বৌদ্ধ ধৰ্ম

বৌদ্ধ ধৰ্ম

বিশেষ সামাজিক ও মানবিক প্রয়োজনে মানুষ কিভাবে বিশেষ আদর্শ ও মূল্যবোধ বা তথাকথিত ধর্মমতের জন্ম দেয় এবং কিভাবে এই প্ৰয়োজন কমে গেলে বা ফুরিয়ে গেলে, ঐ ধর্মমতের ধীর অবলুপ্তি ঘটতে থাকে, তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো বৌদ্ধধর্ম।

বর্তমানে পৃথিবীর মাত্র শতকরা ৫-৭ মানুষ তথাকথিত বৌদ্ধ-ধর্মাবলম্বী হিসেবে পরিচিত। কিন্তু কয়েক শতাব্দী, এমনকি কয়েক দশক আগেও এই সংখ্যা ছিল বিপুল। প্রাচীনত্বের বিচারে বৌদ্ধধর্ম ইসলাম, খ্রীস্ট, এমনকি হিন্দুধর্মেরও পূর্বসূরী, কিন্তু বৈদিকধর্মের পরবর্তীকালের।

প্রকৃতপক্ষে বৈদিকধর্ম ও তার ধ্বজাধারী ব্রাহ্মণ্যধর্মের চরম জনবিরোধী ভূমিকার প্রতিবাদী হিসেবেই এই মানবিক ও তুলনামূলকভাবে অন্ধ সংস্কারমুক্ত বৌদ্ধ ধর্মের সৃষ্টি ঘটে। এবং এই ভারতীয় ভূখণ্ডেই তার সৃষ্টি ও বিকাশ—অন্যান্য দেশে ভারতের বানিজ্যবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এই ধর্মমতও সেখানে ছড়িয়ে পড়ে।

খ্রীস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের শুরুতেই ভারতীয় ভূখণ্ডের বিশেষত উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে বৈদিক ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এবং পূর্বদিকে শাসকগোষ্ঠীর বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের অন্যান্য দিকেও প্রসারিত হতে থাকে। খ্রীস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময়কালে এই বৈদিকধর্ম এবং তার পরবর্তী ব্রাহ্মণ্যধর্মের জনবিরোধী চরিত্রের জন্য বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ ও বিক্ষোভ সৃষ্টি শুরু হয়। বেদ ও ব্রাহ্মণের অন্তঃসারশূন্য আড়ম্বর, অনুষ্ঠানাদি ও আগ্রাসী কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে ছোটো-বড়ো ধর্মীয় আন্দোলন (ঐ পরিবেশে যা সামাজিক আন্দোলনেরই নামান্তর) শুরু হতে থাকে। ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নেতৃস্থানীয় চিন্তাশীল ব্যক্তিরা এই বিক্ষোভকে প্রশমিত করতে নতুনতর সূক্ষ্ম কৌশল সৃষ্টি করেন—সাহিত্য তথা তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে যার নাম হয় উপনিষদ। নতুন ধরনের মোক্ষলাভ ও তুরীয় জ্ঞানের কথা বলা হয়, বেদকে অস্বীকার না করেই।

কিন্তু ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বহিরাগত আর্য-শাসকগোষ্ঠীর তথা বেদের প্রভাব এত গভীর ছিল না। ফলে ঐ সব অঞ্চলে বিভিন্ন তাত্ত্বিক ও দার্শনিক মতবাদ, বিতর্ক ও প্রতিবাদী আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। ক্রমে গোষ্ঠীগত ঐক্য ভাঙতে থাকে। ছোটো ছোটো শাসকগোষ্ঠী, ছোটো ছোটো রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। ধর্মের ক্ষেত্রেও বিভিন্নতা, পরীক্ষামূলক কাজকর্ম, সন্দেহ করা ও বিতর্ক করা ইত্যাদি শুরু হয়।

এইভাবেই খ্রীস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর কাছাকাছি সময়েই নানা নতুনতর চিন্তার তথা ধর্মমতের সৃষ্টি হয়। সঞ্জয় বেলাথিপুত্তের নেতৃত্বে সন্দেহবাদ বা নাস্তিক্যবাদ, পুকুধ কাত্যায়নের নেতৃত্বে কণাবাদ (atomism), অজিত কেসকম্বলিনের* নেতৃত্বে বস্তুবাদ, পূরণ কাসপ-এর নেতৃত্বে নীতিশাস্ত্রের বিরুদ্ধে মতবাদ ইত্যাদি গড়ে ওঠে। শুক্রাচাৰ্য্য, কপিল, বৃহস্পতি, চার্বাক প্রমুখরাও বেদের বিরুদ্ধে মত প্রচার করেন। বহু মানুষই এ ধরনের পরিব্রাজক, বৈপ্লবিক মতাবলম্বী সন্ন্যাসী তথা চিন্তাবিদের শিষ্যত্ব নিতেন, এবং ঐ অনুযায়ী নিজেদের দৈনন্দিন জীবন, সমাজ, অর্থনীতি আর সাংস্কৃতিক চেতনাকে গড়ে তুলতেন। (পাশাপাশি অজিবিকাশের* প্রচার করা নিয়তিবাদও সৃষ্টি হয়। সৃষ্টি হয় জৈনধর্মও)।

 [* নাস্তিকতা নিরীশ্বরবাদ বা অধার্মিকতা, অংশ দ্রষ্টব্য]

এমনই এক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরীক্ষাদির সময়কালে বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয়—খ্রীস্টপূর্ব ৫৬৬ সালের মে মাসে (বৈশাখী পূর্ণিমার দিন)—বর্তমানে নেপালে অবস্থিত রুন্মিন্দেই-এ (প্রাচীন নাম লুম্বিনী উদ্যান)। (‘বুদ্ধ’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ ‘জ্ঞানপ্রাপ্ত’।) কপিলবস্তুর শাক্য-উপজাতীয় গণরাজ্যের ক্ষত্রিয় প্রধান তথা রাজা শুদ্ধোদনের ছেলে তিনি। জন্মের পঞ্চম দিনে ১০৮ জন ব্রাহ্মণ এসে তাঁর নামকরণ করেন সিদ্ধার্থ (পালিভাষায়—– সিদ্দাত্ত)—যার অর্থ ‘যার লক্ষ্য পূরণ হয়েছে’। জন্মের সপ্তম দিনেই তাঁর মা মারা যান এবং সিদ্ধার্থকে লালন পালন করেন শুদ্ধোদনের শ্যালিকা তথা দ্বিতীয়া স্ত্রী মহাপ্রজাপতি গৌতমী।

গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর অনেক পরে তাঁর জীবন ও উপদেশাবলী লিখিত হয়। তার আগে শ্রুতি হিসেবেই এগুলি চালু ছিল (‘এবম ময়া শ্রুতম’)। বৌদ্ধধর্মের স্বীকৃত ও প্রাচীনতম লিখিত গ্রন্থ হলো—তিপিটক। খ্রীস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে পালি ভাষায় লেখা। এর তিনটি অংশ বিনয় পিটক (নিয়মকানুন), সুত্তপিটক (উপদেশাবলী) ও অভিধম্মপিটক (আধিভৌতিক আলোচনা)। মূলত এটি শ্রীলংকায় রক্ষিত আছে। পরবর্তীকালে অন্যত্র, অন্যান্য ভাষায় বৌদ্ধ-ধর্মগ্রন্থ লেখা হয়। কিন্তু এসবের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কল্পনা, সংযোজন ও বিভিন্নতা অবশ্যম্ভাবীরূপে এসে পড়ে। বলা হয়েছে বুদ্ধের জন্মের পর ১০৮ জন ব্রাহ্মণের অনেকেই নাকি বলেছিলেন এই শিশু সংসার ত্যাগ করবে, এঁদের মধ্যে কোন্দন্ন নামের এক ব্রাহ্মণও ছিলেন। এগুলি সত্যি কি মিথ্যে তা যাচাই করার উপায় নেই, নিছক যুক্তিগ্রাহ্য বুদ্ধি প্রয়োগ করা ছাড়া।

তবে এটি অবিতর্কিত যে, সিদ্ধার্থকে চূড়ান্ত বিলাসিতা আর আরামের মধ্যে মানুষ করা হয়, যাতে তিনি গৃহত্যাগ করার চিন্তা কোনোদিন মাথায় না আনেন। ১৬ বছর বয়সে সমবয়সী এবং আত্মীয়তাসূত্রে বোন, রাজকুমারী যশোধরার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর বয়েস যখন ২৯ তখন নাকি তিনি রথে রথে করে রাস্তায় বেরিয়ে বৃদ্ধ, অসুস্থ, মৃতদেহ ও সাধু—এই চারটির দৃশ্য দেখেন। যদিও বলা হয়, এমন জিনিস তিনি ঐ প্রথম দেখলেন, তবে যথাসম্ভব ব্যাপারটি প্রতীকী। না হলে ২৯ বছর বয়স অব্দি এদের তিনি কখনো দেখেন নি এমনটি অস্বাভাবিক। যাই হোক এ থেকেই তিনি সংসার, এই মনুষ্যদেহ, এই আত্মীয়স্বজন—এদের অনিত্যতা উপলব্ধি করেন। যেদিন সাধু দেখেন সেদিনই রাস্তা থেকে ফিরে তিনি তাঁর পুত্র রাহুলের জন্ম সংবাদ পান। এবং সিদ্ধান্ত নেন সংসার ত্যাগ করবেন।

সাধুর বেশে তিনি দক্ষিণের দিকে যাত্রা শুরু করলেন। মগধের রাজধানী রাজগৃহ (বর্তমান নাম রাজগির)-এ আসেন এবং এখানকার রাজা বিম্বিসারের সঙ্গে দেখা হয়। গৌতম বলেন, তিনি সত্য জানার জন্য বেরিয়েছেন। গুরুর সন্ধান করেন। তিনি উরুবেলা-র কাছে সেনানিগম গ্রামে আসেন। এখানে কোন্দন্ন (বা কৌণ্ডিন্য) সহ পাঁচজন তাঁর শিষ্য হন। ছ-বছর ধরে কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন করে গৌতম প্রকৃত জ্ঞানের জন্য চেষ্টা করেন। তাঁর শরীর কঙ্কালসার হয়ে যায়। (২-৪র্থ শতাব্দীর কোনো এক সময়ে তৈরি একটি গান্ধারমূর্তিতে গৌতমের এই শারীরিক অবস্থার ছবি পাওয়া যায়।) তিনি জ্ঞান হারাতে থাকেন এবং বোঝেন এভাবে শরীরকে কষ্ট দিয়ে জ্ঞানলাভ করা যায় না। শিষ্যদের একথা বলতে তাঁরা গৌতমের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে চলে যান।

এক সকালে গৌতম একটা বটগাছের নিচে বসে আছেন। সেনানিগম গ্রামের জমিদারের মেয়ে সুজাতা এসে তাঁকে একবাটি পায়েস খাইয়ে যান। গৌতম শরীর ও মনের জোর পান। সারাদিন শালজঙ্গলে ঘুরে, সন্ধ্যেবেলা একটা অশ্বত্থ গাছতলায় বসে তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, সত্যজ্ঞান লাভ না করে তিনি উঠবেন না। এই সময় ‘মার’ (মারি?) নামে শয়তান নাকি তাঁকে প্রলুব্ধ করতে থাকে। বলা হয়, গৌতম তাঁর অসংখ্য ‘পূর্বজন্মে’ বোধিসত্ত্ব হিসেবে (বুদ্ধত্ব অর্জনের আগের জন্মগুলির নাম) যে ১০টি গুণ বা পারমিতা অর্জন করেছিলেন, তার সাহায্যে তিনি ‘মার’-কে প্রতিহত করেন। এই ১০টি গুণ হলো—দয়া, নৈতিকতা, আত্মোৎসর্গ, প্রজ্ঞা, প্রচেষ্টা, ধৈর্য্য, প্ৰকৃতজ্ঞান, দৃঢ়সঙ্কল্প, বিশ্বজনীন-প্রেম ও মানসিক সমতা। তিনি বলেন, ‘মার’-এর অস্ত্র তো ১০টি—কাম-লালসা, উচ্চতর জীবনের জন্য অনাকাঙ্খা, ক্ষুধাতৃষ্ণা, কামনা-বাসনা, জড়ত্ব ও আলস্য, ভীরুতা, সন্দেহ, ভণ্ডামি, মিথ্যা অহংকার এবং পরনিন্দা ও আত্মগরিমা। সুত্তনিপাত-এর পধানসুত্ত অংশে মার-এর সঙ্গে গৌতমের এই যুদ্ধের কথা বলা আছে। কিন্তু স্পষ্টত এটি কোনো বাস্তব যুদ্ধ নয়—এটি ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে সংগ্রামের কল্পিত প্রতীকী চিত্র এবং মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষা।

বলা হয় তিনি সন্ধ্যে ৬টা থেকে রাত ১০টার মধ্যে পূর্বজন্ম সম্পর্কে উপলব্ধি অর্জন করেন, রাত ১০টা থেকে ২টোর মধ্যে লাভ করেন অতিমানবিক ঐশ্বরিক দৃষ্টি এবং ভোর ৬টার মধ্যে তিনি চরম সত্যজ্ঞান অর্জন করেন, এবং মনের ক্ষত ও মালিন্য দূর করেন। সেদিনও ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা, ৫২৮ খ্রীস্টপূর্বাব্দের মে মাস। তখন তাঁর বয়স ৩৮ বছর।

এরপর ৫-৭ সপ্তাহ ধরে তিনি উরুবেলাতেই তাঁর উপলব্ধির বিষয়ে চিন্তাভাবনা (ধ্যান) করেন। তিনি উপলব্ধি করেন, কোনো কিছুই চিরন্তন বা চিরস্থায়ী নয়, আত্মার মতো কোনো স্থায়ী বা চরম কিছু নেই, কোনো কিছুই অপরিবর্তনশীল বা ধ্রুব নয়। তিনি বোঝেন সব কিছুই পরস্পর নির্ভরশীল ও আপেক্ষিক। তিনি বলেন, ব্রহ্মাণ্ডে একটি স্বাভাবিক উত্থান পতনের নিয়ম রয়েছে এতে ঈশ্বরের কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেই। তাঁর মতে জাতিভেদ নিরর্থক এবং কর্মফল অনুযায়ী জাতিভেদের কথা তিনি মানতেন না। সুকর্মের ফলে পরম মুক্তি অর্থাৎ পুনর্জন্মচক্রের বাইরে বেরিয়ে এসে নির্বাণ লাভের কথা তিনি বলেন। তাঁর উপদেশ ছিল সহজ সরল। এতে দৈব হস্তক্ষেপের কোন প্রশ্ন ছিল না। তাঁর উপদেশাবলী ছিল যুক্তিবাদ ও হেতুবাদের ফসল।

এই সব জ্ঞান অর্থাৎ বুদ্ধত্ব লাভ করে গৌতম হন বুদ্ধ। এরপর তিনি শিষ্যের খোঁজে বেরোন। বারানসীতে পূর্বের ঐ পাঁচ জন শিষ্যকে পান তিনি তাদের নতুন উপলব্ধির খবর দিলেন। বারানসীর চার মাইল দূরে সারনাথের মৃগ উদ্যানে তিনি এই পাঁচজনকে তার প্রথম ধর্মোপদেশ দেন (পালি-তে যার নাম—ধৰ্ম্মচক্কপবত্তন; setting in motion the wheel of truth)। (পরে একটি স্তূপ করে এ জায়গাটি এখনো চিহ্নিত আছে।) তিনি বলেন, যে-ব্যক্তি গৃহত্যাগ করে এগিয়ে যেতে চান (পৰ্ব্বজিত) তাঁর মধ্যপন্থা অনুসরণ করা উচিত (মজঝিমা পটিপদা)—চূড়ান্ত কৃচ্ছ্রসাধন বা চুড়ান্ত অসংযম, এই দুই চরম দিকের কোনটিই সঠিক পথ নয়। তাঁর উপদেশের মধ্যে ছিল চারটি মহৎ সত্য— এ পৃথিবী দুঃখময়, দুঃখ আসে মানুষের আকাঙ্খা থেকে, আকাঙ্খা দূর হলেই মুক্তি আসে এবং এই মুক্তির জন্য আটটি পথ (অষ্টাঙ্গিক মার্গ) অনুসরণ করা প্রয়োজন। তিনি এই আটটি পথের কথা বলেন—সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি, সঠিক চিন্তা, সঠিক কথা, সঠিক কাজ, সঠিক জীবনধারণ, সঠিক প্রচেষ্টা, সঠিক একাগ্রতা ও সঠিক স্মৃতি।

যে পাঁচজন তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন, তাঁদের ভিক্ষু নাম দেওয়া হয় এবং সংগঠন গড়া হয় ‘সঙ্ঘ’ নাম দিয়ে—এঁরা তার প্রথম সদস্য। বুদ্ধ তিন মাস বারানসীতে থাকেন। যস নামে স্থানীয় ধনী ব্যক্তি ও তাঁর বাবা-মা-স্ত্রীও বুদ্ধের শিষ্যত্ব নেন। এরপর যস-এর চার জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, পরে এঁদের পঞ্চাশ জন বন্ধু, এইভাবে মোট ষাট জন তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এঁরা ত্রুটি যুক্ত, অরহন্ত। এঁরা তিন ঐশ্বর্যের অবলম্বী—বুদ্ধ, ধৰ্ম্ম (অর্থাৎ শৃঙ্খলা ও নিয়মাদি) ও সঙ্ঘ। তাঁর নির্দেশে এঁরা ভারতের বিভিন্নদিকে বুদ্ধের কথাবার্তা প্রচার করতে ছড়িয়ে পড়েন। বুদ্ধ যান উরুবেলায়। তিনি মাথায় জটাওয়ালা জটিল নামে পরিচিত তিন সন্ন্যাসী ও তাঁদের শিষ্যদের শিক্ষা দেন এবং ‘অগ্নি উপদেশ’ (পালিতে—আদিত্ত পরিযাজ সুত্ত) দেন। বলেন, যৌনলালসা, অন্যের প্রতি ঘৃণা এবং মিথ্যা ধারণা (delusion)—এই তিন আগুনে মানুষের অস্তিত্ব পুড়ে ছারখার হচ্ছে।

উরুবেলা থেকে বুদ্ধ যান বিম্বিসারের কাছে। তিনি ও তাঁর বহু প্ৰজা বুদ্ধের শিষ্য হন। সারিপুত্ত ও মোগ্‌গল্লান নামে দুই ব্রাহ্মণ সাধুও তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এখান থেকে যান নিজ রাজ্যে কপিলবস্তুতে। বাবা, মা, কাকা, ও অন্যান্যরা তাঁর শিষ্য হন। এখানে বৃদ্ধ পিতা শুদ্ধোদন বুদ্ধকে বলেন, এমন একটা নিয়ম যেন করা হয় যাতে কোনো ছেলে তার বাবা-মা-র অনুমতি ছাড়া দীক্ষিত হবে না। বুদ্ধ এই অনুরোধ রাখেন এবং এখনো এই নিয়ম চালু আছে।

এই সময় তাঁর জ্ঞাতি ভাই ও শিষ্য আনন্দের অনুরোধে বুদ্ধ ভিক্ষুণী সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করেন। গৌতমী ও তাঁর বান্ধবীরা হলেন এর প্রথম সদস্যা। তখনকার ঐ পরিবেশে, নারীদের এই ভাবে মর্যাদা ও স্বীকৃতি দেওয়া একটি বৈপ্লবিক ব্যাপার ছিল—অবশ্য সামাজিক প্রভাবে বুদ্ধ-ও শুরুতে এ ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। (রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর ‘ভবঘুরে শাস্ত্র’-এ মন্তব্য করেছেন, “যে সব পুরুষ নারীর প্রতি অধিক উদারতা দেখিয়েছেন তাঁদের মধ্যে আমি বুদ্ধকেও একজন মনে করি। তিনি যে অনেক ব্যাপারে সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও যখন নারীর ভিক্ষুণী হবার প্রশ্ন উঠল তখন প্রথমে তিনি বড় গড়িমসি করলেন, পরে অবশ্য নিরুপায় হয়ে নারীদের সঙ্ঘে আসার অধিকার দিলেন। তাঁর অন্তিম সময়ে, নির্বাচনের দিনে, যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হলো, নারীর প্রতি ভিক্ষুর ব্যবহার কি রকম হওয়া উচিত, তখন তিনি বললেন, ‘অদর্শন’ অর্থাৎ না দেখা।”…ইত্যাদি)

দেবদত্ত নামে আরেক আত্মীয় তাঁর শিষ্য হলেও, কয়েক বছর পরেই তিনি ক্ষমতালিপ্সু হয়ে ওঠেন। বুদ্ধকে বলেন, সংঘের নেতৃপদে তাঁর নাম মনোনীত করতে। কিন্তু সঙ্ঘের প্রধান নির্বাচিত হতেন সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে—অধিকাংশের ভোটে। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল পদ্ধতির প্রায় সবকটিই তিনি ঐ সময়েই প্রয়োগ করেন। বুদ্ধ কঠোরভাবে এসব নিয়ম মানতেন এবং দেবদত্তকে নিরাশ করেন। এই দেবদত্ত বুদ্ধকে হত্যার চেষ্টা করেন তিন তিনবার, কিন্তু ব্যর্থ হন।

৮০ বছর বয়সে বুদ্ধ রাজগৃহ ছেড়ে উত্তরে যান। পথে অসংখ্য মানুষ তাঁর কাছে শিক্ষা নিতে থাকে। লিচ্ছবির রাজধানী বেসালী-তে রাজনর্তকী অম্বপালী তাঁকে উদ্যান দান করেন। তবে বুদ্ধ ওখানে না থেকে পাশের গ্রাম বেলুবাগামক-এ থাকেন। এখানে অসুস্থ হলেও ঐ অবস্থায় বেশালী ছেড়ে আরো উত্তরে পাবা-য় আসেন এবং স্বর্ণকার শিষ্য চুন্দ-র উদ্যানে থাকেন। এখানে বুদ্ধ আরো অসুস্থ হন। ওইভাবেই তিনি কুসীনারায় আসেন। এবং বৈশাখী পূর্ণিমার দিন, ৪৮৩ খ্রীস্ট-পূর্বাব্দের মে মাসে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

বুদ্ধ তাঁর নিজের যে উপলব্ধির কথা বলেন স্পষ্টত তা ঐ সময়কার পরিবেশে ছিল বৈপ্লবিক, প্রচলিত অন্যান্য ধর্মমতের তুলনায় অনেক বেশি প্রগতিশীল ও বস্তুবাদী। তিনি তাঁর এই উপলব্ধি থেকে যে-সব সিদ্ধান্ত প্রচার করেন তার মূল্যবান একটি হলো—জাতিভেদ প্রথা তথা ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়াদি চতুর্বর্ণ প্রথার বিরোধিতা। (কিন্তু অর্থনৈতিক শ্ৰেণী বিভাজনের বিরোধিতা নয়।) তিনি সব মানুষকে সমান হিসেবে গণ্য করে ভালোবাসার তথা অহিংসার কথা বলেন। প্রচলিত বৈদিক আর ব্রাহ্মণ্যধর্মের ভিত কাঁপিয়ে দিয়ে তিনি অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে মানবিক বিকাশের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথা বলেন। পূর্বজন্ম, ভাগ্য, ঈশ্বরের ইচ্ছা বা ঈশ্বর যেভাবে সৃষ্টি করেছেন ঐভাবে নয়—তিনি বলেন অপরাধ ও অনৈতিক কাজকর্ম দারিদ্র্য থেকেই সৃষ্টি হয়। তাই শাস্তি দিয়ে এসব সমস্যা দূর করা সম্ভব নয়। একমাত্র সমাধান দারিদ্র্য দূর করা।

অস্তিত্বহীন দেবতাদের সন্তুষ্ট করতে বেদে পশুবলির কথা বলা হয়েছে। এভাবে অসংখ্য গরু-মহিষাদি হত্যাও হয়েছে। কিন্তু চাষের ও খাদ্যের প্রয়োজনে গোসংরক্ষণ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। এই সামাজিক প্রয়োজনের ছাপও বুদ্ধের নির্দেশাবলীতে পাওয়া যায়– কঠোরভাবে পশুহত্যা বন্ধ করার মধ্য দিয়ে।

বুদ্ধ অলৌকিকত্বের বিরোধিতা করেছেন। তাঁর শিষ্যরা কখনো এভাবে ‘অলৌকিক ভেল্কি’ দেখিয়ে লোক ভোলালে বুদ্ধ কঠোরভাবে তা বন্ধ করেছেন। তাই বুদ্ধের জীবন সম্পর্কে নানা আপাত-অলৌকিক কাহিনীগুলো যে তাঁর শিষ্যদের দ্বারা পরবর্তীকালে প্রক্ষিপ্ত এটি মোটামুটি নিশ্চিত। তিনি উপনিষদের ও আত্মার আধিভৌতিক অস্তিত্বের বিরোধিতা করেছেন। তাঁর মতে বাস্তব কাজ আর নৈতিক জ্ঞান-এর দ্বারাই নিজের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়—আত্মার সাহায্যে নয়।

তখনকার বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আবিলতার বিরুদ্ধে বৌদ্ধধর্ম এক বৈপ্লবিক ও উদার মানবতাবাদী আদর্শ আর মূল্যবোধ নিয়ে আপামর জনসাধারণের সামনে প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের মধ্যেকার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইতে, অনেক ক্ষত্রিয় রাজা বৌদ্ধধর্মকে ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন।* এর ফলে ব্রাহ্মণদের আধিপত্য অস্বীকার করে তাঁরা নিজেরা নিজেদের স্বাধীন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। ব্রাহ্মণদের শারীরিক শ্রমহীন, সুবিধাভোগী জীবনের ওপর মনে মনে ঘৃণা পোষণকারী বহু তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে নিজের সম্মান ও মর্যাদা খুঁজে পান। (পরবর্তীকালে ইসলাম ও খ্রীস্টধর্মের ক্ষেত্রেও এ-ব্যাপার কিছুটা ঘটেছে।)

[* এ ব্যাপারে বুদ্ধের আপত্তি না থাকলেও তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল সমাজের অবহেলিত নিপীড়িত মানুষ। তাই তিনি সংস্কৃত ছেড়ে, জনগণের ভাষা ‘মাগধী’-কে মাধ্যম করেন।]

খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে সম্রাট অশোকের বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ২৬০ খ্রীস্টপূর্বাব্দের কলিঙ্গ যুদ্ধের (যাতে এক লক্ষ লোক মারা যায়) প্রতিক্রিয়ায় ও আড়াই বছরের চিন্তাভাবনার পর অশোক অহিংস মতবাদ তথা বৌদ্ধধর্মের সমর্থক হয়ে ওঠেন।

বৌদ্ধধর্মের আশ্রয় গ্রহণকারী শাসকগোষ্ঠী তাঁদের ক্ষমতা যত প্রসারিত করেছেন, ততই বৌদ্ধধর্মেরও প্রসার ঘটিয়েছেন। বহির্ভারতে ব্যবসা ও জ্ঞানের আদানপ্রদানের সময় অন্যান্য দেশেও বৌদ্ধধর্ম ছড়ায় ও অচিরে জনপ্রিয় হয়। শ্রীলঙ্কা থেকে জাপান, থাইল্যাণ্ড থেকে চীন—বিশাল এলাকার মানুষ কয়েক শতাব্দীর মধ্যে বৌদ্ধধর্মের মূল্যবোধে দীক্ষিত হয়।

১ম-২য় শতাব্দীর সময়কালে বহিরাগত (মধ্য-এশিয়ার) কুষাণ রাজারা ভারতে তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে। ব্রাহ্মণরা এই বহিরাগতদের ভালোভাবে গ্রহণ করে নি। ফলে কুষাণরা নিজেদের সুরক্ষিত করতে বৌদ্ধধর্মকে সর্বতোভাবে মদত দিতে থাকেন। এইভাবে নানা ক্ষেত্রে নিছক বৌদ্ধধর্মের উদার বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গিই নয়, শাসকশ্রেণী নিজের স্বার্থেও বৌদ্ধধর্মকে ব্যবহার করেছে (যা সব ধর্মমতের ক্ষেত্রেই কমবেশি সত্য)। এভাবে ব্যবহার করতে পারার একটি বড়ো কারণ বৌদ্ধধর্ম দারিদ্র্য দূর করার কথা বললেও কিভাবে তা হবে, সব মানুষকে সমানভাবে ভালোবাসার কথা বললেও রাজা ও অভিজাত গোষ্ঠী তথা অর্থনৈতিক শ্রেণীবিভাগ বজায় রেখে তা বাস্তবত কতটা সম্ভব, ইত্যাদি নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে সে পারে নি এবং তখনকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে তা হয়তো সম্ভবও ছিল না।

পরবর্তীকালে বুদ্ধিজীবীরা নানাভাবে বৌদ্ধধর্মের বিকাশ ঘটাতে থাকেন। অন্যত্র, ও অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় আচার-অনুষ্ঠানও অনুপ্রবেশ করে। যেমন প্রথমদিককার বৌদ্ধধর্মে সমস্ত ধরনের ব্রাহ্মণ্য আচার-অনুষ্ঠানকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে বৃক্ষপূজা ও সমাধিস্তূপ নির্মাণ বৌদ্ধরাও গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে নানা বিভাজনও ঘটে। বুদ্ধের মৃত্যুর ৪-৫ শত বছরের মধ্যে কমপক্ষে ৩০টি উপদলের সৃষ্টি হয়। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিভাজন ঘটে প্রথম খ্রীস্ট শতাব্দী সময়কালে। হীনযান মতের প্রবক্তারা ছিলেন গোঁড়া। তাঁরা বুদ্ধের বলা আচারাদি কঠোরভাবে অনুসরণ করার কথা বলেন। অন্যদিকে দক্ষিণভারতের ব্রাহ্মণ সন্তান নাগার্জুন বুদ্ধের এই সব নির্দেশকে অনেক ক্ষেত্রে বাদ দিয়ে পরিমার্জিত করেন। এবং উদার মতবাদ মহাযান মতের জন্ম দেন।

ব্যাপারটি প্রকৃতপক্ষে বোধহয় ছিল বৌদ্ধধর্মের বিপুল বিস্তারকে রোধ করতে না পেরে, ব্রাহ্মণদের দ্বারা তাকে নিজেদের মতো করে গ্রহণীয় করে তোলার একটা প্রচেষ্টা। বুদ্ধ কোনো দেবতার কথা বলেন নি। কিন্তু স্থানীয় নানা গোষ্ঠীর মধ্যে দেব-দেবীর ধারণা প্রতিষ্ঠিত ছিল। বুদ্ধ তথা হীনযানীরা কোনো ব্যক্তির নির্বাণের জন্য নিজেরই কঠোর প্রচেষ্টার কথা বলতেন। কিন্তু মহাযানীরা বলেন, সাধারণ মানুষের কাছে তা খুবই দুরূহ ও কষ্টকর। তাই এক মাধ্যম দরকার—ইনিই দেবতা। মহাযানীদের হাতে গৌতম বুদ্ধও দেবতার আসন পেলেন। তাদের মধ্যে বেদ-ব্রাহ্মণদের দেবতারা এবং পরবর্তীকালে অন্যান্য দেশের স্থানীয় দেবতারাও আছে। এইভাবে মহাযানীরা স্থানীয় মানুষদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত দেবতাদের অস্বীকার না করেই বৌদ্ধমতে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন। এরকম প্রায় হাজারখানেক বুদ্ধের কল্পনা করা হয়—এদের এদের মধ্যে গৌতমবুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের প্রবক্তা (এবং একমাত্র ঐতিহাসিক চরিত্র), আগামী পৃথিবীর বুদ্ধ হচ্ছেন মৈত্রেয়; বজ্রপাণি হচ্ছেন সর্বশেষ বুদ্ধ; মঞ্জুশ্রী সবচেয়ে জ্ঞানী; আদি বুদ্ধ হচ্ছেন এই পৃথিবীর স্রষ্টা; স্বর্গের অধিপতি হচ্ছেন অমিতাভ ইত্যাদি। এদের ছাড়া বোধিসত্বদেরও পূজা করা হয় মহাযানমতে। মহাযানীরা আরেকটি জনপ্রিয় সংযোজন করেছিলেন, সেটি হলো—গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী না হয়েও নির্বাণ লাভ সম্ভব-এ-ধরনের ধারণার প্রচার। কিন্তু এ-সব সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ তাদের এতদিনকার সংস্কার ও বিশ্বাসের প্রভাবে, অনেক ক্ষেত্রেই বৌদ্ধধর্মকে গ্রহণ করায় দ্বিধান্বিত হয়েছিল। মহাযানীরা সরল বিশ্বাসী অজ্ঞ মানুষদের এ-ধরনের দ্বিধা কাটাতে স্বর্গ-নরকের রহস্যময় কিন্তু জনপ্রিয় কথাবার্তা বৌদ্ধধর্মে ঢোকান–যা বুদ্ধ কখনোই বলেন নি।

চীনে প্রথম শতাব্দীতেই হীনযান মত অনুপ্রবেশ করে। কিন্তু পঞ্চম শতাব্দীতে এর বদলে মহাযান মত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সপ্তম শতাব্দীতে, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে তিব্বত অঞ্চলে মহাযান মত প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে এবং এখানে পদ্মসম্ভবের হাতে ধীরে ধীরে নানা রহস্যময় ক্রিয়াকাণ্ড তথা তন্ত্র বৌদ্ধধর্মে ঢুকতে থাকে। একাদশ শতাব্দীতে এই সংমিশ্রণের কাজ প্রায় পূর্ণতা লাভ করে। দ্বিধাহীন আনুগত্য আর সীমাহীন কুংসংস্কারের জালে তাদের আটকে দলাই লামা হয়ে ওঠেন তিব্বতীদের শাসক–যিনি একসময় নিজের মলকে পর্যন্ত শুকিয়ে বড়ি করে রোগগ্রস্ত সরল বিশ্বাসী তিব্বতীদের দিতেন ওষুধ হিসেবে। এই দলাই লামাকে বলা হয় বোধিসত্ত্বের অবতার বা প্রতিভূ, কিন্তু জাগতিক কাজের দায়িত্ব প্রাপ্ত। প্রজাদের শাসন-শোষণের ক্ষেত্রে দলাই লামার ভূমিকাই ছিল প্রধান। ধর্মের আবরণে ক্ষমতার প্রসার তিব্বত থেকে অন্যত্র ঘটতে থাকে, একই সঙ্গে লামা-তন্ত্রের প্রসারও।

বিভিন্ন দেশে, বিশেষত এশিয়ার দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে এখনও বিপুল সংখ্যক বৌদ্ধধর্মালম্বী রয়েছেন। কিন্তু একইসঙ্গে রয়েছে তাদের অজস্র দল-উপদল। একদা প্রাচীন ভারত অন্যত্র তার ব্যবসায়িক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের অন্যতম অনুসঙ্গ হিসেবে বৌদ্ধধর্মকে ব্যবহার করেছে (এবং কিছুটা হিন্দুধর্মকেও)। কিন্তু বর্তমান সময়কালে বৌদ্ধধম্মাবলম্বীদের এই ভূমিকা নেই বললেই চলে। পাশাপাশি চীন-ভিয়েতনাম সহ এশিয়ার নানা দেশে, বহু মানুষ তথাকথিত ধর্মবিশ্বাস থেকে মুক্ত হয়ে ওঠারও চেষ্টা করছেন। শাসক গোষ্ঠী তার আধিপত্যবাদকে সফল করতে ধর্মকেও নিজের মতো করে গড়ে তোলে, এবং ব্যবহার করে। বৌদ্ধধর্মও তার ব্যতিক্রম হয় নি।

বৌদ্ধধর্মের প্রাথমিক মুক্ত চিন্তা আর তৎকালের প্রগতিশীল তত্ত্বগুলি সংস্কারমুক্ত ব্যক্তিদের চিন্তার খোরাকি জোগাবে। আজ আড়াই হাজার বছর পরে ধর্মপ্রসঙ্গে যুগোপযোগী বৈজ্ঞানিক মতাদর্শ কি হবে তা ঠিক করার ক্ষেত্রেও যথাসম্ভব এই ধর্মভাবনা খোরাক জোগাবে।

পাশাপাশি জাতপাতহীন, বর্ণভেদ বিরোধী ও উদার মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্মে সমাজের অসংখ্য নিপীড়িত মানুষ আশ্রয়ও নিয়েছেন।* ব্ৰাহ্মণ তথা হিন্দুদের সামাজিক অত্যাচার থেকে মুক্তির এ ছিল একটি পথ। পরবর্তীকালে ভারতে বৌদ্ধরাও আগ্রাসী ধর্মান্ধ হিন্দুত্বের ভয়ে দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। (মুণ্ডিত মস্তক এই বৌদ্ধদের জন্যই তথাকথিত হিন্দুরা ব্যঙ্গার্থে মুসলিম বোঝাতে ‘নেড়ে’ কথাটি চালু করেছে।)

[* একই ঘটনা সাম্প্রতিক ভারতেও ঘটেছে। ১৯৫১-তে ভারতে বৌদ্ধ ছিলেন মাত্র ২৪৮৭ জন। ১৯৬১-তে তা হয়েছে ৩২৫০২২৭। মহারাষ্ট্রের গ্রামাঞ্চলের ২০ লক্ষ বৌদ্ধের সবাই আগে ছিলেন অস্পৃশ্য ও তপশিলী শ্ৰেণীভূক্ত মানুষ।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *