শিখধর্ম
পালি ভাষায় ‘শিক্খ’ বা সংস্কৃত ‘শিষ্য’ শব্দ থেকে এসেছে ‘শিখ’ কথাটি,—যার অর্থ অনুগামী। একদিকে ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য ও হিন্দুধর্মের আচার-সর্বস্বতা, অন্যদিকে ইসলামের আগ্রাসী অনুপ্রবেশ,—এই উভয়ের প্রতিবাদী হিসেবে সামাজিক প্রয়োজনে গড়ে উঠেছিল শিখধর্ম,—এই ভারতীয় ভূখন্ডেই। পরবর্তীকালে সামরিক ক্ষমতা আর গোষ্ঠীগত স্বাধীনতা-স্বাতন্ত্র্য রক্ষার প্রচেষ্টাও এর সঙ্গে মিশে যায়।
শিখধর্মের ইতিহাস পাঁচশত বছরেরও কম। হিন্দুধর্মের একটি রূপান্তর মূলত ভক্তি আন্দোলনের ঐতিহাসিক বিকাশের ফলেই এই ধর্মের সৃষ্টি। দক্ষিণভারতে এই আন্দোলন সৃষ্টি হয় ও রামানুজ (১০১৭-১১৩৭ খ্রীস্টাব্দ) একে উত্তরভারতে প্রচার করেন,—সিন্ধু ও গাঙ্গেয় উপত্যকায় ভক্তি আন্দোলন এর ফলে ছড়িয়ে পড়ে। জাতিভেদ প্রথার ও ধর্মানুষ্ঠানের উপর শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদের কর্তৃত্বের প্রতিবাদী ছিল এই আন্দোলন। এ আন্দোলনের মুখ্য কথা হলো,—ভগবান নানা নামের হলেও আসলে এক এবং ব্যক্তিগত ভক্তি ও প্রচেষ্টায় তাঁর সঙ্গে মিলিত হওয়া যায় (অর্থাৎ এর জন্য ব্রাহ্মণ-পুরোহিত ইত্যাদির প্রয়োজন নেই)-এ-ধরনের কথাবার্তা; সবই মায়া-এ জাতীয় তথাকথিত দর্শন এবং ঈশ্বরের নাম-গান মাহাত্ম্য (যার একটি রূপান্তরিত পর্যায় হচ্ছে কীর্তন)। এর পরে রহস্যবাদী, ধর্মীয় কবি কবির (১৪৪০-১৫১৮ খ্রীস্টাব্দ) এই ভক্তি আন্দোলনের সঙ্গে ইসলামের একটি বিভাজন, সুফি মতবাদের ঐক্য সাধন করেন এবং অনেক মানবতাবাদী মতবাদ প্রচার করেন। তিনি শুধু ধর্মীয় পরিবর্তন নয়— সমাজ পরিবর্তনের কথাও বলতেন। তিনি হিন্দু-ইসলাম দুই ধর্মের ঈশ্বরের কথাই বলেছেন। এর ফলে হিন্দু অ-হিন্দু, মুসলিম অ-মুসলিম বহু ব্যক্তিই তাঁর অনুসারী হন। কবিরপন্থা ও শিখধর্মে সরল জীবনের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। কারিগর ও কৃষকদের মধ্যে এই উভয় মতবাদই জনপ্রিয় হয়। বর্ণাশ্রম ও জাতপাতকে এরা কেউই স্বীকার করে না। উলেমা ও ব্রাহ্মণ কেউই এদের সুনজরে দেখে নি।
শিখধর্মের সৃষ্টির মধ্যে ভক্তি আন্দোলন ও সুফি মতবাদ,—উভয়েরই প্রভাব পড়েছে। তবে শিখধর্মের মধ্যে নাম-জপ, ঈশ্বরের নাম-গান-মাহাত্ম্য ইত্যাদির উপর এমন জোর দেওয়া হয় যে একে ‘নামমার্গ’ হিসেবেও অনেকে অভিহিত করেন। এই ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নানকের কথা বলা হয়। ইনি শিখদের দশ জন গুরুর প্রথম গুরু।
নানক ১৪৬৯ খ্রীস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মস্থান বর্তমানের পাকিস্তানে—লাহোর থেকে ৪০ মাইল দূরে রাইভোই তালবন্দি গ্রামে। তাঁর বাবার কাজ ছিল খাজনা আদায় করা (রেভিনিউ কালেক্টার)। এঁরা ছিলেন বেদী বা বৈদিক হিন্দু, ক্ষত্রিয়দের মধ্যেকার একটি তথাকথিত নিচু জাত। নানক তাঁর স্ত্রী ও তিন সন্তানকে ছেড়ে একসময় সুফীদের দলে যোগ দেন এবং পরে তাঁদেরও ছেড়ে নানা স্থানে ঘোরেন। নানক তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন সুলতানপুরে, এক আফগান শাসকের হিসাবরক্ষক হিসেবে। এখানে মদানা নামের এক মুসলিম ছিলেন তাঁর চাকর। রেবেক (rebec) নামে এক তারের বাজনা বাজানোয় ইনি ছিলেন বিশেষ পারদর্শী।
এঁরা দুজনে মিলে একটি ক্যান্টিন গড়ে তোলেন, যেখানে হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে খেতে পারে। নানক হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়ের উপর ও অন্যান্য বিষয়ে নানা আধ্যাত্মিক গান রচনা করতেন, মর্দানা তাতে সুর দিয়ে গাইতেন। এই সুলতানপুরেই নাকি নানকের ঈশ্বর দর্শন ঘটে। একদিন নদীতে স্নান করতে করতে কোথায় উধাও হয়ে যান। তিন দিন পরে এসে তিনি তাঁর বক্তব্য রাখতে শুরু করেন। তিনি বলেন, হিন্দু মুসলিম এইভাবে মানুষের ভাগ করা উচিত নয়, সব মানুষ সমান, ইত্যাদি এবং এইভাবে আরেক গোষ্ঠী শিখদের সৃষ্টি করেন। মানবপ্রেম ও তাঁর নতুনতর ‘বৈপ্লবিক’ ধৰ্মীয় মতামত প্রচার করতে তিনি নাকি আসাম, সিংহল, লাদাখ, তিব্বত, মক্কা-মদিনাতেও গিয়েছিলেন।
তাঁর শেষজীবন কাটে এখনকার পাকিস্তানের করতারপুরে। এখানে তিনি প্রথম শিখ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৫৩৯ খ্রীষ্টাব্দে মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি শিখদের দ্বিতীয় হিসেবে মনোনীত করে যান অঙ্গদকে (তাঁর গুরু পদের সময়কাল ১৫৩৯-৫২ খ্রীস্টাব্দ)।
৪র্থ গুরু হন অঙ্গদের জামাই রামদাস সোধি (১৫৭৪-৮১)। এরপর শুধু এই সোধি পরিবার থেকেই গুরু হতে থাকেন। পরের গুরু রামদাসের ছেলে অর্জুনমল (১৫৮১-১৬০৬), তারপর হরগোবিন্দ (১৬০৬-৪৪), এরপর এঁর নাতি হররাই (১৬৪৪-৬১)। হররাই ৮ম গুরু মনোনীত করেন তাঁর ৫ বছরের ছেলে হরিকৃষেণকে (১৬৬১-১৬৬৪)—মাত্র ৮ বছর বয়সে এই শিশু গুটিবসন্তে মারা যায়। নবম গুরু হন হরগোবিন্দের ছেলে তেগবাহাদুর (১৬৬৪-৭৫)। ১৬৭৫-এর নভেম্বর মাসে দিল্লিতে মোগলরা তাঁকে হত্যা করে। মোগল রাজশক্তির বিরুদ্ধে শিখরা সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হন। দশম গুরু গোবিন্দরাই (১৬৭৫-১৭০৮) এই সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন ও আন্দোলনকে সুসংগঠিত রূপ দেন। ১৬৯৯-এর ১৩ এপ্রিল ( নববর্ষের দিন) গুরু গোবিন্দরাই শিখদের এই সশস্ত্র সংগ্রামকে ধর্মীয় আন্দোলনে রূপান্তরিত করেন। পাঁচজন শিখকে এই নতুনতর ধর্মে দীক্ষিত করেন এবং তাঁদের নাম দেন খালসা। পার্সি শব্দ ‘খালেস’-এর অর্থ পবিত্র। তিনি খালসা পুরুষদের সাধারণ পদবি দেন ‘সিং’ (অর্থাৎ সিংহ) এবং মহিলাদের ‘কাউর’ (অর্থাৎ সিংহী)। খালসাদের জন্য পাঁচ ‘ক’-এর ব্যবহার বাধ্যতামূলক ধর্মীয় আচার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হলো। এগুলি হলো- কেশ (না কাটা চুল-যে চুল কাটবে সে পতিত হবে), কাঙ্গা (অর্থাৎ ছোট চিরুনী), কিরপান, কছ (বিশেষ অন্তবাস) এবং কাড়া (হাতের বালা, যেটি শয়তানের বিরুদ্ধে গুরুর মন্ত্রপুত অস্ত্র হিসেবে গণ্য করা হয়; এটি খালসাদের মধ্যে তথা শিখদের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্বেরও প্রতীক এবং হিন্দুদের রাখী-র একটি পরিবর্তিত রূপ)। অবশ্য গোবিন্দরাই (অর্থাৎ গুরু গোবিন্দ সিং)-এর আগেও শিখদের মধ্যে এগুলির কোন কোনটির কিছু প্রচলন ছিল।
শিখধর্মে হিন্দু ধর্মের কিছু কিছু ছাপ পড়েছে। যেমন বৈদিক রহস্যময়, অর্থহীন শব্দ ‘ওঁ’-কে গ্রহণ করা হয় এবং সৃষ্টিকর্তা (বা ‘কার’)-এর মাহাত্ম্য সম্ভ্রমের সঙ্গে উল্লেখ করার জন্য ব্যবহৃত হয়। “ইক ওঁ কার’-সেই একমেবাদ্বিতীয়ম সৃষ্টিকর্তাকে বোঝায় এবং শিখদের মধ্যে ব্যবহৃত স্থানীয় ভাষা পাঞ্জাবীতে এটি একটি বিশেষ শ্রদ্ধেয় অক্ষরের রূপ পায়। অন্যদিকে শিখধর্মেও ইসলাম ধর্মের মত একেশ্বরবাদ স্বীকৃত, ঈশ্বরের কোনো ছবি বা মূর্তি নিষিদ্ধ, পুতুল পূজাও নিষিদ্ধ সূর্য, চন্দ্র ইত্যাদির পূজা, গঙ্গাজলকে পবিত্র ভাবা,—এসব বন্ধ করা হলো। হিন্দুদের বেদ সব হিন্দু পড়তে পারে না, কিন্তু মুসলিমদের কোরান সবাই পড়তে পারে। শিখদের ধর্মগ্রন্থ আদিগ্রন্থ-ও সবার কাছে উন্মুক্ত—প্ৰতি শিখই তা পড়তে পারে। পঞ্চমগুরু অর্জুন এই আদি গ্রন্থ রচনা করেন— নানকের মৃত্যুর অনেক পরে। এই আদিগ্রন্থকে পরবর্তীকালে দেবতার আসনে বসিয়ে পূজা শুরু হয় এবং গ্রন্থসাহেব (The Granth Personified) নাম দেওয়া হয়। ১৭০৪ সালে গুরু গোবিন্দ সিং এর কিছু পরিমার্জনা করেন। তবে গুরু গোবিন্দ ‘দশম’ নামে আরেকটি ধর্মপুস্তক রচনা করেন— সব শিখ এটি গ্রহণ করেন নি। খালসাদের আচার, শৃঙ্খলা, ঐতিহ্য ইত্যাদি সম্বলিত বই-এর নাম ‘রহতনামা’। এছাড়া আছে ‘সৌশাখি’ (একশ গল্প) নামে আরেকটি নীতিশিক্ষামূলক ধর্মগ্রন্থ।
গুরু গোবিন্দ সিং-এর সামরিক জীবন খুব একটা সফল হয় নি। তাঁর অধিকাংশ অনুগামী আর চার পুত্র মুসলিম শাসকদের (মোগল) সঙ্গে যুদ্ধে মারা যান। তিনি পাঞ্জাব ত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং ১৭০৮ খ্রীস্টাব্দের ৭ অক্টোবর মহারাষ্ট্রের নানদেদ-এ তাকে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর আগে তিনি ঘোষণা করে যান যে, তাঁর পরে আর কেউ গুরু হবে না! অর্থাৎ তিনিই শিখদের শেষ গুরু।
মোগলদের বিরুদ্ধে নিজেদের স্বাতন্ত্র ও স্বাধীনতার যুদ্ধের নেতৃত্ব এরপর দেন বান্দা সিং বাহাদুর (জীবৎকাল ১৬৭০-১৭১৬)। আট বছর ধরে বান্দা মুসলিম শাসকদের প্রতিহত করে রাখেন, কিন্তু অবশেষে ৭০০ অনুচর সহ বন্দী হন এবং ১৭১৬-এর গ্রীষ্মকালে দিল্লীতে তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
এরপর খালসারা পাহাড়ী এলাকায় আত্মগোপন করেন। ১৭৩৮-৩৯ খ্রীস্টাব্দ সময়কালে পারস্যের নাদির শাহ্ ভারত আক্রমণ করার পর মোগলদের নিয়ন্ত্রণ শিথিল ও মোগল সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে খালসারা সমতল এলাকায় নেমে আসেন এবং ‘মিস্’ নাম নিয়ে নিজেদের সংগঠিত করেন। এঁরা শহর ও গ্রামের লোকেদের কাছ থেকে সুরক্ষার নাম করে অর্থ আদায় করতেও শুরু করেন। (পার্সি শব্দ ‘মেসাল’-এর অর্থ উদাহরণ ও সমান—উভয়ই)।
১৭৪৭-১৭৬৯ খ্রীস্টাব্দ সময়কালে আহমদ শাহ দুরানির ক্রমাগত আক্রমণে মোগল সাম্রাজ্য আরো দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৭৬১ সালের তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধে মারাঠারা আফগানদের হাতে পরাজিত হন। এর ফলে ঐ এলাকায় শাসন ক্ষমতায় যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, তাকে কাজে লাগিয়ে শিখরা পাঞ্জাবের বিস্তীর্ণ এলাকার এলাকার শাসন ক্ষমতা লাভ করে।
মুসলিমদের মত শিখরাও শেষ অব্দি ধর্মের সঙ্গে সামরিক ক্ষমতা ও নিজেদের স্বাধীনতাকে সম্পৃক্ত করে ফেলেন। শিখধর্মে সর্বধর্মের সমন্বয়ের কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে নিজেই অন্য ধর্ম থেকে পৃথক একটি ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নানক যে গোঁড়ামি ও ধর্মীয় সংকীর্ণতার বেড়া ভাঙার সামাজিক প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন ঐ ধরনের বেড়ায় নিজেরাও আবদ্ধ হয়ে পড়েন। হিন্দুদের মতো জাতপাত না থাকলেও বা ‘গুরু কা লঙ্গর’-এর মতো জায়গায় সবাই একসঙ্গে খাওয়ার প্রথা থাকলেও শিখধর্মেও নিজ ধর্মাবলম্বী লোকেদের মধ্যেই বিভাজন রয়েছে। এ ধরনের তিন শ্রেণীর মানুষ আছে শিখদের মধ্যে—জাঠ (মূলত কৃষিজীবী), অজাঠ (ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য), মাজাহাবি (অস্পৃশ্য, যাদের একটু নিচু চোখে দেখা হয়, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে।
অন্য সব ধর্মের মতো শিখধর্মও কিছু ব্যক্তি, বিশেষ প্রয়োজনে সৃষ্টি করেছিলেন। অন্য সব ধর্মের মতো শিখধর্মেও বিভিন্ন সময়ে বিভাজন ঘটেছে। নানকের বড় ছেলে শ্রীচাঁদ প্রথম এ ধরনের একটি উপদলের সৃষ্টি করেন ‘উদাসী’ নাম দিয়ে। এঁর অনুগামীরা সন্ন্যাসীদের মতো জীবনযাপন করেন ও ‘মহন্ত’ নাম নিয়ে গুরুদ্বারার নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। ১৯২৫ সালে শিরোমণি গুরুদ্বারা প্রবন্ধক কমিটি (SGPC) তৈরী হওয়ার পর এই মহন্তদের ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। সপ্তম গুরু হররাই অষ্টম গুরু হিসেবে নিতান্তই শিশু, তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র হরিকৃষেণকে মনোনীত করার ফলে, তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রামরাই কিছু শিখকে ভাঙিয়ে আলাদা গোষ্ঠী গড়েন; দেরাদুনে এঁদের প্রধান কার্যালয় এখনো আছে।
খালসারাও পরে নানা উপদলে বিভক্ত হন। বান্দা বাহাদুর সিং-এর প্রত্যক্ষ অনুগামী ‘বান্দাই খালসা’ এখন আর প্রায় নেই। কিন্তু অন্য বিভাগ, যেমন নামধারী ও নিরংকারী-রা এখনো আছেন এবং তাঁরা নিজেদের জীবন্ত গুরুকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করেন।
শিখদের আরাধনার স্থান, মন্দিরের সমগোত্রীয় প্রতিষ্ঠানকে প্রথমে ধর্মশালা বলা হতো যার অর্থ ‘বিশ্বাসের স্থান’—পরে এর নাম দেওয়া হয় ‘গুরুদ্বারা’, যেটি নাকি ‘গুরুর কাছে পৌঁছনোর পথ।’
অন্য প্রায় সব প্রচলিত ধর্মের অনুগামীদের মতো শিখরাও কিছু আচার-অনুষ্ঠানকে অবশ্যপালনীয় বলে মনে করেন। যেমন বাচ্চা জন্মালে তার কয়েক দিন পরে তাকে গুরুদ্বারায় এনে আদিগ্রন্থ খোলা হয় এবং বাঁ দিকের পাতার প্রথম লাইনের প্রথম অক্ষর অনুযায়ী তার নাম রাখা হয়। বয়ঃসন্ধিকালে তার ‘পাহুল’ অনুষ্ঠান (baptize) করে ‘অমৃত’ দেওয়া হয় এবং খালসায় রূপান্তরিত করা হয়। বিয়ের সময় (আনন্দ করজ) বর-বৌকে আদিগ্রন্থের চারপাশে চারপাক ঘুরতে হয়। মৃত্যুর পরে পোড়ানোর আগে অব্দি বিরামহীন ভাবে আদিগ্রন্থ পড়া হয়। আর মৃতের দেহভস্ম বিপাসা বা গঙ্গায় ফেলা হয়। এছাড়া তো আছে পাঁচ ‘ক’। এইভাবেই নানা সংস্কারের স্বাতন্ত্র্যে শিখরা নিজেদের অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষদের থেকে আলাদা করে রাখেন—যা শুরুতে গুরু নানক ভাঙতে চেয়েছিলেন—এবং শুধু নানক বা কেন, তথাকথিত সব ধর্মগুরুরাই প্রায় এধরনের কথা বলেছিলেন। কিন্তু কখনোই এসব ধর্মমত সব মানুষের মিলনস্থল হয়নি। তার একটি বড় কারণ হয়ত অর্থনৈতিক ও সামাজিক দ্বন্দ্বগুলিকে দূর না করে নিছক কিছু আচার অনুষ্ঠানগত সংশোধন করার চেষ্টা, অন্যদিকে ঈশ্বর ও নানা প্রাসঙ্গিক বিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখা।
বর্তমান পৃথিবীর শতকরা ০.৩ ভাগ মানুষ শিখ ধর্মাবলম্বী। এঁরা ছড়িয়ে আছেন ২০টি দেশে। তবে সংখ্যাগত আনুপাতিক বিচারে মূলত ভারতে (জনসংখ্যার শতকরা ১.৯৭ ভাগ) ও কানাডায় (০.৩ ভাগ) এঁরা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় রয়েছেন।
✩ ✩ ✩
এইভাবে ইহুদি (Judaism), হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রীস্ট, ইসলাম বা শিখ— পৃথিবীর সব বড় বড় ধর্মকে মানুষই তার নিজের মতো করে তৈরি করেছে। সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষা, সামাজিক সংস্কার সাধন করা, কিছু প্রাসঙ্গিক মূল্যবোধ ইত্যাদি সমস্ত ধর্মেরই একটি বড় দিক। আরেকটি দিক হচ্ছে ঈশ্বর ও অতিপ্রাকৃতিক শক্তি সম্পর্কে মানুষের মিথ্যা বিশ্বাস, কল্পনা আর আস্থা টিকিয়ে রাখা। বিশেষ সময়ে বিশেষ শাসকগোষ্ঠী বা স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি এসব ধর্মকে নিজেদের কাজে লাগিয়েছে, পৃষ্ঠপোষকতা করেছে।
বর্তমানে, (১৯৯২-এর মাঝামাঝি) পৃথিবীতে এই সাতটি ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা মোট পৃথিবীবাসীর শতকরা ৭০.৯ ভাগ। এছাড়া শতকরা ২০.৪ জন আছেন যাঁরা কোনো তথাকথিত ধর্মে বিশ্বাস করেন না—নাস্তিক বা ধর্মপরিচয় মুক্ত; তাঁদের একমাত্র ‘ধর্ম’ মনুষ্যত্বের ধর্ম, প্রধান পরিচয় মানুষ হিসেবে। বাকি শতকরা ৮.৭ ভাগ পৃথিবীবাসীর মধ্যে আরো অজস্র ছোটোবড় ধর্মমত প্রচলিত। এদের কোনো কোনোটির ইতিহাস অতি প্রাচীন, কোনো কোনোটি আবার নিতান্তই হাল আমলের। কোনো কোনোটি প্রায় লুপ্ত হয়ে যাওয়ার মুখে, এখন আর অনুগামী নেই বললেই চলে। সামাজিক প্রয়োজন কমে গেলে বা ফুরিয়ে গেলে ঐসব ধর্মমতও পরিমার্জিত হয়েছে, রূপান্তরিত হয়েছে বা লুপ্ত হয়ে গেছে, চিরন্তন হয়ে থাকতে পারেনি।
মেক্সিকোর অ্যাজটেক, গুয়াতেমালার মায়া, কলম্বিয়ার চিবচান বা পেরুর ইনকা—এসব প্রাচীন সভ্যতার দেবদেবী ও ধর্মাচরণ এখন অর্ধলুপ্ত বা প্রায় সম্পূর্ণ লুপ্ত। কোয়েতজাল কোল (সর্পদেবতা), তেজকাতলিপোকা (সূর্যদেবতা), পাচাকামাক ও পাচামামা (উর্বরতার দেবদেবী)—ইত্যাদি ধরনের যে সমস্ত দেবতারা আমেরিকার আদি অধিবাসীদের আরাধ্য ছিল, তারা এখন মানব সভ্যতারা যাদুঘরে ঠাঁই পেয়েছে। আর্যরা ভারত ভূখণ্ডে ঢোকার আগে মোঅনজোদারো বা হরপ্পায় যে-সব দেবদেবীর পূজা করা হতো, তার অনেকগুলিই এখন আর মানুষের মনে জায়গা পায় না। আবার মাথায় শিংওয়ালা, তিনমুণ্ডওয়ালা (?) যে পুরুষটির (দেবতার) ছবি সিন্ধু সভ্যতার মুদ্রা ইত্যাদিতে পাওয়া যায়, সেটি পরবর্তীকালে তথাকথিত হিন্দুদের ব্রহ্মা বা শিবের মতো দেবতার কল্পিত মূর্তিতে ছাপ ফেলেছে।