ইহুদি ধর্ম

ইহুদি ধর্ম

প্রস্তর যুগের ধারাবাহিকতায় পৃথিবীর নানা অঞ্চলের মানুষ নিজেদের পরিবেশ-পরিস্থিতির আর কল্পনার বৈচিত্র্য অনুযায়ী বিভিন্ন নামের ও বিভিন্ন ধরনের দেবদেবীর কল্পনা ও আরাধনা করেছে। যত দিন গেছে, ততই এ ধরনের দেবদেবীর সংখ্যা বেড়েছে—একই সঙ্গে বেড়েছে তাদের ঘিরে ধর্মীয় গোষ্ঠীর সংখ্যা এবং গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে দ্বন্দ্ব। কিন্তু যখন শাসকগোষ্ঠী সামাজিক প্রয়োজন হিসেবে অবশ্যম্ভাবীরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখন এরা দেখেছে বিপুল সংখ্যক মানুষকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে শাসন করার ক্ষেত্রে এই তথাকথিত ধর্মীয় গোষ্ঠীভেদ অসুবিধার সৃষ্টি করে। একই সঙ্গে মানুষে মানুষে হানাহানি বন্ধ করার উদ্দেশ্যও নিশ্চয়ই ছিল। সব মিলিয়ে প্রয়োজন হয় সামাজিক ও ঐতিহাসিকভাবে একেশ্বরবাদ সৃষ্টির। এর ফলে একটিমাত্র কল্পিত উপাস্যের আধ্যাত্মিক বলয়ের মধ্যে বিপুলতর সংখ্যক মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা যায় তথা শাসন করা যায়। ইসলাম ধর্ম এই একেশ্বরবাদ তথা নিরাকার ঈশ্বরের ধারণা সম্পৃক্তভাবে মিশে আছে। কিন্তু তার আগে সৃষ্টি হওয়া ইহুদি ধর্ম এক্ষেত্রে পূর্বসুরি।

খ্রীস্টপূর্ব দুই থেকে দেড় হাজার বছর সময়কালে আরবের উত্তরে ইজরায়েল অঞ্চলে ইহুদি ধর্মের (Judaism) সূচনা হয়। শুরুতে অবশ্য একেশ্বরবাদের চিন্তা প্রতিষ্ঠিত হয় নি। গাছপালা, পাহাড় পাথর, ঝর্ণা, এমনকি পাথরের থাম, এসবেরও পূজা করা হতো। এরপর ধীরে ধীরে ইহুদিদের দেবতা ইয়াহুয়া (Yahweh)-এর কল্পনা পল্লবিত হয়। (আগে ভুলভাবে একে জিহোবা বা Jehovah নামে অভিহিত করা হতো।)

ইজরায়েল, প্যালেস্টাইন তথা আরব অঞ্চলে নানা রাজ্য ও শাসকগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়, তাদের মধ্যে ক্ষমতা ও রাজ্য দখলের লড়াই চলে। অবিশ্রান্ত রক্তপাতের ঐ পরিবেশে ইয়াহুয়া-ও ইজরায়েলের তথা ইহুদিদের সামরিক শক্তির অধিষ্ঠাতা দেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহুদিদের নানা ধর্মীয় অনুশাসনের স্রষ্টা হিসেবে পরিচিত মোজেস, এর দেখা পান বলে কথিত আছে। মিশরের সীমান্ত এলাকায় সিনাই অঞ্চলে হোরেব পাহাড়ে এই দর্শন ঘটে বলে বলা হয়। ইয়াহুয়ার কল্পনাও সম্ভবত এসেছে এই এলাকার আদিবাসীদের কাছ থেকে। পরবর্তীকালে ইজরায়েলের যাযাবর ইহুদিরা প্যালেস্টাইনের কৃষি অঞ্চল দখল করা শুরু করে, -এই সময়েই ইয়াহুয়াকে যুদ্ধের দেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা শুরু হয়। ধারণা করা হয়,-এর উদ্দেশ্য ছিল দেবতা তথা ধর্মবিশ্বাসের নাম করে মানুষের মধ্যে নিজ গোষ্ঠীর স্বার্থে অন্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রতি স্বাভাবিক আগ্রহ সৃষ্টি করা তথা অন্যদের হত্যা করে, তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করাকে নীতিবিরুদ্ধ নয়, বরং ঈশ্বরের অভিপ্রায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। খ্রীষ্টপূর্ব দশম শতাব্দীতে রাজা সলোমন জেরুজালেমে ইয়াহুয়ার বিশাল মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ৫৮৬ খ্রীস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনের রাজা জেরুজালেম অধিকার করে নেন। ৫৩৮ খ্রীস্টপূর্বাব্দে পার্সিয়ার সাইরাসের অধীনে র‍্যাবিলনের দাসত্ব থেকে ইহুদিদের মুক্তি ঘটে এবং জেরুজালেমের মন্দির পুনগঠন করা হয়। আর এই সময় কালেই ইহুদিধর্ম তার চূড়ান্ত রূপ পায় এবং কঠোরভাবে একেশ্বরবাদ অনুসরণের কথা বলা হয়, ধর্মগ্রন্থগুলিকে সুসংহত, চূড়ান্ত রূপ দিয়ে তাকে প্রামাণ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয় (Canonisation )।

জুড়িয়ার রাজা জোসিয়া (খ্রী. পূ. ৬২১) সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ইহুদিধর্মের অনুশাসনগুলিকে সুনির্দিষ্ট করেছিলেন। আসিরিয়া, মিশর ও ব্যাবিলনের দ্বারা ইহুদিদের মাতৃভূমি ইজরায়েল আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনার সময় ইহুদিদের ঐক্যবদ্ধ, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও নৈতিকভাবে সাহসী করে তোলার উদ্দেশ্যে এই সময়েই মোজেস-এর পঞ্চম বই (Fifth Book) তথা ডয়টেরনমি (Deuteronomy) লেখা হয়। এতে দাসত্ব ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে আইন, ইহুদিধর্মের আনুষ্ঠানিক নিয়মগুলি ও আইনগত অন্যান্য নানা বিষয় রয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক কেন্দ্রিকতা স্থাপন। জোসিয়া জেরুজালেমের মন্দির থেকে অন্য দেবদেবীর মূর্তি ধ্বংস করেন, একমাত্র ইয়াহুয়ার আরাধনার কথা বলেন।

বাইবেল কথাটির অর্থ ‘বই’। ইহুদিদের এ-সব ‘বই’কে তিনভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমভাগে রয়েছে নিয়মকানুনের ও নির্দেশাবলীর কথা। জেনেসিস (ঈশ্বর কীভাবে পৃথিবী, মানুষ ইত্যাদি সৃষ্টি করেছে তার গল্প, নোয়ার কথা রয়েছে এতে), এক্সোডাস (মোজেস-এর জীবনী, বিখ্যাত টেন কম্যান্ডমেন্টস ও অন্যান্য ধর্মীয় নির্দেশ এবং মিশরীয়দের অধীনতা থেকে হিব্রুদের তথা ইহুদিদের মুক্তির কথা রয়েছে এতে), লেভিটিকাস (ধর্মীয় আইন), নাম্বারস (মিশর থেকে চলে আসার পরেরকার ইতিহাস ও বিধিনেষেধ আছে এতে), ডয়টেরনমি (ধর্মীয় আইন) এবং জোশুয়ার বই, Book of Joshua (Nun-এর ছেলে জোশুয়ার নেতৃত্বে ইহুদিরা কিভাবে প্যালেস্টাইন তথা Land of Canaan অধিকার করল তার কথা রয়েছে এতে), -এই সবগুলি এই প্রথম ভাগটির অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে ঐতিহাসিক বই,—জাজেস, রুথ, স্যামুয়েল, প্যারালিপোমেনন (ক্রনিক্‌ল্স), এজরা, নেহেমিয়া, এস্থার জোব, রাজা ডেভিড ও সলোমন ইত্যাদির বই। তৃতীয় ভাগে আছে তথাকথিত ঈশ্বরের দূতেদের বই,-ইসাইয়া, জেরেমিয়া, এজেকিয়েল, ডানিয়েল এবং আরো বারোজন ছোট ছোট দেব-দূতের বই। এ সবগুলিই ইহুদিধর্মের সৃষ্টির নানা পর্যায়ে লেখা হয়েছে। পরবর্তীকালে সৃষ্টি হওয়া খ্রীস্টধর্মালম্বীরা বাইবেলের এসব বইকে একত্রে ওল্ড টেস্টামেন্ট হিসেবে অভিহিত করেন। খ্রীস্টানদের ধর্মগ্রন্থ হচ্ছে নিউ টেস্টামেন্ট, ইহুদিরা একে স্বীকার করেন না।

বর্তমানে পৃথিবীর মাত্র ০.৩ ভাগ মানুষ ইহুদি ধর্মাবলম্বী এবং কম-বেশি সংখ্যায় এঁরা ছড়িয়ে আছেন ১৩৪টি দেশে। কিন্তু যখন খ্রীস্টধর্ম বা ইসলাম কোনোটিরই সৃষ্টি হয় নি, তখন এই ইহুদিধর্মই ছিল ব্যাপক একটি ধর্মবিশ্বাস এবং এর থেকেই বর্তমানে পৃথিবীর বৃহত্তম এই দু’টি ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে বলা যায়; ওল্ড টেস্টামেটের বহু তত্ত্ব, ধর্মীয় আচার, ঘটনা বা কল্পনা খ্রীস্টধর্ম ও ইসলাম ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সামাজিক নানা পরিবর্তনের সঙ্গে কীভাবে মানুষের তৈরী করা ধর্মবিশ্বাস পরিবর্তিত রূপান্তরিত হয় তার একটি বড় উদাহরণ ইহুদিধর্ম। এবং এর সঙ্গে যুক্ত খ্রীস্টধর্ম সৃষ্টির উদাহরণটিও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *