ইসলামধর্ম

ইসলাম ধর্ম

ইসলাম কথার অর্থ অনুগত হওয়া বা আত্মসমপর্ণ করা। এই আনুগত্য, নিজেকে এই সমর্পণ সেই কল্পিত ঈশ্বরের কাছে যাকে আরবী ভাষায় বলা হয় ‘আল্লা’। অবশ্য ঈশ্বরের সমার্থক এই ‘আল্লা’ শব্দটির ব্যবহার শুধু ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাই নন, আরবের খ্রীস্টানরাও করে থাকেন। আরবী শব্দ ‘ইসলাম’ থেকে উৎপত্তি হয়েছে ‘মুসলিম’ কথাটি যার দ্বারা তাঁদেরই বোঝায় যাঁরা আল্লার ইচ্ছার কাছে নিজেদের সমর্পণ করেছেন। এই ধর্মমতের প্রবর্তক হজরত* মহম্মদ (পুরো নাম—আবু আল-কাসিম মহম্মদ ইব্‌ন্‌ আব্‌দ্‌ আল্লা ইব্‌ন্‌ আল-মুত্তালিব ইব্‌ন্‌ হাশিম)। ইসলাম ধর্মে আদম, নোয়া, যীশুখ্রীস্ট ইত্যাদি ঈশ্বরের বিভিন্ন দূত বা নবী (পয়গম্বর, prophet)-এর কথা বলা হয়। মহম্মদ ঈশ্বরের শেষ দূত। এই ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ আরব অঞ্চলে। ইহুদি ও খ্রীস্টধর্ম এবং অন্যান্য নানা আঞ্চলিক ধর্ম তখন ঐ অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। কিন্তু আরবের সামাজিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। শিশুহত্যা, ব্যভিচার, অবাধ যৌনবিহার, লুঠপাট, অসহায় দরিদ্রদের উপর সবল ধনীদের অত্যাচার, নরহত্যা, দাঙ্গা ইত্যাদির যেন কোন সীমা-পরিসীমা ছিল না। সামান্য কারণে নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি, খুনজখম শুরু হয়ে যেত।

[* ‘হজরত’ একটি সাধারণ সম্মানসূচক উপাধি।]

আরবের মক্কা শহরে কার্বা নামে একটি ধর্মীয় স্থান ছিল। এতে ছিল অজস্র (৩৬০ টি) দেবদেবীর মূর্তি। স্থানীয় মানুষের কাছে এই অঞ্চলটি ছিল মানসিক শান্তি ও সামাজিক সুরক্ষার স্থান। এই কাবা-কে ঘিরে ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল—যা মূলত নিয়ন্ত্রণ করত কোরাইশ বংশের লোকেরা। ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ দিকে এই ব্যবসা খুবই অর্থদায়ী হয়ে ওঠে, একই সঙ্গে কিছু অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বেরও সৃষ্টি হয়। এছাড়া মরুযাত্রী ব্যবসায়ীরা উট নিয়ে ভারত-ইথিওপিয়া থেকে জিনিসপত্র ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে নিয়ে যেত, ইয়েমেন-সিরিয়ার মধ্যে ( গাজা ও দামাস্কাস) ব্যবসা চলত। কিন্তু সম্পদ কুক্ষিগত ছিল মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে, বিপুল সংখ্যক মানুষ ছিল হতদরিদ্র। এদের প্রতি বিন্দুমাত্র নজর দেওয়ার মতো মূল্যবোধ ও মানসিকতা ধনীদের ছিল না; গোষ্ঠীগত ঐক্যও ভেঙে যাচ্ছিল।

এই চরম অনাচার ও অমানবিক অবস্থার মধ্যে জন্মেছিলেন মহম্মদ। তিনি তাঁর সুদক্ষ সামরিক ক্ষমতার সঙ্গে ঐশ্বরিক নির্দেশাবলী হিসেবে নানা নিয়মকানুনের প্রচারকে নিপুণভাবে মেশান এবং জীবদ্দশাতেই প্রায় সমগ্র আরবকে ঐক্যবদ্ধ করেন। জন্ম দেন ইসলামধর্মের—যার অধীনে ঐক্যবদ্ধ হয় ছিন্নবিচ্ছিন্ন আরব জাতি। খ্রীস্ট বা হিন্দুধর্মের মত, মহম্মদের জীবনকে ঘিরে বিশেষ কোনো অলৌকিক ঘটনা বা ক্ষমতার কথা প্রচারিত হয় নি। তথাকথিত জটিল ও দুর্বোধ্য আধ্যাত্মিকতার কথাও বলা হয় নি। দরিদ্রকে দান করতে হবে, সুদ নেওয়া চলবে না, মদ খাওয়া চলবে না বা সব মানুষ সমান- এই জাতীয় সহজ সরল কথাবার্তা এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক সামরিক প্রয়োজনে, নিজেদের স্বার্থে সৃষ্টি করা নানা নিয়মাবলী-এগুলিই ইসলামধর্মের মূল কথা

৫৭০ খ্রীস্টাব্দের ২৯ আগষ্ট, সোমবার, মহম্মদ মক্কা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের আগেই বাবা আব্আল্লা মারা যান, মা আমিনা মারা যান মহম্মদের ছ’বছর বয়সে। তাঁরা ছিলেন কোরাইশদের সম্ভ্রান্ত গোষ্ঠী হাশিম-এর অন্তর্ভুক্ত। তাঁর ঠাকুর্দা ছিলেন এই হাশিম গোষ্ঠীর নেতা। ইনি মারা যাওয়ার পর মহম্মদ কাকা আবু তালিবের কাছে থাকেন। মহম্মদ ছিলেন নিরক্ষর। ছোটবেলায় মেষ চরাতেন। বড় হয়ে কাকার সঙ্গে ব্যবসায় সিরিয়াতে যাতায়াত করেন।

৫৯৫ সাল নাগাদ এমনই এক ব্যবসায়িক যাত্রায় খাদিজা নামে এক ধনী ব্যবসায়ী মহিলার সঙ্গে মহম্মদ পরিচিত হন। ৪০ বছর বয়সী এই মহিলা মহম্মদের দ্বারা এমনই প্রভাবিত হন যে, শেষ অব্দি তাঁরা বিয়ে করেন। তাঁদের দুই ছেলে হয়—তাঁরা অকালে মারা যান; আর হয়েছিল ৪টি মেয়ে।

