চীনের লৌকিক ধর্ম
অন্যদিকে যে-সব প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস এখনো টিকে আছে তাদের মধ্যে অনুগামীদের সংখ্যা বিচারে চীনের লৌকিক ধর্ম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে পৃথিবীর শতকরা ৩.৪ ভাগ মানুষ এই ধর্ম অনুসরণ করেন। চীন সহ পুর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে তো বটেই, পৃথিবীর মোট ৫৬টি দেশে ছড়িয়ে আছেন এঁরা। খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দ সময়কালে, ইন রাজবংশের রাজত্বকালে চীনের প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসের লিখিত ইতিহাসের পরিচয় পাওয়া যায়। তখন দাসব্যবস্থার উন্মেষ ঘটছে। পাশাপাশি একবংশীয়, গোষ্ঠীগত ঐক্যও প্রবল। টোটেম বিশ্বাসও ছিল ব্যাপক। অন্যদিকে ঈশ্বর সম্পর্কিত—তুলনামূলকভাবে উন্নত চিন্তার উন্মেষ ঘটেছে। ঐ ঐশ্বরিক শক্তির সঙ্গে যোগাযোগের অদ্ভুত অদ্ভুত উপায়ও অবলম্বন করা হতো। যেমন আগুনে কচ্ছপের খোলা বা জন্তুর কাঁধের চওড়া হাড় ফেলে দেওয়া হতো। তারপর ঐ পুড়ে যাওয়া খোলা বা হাড়ে যেভাবে ফাটল ধরত তা পড়ার চেষ্টা করা হতো। প্রচলিত কোনো অক্ষরের সঙ্গে মিল দেখে, অর্থ বার করা হতো।
ধীরে ধীরে পেশাগতভাবে পুরোহিত গোষ্ঠীরও জন্ম হয়। এরা কেউ ধর্মে দীক্ষা দিত ও ঐশ্বরিক শক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করত (‘বু’), কেউ পার্থিব আবহাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করতে ও এ-সম্পর্কে খোঁজখবর রাখত (‘শি’), কেউ করত ওঝাগিরি (‘উ’), কেউ বা বলি দেওয়া বা এ-ধরনের উৎসর্গের কাজকর্ম করত (‘ঝু’)। মানুষে মানুষে সামাজিক শ্রেণী বিভাজনের ছাপ ধর্মাচরণের মধ্যেও পড়েছে। যেমন রাজা-রাজপুত্রদের আড়ম্বরপূর্ণ কবর আর সাধারণ মানুষের অনাড়ম্বর কবরের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
ধীরে ধীরে রাজতন্ত্র ও তাকে ঘিরে অভিজাত শ্রেণী প্রতিষ্ঠিত হয়। এরা নিজেদের স্বার্থ ও ক্ষমতার জন্য পরস্পরের মধ্যে হানাহানি করতেও পিছপা হতো না। খ্রীস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী সময়কালে এই সব রাজা, অভিজাতরা নিজেদের মতো করে দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক নানা তত্ত্ব ও অনুশাসনের জন্ম দিতে থাকে। সমগ্র সংস্কৃতি ও লিখিত সাহিত্য ছিল এদেরই একচেটিয়া।
এ-সবের প্রতিক্রিয়ায় খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী সময়কালে হান-ফেই-এর নেতৃত্বে কিছু বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন ‘ফাজিয়া’ নামে একটি মতবাদের জন্ম হয়। এর মধ্যে নিছক রাজরাজড়া নয়—সাধারণ মানুষের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, আশা-আকাঙ্খারও প্রতিফলন দেখা যায়। এসবের ফলে চীনের অন্যতম সরকারি ধর্ম তাও (Daoism) ধীরে রূপ পায়। প্রকৃতপক্ষে খ্রীস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের মাঝামাঝি কিম্বদন্তীপ্রায় চরিত্র লাও-ঝি-এর শিক্ষাগুলি সংকলিত হয়ে তাও-দে-চিং (Book of Dao) লেখা হয়। এই লাও-ঝি-এর শিষ্যরা ছিলেন হান ফেই, ইয়াং ঝু প্রমুখরা। ‘তাও’ কথাটির অর্থ ‘পথ’। সমসাময়িক কিছু প্রাসঙ্গিক বিশ্বাসের সঙ্গে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির আভাসও এই প্রাচীন দার্শনিক তত্ত্বের মধ্যে পাওয়া যায়। দুই বিপরীতের মিলন সবকিছুর মূলে এ ধরনের চিন্তাভাবনা তত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এই দুই বিপরীতের দ্বন্দ্বও যে ঘটে তা ঐ দর্শনে অনুপস্থিত ছিল। এর ফলে যারা সমাজকে শাসন করে তারা শ্রম করবে না—এমন তত্ত্ব সৃষ্টি হয়। ধনী দরিদ্রের সুষ্ঠু মিলনই ছিল এই দর্শনের কাম্য এবং সমাজের স্থিতাবস্থা বজায় রাখার উপায়। নিষ্ক্রিয়তা, শারীরিক শ্রম না করা, ইত্যাদি মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের জন্য ধর্মীয় স্বীকৃতি পায়।