ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে আপস, নাকি ধর্মবিশ্বাস থেকে মুক্তি?
১৯৯২ সালের মাঝামাঝি পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫৪৮ কোটি ১০ হাজার। পৃথিবীর নানা অঞ্চলে, নানা ভৌগোলিক পরিবেশে ছড়িয়ে আছে এই মানুষ—নানাবিধ তাদের ভাষা, নানাবিধ তাদের আচার আচরণ, মূল্যবোধ, খাদ্যাভ্যাস, চেতনা ও ধর্মবিশ্বাস। এত বিপুল বৈচিত্র্য সত্ত্বেও, ধর্মবিশ্বাসের প্রসঙ্গে এটা বলা যায় যে, পরিভাষা বিভিন্ন হলেও এবং ধর্মাচরণের নানা ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকলেও, প্রচলিত অর্থের নানা ধর্মে বিশ্বাসী সব মানুষই একটি অতি প্রাকৃতিক সর্বশক্তিমান শক্তি তথা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন। ধর্ম ও ঈশ্বর বিশ্বাস প্রায় অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। এখানে আলোচনায় ধর্ম বলতে এই সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত ধর্মের কথাই বোঝানো হচ্ছে, যেমন হিন্দুধর্ম, ইসলাম ধর্ম, খ্রীস্টধর্ম, ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ ধর্ম কথাটির বৃহত্তর অর্থ, যেমন মনুষ্যত্বের ধর্ম,-এভাবে ধর্ম কথাটিকে এখনকার আলোচনায় আপাতত ধরা হচ্ছে না।
প্রচলিত অর্থের এই ধর্মে যতজন বিশ্বাস রাখেন তাঁদের তুলনায় মনে প্রাণে এ-ধরনের কোন ধর্মে তথা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করেন না, বা তাকে কৃত্রিম ও কল্পনা বলে জানেন-এমন ব্যক্তির সংখ্যা যথেষ্টই কম (অনুপাত প্রায় ৪:১)। ধর্মবিশ্বাসীরাই এখনো পৃথিবীতে সংখ্যাগত দিক থেকে অনেক বেশি বলীয়ান। ভাষাগত দিক থেকেও এঁরা সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন ঐতিহাসিক কারণেই। অবিশ্বাসীদের এঁরা চিহ্নিত করেন অধার্মিক, না-ধার্মিক, নিরীশ্বরবাদী, নাস্তিক ইত্যাদি নানাবিধ নেতিবাচক বিশেষণে। ধর্মকে যাঁরা মানুষের সত্যিকারের পরিচয় বলে মনে করেন না, সেই অবিশ্বাসীরাও নিজেদের এইভাবে পরিচিত করান; বরং বলা ভালো, উপযুক্ত পরিভাষার অভাবে এইভাবে নিজেদের পরিচিত করাতে এখনো বাধ্য হন।
ধর্মবিশ্বাস বা ঈশ্বরবিশ্বাস ভাষাগত দিক থেকে এই সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার প্রধান কারণ, এই বিশ্বাস তথা কল্পনার সৃষ্টি আগে হয়েছে। এই বিশ্বাস যে মিথ্যা, এ যে নিছকই কল্পনা, -এমন সত্য মানুষ উপলব্ধি করেছে পরে, তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। একটি শিশু যখন জন্মায় তখন সে সহজাত কিছু প্রবৃত্তি ছাড়া, বিশেষ কোন জ্ঞান বা বিশ্বাস বা কল্পনা নিয়ে জন্মায় না। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে চারপাশের জিনিষ দেখতে থাকে। তার চেয়ে বয়স্ক ব্যক্তিরা যেমন তাকে নানাকিছু শেখায় ও তার মনে নানা ধরনের ধারণা, বিশ্বাস, মূল্য বোধ ইত্যাদি ঢোকাতে থাকে, তেমনি তার নিজেরও কল্পনা করার ক্ষমতা উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেই নানা কিছুর ব্যাখ্যা করতে থাকে। একটি শিশু তার চারপাশের জিনিষকে নিজের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের সাহায্যে নিজের মত করেই ব্যাখ্যা করে। আর এই ব্যাখ্যায় স্বাভাবিক কারণেই থাকে সীমাহীন অবাস্তব কিছু কল্পনা, মিথ্যা কিছু ধারণা।
মনে আছে, ছোটবেলায় গ্রামে বিরল দর্শন মোটর গাড়ি দেখে আমরা ভাবতাম গাড়ীর ভেতর প্রবল শক্তিশালী কেউ একজন বসে আছে। সে ঐ ভারী গাড়ীটাকে প্রবল বেগে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, ইচ্ছেমত বাঁকা রাস্তায় বা সোজা রাস্তায় নিয়ে যাচ্ছে। এবং শুধু ঐ মোটর গাড়ী নয়, একটি শিশু তার কল্পনায় নিজের অজ্ঞতা ও সার্বিক অসহায়তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে, তার চেয়েও শক্তিশালী, রহস্যময় কোন একজনের কথা ভেবে নিজের অনুসন্ধিৎসাকে তৃপ্ত করে। এটিই ক্রমশঃ পরিব্যাপ্তি লাভ করে।
কিন্তু একসময় আরো বড় হলে, যদি সে মোটরগাড়ির কলা কৌশল জানতে পারে, তবে গাড়ির ভেতরে সে জড় ইঞ্জিনের অস্তিত্বই মেনে নেয়, ও তার মধ্যে প্রবল শক্তিমান মানুষের একমাত্র প্রবল অস্তিত্বকে মিথ্যা বলেই নিশ্চিত হয়। একইভাবে প্রকৃতির নানা রহস্যময়তার পেছনে বৈজ্ঞানিক তথ্য, তত্ত্ব ও ব্যাখ্যা জানার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলির পেছনে কোন রহস্যময় শক্তির অস্তিত্বের চেয়ে প্রাকৃতিক নিয়মাবলী ও সত্যকেই জানতে পারে। জানতে পারে, গাড়ীর চালকও ঈশ্বরের প্রতীক নয়, -তাঁর ভূমিকা ইঞ্জিনটাকে নিয়ন্ত্রণ করার তথা মানুষের বর্তমান জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা-পূরণকারীর
এইভাবে একটি মানবশিশু তার জীবনের শুরুতে কল্পনাপ্রবণতা আর কল্পিত নানা কিছু সম্পর্কে বিশ্বাস ইত্যাদির জন্ম দেয়। এই সময় তার ভুত প্রেত, রাক্ষস খোক্কস, রহস্যময় অলৌকিক গা ছমছমে গল্প এসব খুব ভাল লাগে। যুক্তিবাদ, বাস্তব সম্মত চিন্তা ভাবনা, যুক্তি ভিত্তিক কল্পনা ও সিদ্ধান্ত করার ক্ষমতা, এগুলি মানুষ আয়ত্ত করে পরের দিকে, -শৈশব পেরিয়ে বয়স বাড়ার সঙ্গে, তার মস্তিষ্কের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে।
আরো অনেক অনেক বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে মানব-সভ্যতা সম্পর্কেও এটি সত্য। মনুষ্যেতর প্রাণী থেকে ‘মানুষ’ যখন মানুষ হয়ে উঠতে থাকে, তখন তার মস্তিষ্কের বিকাশও ধীর গতিতে ঘটতে থাকে, চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা বাড়তে থাকে। কিন্তু প্রকৃতির কাছে সে ছিল শিশুর মত অসহায়, প্রকৃতি-বিজ্ঞান সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল শিশুর মতই অপ্রতুল। তবু অনুসন্ধিৎসা ও চিন্তা করার ক্ষমতার সে অধিকারী। এই অনুসন্ধিৎসাকে তৃপ্ত করতে সে আপাত যুক্তি গ্রাহ্য নানা কল্পনার জন্ম দেয়। প্রাকৃতিক নানা কিছুর পেছনে এক পরমশক্তির কল্পনা করে। এই কল্পনাই পরে ঈশ্বর তথা নানা ভাষায় নানা নামে অভিহিত হয়। কেটে যায় হাজার হাজার বছর। জ্ঞান ও পরীক্ষা-প্রমাণ-লব্ধ তথ্যাদি মানুষ ক্রমশঃ আহরণ করতে থাকে। আর এর ফলে পূর্বেকার কল্পনার বহু কিছুই সে জ্ঞানের আলোয় বিচার করে। তখন মানুষ তার পূর্বেকার, ঈশ্বর সম্পর্কিত কল্পনার ফাঁকি সম্পর্কেও সচেতন হতে থাকে।
এভাবেই ‘ঈশ্বর’ তথা ঈশ্বর কেন্দ্রিক ধর্ম সৃষ্টি হয়েছে আগে—মানব সভ্যতার শৈশবলগ্নে। তাই ভাষাগত দিক থেকেও এগুলিই প্রথমে স্বীকৃতি পেয়েছে। পরে মানব সভ্যতা ক্রমশঃ পূর্ণতা লাভ করতে শুরু করলে কিছু মানুষ এ সবকে কল্পনা ও মনুষ্যসৃষ্ট বলে উপলব্ধি করেন। এই উপলব্ধিকে ভাষাগতভাবে প্রকাশ করার জন্য পূর্বেকার স্বীকৃতিকে তথা পরিচিতিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা সম্ভব নয়। কারণ তা বহু বছর ধরেই মানসিক ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। তাই তার নেতিবাচক পরিচিতি-নাস্তিকতা, নিরীশ্বরবাদ, ধর্মহীনতা বা অধার্মিকতা। তবে দুঃখের বিষয়, যারা মিথ্যা কল্পনায় আচ্ছন্ন, তারা কিন্তু ‘নাস্তিক’ বা ‘অধার্মিক’ কথাগুলিকে গালাগালি হিসেবে ব্যবহার করে। এভাবে গালাগালি করার প্রধান উদ্দেশ্য, জন সমক্ষে তাঁদের হতমান করা, সাধারণ মানুষের কাছে তাঁদের নিন্দার্হ হিসেবে হাজির করা। বিপুল বিস্তারী মিথ্যার মধ্যে মুষ্টিমেয় যাঁরা সত্যকে তুলে ধরে বিপ্লবী ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের প্রায় সবার ক্ষেত্রেই এটি সত্য।
অবশ্য ধর্মবিশ্বাস বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবন, সংস্কৃতি, আবেগ ও চেতনায় এমন গভীরভাবে জড়িয়ে আছে যে, যাঁরা ধর্মের অনড় অবস্থার বিরোধিতা করেন ও তার ভ্রান্তির কথা আলোচনা করেন, তাঁরা আগেভাগেই বলে রাখেন :— বিশেষ কোন ধর্মমতাবলম্বীদের বিন্দুমাত্র আঘাত করার কোন ইচ্ছা নেই ইত্যাদি; এবং তাঁদের বিরোধিতার প্রধান বিষয় থাকে ধর্মান্ধতা, উগ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় একগুঁয়েমি বা ধর্মীয় হিংস্রতা ইত্যাদি। এ ধরনের বক্তব্যের সাহায্যে এটি পরিষ্কার করা হয় যে, একপেশেভাবে, বিশেষ সংকীর্ণ উদ্দেশ্যে শুধু বিশেষ একটি ধর্মকে হতমান করা, তথা অন্য বিশেষ একটি ধর্মকে গরীয়ান করে দেখানো তাঁদের উদ্দেশ্য নয়, বরং ধর্ম নিয়ে গোঁড়ামি আর অযৌক্তিক একগুঁয়েমির বিরুদ্ধেই তাঁরা বক্তব্য রাখেন। একপেশেভাবে বিশেষ ধর্মের আহতুক নিন্দাবাদ করা অবশ্যই নিন্দনীয়, কিন্তু ধর্ম প্রসঙ্গে তথা ধর্মীয় গোঁড়ামি, ধর্মান্ধতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রকৃত সত্যকে তুলে ধরতে গেলে আঘাত না করে কি তা করা সম্ভব? মোটেই না। আঘাত একটা দিতেই হয়—যদিও তা তথ্য ও যুক্তির সাহায্যে, বাস্তব পরিস্থিতির বিচারেই করণীয়।
বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, ভারতবর্ষে রাম মন্দির-বাবরি মসজিদের ব্যপারটাকে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক স্বার্থরক্ষা ও রাজনৈতিক ফায়দা ওঠানোর জন্য যারা ব্যবহার করছে তাদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে খুবই নগণ্য। দেশের কোটি কোটি হিন্দু বা লক্ষ লক্ষ মুসলমান জনসাধারণের সঙ্গে তার প্রায় কোন প্রত্যক্ষ সংস্রব নেই। কিন্তু পরোক্ষ যোগাযোগ আছেই, যার উৎস এই সাধারণ ব্যক্তিদের মনের গভীরে থাকা গভীর ধর্মবিশ্বাস—যা এই ধরনের ধর্মভিত্তিক ‘আন্দোলনের’ ক্ষেত্র প্রস্তুত করে এবং যার ফলে মসজিদ ভাঙ্গার জন্য ও রাম মন্দির হলে বহু হিন্দুই মনে মনে খুশি হচ্ছেন এবং বহু মুসলমানই ক্রুদ্ধ হচ্ছেন—অনেকে প্রকাশ্যেও তাঁদের এই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন।
তাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানো, রাম মন্দির-বাবরি মসজিদের মতো অর্থহীন বিরোধে লিপ্ত হওয়ার বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বা প্রচার চালাতে যখন পোস্টার বা ব্যানার দেখা যায়,—‘ধর্মান্ধতা সাম্প্রদায়িকতাকে যারা রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে তারা দেশের শত্রু’, ‘ধর্মনয়, ধর্মান্ধতার বিরোধিতা করুন’ ইত্যাদি কিংবা ‘সবধর্ম সমন্বয়,’ ‘সর্বধর্মে সমভাব’ তথা ধর্ম-নিরপেক্ষতা জাতীয় কথাবার্তা, তখন এটি বোঝা দরকার যে, এ ধরনের বক্তব্য মূল সমস্যার বিরুদ্ধে নিতান্তই আংশিক—এবং হয়তো বা আপসপন্থী—একটি বক্তব্য। এই আপস ধর্মের সঙ্গে, বৃহত্তর জনসংখ্যার ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে।
‘ধর্মনিরপেক্ষতা” বা ‘সর্ব ধর্ম সমন্বয়’—এ সব কথার মধ্যে ধর্মকে স্বীকার করে নেওয়ার কথাই বলা হয়। নানা ধর্ম আছে থাক, মানুষ বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাস করছে করুক, কিন্তু সব ধর্মবিশ্বাসী মানুষের ঐক্য হোক— এটাই যেন কাম্য; কিংবা ধর্মকে টিকিয়ে রেখেই সব ধর্মের প্রতি সম দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করাটাই যেন কামনা। কিন্তু শত শুভ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এ সব কামনা যেন ‘সোনার পাথরবাটি’ কামনা করার মত।
একটি নিছক কল্পনা ও মিথ্যার উপর ভিত্তি করে যে বিশ্বাস গড়ে ওঠে তা কমবেশি অন্ধ হতে বাধ্য। যুক্তিহীন বিশ্বাস ও দ্বিধাহীন আনুগত্যই তার গোড়ার কথা। সঙ্গে মিশে থাকে গোষ্ঠীগত স্বাতন্ত্র, প্রাচীন ঐতিহ্য, সামাজিক অনুশাসন ও নীতিবোধ ইত্যাদি নানা দিক সব মিলিয়ে, এ ধরনের বিশ্বাসীরা অন্য একটি গোষ্ঠীর প্রতি সমমনোভাবাপন্ন হবেন বা সর্বক্ষেত্রে তাঁদের সঙ্গে সমন্বিত হবেন—এমন আশা করা,—বাঞ্ছিত হলেও, আকাশ কুসুমের মত অসম্ভব। কিন্তু পাশাপাশি এটিও সত্য যে, বিপুল সংখ্যক মানুষের মন ও সমাজ থেকে ঈশ্বর ও ধর্ম সংক্রান্ত বিশ্বাসগুলি এখনি রাতারাতি দূর করা দুরূহ। তাই যতদিন এ বিশ্বাস থাকবে ততদিন তার মধ্যে উগ্রতা, হিংসা বা অসহিষ্ণুতাকে নিয়ন্ত্রণ করা অবশ্যই প্রয়োজন। তবু ধর্মীয় বিশ্বাস তথা ধর্মের উপরে মানসিক ভাবে নির্ভর করার প্রবণতা দূর করাটাই আসল প্রয়োজন।
এর অর্থ এ নয় যে ধর্মীয় বিভেদই মানুষে মানুষে বিভেদের একমাত্র বা প্রধানতম কারণ। প্রধান কারণ অবশ্যই অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য। আর ধর্মের সৃষ্টি সমাজে এই বৈষম্য সৃষ্টিরও আগে। পরবর্তীকালের সমাজ ও বিশেষ শ্রেণী নিজ স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করেছে মাত্র। কিন্তু সাধারণভাবে বিপুল সংখ্যক সধারণ মানুষই এই অর্থনৈতিক বৈষম্যের চেয়ে ধর্মীয় বৈষম্য সম্পর্কেই বেশি সচেতন। এর ফলে বিভেদ ও বৈষম্য ক্রমশঃ বেড়েই চলে—একদিকে ধর্ম-সম্পর্কে মিথ্যা বিশ্বাস ও অন্যদিকে অর্থনৈতিক বৈষম্য সম্পর্কে অসচেতনতা এই বেড়ে চলার জন্য প্রধানত দায়ী। এটি বোঝা দরকার যে ধর্মীয় বিভেদ কিছু কল্পনা ও মিথ্যা বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। অন্যদিকে অর্থনৈতিক বৈষম্যের পেছনে রয়েছে বাস্তব সামাজিক কারণ। পৃথিবীর সবাই যদি এ দিকটি সম্পর্কে প্রকৃতই সচেতন হন, তবে ধর্মের মত একটি কৃত্রিম বায়বীয় ব্যাপারকে কেন্দ্র করে সময়, শ্রম ও উদ্যম নষ্ট করা এবং পারস্পরিক সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে লিপ্ত হওয়ার মত ব্যাপারগুলিকে বালখিল্যসুলভ কাজ বলে পরিহার করতে সমর্থ হবেন। সময়, শ্রম ও উদ্যম ব্যয় করতে পারবেন অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য ও দুরবস্থাকে দূর করার জন্য; তবে এই বৈষম্য টিকে থাকার কারণে মানুষের শ্রেণীতে শ্রেণীতে দ্বন্দ্ব ও লড়াই থাকবেই—ধর্মীয় বিভেদ যদি না-ও থাকে তাহলেও। কিন্তু ধর্ম-যুদ্ধ বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নেতিবাচক ছাড়া ইতিবাচক কোন ভূমিকা নেই; পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংগ্রাম মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের উত্তরণ ঘটাতেই সাহায্য করবে।
তাই ধর্মের প্রকৃত চরিত্র, ধর্মের সৃষ্টির পেছনকার প্রকৃত সত্যকে সাধারণ মানুষের সামনে ব্যাপকভাবে তুলে ধরা দরকার—যা সচেতন ব্যক্তিদের আরো আগে, আরো গুরুত্ব দিয়ে রাজনৈতিকভাবে করার প্রয়োজন ছিল। তা না হওয়ার ফলে বাবরি মসজিদ-রামজন্মভূমি, সতীদাহ, ধর্মকেন্দ্রিক দাঙ্গা কিংবা তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক দেশে চার্চ, ইসকনের মাধ্যমে কৃষ্ণ-চেতনা, বা ধর্মীয় পশ্চাদপসরণ কিংবা পৃথিবীর অন্যত্র আয়াতোল্লাতন্ত্রের মত নানা মৌলবাদী চিন্তার জন্ম হয়েছে ও হচ্ছে। আপাত ও সাময়িক জনসমর্থন হারানোর ভয়ে কিংবা ধর্মকে গণসংযোগের একটি উপায় হিসেবে ভেবে, যে সচেতন ব্যক্তিরা (এঁদের মধ্যে আমাদের দেশের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিরাও আছেন) সুযোগ থাকলেও তা করেন নি, পরে তাঁদের তার মাশুল দিতে হচ্ছে, হবেও। এখানে এ-বিষয়ে প্রাথমিক কিছুটা আলোচনা করা হচ্ছে, তবে এ আলোচনা আরো পূর্ণাঙ্গ, আরো যথার্থ করে তোলা দরকার—আরো অনেকের অংশগ্রহণে।