ব্যবসায়িক কাজকর্মের সঙ্গে সঙ্গে, ৬১০ সালের কাছাকাছি সময়ে মহম্মদ মক্কার তিন মাইল দূরে হেরা পর্বতগুহায় মাঝে মাঝে নির্জনে সময় কাটাতে থাকেন; এসময়ই একদিন দেবদূত গ্যাব্রিয়েলের তিনি দর্শন পেয়েছেন বলে তাঁর মনে হয় এবং শোনেন দেবদূত যেন তাঁকে বলছেন, ‘তুমি ঈশ্বরের দূত’। এরপর থেকে মৃত্যু অবধি মাঝে মাঝেই এমন দৈববাণী বা ঈশ্বরের নির্দেশ (ওহী) তিনি শুনেছেন বলে বলা হয়। গ্যাব্রিয়েল দর্শনের পর মহম্মদ অত্যন্ত অস্থির হয়ে পড়েন। স্ত্রী তাঁকে আশ্বাস দেন ও শান্ত করেন। এরপর এ ধরনের দর্শন তিনি আর পান নি, যদিও বাণী শুনেছেন। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা অনুসারে, এই ধরনের অস্বাভাবিক অনুভূতির সময়, “মাঝেমাঝেই তাঁর শরীর ঘেমে ঠাণ্ডা হয়ে যেত। এধরনের ঘটনা থেকে এটি অনুমান করা হয়েছিল যে তাঁর মৃগীরোগ ছিল—অবশ্য বর্তমানে এটি চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠিত মত নয়; মাঝে মাঝে কোন বাণী ছাড়াই তিনি ঘন্টাধ্বনিও শুনতে পেতেন।” [প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে মৃগী (epilepsy) রোগের রোগীদের মধ্যে অবাস্তব, মিথ্যা নানা অনুভূতি (hallucination) ঘটতে পারে, যেমন যা নেই তা দেখা (দেবদর্শন), শোনা (দৈববাণী) ইত্যাদি। ]

এধরনের বাণী মহম্মদ একবার ‘শুনেই’ মুখস্থ করে ফেলতে পারতেন এবং পরবর্তীকালে স্ত্রী খাদিজা-র খ্রীস্টান ভাই ওয়ারাকা-র সাহায্যে এইসব বাণীর ব্যাখ্যা করেন। দেখা যায় ইহুদি ও খ্রীস্টধর্মের এবং অন্যান্য স্থানীয় বিশ্বাসের অনেক কিছুর সঙ্গে এগুলির মিল রয়েছে।

৬১৩ সাল থেকে মহম্মদ এই সব বাণী প্রকাশ্যে প্রচার করতে থাকেন। একেশ্বরবাদের নামে, দুর্বলদের সাহায্য করা আর অত্যাচারীর মোকাবিলার কথা বলেন। ইতিমধ্যেই তাঁর ৩৯ জন অনুগামী জুটেছিল। এঁরা আরকাম নামে এক বন্ধুর বাড়িতে একসঙ্গে এগুলি নিয়ে আলোচনা করতেন, মাঝে মাঝে কাবা-য় একসঙ্গে পুজা করতেও যেতেন। এই অনুগামীদের প্রায় সবাই-ই ছিলেন মক্কার ধনী ব্যবসায়ীদের ছেলে বা ভাই। কিন্তু মহাম্মদের শোনা ও প্রচার করা ঐ দৈববাণীগুলো ছিল আসলে সামাজিক নানা সংস্কারমূলক আচরণবিধি। মক্কার ধনী ব্যবসায়ীদের ব্যবহার ও প্রচলিত মানসিকতার সমালোচনায় প্রায়শই এগুলি মুখর ছিল। আত্মকেন্দ্রিক ব্যবসায়িক মানসিকতার বিরুদ্ধে মহম্মদের কথাবার্তা ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে দেখে ধনী গোষ্ঠী মহম্মদের সামনে নানাবিধ প্রলোভন হাজির করতে থাকে, যেমন ব্যবসায় অংশীদার করা, সবচেয়ে ধনী পরিবারের মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া ইত্যাদি। এধরনের বহু বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন তিনি। বিশেষ করে কোরাইশ গোষ্ঠীর লোকেরা কাবা-র পূজা থেকে বিপুল আয় করত। তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। তার প্রধান কারণ, মহম্মদ বলতে থাকেন, একমাত্র নিরাকার আল্লা-তেই বিশ্বাস করতে হবে, অন্য দেবদেবী সব মিথ্যা। তিনি বলেন যারা এই আল্লায় অত্মসমর্পিত তারা সব সমান, ভাই-ভাই; তারা মুসলিম, আর তিনি নিজে এই আল্লা-র প্রেরিত দূত (রসুল)। তিনি ও তার বন্ধুরা কাবা-কে আক্রমণ না করলেও, অন্যান্য মূর্তিগুলির উপর আক্রমণ চালান।

মক্কার বিরক্ত সন্ত্রস্ত ধনী ব্যবসায়ীরা মহম্মদের উপর নানাভাবে ব্যবসায়িক চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। ৬১৬ সালে আবু জাহল নামে একজন হাশিম গোষ্ঠীকে (কোরাইশদের এই অংশের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন মহম্মদ) একঘরে অর্থাৎ বয়কট করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। কিন্তু বছর তিনেকের মধ্যেই এই বয়কট আন্দোলনে ভাঁটা পড়ে যায় যারা এটি করছিল তারা সম্ভবত এক সময় বুঝতে পারছিল যে, এর দ্বারা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে।

৬১৯ সালে কাকা আবু তালিব (ইনি খাদিজারও সম্পর্কে কাকা ছিলেন) মারা যান; হাশিম গোষ্ঠীর নতুন প্রধান হন আবু লাহার। ইনি মক্কার ধনী ব্যবসায়ীদের কাছের লোক ছিলেন। এঁর যোগসাজসে হাশিম গোষ্ঠী মহম্মদকে আশ্রয় ও নিরাপত্তা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে মহম্মদ ও তাঁর অনুগামীরা যে কোনো সময় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা করতে থাকেন। তাঁরা পাশের শহর আত্‌-তাইফ-এ চলে যান। কিন্তু এখানে তাঁর মত গ্রহণ করার লোক পাওয়া গেল না। এই সময় মক্কার আরেক প্রতিযোগী গোষ্ঠীর কাছ থেকে নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়ে তাঁরা আবার মক্কায় ফিরে আসেন। ৬১৯ সালে স্ত্রী খাদিজাও মারা যান।

৬২০ সাল নাগাদ মহম্মদ দূরের শহর মদিনার লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে থাকেন। ৬২১ সালে মদিনা থেকে ১২ জন ব্যক্তি কাবা-য় তীর্থ করতে এসে মহম্মদের সংস্পর্শে আসেন এবং মহম্মদের অনুগামী অর্থাৎ মুসলিম হন। ৬২২-এর জুন মাসেও দু’জন মহিলা সহ ৭৫ জন এভাবে এসে মুসলিম হয়ে যান। এঁরা মহম্মদকে নিজের আত্মীয়ের মতো রক্ষা করার অঙ্গীকার করেন (আল-আকাবা-র দুই অঙ্গীকার)। মদিনায় ছিল মরূদ্যান, ছিল কৃষিজীবী মানুষ, ছিল ইহুদি ও অন্যান্য নানা উপজাতি, গোষ্ঠী। এদের মধ্যে মারামারি লেগেই ছিল। ৬১৮ সালে এখানে রক্তক্ষয়ী ভয়াবহ যুদ্ধ ও হয়। এই অস্থির ও অর্থনৈতিক ভাবে চরম বৈষম্যমূলক সামাজিক পরিমণ্ডলে মহম্মদ বন্ধু আবু বকরকে নিয়ে ৬২২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর চলে আসেন। (এই বছরেরই প্রথম আরবী বাৎসরিক দিন অর্থাৎ ১৬ জুলাই থেকে ইসলামী বছর তথা হিজরা সন, Anno Hegirae, AH গণনা শুরু হয়।) প্রথম পাঁচ বছর তাঁর কর্তৃত্ব এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ইহুদিরাও তাঁকে নবী হিসেবে অস্বীকার করেন। তবে মদিনায় তাঁর অনুগামীরা তাঁকে জমিজায়গা দিয়েছিল। মহম্মদ এ জায়গায় একটি বাড়িও করেন (এই বাড়িটি পরে মদিনার বিখ্যাত মসজিদে রূপান্তরিত হয়েছে)। মদিনায় তাঁর প্রথম ১৮ মাস এভাবে একটু গুছিয়ে নিতেই কেটে গেছে। এরপর ধীরে ধীরে মহম্মদ তাঁর অনুগামীদের নিয়ে নিজের শক্তি ও ক্ষমতার প্রতিষ্ঠা করতে থাকেন। পরে কিছু ধনী ও প্রভাবশালী লোক এবং ভালো সংখ্যার দরিদ্র ও ক্রীতদাস (গোলাম) তাঁর ধর্মমত গ্রহণ পাঠক এক হও!

ঐ সময় মক্কার ব্যবসায়ীরা একসঙ্গে দল বেঁধে সিরিয়া সহ অন্যত্র ব্যবসা করতে যেতেন। সারিসারি উটের পিঠে পণ্য চাপিয়ে, মরুভূমির মধ্য দিয়ে তাঁরা পথ চলতেন—সঙ্গে থাকত অস্ত্রশস্ত্র, কারণ দস্যুদের আক্রমণ ছিল প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। তাদের মোকাবিলা করেই ব্যবসা চালাতে হতো। মদিনার সঙ্গে মক্কার অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ও সামাজিক শত্রুতাও ছিল। ৬২৩ সালের মধ্যে মহম্মদ নিজে এভাবে তিনবার হানা চালান, কিন্তু ব্যর্থ হন। অবশেষে ৬২৪-এর জানুয়ারিতে ইয়েমেন থেকে প্রত্যাগত একটি ব্যবসায়ী দলের উপর মহম্মদ স্বল্প সংখ্যক লোক নিয়ে আক্রমণ চালান এবং সফল হন। মক্কাবাসীরা মহম্মদের শক্তির আভাস পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন।

এ সময় মহম্মদ তাঁর কয়েকটি নীতির পরিবর্তনও করেন। যেমন, এর আগে ইহুদিদের মধ্যে নিজেকে ঈশ্বরের দূত হিসেবে গ্রহণীয় করার জন্য কিছু সুযোগ দেওয়ার কথা বলতেন। কিন্তু এবার ইহুদিদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হওয়ার আহ্বান জানালেন তিনি।

এদিকে ৬২৪ সালের মার্চেও মহম্মদ সিরিয়া থেকে প্রত্যাগমনকারী আরেক ব্যবসায়ীদলের উপর মাত্র ৩১৫ জন অনুগামী নিয়ে হানা দিয়ে সফল হন। মহম্মদ এই সাফল্যকে ঐশ্বরিক অনুগ্রহে সম্ভব হয়েছে বলে ব্যাখ্যা করেন। এটিই বদরের বিজয় নামে বিখ্যাত। ক্রমশই মহম্মদের সামরিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে এবং সবক্ষেত্রেই তিনি এসবকে আল্লার অনুগ্রহ তথা ইসলাম ধর্মানুসরণের যথার্থ ফল বলে বর্ণনা করেন। এধরনের আক্রমণের নাম দেওয়া হয় রাজ্জিয়া বা খাজাওয়াত।

কিন্তু মদিনাতেও কিছু মানুষ তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকে। স্থানীয় ইহুদিদের সঙ্গে মিলে আব্দ আল্লা ইব্‌ন উবেয়ী এ ধরনের একটি বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করেন। এ ধরনের নানা বিরুদ্ধাচরণের মোকাবিলার জন্য মহম্মদ নানা পদ্ধতি অবলম্বন করেন। এর একটি ছিল বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন। নিজে ঈশ্বরের প্রেরিত দূত বা রসুল হলেও, মুসলিম গোষ্ঠীর প্রধান হিসেবে অন্যজন মনোনীত হতেন— তাঁর উপাধি ছিল খলিফা। মহম্মদ প্রথম খলিফা (হজরত) আবু বকর-এর মেয়ে আইশাকে আগেই বিয়ে করেছিলেন (প্রথমা স্ত্রী খাদিজা-র মৃত্যুর পর)। এখন দ্বিতীয় খলিফা উমরের মেয়ে হাফসাহ-কেও বিয়ে করলেন। নিজের মেয়ে উম কুলথুম (বা উম্মে কুনসুম)-এর সঙ্গে বিয়ে দিলেন উসমান-এর (ইনি পরে তৃতীয় খলিফা হন) এবং আরেক মেয়ে ফাতিমা-র সঙ্গে (হজরত) আলী ইবান আবু তালিব-এর (চতুর্থ খলিফা)। পাশাপাশি আশেপাশের শত্রু স্থানীয় যাযাবর গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও রাজ্জিয়া পরিচালনা করে সফল হন ও তাদের বশীভূত করেন। এভাবে মহম্মদের প্রভাব ক্রমে বাড়তেই থাকে।

কিন্তু মক্কাবাসীরা বসে নেই। ৬২৫-এর ২১ মার্চ আবু সুফিয়ান-এর নেতৃত্বে ৩০০০ মানুষের এক বাহিনী মহম্মদের আশ্রয়স্থল মদিনার মরূদ্যান আক্রমণ করে। মহম্মদ ১০০০ অনুগামী নিয়ে শত্রুদের ডিঙিয়ে উহুদ পাহাড়ে চলে আসেন। কিন্তু এই যুদ্ধে মহম্মদ সম্পূর্ণ সাফল্য যাকে বলে তা অর্জন করতে পারেন নি—ফলে এই যুদ্ধকে আগের সাফল্যের মতো ঈশ্বরের অভিপ্রায় বা অনুগ্রহ না বলে, ভিন্নতর ব্যাখ্যার সাহায্যে অনুগামীদের মধ্যে বিশ্বাস অটুট রাখেন। আবু সুফিয়ান আবার আক্রমণ চালায়। মহম্মদ চারপাশে পরিখা খুঁড়ে দক্ষ সামরিক নেতৃত্ব দেন এবং এবারে সফল হন। এই সাফল্যের পর মহম্মদ অনায়াসে মক্কা আক্রমণ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তাঁর দূরদর্শিতার পরিচয় দেন এ ধরনের আক্রমণে না গিয়ে; তিনি মক্কাবাসীর স্বেচ্ছা আনুগত্যের জন্য অপেক্ষা করেন। পাশাপাশি তিনি এও বোঝেন, আরব গোষ্ঠীরা নিজেদের মধ্যেই রাজ্জিয়া চালাতে থাকে তবে তা নিজেদের শক্তিকেই ক্ষয় করবে।

ইতিমধ্যে মহম্মদ কুবেইজা-র ইহুদিদের আক্রমণ করে পরাজিত করেন। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী তথা কাফের হিসেবে অভিহিত করে, নতিস্বীকার করা সমস্ত পুরুষ ইহুদিদের নৃশংসভাবে হত্যা করেন এবং তাদের নারী ও শিশুদের ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেন।

পরে ৬২৮ সালে উৎসর্গ করার জন্য জীবজন্তুদের নিয়ে মহম্মদ মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কিন্তু অনুগামীর সংখ্যা আশানুরূপ হয় নি—ছিল মাত্র ১৬০০ জন। মক্কাবাসীরা তাঁকে বাধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, ফলে মহম্মদ মক্কায় না ঢুকে আল-হুদাইরিয়া শহরে অপেক্ষা করতে থাকেন এবং অবশেষে মক্কাবাসীদের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যে, ৬২৯ সাল থেকে মক্কার কাবায় তীর্থ করতে যাওয়া যাবে। এর কয়েক মাস পরে মহম্মদ খাইবার মরূদ্যানের ইহুদিদের আক্রমণ করে পরাজিত করেন এবং তাদের খেজুর উৎপাদনের অর্ধেক কর হিসেবে দিতে বাধ্য করেন।

মোটামুটি এই সময়ে মহম্মদ আবার দু’জনকে বিয়ে করেন—উস হাবিবা নামে ইথিওপিয়ায় মারা যাওয়া এক মুসলিমের বিধবাকে এবং মক্কায় তাঁর কাকা আল-আব্বাস-এর শ্যালিকা ময়মুনাহ্-কে।

এদিকে ৬২১ সালের নভেম্বর মাসে চুক্তি লঙ্ঘন করে মক্কা থেকে আবার আক্রমণ চালানো হলে মহম্মদ ১০,০০০ লোক নিয়ে মক্কা অভিযান করেন ৬৩০ সালের জানুয়ারি মাসে। মক্কাবাসীরা নতি স্বীকার করে এবং বহুজন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। মহম্মদ ১৫-২০ দিন মক্কায় থাকলেন। কাবা-র সমস্ত মূর্তি ধ্বংস করলেন এবং মক্কার শাসন সংক্রান্ত শৃঙ্খলাদি ফিরিয়ে আনলেন। ধনী মক্কাবাসীদের বাধ্য করলেন দরিদ্র মুসলিমদের জন্য অর্থদান করতে। এছাড়া বিভিন্ন যাযাবর গোষ্ঠীকেও পরাভূত করলেন।

এইভাবে সমগ্র আরব অঞ্চলে মহম্মদ সামরিকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেন। সমসাময়িক আরো কিছু ঘটনাও তাঁর এই প্রতিষ্ঠাকে সাহায্য করে। যেমন ৬২৭-৬২৮ সালে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য (খ্রীষ্টান) পারস্য সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে। ফলে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের ইয়েমেন ও অন্যান্য স্থানের যারা পারস্য সাম্রাজ্যের উপর নির্ভরশীল ছিল তারা মহম্মদের সাহায্যে নেয় ও আনুগত্য গ্রহণ করে। আবার ৬৩০ সালেই মহম্মদ তাঁর সর্ববৃহৎ রাজ্জিয়া চালান সিরিয়া সীমান্তে। ৩০ হাজার লোক নিয়ে তিনি সিরিয়া অধিকার করেন। সিরিয়ায় অনেক খ্রীস্টান ছিল। ফলে খ্রীস্টানদের সঙ্গে মহম্মদের প্রারম্ভিক সখ্যভাব শত্রুতায় পর্যবসিত হয়। ৬৩১ সালে আরবের অন্যান্য অঞ্চলের আরো বহু গোষ্ঠীর নেতাই দূত মারফৎ মহম্মদের আনুগত্য স্বীকার করেন। ইরাকেও তাঁর প্রভাব বিস্তৃত হয়।

এইভাবে নিজের সামরিক দক্ষতা এবং একই সঙ্গে অর্থনৈতিক- ব্যবসায়িক-সামাজিক স্বার্থের সঙ্গে জড়িত নতুনতর উদার ধর্মমতের সাহায্যে মহম্মদ বিশাল আরব অঞ্চলের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু এদিকে তাঁর শরীরও ভেঙে আসছে। ৬৩১ সালের মার্চ মাসে মহম্মদ মক্কায় তার জীবনের শেষ হজ (কাবা দর্শন) পালন করেন। এরপর ৬৩২ সালের ৮ জুন মদিনায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

মহম্মদের মৃত্যুর পরে, ৬৩৩ সালে আবার ক্ষমতার লড়াই শুরু হয় (ইয়ামাসাহ্-এর যুদ্ধ)। মহম্মদের প্রত্যক্ষ সহচরদের সংখ্য কমে যায়। এঁদের অনেকেই মহম্মদের প্রচারিত ‘বাণীগুলি’ মুখস্থ রেখেছিলেন। তখন মহম্মদের আরেক সঙ্গী জায়েদ ই-থাবিত কিছু কাগজে এই সব বাণী লিখে খলিফা উমরকে এবং উমরের মৃত্যুর পর তাঁর মেয়ে হাফসাহ্-কে দেন। কিন্তু বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ভাবে এই সব বাণী প্রচলিত ছিল। এ সব দেখে খলিফা উসমান (৬৪৪-৬৫৬ খ্রীঃ) জায়েদ ইবন্‌ -থাবিত সহ কয়েকজনকে দায়িত্ব দেন এইসব বাণী সংকলিত করে একটি চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার জন্য। হাফসাহ্-এর কাছ থেকে কাগজগুলি নিয়ে, বহু সাক্ষ্য গ্রহণ করে তাঁরা একসময় মহম্মদের ‘বাণী’ তথা ‘ঐশ্বরিক নির্দেশাবলী’ সংকলিত করেন। এই সংকলনই মুসলিমদের পবিত্র গ্রন্থ কোরআন শরিফ (এছাড়া আছে হাডিথ—যা মহম্মদের নিজস্ব কথাবার্তার সংকলিত রূপ)।

সামরিক শক্তির সঙ্গে আধ্যাত্মিক চিন্তা মিশিয়ে মহম্মদ যে-কাজ শুরু করেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর অতি দ্রুত তার বিস্তার ঘটতে থাকে। সামরিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক আধিপত্য এবং একই সঙ্গে অন্য ধর্মাবলম্বীদের নির্মূল করার কোরআন-অনুমোদিত স্বীকৃতি থাকার ফলে ইসলামী শাসকশ্রেণী তাদের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সাধারণ মুসলিমদের আনুগত্য সহজে পেতে থাকে। দুর্বার গতিতে ইসলাম ছড়িয়ে যায়। মহম্মদের মৃত্যুর ২০ বছরের মধ্যে বাইজন্টাইন ও পারস্য সাম্রাজ্য, লিবিয়া ও পারস্যের বিশাল এলাকা মুসলিম-অনুগত হয়, সৃষ্টি হয় বিশাল ইসলামী সাম্রাজ্য। পরবর্তী একশত বছরে এটি স্পেন থেকে ভারত তথা দক্ষিণ, পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।

ইসলাম ধর্মে মহম্মদকে শেষ নবী তথা রসুল হিসেবে স্বীকার করা এবং কোরআনকে অভ্রান্ত, অপরিবর্তনীয় হিসেবে বিশ্বাস হিসেবে বিশ্বাস করা—অতি অবশ্যভাবে পালনীয়। কিন্তু যে সামাজিক-অর্থনৈতিক তথা মানবিক কারণে মহম্মদের হাতে এই ধর্মের সৃষ্টি, সেই সব কারণে এই ধর্মেরও নানা বিভাজন হয়েছে, পরিমার্জনা করার চেষ্টা হয়েছে।

মহম্মদের মৃত্যুর পর মূলত ইমামতের বা নেতৃত্বের তথা ক্ষমতার লড়াই থেকে মুসলিমরা শিয়া ও সুন্নি—এই দুটি বড় ভাগে বিভক্ত হয়। শিয়ারা সংখ্যালঘু, তাঁরা (হজরত) আলী-র পূর্ববর্তী খলিফাদের খলিফা হিসেবে মানেন না। তাঁদের মতে মহম্মদের প্রকৃত উত্তরসূরী হলেন তাঁর কন্যা ফতিমা-র স্বামী, হাসান-হোসেনের বাবা এই (হজরত) আলী ইবান্-আবু তালিব-ই। বিষ প্রয়োগে হাসান-এর এবং কারবালার প্রান্তরে হোসেনের নৃশংস মৃত্যুর পর এই বিভাজন আরো তীব্র হয়। অন্যদিকে সংখ্যাগুরু সুন্নিরা মহম্মদের উত্তরসূরীকে নির্বাচনের মাধ্যমে ( elective) ঠিক করার পদ্ধতিকে সমর্থন করেন। (হজরত) আলী শিয়া গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা হলেও, এঁর এবং (হজরত) ফাতিমার বংশধরদের সমর্থকরা মহম্মদের সঙ্গে রক্ত সম্পর্ক বা আত্মীয়তা সূত্রে যুক্ত {hereditary) কাউকে নেতৃত্বে বসানোর “ ব্যাপারে আপোসহীন—-এঁদের মতে মুসলিমদের প্রধান হবেন ইমাম এবং তিনি হবেন কোন না কোন ভাবে মহম্মদের বংশধর। প্রকৃতপক্ষে পারস্য অঞ্চলের (ইরান) সামন্ত জমিদার ও কৃষক গোষ্ঠীরা ধর্মীয় বাতাবরণে শিয়া নাম নিয়ে আরব বিজেতাদের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত হয়। অর্থাৎ প্রথমে এই মতপার্থক্য ছিল মূলত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক তথা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। পরে তাতে ধর্মীয় কিছু কিছু দিকও যুক্ত করা হয়।

ইরানে শিয়ারা সুপ্রতিষ্ঠিত। এঁদের একাদশ ইমামের কথা অব্দি জানা যায় কিন্তু ১ম শতাব্দীতে দ্বাদশ ইমাম নাকি কোথাও আত্মগোপন করেছেন, এখনো করে আছেন এবং একদিন মাহুদি বা মুক্তিদাতা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার অপেক্ষায় আছেন। এই বিশ্বাস থেকে শিয়ার একটি উপবিভাগ সৃষ্টি হয় এবং এটি ইরানে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। শিয়ার অন্যান্য বিভাজনের মধ্যে রয়েছে ইসমাইল পন্থা (এর থেকে আগা খান), কারমাথিয়া, ইসমাইল পন্থার পরবর্তী বিভাজন আসাসিন ( Assassin—হাশিশ নামক ড্রাগটি এঁদের ধর্মানুষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ; বৈদিক যুগে যেমন ছিল সোমরস), লেবাননের ভুজ (Druze) (বর্তমানে ইজরায়েলের শতকরা ১.৬ মানুষ ভুজ) ইত্যাদি।

তৃতীয় খলিফার আমলে আরেক বিদ্রোহী ইসলামী গোষ্ঠী খাওয়াবিজের (বা খারেজীদের) জন্ম হয়। এরা ছিল উগ্র ধর্মান্ধ। পাশাপাশি ছিল ধর্ম-শিথিল মুরজিয়া। এ দু’য়ের প্রতিক্রিয়ায় ৮ম-৯ম শতাব্দীতে কিছু যুক্তিবোধসম্মত চিন্তাভাবনা নিয়ে ধর্মীয় তত্ত্বের সৃষ্টি হয় মুতাজিলাহ্ নামে।

এই মুতাজিলাহ্ চিন্তাবিদগণকে মুসলিম দর্শনের সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিবাদী তথা যুক্তিবাদী সম্প্রদায় হিসেবে গণ্য করা হয়। ওয়াসিল-বিন-আতা এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। ইনি ইমামের প্রচলিত ইসলামী ব্যাখ্যার বিরোধিতা করেন। ইমাম তাঁকে ‘ইতাজালা আন্না’ (সে আমাদের দল পরিত্যাগ করিয়াছে) নামে অভিহিত করেন। এর থেকেই ওয়াসিল-বিন-আতা প্রতিষ্ঠিত সম্প্রদায়ের নাম হয় মুতাজিলাহ্ (পরিত্যাগকারী)। ইসলামী শিক্ষা থেকে এদের সৃষ্টি হলেও পরে তাঁরা গ্রীক দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হন। এবং প্রচলিত ইসলামী চিন্তার অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের বিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন তাঁরা কোরআন-কে চিরন্তন বলে মনে করেন না, তাঁদের মতে একমাত্র আল্লাহ্-ই চিরন্তন—কোরআন তাঁর সৃষ্টি, অতএব কোরআন চিরন্তন হতে পারে না। এ ধরনের বক্তব্য কিন্তু গোঁড়া মুসলিমদের বিশ্বাস বিরোধী বক্তব্য। একইভাবে মুতাজিলাদের মতে ঈশ্বর বা খোদার সিকাত বা গুণাবলী (তাঁদের মতে ১৯টি) খোদার সত্ত্বা থেকে স্বতন্ত্র নয়— অভিন্ন। এঁরা মানুষের ইচ্ছার স্বাতন্ত্র ও কর্ম স্বাধীনতায় বিশ্বাসী এবং অদৃষ্টবাদকে (যেমন জাবারিয়াদের) এঁরা বর্জন করেন। এছাড়া এঁদের মতে ঈশ্বর বা খোদার দর্শন সম্ভব নয়। গোঁড়া মুসলমানেরা বিশ্বাস করেন যে, পরকালে বিশ্বাসীরা খোদার দর্শন পাবে এবং অবিশ্বাসীরা এই দর্শন থেকে বঞ্চিত হবে। কিন্তু মুতাজিলাদের মতে কোন কালেই খোদার দর্শন সম্ভব নয়- কারণ তাঁর কোন আকার নেই। অন্যদিকে কোরআনে পরকালে বিশ্বাসীদের জন্য খোদার দর্শনের কথা বলা হয়েছে। মুতাজিলাদের বক্তব্য— কোরআনে-র এই ওয়াদা রূপক অর্থে গ্রহণ করতে হবে, খোদার দর্শন সম্ভব হলে তা হবে আধ্যাত্মিক, জৈবিক নয়। এঁদের মতে খোদা কখনো অকল্যাণকর কিছু করতে পারেন না, অকল্যাণকর কিছু ঘটলে তা মানুষের কৃতকর্মের ফল। জগতের সৃষ্টি সম্পর্কে এঁরা কোরআনকে হুবহু গ্রহণ করেন না। কোরআনে বলা হয়েছে জগত এক বিশেষ মুহূর্তে সৃষ্টি হয়েছে, অ্যারিস্টটলের মতে জগত চিরন্তন। মুতাজিলারা বলেন, জগত সৃষ্টির আগেও জগতের অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু তা ছিল নিশ্চল নিস্তব্ধ অবস্থায়; খোদা এক সময় তাকে গতিশীল করেছেন। ইত্যাদি। পরবর্তীকালে মুতাজিলাহ্ চিন্তাবিদদের মধ্যে নাজ্জাম প্রমুখের নাম বিখ্যাত।

এছাড়া ইসলাম থেকে ইসমাইলপন্থী-বাহাইপন্থী এদেরও সৃষ্টি হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতের পাঞ্জাবে মীর্জা গোলাম আহমদ নামে একজন নিজেকে ঈশ্বরের দূত হিসেবে প্রচার করে ইসলামধর্মের কিছু পরিমার্জনা করেন এবং আহমদিয়া ধর্মমতের সৃষ্টি করেন। এঁরা ইসলাম, খ্রীস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ ইত্যাদি নানা ধর্মের মিলনের কথা বলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিমরা নিজেদের সামাজিক-অর্থনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে মিলিয়ে এলিজা মহম্মদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নেশান অব ইসলাম’। পরে এর নাম হয় ওয়ার্লড্ কম্যুনিটি অব ইসলাম এবং সাম্প্রতিকতম নাম আমেরিকান মুসলিম মিশন।

এছাড়া শিয়াগোষ্ঠী থেকে ১০ম শতাব্দীতে পারস্য (ইরান)-এ জন্ম হয়েছিল সুফি মতের—যাতে অতীন্দ্রিয়, রহস্যময় নানা কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। ভারতে ইসলামধর্মাবলম্বীরা প্রবেশের সময় এই সুফিরাও এদেশে আসেন। হিন্দুধর্মের ভক্তি আন্দোলন বা গুরুবাদের সঙ্গে এঁদের কথাবার্তা ও কাজ কর্মের স্পষ্ট মিল ছিল। ফলে এদেশে সুফিরা (এবং তাঁদের নেতৃস্থানীয় পীর বা শেখ) নিজেদের বিকাশের উপযুক্ত ক্ষেত্র খুঁজে পান; এঁদের অনুগামীরা ফকির, দরবেশ ইত্যাদি নামে অভিহিত। হিন্দুধর্মের তথাকথিত নানা গুরু, অবতার বা বাবাজিদের মত এঁরাও সম্মোহন ও আত্ম সম্মোহন ( hypnosis and autohypnosis)-এর নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে (যেমন, উদ্ভট রহস্যময় শব্দ করতে করতে নাচতে থাকা যতক্ষণ না আবিষ্ট অবস্থার সৃষ্টি হয় — কীৰ্ত্তন, নামগান ইত্যাদির অনুরূপ) এঁরাও ঐ কল্পিত পরম শক্তি তথা ঈশ্বরের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করেন; সাধারণ সরলবিশ্বাসী মানুষ এঁদেরও এসব কাণ্ড দেখে ভয়ে ভক্তিতে বিহ্বল হয়ে পড়েন।

এছাড়া ইসলাম ধর্মের সাম্যের কথাবার্তা (অর্থাৎ সব মানুষকে সমান ভাবা) এই সুফিরা যে আন্তরিকতার সঙ্গে বলেছেন ও বাস্তবে প্রয়োগ করেছেন, পরবর্তীকালের ইসলামের নেতৃস্থানীয়রা (উলেমা) ঐভাবে করেন নি। ফলে দরিদ্র কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষদের কাছে এই সুফিরা জনপ্রিয় ও গ্রহণীয় হন। অন্য দিকে সুফিদের কেউ কেউ প্রচলিত ইসলামধর্মের গোঁড়ামি ও অন্ধ আচারের প্রতিবাদী হিসেবেও তাঁদের চিন্তাভাবনার প্রসার ঘটান। তবে অধিকাংশই মানুষের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে জীবন যাপন করেন।

উলেমা অনেকটা হিন্দুদের পুরোহিত স্থানীয়–শাসক সুলতান বা বাদশার সহায়ক শক্তি। এই উলেমারা পাশাপাশি কোরআন তথা ধর্মের ঊর্দ্ধে ওঠার জন্য সুলতানের কোন প্রচেষ্টাকেও নিয়ন্ত্রণ করেন। কোরআনের শরিয়ত-এর ব্যাখ্যা এই উলেমারা করেন। স্বাভাবিকভাবেই শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থে, কখনো শুধু নিজেদের স্বার্থে, আবার কখনো উভয়েরই স্বার্থে সাধারণ মানুষের সামনে শরিয়তের নানা রকম ব্যাখ্যা দেওয়া হয়।

ইসলাম ধর্মে মানবিক দিকই প্রধান। এতে জটিল কোনো আচার পদ্ধতিও নেই। নেই অলৌকিক কাণ্ড কারখানাও। এছাড়াও একই ধর্মাবলম্বী সবাই ভাই-ভাই, সমান—একথাও বলা হয়। আবার অর্থনৈতিক বৈষম্যকে স্বীকারও করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে ধনী-দরিদ্রের বিভেদ ঈশ্বরেরই ইচ্ছায় ঘটে। ধর্মকে শাসকশ্রেণী ব্যবহার করেই এবং সাধারণ মানুষের সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে—ইসলামধর্মেও তা অনিবার্যভাবে প্রতিফলিত। দরিদ্রদের জন্য যে দান তথা জাকাত-এর কথা বলা হয়, তা যায় বাস্তবত মৌলবীদের হাতে। অসংখ্য মুসলিম দরিদ্র ও শোষিত অবস্থায় দিন কাটায়, মুষ্টিমেয় মুসলিম চরম বিলাসিতা ও প্রাচুর্যের নেশায় বিভোর। সবাই যে ইসলামের নানা নির্দেশ মানেন তাও নয়। যেমন মদ খাওয়া প্রথমের দিকে না হলেও, পরে মুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু মোগল সম্রাট থেকে হাল আমলের মহম্মদ আলি জিন্না সহ অন্যান্য অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বই মদ্যপানে অভ্যস্ত ছিলেন, আর ধনী-নির্ধন আরো বহু মদ্যপায়ী মুসলিমের উদাহরণ তো আছেই। প্রয়োজনে ধর্মাচরণে নানা পরিমার্জনাও করা হয়। যেমন, প্রস্রাব-পায়খানার পর জল দিয়ে ভালো করে জায়গাটা ধোওয়া মুসলিমদের পক্ষে অবশ্য পালনীয়—কিন্তু জল না পেলে ধুলো বা বালি দিয়েও করা যায়; নির্দিষ্ট একমাস ধরে উপবাস (রমজান)-এর কথা বলা হলেও অসুস্থ ব্যক্তি বা ভ্রমণরত ব্যক্তি অন্য কোনো সময়ও এ কাজ করতে পারে।

[অন্যতম জননেতা মহম্মদ আলি জিন্না প্রকৃতপক্ষে ইসলামী রীতি-নীতি ও আচারাদি পুরোপুরি অনুসরণও করতেন না। সরোজিনী নাইডু তাঁকে ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতীক’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। সদ্য আফ্রিকা ফেরৎ মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সম্বর্ধনাসভার তিনি সভাপতি ছিলেন। ঐ সভায় গান্ধী তাঁকে ‘ভারতীয় বন্ধু’ নয়, ‘মুসলিম গুজরাটি’ বলে অভিহিত করায় তিনি অপমানিত বোধ করেন। নাগপুর কংগ্রেসে সব মুসলিম প্রতিনিধি গান্ধীকে ‘মহাত্মা’ নামে সম্বোধন করেন, কিন্তু জিন্না নন। এর ফলে প্ৰধানতমুসলিম প্রতিনিধিরাই তাঁকে তীক্ষ্ণ বিদ্রূপে জর্জরিত করেন। জিন্না চলে আসেন এবং কংগ্রেসেও আর ফিরে আসেননি। জিন্নার স্ত্রী ছিলেন পার্সী। কথিত আছে জিন্না কোন দিন নামাজ পড়েন নি। মুসলিম প্রীতির চেয়ে গান্ধী বিরোধিতাই হয়তো তাঁর ইসলামী রাষ্ট্রের দাবির পেছনে বেশি কাজ করেছিল। (Ansar Harvani, Before Freedom and After, New Delhi, 1989)। একটি ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত জিন্নার প্রকৃত মূল্যায়ন যেমন করা দরকার, তেমনি ধর্ম কীভাবে বিশেষ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় তাও বোঝা দরকার।]

ইসলামধর্ম সৃষ্টির আগে আরব অঞ্চলে ইহুদি ও খ্রীষ্টধর্ম প্রচলিত ছিল। এই সব ধর্মের প্রচলিত নানা বিশ্বাস আচার-অনুষ্ঠান ইসলাম ধর্মেও অনুপ্রবেশ করেছে—স্থানীয় অঞ্চলের মানুষের মধ্যে প্রচলিত ধ্যান-ধারণা নতুন মতবাদে কিছুটা স্থান পায়ই। খ্রীস্টধর্মেও দেবদেবীর পূজা করা নিষেধ করা হয়। ৭-১০ বছর বয়সে মুসলিম ছেলেদের লিঙ্গমুণ্ড আবরণী ছেদের ধর্মানুষ্ঠান ইহুদিদেরও ছিল (তবে আরো কম বয়সে)। ইহুদিদের মতো মুসলিমদের কাছেও শূকরের মাংস নিষিদ্ধ, ঈশ্বরের ছবি আঁকাও নিষিদ্ধ।

ইহুদি ও খ্রীস্টান—যাদের নিজস্ব ধর্মগ্রন্থ ছিল, ইসলামের প্রারম্ভিক সময়ে তাঁদের কিছু মর্যাদা দেওয়া হতো। তাঁদের পরাজিত করা হলেও ধর্মীয় স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেওয়া ছিল এবং আল আলকিতাব (People of the Book) নামে অভিহিত করা হয়, তবে মোটা অর্থকর হিসেবে (জিজিয়া) দিতে হতো। আর মূর্তিপূজক অন্যান্য গোষ্ঠীকে মৃত্যু অথবা ইসলামে ধর্মান্তর গ্রহণের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হতো। কিন্তু আধিপত্য করা, একচেটিয়া ব্যবসা করা ও নতুন রাজ্য দখল করার যে-সব দিক ইসলামধর্মের জন্ম থেকেই তার সঙ্গে সম্পৃক্তভাবে মিশে আছে (অথবা এসবের উদ্দেশ্যেই এই ধর্মের ঐতিহাসিক সৃষ্টি), তার থেকে এই জিহাদ অপ্রাসঙ্গিক মোটেই নয়।

শুধুমাত্র নিজের ধর্মাবলম্বীদের তবু কিছুটা আপন ভাবা হয়—যদিও একই ধর্মাবম্বীদের মধ্যেও শাসক-শোষিত বা ধনীদরিদ্রের অস্তিত্বও ধর্মানুমোদিত। বলা হয়েছে “এবং তিনিই হাসাইয়া থাকেন ও কাঁদান, এবং তিনিই মারেন ও বাঁচান, ধনী গরীব করেন….।” অর্থাৎ ইসলাম ধর্মে সাম্যের কথা বলা হয়েছে বলে বল্লেও আসলে ঐ সাম্য ব্যাপারটির মধ্যে ফাঁকি যে আছে তা স্পষ্ট এবং হিন্দুদের মত সেখানেও এই বৈষম্য ঈশ্বরসৃষ্ট বলেই চালানো হয়েছে। শেষ বিচারের দিনের কথা বলা হয়, যেদিন ঈশ্বর অন্যায়কারীর বিচার করবেন। হিন্দুদের মতো পূর্বজন্ম বা কর্মফলের কথা না বললেও এই শেষ বিচারের বা স্বর্গ-নরকের বিশ্বাসে দরিদ্র, লাঞ্ছিত, অত্যাচারিত মুসলিমরা মানসিক সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করেন। “নিশ্চয়, নেক্কার মানুষেরা বেহেশতে সুখে নিয়ামতের মধ্যে থাকিবে এবং পাপীরা নিশ্চয়ই দোযখের মধ্যে থাকিবে।”

ইসলামে মেয়েদের সম্পত্তির ভাগ দেওয়া হয়েছে। তৎকালীন আরবে এক একজন ধনী ব্যক্তি অসংখ্য নারীর সঙ্গে ব্যভিচার চালাত। মহম্মদ শুধু চারটি বিয়ের কথা বলেন। (লক্ষণীয় প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি ও চারটিই বিয়ে করেন। তবে অনেকের মতে তিনি মোট ১৪ জন মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন।) তবে শর্ত—সবার সঙ্গে সমান ব্যবহার করতে হবে—যা বাস্তবত অসম্ভব। ইসলামে আত্মহত্যা করা ( এবং ফলশ্রুতিতে সতী হওয়া) অধার্মিক কাজ।

তৎকালীন পরিবেশ অনুযায়ী, কোরআনেও নারীদের ওপর পুরুষদের কর্তৃত্বের কথাই জোর দিয়ে বলা হয়েছে, সতীত্বের কথা বলা হয়েছে। ‘পুরুষের নারীর ওপর কর্তৃত্ব আছে, কেন না আল্লাহ তাহাদের একজনকে অপরের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন, এবং সেই হেতু যে, পুরুষ (তাহাদের জন্য) নিজের ধন ব্যয় করে। ফলে সাধ্বী নারীরা পুরুষের হুকুম মত চলিবে। এবং তাহাদের অনুপস্থিতেও আল্লাহর হেফাজতে (মান-ইজ্জত) রক্ষা করিবে। আর যে-নারীদের কু-স্বভাবের আশঙ্কা কর, তাহাদিগকে নসীহত কর; ( যদি না মানে) তাহাদের সহিত এক শয্যায় শয়ন বন্ধ কর, এবং (তাহাতেও যদি সংশোধন না হয়) তবে তাহাদিগকে প্রহার কর। কিন্তু যদি তাহারা তোমাদের কথা মানা করে, তবে তাহাদের ওপর অত্যাচারের বাহানা খুঁজিও না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ শ্রেষ্ঠ ও মহান।’ অর্থাৎ নারীরা যেন পুরুষদের গৃহপালিত পশু বিশেষ! এবং এই মানসিকতা থেকেই হয়তো নারীদের প্রতি করুণা করা, সম্ভ্রম দেখানো, সম্পত্তির ভাগ দেওয়া এসবের কথাও বলা হয়েছে। (স্মরণ করা যেতে পারে যে, বৃহদারণ্যক উপনিষদে যাজ্ঞবন্ধ্য-ও অনিচ্ছুক স্ত্রী-কে প্রহার করে যৌনমিলনে বাধ্য করার ‘হিতোপদেশ’ দিয়েছেন।)

কোরআনের নানা নির্দেশের নানা ধরনের ব্যাখ্যাও করা হয়। এখনকার সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তার অনেক কিছুই স্বাভাবিকভাবে তাদের প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে (যেমন মহম্মদের সময়েই ইহুদিদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও মদ্যপান সহ কিছু কিছু সংযোজন-পরিমার্জনার প্রয়োজন হয়েছিল)

আগেই বলা হয়েছে, এই ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের অনেক আচার-অনুষ্ঠানই ইসলাম ধর্মে তথা কোরআন শরিফে স্থান পেয়েছে। ইসলামের পূর্বসূরী ইহুদিধর্ম (Judaism)-এ বেশ কিছু বিধিনিষেধ সংশ্লিষ্ট ছিল। যেমন, শুয়োর, উট, খরগোস ইত্যাদির মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। যাযাবর ইহুদিদের শত্রু- স্থানীয়রা (কৃষিজীবী) শুয়োর পুষত। শুয়োর যেহেতু শত্রুদের গৃহপালিত জন্তু তাই তাকে ঘৃণ্য বা অখাদ্য হিসেবে প্রচার করা হয়েছিল। উট ছিল খুবই উপকারী প্রাণী—যা মরুবাসীদের অর্থনৈতিক ও দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য ছিল। রক্তযুক্ত প্রাণীমাংস খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল, কারণ রক্তকে ভাবা হত দেহের আত্মা। লিঙ্গ মুণ্ডচ্ছেদ (circumcision)-এর নিয়মও ইহুদিদের মধ্যে চালু ছিল। এমনি ধরনের নানা স্থানীয় ইহুদি আচারের কিছু কিছুকে আর এড়ানো যায় নি —সেগুলি মুসলিমদেরও আচারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু (হজরত) মহম্মদের নেতৃত্বাধীন মুসলিমদের কাছে ক্ষমতার প্রশ্নে ইহুদিরা ছিল শত্রুস্থানীয়। তাই একসময় স্থানীয় এই প্রতিদ্বন্দ্বীগোষ্ঠী সম্পর্কে শত্রুতামূলক নির্দেশ কোরআন শরিফে অনুপ্রবেশ করেছে যেমন, “হে ইমানদারগণ! তোমরা ইহুদী ও খ্রীস্টানদিগকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করিও না; তাহারা পরস্পরের বন্ধু এবং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি তাহাদিগকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করে, সে তাহাদেরই একজন হইয়া যায়।…”, “নিশ্চয়, আমি কাফিরদের জন্য শিকল গলার বেড়ী ও জ্বলন্ত আগুন প্রস্তুত রাখিয়াছি” ইত্যাদি ইত্যাদি।

‘পবিত্র কোরআনে’র এই সব নির্দেশ গত দেড়হাজার বছর ধরে কিছু মানুষ অনুসরণ করছেন। এর সৃষ্টির সামরিক ও অর্থনৈতিক চরিত্র ছিল প্রকট। অন্যদিকে ইসলামের মধ্য দিয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত যাযাবর মানুষদের, শহরের মানুষ ও ব্যবসায়ীদের —সবার স্বার্থই কমবেশি দেখা হয়েছে। আবার অনেকের মতে এটি মূলত ছিল শহরের অভিজাত ও ধনীদের বিরুদ্ধে যাযাবর বেদুইনদের ক্ষমতা ও জায়গা দখলের লড়াই। ভিন্ন মতে, মহম্মদের সামাজিক ভিত্তি ছিল মদিনার দরিদ্র কৃষিজীবী মানুষরা—পরে বেদুইনরা তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়ে আন্দোলনের নির্ধারক ভূমিকা গ্রহণ করে। কোনো কোনো ঐতিহাসিক গবেষক, ইসলাম ধর্মের মধ্যে মক্কার ধনী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের আন্দোলনের অস্তিত্ব লক্ষ্য করেছেন। এঙ্গেলস-এর মতে, ইসলামধর্ম একদিকে শহরবাসী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, অন্যদিকে যাযাবর বেদুইন গোষ্ঠী—উভয়েরই স্বার্থবাহী ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *