জরথুষ্ট্রবাদ
জরথুষ্ট্রবাদ (Zoroastrianism) আরেকটি প্রাচীন ধর্ম যা পারস্য (এখনকার ইরান) অঞ্চলের মানুষেরা সৃষ্টি করেন। কিন্তু ৭ম শতাব্দীর পরে এখানকার মানুষ ব্যপকভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার ফলে, পারস্যের নিজস্ব এই প্রাচীন ধর্ম মাতৃভূমিতে প্রায় বিলুপ্ত হয়। বর্তমানে এই ধর্মের অনুসারীরা প্রধানত পার্সী নামে পরিচিত, সংখ্যায় এঁরা সারা পৃথিবীতে দেড় লক্ষেরও কম এবং মূলত ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে রয়েছেন। এই ধর্ম-এর প্রধান দেবতা আহুরা মাজদা, এ কারণে একে মাজদাবাদ (Mazdaism) নামেও ডাকা হয়। জরথুষ্ট্রকে এই ধর্মের প্রচারক হিসেবে বলা হয়। এর প্রধান ধর্মপুস্তক আবেস্তা, তাই অনেক একে আবেস্তাবাদ (Avestism) নামেও অভিহিত করান। আবার এই ধর্মের প্রধান দিক হচ্ছে আগুনকে পবিত্র ভেবে রক্ষা করা, পূজা করা ইত্যাদি—যে কারণে একে অগ্নি উপাসনা এবং এই ধর্মাবলম্বীদের অগ্নিউপাসক হিসেবেও বলা হয়।
জরথুষ্ট্র খ্রীস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দী সময়কালে পারস্যে জন্মান। ( অনেকের মতে আরো আগে, কারো মতে আদৌ এ নামে কোন ঐতিহাসিক চরিত্র ছিল না।) তিনিই আবেস্তাকে লিখিতরূপ দেন। জরথুষ্ট্রবাদ যথাসম্ভব উত্তর-পূর্ব পারস্যে (বর্তমানের আফগানিস্থান ও তাজিকিস্থান) বিকশিত হয়। আবার অনেকের মতে আবেস্তা রচিত হয় উত্তর পশ্চিম পারস্যে-মিডিয়া (Midia) নামক স্থানে, যেখানকার আদিবাসীদের মধ্যে এই তথাকথিত ধর্মপুস্তক প্রচলিত ছিল। আর পারস্যের পশ্চিমাঞ্চলে যে মাজি (Magi) নামক ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রভাব ছিল তা মোটামুটি সুনিশ্চিত।
খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দ সময় কালে পারস্যের একটি জনগোষ্ঠী, পূর্বদিকে ক্রমশ ভারতীয় অঞ্চলে প্রবেশ করে এবং আর্য নাম ধারণ করে (প্রকৃতপক্ষে আর্যভাষী)। তার আগে, ঐ প্রাগৈতিহাসিক সময়ে, এই অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে যে সব বিশ্বাস ও তথাকথিত ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল, সেগুলি এই ভারতীয় আর্যভাষীরাও সঙ্গে করে আনেন। আবার সেগুলি পরবর্তীকালে গ্রন্থিত আবেস্তা-তেও অন্তর্ভুক্ত হয় এবং আবেস্তবাদ তথা জরথুষ্ট্রবাদের অঙ্গীভূত হয় : যেমন পবিত্র পানীয় হাওম (haoma) (ভারতীয় সোমরস), আহুরা (ভারতীয় অসুর), দীব (ভারতীয় দেবতা), আন্দ্ৰা (বৈদিক ইন্দ্ৰ), যিম (বৈদিক যম), সূর্যদেবতা মিথরা ( এখনো ভারতে এই নামের দেবতার পূজা করা হয়) ইত্যাদি। অবশ্য জরথুষ্ট্রবাদের আহুরা ছিলেন আলো ও দয়ার ‘দেবতা’ আর দীব ছিলেন অন্ধকার ও পাপের ‘দেবতা”। প্রধান আহুরা ছিলেন আহুরা মাজদা—তিনি সব ভাল জিনিসের সৃষ্টিকর্তা এবং এঁর শত্রু বা বিপরীত (কিন্তু যমজ ভাই) ছিলেন আংরা মইন্যু ( Angra Mainyu) যিনি সব মন্দ, অপকারী জিনিষের সৃষ্টিকর্তা। এই দ্বৈতবাদ (অর্থাৎ একই ঈশ্বর ভালমন্দ সৃষ্টি করেছেন তা নয়) এই ধর্মের একটি বড় দিক।
আসলে, প্রাগৈতিহাসিক সময়কার দুই বিপরীত অর্থনীতি অনুসরণকারী আদি জনগোষ্ঠীর মধ্যকার বিরোধ এই দ্বৈতবাদের মধ্যে প্রতিফলিত। নির্দিষ্ট জায়গায় বসাবাসকারী কৃষিজীবী গোষ্ঠী এবং যাযাবর গোষ্ঠী (যারা তখন যাযাবর বৃত্তি ত্যাগ করে স্থিতু হতে চাইছিল অর্থাৎ জমির মালিক হতে চাইছিল)—এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ স্বাভাবিক ভাবে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। পূর্বোক্ত গোষ্ঠী আহুরা-পন্থী (এঁরা পারস্যেই থেকে যান) এবং দ্বিতীয়টি দীব-পন্থী (অথবা এঁদের এই নামে অভিহিত করা হয়, কারণ দীব মানেই মন্দ; এই গোষ্ঠীই পারস্যে নিরাপদ স্থান না পেয়ে একসময় পূর্বদিকে ‘পশ্চাদপসরণ’ করতে করতে সিন্ধু উপত্যকায় আসেন, ধীরে ধীরে যাযাবরবৃত্তি ত্যাগ করে কৃষি, পশুপালন ইত্যাদির সাহায্যে স্থিতু হয়ে বসেন; এবং পরে এঁরাই ভারতীয় ‘আর্য’ হিসাবে অভিহিত হন; এঁদের কাছে ‘দীব’ তখন হয়ে যান উপাস্য ও শুভ, আহুরা হয়ে যান অসুর ও মন্দ। ভারতীয় আর্যভাষীদের প্রথম বই ঋগবেদ-এর ভাষা আদি সংস্কৃত; এর অনেক শব্দ পরবর্তী সংস্কৃতে পাওয়া যায় না। আবেস্তা ইত্যাদির সঙ্গে মিলিয়েই এমন অনেক শব্দের অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে)।
পারস্যে থেকে যাওয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধীরে ধীরে জন্ম হয় সুসংহত ধর্মমত—জরথুষ্ট্রবাদ। খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী সময়কালে, পশ্চিম পারস্যের পুরোহিতগোষ্ঠী মাজি-দের হটিয়ে দিয়ে, আর্কিমেনিডী ক্ষমতায় আসেন এবং আহুরা মাজদাকে রাষ্ট্রীয় উপাস্য দেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। যথাসম্ভব এই সময়ই জরথুষ্ট্র ধর্মীয় সংস্কারক-এর ভূমিকা গ্রহণ করেন এবং প্রকৃতপক্ষে রাজার স্বার্থরক্ষার জন্য আহুরা মাজদা-কেন্দ্রিক মাজদাবাদ তথা জরথুষ্ট্রবাদকে সুসংহত ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন।
এই ধর্মে নানা অনুষ্ঠানাদির মধ্য দিয়ে পবিত্রতা অর্জন করা, পবিত্র আগুনকে রক্ষা করা ইত্যাদি গুরুত্ব পায়, কিন্তু অনুষ্ঠানাদি করার অধিকার ছিল একমাত্র পুরোহিত স্থানীয় আথ্রাবানু (Athravanos)-দের। মৃতদেহ এতে চরম অপ্রবিত্র জিনিষ হিসেবে গণ্য হয় এবং কোনভাবে যাতে মাটি, জল ও আগুনের সংস্পর্শে না আসে তার দিকে কঠোর নজর দেওয়া হয়। দাখমা (dakhma) নামে একটি উঁচু স্তম্ভের উপর মৃতদেহ রেখে দেওয়ার প্রথার সৃষ্টি হয়েছে, শকুনিরাই তা খেয়ে ফেলবে। দাখমা শয়তান বা দীব-দের জায়গা। জন্মান্তরের কথা না বল্লেও, এই ধর্মে মৃত্যুর পরে স্বর্গ (আহুরা মাজদা-র রাজ্য) ও নরক (আংরা মইন্যু-র রাজ্য) ইত্যাদিতে যাওয়ার কথা ভাবা হয়—জীবনে ভালকাজ বা মন্দ কাজের উপর এই ‘ভবিতব্য’ নির্ভর করে। এইভাবে নৈতিকতা ও মানবতাবদী নানা কাজ ও চিন্তা এই ধর্মেও স্বাভাবিক ভাবেই আছে—যা সব ধর্মের ক্ষেত্রেই সত্য এবং যা, মানুষকে অনুসরণ করতে বলা হয় এক কল্পিত শাস্তির ভয় দেখিয়ে। অন্যদিকে ধর্মে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের ‘আত্মা’-র ভবিতব্যের কথাও বলা হয়, এবং এইভাবে একটি স্বাতন্ত্র্যের দাবী করে, বিশেষত সেই সব ধর্ম থেকে যে সব ধর্ম মানুষের তথা তার আত্মার’ ভবিতব্য জন্মসূত্রেই নির্ধারিত বলে প্রচার করে।
এই ধর্মে মিথরা (সূর্য) দেবতা প্রচণ্ড শক্তিশালী, বীর; ২৫শে ডিসেম্বর তাঁর ‘জন্মদিন’ পালন করা হয়, যে দিনটি পৃথিবীর সূর্যপরিক্রমার সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত।
৭ম শতাব্দী সময়কালে আরবীয় মুসলিমদের দ্বারা ইরান অধিকারের আগে অব্দি জরথুষ্ট্রবাদ সেখানকার রাষ্ট্রীয় ধর্ম ছিল। পরবর্তীকালে ইসলাম-এর স্রোতে তা ভেসে যায় বা অন্যান্য নানা স্থানীয় ধর্মের সঙ্গে মিশে নানা রূপ ও গোষ্ঠীর জন্ম দেয় যেমন পলিসিয়ান (৭ম শতাব্দী), বোগোমি (১০ম শতাব্দী), ক্যাথারিস্ট ও আলবিজেনিস (১২-১৩শ শতাব্দী) ইত্যাদি, কিংবা কুর্দদের মধ্যে, ককেশাস অঞ্চলে (যেখানে প্রায় একই ধরনের স্তম্ভে মৃতদেহের সৎকার করা হয়) ইত্যাদি। ইরানের গবর (gabr) নামক ক্ষুদ্র অগ্নি উপাসক গোষ্ঠী কিংবা বোম্বাই-গুজরাটের পার্সিদের মধ্যে (ভারতের জনসংখ্যার শতকরা ০.০১ জন জরথুষ্ট্রবাদী) এই ধর্মবিশ্বাসের অবশেষ এখনো আছে।
ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাস কিভাবে সময় ও সমাজের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়, মানুষের প্রয়োজনে বিকাশের ও অপ্রয়োজনে অবলুপ্তির পথে এগিয়ে যায়——তার আরেকটি জ্বলন্ত উদাহরণ জরথুষ্ট্রবাদ।