বাহাই ধর্ম

বাহাই ধর্ম

অন্যদিকে আধুনিকতম যে ধর্মমত বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে, সেটি হলো বাহাই ধর্ম (Bahaism)। অনুগামীর সংখ্য বিচারে এ ধর্মের দুর্বলতা স্পষ্ট—মাত্র ০.১ ভাগ পৃথিবীবাসী এর অনুগামী। কোন কোন দেশে এই ধর্মাবলম্বীদের কিছু সংখ্যাধিক্য রয়েছে, যেমন, দক্ষিণ আমেরিকার বলিভিয়ায় জনসংখ্যার শতকরা ২.৬ ভাগ, কিরিবাটির ২.৪ ভাগ বাহাইপন্থী। কিন্তু এর শক্তির আঁচ পাওয়া যায় এর ব্যাপকতা থেকে–পৃথিবীর ২০৫টি দেশে ছড়িয়ে আছেন এর অনুগামীরা। ধর্মের বিচারে, খ্রীস্টানধর্মাবলম্বী ও নাস্তিক-ধর্মপরিচয়মুক্ত-অধার্মিক ব্যক্তিরা ছাড়া, অন্য কোন বিশেষ ধর্মের অনুগামীরা এত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে নেই। অবশ্য, মূলত এটি কিছু শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী ও ধনী মানুষদের মধ্যে প্রচলিত। এর বৈভবের আভাস পাওয়া যায় দিল্লীর সুবিশাল লোটাস টেম্পল থেকে—যে ধরনের সৌধ আরো বহু দেশেই বাহাইপন্থীরা গড়ে তুলেছেন।

বাহাই-ধর্মের ভিত্তি কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পারস্য (ইরান)-এর দরিদ্র কৃষক ও শহরের হতদরিদ্র মানুষদের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া ইসলামধর্মের প্রতি অসন্তোষ ও বিক্ষোভের মধ্যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে। এদের তাত্ত্বিক নেতৃত্ব দেন শিরাজের মহম্মদ আলি (১৮১৯-১৮৫০)—যিনি নিজেকে ব্যাব (Bab} নামে ডাকতেন—যার অর্থ জনগণ ও ঈশ্বরের সংযোগকারী দ্বার। ২৩শে মে, ১৮৪৪ তারিখে তিনি প্রথম তাঁর কথা প্রচার শুরু করেন। এই আন্দোলন ব্যাবাইট আন্দোলন নামে পরিচিত হয়। মুসলিমদের মধ্যেকার নানা বৈষম্য, বিভেদ, দল-উপদলকে ভেঙে, সমস্ত মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের বাণী প্রচার করে এই আন্দোলন। এর মধ্যে রহস্যময় কিছু ক্রিয়াকলাপও ছিল। এবং ঈশ্বরের নির্দেশে নতুন ধরনের মানবিক নিয়মাবলীর কথা প্রচার করা হয়। কিন্তু ১৮৫০ খ্রীস্টাব্দে গোঁড়া মুসলিম শাসকগোষ্ঠী এঁকে এবং পরবর্তী দু’দশকে তাঁর প্রায় ২০০০০ অনুগামীদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। তবু আন্দোলনের রেশ মিলিয়ে যায় নি। মহম্মদ আলির অন্যতম অনুগামী, মীর্জা হুসেন আলি নুরীর (১৮১৭–১৮৯২) নেতৃত্বে কিছু পরিমার্জিত আকারে ঐ আদর্শ ও মূল্যবোধ প্রচারিত হয়। শুধু মুসলিমদের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্ব ও সাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। মুসলিমদের ধর্মান্ধতা, বিধর্মীদের প্রতি হিংস্র মনোভাব,—এ-সবের বিরোধিতা করে তিনি ক্ষমা ও অহিংস প্রতিবাদের কথা বলেন। নিরাকার ঈশ্বরের কাছে নীরব প্রার্থনার কথা বলা হয় এ-ধর্মে। মীর্জা হুসেন নিজেকে বাহাও-ওল্লাহ নামে অভিহিত করেন এবং এ -থেকেই তাঁর প্রচারিত ধর্মের নাম হয় বাহাই।

বাহাই ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে মীর্জা হুসেনকে নানা অত্যাচার সইতে হয়েছে। ১৮৫৩-তে তাঁকে জেলে ভরা হয়; এখানেই তাঁর ‘উপলব্ধি’ হয়, যে ‘ব্যাব’ এর বলা ‘প্রতিশ্রুত একজন’ (The promised one) আসলে তিনিই। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার তাঁকে বিতাড়িত করা হয়। বাগদাদ থেকে কনস্টানটিনোপল, আড্রিয়ানাপোল ও প্যালেটাইনের আক্কা,—নানা স্থানে তাঁকে ঘুরে বেড়াতে হয়। ১৮৯২-এ তিনি মারা যান এবং কারমেল পর্বতের মুখোমুখি বাহজি-তে তাঁর দেহাবশেষ রাখা আছে। তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর চিন্তা ভাবনা পার্সিয়া-অটোমনি ছাড়িয়ে ককেশাস, তুর্কিস্তান, ভারত, বর্মা, মিশর, সুদানে ছাড়িয়ে পড়ে। তিনি মৃত্যুর আগে তাঁর কথাবার্তা গুলি লিপিবদ্ধ করে যান। যথাসম্ভব এই প্রথম কোন ধর্মের প্রচারকের নিজের হাতে লেখা ‘ধর্মগ্রন্থ’ পাওয়া গেল।

মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর বড় ছেলে, আবদুল-বাহা (১৮৪৪-১৯২১) -কে তাঁর ধর্মীয় উত্তরাধিকারী করে যান। মৃত্যুর আগে ইনি উত্তরাধিকারী করেন তাঁর নাতি শোখি এফেন্দি-কে। ইনি মারা যান ১৯৫৭-তে।

বাহাই ধর্মে মানবজাতি এক, সত্যের জন্য স্বাধীন অনুসন্ধান, সমস্ত ধর্মের এক ভিত্তি, ধর্ম ও বিজ্ঞানের ঐক্য, নারী পুরুষের সাম্য, ব্যক্তিগত অহংকার পরিত্যাগ, সর্বজনীন শিক্ষা, অভিন্ন আন্তর্জাতিক সহায়ক ভাষা, আন্তর্জাতিক শান্তি, দারিদ্র ও সম্পদের চরম বৈষম্য দূর করা, ইত্যাদির কথা বলা হয়। অর্থনৈতিক সমস্যার আধ্যাত্মিক সমাধানের নীতিও বলা হয়েছে বাস্তবত তা সম্ভব হোক বা না হোক এবং এমন সমাধান আসলে কাদের লাভ করে তার বিচার করা যাক বা না যাক। (প্রচলিত প্রায় সব ধর্মেই অবশ্য এমন ফর্মুলা দেওয়া হয়।) একই ভাবে নিজদেশের সরকারের প্রতি কঠোর আনুগত্য (‘strict obedience”), দেশ ও জাতির রক্ষার জন্য ধর্মের প্রয়োগ–এমন সব নীতিমালাও বাহাই ধর্মের ভিত্তি।

✩ ✩ ✩

এই ভাবে বর্তমান পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য ধর্মগুলির সৃষ্টি, মানুষের হাতেই (বা মনোজগতেই)। এখানে আলোচিত ধর্মগুলি ছাড়া আরো প্রায় ৭০ টি ধর্ম পৃথিবীতে প্রচলিত—তবে অনুগামীর সংখ্যা বিচারে তাদের এখনকার প্রভাব নগণ্য; শতকরা দু’ তিন জন পৃথিবীবাসী এতগুলি ধর্মের আশ্রয়ে রয়েছেন। ঈশ্বরের অলৌকিক শক্তি, ক্ষমতা ও ঘটনা, আত্মা ইত্যাদির সঙ্গে বিশেষ বিশেষ আচার অনুষ্ঠানও এই সমস্ত ধর্মেরই সাধারণ লক্ষণ

পাশাপাশি এটিও সত্য যে, ঐ প্রাচীনকাল থেকেই সমাজের কিছু মানুষ ঈশ্বর-আত্মা-অলৌকিকত্ব সম্পর্কিত ব্যাপক বিশ্বাসের ভ্রান্তি সম্পর্কে সচেতন হয়েছেন, তার বিরুদ্ধে সত্যকে এবং শুধু মানুষের পার্থিব কথাকে তথা প্রকৃত সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসীরা এদের নাস্তিক বা অ-ধার্মিক—এ ধরনের নেতিবাচক বিশেষণে ভূষিত করলেও, বর্তমানে পৃথিবীতে মাত্র বিগত কয়েক দশকের মধ্যেই এঁরা একটি সম্ভাবনাময় শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রতি পাঁচজনের কমপক্ষে একজন ব্যক্তিই সরকারিভাবে এই দলভুক্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *