স্পষ্ট কথা বলতে হবে এখনি

স্পষ্ট কথা বলতে হবে—এখনি

‘ধর্ম’ কথাটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ‘যা ধারণ করে’ অর্থাৎ যা সমাজকে ধরে রাখে। নানা ধর্মীয় অনুশাসন, মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও বিধিনিষেধগুলি সামাজিক শৃঙ্খলা, ও মানুষে মানুষে সম্পর্ককে ধরে রাখার ক্ষেত্রে সংবিধানের ভূমিকা ও আধুনিক রাষ্ট্রের আইনের ভূমিকা পালন করে। ইংরেজি ‘Religion’ কথাটি এর প্রায় সমার্থক হিসেবেই প্রচলিত হয়ে গেছে; এর অর্থ পুনরায় যুক্ত করা (ল্যাটিন উৎস ‘re-ligare’)।

ধর্ম নামক সংবেদনশীল এই প্রক্রিয়ার সম্পর্কে বলতে গেলে, এটা মাথায় রাখা প্রয়োজন যে, ধর্ম মানুষকে অনেক কিছু দেয় ও দিয়ে এসেছে যে কারণে বহু শত বছর ধরে গরিষ্ঠতর মানুষের মধ্যে ধর্মবিশ্বাস টিকে আছে, যদিও ধর্ম থেকে সাধারণ মানুষের এই পাওয়ার ব্যাপারটা একটা মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে, পরবর্তীকালে এই পাওয়াটা ফাঁকি আর প্রতারণার পর্যায়েই পৌঁচেছে।

তবু আপাতভাবে কিছু পাওয়ার সান্ত্বনা সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্ম বিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখে। কল্পিত সর্বশক্তিমান ঈশ্বর, দেবদেবী ইত্যাদিকে পূজা প্রার্থনা নামাজ ইত্যাদির মাধ্যমে সন্তুষ্ট করতে পারলে অনিশ্চয়তায় ভরা জীবনে স্বস্তি, স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তা পাওয়া যাবে-এ ধরনের বিশ্বাস সমস্যা-সঙ্কুল জীবনে সংগ্রাম করার জন্য মানুষকে মানসিক সাহস যোগায়। এ-সাহস নিছকই মানসিক বা মনে হওয়ার ব্যাপার হলেও ধনী-নির্ধন সব মানুষের ক্ষেত্রেই এর বিরাট ব্যবহারিক গুরুত্ব রয়েছে। ধর্মাচরণ ও ঈশ্বর বিশ্বাসকে মহান পুণ্য কাজ বলে বিশ্বাস করলে, নিজের জীবনের অনেক অপ্রাপ্তি, অনেক হতাশা ও বঞ্চনার যন্ত্রণা ভুলে যাওয়া যায়। অন্যদিকে অন্য মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি অন্যায় ও প্রবঞ্চনা করেও, কেউ ধর্ম নামক কায়াহীন, মায়াময় প্রতিষ্ঠানকে সন্তুষ্ট করে আত্মগ্লানি দূর করে। কোটিপতি চোরাকারবারি ধূমধাম সহকারে পূজা-যজ্ঞ করে বা মন্দির গড়ে দেয় কিম্বা ধর্ষণকারী ব্যক্তি ঈশ্বরের কাছে স্বীকারোক্তি ও প্রার্থনা করে ভাবে নিজের পাপস্খালন হয়ে গেল। দাসদের (শুদ্রদের!) এবং নারীদের নিপীড়ন করা তো হিন্দু-ধর্মের স্বীকৃতিই পেয়েছে। কাফের হত্যার নাম করে ভিন্ন-ধর্মাবলম্বীদের হত্যাও ধর্মানুমোদিত!

পাশাপাশি, সমাজে বঞ্চিত মানুষেরা অভিযোগ জানানোর বা অত্যাচারের প্রতিকার করার মতো কাউকে বাস্তবে না পেয়ে ঈশ্বর ও তার অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান তথা ধর্মের আশ্রয় নিয়ে মানসিক সাহস ও সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করে। এই সাহস ও সান্ত্বনা বাস্তবে ভিত্তিহীন। তবু প্রকৃতির কাছে অতি অসহায় মানুষের আদিমকালে ও পরবর্তী সময়ের শোষণভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় বেঁচে থাকার প্রক্রিয়ায়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একইভাবে প্রতারক, অত্যাচারী, অন্যায়কারীদের নিজের হাতে শাস্তি না দিতে পেরে, ধর্মানুমোদিত ও বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন নামে পরিচিত ঈশ্বরের আদালত, নরকবাস, চরম বিচার ইত্যাদিতে তারা শাস্তি পাবে ভেবে মানসিক জ্বালা ও ক্ষোভকে প্রশমিত করে শান্তি লাভ করা যায়। কোনরকমে দিনাতিপাত করে বেঁচে থাকতে হলেও এই শাস্তির ও ক্ষোভ প্রশমনের উপযোগিতা আছে। শ্রেণীবৈষম্য সৃষ্টির আগে আদিম মানুষও প্রকৃতির কাছে ছিল আরো অসহায়। ঐ অবস্থায়ও এই ঐশ্বরিক শক্তিতে বিশ্বাস তাকে ‘সাহস’ জুগিয়েছে, মানসিক স্বস্তি দিয়েছে।

কিন্তু এই উপযোগিতা সত্ত্বেও কখনোই তা সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ এ ধরনের মিথ্যা মানসিক আশ্বাসের ফলেই বঞ্চিত গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষেরা তাদের প্রকৃত শত্রুকে চিহ্নিত করে নির্মূল করার উদ্যোগ হারিয়ে ফেলে, প্রকৃত শত্রুকে চেনার ক্ষেত্রেও বিভ্রান্তি থেকে যায়; দুঃখ দারিদ্র্য দুর্দশা অকালমৃত্যু—সবই পূর্বজন্মের কর্মফল, ভাগ্যলিপি, ঈশ্বরের ইচ্ছা ইত্যাদি ধর্মানুমোদিত নানা অপতত্ত্বের সাহায্যে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়। ধর্মবিশ্বাস মানুষের ব্যবহারিক, মানসিক ও আবেগগত কিছু প্রয়োজন মেটালেও, তার সামগ্রিক ক্ষতি অনেক বেশি।

গ্রামাঞ্চলের লোকেরা সাপের কামড়ের বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা পান না, তাই যতদিন না এ-ধরনের বিকল্প তাঁদের দেওয়া যাচ্ছে ততদিন ওঝা গুনিনের উপর তাঁদের নির্ভরতা দূর করা উচিত নয়, কারণ তা হলে তাঁরা ওঝা-গুনিনের কাছ থেকে যতটুকু মানসিক সাহস পাচ্ছিলেন তা বন্ধ হয়ে যাবে এবং এর ফলে নির্বিষ সাপের কামড়েও চরম আতঙ্কিত ব্যক্তি এই সাহসের অভাবেই মারা পড়তে পারেন—এধরনের একটি যুক্তি অনেকে দেখান। কিন্তু এটি একটি অপযুক্তি। একইভাবে এটিও অপযুক্তি যে, ধর্ম বিপুল সংখ্যক মানুষকে যে গোষ্ঠীবদ্ধতা, যে মূল্যবোধ, যে মানসিক ও সামাজিক আশ্বাস দেয়, তার বিকল্প না দেওয়া অব্দি ধর্ম সম্পর্কে মানুষের মোহ দূর করা উচিত নয়, কারণ তা হলে মুলাবোধহীনতা ও মানসিক শূন্যতার সৃষ্টি হবে। সাপের প্রসঙ্গে তা অপযুক্তি—কারণ, এখন বিশেষত যখন সর্প দংশনের বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার কথা জানা গেছে, তখন আজো বঞ্চিত মানুষকে তা না জানানোর অর্থ, বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা পাওয়ার জন্য তাদের সচেতন প্রয়াস গড়ে তুলতে উৎসাহিত না করা, এবং গ্রামে স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়া, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করা ইত্যাদির জন্য তাদের আন্দোলন গড়ে তুলতে সহযোগিতা না করা। একইভাবে, ধর্ম প্রসঙ্গে তার উৎপত্তির ইতিহাস জানা গেছে, ধর্মকে কিভাবে পরবর্তীকালে শাসকশ্রেণী শাসন-শোষণের স্বার্থে ব্যবহার করে ও শাসিত-শোষিত মানুষ কিভাবে ধর্মে মিথ্যা আশ্রয় খোঁজার কাজে তাকে ব্যবহার করে—এসব জানা গেছে। আর তাই পাছে এখনো কেউ ক্রুদ্ধ হবে, কারো বিশ্বাসে আঘাত করা হবে, —এসব ভেবে ধর্ম প্রসঙ্গে সত্য ও বৈজ্ঞানিক তথ্য মানুষকে না জানানোর অর্থ যথার্থ বিজ্ঞানসম্মত মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে মানুষকে সচেতন না করা, ধর্মকে কেন্দ্র করে শাসককুলের ষড়যন্ত্র আড়াল করার চেষ্টা করা এবং নিপীড়িত মানুষের আত্মবঞ্চনার যন্ত্রণা দূর করতে তাঁদের সংগঠিত না করা। ধর্মের বিকল্প যথার্থভাবে না পাওয়া অব্দি এবং যে প্রাকৃতিক ও সামাজিক অবস্থার কারণে ধর্মের নানা ধরনের ব্যবহার টিকে আছে সে-অবস্থার পরিবর্তন না হওয়া অব্দি ধর্মচেতনার অবশেষ, উপযোগিতা ও ধর্মের ব্যবহার টিকে থাকবে—এটি আংশিক হলেও সত্য। কিন্তু এটি আরো সত্য যে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে এই বিকল্প ও পরিবর্তিত অবস্থা গড়ে তোলার জন্য ধর্ম সম্পর্কে মোহ, তার উৎপত্তির ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা, শাসন-স্বার্থে ধর্মের ব্যবহার সম্পর্কে অসচেতনতা—এগুলিও গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষের মন থেকে দূর করা দরকার।

ধর্ম শোষিত মানুষের দীর্ঘশ্বাস, সমাজের প্রতিকূল শক্তিসমূহ ধর্মের মধ্যে প্রতিফলিত হয়, ধর্ম ও ঈশ্বরবিশ্বাস আফিমের মতো কাজ করে — ধর্ম সম্পর্কে এ ধরনের ব্যাখ্যা সত্য হলেও, এটিও সত্য যে, ধর্মীয় অনুশাসন এক সময় সংবিধানের কাজ করেছে; পৃথিবীর দু-একটি দেশে প্রত্যক্ষ ভাবে এখনো তা করছে, যেমন নেপালে হিন্দু ধর্ম, আরব দেশগুলিতে ইসলাম ধর্ম ইত্যাদি। রাষ্ট্রের উৎপত্তির পর থেকেই রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুন তথা সংবিধান সর্বদাই শাসক শ্রেণীর শাসন কার্যের সুবিধার জন্য তৈরি করা। অতীতে এক সময় বহু রাষ্ট্রে ধর্ম আর ধর্মীয় অনুশাসন ছিল এই সংবিধানের মূল ভিত্তি। বর্তমানে কয়েটি ছাড়া পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রে ধর্ম তার এই ভূমিকায় প্রত্যক্ষভাবে নেই। কিন্তু পরোক্ষে যথেষ্ট শক্তিশালীভাবেই রয়েছে। তার এই প্রচ্ছন্ন প্রভাব দূর না হওয়ার কারণে কিছু তথাকথিত ধর্ম-নিরপেক্ষ ও কিছু তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক দেশেও তার শক্তিশালী পুনরাবির্ভাব ঘটেছে—যার সঙ্গে হাত ধরাধরি করে রয়েছে মানুষের ব্যাপক হতাশা ও অনিশ্চয়তা, সমাজের প্রতিকূল শক্তির ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা, বঞ্চনা ও বিশ্বাসভঙ্গ।

এই পশ্চাদপসরণ দূর করার জন্যও ধর্ম সম্পর্কে প্রকৃত সত্য দেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত প্রতিটি মানুষকে প্রতিটি প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে জানানো দরকার। পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মের উৎপত্তি, বিকাশ ও অপব্যবহার সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত তথ্যাবলী জানা ও জানানোর চেষ্টা করা দরকার আপামর জনসাধারণকে।

ধর্ম যে মানুষেরই প্রয়োজনে মানুষেরই তৈরী, ধর্মীয় তথা সাম্প্রদায়িক বিভেদ যে নির্ভেজাল কৃত্রিম একটি ব্যবস্থা—এ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা দরকার। ধর্ম না থাকা মানে খুব খারাপ কিছু বা ঈশ্বরে অবিশ্বাস মানে খুব নিন্দার্হ একটি ব্যাপার—এ সবও মনে করার কারণ নেই। বর্তমানে পৃথিবীর ১১০ কোটিরও বেশি মানুষ কোন ধর্মে বা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না অর্থাৎ তাঁরা ধর্মপরিচয়মুক্ত তথা অধার্মিক বা নাস্তিক। তাঁরাও অন্য ধার্মিক, ঈশ্বর বিশ্বাসীদের মতই বেঁচে আছেন। তাঁদের জীবনেও অন্যদের মতই সমস্যা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, শোষণ ও বঞ্চনা, সমাজের প্রতিকূল শক্তি সমূহের প্রতিফলন ইত্যাদি সবকিছুই আছে। কিছু তার জন্য তাঁদের ঈশ্বর বিশ্বাসে আশ্রয় নেওয়ার বা ধর্মীয় আফিমের নিষ্ক্রিয় নেশায় আচ্ছন্ন থাকার প্রয়োজন হয় না।

তাঁরা জানেন আফিম যেমন রোগ না সারিয়ে কৃত্রিমভাবে যন্ত্রণা ভুলিয়ে রাখে, তেমনি ধর্ম ও ঈশ্বরবিশ্বাসও সমস্যাবলীর সমাধান না করে কৃত্রিমভাবে জীবন-যন্ত্রণা ভুলিয়ে রাখে মাত্র। যন্ত্রণার প্রকৃত সমাধানে উভয় নেশাকেই পরিহার করা দরকার। অর্থাৎ ধর্ম মানুষের জীবনে একান্ত প্রয়োজনীয় আদৌ নয়। তবে প্রয়োজন হল প্রাসঙ্গিক মানবিক মূল্যবোধ ও যুগোপযোগী নৈতিকতা তৈরী করা ও অনুসরণ করা।

পূর্বোক্ত ঐ ১১০ কোটিরও বেশি ধর্মপরিচয়যুক্ত ও ঈশ্বরে অবিশ্বাসী মানুষ সমাজে একঘরে, অসম্মানিত, প্রেমহীন, আবেগহীন, যন্ত্রবৎ মোটেই নন। তাঁদের কাছে ঈশ্বরকে ভালবাসা ও সম্মান করার পরিবর্তে মানুষকে ভালবাসা ও সম্মান করাটাই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের কাছে ধর্ম ও ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করার চেয়ে মানবিক মূল্যবোধ ও গণতান্ত্রিক চেতনাকে রক্ষা করাটাই মুখ্য। অন্যদেরও এ সম্পর্কেসচেতন করা এখন অন্যতম জরুরী কাজ।

দুঃখের বিষয়, এখনো তা তো হয়ই নি, বরং সম্পূর্ণ উল্টো কাজ‍ই হচ্ছে –এটিও ধর্মকে শাসকশ্রেণীর স্বার্থে ব্যবহার করার কৌশলেরই অন্তর্ভুক্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *