক শত বছরে সেটি যেমন অজ্ঞাত ছিল, তেমনি পুজো করার ক্ষমতার মতো দেবতার চরিত্রেরও গণতন্ত্রীকরণ করা হলো। সৃষ্টি হলো অবতারবাদ। খ্রীস্টজন্মের পরবর্তী তিন-চার শত বছরের মধ্যে (গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়ে) এই নতুন চিন্তার উন্মেষ তথা কল্পনার বিকাশ ঘটানো হয়। আগে ব্রাহ্মণরা স্বর্গ বা মহাশূন্যে বসবাসকারী যে ঈশ্বর বা দেবদেবীর কথা বলত, এখন তাদের মাঝে মাঝে মানুষের মধ্যে নামিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হলো। বলা হলো, ঐ দেবদেবীও মাঝে মাঝে মানুষের মতো এই মর্ত্যে (পৃথিবীতে) মানুষের ঘরে মানুষ হয়েই জন্মায়—তার মধ্যে ঐশ্বরিক বা দৈবী গুণাবলী থাকে, তাই মানুষ হলেও ঐ বিশেষ মানুষ ঈশ্বর বা দেবদেবীর মতই পূজ্য। এই বিশেষ ব্যক্তির নাম দেওয়া হল ঐ বিশেষ ‘দেবদেবীর অবতার’। বৌদ্ধধর্মের জাতক কাহিনীর অনুকরণে এই অবতারতত্ত্ব আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এর ফলে দেবদেবী একেবারে সাধারণ মানুষের ঘরের কাছেই যেন চলে এল। নির্ভর করার মতো, বিপদমুক্ত করার মতো, একজন নিজেরই মতো মানুষ পেয়ে যাওয়ায় ব্যাপক মানুষের কাছে অবতার অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় হয়ে উঠল। আরো পরে শুধু মানুষ নয়, জীবজন্তুর মধ্যেও এই অবতারত্ব আরোপিত হয়। সব মিলিয়ে বহু অবতার সৃষ্টি হতে থাকে। কখনো বা সম্পূর্ণ কল্পিত হিসেবে, প্রচারিত গল্প গাথার মাধ্যমে; কখনো বা বিশেষ বুদ্ধিমান, ক্ষমতাবান, দরদী একজন মানুষ হিসেবে। রাম, কৃষ্ণ, কূর্ম, বরাহ ইত্যাদি বিষ্ণুর নানা অবতারের গল্প প্রচার করা হয়, নাম দেওয়া হল পুরাণ এবং তাদের ঘিরে বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীও গড়ে ওঠে। এদের কাউকে কাউকে আবার বিশেষ উদ্দেশ্যে ও লাগানো হয়। যেমন আর্যরা যখন দাক্ষিণাত্য (যথাসম্ভব শ্রীলংকা নয় ) অধিকার করে তখন বিষ্ণুর অবতার হিসেবে রামের কথা বলা হয়।
মৌর্য সাম্রাজ্যের পরে গুপ্ত যুগে—৪র্থ শতাব্দী ও তার পরবর্তী সময় কালে—হিন্দুধর্মের এ জাতীয় বহুবিধ রূপান্তর ও সংযোজন ঘটানো হয়, যার অনেককিছু বর্তমানেও অনুসরণ করা হয়। প্রকৃতপক্ষে এই সময়েই আধুনিক হিন্দুধর্মের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যাপকভাবে বিষ্ণুমন্দির প্রতিষ্ঠা, অবতারতত্ত্ব (গুপ্ত যুগে মূলত কৃষ্ণ ও বরাহ অবতারের পূজা করা হত) ইত্যাদির পাশাপাশি আরাধ্য হিসেবে নারীদেরও সামনে আনাহল—স্পষ্টতঃই, এটিও ছিল ধর্মের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সহায়ক আরেকটি পদ্ধতি। বৈদিক যুগে লক্ষ্মীর মতো দু’একটি দেবীর কথা বলা হলেও তারা এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছিল না; ৪র্থ শতাব্দী সময়কালে গুরুত্ব দিয়ে দুর্গার প্রচলন করা হল—আরো পরে কালী ইত্যাদির।
বৈজ্ঞানিক চিন্তভাবনারও কণ্ঠরোধ করা হয়। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য ভারতীয় বৈজ্ঞানিক ছিলেন আর্যভট (জন্ম: ৪৭৬ খ্রীষ্টাব্দ)। পাই-এর মান নিরূপণ (৩.১৪১৬ অব্দি), পার্থিব বছরের সময় কাল নির্ণয় (365.3586805 দিন ), পৃথিবীর ঘূর্ণায়মান চরিত্র ও গোলাকৃতি সম্পর্কে ধারণা, পৃথিবীর ছায়া পড়ে চন্দ্রগ্রহণ হওয়ার ঘটনা, জ্যেতির্বিদ্যাকে জ্যোতিষ ও অঙ্ক থেকে অলাদা একটি শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার মত গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারও নানা কাজকর্ম তিনি করেন। কিন্তু এর ফলে হিন্দুদের গোঁড়া, অবৈজ্ঞানিক নানা ধ্যান-ধারণার ভিত্তি কেঁপে ওঠে। এই গোঁড়া, ধর্মবিশ্বাসী পুরোহিত গোষ্ঠীকে (ও শাসক বৃন্দকেও) সন্তুষ্ট করতে আর্যভট্টের পরবর্তীকালের জ্যোতির্বিদেরা আর্যভট্টের অনেক বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত ও কাজের বিরোধিতা করেন। যেমন বরাহমিহির (জন্ম : ৫০৫ খ্রীষ্টাব্দ) জ্যোতির্বিদ্যা-চর্চাকে সমান গুরুত্বপূর্ণ তিনটি শাখায় বিভক্ত করেন—জ্যোতির্বিদ্যা ও অঙ্ক, কোষ্ঠিবিচার, এবং জ্যোতিষবিদ্যা। এইভাবে অবৈজ্ঞানিক জ্যোতিষবিদ্যাকে (তথা কর্মফল, অদৃষ্টবাদ, নিয়তিবাদ ইত্যাদিকে) বরাহমিহির সমান— এমন কি বেশি গুরুত্ব দিলেন, যা আর্যভট্ট অবৈজ্ঞানিক বলে বাতিল করেছিলেন।
এই সময় সতীদাহ প্রথা ও গৌরীদানকেও মহান কাজ বলে প্রচার করা হয় যা পরবর্তীকালে বাংলা সহ ভারতের পূর্বাঞ্চলেও পালবংশ স্থাপনের পর (গোপাল-এর দ্বারা ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দ সময়কালে) ব্যাপক ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বিরল দু’একজন মহিলা অধ্যাপক ও দার্শনিক ছাড়া, সাধারণভাবে নারীদের হতমান করে রাখাই হয়। অভিজাত ধনী মহিলাদের কারো কারোর জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল—কিন্তু তা ছিল কথাবার্তা আচার আচরণ তারা যাতে ভালভাবে বলতে-করতে পারে তার জন্য, জনসমক্ষে ব্যবহারের জন্য নয়। নারীদের পেশা হিসেবে বলা ছিল নটী, বেশ্যা ইত্যাদি— সম্মানিত কোন পদ নয়। কেউ কেউ অবশ্য হিন্দু ধর্মত্যাগ করে বৌদ্ধ ভিক্ষুণীও হয়ে যান। (নিম্নবর্ণের বহু হিন্দুও একইভাবে হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ ও পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। )
‘দ্বিজ’ কথাটির দ্বারা এই সময় প্রধানত ব্রাহ্মণদের বোঝানো হতে শুরু করে এবং ব্রাহ্মণদের পবিত্রতা রক্ষা চরম গুরুত্ব পায়। অস্পৃশ্য বা শূদ্ররা কাছাকাছি এলেও ব্রাহ্মণদের শুদ্ধ হতে হত। ধর্মের নামে বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠান, ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণের তথাকথিত পবিত্রতা রক্ষা করা, নানা ধরনের ধর্মীয় নিয়মকানুন ও অনুশাসন ইত্যাদি কঠোরভাবে পালন করার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। বহির্ভারতে বাণিজ্য চলতই, কিন্তু ধর্মকাররা সমুদ্র যাত্রাকে অধর্মীয় কাজ বলে ফরমান দেন। এর ফলে ম্লেচ্ছদের সঙ্গে হিন্দুদের মেলামেশা হয়ে হিন্দুত্বের পবিত্রতা নষ্ট হওয়ার ভয় দেখানো হয়। এইভাবে বাইরের জ্ঞান আহরণ ও দৃষ্টির প্রসারকে সীমায়িত করার চেষ্টা করা হয়। জড়বদ্ধ পরিবেশ ও মানসিকতায় আটকে রাখার একটি প্রচেষ্টা ছিল এটি। এর ফলে ব্রাহ্মণরা ব্যবসায়ী তথা বৈশ্যদের অর্থনৈতিক উত্থানকেও কিছুটা আটকাতে সক্ষম হয়, অন্তত তার চেষ্টা করে।
এই গুপ্ত যুগ তথাকথিত হিন্দুধর্মের নানা সংস্কার, আচার-নিয়ম ইত্যাদি বিকাশের স্বর্ণযুগ। বৌদ্ধ ধর্ম, জৈনধর্ম, গ্রীক সভ্যতা ইত্যাদির প্রভাব ও চ্যালেঞ্জের প্রতিক্রিয়ায় বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের উত্তরসূরীরা এই ধরনের কঠোর, যান্ত্রিক নিয়ম কানুন ধর্মের নাম করে প্রচার করতে বাধ্য হন—নিজেদের স্বাতন্ত্র্য, শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্ব অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টায়।
কল্পিত অবতারতত্ত্বেরই পরবর্তী ফল নানা গুরুর তথা গোষ্ঠীর সৃষ্টি। ধর্মমতে অনৈক্য ও বিভেদ (schism) এর মূলে— কখনো বা বিশেষ স্বার্থের কারণে, কখনো বা উদারনৈতিক, মানবতাবাদী ও জনকল্যাণমূলক কাজের অংশ হিসেবে। গুরুরা অবতারের আরো সরলীকৃত, আরো গণতন্ত্রীকৃত রূপ। এক-একজন গুরু এক-একটি দেবতা তথা অবতারের প্রতিনিধি হয়ে উঠল। মানুষের মধ্যে বাস করে ধর্মোপদেশ দেওয়া থেকে শুরু করে নৈতিক মূল্যবোধ জাগানো পর্যন্ত নানাবিধ কাজই সে করল।
হিন্দুধর্মের এই বিকশিত নানাবিধ দিকের সঙ্গে নানা সময়েই মিশেছে আরো অজস্র দিকও—এসেছে আদিম গোষ্ঠীর থেকে জীবজন্তু পূজা, সৃষ্টি হয়েছে গণেশ পূজা, সৰ্প পূজা, হনুমান পূজা ইত্যাদি ইত্যাদি। কখনো বা কৃষিভিত্তিক সমাজে অর্থনৈতিক কারণে জন্ম নিয়েছে গরুকে দেবতা ভেবে পূজা করা (প্রকৃত অর্থে সংরক্ষণ করা—যাতে মুনিঋষি ও অন্যদের দ্বারা ব্যাপকভাবে গোমাংসভক্ষণ আর বলি দেওয়া, উৎসর্গকরা ইত্যাদির জন্য ব্যাপক গোহত্যা বন্ধ করা যায়)।* বিশেষ নদীকে ঐ অর্থনৈতিক কারণে পূজ্য বলে কল্পনা করা হয়েছে, যেমন- গঙ্গা, সরস্বতী, যমুনা ইত্যাদিকে। মুণ্ডারা যেমন তাদের ধরিত্রীদেবী মেরিয়া-র কাছে বালক বলি দিত, তেমনি শক্তির প্রতীক কালীর কল্পনা করে তার কাছে চালু হল নরবলি।
[* প্রাচীন ভারতে হরদম গরুর মাংস খাওয়া হত। কৃষ্ণযজুর্বেদের মৈত্রায়নীয় শাখার অন্তর্ভুক্ত মানব গৃহ্যসূত্রে স্পষ্টই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বাড়িতে অতিথি এলে গোমাংস দিয়ে আপ্যায়ন করতে হবে এবং সঙ্গে চারজন ব্রাহ্মণকেও মাংসভোজনে আমন্ত্রণ জানাতে হবে।]
৬ষ্ঠ-৭ম শতাব্দী সময়কালে বেদ-ব্রাহ্মণকে পরোক্ষভাবে অস্বীকার করে হিন্দুধর্মের মধ্যেই একটি আন্দোলন গড়ে ওঠে যাকে ভক্তি আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করা যায়। কল্পিত ঈশ্বর সম্পর্কে বিশ্বাস তখন প্রবল ও গভীর। এই বিশ্বাসের জায়গা থেকে, ঈশ্বর বা নানা দেবদেবীকে সরাসরি ভালবাসা ও তার সঙ্গে সরাসরি নিজের যোগাযোগ স্থাপন করাই ছিল ভক্তি আন্দোলনের মূল কথা–ব্রাহ্মণকে মাধ্যম করে নয়, বা বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নয়। বিভিন্ন দেবদেবীকে কেন্দ্র করে এইভাবে বহু ব্যক্তিত্ব, ভক্ত বা সম্ভ-এর সৃষ্টি হয়। শিবভক্তরা হল শৈব, দাক্ষিণাত্যে এদের নাম নায়নার; বিষ্ণুভক্তরা বৈষ্ণব, দাক্ষিণাত্যে এদের নাম আলভার। মিথ্যা অন্ধ বিশ্বাসের প্রাবল্যে এ সব ভক্তের কেউ কেউ মানসিক অসুস্থতার শিকার হতেন এবং নানা অবাস্তব অবিজ্ঞতা লাভ করতেন, (এবং এখনো করেন)— যেমন কালী শিব কৃষ্ণের বা রাধার দেখা পাওয়া (visual hallucination), কৃষ্ণের বাঁশি বা পায়ের নূপুরের শব্দ শোনা ( auditory hallucination), দেবতার হাতের ছোঁয়া পাওয়া (tactile hallucination) ইত্যাদি। এঁদের সাধারণভাবে শামান (shaman) নামে অভিহিত করা যায়। ব্রাহ্মণ-আধিপত্য ও জাতপাতের ভেদাভেদকে গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে, ভক্তি আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ঘিরে আপামর জনসাধারণই জড়ো হন, নিজেদের ঈশ্বরবিশ্বাসের জায়গা থেকে
মূলত দক্ষিণভারতে (তামিল অঞ্চলে) এই আন্দোলন শুরু হয়। চতুর্দশ শতাব্দী সময়কালের মধ্যে উত্তর ভারতে এবং অন্যান্য এলাকায়ও এটি ছড়িয়ে পড়ে। বেদ-বর্ণাশ্রম ইত্যাদি তথা হিন্দুধর্ম যে চিরন্তন, ঐশ্বরিক কিছু নয় তা ভক্তি আন্দোলনের নেতারা পরোক্ষভাবে প্রমাণ করেছেন—যখন নিজেদের প্রয়োজনে নিজেরা ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক দিকগুলিকে, কিংবা ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিকে চূড়ান্তভাবে ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে পরিমার্জিত করেছেন। রাজপুত রাণী মীরাবাই, আগ্রার অন্ধকবি সুরদাস, কাশ্মীরের লালা, পশ্চিমভারতের কবির ( ১৪৪০-১৫১৮) ও নানক (১৪৬৯-১৫৩৯), পূর্বভারতের শ্রীচৈতন্য (নিমাই) (১৪৮৬-১৫৩৩) ইত্যাদি বহু ব্যক্তিই বিভিন্ন সময়ে নিজের মত করে এই আন্দোলনের কথা বলেছেন বা নেতৃত্ব দিয়েছেন। সম্প্রতি গদাধর বা শ্রীরামকৃষ্ণও এই ভক্তি মানসিকতার (অর্থাৎ দেবদেবী ঈশ্বরের সঙ্গে সরাসরি ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তোলার তাগিদের) ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি,—বিশেষ সমাজিক পরিবেশে ও প্রয়োজনে।
নানা ক্ষেত্রে, ভারতে আগত ইসলামধর্মাবলম্বীদের শিয়াগোষ্ঠী থেকে সৃষ্টি হওয়া সুফিদের সঙ্গে এই ভক্তিআন্দোলনের নেতাদের মানসিকতার মিল রয়েছে। এই মিল থাকার কারণে সুফি ও তাঁদের বিভিন্ন প্রচারক (পীর, ফকির ইত্যাদি) বা বিভাগ (চিস্তি, ফিরদৌসি ও সুহ্রাবর্দী) হিন্দুধর্মাবলম্বীদের একাংশের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে।
ভক্তি আন্দোলনের অধিকাংশ নেতাই নিজেদের অবতার ইত্যাদি নামে অভিহিত না করলেও পরবর্তিকালে তাঁদের অন্ধ ভক্তরা নিজেদের সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁদের উপর অবতারত্ব আরোপ করেছে। অবশ্য এদের মধ্যে দু’একজন ব্যতিক্রম ছিলেন, যাঁরা নিজেরাই নিজেদের অবতার হিসেবে হাজির করেছেন ও প্রচার করতেন—কেউ বলেছেন তিনি বিষ্ণুর অবতার, কেউ বলেছেন অমুক ঠাকুর আর তমুক ঠাকুর (যেমন রাম আর কৃষ্ণ) মিলিয়ে তিনি; কেউ বা আবার অন্যদিকে চৌদ্দ পুরুষের ঠিকুজি ঘেঁটে পূর্বতন কারোর সঙ্গে (যেমন শ্রীচৈতন্যের সঙ্গে) রক্ত সম্পর্ক খুঁজে ব্যবসায়িক স্বার্থে প্রচার করে।
এধরনের নানা ধর্মীয় আন্দোলনই (যা আসলে সামাজিক বিক্ষোভ ও সংশোধনবাদী মানসিকতার প্রকাশ) পুরনো নানা প্রথা বা ধারণার পরিমার্জনা করেছে। যেমন, ব্রাহ্মণ্য তথা হিন্দু ধর্মের মূল শাস্ত্রাদিতে নারীদের সামাজিক কাজকর্মে অংশগ্রহণ ছিল অতি সীমিত। ভক্তি আন্দোলন, পরবর্তীকালে ব্রাহ্ম সমাজ ও আর্যসমাজ আন্দোলন ইত্যাদিগুলি নারীদের কাজের ক্ষেত্র আরো বাড়িয়ে কিছুটা সম্মান দেয় এবং চতুর্বর্ণাশ্রম, অন্ধ আচার অনুষ্ঠান ইত্যাদিকেও কমবেশি সংশোধন করে।
ষষ্ঠ শতাব্দী সময়কালে হিন্দুধর্মের মধ্যেই আরেকটি ধারা বিকশিত হয় যা তন্ত্র নামে অভিহিত। তান্ত্রিক মতে পুরুষ নারীর সঙ্গে মিলিত হয়েই তার শক্তির পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারে, তাই দেবতাদেরও স্ত্রী সঙ্গিনী প্রয়োজন হয়; আর এ থেকে বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী এবং শিবের স্ত্রী দুর্গা তথা কালী তথা পার্বতী বা তারা ইত্যাদি দেবীর পূজা এই তন্ত্রে প্রাধান্য পায়। উত্তরপূর্ব ভারতে ৮ম শতাব্দীর সময় এই তন্ত্রমত বিকশিত হয়। পরবর্তীকালে তিব্বতেও যায় এবং বৌদ্ধধর্মেও অনুপ্রবেশ করে। তন্ত্রপদ্ধতি বৈদিক ধারার সরলীকৃত রূপ হিসেবে অভিহিত এবং নারীদের অংশগ্রহণ এর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। নানা ধরনের কল্পিত রহস্যময় পদ্ধতি, প্রতীক, আচার অনুষ্ঠান ইত্যাদি— নিরর্থক হলেও—তন্ত্রোক্ত মতে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। নারীশক্তি তথা মাতৃ আরাধনার প্রাধান্য থেকে এটি অনুমান করা যায় তন্ত্র মূলত অনার্য প্রভাবে বিকশিত এবং প্রকৃতপক্ষে আর্যদের প্রভাব যে সব এলাকায় কম ছিল ঐ সব জায়গাতেই এটি প্রধানত বিকশিত হয়, পরবর্তিকালে ধীরে ধীরে এটি হিন্দুধর্মের একটি ধারা হিসেবে পরিগণিত হয়ে যায়।
এসব থেকে শুরু করে আধুনিককালে সৃষ্টি হয়েছে আরো নানা গুরু বা অবতারের—রামকৃষ্ণ, সাঁইবাবা, অনুকুল ঠাকুর, মোহনানন্দ, ওঙ্কারনাথ, ইত্যাদি। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সৃষ্টি হয়েছিল আর্য সমাজ—যারা আবার বৈদিক যুগে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানায়। সম্প্রতি আবার তথাকথিত হিন্দুদের নানা সংগঠনও গড়ে উঠেছে—অধিকাংশ হিন্দু তার অন্তর্ভুক্ত না হলেও এসব সংগঠনের কেউ বেশি, কেউ বা কম হিন্দুধর্মের মাহাত্ম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বলে,—কেউ বলে নিছক রাজনৈতিক ফায়দা ওঠাবার জন্য, কেউ বা নিছক অন্ধ বিশ্বাসের কারণে। কিন্তু এঁরাও বেদ বা উপনিষদ বা মনুসংহিতা বা পুরাণের নানা তত্ত্বের কোটি বাদ দিচ্ছেন কোটি রাখছেন তা স্পষ্ট করে বলেন না। তবে এটি স্পষ্ট যে সব কটাকে মানা সম্ভব নয়। কারণ ঋগ্ বেদ মানতে গেলে চতুর্বর্ণ মানা চলবে না, কিংবা অথব বেদ মানলে কুষ্ঠ-যক্ষ্মা হলে বা সাপে কামড়ালে হাসপাতালে যাওয়া চলবে না। যজুর্বেদ মানতে গেলে গরুর মাংস খেতে তো হবেই— ব্রাহ্মণদের নেমন্তন্ন করে খাওয়াতেও হবে। মনুসংহিতা মানতে হলে, কোনো অব্রাহ্মণ (শূদ্র) ব্রাহ্মণের চুল ধরলে তার হাত কেটে ফেলতে হবে, কিংবা সব ব্রাহ্মণকে অবশ্যই বেদ পাঠ করতে হবে, ক্ষত্রিয় ছাড়া অন্য কাউকে মন্ত্রী বা পঞ্চায়েত প্রধান করা চলবে না, শূদ্র ছাড়া আর কারোর চাকরি করা চলবে না (কারণ মনুসংহিতায় একমাত্র শূদ্রবর্ণের জন্যই অন্য তিনবর্ণের সেবা করার কাজ সংরক্ষণ করা হয়েছে) ইত্যাদি ইত্যাদি।
হিন্দুধর্ম উৎস বিচারে গত প্রায় সাড়ে তিনহাজার বছর ধরে বিকশিত হয়েছে। তার নানা কিছু আজ গোঁড়া হিন্দুও অনুসরণ করেন না, আবার বিশেষ কিছু ঘটনা বিশেষ উদ্দেশ্যে কেউ কেউ ব্যবহার করে— এমনকি রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্যও। অন্য ধর্মের মত হিন্দু ধর্মকেও শাসক শ্রেণী বরাবর নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেছে এবং সম্প্রতি একইভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য কিছু ব্যক্তি সাধারণ মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে কাজে লাগাচ্ছে মানুষকে প্রতারিত করছে। এগুলি এটিও প্রমাণ করতে যথেষ্ট যে, অন্য ধর্মের মতো হিন্দুধর্মও মানুষেরই সৃষ্টি, তার নিজেরই প্রয়োজনে। নানা মানুষ নানাভাবে এর যে পরিমার্জনা করেছেন, নানা গোষ্ঠী ও দলের সৃষ্টি করেছেন তার তালিকাও বিশাল।
✩ ✩ ✩
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “হিন্দু মুসলমানের পার্থক্যটাকে আমাদের সমাজে আমরা এতই কুশ্রীভাবে বেআব্রু করিয়া রাখিয়াছি যে, কিছুকাল পূর্বে স্বদেশী অভিযানের দিনে একজন স্বদেশী প্রচারক এক গ্লাস জল খাইবেন বলিয়া তাঁহার মুসলমান সহযোগীকে দাওয়া হইতে নামিয়া যাইতে বলিতে কিছুমাত্র সংকোচ বোধ করেন নাই। … আমরা বিদ্যালয়ে ও আপিসে প্রতিযোগিতার ভিড়ে মুসলমানকে জোরের সঙ্গে ঠেলা দিয়াছি; সেটা সম্পূর্ণ প্রীতিকর নহে তাহা মানি; তবু সেখানকার ঠেলাঠেলিটা গায়ে লাগতে পারে, হৃদয়ে লাগে না। কিন্তু সমাজের অপমানটা গায়ে লাগে না, হৃদয়ে লাগে। কারণ সমাজের উদ্দেশ্যই এই যে, পরস্পরের পার্থক্যের উপর সুশোভন সামঞ্জস্যের আস্তরণ বিছাইয়া দেওয়া।”
ধর্মের নামে মানুষকে এমন অশুচি, অস্পৃশ্য পর্যায়ে নামিয়ে আনার এ ধরনের উদাহরণ আরো অসংখ্য আছে। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’—এই বিশ্বমানবিক সত্যকে উপেক্ষা করাটা তখনি সহজ হয়ে ওঠে, যখন মানুষের প্রধান পরিচয় হয়ে দাঁড়ায় তার ধর্মবিশ্বাস, অন্য কোন গুণাবলী নয়। ভারতবর্ষে বহু হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এরকম নির্লজ্জ ব্যবহারে পুরুষানুক্রমে অভ্যস্ত। বিগত ৭ম-৮ম শতাব্দীতে এদেশে যখন মুসলিম অনুপ্রবেশ শুরু হয়, তারপর থেকেই ধীরে ধীরে তাঁদের সম্পর্কে এ ধরনের ধর্মানুমোদিত মানসিকতা প্রচার করা শুরু হয়।
প্রথমত, হিন্দুধর্মের ধ্বজাধারী সমাজপতিরা নিজেদের অস্তিত্ব সুরক্ষিত করতে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ঘৃণ্য, অস্পৃশ্য বলে অভিহিত করতে হয়তো বাধ্যই হয়। মনুসংহিতা তথা ব্রাহ্মণ্যধর্মের অন্যান্য সাংবিধানিক বিবৃতিতে, বিশেষত শূদ্রদের সম্পর্কে এ ধরনের মানসিকতার পরিমণ্ডল ছিলই। ফলে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য মুসলিমদের সম্পর্কেও এমন ধারা প্রচার নতুন করে অমানবিক ও বেহায়াপনা হিসেবে সাধারণভাবে মনে হয় নি। হিন্দু সমাজ এ ধরনের মানসিকতায় অভ্যস্ত ছিলই, শুধু তার বিস্তৃতি ঘটল। দ্বিতীয়ত, ইসলাম ধর্মে অন্তত এটি ছিল না যে, একই ধর্মে বিশ্বাসী মানুষদেরই বৃহত্তম অংশকে নীচ বা অস্পৃশ্য বলে বিভাজন করতে হবে। এছাড়া হিন্দুধর্মের মত এত অসংখ্য দেবদেবী, অবতার, গুরু, নেতা ইত্যাদি ধরনের বিভাজন ও খেয়োখেয়িও ইসলামে ছিল না। এসবের ফলে হিন্দু শাসককুলের দাক্ষিণ্যে লালিত বিপুল সংখ্যক অন্ত্যজ ও শূদ্র স্থানীয় মানুষ ইসলামধর্মের কিছু মানবিক দিকে আকৃষ্ট হতে থাকে, ধর্মান্তরিত হতে থাকে। পাশাপাশি মুসলিমরা কিছু ক্ষেত্রে শাসন ক্ষমতায় আসার ফলে, তাদের জোরজবরদস্তি ও অত্যাচারে এবং তাদের অনুগ্রহ লাভের জন্যও কিছু মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। এসব কিছুই হিন্দু শাসককুলকে সন্ত্রস্ত করে তোলে। ধর্মান্তরের এই হিড়িক আটকানোর জন্যও প্রয়োজন হয়, হিন্দুধর্মকে অন্য ধর্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার। ভারতবর্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে, হিন্দু শাসককুল এ মানসিকতার প্রতিষ্ঠা সহজতর ভাবে করতে সক্ষম হয়।
কিন্তু মানুষের কল্পনায় লালিত ধর্মবিশ্বাস যখন গোঁড়ামি, অন্ধতা ও যুক্তিহীনতার পর্যবসিত হয়, তখন শুধু হিন্দুধর্মই নয়, সব ধর্মের মধ্যেই এই নির্লজ্জ অমানবিকতা প্রকাশ পেতে বাধ্য। সব ধর্মেই এই ধরনের মানসিকতা কখনো কম, কখনো বেশি, নানা আকারে পরিস্ফুট হয়েছে—ব্যাপারটি শুধু হিন্দু শাসককুলের একচেটিয়া নয়। কোনো কোনো ধর্মে, নিজস্ব উদারতা সত্ত্বেও, এই গোঁড়ামি ভিন্নধর্মাবলম্বীদের প্রতি আচরণে বর্বরতার পর্যায়ে পৌঁছেচে। তার একটি হলো ইসলাম ধর্ম। আর এর হোতা অবশ্যই অগণিত মুসলিম জনগণ নয়—তাদের মুষ্টিমেয় কিছু সুবিধাভোগী শাসক গোষ্ঠীই। রবীন্দ্রনাথেরই ভাষায়, “পৃথিবীতে দুটি ধর্ম সম্প্রদায় আছে অন্য সমস্ত ধর্মমতের সঙ্গে যাদের বিরুদ্ধতা অত্যুগ্র—সে হচ্ছে খৃষ্টান আর মুসলমান ধর্ম। তারা নিজের ধর্মকে পালন করেই সন্তুষ্ট নয়, অন্য ধর্মকে সংহার করতে উদ্যত। এই জন্যে তাদের ধর্ম গ্রহণ করা ছাড়া তাদের সঙ্গে মেলবার অন্য কোনো উপায় নেই।….অপর পক্ষে হিন্দু জাতিও এক হিসাবে মুসলমানদের মতো। অর্থাৎ, তারা ধর্মের প্রাকারে সম্পূর্ণ পরিবেষ্টিত। বাহা প্রভেদটা হচ্ছে এই যে, অন্য ধর্মের বিরুদ্ধতা তাদের পক্ষে অকর্মক নয়—অহিন্দু সমস্ত ধর্মের সঙ্গে তাদের non-violent non-cooperation …..ধর্মমতে হিন্দুর বাধা প্রবল নয়, আচারে প্রবল; আচারে মুসলমানের বাধা প্রবল নয়, ধর্মমতে প্রবল।” (শ্রীকালিদাস নাগকে লেখা চিঠি, কালান্তর)।
আর এভাবেই অত্যুগ্র ধর্মান্ধতার জন্য ইসলাম ধর্মও প্রকৃতপক্ষে হিন্দুধর্মের আরেক পিঠের মতেই (অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কেও এটি কমবেশি সত্য)। বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা বিচারে ভারতের তথা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম ইসলাম। তার এই অত্যুগ্রতার বহিঃপ্রকাশও হয়ে চলেছে অবিরামভাবে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাংলাদেশ, সলমন রুশদি থেকে তসলিমা নাসরিন, শরিয়তি আইন ও বস্তাপচা মৌলবাদী মানসিকতা—নানা ক্ষেত্রে ছড়িয়ে আছে এই উগ্রতা। এবং সেখানেও একইভাবে ভুলে যাওয়া হয় যে, মানুষের কল্পনার সন্তান ও মানুষের প্রয়োজনে লালিত সেই ঈশ্বরকে কেন্দ্র করে, মানুষেরই বিশেষ প্রয়োজনে যে ধর্মমত গড়ে তোলা হয়েছে, সেটির পরিবর্তন ও বিলুপ্তি একদিন মানুষের প্রয়োজনে হতেই পারে—যা হিন্দু-খ্রীস্ট সহ সব ধর্মের ক্ষেত্রেই সত্য।
এই প্রয়োজন বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধর্মের দ্বারা বিভিন্ন ভাবে মেটানো হয়েছে। আর এরই কারণে হিন্দুধর্ম ও ইসলামধর্ম (ভারতের দুই বৃহৎ ধর্ম)—এদের মধ্যে গুণগত কিছু পার্থক্যও রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে এর জন্য কোন্ ধর্ম ভাল বা খারাপ এ ধরনের বিচার বালখিল্যসুলভ প্রয়াস মাত্র। হিন্দুধর্মের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট পূর্বে কিছু আলোচনা করা হয়েছে, তেমনি ইসলামধর্ম মানুষ কীভাবে সৃষ্টি করেছে, তার শাসককুল কীভাবে অগণিত সাধারণ মুসলিমদের শাসন করার জন্য এই ধর্মবিশ্বাস কাজে লাগিয়েছে তার সংক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক পরিচয় যদি বিপুল সংখ্যক নিপীড়িত মানুষ হৃদয়ঙ্গম করেন, তবে বাহ্যিক অন্ধতা ও অতুগ্র আচরণকে যুক্তিহীন বলে বোঝা যেতে পারে।
***
ভারতীয় সমাজের সংক্ষিপ্ত কালপঞ্জী
এখানে ভারতীয় ইতিহাসের ধর্মীয় ও সামাজিক কয়েকটি ঘটনার সময়কাল উল্লেখ করা হল।
খ্রীঃ পূঃ ২৫০০—হরপ্পা সংস্কৃতি
খ্রীঃ পূঃ ১৫০০—হিন্দুকুশ দিয়ে আর্যভাষীদের ভারতে আগমন
খ্রীঃ পূঃ ১৩০০—মৌখিকভাবে বেদ রচনা শুরু
খ্রীঃ পূঃ ১০০০ — ৭০০—মহাভারত ও রামায়ণের মূল ঘটনার সময়কাল
খ্রীঃ পূঃ ৮০০—লোহার ব্যবহার শুরু
খ্রীঃ পূঃ ৭০০-৩০০—ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ রচনা
খ্রীঃ পূঃ ৫০০–বর্ণভেদ ও চতুরাশ্রমের সৃষ্টি; কর্মফল, জন্মান্তরের ধারণা
খ্রীঃ পূঃ ৬০০—মগধ সাম্রাজ্যের উত্থান
খ্রীঃ পূঃ ৪৯৩–মগধের রাজা অজাতশত্রু
খ্রীঃ পূঃ ৪১৩–-শিশুনাগ রাজবংশ
খ্রীঃ পূঃ ৩৬২-২১-–নন্দ রাজবংশ
খ্রীঃ পূঃ ৩২৭-৫—ম্যাসিডনের আলেক্সাণ্ডারের ভারতে আগমন
খ্রীঃ পূঃ ৩২১—মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা (চন্দ্রগুপ্ত), চাণক্য ও অর্থশাস্ত্র
খ্রীঃ পূঃ ২৬৮-৩১—অশোকের রাজত্বকাল
খ্রীঃ পূঃ ১২৮-১০—শতকর্ণীর নেতৃত্বে শতবাহন সাম্রাজ্য
খ্রীঃ পূঃ ১২৮-১০-শতকর্ণীর খ্রীঃ পূঃ ৮০—প্রথম শকরাজা
খ্রীঃ পূঃ ৫০—কলিঙ্গের রাজা খারবেল
৩১১-২০ খ্রীস্টাব্দ চন্দ্রগুপ্ত (১)-এর দ্বারা গুপ্ত সাম্রাজ্যের পত্তন
খ্রী: পূ: ৫০০-৫০০ খ্রী:— পুরাণ রচনা
৬০৬-৪৭ খ্রীঃ—কনৌজের রাজা হর্ষবর্ধন
৬০০-৩০ খ্রী:—পল্লব রাজবংশের শুরু (মহেন্দ্র বর্মন—১)
৭১২ খ্রীঃ—আরবদের দ্বারা সিন্ধু বিজয়
৮০০ খ্রী:—দার্শনিক শঙ্করাচার্য
৯৯৭-১০৩০—উত্তর পশ্চিম ভারতের মহম্মদ গজনি
১০৫০ খ্রী: — দার্শনিক রামানুজ
১৪৪০-১৫১৮- কবীর
১৪৬১—১৫৩০- নানক
১৪৮৫-১৫৩৩-চৈতন্য
(শেষোক্ত তিনজনই ভক্তি আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি)
(* সমসাময়িক কাল বা আনুমানিক সময়)
[ A History of India (Vol 1 ), Romila Thapar, Penguin Books Ltd, 1966 থেকে ]