শিণ্টোধর্ম

শিণ্টোধর্ম

চীনের প্রতিবেশী জাপানে যে প্রাচীন ধর্মমত সৃষ্টি হয়েছিল তা শিন্টোধর্ম নামে পরিচিত। বর্তমানে পৃথিবীর ০.১ ভাগ মানুষ এখনো এই ধর্মে বিশ্বাস করেন এবং এঁরা ছড়িয়ে আছেন জাপান সহ পৃথিবীর মাত্র তিনটি দেশে। প্রাচীন জাপানের পুরোহিত স্থানীয় ব্যক্তিরা শুরুতে তিনটি দেবতার, পরে আরো দুটির এবং আরো পরে এক এক করে আরো পাঁচ জোড়া দেবতার কল্পনা করেন। তাঁদের কল্পনায় আকাশ ও পৃথিবী প্রথমে সৃষ্টি হয়। দেবতারা আকাশে থাকেন। প্রথমদিকের দেবতাদের কোনো নাম নেই। শেষ দুটি দেবতারই নাম ও মূর্তি আছে। এরা হচ্ছে ইজানাগি ও ইজানামি নামে দম্পতি। এরাই জাপানের দ্বীপপুঞ্জ, সূর্য ও তার দেবী আমাতেরাসু ও অন্যান্য দেবতাদের আর চন্দ্র, বজ্র, বিদ্যুৎ ইত্যাদি সৃষ্টি করে। এবং এই সূর্যদেবী আমাতেরাসু নাকি জাপানের প্রথম সম্রাট, খ্রীস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর জিম্মু তেন্নোকে সৃষ্টি করেছে। স্পষ্টতই শাসকগোষ্ঠী সাধারণ মানুষের মধ্যে নিজের কর্তৃত্ব, স্বাতন্ত্র্য ও মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠার জন্য সূর্যের সঙ্গে নিজেদের সৃষ্টিকে জুড়ে দিয়েছিল। এই সূর্য যে পৃথিবীর প্রাণ ও প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর পেছনে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ কারণ, ঐ বোধ—আদিমকাল থেকেই মানুষ উপলব্ধি করেছে। তাই সূর্যের থেকে যার সৃষ্টি সে যে সর্বোত্তম তাতে তো সন্দেহ নেই। মহাভারতের ‘সূর্যবংশীয় রাজা’ থেকে শুরু করে বহু দেশের শাসকগোষ্ঠীই এই কৌশল অবলম্বন করেছে এবং তাকে মানুষের ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে।

জাপানের প্রাচীনতম ধর্মবিশ্বাসে গোষ্ঠীদেবতার আরাধনা ছিল মুখ্য, যাকে বলা হতো ‘কামি’–এর অর্থ শ্রেষ্ঠ, প্রধানতম ইত্যাদি। এ-ধরনের ধারণাকে কেন্দ্র করে নানা আচার-অনুষ্ঠানের জন্ম হয়। কিন্তু ধর্ম হিসেবে এর আলাদা কোন নাম ছিল না। চতুর্থ শতাব্দীর সময়কালে চীন থেকে কনফুসিয়ান ধর্ম জাপানে অনুপ্রবেশ করে। ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে কোরিয়ার কিছু ব্যক্তি জাপানে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। এর প্রায় একশ বছর পরে জাপানের সম্রাট তেন্নো (বা মিকাডো) বৌদ্ধধর্মকে নিজের শাসনকার্যের সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করেন এবং অষ্টম শতাব্দীতে (Nara period) এটি জাপানের কেন্দ্রীয় সরকারি ধর্মে পরিণত হয়।

অন্যদিকে জাপানের নিজস্ব ধর্মীয় কল্পনা এ-সব বহিরাগত ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত ও পরিমার্জিত হতে থাকে। কামি-দেবতার আচার অনুষ্ঠানকে চীনারা বলত শিন-টো নামে। এই চৈনিক নামটিই পরে জাপানের ঐ নামহীন, প্রাচীন, নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাসাদির পরিচায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। শিন্টোধর্মাবলম্বীদের অনেকেই বৌদ্ধ বা কনফুসিয়ান-ধর্মেও একই সঙ্গে বিশ্বাস করেন। আবার উভয়ের মধ্যে বিরোধও ঘটে।

পরে ষোড়শ শতাব্দীতে খ্রীস্টধর্ম জাপানে অনুপ্রবেশ করে। বিশেষত বহু দরিদ্র জাপানি কৃষক এই ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করেন। কিন্তু পরে জাপানি শাসকরা এ-ধরনের বিধর্মী অনুপ্রবেশকে নিজেদের অস্তিত্বের পক্ষে বিপজ্জনক হিসেবে অনুভব করেন। এবং ১৬১৪ খ্রীস্টাব্দে জাপানে খ্রীস্টধর্ম নিষিদ্ধ করা হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে চীন ও কোরিয়ার প্রভাবকেও খর্ব করার জন্য কনফুসিয়ান ও বৌদ্ধধর্মকে হতমান করা হয়। এবং দেশের নিজস্ব প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস ও শিণ্টোধর্মে ফিরে যাওয়ার আন্দোলন গড়ে ওঠে। ১৮৬৭-৬৮ খ্রীস্টাব্দে মেইজি অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অত্যাচারী সামন্ততান্ত্রিক অভিজাতদের হঠিয়ে দিয়ে উদার রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং শিন্টোধর্মকে জাপানের সরকারি ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

বর্তমানে জাপানে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি বা সাম্প্রদায়িক বিরোধ আর নেই। তবু শিন্টোধর্ম বেশ কিছু মানুষের নিজস্ব বিশ্বাস হিসেবে টিকে আছে। জাপানের সম্রাটকে ঐ সূর্যের দেবী আমাতেরাসুর উত্তরসূরী হিসেবেই ভাবা হয়—কিন্তু সে শুধু খাতায় কলমে। শিণ্টোধর্মে, পরজন্ম বা মৃত্যুর পরের অবস্থার কোনো কাল্পনিক ছবি আঁকা হয় না এবং তাকে গুরুত্ব ও দেওয়া হয় না। পৃথিবীর মানুষদের নিয়েই তার কারবার, পার্থিব ব্যাপার নিয়েই তার যা আচার-অনুষ্ঠান। আর এ-কারণেই হয়তো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর, ১৯৪৫-এর ডিসেম্বরে শিন্টোধর্মকে সরকারি ধর্ম হিসেবে গণ্য করার নিয়ম বাতিল করা, সম্রাটকে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে গণ্য করা ও জাপানিদের পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে মনে করা জাতীয় প্রাচীন ধর্মীয় বিশ্বাসগুলিকে অসার হিসেবে ঘোষণা করা সত্ত্বেও,—কোনো গণবিক্ষোভ ঘটে নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *