খ্রীস্ট ধর্ম

খ্রীস্টধর্ম

বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যার বিচারে বর্তমানে পৃথিবীর বৃহত্তম ধর্ম হচ্ছে খ্রীস্টধর্ম। অবশ্য হিন্দু-ইসলাম ইত্যাদি সব ধর্মের মতোই এই ধর্মাবলম্বীরাও নানা সময়ে নানাভাবে বিভক্ত হয়েছে, সামাজিক-অর্থনৈতিক-আধ্যাত্মিক স্বার্থের বিভিন্নতার কারণে। খ্রীস্টধর্ম সৃষ্টির ক্ষেত্রে মতাদর্শগতভাবে যেমন ইহুদিধর্ম তথা ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রভাব ছিল, তেমনি রাজনৈতিকভাবে রোমান সাম্রাজ্যের সৃষ্টি একটি নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে। ইউরোপ-এশিয়া-আফ্রিকার বিশাল অঞ্চলে পরিব্যাপ্ত রোম সাম্রাজ্যে বিপুল সংখ্যক মানুষ দাস হিসেবে, এবং বিপুলতর সংখ্যার মানুষ দাস না হয়েও নিপীড়িত জীবন কাটাতে বাধ্য হতো। এদের একাধিক বিদ্রোহ অত্যাচারী রোম সম্রাট ও তার অনুগত মুষ্টিমেয় আমলাদের দ্বারা নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়েছে।

এই সময় বিপুলতর সংখ্যার সাধারণ মানুষের কাছে এমন একটি ধর্মমতের প্রয়োজন হয়, যেটি তাদের এই অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম চালাতে সাহসী করে তুলবে। দৃঢ়মূল ঈশ্বরবিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের এমন একটি তত্ত্বের প্রয়োজন হয়, যেটি নিপীড়িত মানুষকে একটি উদার ছত্রছায়ায় ঐক্যবদ্ধ করবে। রোমান শাসকদের পক্ষ থেকেও চেষ্টা করা হয়েছিল, -রোম শহরের দেবতা রোমা (Roma ) ও জুপিটার (Jupiter Capitolius)-এর আরাধনার কথা বলা হয় এবং সবাইকে তা মানতে বাধ্য করার চেষ্টা করা হয়। রোমান সৈন্যদের মধ্যে পারস্য (ইরান)-এর মিথ্রা মতবাদও প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এদের কোনোটিই বিপুল সংখ্যক নিপীড়িত মানুষের সামনে মুক্তির আশ্বাস নিয়ে আসে নি। এবং এমনই পরিস্থিতিতে খ্রীস্টধর্মের সৃষ্টি।

খ্রীস্টধর্ম (Christianity) কথাটি এই প্রচলিত অর্থে প্রথম ব্যবহার করেন অ্যন্টিওক-এর বিশপ ইগনাটিয়াস (মৃত্যু : ১১০ খ্রীষ্টাব্দে) তাঁর ‘লেটার টু দি ম্যাগনেসিয়ানস’-এ। (খ্রীস্টপূর্ব-খ্রীস্টাব্দ জাতীয় কথাগুলি অবশ্য ঐ সময় এমনভাবে ব্যবহার করা হতো না। ইয়োরোপের মধ্যযুগে এ ধরনের শব্দের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়।)

এই ধর্মের প্রবর্তক হিসেবে নাজারেথ-এর যীশু (Jesus of Nazareth )—এর কথা বলা হয়। কিন্তু গীর্জা ও যাজকরা যীশুর জীবনকে ঘিরে এমন একটা আধ্যাত্মিক ধোঁয়াশার সৃষ্টি করেছে যে, তাঁর সত্যিকারের জীবন ইতিহাস জানা দুঃসাধ্য। তবু মোটামুটি বলা যায়, তিনি খ্রীস্টপূর্ব ৬ সালে জুডিয়াতে জন্মান ও ৩০ খ্রীস্টাব্দে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা যান। ম্যাথিউ ও লিউক-এর দেওয়া বর্ণনায় অবশ্য সামান্য অন্যরকম তথ্য পাওয়া যায়।

খ্রীস্টানদের যীশু-র জন্মের অনেক আগে থেকেই প্যালেস্টাইনে যীশু নামে এক দেবতার (God Jesus) কথা বলা হতো। অনেকের মতে এটিই পরে কল্পনায় বিশেষ মানুষ সম্পর্কে আরোপিত হয়। খ্রীস্টধর্মের প্রচারক হিসেবে পরিচিত যীশু নামে আদৌ কেউ ছিলেন কিনা, এ-ব্যাপারে তাই সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। এ সন্দেহ আরো বাড়ে যখন দেখা যায়, কুমারী মেয়ে মেরি-র সঙ্গে ঐশ্বরিক মিলনের ফলে তাঁর জন্ম হয়েছে বলে বলা হয়। এ-ধরনের আধ্যাত্মিক কল্পনা অবশ্য খ্রীস্টানদের মধ্যেই নয়, টোটেমপন্থী নানা আদিম মনুষ্যগোষ্ঠীর মধ্যেই এর সৃষ্টি, পরবর্তীকালে নানা ধর্মে এর প্রতিফলন ঘটেছে,—যেমন তথাকথিত হিন্দুদের অপূর্ব গল্প রামায়ণ-মহাভারতে এ ধরনের ঐশ্বরিক ঔরসে সন্তানলাভের কথা আকছারই বলা হয়েছে। তবে যে-ইহুদিধর্ম (Judaism) খ্রীস্টধর্ম সৃষ্টির অন্যতম ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছে, তাতে কিন্তু এ-ধরনের ঘটনা অস্বীকৃত। তাই খ্রীস্টধর্মের তথাকথিত ধর্ম-পুস্তকগুলিতে যে-সব গল্প-গাথা সন্নিবিষ্ট হয়েছে, তাদের মধ্যে প্রাচ্যের কিছু প্রতিফলনও লক্ষ্য করা যায়। খ্রীস্ট (Christ) কথাটি ইহুদি শব্দ মেসায়া অর্থাৎ পরিত্রাতার গ্রীক অনুবাদ। ইহুদিদের কাছে মেসায়া ভবিষ্যতে আবির্ভূত হবেন। খ্রীস্টানদের কাছে যীশু-ই এই পরিত্রাতা অর্থাৎ খ্রীষ্ট।

যীশু সম্পর্কে প্রচলিত নানা গল্প-গাথায় অনেক সময় মতানৈক্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন সেন্ট ম্যাথ্যু ও সেন্ট লিউক উভয়েই তাঁদের মঙ্গলবার্তায় (Gospel) যীশুকে রাজা ডেভিডের বংশধর বলেছেন। কিন্তু সেন্ট ম্যাথ্যুর মতে তিনি রাজার ২৮ তম বংশধর, অন্যের মতে ৪২ তম। সেন্ট ম্যাথ্যুর মতে যীশুর ঠাকুরদার নাম জেকব, সেন্ট লিউকের মতে এলিজা। সেন্ট ম্যাথ্যু বলেছেন, যীশুর মা ও বাবা (অর্থাৎ জাগতিক বাবা) জুড়িয়ার শহর বেথলহেম-এ থাকতেন; রাজা হেরড সব নবজাতক শিশুকে হত্যার আদেশ দিলে, যীশু জন্মানোর পর তাঁরা মিশরে পালিয়ে আসেন; হেরড মারা গেলে তাঁরা সপরিবারে গ্যালিলিয়ার শহর নাজারেথ এ চলে আসেন। অন্যদিকে সেন্ট লিউক বলেছেন, যীশুর বাড়ির লোকজন বরাবরই নাজারেথ-এ থাকতেন, শুধু যীশু যখন জন্মান তখন বেথলহেম-এ ছিলেন; তারপর তাঁরা আবার নাজারেথ-এ ফিরে আসেন।

হিন্দুধর্ম সহ অন্যান্য প্রায় সব ধর্মের মতো (অন্যতম কিছু ব্যতিক্রম ইসলাম ও মহম্মদের জীবন) খ্রীস্টধর্মেও যীশুর জীবনকে ঘিরে নানা অলৌকিক কাহিনী প্রচলিত আছে। গল্প হিসেবে এগুলি যেমন চিত্তাকর্ষক, তেমনি শিক্ষাপ্রদও বটে। তবু যীশুর হাতের ছোঁয়ায় দুরারোগ্য রোগ ভালো হয়ে গেল বা জন্মান্ধ দেখতে পেল, কিংবা যীশু জলের উপর হেঁটে গেলেন,—এগুলি স্পষ্টতই অবিশ্বাসীদের বিশ্বাস উৎপাদনের অন্যতম চিরাচরিত কৌশল মাত্র অথবা কাকতালীয় কিছু ঘটনার ধর্মীয় ব্যাখ্যার চেষ্টা।

খ্রীস্টধর্মের স্বীকৃত ধর্মগ্রন্থকে চারভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে রয়েছে সেন্ট ম্যাথ্যু, সেন্ট লিউক, সেন্ট মার্ক ও সেন্ট জ-এর লেখা চারটি গসপেল। এতে যীশুর জীবন, মৃত্যু ও পুনরুজ্জীবনের কথা বলা হয়েছে। এদের মধ্যে সেন্ট জন-এর গস্পেলটির সঙ্গে অন্য তিনটির আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে। দ্বিতীয়ভাগে রয়েছে খ্রীস্টধর্মে প্রথম ধর্মান্তরিত ব্যক্তিদের কথা (proselytisers)। তৃতীয়ভাগে রয়েছে তথাকথিত ঈশ্বরের দূতেদের লেখা (epistles of apostles)। চতুর্থটি হচ্ছে সেন্ট জন-এর দি রিভিলেশন। এই সবগুলিকেই একত্রে নিউ টেস্টামেন্ট বলা হয়।

বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন সময়ে এগুলি লিখেছেন। যীশু নামে সত্যিই কেউ থেকে থাকলে তাঁর মৃত্যুর পর এগুলি লেখা, -দ্বিতীয় শতাব্দীর আগে নয়। তার আগে মৌখিকভাবে এগুলি চালু ছিল। আর এ-সবের লেখকরা বেশ কিছু ক্ষেত্রেই ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক তথ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না। যেমন প্যালেস্টাইনের শুয়োরের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু ইহুদিরা অপবিত্র ভেবে শুয়োর পুষতই না। আবার সর্ষে গাছকে ডালপালাওয়ালা বিশাল গাছ হিসেবে বলা হয়েছে, যা হাস্যকর। রাজা হেরড ও সিরিয়ার শাসক কুইরিনিয়াস-এর সময়কালকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে, অথচ এঁদের সময়ের ব্যবধান ছিল প্রায় এক হাজার বছর। লেখাগুলির অধিকাংশই যে কল্পনাশ্রয়ী ছিল ও বিভিন্ন সময়ে প্রক্ষিপ্ত হয়েছিল তাও এ থেকে বোঝা যায়।

যাই হোক সব মিলিয়ে এটিই প্রচলিত যে, যীশু নিপীড়িত মানুষ ও দাসেদের সামনে একটি নতুন মানবতাবাদী মতাদর্শ প্রচার করেন। তাঁর অনুগামীদের প্রথমে নাজারিন নামে অভিহিত করা হতো। শুরুতে বিরুদ্ধ- বাদীরা ব্যঙ্গার্থে বা গালাগাল করার উদ্দেশ্যে তাঁদের খ্রীস্টান বলতেন। দ্বিতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝির পর থেকে এই নতুন ধর্মমতে বিশ্বাসীরা নিজেরাই নিজেদের খ্রীস্টান বলে অভিহিত করতে থাকেন।

যীশুর আগে ব্যাপটিস্ট জন প্রকৃতপক্ষে খ্রীস্টধর্মের নীতিমালার প্রচার করেন, এবং যীশুকে ব্যাপটাইজ করেন। ‘পবিত্র’ নামে চিহ্নিত জল গায়ে ছিটিয়ে এই ধর্মানুষ্ঠান ইহুদিদের মধ্যেই প্রচলিত ছিল। পরে খ্রীস্টধর্মে অনুপ্রবেশ করে। জন ঈশ্বরের রাজ্যের কথা, পাপের জন্য অনুতাপ করার কথা ইত্যাদি বলেছিলেন। কিন্তু এই ঈশ্বরের রাজ্য জাতীয় কথাবার্তা স্পষ্টতই রাজা তথা শাসককুলের পছন্দসই ছিল না। জন বন্দী হন। এবং যীশু তাঁর আরব্ধ কাজ কাঁধে তুলে নেন।

যীশু সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে, তাদের সুখ-দুঃখের ভাগীদার হয়ে ঈশ্বরের কথা বলতে থাকেন। সমাজের তথাকথিত উচ্চ-নীচ ভেদ না করে, তিনি সবাইকে ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে অভিহিত করেন এবং খুব সহজ সরল ভাষায় নীতিমালা শিক্ষা দিতে থাকেন। নিজের প্রতিনিধি হিসেবে সাধারণ মানুষদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে বেছে নন, যেমন, অ্যান্ড্রু, পিটার, জেমস ও জন ছিলেন জেলে, ম্যাথ্যু ছিলেন ট্যাক্স কালেক্টার ইত্যাদি। প্রথমে তিনি গ্যালিলির সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে তাঁর মতাদর্শ প্রচার করেন। তারপর জেরুজালেমে যান (পাসওভার)। এখানেই রোমান আইন অনুসারে তাঁকে রাজদ্রোহী হিসেবে গণ্য করা হয় এবং ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়। মার্ক ও লিউকের মতে, এর আগে বিচারের সময় যীশু নিজেকে মেসায়া বা খ্রীস্ট বলে দাবি করেন। তাই তাঁর ওপর মৃত্যুদন্ড নেমে আসে। তাঁর জীবনের ঐতিহাসিক নানা তথ্যে ভক্তদের বিবরণে গরমিল থাকলেও তিনি যে শুক্রবার মারা যান তা মোটামুটি সর্বজন স্বীকৃত এবং এ তারিখটি সম্ভবত ৭ এপ্রিল (৩০ খ্রীস্টাব্দ)।

খ্রীস্টধর্মাবলম্বীদের কাছে ক্রুশ চিহ্ন একটি পবিত্র জিনিস হিসেবে গণ্য করা হয়। অনেকের ধারণা যীশু যেহেতু ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা যান, তাই ক্রুশ সম্পর্কে এ রকম ধারণা জন্মেছে। কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য তা নয়। রোমানরা যে ক্রুশে বিদ্ধ করে মানুষ মারত সেটি ইংরেজি ‘টি’ (T) অক্ষরের মতো,—তার তিনটি বাহু। কিন্তু ‘পবিত্র’ ক্রশ-এর চারটি বাহু। এবং প্রকৃতপক্ষে খ্রীস্টধর্ম প্রচলিত হওয়ার আগে থেকেই প্রাচীন চীন, প্রাচীন ভারত, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকার অধিবাসীদের কাছে এ-জাতীয় চিহ্ন পবিত্র হিসাবে গণ্য হতো। ভারতীয় হিন্দু বা আর্যদের কাছে তার একটি রূপান্তরিত পর্যায় হচ্ছে স্বস্তিকা চিহ্ন। মিশর, ক্রীট ও অন্যান্য অঞ্চলের অতি প্রাচীন শিল্পকর্মের মধ্যেও পবিত্র বা ঐশ্বরিক হিসেবে ক্রশ-এর ছবি দেখতে পাওয়া যায়। এ ধরনের চিহ্ন কেন পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়েছে তা সুনিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল। তবে অনেক গবেষকের মত হলো, আগুন জ্বালানোর সময় কাঠের টুকরো আড়াআড়িভাবে রাখার পদ্ধতি থেকে এ ধরনের চিহ্নকে আগুনের প্রতীক ও পরে পবিত্রতা বা ঐশ্বরিক শক্তির প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। আবার অনেকের মত সূর্যের আলোকচ্ছটা দেখে এ চিহ্ন সৃষ্টি হয়েছে। কারো মতে এটি যৌনতা তথা উর্বরতার প্রতীক। উত্তর আমেরিকার রেড-ইন্ডিয়ানরা এরকম ক্রশ চিহ্নের চারটি প্রান্তকে পৃথিবীর চারদিক (পৃথিবীকে চতুষ্কোণ হিসেবেই কল্পনা করা হতো) বলে ভাবত ও পূজা করত। উৎস যাই হোক না কেন এবং কাঠ, লোহা, সোনা, রূপা ইত্যাদি যা দিয়েই বানানা হোক না কেন, ক্রশচিহ্ন শত-শত বছর ধরে নিছক মানুষেরই হাতে প্রতীকী তাৎপর্য্য পেয়েছে। তাকে আলাদাভাবে পবিত্র ভাবার মধ্যে ঐশ্বরিক কোনো ব্যাপার নেই। তথাকথিত খ্রীস্টধর্মালম্বীদের কবরখানার শুরুর দিকে এমন আবশ্যিকভাবে ক্রশ রাখাও হতো না,- বরং ভেড়ার ছানা, কাঁধে ভেড়া নিয়ে মেষপালক, মাছ ইত্যাদির ছবি বা মূর্তি রাখা হতো। পরবর্তীকালের কবরখানায় বিভিন্ন আকারের ক্রশ-এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু তখনো ক্রুশবিদ্ধ যীশুর ছবি আসে নি। কেবলমাত্র অষ্টম-নবম শতাব্দী থেকে এমন ক্রুশবিদ্ধ যীশুর ছবি ও মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়।

যাই হোক খ্রীস্টধর্ম শুরুর দিকে ইহুদি ও আদিবাসী অন্যান্য গোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাস দিয়ে প্রায় পরিপূর্ণ ছিল। কিন্তু খ্রীস্টধর্মের মৌলিক দিক হচ্ছে পাপ-এর ধারণা, এবং পাপ থেকে মুক্তি বা মোক্ষলাভের ধারণা ( salvation)। পাশাপাশি সবাইকে ঈশ্বরের সন্তান ভাবা ও ভাই হিসেবে ভাবা,-এসব উদারনৈতিক মানবতাবাদী কথাও ছিল। অপরাধ স্বীকার করা, প্রার্থনা করা, সহ্য করা, ক্ষমা ও আনুগত্য,-এগুলির কথাও বলা হয়।

এর ফলে নিপীড়িত মানুষ তার দারিদ্র ও দুর্দশার একটা ‘যুক্তিগ্রাহ্য’ ব্যাখ্যা খুঁজে পেল, ধনী-দরিদ্র বিভাজন যে ঈশ্বরের অনভিপ্রেত,-এসব ভেবে আত্মসন্তুষ্টি লাভ করতে লাগল। কিন্তু সমস্যার সমাধান হিসেবে বিপজ্জনকভাবে এই সহজ পদ্ধতিই প্রতিষ্ঠিত হলো যে, নিজের পাপক্ষালনের চেষ্টা করার মধ্য দিয়েই মুক্তি আসবে। ‘সামাজিক কারণ নয়, আমার দুর্দশার জন্য আমার পাপই দায়ী’– এমন ধারণাই প্রতিষ্ঠিত করা হলো এবং এখনো করা হচ্ছে। তথাকথিত মিশনারী সম্প্রদায় দেশে-বিদেশে এখনো খ্রীস্টধর্মের মানবপ্রেমের কথাবার্তার সঙ্গে সুন্দরভাবে এই তত্ত্বকে মিশিয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে সামাজিক যেসব কারণ বৈষম্য, শোষণ ও নিপীড়নের জন্য দায়ী সেগুলিকে খুঁজে বের করা এবং তার বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালানোর প্রচেষ্টাকে ভোঁতা করে দেওয়া যায়। প্রায় সমস্ত প্রচলিত ধর্মই শাসকশ্রেণীর সুবিধাজনক এই জাতীয় তত্ত্ব জানিত বা অজানিতভাবে প্রচার করেছে। খ্রীস্টধর্ম-ও তার ব্যতিক্রম নয়। সামাজিক অন্যায়গুলিকে দূর করার মধ্য দিয়ে নয়, মুক্তিদাতা যীশুর নির্দেশ অনুসারে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেই মুক্তিলাভ হবে, এ-জাতীয় কথাবার্তার বড় বিপদ এখানেই। সত্যিই যদি তাই হতো, তবে খ্রীস্টধর্মালম্বীদের মধ্যে অন্তত এই দু-হাজার বছরের পরেও দারিদ্র, বঞ্চনা, বৈষম্য ও নিপীড়ন থাকার কথা ছিল না; এবং তারও ব্যাখ্যা ঐ মানবজাতির আদিম পাপ,-এমন সর্বনাশা তত্ত্ব।

যীশু নামে সত্যিই যদি কেউ জন্মে থাকেন, তবে তিনি যেমন অস্তিত্বহীন ঈশ্বরের প্রতিনিধি নন,-সামাজিক কারণেই তাঁর ও তাঁর মতাদর্শের সৃষ্টি ও জনপ্রিয়তা, তেমনি পরবর্তীকালে নিছকই সামাজিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণেই তাঁর মতাদর্শের বিভাজন, পরিমার্জন হয়েছে। দ্বিতীয় শতাব্দীতে এমন একটি আন্দোলন গড়ে ওঠে নস্টিক (Gnostic) নামে; এদের কাছে ইহুদিরা একেবারেই পরিত্যাজ্য ছিল, কিন্তু খ্রীস্টধর্মে ইহুদিদের সঙ্গে কিছু বোঝাপড়ার ব্যবস্থা রাখা হয়। নস্টিক মতবাদ মুলত ধনী অভিজাতদের চিন্তাভাবনা ছিল, প্রধানত এ-কারণেই এর সর্বজনীনতা সম্ভব হয় নি। তবে নস্টিকদের কিছু চিন্তার প্রতিফলন পরবর্তীকালের খ্রীস্টধর্মের মধ্যে ঘটে। প্রায় এই সময়েই মন্টানিস্ট (Montanist) আন্দোলনও গড়ে ওঠে, যেটিতে চার্চের ও বিশপদের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়। দাস-মালিকদের স্বার্থের উপযোগী ছিল এ ধরনের আন্দোলন এবং মূল খ্রীস্টধর্মের ক্রমবর্ধমান বৈপ্লবিক সর্বজনীনতাকে এটিও আটকাতে পারে নি। তবে এই সময়কালে খ্রীস্টধর্মের ধারক ও বাহক হিসেবে ধনী ব্যক্তিরাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছিল। মন্টানিস্টদের আন্দোলন ঠেকাতে এরা বিশপদের সঙ্গে যীশুর তথা ঈশ্বরের দূতের ধারাবাহিকতার কথা প্রচার করতে শুরু করে।

তৃতীয় শতাব্দীতে বিশেষত পারস্য অঞ্চলে খ্রীস্টধর্ম জোরোঅ্যাস্ট্রিয়ানবাদের সমন্বয়ে মানিকিয়া গোষ্ঠী ( Manichaean sect) গড়ে ওঠে। চতুর্থ শতাব্দীতে বিশেষত উত্তর আফ্রিকায় বিশপ ডোনেটাসের নেতৃত্বে ডোনাটিস্টদের উদ্ভব হয়। এরা সরকারের সঙ্গে কোনোধরনের সহযোগিতার বিরোধিতা করেন, বিশপ ও যাজকদেরও অস্বীকার করেন। এটি ধনীদের বিরুদ্ধে দরিদ্রদের সরাসরি বিদ্রোহে রূপান্তরিত হয় এবং অ্যাগোনিস্ট নাম ধারণ করে। সপ্তম শতাব্দীতে ইসলাম ধর্ম উত্তর আফ্রিকায় প্রবেশ করার পর ধীরে ধীরে এই বিদ্রোহী মতবাদের বিলুপ্তি ঘটে।

চতুর্থ শতাব্দীতে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার যাজক আরিয়স-এর নেতৃত্বে খ্রীস্টধর্মের উৎপত্তি তথা যীশুকে ঈশ্বরের দূত হিসেবে ভাবার বিরুদ্ধে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে ওঠে। দু’পক্ষে দাঙ্গাও ঘটে। গোঁড়া খ্রীস্টানরা আরিয়সকে সবচেয়ে পাপী শয়তান হিসেবে অভিহিত করলেও বেশ কিছুকাল ধরে তাঁর চিন্তাভাবনা প্রসারিত হতে থাকে, যার একটি বিভাজনের কিছু ছাপ ক্যাথলিক ধর্মমতে পাওয়া যায়। আরিয়স-এর পরাজয়ের পরে-পরেই প্রায় একই ধরনের বিদ্রোহী মানসিকতা নিয়ে কনস্তানতিনোপলের বিশপ, নেস্টোরিয়াসের নেতৃত্বে আরেকটি আন্দোলন গড়ে ওঠে। যীশুখ্রীস্টকে তিনি মানুষ হিসেবেই গণ্য করেন, ঈশ্বর বা তাঁর দূত নয়; কুমারী মেরি তাঁর মতে যীশুর জন্মদাত্রী মাত্র। নেস্টোরিয়াসের মতবাদ পরে ব্যাপকতা লাভ না করলেও দক্ষিণ ভারত, লেবালন ইত্যাদি এলাকার কিছু কিছু ক্ষুদ্র খ্রীস্টান গোষ্ঠী এখনো এই মতাবলম্বী।

এই ধরনের বিদ্রোহী মতবাদের প্রতিক্রিয়ার চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দীতে যীশুকে পূর্ণ অর্থে দেবতার আসনে বসিয়ে মনোফাইসিট (Monophysite) মতবাদের জন্ম হয়। বিশপ ইউটিকাস-এর প্রচারিত এই মতাদর্শ রোমসাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের মানুষের স্বতন্ত্রতার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মিশে যায়। বর্তমানে আর্মেনিয়ান চার্চ, আবিসিনিয়ার কিছু মানুষ এই মতবাদে বিশ্বাসী।

খ্রীস্টধর্মের শুরুর দিকে আচার-অনুষ্ঠান খুবই কম ছিল, ছিল সহজ সরল পদ্ধতি। পুরনো নানা ধর্মমতগুলিতে এ ধরনের নানা অনুষ্ঠানের দ্বারাই মানুষে মানুষে বিভাজন করা হতো,-খ্রীস্টধর্মের সারল্য এই বিভাজন দূর করতে সাহায্য করেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে কম্যুনিয়ম, ব্যাপটিজম, ইস্টার ইত্যাদি নানা অনুষ্ঠান চালু হয় দু-তিন শ’ বছরের মধ্যেই। এগুলি প্রায় সবগুলিই স্থানীয়ভাবে প্রচলিত নানা অনুষ্ঠানের প্রতিফলিত রূপ। যেমন স্নান করে পাপ দূর করা, জল ছিটিয়ে শরীর পবিত্র করা ইত্যাদি নানা গোষ্ঠীর মধ্যেই চালু ছিল। এরই পাশাপাশি আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মের নামে গোঁড়ামি আর পাশবিক কাজকর্মের ছড়াতে থাকে। নব্য খ্রীস্টানরা তাদের ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার নির্বোধ তাড়নায় ৪১০ খ্রীস্টাব্দে রোমের শিল্প ও বিজ্ঞানের নানা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে ওয়েস্ট গথদের নেতৃত্বে। ৪১৫ খ্রীস্টাব্দে প্যাট্রিয়ার্ক কিরিল-এর নেতৃত্বে গোঁড়া যাজক ও খ্রীস্টানরা আলেকজান্দ্রিয়ার বিশাল লাইব্রেরি ধ্বংস করে, এবং অঙ্কবিদ, দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ মহিলা হাইপাটিয়াকে হত্যা করে। ৪৫৫ খ্রীস্টাব্দে ড্যান্ডালদের নেতৃত্বে আরো ব্যাপকভাবে এ ধরনের ধ্বংসলীলা চালানো হয় ধর্মের নামে (এ থেকেই এসেছে vandalism কথাটি)।

এই কালপর্বে রোম সাম্রাজ্যের পতন শুরু হতে থাকে, এবং খ্রীস্টধর্ম ইয়োরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ায় ছড়াতে থাকে। দশম শতাব্দীর মধ্যে সমগ্র ইয়োরোপই বাস্তবত খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করে। তবে সপ্তম শতাব্দীর পর ক্রমপ্রসার্যমান ইসলাম ধর্মের সঙ্গে তার বিরোধ শুরু হয় এবং আফ্রিকা ও এশিয়ায় খ্রীস্টধর্মের প্রসার বাধা পায়। খ্রীস্টধর্ম অবশ্য ইসলাম থেকে গুণগতভাবে কিছু পৃথক ছিল। যে সব অঞ্চলে এ ধর্ম ছড়িয়েছে, সেখানকার প্রচলিত ধর্মচিন্তাকে খ্রীস্টধর্ম পুরোপুরি ধ্বংস করে নি, বরং সেগুলির অনেকখানি গ্রহণ করে।

ধর্ম সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে জন্মায়, পাল্টায়। খ্রীস্টধর্মও তার ব্যতিক্রম নয়। নয়। তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দী সময়কালে রোম সাম্রাজ্য ক্ষমতাগতভাবে পূর্ব ও পশ্চিমে বিভাজিত হতে থাকে। পশ্চিমে সম্রাটের ক্ষমতা কমতে কমতে লুপ্ত হয়ে গেলে, চার্চের প্রধান অর্থাৎ রোমের বিশপ (যাকে পোপ নামে ডাকা হতো) চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে। কিন্তু পূর্ব অংশে তা হয় নি এবং শাসকসম্রাট চার্চের স্বাধীন ক্ষমতা খর্ব করে। এভাবে ক্ষমতাগতভাবে পূর্ব ও পশ্চিমের চার্চের বিভাজন ঘটে, এরই সঙ্গে প্রাসঙ্গিকভাবে তাদের নিয়ম কানুন, আচারবিধি ইত্যাদিরও। ১০৫৪ খ্রীস্টাব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে এই বিভাজন পূর্ণতা লাভ করে,-পশ্চিমগোষ্ঠীর নাম হয় রোমান ক্যাথলিক, পূর্বের গ্রেকো-অর্থোডক্স। ক্যাথলিকদের মতে ‘ঐশ্বরিক আত্মা’ ‘পিতা’ ও ‘সন্তান’ (ঈশ্বর ও যীশু) উভয়ের থেকেই আসে, অর্থোডক্সদের মতে শুধু ‘পিতা’ থেকে। এ ধরনের আরো কিছু তফাৎ এদের মধ্যে রয়েছে, যেমন ক্যাথলিকরা জল ছিটিয়ে ধর্ম গ্রহণ করে (Christening), অর্থোডক্সরা তখন জলে পুরো শরীর ডোবায়। ক্যাথলিকদের কোনো ধর্মযাজকই বিয়ে করতে পারবে না, কিন্তু অর্থোডক্সদের সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনী (monks and nuns) ছাড়া বাকিদের কাছে বিবাহ নিষিদ্ধ নয়, ইত্যাদি। ক্যাথলিক চার্চ সাংগঠনিকভাবে অনেক শক্তিশালী এবং বহু দেশের রাজনৈতিক তথা শাসন ক্ষমতার নিয়ামক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

ক্যাথলিক চার্চের এই শাসকচরিত্র প্রকট হয় মধ্যযুগে, যখন ইয়োরোপে ক্রমবর্ধমান শ্রেণীসংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ধর্মীয় নানা গোষ্ঠী, মতবাদ ইত্যাদি সৃষ্টি হতে থাকে। দ্বাদশ শতাব্দীতে পোপ ‘হোলি ইনকুইজিশান’ নামে বিশেষ ধর্মীয় আদালত প্রতিষ্ঠা করে। যাদেরই ক্যাথলিক-বিরোধী মনে করা হতো, তাদেরই ‘বিচার’ করে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হতো। অকথ্য অত্যাচার থেকে শুরু করে পুড়িয়ে মারা, সবই ধর্মের নামে চলতে থাকল। এই গোঁড়ামি আর যুক্তিহীন জান্তব অন্ধতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অবশ্যম্ভাবীরূপে নানা কুসংস্কারের সৃষ্টি হয়, যার অন্যতম হলো ডাইনী ও মন্ত্রজ্ঞ ওঝাদের সম্পর্কে ধারণা। ধর্মের নামে স্পেন সহ নানা অঞ্চলে হাজার হাজার নির্দোষ মানুষকে, মানবপ্রেমিক হিসেবে প্রচারিত যীশুকে সামনে রেখে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হলো।

পাশাপাশি এই সময়ে কিছু ব্যক্তির মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার উপযোগিতা অনুভূত হয়। তাঁরা খ্রীস্টধর্মের ভিত্তিকে যুক্তি গ্রাহ্য ও ‘বিজ্ঞানসম্মত’ করার প্রচেষ্টায় ‘স্কলাস্টিক’ মতবাদের জন্ম দেন। কিন্তু আরো কিছু গোঁড়া ধার্মিকদের কাছে বিজ্ঞান ও ধর্ম ছিল তেল আর জলের মতো, তাদের কাছে বিজ্ঞানের চর্চা যারা করে তারা খ্রীস্টধর্মের বিরোধী অর্থাৎ হত্যার যোগ্য। ইয়োরোপের মধ্যযুগে ক্যাথলিক চার্চও এই মানসিকতায় সম্পূর্ণভাবে ডুবে যায়। কোপানিকাস-এর বৈজ্ঞানিক তথ্যাদিকে নিষিদ্ধ করা হয়। রজার বেকন, গালিলিও গ্যালিলেই প্রমুখ-দার্শনিক বিজ্ঞানীদের ওপর অত্যাচার নেমে আসে, জিওরদানো ব্রুনো ও লুচিলিও ভানিনির মতো বিজ্ঞানীদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ষোড়শ শতাব্দীর শুরু অব্দি চলতে থাকে এই বাধাহীন ধৰ্মীয় তাণ্ডব।

কিন্তু এরপরের সময়কালেই ইয়োরোপে অঙ্কুরিত হলো সামন্ততান্ত্রিক, তথা ক্যাথলিক ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে উদার ও তৎকালে প্রগতিশীল বুর্জোয়া মতবাদ। পোপের কর্তৃত্ব আর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মতাদর্শ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। শুরু হয় রিফর্মেশান আন্দোলন তথা বিভিন্ন প্রতিবাদী প্রোটেস্টান্ট চার্চ-এর সৃষ্টি প্রক্রিয়া। ধর্মীয় ব্যাপারগুলি অবশ্য থাকলই। তবে গুণগতভাবে না হলেও তাদের বাহ্যিক কিছু পরিমার্জন ও সংশোধন করা হলো। জার্মানি ও স্ক্যাণ্ডিনেভিয়ায় এভাবে গড়ে উঠল লুথেরান চার্চ। সুইজারল্যাণ্ড ও নেদারল্যাণ্ডস-এ ক্যালভিনিজম, স্কটল্যাণ্ডে প্রেসবিটেরিয়ানিজম, ইংল্যাণ্ডে অ্যাংলিকান চার্চ ইত্যাদি। এই সব প্রোটেস্টান্ট চার্চ প্রচলিত ধর্মীয় পুস্তককে ধর্মাচরণের একমাত্র নির্দেশিকা হিসেবে মানতে অস্বীকার করে। ক্যাথলিক চার্চের মত ছিল “ভাল কাজ করা বা চার্চকে দান করাটাই মুখ্য কাজ—প্রোটেস্টান্টরা ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রধান গুরুত্ব দেন। এঁরা চার্চের ওপর নয়, মানুষেরই ওপর ধর্মাচরণের কর্তৃত্ব আরোপ করার কথা বলেন। এরই সঙ্গে পোপের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ রাজশক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়, কোথাও বুর্জোয়ারা শাসন ক্ষমতা দখল করে।

১৮৭০ খ্রীস্টাব্দে সুইজারল্যাণ্ড ও দক্ষিণ জার্মানির একটি ছোট ক্যাথলিক গোষ্ঠী পোপের মাহাত্ম্যে সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং কিছু গণতান্ত্রিক পরিবর্তন ও সরলীকরণ ঘটান। ১৯২০ সালে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে চেকোস্লোভাকিয়ার কিছু ক্যাথলিক যাজক আলাদা চেক ক্যাথলিক চার্চ গঠন করেন। এ-ধরনের ছোটখাট কিছু ঘটনা ছাড়া ক্যাথলিক মতের বিশেষ ভাঙন ঘটে নি। এর একটি কারণ, ব্যাপক মানুষের কাছে, অলীক হলেও একটি কার্যকর আশ্রয় হিসেবে ক্যাথলিক মতের উপযোগিতা। এখনো অব্দি গরিষ্ঠ সংখ্যার মানুষ প্রাকৃতিক ও সামাজিক প্রতিকূল শক্তিসমূহের কাছে অসহায়। এই অসহায়ত্বের ওপর প্রলেপ দিয়ে, আপাত মানসিক সাহস ও শান্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে অপ্রতিবাদী ও ঐতিহ্যের মায়া মাখানো ক্যাথলিক মত (অন্যান্য ধর্মও) তার ভূমিকা পালন করতে পারছে।

এরই পাশাপাশি শিল্পবিপ্লব ও বুর্জোয়া বিকাশের ফলে খ্রীস্টধর্মালম্বীরা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বিশ্বে নেতৃত্বদায়ী ভূমিকা নিয়েছে বিগত শতাব্দী থেকে। এর ফলে তারা সারা বিশ্বে যেমন অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করতে পেরেছে, তেমনি ধর্মীয় ক্ষেত্রেও তাদের ধর্মমতকে এই আধিপত্যের উপযোগী করে ব্যবহার করেছে। স্বাভাবিকভাবেই এশিয়া, আফ্রিকা সহ পৃথিবীর নানা উপনিবেশে খ্রীস্টধর্মের যাজক তথা প্রচারকরাও ছড়িয়ে পড়েছে। জাতপাতের ঊর্ধে উঠে ও তথাকথিত নানা সেবামূলক কাজের মধ্য দিয়ে তারা এক নতুন আপাত-উদার ধর্মমতের প্রচার করেছে। তারা একদিকে ঐ সব দেশের মানুষদের একাংশকে যীশুর ভালবাসার বাণী শুনিয়ে আকৃষ্ট করতে পেরেছে, অন্যদিকে তাদের দুর্দশার মূলে তাদের পাপই দায়ী আর এ পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য যীশুর আশ্রয় নেওয়ার কথা বলে স্বধৰ্মীয় নয়া শাসকদের তথা সমগ্র শাসককুলকে আড়াল করতে সমর্থ হয়েছে। কলকাতার বস্তি থেকে আফ্রিকার অরণ্য—সর্বত্র এদের বিচরণ।

বর্তমান সময়ে আন্তর্জাতিক স্তরে তথাকথিত খ্রীস্টধর্মালম্বীদের একাংশ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রক ভূমিকায় রয়েছে। এর একটি প্রতিফলন দেখা যায়, বর্তমানে সব ধর্মের মধ্যে অনুগামীর সংখ্যা বিচারে এদের সংখ্যাধিক্যের মধ্যেও। অবশ্য স্বাভাবিকভাবেই এদের মধ্যেও অর্থনৈতিক বৈষম্য যেমন রয়েছে, তেমনি ধর্মমতের খুঁটিনাটি নানা ক্ষেত্রেও অনৈক্য রয়েছে।* আগামী কয়েক দশক বা শতাব্দী পরে, সমাজ ও অর্থনীতির পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, অন্যান্য ধর্মের মতো খ্রীস্টধর্মও তার অনুগামীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাতে পারে–প্রাচীন নানা ধর্মের মত বিলুপ্ত হয়ে যাবে একদিন এবং এটি বর্তমানে কমবেশি প্রচলিত অন্যান্য সব ধর্মের ক্ষেত্রেও সত্যি।

[* খ্রীস্টধর্মাবলম্বীরা প্রধান তিনটি বিভাগে বিভক্ত—রোমান ক্যাথলিক, অর্থোডক্স ও প্রোটেস্টান্ট। প্রোটেস্টান্টরাও আবার বহুধা বিভক্ত, যেমন অ্যাংলিকান কম্যুনিয়ন, ব্যাপটিস্ট চার্চ, ক্রিস্টিয়ান চার্চ (ডিসাইপ্স্ অব্ ক্রাইস্ট), চার্চেস অব ক্রাইস্ট, চার্চ অব্ ক্রাইস্ট—সায়েন্টিস্ট, চার্চ অব্ জেসাস ক্রাইস্ট অব্ ল্যাটার-ডে সেন্ট, জিহোভাস উইটনেসেস, লুথেরান কমিউনিয়ন, মেথডিস্ট চার্চ, পেন্টিকোস্টাল চার্চ, রিফর্মড প্রেসবিটেরিয়ান অ্যাও কংগ্রেগেশন্যাল চার্চ, রিলিজিয়াস সোসাইটি অব্ ফ্রেগুস, স্যালভেশান আর্মি, সেভেন্‌থ্ ডে অ্যাডভেন্টিস্ট চার্চ, ইউনিটারিয়ান চার্চ, দি ইউনাইটেড চার্চ’ অব্ কানাডা, ইউনাইটেড চার্চ অব্ ক্রাইস্ট ইত্যাদি। তথাকথিত কমিউনিস্ট দেশের পতনের পর অর্থোডক্সরাও (গোঁড়া, ঐতিহ্যবাহী) মাথা চাড়া দিয়েছে।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *