ধর্মবিশ্বাসের উদ্ভব ও বিবর্তন

ধর্ম বিশ্বাস : উদ্ভব ও বিবর্তন

পৃথিবীতে বর্তমানে প্রচলিত ধর্মগুলি সৃষ্টি হয়েছে বড় জোর বিগত ২-৪ হাজার বছরের মধ্যে। হিন্দু, ইসলাম, খ্রীস্ট ইত্যাদি কোন ধর্মই চিরন্তন বা সনাতন (eternal অর্থে) নয়; সনাতন ধর্ম নিছকই একটি ভ্রান্ত বিশ্বাস। তবে সনাতন না হলেও ধর্মসৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল আরো বহু সহস্র বছর আগে। এখনো অব্দি পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এটি জানা গেছে, মানুষ-এর মনে ধর্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল এখনকার মানুষের পূর্বসূরী নিয়ানডার্থাল মানুষের আমলে যারা পৃথিবীতে ছিল এখন থেকে প্রায় আড়াই লক্ষ থেকে ৪০-৫০ হাজার বছর আগে (Mousterian Period —Pleistocene epoch-এর একটি অংশ)।

***

সৃষ্টি রহস্য— ১

এখন থেকে দেড়-দুই হাজার কোটি বছর আগে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, এক মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে।

পারমাণবিক কণিকা ও বিভিন্ন কণিকার মিলনে নানাবিধ পদার্থের পরমাণু-অণুর সৃষ্টি হতে থাকে।

পরবর্তী কোটি কোটি বছর ধরে ছায়াপথ, নক্ষত্র, সূর্য-গ্রহ ইত্যাদির সৃষ্টি।

এখন থেকে ৪৬০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর আদিমতম শিলা (মাটি) সৃষ্টি হয়।

৪৬০-৫৭ কোটি বছর আগেকার সময়কে বলা হয় প্রিক্যামব্রিয়ান যুগ (Precambrian era)। এই সময়েই নানা পদার্থের ভাঙ্গা গড়ার মধ্য দিয়ে আকস্মিকভাবে জৈব পদার্থ ও তার থেকে এককোষী প্রাণের জন্ম,—এখন থেকে ৩৭০-৩০০ কোটি বছর আগে কোন এক সময়ে।  এক কোষী প্রাণ সৃষ্টির ২৬ কোটি বছর পরে বহু কোষী প্রাণের জন্ম। তারও পরে কোটি কোটি বছর ধরে জটিলতর বহুকোষী প্রাণীর সৃষ্টি। এদের অধিকাংশই স্বল্প সময়ে লুপ্ত হয়ে যায়। কিছু পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে টিকে থাকে ও তাদের ক্রমবিবর্তন ঘটতে থাকে।

৫৭-২২.৫ কোটি বছর আগেকার সময় বলা হয় প্যালিওজোইক যুগ। এই সময়কালে ক্রমশঃ অমেরুদণ্ডী প্রাণী, খোলওয়ালা শামুক ইত্যাদি, মাছ, পোকা-মাকড়, প্রাথমিক উদ্ভিদ, ফার্ন-এদের সৃষ্টি।

***

তখন শাসক-শাসিত শ্রেণীবিভাগ ছিল না, শাসনস্বার্থে ধর্মের ব্যবহার হওয়ার প্রশ্নই ছিল না। মানুষ নিছক তার অনুসন্ধিৎসার ফলে, অজ্ঞতা ও অসহায়তায় কারণে তার উন্নত কল্পনাশক্তির সাহায্যে তথাকথিত আদিম ধর্মের সৃষ্টি করেছে। তখনকার পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে এটি ছিল একটি উন্নততর ও বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া। ধর্মকে শাসকশ্রেণীর অপব্যবহারের কাজ, যা ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে—সেটি অনেক অনেক পরের ব্যাপার,

— বিগত ২-৩ শতকের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলি এখন যেমন বিশেষ গোষ্ঠীর হাতে পড়ে ব্যাপক মানুষকে শোষণ ও শাসন করার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু সে আরেক ইতিহাস।

***

সৃষ্টি রহস্য—২

২২.৫-৬.৫ কোটি বছর আগেকার সময়কালকে বলা হয় মেসোজইক যুগ। এই সময়েই নানা সরীসৃপ, পাখী, স্তন্যপায়ী প্রাণী ইত্যাদির সৃষ্টি। এর শেষ ৭ কোটি বছর সময়কালে (ক্রেটাসিয়াস পিরিয়ড) ডাইনোসরের উদ্ভব—কয়েক কোটি বছর ধরে পৃথিবী দাপিয়ে তাদের অবলুপ্তি। এই সময়ে পুষ্পিত উদ্ভিদেরও সৃষ্টি।

৫ কোটি বছর আগে থেকে বর্তমান সময়কালকে বলা হয় সেনোজইক যুগ (cenozoic era) i

৬.৫ কোটি বছর আগে থেকে, বর্তমান সময়ের ২৫ লক্ষ বছর পূর্ববর্তী সময়কালকে বলা হয় টারসিয়ারি পিরিয়ড—এই সময়ে উল্লেখযোগ্য বিবর্তনঘটে স্তন্যপায়ী প্রাণীর। লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনে বাঁদর, শিম্পাঞ্জি ইত্যাদির সৃষ্ট হয়। এদেরই একটি শাখা থেকে আদিমতম মনুষ্যেতর প্রাণীর উদ্ভব (early hominid), 2.5 থেকে ১.৮৫ কোটি বছরের মধ্যবর্তী সময়কালে। লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তন ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এদের থেকে সৃষ্টি হয় অস্ট্রালোপিথেকাস—যারা বর্তমান মানুষের আদিম রূপ হিসেবে গণ্য হয়।

***

‘নিয়ানডার্থাল মানুষের আগের স্তর অর্থাৎ পিথেকানথ্রোপাস (Pithecanthropus erectus). বা সিনানথ্রোপাসদের (Sinanthropus pekinensis) মধ্যে ধর্মাচরণের নিদর্শন পাওয়া যায় নি। তখনকার ‘মানুষের’ মস্তিষ্ক তথা চিন্তা করার ক্ষমতা এতটা উন্নতও ছিল না, * যার সাহায্যে ধর্ম ও অতি-প্রাকৃতিক শক্তি জাতীয় উন্নততর চিন্তা করা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেত। (এ-কারণে গরু ছাগল, এমন গরিলা শিম্পাঞ্জিও ভগবানের কল্পনা কিংবা ধর্মচিন্তা করতে পারে নি।) মানুষকে তখন স্কুল জৈবিক প্রয়োজনেই প্রকৃতির প্রতিকূল অবস্থা ও জীব-জন্তুর সঙ্গে নিরন্তর সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়েছে। নিতান্তই ব্যবহারিক প্রয়োজনে তাদের চেতনা ব্যতিব্যস্ত ছিল। প্রাণ ও প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন করা; মৃত্যুর পরে কি ঘটে, ইত্যাকার গবেষণা তাদের পক্ষে করা সম্ভব হয় নি। কিন্তু হাজার হাজার বছরের অস্তিত্বের মাধ্যমে তাদের মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে, জীবনযাত্রা রূপান্তরিত হয়েছে, পথ পরিষ্কার হয়েছে নিয়ানডার্থালদের সৃষ্টির। ধর্ম আলোচনার প্রসঙ্গে:- নিয়ানডার্থাল মানুষের আগেকার ঐ অবস্থাকে বিজ্ঞানীরা বলেন প্রাকধর্মীয় অবস্থা (Pre-religion Stage)।

[* পিথেকানথ্রোপাস বা জাভা মানুষদের মস্তিষ্কের আয়তন ছিল বর্তমান মানুষের মস্তিষ্কের দুই তৃতীয়াংশ অর্থাৎ বৃহত্তম গরিলা ও নিকৃষ্ট আধুনিক মানুষ (Cromagnon, Homo sapiens)-এর মাঝামাঝি। এরা প্রায় সোজা হয়ে হাঁটত। সিনানথ্রোপাস বা পিকিং মানুষ আরেকটু ভালোভাবে সোজা হয়ে হাঁটত, মস্তিষ্কের আয়তন ছিল আরেকটু বেশি।]

***

সৃষ্টি রহস্য- ৩

এখন থেকে ২৫ লক্ষ বছর আগে থেকে ১০,০০০ বছর আগের সময়কে বলা হয় প্লীস্টোসিন কাল (Pleistocene epoch) এবং ১০,০০০ বছর আগে থেকে আজ অব্দি সময়কে বলা হয় হলোসিন কাল (Holocene epoch)। এই উভয়কাল মিলে কোয়ার্টারনারি পিরিয়ড যা সেনোজইক যুগের সর্বশেষ অংশ।

প্লীস্টোসিন কাল-এ মনুষ্যেতর প্রাণীর আরো পরিবর্তন ঘটেছে। ১৫ লক্ষ থেকে ৩ লক্ষ বছর আগে জাভা মানুষের (পিথেকানথ্রোপাস ইরেক্টাস) সৃষ্টি। এরা (Homo erectus) মানুষ (Homo sapien)-এর পূর্ববর্তী রূপ।

এখন থেকে সাড়ে ৩ লক্ষ বছর আগে—জাভা মানুষ থেকে মানুষ-এ রূপান্তরের পর্যায়ে,—আরেক ধরনের অন্তর্বর্তী মনুষ্যেতর প্রাণীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এরা sapiens erectus intermediate type বা Verteszollos man নামে পরিচিত এবং বুদাপেষ্টের কাছে এদের কঙ্কাল আবিষ্কৃত হয়েছে। এরি কাছাকাছি সময়কালে পিকিং মানুষ (সিনানথ্রোপাস পেকিনেনসিস) ইত্যাদিদের উদ্ভব।

এসব মানুষের মধ্যে ঈশ্বর, আত্মা, ধর্ম ইত্যাদি সম্পর্কিত কল্পনার সামান্যতম উন্মেষও ঘটে নি।

***

এর পর উদ্ভব হলো নিয়ানডার্থাল মানুষদের, পৃথিবীতে তখন চতুর্থ হিমযুগ চলছে। ১৮৫৬ সালে জার্মানির ডুসেলডর্ফের কাছে নিয়াণ্ডার উপত্যকায় পাওয়া গেল এই ধরনের ভিন্নতর ও উন্নততর মানুষের অসম্পূর্ণ কঙ্কাল। তার আগে জিব্রাল্টারেও অবশ্য এ ধরনের একটি কঙ্কাল পাওঁয়া যায়। পরে ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ড, ইতালি, স্পেন, রাশিয়া, পোল্যাণ্ড, ক্রিমিয়া, এশিয়া মাইনর, প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, ইরাক, উত্তর আরবের মরুভূমি অঞ্চল, উত্তর আফ্রিকা, চীন ইত্যাদি বহু অঞ্চলে এ ধরনের মানুষের কঙ্কাল, কবর ও অন্যান্য নানা নিদর্শন পাওয়া যায়। এখন থেকে প্রায় ২৫,০০০ বছর আগে বিশুদ্ধ আধুনিক মানুষ (ক্রোম্যাগনন মানুষ বা Homo sapiens)-এর উদ্ভব। তার আগে অব্দি সুদীর্ঘকাল ধরে এই নিয়ানডার্থাল মানুষ পৃথিবীর নানা প্রান্তে টিকে ছিল। তারা ছিল শিকারী, থাকত গুহায় এবং পরিবার গঠনের প্রাথমিক প্রয়াস তাদের মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে। তাদের মস্তিষ্ক আধুনিক মানুষের মতো উন্নত ও জটিল না হলেও, পূর্ববর্তী যে কোন ‘মনুষ্যেতর মানুষের মস্তিষ্কের চেয়ে বিকশিত ছিল। এবং এর সাহায্যে তারা দৈনন্দিন জীবনের অন্যান্য নানা কিছুর মতো, জীবনের রহস্য ও মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা ও এ-ব্যাপারে চিন্তা করতে পেরেছিল বলেই মনে হয়। এই চিন্তা ও প্রাণের রহস্য সমাধানের জন্য প্রচেষ্টার ফলে ‘আত্মা’-র কল্পনা এসেছে। স্বপ্ন দেখার ঘটনা এ কল্পনাকে উৎসাহিত করেছে।

নিয়ানডার্থাল মানুষদের কবর খুঁড়ে এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, মৃত্যুর পরেও যাতে মৃত ব্যক্তির কোন অসুবিধা না হয় তার জন্য দৈনন্দিন প্রয়োজনের কিছু জিনিস কবরের সঙ্গে রেখে দেওয়ার পদ্ধতি তারা অনুসরণ করত। উত্তর ইরাকের শানিদার গুহায় (Shanidar Cave-এ) এই ধরনের মানুষের (Homo sapien reanderthalis-দের) কবরস্থান আবিষ্কৃত হয়েছে যাতে ধর্মীয় ভাবনার প্রকাশ দেখা যায়। এটির আনুমানিক সময়কাল ৬০০০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দ এবং এটিই এখনো অব্দি আবিষ্কৃত মানুষের প্রাচীনতম ধর্মাচরণের নিদর্শন। মৃত শরীরকে নষ্ট না করে বা অবহেলায় ফেলে না রেখে কবর দেওয়ার ব্যাপারটিও ছিল অভিনব ও যুগান্তকারী একটি আবিষ্কার।

***

সৃষ্টি রহস্য- ৪

এখন থেকে আড়াই লক্ষ বছর নিয়ানডার্থাল মানুষ (Homo sapien neanderthalis)-এর উদ্ভব ঘটে। কিন্তু এই নিয়ানডার্থাল মানুষও তার পরিপূর্ণ বৈশিষ্ট্য অর্জন করে আরো লক্ষাধিক বছর পরে। এদের বিকশিত বিবর্তিত রূপ হচ্ছে আধুনিক মানুষ বা ক্রোম্যাগনন মানুষ (Homo sapien)- এখন থেকে ৫০-২৫ হাজার বছর আগে এদের উদ্ভব।

ক্রোম্যাগনন মানুষে পরিবর্তিত হওয়ার পর্যায়ে ধীরে ধীরে নিয়ানডার্থাল মানুষই আত্মা বা অতিপ্রাকৃতিক শক্তি সম্পর্কে ধারণার জন্ম দেয়। আদিম ধর্মানুষ্ঠানের উন্মেষও ঘটে এই সময়েই।

***

আর এভাবেই মৃত্যুর পরবর্তী ‘প্রাণ’ বা প্রাণের কারণ হিসাবে ‘আত্মা’ জাতীয় কোন একটি কিছুর সম্পর্কে চিন্তাভাবনা যে তারা ধীরে ধীরে শুরু করেছিল তা বোঝা যায়। রহস্য উন্মোচন করা, অনুমান করা, সিদ্ধান্ত নেওয়া ও অনুসন্ধান করার এই আদিম বৈজ্ঞানিক মানসিকতার আভাস তাদের মধ্যে এভাবে পাওয়া যায়। পরিবেশ ও প্রকৃতির বিরূপ শক্তিগুলিকে সন্তুষ্ট ও আয়ত্ত করার উদ্দেশ্যে নানা ধরনের যাদুবিদ্যা বা ম্যাজিক-এর প্রাথমিক উদ্ভবও এ-সময় ঘটে। জীবজন্তু কিংবা নিয়ানডার্থালদের আগেকার ‘মানুষেরা’ এটি ভাবেই নি যে, এভাবে নিজেদের করা (উদ্ভাবিত!) কোন পদ্ধতি বা অনুষ্ঠানের সাহায্যে আসন্ন শিকারের কাজ ‘সফল’ করা যেতে পারে বা রহস্যময় প্রাকৃতিক শক্তিকে ‘সন্তুষ্ট করা যেতে পারে’। শিশুকে বা কোন ব্যক্তিকে খাবার দিয়ে বা আদর করে সন্তুষ্ট করার বাস্তব ঘটনা হয়তো তাদের মধ্যে এ-ধরনের সিদ্ধান্তের জন্ম দিয়েছে। প্রায় ৬০,০০০ বছর আগে ঐ সময়ে এখনকার অর্থে কোন ধর্ম তখন স্পষ্টতই ছিল না।

পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখব, তথাকথিত বৈদিক ধর্মের (হিন্দুধর্মের পূর্বসুরী) উদ্ভব হয়েছিল এখন থেকে মাত্র ৩,৫০০ বছর আগে (প্রায়), ইসলামধর্ম ১,৩০০ বছর আগে, বৌদ্ধধর্ম আড়াই হাজার বছর আগে, খ্রীষ্টধর্ম ২,০০০ বছর আগে ইত্যাদি। মানুষের লিখিত ইতিহাসের বয়স মাত্র ৫, বছর। ৭-৮ হাজার বছর ধরে সে ধাতু ব্যবহার করছে। তার আগে লক্ষ লক্ষ বছর আদিম মানব পাথরই ব্যবহার করত; তথাকথিত ধর্মচেতনাও ছিল অনুরূপভাবে আদিম। কিন্তু ধর্মের প্রাথমিক উপাদান ৫০-৬০ হাজার বছর আগে নিয়ানডার্থাল মানুষের চেতনাতেই আভাসিত হয়, আত্মা(soul), অলৌকিক শক্তি, যাদুবিদ্যা ইত্যাদি ধারণারও ভিত্তি সৃষ্টি হয়।

আত্মার আ আদিম ধারণাই হাজার হাজার বছর ধরে, শতশত বংশ পরস্পরায় পল্লবিত হয়েছে ঐ আদিম মানুষের মনে, এবং এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিকর্তা তথা প্রাণের সৃষ্টিকর্তা ও সমস্ত আত্মার উৎস-স্বরূপ এক পরমশক্তি বা পরমাত্মার ধারণার সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন ভাষার সৃষ্টি হলে এর নামও ভিন্ন হয়, যেমন ওসিয়ানিয়ায় ‘মানা’ (Mana), এশিয়ার কিয়দংশে ব্রহ্ম বা আল্লা, ইয়োরোপে গড, অস্ট্রেলিয়ায় রাতাপা (Ratapa)ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু স্পষ্টতই এগুলি ধারণাই এবং নিয়ানডার্থাল থেকে এই স্তরে আসার আগে আরো অনেক বিবর্তন ঘটেছে এসব ধারণার।

এখন থেকে ৪০-১৮ হাজার বছর আগে ছিল উচ্চতর পুরা-প্রস্তর যুগ (Upper Palaeolithic Period)। আধুনিক মানুষের সৃষ্টি এ-সময়ে হয়েছে। ‘ধর্ম’, আত্মা, পরমাত্মা, যাদুবিদ্যা বা ম্যাজিক সম্পর্কিত ধারণাবলীও আরো সুসংহত হয়েছে। তাদের পাথরের অস্ত্র উন্নত হয়েছে। একই সঙ্গে সফল ও নিরাপদভাবে শিকার করা, প্রকৃতিকে সন্তুষ্ট করা—এসব উদ্দেশ্যে নানাবিধ আচার-অনুষ্ঠানও উন্নত হয়েছে। তাদের কবরস্থানের উপর গবেষণা করে এটি জানা গেছে যে, কারোর মৃত্যুর পরে তারা কিছু কিছু আচার ও পূজা জাতীয় অনুষ্ঠান পালন করত—এখনকার শ্রাদ্ধশান্তি, কোরাণখানি, প্রার্থনা ইত্যাদির যা ছিল আদিমরূপ।

মৃত্যুর পরেও মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কে তাদের কুসংস্কার ছিল—যে ধারা এখনো চলছে। অতি পরিচিত প্রিয় কেউ মারা গেলে, সে একেবারেই নিঃশেষ হয়ে গেল- এ ধরনের করুণ সত্যকে এড়িয়ে গিয়ে আপাত সান্ত্বনালাভের উপায়ও ছিল তা। পূর্ববর্তী সময়ে যে ধর্মবিশ্বাসের ভ্রূণ সৃষ্টি হয় এ-সময় তা শৈশব লাভ করে।

স্পেন, ফ্রান্স ইত্যাদির গুহাগাত্রে পাওয়া তখনকার মানুষের আঁকা ছবি থেকে, সফল শিকারের জন্য তারা যে নানা অনুষ্ঠান করত তার সুনিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেছে। উত্তর স্পেনের এল জ্ঞিয়ো (El Jnyo) গুহার অভ্যন্তরীণ অলংকরণ থেকে অনুমান করা হয়, এটি এ ধরনের একটি পূজাস্থল ছিল। এর সময়কাল প্রায় ১২০০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দ এবং এটিই এখনো অব্দি আবিষ্কৃত মানুষের প্রাচীনতম মন্দির-মসজিদ-গীর্জাস্থানীয় ‘পবিত্র পূজাস্থল (Shrine)’- এর সুনির্দিষ্ট নিদর্শন। প্রকৃতির অজ্ঞাত রহস্যময়, হয়তো বা প্রতিকূল শক্তিকে সন্তুষ্ট করার জন্য ‘পুজা-আচ্চা’র জন্ম হয় এ-সময় (– যে ধারা এখনো তথাকথিত উন্নত শিক্ষিত মানুষের মধ্যে আরো জটিলভাবে রয়েছে, এবং যে-দিকটি এখনকার এ-সব মানুষের মানসিকতার ঐ পুরা-প্রস্তরযুগীয় অবস্থার পরিচয় বহন করে)। এইভাবে ইয়োরোপের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া ০০০০ থেকে ১০০০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ সময়কার বিভিন্ন গুহার বিভিন্ন ছবি থেকে বোঝা যায় সেগুলি ঐ পুজো আচ্চার জায়গা হিসেবে কোন না কোনভাবে ব্যবহৃত হত। ঐসব ছবিতে এও দেখা গেছে যে, বিশেষ একজন পশুর মুখোশ পরে বিশেষ ক্রিয়াকান্ড করছে—যাকে যাদুকর (sorcerer) হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ঐ আদিম মানুষদের কেউ কেউ যে নিজেকে ম্যাজিক জানা বা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে দাবী করত, অথবা বিশেষ কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হতো অতিপ্রাকৃতিক শক্তিকে সন্তুষ্ট করার জন্য, কিংবা মস্তিষ্ক তথা চিন্তা করার কিছু অতিরিক্ত ক্ষমতার জন্য বিশেষ কেউ সিদ্ধান্ত নিতে পারত এবং এ ধরনের দায়িত্ব গ্রহণ করত, এটি স্পষ্ট বোঝা যায়।

পরবর্তীকালের পুরোহিত, অবতার, বাবাজি, অবধূত, মোল্লা, যাজক ইত্যাদির আদিম পূর্বসূরী এরা। অর্থাৎ এ-ধারাও শুরু হয়েছিল পুরা প্রস্তর যুগেই। এসব ছবিতে আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল, -মানুষের মুখকে অস্বাভাবিক ভয়ঙ্কর করে দেখানো, অথচ জীবজন্তুর ক্ষেত্রে তা করা হয় নি। অনেক গবেষকের মতে, মানুষের উপর যাতে অন্য অশুভ শক্তি বা জীবজন্তু যাদুবিদ্যা প্রয়োগ করতে না পারে, তার জন্যই মানুষের সঠিক ছবি আঁকা হয় নি। বাস্তব থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে সরে গিয়ে কাল্পনিক চরিত্র সৃষ্টির প্রবণতা এসবের মধ্যে স্পষ্ট। এটি আরো প্রকটভাবে দেখা যায় নারীচিত্রে, -যেগুলি মূলত দেখা গেছে পশ্চিম ইয়োরোপ ও রাশিয়ার পুরা প্রস্তর যুগীয় গুহাগাত্রে। উলঙ্গ, বৃহৎ স্তনযুক্ত, অতিমাত্রায় স্ফীত-উদরসহ এসব নারীর ছবি বিশ্লেষণ করে গবেষকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এগুলি প্রধানত ছিল আবাসস্থলের রক্ষাকর্ত্রী হিসেবে কল্পিত, মাতৃতান্ত্রিক সমাজের আচার-অনুষ্ঠানের প্রতীক ও যৌনতা-উর্বরতার দ্যোতক।

পুরা-প্রস্তর যুগের শেষের দিকে, অ্যাজিলিয়ান সময়ে* আঁকা গুহার ছবির বৈশিষ্ট্য ছিল, তাতে মানুষ ও জীবজন্তুর চিত্র প্রায় অনুপস্থিত। আবার জ্যামিতিক চিত্র, পাথরের একদিকের গায়ে প্রায় সমান্তরাল রহস্যময় রঙীন রেখা (প্রায়শই লাল), ডিম্বাকার চিহ্ন এবং অক্ষর জাতীয় চিহ্নাদির নিদর্শন পাওয়া যায়। এসবের বিশ্লেষণ করে, এগুলি টোটেম ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে অনুমান করা হচ্ছে, যদিও এগুলির পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা এখনো করা সম্ভব হয়নি। তবে এটি অন্তত স্পষ্ট যে, বিভিন্ন পূজা-আচ্চা, আচার অনুষ্ঠান, যাদুবিদ্যা ইত্যাদির জন্যও এসব কাজে লাগানো হতো। বিশেষ অঞ্চলে বসবাসকারী একটি মনুষ্যগোষ্ঠী নিজেদের রক্ষাকর্তা হিসেবে কোন বিশেষ জীবজন্তু বা প্রাকৃতিক জড় বস্তুকে কল্পনা করতে শুরু করেছে। এটি টোটেম চিন্তা ও এর থেকে পরে নাগবংশ, সূর্যবংশ জাতীয় কল্পনারও সৃষ্টি। পুরা-প্রস্তর যুগেই পৃথিবীর নানা অংশে এই কল্পনা প্রাথমিক ভিত্তিলাভ করে।

[* পুরা প্রস্তরযুগীয় কালকে চার ভাগে ভাগ করা হয়: Aurignancian, Solutrean, Magdalenin ও Azilian.]

এই টোটেমচিন্তা (toternism) ধর্ম নয়, কিন্তু এর মধ্যে বিভিন্ন মাত্রায় বিভিন্ন ধর্মীয় উপাদান মিশে আছে। একটি টোটেম হচ্ছে একটি বিশেষ কোন পদার্থ, যেমন হয়তো কোন বিশেষ প্রাণী বা গাছ, যা কোন মানুষ বা মনুষ্যগোষ্ঠীর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কযুক্ত (অবশ্যই এই সম্পর্ক কল্পিত) হিসেবে ভাবা হয় বা তাকে ঐ মানুষ বা মনুষ্যগোষ্ঠীর প্রতীক হিসেবে কল্পনা করা হয়। টোটেমচিন্তা হচ্ছে এমন এক ধরনের কল্পনা যেটি ঐ বিশেষ একটি টোটেম-এর সঙ্গে কোন মানুষ বা মনুষ্যগোষ্ঠীর রহস্যময় সম্পর্ক বা আত্মীয়তার কথা বলে। মানুষের সাংস্কৃতিক চেতনা ও ধর্মীয় চিন্তা বিকাশের সর্বক্ষেত্রে, সর্বত্র যে টোটেমচিন্তা ঐতিহাসিকভাবে একই মাত্রায় বিকশিত হয়েছে তা নয়। কোন মনুষ্যগোষ্ঠীর মধ্যে কম, কারোর মধ্যে বেশি এই টোটেমচিন্তা এসেছে। কিন্তু সাধারণভাবে মানুষের মনোজগতে এই টোটেমচিন্তার বিভিন্ন ধরনের প্রভাব পড়েছেই।

টোটেম ও টোটেমিজম সম্পর্কে এ ধরনের ধারণা বা ব্যাখ্যা বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত হলেও, এই শব্দটি সৃষ্টি হয়েছে কিছুটা ভুল ভাবে। শব্দটির উৎস উত্তরপূর্ব আমেরিকার গ্রেট লেক অঞ্চলের, অ্যালগোকিয়ান নামে এক আদিবাসী গোষ্ঠীর ব্যবহৃত শব্দ ‘অটোটেমান’ (ototernan )। ওজিব্‌ ওয়া-র এই আদিবাসীগোষ্ঠীরা এই শব্দটির সাহায্যে ভাইবোনের সম্পর্ককে বোঝাত এবং এর ব্যাকরণগত মূল ধাতু (root) হচ্ছে ‘ওট’ (ote), যার অর্থ ভাইবোনের মধ্যকার রক্ত-সম্পর্ক, যে সম্পর্কের কারণে এদের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। ওজিয়া-র এই আদিবাসীরা বিশেষ পশুর ছাল পরত। এক ইংরেজ ব্যবসায়ী ঐ এলাকায় গিয়ে এটি লক্ষ্য করেন এবং ‘ওটোটেমান’ শব্দটির ব্যবহার শুনে ভুলভাবেই তাঁর ধারণা হয় যে, এর সাহায্যে বিশেষ ব্যক্তির আত্মার কথা বলা হচ্ছে, যে আত্মা কোন একটি পশু রূপে উপস্থাপিত হচ্ছে। ১৭৯১ সালে তিনি এই শব্দটি ইয়োরোপে এই অর্থে ব্যবহার করেন। অন্য সূত্র থেকে প্রায় এই সময়কালেই জানা যায় যে, ঐ আদিবাসী গোষ্ঠীর লোকেরা নিজেদের মধ্যকার বিভিন্ন উপগোষ্ঠীকে ঐ এলাকার বিভিন্ন জীবজন্তুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হিসেবে পরিচিত করায়। সব মিলিয়ে ধারণা হয় যে পূর্বোক্ত শব্দটির সাহায্যে বিশেষ পশু ও তার সঙ্গে বিশেষ মনুষ্যগোষ্ঠীর প্রতীকী সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে। কিছু পরিবর্তিত হয়ে শব্দটি ‘টোটেম’ রূপ পায়। ভুলটা বোঝা যায় পিটার জোন্‌স্‌ নামে ওজিয়া এলাকারই এক পূর্বতন আদিবাসী গোষ্ঠীনেতার লেখা বই থেকে। ইনি মেথডিষ্ট যাজক হয়েছিলেন এবং ১৮৫৬ সালে মারা যাওয়ার পর তাঁর বইটি প্রকাশিত হয়। এতে তিনি জানিয়েছেন যে, ঐ আদিবাসীগোষ্ঠীর সদস্যরা মনে করতেন পরম আত্মা (the great spirit) তাঁদের টুডেম (toodaim) দান করেছেন, যার ভাবগত অর্থ হল গোষ্ঠীর সবাই পরস্পর রক্ত সম্পর্কযুক্ত এবং তাই নিজেদের মধ্যে বিবাহ তথা যৌনসম্পর্ক করা উচিত নয়। ব্যাপারটি স্পষ্টই নিজ গোষ্ঠীর মধ্যে যৌন ব্যভিচার বন্ধ করার একটি প্রচেষ্টা। কিন্তু ততদিনে ‘টোটেম’ শব্দটি ভিন্ন ব্যঞ্জনা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।

যাই হোক, টোটেমচিন্তার কয়েকটি সাধারণ লক্ষণ হচ্ছে-

(ক) টোটেম-কে আত্মীয়, রক্ষাকর্তা, সাহায্যকারী বন্ধু বা বংশের আদিপুরুষ হিসেবে কল্পনা করা হত। তার রয়েছে অতিমানবিক ক্ষমতা ও শক্তি। তাকে শুধু শ্রদ্ধা বা সন্তুষ্ট করার জন্য পূজা করাই হত না, তাকে ভয়ও করা হত।

(স্পষ্টতঃ পরবর্তীকালের নানা কল্পিত দেবদেবীর পূর্বসূরী বা সমগোত্রীয় ছিল এই ধরনের টোটেমরা।)

(খ) টোটেম-কে বিশেষ নাম ও প্রতীক দিয়ে চিহ্নিত করা হত।

(গ) টোটেমের সঙ্গে নিজেদের আংশিক একাত্মতা বা প্রতীকী আত্মীকরণের দিকটি কল্পিত হয়েছে।

(ঘ) টোটেমকে হত্যা করা, খাওয়া, এমন কি স্পর্শ করাও নিষিদ্ধ করা হয়; কখনো বা তাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলার কথাও বলা হয়।

(ব্যাপারটি হয়তো এলাকায় বিশেষ জন্তু বা গাছকে রক্ষা করার তাগিদ থেকে এসেছে। তথাকথিত হিন্দুরা যেমন শুরুতে গরুর মাংস খেত বা ব্যাপকভাবে গরু বলি দিত, -কিন্তু পরে অর্থনৈতিক কারণে গোসংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হওয়ায় তাকে মাতৃরূপে কল্পনা করে দেবতার মর্যাদা দিয়েছে।)

(ঙ) টোটেমকে কেন্দ্র করে নানা অনুষ্ঠান ও আচারবিধির সৃষ্টি।

পৃথিবীর নানা অংশে পরবর্তিকালে পরিবর্তিত বা অপরিবর্তিত আকারে এই টোটেমচিন্তার নানা দিক বিভিন্ন ধর্মে প্রবেশ করেছে। মুসলিমরা শুয়োর খাওয়া নিষিদ্ধ করেছে। অনেক ভারতীয় (তথাকথিত হিন্দু) বাঁদর বা হনুমানকে পূজা করা শুরু করেছে, কেউ বা করে সাপের পূজা; আর অধিকাংশ হিন্দুর কাছে গরুতো পূজা দেবতাই।

এছাড়া আদিমকাল থেকেই ‘মানুষ’ অনুভব করে প্রকৃতির কয়েকটি সম্পদের অপরিহার্যতাকে। যেমন জল ও সূর্য প্রাণধারণের পক্ষে অপরিহার্য। ফলে ধর্ম চিন্তার উন্মেষের সঙ্গে এগুলিকেও ধীরে ধীরে সম্পৃক্তভাবে ধর্মীয়-ঐশ্বরিক-আধ্যাত্মিক ক্রিয়াকান্ডের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। পৃথিবীর প্রায় সব প্রান্তের মানুষই জলের তথা সমুদ্র ও বিশেষ নদ-নদীর অধিষ্ঠাতা দেব-দেবীর কল্পনা করেছে, জল দিয়ে শরীর পরিশুদ্ধ করে অলৌকিক ঐশ্বরিক শক্তির কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করেছে। একইভাবে সূর্যদেবতাও পৃথিবীর প্রায় সব আদিম ও প্রাচীন সভ্যতায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছে। এছাড়া চাঁদ, পাহাড়, বায়ু ইত্যাদি তো ছিলই।

নিয়ানডার্থাল আমলেই মানুষ কৃত্রিমভাবে আগুন জ্বালানোর কৌশল আবিষ্কার করে বলে অনুমান করা হয়। এখন থেকে প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে, চতুর্থ হিমযুগের কাছাকাছি সময়, ইয়োরোপে যে মুস্তেরীয় ‘সভ্যতার’ অস্তিত্ব ছিল, ঐ সময়েই যথাসম্ভব এই যুগান্তকারী আবিষ্কার ঘটে। (ফ্রান্সের Le Moustier নামক স্থানে পাওয়া প্রাগৈতিহাসিক মানুষের দেহাবশেষ ও যন্ত্রপাতি থেকে এই ‘সভ্যতার’ অস্তিত্বের কথা প্রথম জানা যায়। নিয়ানডার্থাল মানুষের পূর্ববর্তী কয়েক লক্ষ বছরের ক্রিয়াকান্ডকে চেলীয় বা Chellean culture বলা হয়। এ নামটিও এসেছে ফ্রান্সের Chelles নামক স্থানে প্রথম পাওয়া নিদর্শনগুলি থেকে। নিয়ানডার্থাল মানুষদের শেষের দিকের ২০-৩০ হাজার বছর ব্যাপী ক্রিয়াকান্ডকে মুস্তেরীয় বা Mousterian culture বলা হয়। অনেকের মতে কৃত্রিমভাবে আগুন জ্বালানোর কৌশল ঐ চেলীয় সময়েরই কখনো মানুষ আয়ত্ত করে থাকতে পারে।) স্বাভাবিকভাবে কৃত্রিমভাবে আগুন জ্বালানোর কৌশল আবিষ্কার করার ফলে মানুষ বিপুল ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে। জীবজন্তু ও অন্যান্য মনুষ্যেতর ‘মানুষদের’ চেয়ে তার সামগ্রিক শক্তিমত্তায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটে। মানুষের সভ্যতার বিকাশে এই আবিষ্কারের গুরুত্ব বিশ্লেষণ এখানে বাহুল্য। তবু প্রাসঙ্গিকভাবে এটি উল্লেখ্য যে, অনিবার্যভাবে মানুষের ধর্মচিন্তায়ও আগুন, আগুন জ্বালানো, আগুনের সংরক্ষণ ইত্যাদিও বিশাল স্থান অধিকার করে নেয়। মুস্তেরীয় মানুষদের মধ্যেই মৃতদেহ কবর দেওয়া, কবরে মৃতদেহের সঙ্গে পাথরের বালিশ, যন্ত্রপাতি, মাংসের টুকরা এবং আগুন রাখার ব্যবস্থা করা,-এসবের প্রচলন হয় বলে প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ নিয়ান্ডার্থাল মানুষদের এই পর্যায় অবশ্যই মৃত্যু পরবর্তী প্রাণের কল্পনা করতে সমর্থ হয়েছিল।

সময় কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মস্তিষ্ক, চিন্তাভাবনা, জীবনযাত্রা রিকশিত হতে থাকে— একইসঙ্গে বিকশিত ও রূপান্তরিত হতে থাকে সম্পৃক্তভাবে মিশে থাকা ধর্মচিন্তা। পরবর্তী আলোচনায় নব্যপ্রস্তর যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ ইত্যাদি সময়ে ধর্মের বিকাশ নিয়ে আলোচনা করা হবে। তার সময়কাল একেবারে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা মুশকিল। অনেক ক্ষেত্রেই পূর্ববর্তী স্তরের মানুষ, পরবর্তী স্তরের সঙ্গে একই সময়ে ছিল— এমনকি হাজার হাজার বছর ধরেও। পুরা প্রস্তর যুগের সময়কেও অনেকে নব্যপ্রস্তর যুগের পূর্ববর্তী কয়েকলক্ষ বছর বলেই ধরেন। ঐ সময়ে মানুষ আগুন আবিষ্কার করে, যা তার জীবনযাত্রায় অভূতপূর্ব পরিবর্তন আনে, জীবজন্তুর থেকে তার পার্থক্যকে বিপুলভাবে বাড়িয়ে দেয়। এই আগুন অবশ্যম্ভাবীভাবে তার যাদুবিদ্যা ও ধর্ম চিন্তার মধ্যেও মিশে গেছে। ২৫-৩০ হাজার বছর আগে নিয়ানডার্থাল মানুষ সংখ্যায় কমতে থাকে বা প্রায় লুপ্ত হয় এবং আধুনিক মানুষের সৃষ্টি হয়— মস্তিষ্কের আয়তনবৃদ্ধি তথা জটিলতা ও দক্ষতা, যার অন্যতম গুণগত বৈশিষ্ট্য। আগের লক্ষ লক্ষ বছরে যা হয়নি, পরবর্তী কয়েক হাজার বছরে এর ফলেই মানুষের চিন্তা, জীবন ও সংস্কৃতি বৈপ্লবিকভাবে উন্নত হতে থাকে। মানুষ খাদ্য সংগ্রাহক থেকে খাদ্য উৎপাদক হয়ে উঠতে থাকে। সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি পাল্টাতে থাকল। জাদুবিদ্যার ব্যবহার- যা ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্তভাবে যুক্ত, তারও ব্যবহার, জটিলতা ইত্যাদিও উল্লম্ফনের ভঙ্গিতে বাড়তে থাকে। আত্মা, ঈশ্বর ইত্যাদি সম্পর্কিত ধারণাও অতি দ্রুত পল্লবিত হয়। ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় সর্বপ্রাণবাদ (animism, animatism)-এর।

আদিম মানুষের ধর্ম চিন্তা প্রসঙ্গে কয়েকটি দিক অত্যন্ত স্পষ্ট;

এক, ধর্মীয় তথা ঐশ্বরিক চিন্তা আদিম মানুষকে কেউ দেয়নি, আদিম মানুষই তার ক্রমবিকাশমান মস্তিষ্কের বলে একসময় এ ধরনের চিন্তার সৃষ্টি করতে পেরেছে;

দুই, মানুষ ঈশ্বরের সন্তান নয়, ঈশ্বরই মানুষের কল্পনার সন্তান;

তিন, মানুষ তার নিজের বাস্তব প্রয়োজন মেটাতে (অন্তত সে যাকে মনে করেছে ‘প্রয়োজন মেটানো’) যাদুবিদ্যা, মাত্মা, মৃত্যু পরবর্তী প্ৰাণ, ইত্যাদি ধারণার ‘উদ্ভাবন’ করেছে, তথা ধর্মের ভিত্তি স্থাপন করেছে;

(পরবর্তীকালে এগুলি আরও সুসংহত রূপও পেয়েছে এবং এখনকার বিশেষ নামের বিভিন্ন ধর্মেরও চেহারা নেয়, কিন্তু সে পরবর্তী আলোচনার বিষয়; )

চার, প্রাণের পেছনে ‘আত্মা’-র ভূমিকা নেই। আত্মা বহু সহস্র বছর আগেকার মানুষের কল্পনাই। তখন বৈজ্ঞানিক উন্নত কোন পদ্ধতিও ছিল না, যার সাহায্যে কল্পনা ছাড়া প্রাণের রহস্য সমাধানে যথার্থ কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *