কনফুসিয়াসের ধর্ম

কনফুসিয়াসের মতবাদ

ভারতীয় ভূখণ্ডে গৌতম বুদ্ধের জন্ম ও মতাদর্শ প্রচারের সমসাময়িককালে চীন ভূখণ্ডে আরেক দার্শনিক ও ধর্মপ্রবক্তার জন্ম হয়— তিনি ছিলেন কনফুসিয়াস (৫৫১-৪৭৯  খ্রীস্টপূর্বাব্দ)। তাঁর মতাবলম্বীরা তাঁর নাম অনুসারেই এই বিশেষ ধর্মের জন্ম দেন। বর্তমানে পৃথিবীর মাত্র ০.১ ভাগ মানুষ এই ধর্মমতে বিশ্বাসী এবং তারা মূলত মাত্র তিনটি দেশে এখন টিকে আছেন—এদের মধ্যে চীনেই তাঁরা এখনো আছেন কিছু উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়।

কনফুসিয়াসের মতবাদ ঐ সময়কার নৈতিক অনুশাসন ও মূল্যবোধের একটি সংকলিত রূপ। আসলে এটি সরকারী আমলাদের দৃষ্টিভঙ্গী ও স্বার্থরক্ষার সার্থক একটি প্রতিফলন। অনেকে একে ধর্ম না বলে বিশেষ দর্শন ও আচরণ বিধি হিসেবে দেখেন। তবু প্রকৃত অর্থে এটিও একটি ধর্মই। প্রচলিত অর্থের ধর্ম বিশ্বাসে যে অতিপ্রাকৃতিক শক্তি, আত্মা ইত্যাদির বিশ্বাস মিশে আছে, কনফুসিয়াসের ধর্মের বইগুলিতে এসবেরও উল্লেখ আছে। জন্মান্তর বা মৃত্যু পরবর্তী কাল্পনিক জীবনের অস্তিত্বও এই ধর্মে স্বীকৃত। তবে এই ধর্মমতে পেশাদার পুরোহিত বা গুরু জাতীয় কেউ ছিল না। ব্যক্তি কনফুসিয়াসকেই প্রায় অবতার বা ঈশ্বরের আসনে বসানো হয়েছে। পরবর্তীকালে শতশত বছর ধরে কনফুসিয়ান ধর্ম চীন ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে বিস্তার লাভ করে। এবং চীনের অন্যতম বৃহৎ ধর্ম হিসেবে পরিগণিত হয়। অন্যান্য ধর্মের মতো এই ধর্মকেও সামন্ততান্ত্রিক শাসকশ্রেণী সুদক্ষভাবে নিজস্বার্থে ব্যবহার করে।

কনফুসিয়ান-ধর্মে আচার-অনুষ্ঠানগুলিকে কঠোরভাবে অনুসরণ করার ওপর জোর দেওয়া হতো। পূর্বপুরুষ তথা বাবা-মায়ের প্রতি অবিচল ভক্তি ও আনুগত্য এবং তাদের আরাধনার ওপরও জোর দেওয়া হয়। পুত্রসন্তান না হওয়া মানে জীবনের সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার—এধরনের চিন্তা প্রতিষ্ঠিত হয়। চীনের রাজাদের আমলে চাকরি পেতে হলে পরীক্ষা দিতে হতো। এই পরীক্ষায় অবশ্য-পাঠ্য ছিল কনফুসিয়াসের গ্রন্থগুলি।

পরবর্তীকালে চীনে তাওধর্ম, কনফুসিয়ানধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম—এ তিন ধরনের ধর্মই প্রধান ধর্মমত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এদের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিরা ক্ষমতালাভের লড়াইতে প্রায়শই জড়িয়ে পড়ত। তাও পুরোহিতরা একসময় রাজকীয় ক্ষমতারা জন্য লালায়িত হয়ে ওঠে যদিও এ-ধর্মে আগে রাজকার্যে হস্তক্ষেপ না করে নিষ্ক্রিয় থাকার কথা বলা হয়েছিল। এবং মিতাচার (abstinence)-কে তাওধর্মের মহৎ গুণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। এমনই ক্ষমতার লড়াইতে কনফুসিয়ান হান রাজত্ব, ১৮৪ খ্রীস্টাব্দে তাওপন্থী কৃষক বিদ্রোহের দ্বারা পর্যুদস্ত ও পরাজিত হয়।

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে চীনে প্রায় ১,৫০০ কনফুসিয়ান মন্দির ও এক লক্ষ তাও-পুরোহিত ছিল। অবশ্য সরকারি ধর্ম মূলত ছিল কনফুসিয়ান। ১৯১১ সালে চীন বিপ্লবের পর সান-ইয়াৎ-সেনের নেতৃত্বে এ-অবস্থা পাল্টাতে শুরু করে। কনফুসিয়ান ধর্মে রহস্যময় অতিপ্রাকৃতিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন জাতীয় কাজকর্ম ছিল না (যদিও এ-সবে বিশ্বাস ছিল), কিন্তু দৈনন্দিন রাজকার্যে তার প্রভাব ছিল সর্বগ্রাসী। সান-ইয়াৎ-সেন এসব বন্ধ করেন। কনফুসিয়ান ও তাওদের মন্দির তথা ধর্ম থেকে রাষ্ট্র পরিচালন ব্যবস্থা আলাদা করে দেন। স্কুলে, চাকরির পরীক্ষায় কনফুসিয়ান ধর্ম বাধ্যতামূলকভাবে পড়ার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। তাও-ধর্মে অবশ্য অলৌকিক শক্তির ওপর আস্থা তথা এ-জাতীয় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান চালু ছিল। কিন্তু তা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েছিল—এরপর আরো দুর্বল হয়ে যায়। ১৯৪৯-এ চীনের মুক্তির পর এ-ব্যাপারে আরো বিজ্ঞানসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া হয়। প্রাচীন মন্দির ইত্যাদি সুরক্ষিত করে মিউজিয়াম করা হয়। সরকারি সমস্ত কাজে কোনো ধরনের ধর্মীয় হস্তক্ষেপ বন্ধ করা হয়। ধর্মকে উৎসাহ দেওয়া হয় না, ধর্মকে বিশেষ ব্যক্তির নিজস্ব বিশ্বাস হিসেবে গণ্য করা হয়। তবু এখনো চীনের বিশেষত গ্রামাঞ্চলে, কুনফুসিয়ান-ধর্ম, তাও ধর্ম তথা চীনের লৌকিক ধর্মকে আর বৌদ্ধধর্মকে বেশ কিছু মানুষ অনুসরণ করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *