নাস্তিকতা, নিরীশ্বরবাদ ও অধার্মিকতা

নাস্তিকতা, নিরীশ্বরবাদ বা অধার্মিকতা

নাস্তিকতা বা অধার্মিকতা প্রচলিত অর্থের বিশেষ আরেকটি ধর্ম নয়-বরং ধর্মের বিপরীত একটি দিক। উপযুক্ত পরিভাষার অভাবে এই দিকটিকে এমন নেতিবাচকভাবে পরিচিত করাতে হয়। তার প্রধান কারণ মানুষের চেতনায় এই দিকটি বিকশিত হয়েছে ঈশ্বরবিশ্বাস বা আস্তিকতা তথা ধার্মিকতার পরবর্তীকালে।

একটি শিশু তার অসম্পূর্ণ জ্ঞান ও পারিপার্শ্বিকের কাছে অসহায়তার জন্য নানা ঘটনার পেছনে অবাস্তব, মিথ্যা নানা কিছুর কল্পনা করে। রহস্যময় একটি শক্তি তথা ভূত-প্রেত, অলৌকিক ক্ষমতাধর কোনো কিছুর চিন্তা তার মাথায় ঢোকে। চারপাশের বয়স্করা এই কল্পনাকে শক্তিশালী করে দেয়। মানবসভ্যতার শৈশবকালেও মানুষ একইভাবে অলৌকিক, অতিপ্রাকৃত শক্তির কল্পনা করেছে; সৃষ্টি হয়েছে ঈশ্বর চিন্তা, ধর্মবিশ্বাস ইত্যাদি।

সবাই না হলেও, অনেক শিশুই বড় হয়ে তার শৈশবের মিথ্যা কল্পনাগুলিকে দূর করতে পারে। জ্ঞান ও যুক্তিবোধ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে সত্যকে জানে বা জানার চেষ্টা করে। একইভাবে, মানবসভ্যতা সময়ের পথ বেয়ে এগিয়ে চলার সময়, কিছু মানুষ আগেকার কাল্পনিক নানা ধারণার ভ্রান্তিকে বুঝতে পারে এবং ঈশ্বর ও ঈশ্বর-কেন্দ্রিক ধর্মের কাল্পনিক ভিত্তি সম্পর্কে সচেতন হয়। তখন আগেকার কল্পনাকে অস্বীকার করেই তার সত্য-উপলব্ধি বা জ্ঞানকে প্রকাশ করতে হয়। কিন্তু ততদিনে ঈশ্বর, ধর্ম ইত্যাদি সামাজিক ও চেতনাগত যেমন, তেমনি ভাষাগত ভিত্তিও পেয়ে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে এই অস্বীকারের ব্যাপারটা নেতিবাচকভাবেই প্রকাশ করতে হয়। একটি শিশু বড় হয়ে যাওয়ার পরও, অর্থাৎ একটি পূর্ণবয়স্ক মানুষ যেমন বালখিল্যসুলভ নানা মিথ্যা বিশ্বাস, অলৌকিক অতিপ্রাকৃতিকে আস্থা ইত্যাদি বজায় রাখতে পারে, তেমনি মানব সভ্যতাও তার শৈশব পেরিয়ে বহুদূর চলে এলেও তার কিয়দংশে এখনো ঈশ্বর ও ধর্মবিশ্বাস টিকে আছে।

নাস্তিকতা (atheism)-এর কাছাকাছি আরেকটি চিন্তা হলো অজ্ঞাবাদ বা অ্যাগনস্টিসিজম (agnosticism )। নাস্তিকতা ঈশ্বর বা এই জাতীয় কোনো শক্তির অস্তিত্বকে স্পষ্ট ও সম্পূর্ণভাবে সরাসরি অস্বীকার করে; অন্যদিকে অ্যাগনস্টিসিজম-এ ‘ঈশ্বর আছে কি নেই’ এ ধরনের প্রশ্ন উত্তরের অতীত বা এ-ধরনের প্রশ্ন করাই ভিত্তিহীন,–এভাবে ব্যাপারটিকে হাজির করা হয়। অজ্ঞাবাদীদের কাছে নিজস্ব অভিজ্ঞতার বাইরে কোনো কিছুর অস্তিত্ব সম্পর্কে কোনো কিছু জানা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। গ্রীক শব্দ ‘অ্যাগনস্টস’ থেকে এর উৎপত্তি, ‘অ্যাগনস্টস’ কথাটির অর্থ ‘অজ্ঞেয়’। ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দে টমাস হাক্সলি একটি ভিন্নতর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক হিসেবে কথাটির ব্যবহার শুরু করেন, এই দৃষ্টিভঙ্গি ইহুদি ও খ্রীষ্টধর্মের ঈশ্বর বিশ্বাসের বিরোধী, আবার চূড়ান্ত নাস্তিকতা থেকেও ভিন্ন। ধর্ম ও ঈশ্বরের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আরেকটি যে দার্শনিক চিন্তাধারা বিকশিত হয়েছে তা হলো সন্দেহবাদ (skepticism); কোনো কিছুকে অন্ধভাবে বিশ্বাস না করে,—প্রশ্ন তোলা, সন্দেহ করা, বিতর্ক করা ইত্যাদি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হওয়ার কথা এতে বলা হয়। ল্যাটিন শব্দ scepticus বা গ্রীক skeptikos -এর অর্থ অনুসন্ধান বা enquiring ।

দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির তথা মানুষের চিন্তাভাবনার প্রক্রিয়ার শ্রেণীবিভাগের ফলে, অভিজ্ঞতাবাদ (empiricism)-এর বিপরীতে যুক্তিবাদ (rationalism)-ও সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত হয়েছে। যুক্তিবাদী চিন্তায়, জ্ঞানের উৎস ও কোনো বিশেষ কিছু সম্পর্কে জ্ঞানের একমাত্র পরীক্ষা বা প্ৰমাণ হলো যুক্তি ও কারণ (reason )। সব কিছুর পেছনেই যুক্তি থাকবে,—যুক্তিহীন কোনো বিশ্বাস বা জ্ঞান আসলে অজ্ঞতা। তাই ঈশ্বর, আত্মা, অলৌকিক ক্ষমতা ও ঘটনা ইত্যাদি জাতীয় নানা কল্পনার পেছনে যদি যুক্তি না থাকে, তবে এগুলি অজ্ঞতারই পরিচায়ক। আবার, যুক্তিবাদী চিন্তা প্রক্রিয়ায়, কেউ যদি কারণ দেখিয়ে, যুক্তি দিয়ে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব সত্যিই প্রমাণ করে, তবে তা গ্রহণযোগ্য।

এই সব দার্শনিক পদ্ধতির পাশাপাশি নাস্তিক্যবাদ (atheism) ঈশ্বর বা এই জাতীয় ঐশ্বরিক শক্তির অস্তিত্বকে সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করে। এই চিন্তার বিকাশে অজ্ঞাবাদ, সন্দেহবাদ, যুক্তিবাদ ইত্যাদি পদ্ধতি অবশ্যই পুষ্টি জুগিয়েছে। তবে ইয়োরোপে নাস্তিক্যবাদের ইতিহাস অতি প্রাচীন। প্লেটোর প্রায় সমকালীন, ডেমোক্রিটাস ও এপিকুরাস (খ্রী. পূ. ৩৪১—২90 ) নাস্তিক্যবাদের সমর্থনে যুক্তিবিন্যাস করেন এবং বস্তুবাদ—তথা নাস্তিক্যবাদ-বিরোধী প্লেটোর সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হন। এই ডেমোক্রিটাসদের চিন্তাতেই বস্তুবাদ (materialism) ( যথাসম্ভব প্রথম) আভাসিত হয়। এইভাবে, পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা গ্রীক সভ্যতায় এবং তার ধারাবাহিকতায় বিকশিত পাশ্চাত্য পরিমন্ডলে, ঈশ্বর জাতীয় কোনো কিছুর আদিম কল্পনাকে অস্বীকার করে, প্রকৃত সত্য জানার প্রচেষ্টা হয়েছিল অন্তত আড়াই হাজার বছর আগেই।

এবং মোটামুটি এই সময়কাল থেকেই, পৃথিবীর আরেক প্রাচীন সভ্যতা, যা ভারতীয় ভূখন্ডে বিকশিত হয়েছে, সেখানেও ঈশ্বর সম্পর্কিত কল্পনার বিরোধী চিন্তা বিকশিত হয়েছে এবং নানা দার্শনিক মত ও ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছে। ভারতীয় সভ্যতা মানেই ঈশ্বর, ব্রহ্ম ইত্যাদি সহ যাবতীয় ভাববাদী চিন্তায় পরিপূর্ণ—এধরনের ধারণা ও প্রচার যে মিথ্যা তা এখন প্রমাণিত। বেদ-উপনিষদ-রামায়ণ-মহাভারতের মতো প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য, যা প্রকৃত অর্থে ধর্মশাস্ত্রেরই নামান্তর, সেগুলিতে এ-ধরনের মত ও ব্যক্তির উল্লেখ সংক্ষিপ্ত হলেও রয়েছে। প্রচলিত ধর্মবিরোধী ও ঈশ্বর চিন্তা-বিরোধী এই সব মত ও ব্যক্তিরা সমাজে একটি ক্ষুদ্রতর শক্তি হলেও, উল্লেখযোগ্য শক্তি হিসেবে ছিলই এবং তাকে অস্বীকার করা সম্ভব হয় নি। জনসমক্ষে তাঁদের হেয় করতে ও তাঁদের চিন্তাপদ্ধতির বিরোধিতা করার জন্য ঐ সব ধর্মগ্রন্থে এঁদেরও স্থান দিতে হয়েছে। কিন্তু ঈশ্বরকেন্দ্রিক ধর্মচিন্তার শক্তি ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি ও অনেক প্রভাবশালী, তার বিরোধী চিন্তা ঐভাবে বিশেষ কোনো গ্রন্থাকারে পাওয়া যায় না,—বিচ্ছিন্নভাবে কিছু লেখাপত্র ছাড়া। কিংবা তাদের বিকৃত করা হয়েছে।

চরকসংহিতায় যুক্তিবাদী, বস্তুবাদী চিন্তার আভাস পাওয়া যায়। ‘অনুমান’ করার পদ্ধতি হিসেবে বলা হয়েছে, যা আগে দেখা গেছে, সে সম্পর্কে বা তার ওপর ভিত্তি করেই কেবল পরবর্তী অনুমান করা যায়। এ কারণে, আত্মা, কর্মফল, জন্মান্তর জাতীয় যে-ব্যাপারগুলির পেছনে আগে দেখা কোনো কিছু জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নেই, সেগুলি প্রকৃত অনুমান নয়, নিছক কল্পনা। তবে পারিপার্শ্বিক পুরোহিত ও শাসকগোষ্ঠী প্রবল শক্তিশালী থাকায়, চরকসংহিতায় সরাসরি এভাবে ঈশ্বর, আত্মা, কর্মফল জাতীয় ব্যাপারগুলিকে অস্বীকার করা হয় নি; কিছুটা কৌশল ও আপস করতে হয়েছে।*

[*আনুমানিক ১০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে আয়ুর্বেদ রচিত হয়েছিল-যা অনেকের মতে অথর্ববেদেরই একটি শাখা। বহু জনের বহুদিনের অভিজ্ঞতার সারসংলন এই আয়ুর্বেদ। এর থেকে অগ্নিবেশ-এর দ্বারা অগ্নিবেশতন্ত্র রচিত হয়। পরে ৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ সময়কালে আত্রেয় ও সুশ্রুত নিজস্ব সংহিতা রচনা করেন। চরক এঁদের পরবর্তী; তিনি ৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ ২০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যবর্তী কোন সময়ে যথাসম্ভব কাশ্মীরে জন্মগ্রহণ করেন। চরক এবং দৃঢ়বল নামে আরেক চিকিৎসক অগ্নিবেশত অবলম্বনে চরক সাহিত্য রচনা করেন। আত্রেয় ছিলেন চিকিৎসাবিদ্যা (Medicine) ও সুশ্রুত শলাবিদ্যায় (Surgery) পারদর্শী। ঔপধেনব, ঔরভ্র, পুষ্কলাবত, নাগার্জুন প্রমুখের দ্বারা সংহিতার সংস্কার ও পরিমার্জনা হয়। বৈদিক আমলের তুলনায় ব্রাহ্মণ্য যুগে নানা কুসংস্কার ও ভাববাদী মানসিকতা দৃঢ়মূল হতে থাকে এবং চিকিৎসাবিদ্যা, বিশেষতঃ শল্যবিদ্যাকে, হতমান ও ঘৃণ্য কাজ হিসেবে গণ্য করার কাজ শুরু হয়। (বৌদ্ধ যুগের অহিংসার তত্ত্বও শল্যবিদ্যার বাধাস্বরূপ হয়।) ব্রাহ্মণ্য মানসিকতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে, ও তার ধারাবাহিকতায় প্রাচীন ভারতীয় এই সব চিকিৎসা গ্রন্থের বস্তুবাদী দিকগুলির বিকৃতি সাধন করা হতে থাকে।]

এছাড়া প্রাচীন ভারতীয় ন্যায় ও সাংখ্য দর্শনেও অনুরূপ প্রত্যক্ষ নির্ভর যুক্তিবাদী অনুমান পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, প্রাচীন ভারতে হিন্দুদের দার্শনিক চিন্তা পদ্ধতি অন্তত ছয়টি শাখায় সুসংহত হয়। এগুলি হল ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য, যোগ, মীমাংসা ও বেদান্ত। গুপ্ত যুগে অর্থাৎ হিন্দুধর্ম প্রতিষ্ঠার তথাকথিত স্বর্ণযুগে (৩১৯-২০ খ্রীষ্টাব্দে চন্দ্রগুপ্ত-১-এর দ্বারা যার সূচনা) এই ছয়টি দার্শনিক পদ্ধতি তার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি অর্জন করে, কিন্তু এগুলির ভিত্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল অনেক আগেই,—হয়তো বা বেদ-উপনিষদের আমলেই। এদের মধ্যে সাংখ্য দর্শন মূলত ছিল নিরীশ্বরবাদী বা নাস্তিক্য দর্শন; তবে বস্তু ও আত্মার দ্বৈতভাব এতে স্বীকৃত। ন্যায় ছিল মূলত যুক্তিবাদী-কল্পনা, ভাববাদী চিন্তার প্রশ্রয় এতে ছিল না; যুক্তি তর্ক ছাড়া কোন কিছুকে গ্রহণ করার ছিল না। অবশ্য ন্যায় সৃষ্টি হয়েছিল প্রধানত বৌদ্ধ দার্শনিক ও অধ্যাপকদের যুক্তিবাদী কথাবার্তাকে খন্ডন করে, তাঁদের সঙ্গে যথার্থ বিতর্ক করার জন্য। বৈশেষিক দর্শনও অন্তত বস্তুবাদী দর্শন ছিল; এতে বলা হয় বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পরমাণু দিয়ে তৈরী এবং তা আত্মা নয়। অবশ্য পরে বস্তু ও আত্মার আলাদা জগতের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছিল। যোগ-এর বক্তব্য ছিল শরীর মন ও অনুভূতির যথার্থ নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়েই চরম সত্য উপলব্ধি করা যায়। এইভাবে ধ্যান, পূজা, যজ্ঞ, প্রার্থনা জাতীয় কাজের উপযোগিতা পরোক্ষভাবে অস্বীকার করা হয়। এই দর্শনেও অন্তত কিছুটা বস্তুবাদী চিন্তার আভাস রয়েছে। মীমাংসার মধ্যেও অনেকে বস্তুবাদের লক্ষণ অনুভব করেন, তবে এটির সৃষ্টি হয় বেদ-কে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য; ব্রাহ্মণদের তথাকথিত শ্রেষ্ঠত্বের উৎস যে বেদ, ঐ বেদ-এর মূল অনুশাসনকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, যে মহিমা বৌদ্ধ ও জৈন দর্শন সহ নানা বস্তুবাদী ও নিরীশ্বরবাদী দর্শনের সাহায্যে খর্ব হয়েছিল; মীমাংসার প্রধান সমর্থন ছিল গোঁড়া ব্রাহ্মণেরা। (আর বেদান্ত ছিল চূড়ান্তভাবে বস্তুবাদ বিরোধী বা নিরীশ্বরবাদী চিন্তার বিরোধী। অব্রাহ্মণ্য সমস্ত চিন্তাভাবনাকে প্রবলভাবে অস্বীকার করে এর প্রতিষ্ঠা। সবই মায়া, সমস্ত কিছুর মধ্যে পরমাত্মার অস্তিত্ব রয়েছে এবং এই পরমাত্মার সঙ্গে মিলনই প্রতি মানুষের অস্তিত্বের চূড়ান্ত লক্ষ্য—ইত্যাদি ধরনের কথাবার্তা এটি প্রচার করে। স্পষ্টতঃই হিন্দুধর্ম প্রতিষ্ঠার ঐ অনুকূল সময়ে এই দর্শনই ব্যাপক প্রচার লাভ করে, হিন্দু শাসকগোষ্ঠী এর সমর্থনে এগিয়ে আসেন এবং জনমানসে তার শিকড় গেড়ে দেওয়ার সমস্ত প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মত ব্যক্তিরা বৈদান্ত দর্শনকে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত একটি দর্শন হিসেবে অভিহিত করেছেন।*

[* “বেদান্ত ও সাংখ্য দর্শন যে ভ্রান্ত দর্শন, এ সম্বন্ধে এখন আর মতদ্বৈধ নাই। মিথ্যা হইলেও হিন্দুদের কাছে এই দর্শন অসাধারণ শ্রদ্ধার জিনিস।” ইত্যাদি (শ্রী প্রমথনাথ বিশী সম্পাদিত ‘বিদ্যাসাগর রচনা সম্ভার’ থেকে)]

ভারতের উত্তর ও উত্তরপূর্বাঞ্চলে ক্রমঅগ্রসরমান বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতিক্রিয়ায়, খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে নাস্তিকবাদী-তথা নিরীশ্বরবাদী চিন্তা বিকশিত হয়েছিল। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সঞ্চয় বেলাথিপুত্তের নেতৃত্বে সন্দেহবাদ যা ছিল বেদবিরোধী ও নিরীশ্বরবাদী এবং অনেক পরে পাশ্চাত্ত্যে বিকশিত সন্দেহবাদের যা ছিল প্রায় সমগোত্রীয়।

খ্রীষ্টপূর্ব ৫ম-৩য় শতাব্দীর সময়ে নাস্তিকবাদী আরেকটি যে মতবাদ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল সেটি হল নিয়তিবাদ। আজীবিক বা অর্জীবক সম্প্রদায় ছিল এর প্রবক্তা। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গোশাল মংঞ্চলিপুত্র (ভিন্ন মতে বা ভিন্ন নামে অজিবিকাশ!)। ইনি মহাবীরের বন্ধু ছিলেন, তবে জৈনরা ও বিশেষ করে বৌদ্ধরা এঁদের বিরোধীতা করেছেন। গৌতমবুদ্ধের মৃত্যুর কিছুদিন আগে, সম্ভবত ৪৮৪ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে মংথলিপুত্রের মৃত্যু হয়। তাঁর প্রচারিত নিয়তিবাদ অনুযায়ী সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তথা মানুষ থেকে একটি ধূলিকণা পর্যন্ত—সবকিছুই পূর্ব নির্ধারিত অর্থাৎ নিয়তির দ্বারা পূর্ব নির্দিষ্ট; মানুষ তার সৎকাজে ও কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা তার ‘ভাগ্য’ নিয়ন্ত্রণ বা পরিবর্তন করতে পারে না (অর্থাৎ যাগযজ্ঞ, ধ্যান, পূজা, ব্রাহ্মণভোজন বা গোদান, আরাধনা ও প্রার্থনা ইত্যাদি মানুষের নিয়তির পরিবর্তন ঘটাতে পারে না)। তাঁদের মতে, সবাইকেই দুঃখের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ৮৪ লক্ষ বার জন্মগ্রহণ করতে হয়। স্পষ্টতঃই কয়েক শতাব্দী ধরে জনপ্রিয় এই বেদবিরোধী, ঈশ্বরবিরোধী কল্পিত (তথা মিথ্যা)আবিষ্কারগুলি পরবর্তী কালে তথাকথিত হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্মেও কিছুটা প্রভাব ফেলে,—অন্তত, তার চমকপ্রদ, জনপ্রিয় অংশগুলি থেকে যায়। ‘নিয়তি কেন বাধ্যতে’ বা জাতকের গল্পগুলি হয়তো এসবেরই প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি।

এছাড়া পুকুত কাত্যায়নের নেতৃত্বে কণাবাদ, অজিত কেসকম্বলিনের নেতৃত্বে বস্তুবাদ, পুরণ কাসপ-এর নেতৃত্বে নীতিশাস্ত্রবিরোধী (antinomian) মতবাদ ইত্যাদিও যে গড়ে উঠেছিল তা আগে বৌদ্ধধর্ম আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছিল। ঐ সামাজিক পরিবেশে প্রচলিত ধর্ম ও ঈশ্বরবিশ্বাসের প্রতি মানুষের ঘৃণা বা মোহমুক্তির অন্যতম বহিঃপ্রকাশ ছিল এগুলি। আর তার অন্যতম সুসংহত রূপ ছিল বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্মের বিকাশ। এ সবের প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব যে পরবর্তীকালে সাংখ্য, ন্যায়, বৈশেষিক ইত্যাদি দর্শনের বিকাশে কাজ করেছে তা স্পষ্ট।

(এবং এখন থেকে আড়াই হাজার বছর আগে ভারতীয় ভূখন্ডে যে নতুন অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিকাশ ও বিবর্তন ঘটছিল, তার সঙ্গেই নিঃসন্দেহে সম্পর্কযুক্ত ছিল এই ব্যাপক বেদ-ব্রাহ্মণবিরোধী, নাস্তিক্যবাদী-নিরীশ্বরবাদী চিন্তা। অবশ্য তা সমাজের চালিকাশক্তির ভূমিকা নিতে পেরেছিল কিনা বা গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলো কিনা তা যথাসম্ভব এখনো অমীমাংসিত।)

এসবের আগে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে স্বভাববাদ ও ভূতবাদ নামে দুই চিন্তাপদ্ধতির উল্লেখ আছে। স্বভাববাদ অনুযায়ী কোনো বস্তুর নিজস্ব গুণ বা স্বভাবের জন্যই সবকিছু ঘটে থাকে, এই স্বভাবের বাইরে কোনো কিছু ঘটাও সম্ভব নয়। পৃথিবীর তথা বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সবকিছু তার নিজস্ব গুণাবলী নিয়েই চলছে। বাতাস বইছে, জল তরল বা লোহা শক্ত,—এগুলির গুণই তাই, কেউ সৃষ্টি করেছে বলে এগুলি এরকম নয়। স্বভাববাদের সঙ্গে প্রায় অভিন্ন হচ্ছে ভূতবাদ। ভূতবাদীরা চরম বস্তুবাদী; ভূতবস্তু ছাড়া অন্যকিছু তাঁদের কাছে গণ্য নয়। এঁরা অদৃষ্ট তথা কর্মফলে সামান্যতম বিশ্বাসও করেন না, যুক্তিবাদী চিন্তায় তাঁরা আপসহীন।

এবং এই বস্তুবাদী চিন্তাপদ্ধতির অন্যতম সুসংহত একটি রূপ হচ্ছে লোকায়ত দর্শন তথা চার্বাকবাদ। এই দর্শন মহাভারতের আমলেই একটি প্রতিষ্ঠিত রূপ পেয়ে গিয়েছিল। মহাভারতে একাধিক স্থানে এই দর্শন ও তার অনুসারী ব্যক্তির উল্লেখ রয়েছে,—অবশ্যই হতমান-অপমান করে। শঙ্করাচার্য থেকে শুরু করে তাবড় তাবড় ভাববাদী দার্শনিকেরাও এই বস্তুবাদী দর্শনকে অবিরাম গালাগালি করে গেছেন। কিন্তু এ-থেকে যা স্পষ্ট তা হলো, এই দর্শন শাসকগোষ্ঠীর দর্শন নয়, এটি সাধারণ মানুষের অর্থাৎ সাধারণের চিন্তা, তাদের দৈনন্দিন জীবনসংগ্রামের দর্শন। লোকগাথা হিসেবে এই দর্শনের নানা বক্তব্য ছড়িয়ে ছিল। ‘সবদর্শন সংগ্রহে’ মাধবাচার্য তার একটি সংকলন প্রকাশ করেছিলেন। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে’ গ্রন্থ থেকে এগুলির কয়েকটির অনুবাদ এখানে সামান্য পরিবর্তিত আকারে উল্লেখ করা যায়। বলা হয়েছে :

‘স্বর্গ, মুক্তি, পরলোকগামী আত্মা বলে কিছু নেই। বর্ণাশ্রম অনুযায়ী করা ক্রিয়াকান্ড নিতান্তই নিষ্ফল।

‘যাদের বুদ্ধি নেই, পরিশ্রম করার ক্ষমতা (বা ইচ্ছা) নেই, তারাই বা তাদেরই জন্য, যজ্ঞ, বেদ, দন্ড ধরে গায়ে ছাই লেপে সন্ন্যাসীর ভেক,—এসব সৃষ্টি করেছে বা করা হয়েছে।

‘যজ্ঞে নিহত প্রাণী স্বর্গে যায় বলে বলা হয়। তাহলে এমন যজ্ঞে যজমান তার পিতা (এবং প্রিয়জনকে) মারে না কেন–তাহলে তো তারা সরাসরি স্বর্গে যেতে পারে।

‘কেউ মারা গেলে তার শ্রাদ্ধ করলে যদি তার তৃপ্তি হয়, তবে প্রদীপ নিভে যাওয়ার পর তেল ঢাললে তার আবার জ্বলে ওঠার কথা।

‘মারা যাওয়ার পর কারোর উদ্দেশ্যে পিন্ড দেওয়া মিথ্যা, তা না হলে তো কেউ বিদেশে গেলে তার উদ্দেশ্যে ঘরে বসে পিন্ড দিলেই তার খিদে মিটে যাওয়ার কথা।

‘ব্রাহ্মণদের জীবিকা হিসেবেই শ্রাদ্ধ, প্রেতকর্ম ইত্যাদির ব্যবস্থা,—এছাড়া এসবের অন্য কোনো উপযোগিতা নেই।

‘অর্থহীন বেদমন্ত্র ধূর্ত পণ্ডিতের কথাবার্তা; যারা এ-সব রচনা করেছে তারা ভণ্ড, ধূর্ত ও চোর’… ইত্যাদি ইত্যাদি।

এ সবের মধ্যে সরাসরি ঈশ্বরের অস্তিত্বকে বাতিল না করলেও পরোক্ষভাবে ঐ কল্পিত পরমাত্মাকে কখনো স্বীকারও করা হয় নি।

একইভাবে অজিত কেশকম্বলিন মানুষের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন,—

“মানুষ চারটি মূল পদার্থ দিয়ে তৈরী। (মাটি, জল, আগুন, বায়ু।) মৃত্যুর পর মাটি চলে যায় মাটিতে। জল চলে যায় জলে। আগুন মেশে আগুনে। বায়ু উড়ে যায় বায়ুতে। আর তার চেতনা বিলীন হয় মহাশূন্যে। চারজন শববাহক মৃতদেহ নিয়ে যায় শ্মশানে। শববাহকরা যতক্ষণ গল্প করতে থাকে ততক্ষণে মানুষটির হাড়গুলি পুড়ে বনকপোতের ডানার রঙ পায়। তার জীবনের সমস্ত দাগের হিসেব পুড়ে ছাই হয়। যারা ভিক্ষাদানের উপদেশ দেয় তারা নির্বোধ। যারা দেহোত্তর অস্তিত্বের কথা বলে, তারা মিথ্যা রাগবিস্তার করে, শরীরের যখন মৃত্যু হয়, মূর্খ আর জ্ঞানী সকলেই সমানভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মৃত্যুর পর কিছু বাকী থাকে না।” (কৃষ্ণা গুপ্ত অনূদিত রোমিলা থাপারের ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত। মূল উৎস-দিঘনিকায়, প্রথম, ৫৫; অনুবাদ-এ হল ব্যাশাম, দি ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া)

প্রাচীন ভারতীয় ধর্মগ্রন্থে এই ধরনের নানা প্রতিবাদী চরিত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়, যারা বেদ, ব্রাহ্মণ, ঈশ্বর, আত্মা স্বর্গ বা পরলোক, জন্মান্তর, কর্মফল জাতীয় ষড়যন্ত্রমূলক বা কল্পনাভিত্তিক প্রচারের বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। কণাদ (ভিন্ন নাম উলুক) যে দর্শনের প্রচার করেন তাতে ঈশ্বরের কোনো উল্লেখ নেই। তাই অনেকে কণাদ-দর্শনকে নাস্তিক্য দর্শন হিসেবেই গণ্য করেন। শুক্রাচার্য, কপিল প্রমুখ পৌরাণিক চরিত্ররাও নাস্তিক্যবাদ তথা বেদবিরোধী বক্তব্য তুলে ধরেছেন। মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণের পিসতুত ভাই অরেষ্টনেমী-ও বেদবিরোধী বক্তব্য (যা হিন্দুদের মতে নাস্তিক্যবাদ) তুলে ধরেছিলেন। পরেশনাথও ছিলেন এমনই এক প্রাচীন ভারতীয় ব্যক্তিত্ব। ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজা পরীক্ষিৎ ও মণ্ডুকরাজ আয়ুর কন্যা সুশোভনার এক পুত্র ছিলেন বল–ইনি ছিলেন চরম ব্রাহ্মণ-বিদ্বেষী। এছাড়া খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে বুদ্ধ, মহাবীর প্রমুখ মনীষীরাও বেদ-ব্রাহ্মণ বিরোধী চিন্তার প্রচার করেন। চার্বাককেও বলা হয় দেবগুরু বৃহস্পতির শিষ্য। অবশ্য বৃহস্পতি নাকি দৈত্যদের বিনাশ করার জন্যই তাদের মধ্যে এমন তথাকথিত ‘বেদ-বিরোধী লোকায়ত তথা বস্তুবাদী’ দর্শনের প্রচার করেন। স্পষ্টতঃই, এমন কাহিনী প্রচারের উদ্দেশ্য ছিল জনসমক্ষে বস্তুবাদী দর্শনকে হেয় করা। যেন—বস্তুবাদী দর্শনে বিশ্বাস করা মানেই নিজের সর্বনাশ করা।

ইউরোপীয় পরিমণ্ডলে বস্তুবাদী চিন্তা ও নাস্তিক্য দর্শন নানা সময়ে বিকশিত হলেও, ভারতীয় পরিমণ্ডলের মতো এতটা চূড়ান্ত বিরোধিতা, লাঞ্ছনা ও অপমান তথা প্রায় অবলুপ্তি তাকে সহ্য করতে হয়নি। এ কারণে গ্রীক দর্শনের বস্তুবাদী অংশের ধারাবাহিতায় নাস্তিক্য-দর্শন বা তার পূর্বসূরী চিন্তার ধারাবাহিক ইতিহাস ও গ্রন্থাবলী পাওয়া গেলেও, ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে থাকা কিছু উল্লেখ ছাড়া অন্য কিছু সুসংবদ্ধরূপে পাওয়া মুশকিল। তার একটি বড় কারণ, প্রাচীন ভারতের স্বভাববাদ-ভূতবাদ-সংখ্য-ন্যায়-বৈশেষিক বা যোগ, কিংবা আয়ুর্বেদ বা চরক-সুশ্রুত সংহিতার মত শাস্ত্রাদির মধ্যে যে বস্তুবাদী কিংবা নিরীশ্বরবাদী, নাস্তিক্য চিন্তা ছিল, সেগুলিকে সচেতনভাবে বিকৃত করা হয়েছে—যেমন পরবর্তীকালে আর্যভট্টের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী (যেমন জ্যোতির্বিদ্যা) বরাহমিহিরের মত ব্যক্তিদের দ্বারা (যেমন জ্যোতিষবিদ্যায়) বিকৃত হয়েছে। আর এর ফলে নাস্তিক্য-দর্শনের পূর্বসূরী প্রবক্তারা ভারতীয় অঞ্চলে থাকলেও, সম্প্রতিকালে এর বিকাশ মূলত ঘটেছে পাশ্চাত্যে। আধুনিক বিজ্ঞানের বিকাশ, বৈজ্ঞানিক যুক্তিনির্ভর মন নিয়ে সত্যানুসন্ধানের প্রচেষ্টা, শিল্প-বিপ্লব তথা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব, মার্কসবাদের মতো একটি অতি প্রভাবশালী সামাজিক-অর্থনৈতিক মতাদর্শের বিকাশ ইত্যাদিও ইয়োরোপীয় এলাকায় ঘটার পেছনে এই ঐতিহাসিক দিকটি নিশ্চয়ই কিছুটা ভূমিকা পালন করেছে। অন্যদিকে, পৃথিবীতে মানবসভ্যতার যে পর্যায়ে কল্পিত ঈশ্বরকেন্দ্রিক আদর্শ ও রাষ্ট্র গড়ার পরিমণ্ডল ছিল, ঐ পর্যায়ে এই ভারতেই একটি স্তর পর্যন্ত মানব সভ্যতা, উৎপাদন, অর্থনৈতিক স্বাচ্ছল্য- এ সবের অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভাববাদী ও কল্পিত বায়বীয় চিন্তাভাবনা দূর করে বৈজ্ঞানিক সত্যকে জানার আগ্রহ সৃষ্টি না হওয়ায়, একদা উন্নত ভারতীয় সভ্যতা অধোগতি লাভ করেছে।

নাস্তিক্য-দর্শন মূলগতভাবে বৈজ্ঞানিক বিশ্বদর্শন হলেও তার ওপর বিদেশী ছাপ মারার প্রবণতা আমাদের দেশে অনেকের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু এই দর্শন যে ভারতীয় ভূখণ্ডেও যথেষ্ট বিকশিত হয়েছিল তা ঐতিহাসিকভাবে অবিতর্কিত। তবে এ দেশের ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি, শাসকগোষ্ঠী এবং পরবর্তীকালে বিদেশী পণ্ডিতেরা বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্যে, এ দেশের বস্তুবাদী, নাস্তিক্যবাদী বা নিরীশ্বরবাদী ঐতিহ্যের দিকটিকে হতমান করেছেন। আর সত্যকে দেশী বা বিদেশী হিসেবে ভাগও করা যায় না। সত্যেন বসুর নামানুসারী ‘বোসন’-ই হোক, বা নিউটন আবিষ্কৃত আবিষ্কৃত প্রাকৃতিক নিয়মই হোক–সত্য আন্তর্জাতিকভাবেই সত্য

আধুনিক কালে নাস্তিক্যবাদ (atheism) বলতে বোঝায় ঈশ্বরকে সরাসরি অস্তিত্বহীন হিসেবে স্বীকার করা বা আরো সঠিকভাবে বললে, ঈশ্বর বিশ্বাসকে মিথ্যা বিশ্বাস হিসেবে গণ্য করা এবং যে-সব ধর্মকে এই ঈশ্বর বা ঐশ্বরিক শক্তির ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা হয়, সেই ধরনের সমস্ত ধর্মেও বিশ্বাস না করা। [এভাবে নাস্তিক ( atheist) ও অধার্মিক বা ধর্মহীন (non-religious) প্রায় সমার্থক।] ঈশ্বরই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, মানুষ ইত্যাদি সৃষ্টি করেছে— তা এই চিন্তায় বাতিল! প্রাসঙ্গিকভাবে নাস্তিকরা আত্মা, জন্মান্তর, কর্মফল ইত্যাদিতে বিশ্বাস করেন না—কিন্তু এই অবিশ্বাস না থাকলেও কেউ নাস্তিক হতেই পারেন, কারণ ঈশ্বরে অবিশ্বাসই আক্ষরিক অর্থে নাস্তিকতার প্রধান লক্ষণ। স্পষ্টত যাঁরা বিজ্ঞানমনস্ক বা যুক্তিবাদী তাঁরা নাস্তিক শব্দটির অর্থগত ও ব্যঞ্জনাগত সীমাবদ্ধতা অনুভব করেন। পরিভাষাগত সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। Atheism -এর বাংলা নাস্তিক্য বা নিরীশ্বরবাদ—দুটোই (সংসদ অভিধান)। কিন্তু হিন্দুদের কাছে, নাস্তিক বলতে বেদ (ও চতুর্বর্ণ)-বিরোধী ব্যক্তিদেরই বোঝাত—সরাসরি নিরীশ্বরবাদীদের নয়। অন্যদিকে বর্তমানে সাধারণ ভাবে প্রচলিত ভাবার্থ অনুযায়ী নাস্তিক বলতে এমন একজনকে বোঝায়, যিনি ঈশ্বর ও সংশ্লিষ্ট ধর্মাদিতে বিশ্বাস করেন না।

বহু ধরনের চিন্তাপদ্ধতি ও দার্শনিক প্রক্রিয়া এই আধুনিক নাস্তিক্যবাদ সৃষ্টির মূলে কাজ করেছে। প্রাচীন ভারতের কপিল, কণাদ, চার্বাক, বৃহস্পতি, অরিষ্টনেমী, বল, বুদ্ধ, মহাবীর ইত্যাদি (যদি এঁরা সবাই ঐতিহাসিক চরিত্র হয়ে থাকেন) বহু বৈপ্লবিক চিন্তাবিদের মতো সাম্প্রতিককালের বহু পাশ্চাত্য চিন্তবিদও এই উপলব্ধির বিকাশ ঘটিয়েছেন। প্রাচীন ভারতের চার্বাক দর্শন, কণাদ দর্শন, ন্যায় শাস্ত্র, সাংখ্য দর্শন ইত্যাদি যেমন পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে নাস্তিক্যবাদের স্বপক্ষে বলেছো, ইয়োরোপীয় অঞ্চলেও এমনই নানা চিন্তাপদ্ধতি ছিল—যার কথা আগেই বলা হয়েছে (অজ্ঞাবাদ, সন্দেহবাদ ইত্যাদি)।

চার্লস ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২) ছিলেন অজ্ঞাবাদী। তিনি প্রকৃতি বিজ্ঞানের যে তত্ত্ব বিকশিত করেন, সেটি খ্রীষ্টধর্ম ও ইহুদিধর্মের কল্পিত সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কিত বিশ্বাসের মুলে কঠোর কুঠারাঘাত হানে। পরে সিগমুন্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯৩৯) ঐ ডারউইন তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে ঈশ্বর বিশ্বাসের উৎস প্রসঙ্গে বিশ্লেষণী বক্তব্য রাখেন।

ষোড়শ শতাব্দীতে নিক্কোলো মাকিয়াভেলি রাষ্ট্রনীতি থেকে ধর্মকে সম্পূর্ণ আলাদা করার কথা বলেন। তখন শাসন ব্যবস্থায় ধর্মীয় প্রভাব এত বেশি ছিল যে, ব্যাপারটি একটি বৈপ্লবিক রূপ পায় এবং পরোক্ষভাবে নাস্তিক্যবাদের বিকাশে সাহায্য করে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ডেভিড হিউম, এমানুয়েল কান্ট-এর মতো ব্যক্তিরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে চিরাচরিত ধারণাবলীর বিরুদ্ধে বিতর্ক করেন এবং ঈশ্বরের অস্তিত্বকে মানুষের নিছক বিশ্বাসের ব্যাপার বলে মনে করেন। তাঁরা নাস্তিক ছিলেন না, কিন্তু মানুষের জ্ঞান ও বিচার বুদ্ধিকে শুধু বস্তুগত অভিজ্ঞতাভিত্তিক বলে প্রতিষ্ঠা করেন এবং চিরাচরিত ঈশ্বরতত্ত্বকে অস্বীকার করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসী এনসাইক্লোপিডিস্টদের মধ্যে নাস্তিকতার প্রকাশ ঘটে—এঁরা ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদ (empiricism)-এর সঙ্গে বিশ্বব্রহ্মান্ড সম্পর্কে রেনে দেকার্ত-এর যান্ত্রিক বা বস্তুবাদী তত্ত্বের সমন্বয় ঘটান। ঊনবিংশ শতাব্দীতে লুডভিগ ফয়েররাখ (১৮০৪-৭২) সুনির্দিষ্টভাবে বলেন যে, ঈশ্বর আসলে মানুষেরই চিন্তাভাবনার একটি রূপ মাত্র এবং তিনি ঈশ্বরকে অস্বীকার করার ব্যাপারটিকে মানুষের মুক্তির প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত করেন। এই ধারাবাহিকতায় কার্লমার্কস (১৮১৮-১৮৮৩) ধর্ম ও ঈশ্বর বিশ্বাসকে সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত বলে ব্যাখ্যা করেন; ধর্ম যে নিছকই মানবিক একটি ব্যাপার এবং ধর্ম ও ঈশ্বর বিশ্বাস যে মানুষকে তার নিজস্বতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, সে ব্যাপারে তিনি বলিষ্ঠ যুক্তিনির্ভর ও বিজ্ঞানসম্মত বক্তব্য রাখেন। মার্কসবাদ মূলগতভাবে নাস্তিক্যদর্শন নয়, তবে মার্কসীয় দর্শনের অনিবার্য সিদ্ধান্ত ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হচ্ছে নাস্তিক্যবাদ এবং আত্মা, জন্মান্তর, কর্মফল, ধর্ম ইত্যাদির ওপর নির্ভরতা থেকে মুক্তিও। মার্কস কোনো না কোনো ভবিষ্যতে ধর্মের অবলুপ্তির কথা বলেন; তাঁর মতে ঈশ্বর ও অলৌকিক শক্তিভিত্তিক এই প্রচলিত ধর্ম নিপীড়িত মানুষের বেদনাময় দীর্ঘশ্বাস ও অন্যতম অসহায় আশ্রয়স্থল,– হৃদয়হীন পৃথিবীতে ধর্ম মানুষের কাছে এক আশ্বাসদায়ী হৃদয়।

নাস্তিক্যবাদী দর্শনের আরেকটি ধারা অস্তিত্ববাদী (existentialist) চিন্তার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। ফ্রিডরিখ নিৎসে (১৮৪৪-১৯০০)-র মতো দার্শনিকেরা এর প্রবক্তা। তিনি ‘ঈশ্বরের মৃত্যু’-র কথা বলেন—অর্থাৎ মানুষের চেতনা থেকে ঈশ্বর-এর পরিপূর্ণ অবলুপ্তি। তাঁর মতে, এটি সম্ভব পরিপূর্ণ নেতিবাদ (nihilism)-এর মাধ্যমে এবং এর ফলে মানুষ নিজে নিজস্ব পরিপূর্ণতার দিকে মুক্তভাবে এগোতে পারবে, নিজ জীবনের মূলগত তাৎপর্য স্বাধীনভাবে উপলদ্ধি করতে সক্ষম হবে। বিংশ শতাব্দীতে আলবার্ট কাম্য, জাঁ পল সার্ত্র-এর মতো মনীষীরা এই চিন্তার ধারাবাহিকতায় বিশ্লেষণ করেন যে, সর্ব অর্থে মানুষের ‘মুক্তি’-র জন্য ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণার পরিপূর্ণ অবলুপ্তি একটি প্রাথমিক শর্ত।

আধুনিককালে নাস্তিক্যবাদের আরেকটি বড় সমর্থক হচ্ছে তার্কিক ইতিবাদ (logical positivism)। ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যাবে কি যাবে না— এই প্রশ্নের বিচারে ইতিবাদীরা নাস্তিক নন; তাঁরা নাস্তিক এই অর্থে যে, তাঁদের মতে ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণাটি সম্পর্কেই কোনো আলোচনা অসম্ভব এবং অপ্রামাণ্য ঈশ্বর সম্পর্কে কোনো কথা বলাটাই নির্বুদ্ধিতার লক্ষণ। হিউম, টমাস হাক্সলি, জন স্টুয়ার্ট মিল প্রমুখ চিন্তাবিদরা এই ইতিবাদী আন্দোলনের প্রবক্তা। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় অতি হাল আমলের (১৯৩৬) বইপত্রে (যেমন Language, Truth and Logic, A. J. Ayer) ঈশ্বরতত্ত্ব, নাস্তিক্যবাদ অজ্ঞাবাদ ইত্যাদি ঈশ্বর সম্পর্কিত যাবতীয় আলোচনাকেই অনর্থক বা মিথ্যা (ungenuine) হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

কণাদ থেকে কাম্যু বা ‘চার্বাক’ থেকে মার্কস বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যে সব মনীষীরা ঈশ্বর সম্পর্কে মানুষের কল্পনার ধোঁয়াশা দূর করে যুক্তি, বিশ্লেষণ ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রকৃত সত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন, তাঁদের প্রায় সবাই-ই মানুষের সমাজ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক, চেতনা ইত্যাদির ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করে নাস্তিক্যবাদী সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। এই সিদ্ধান্ত হাল আমলে আরো সুদৃঢ় হয়েছে, প্রাণ-এর সৃষ্টির পেছনে বস্তুর বিকল্পহীন ভূমিকার নিঃসন্দেহ বৈজ্ঞানিক প্রমাণের মধ্য দিয়ে। স্ট্যানলি মিলার ও তাঁর উত্তরসূরী বহু বৈজ্ঞানিকের বহু পরীক্ষায় এটি আজ জানা গেছে, মানুষসহ সমস্ত প্রাণী-উদ্ভিদের এই অপার রহস্যময় প্রাণের সৃষ্টির পেছনে রয়েছে জড় বস্তুর অসংখ্য রাসায়নিক বিক্রিয়া। দেড় বা দুই হাজার কোটি বছর আগে বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টির পর কিভাবে ধাপে ধাপে সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী ও পার্থিব পরিমণ্ডল আর প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে, তা আজ মোটামুটি জানা গেছে। নস্তিক হোন বা নাই হোন, এসব বিজ্ঞানীর পরীক্ষায় এটি আজ প্রমাণিত যে, সৃষ্টিকর্তা হিসেবে ধরাছোঁয়ার বাইরে অলৌকিক, অতিপ্রাকৃতিক কোনো পরম পুরুষ তথা ঈশ্বরের কোনো প্রয়োজনই নেই পৃথিবী ও প্রাণ সৃষ্টির জন্য। বিগত কয়েক বছরের পরীক্ষায় হাতেনাতে মানুষ জেনেছে যে, আত্মা, পরমাত্মা তথা সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর বাস্তবে অসম্ভব—তাদের অস্তিত্ব শুধু মানুষেরই কল্পনায়, অজ্ঞতায়, অসহায়তায়।

এই কাল্পনিক ঈশ্বর সম্পর্কে গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের দ্বিধাহীন বিশ্বাস থাকলেও,ঈশ্বর-অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ-আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্তভাবে খুব কম ক্ষেত্রেই হয়েছে। বরং নাস্তিক্যবাদী চিন্তার মধ্য দিয়ে যখনই মানবিক ও বৈপ্লবিক বা সংস্কারমূলক গুণাবলী বিকশিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে, তখন বহু সাধারণ মানুষই তার দিকে এগিয়ে এসেছেন। বুদ্ধ বা মার্কস্-এর অনুগামী কোটি কোটি মানুষই শুধু এর উদাহরণ নন, নাস্তিকতার প্রচারক বহু চিন্তাবিদের সমর্থনেই নানা সময়ে বহু মানুষ এগিয়ে এসেছেন। এঁদের বিরুদ্ধে আন্দোলন মূলত সংগঠিত হয়েছে কায়েমী স্বার্থ বা শাসকগোষ্ঠীর নেতৃত্বে ও উসকানিতে, যারা নিজেদের ও সাধারণ মানুষের ঈশ্বরবিশ্বাস ও ঈশ্বরকেন্দ্রিক ধর্মবিশ্বাসকে শাসনের স্বার্থে কাজে লাগিয়েছে। বৌদ্ধ ও চার্বাক পন্থীদের পুড়িয়ে মারা বা লাঞ্ছিত করা, শিশুনারী নির্বিশেষে ‘কাফের’দের হত্যা করা, কিংবা বাইবেল-বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করার উদাহরণ বিরল মোটেই নয়। চার্বাক বা বুদ্ধের বিরুদ্ধে আমাদের দেশের শাস্ত্রকাররা তো নিছক গালাগালিই বর্ষণ করেছেন একসময়। অন্যত্রও কমবেশি এই ব্যাপারই ঘটেছে।

তবু নাস্তিকতার বিপদ সম্পর্কে কিছু মতামত অবশ্যই বিচার্য। যেমন, সাধারণ সরলবিশ্বাসী মানুষ এখনো চায় কোনো এক সর্বশক্তিমানের আশ্রয়ে বা ভরসায় থাকতে। এর ফলে সে মানসিক সাহস পায়, যে সাহস তার দুঃখতাপিত, অনিশ্চিত ভবিষ্যতে ভরা জীবনে বেঁচে থাকার ও লড়াই করার উৎসাহ জোগায়। ঈশ্বর বা এই জাতীয় ধারণার অস্তিত্ব না থাকলে, এরা একটি মানুষকে ‘ঈশ্বরের’ আসনে বসিয়ে তার ওপর একই গুণাবলী, ভরসা ও অন্ধবিশ্বাস আরোপ করবে। এবং বাস্তবত অতীতে বুদ্ধের ক্ষেত্রে একই ব্যাপার ঘটেছে; সম্প্রতি মার্কস বা মাও সে তুঙ-এর মতো দার্শনিকের ক্ষেত্রেও এটি ঘটা অসম্ভব নয়।

আর এভাবেই নাস্তিক্যবাদী চিন্তার অনুসরণ একটি চরম সাহসিক কাজ এটি শুধু চারপাশের ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষের মধ্যে সংখ্যালঘু হওয়ার বিপদ নয়; মানসিকভাবে ঈশ্বর বিশ্বাসীরা, অলীক হলেও ভরসা করার মতো যে ঐশ্বরিক আশ্রয় পায়, নাস্তিকদের কাছে এই মানসিক ভরসার এরকম কোনো কেন্দ্র নেই—নির্ভর করতে হয় শুধু নিজের ও নিজের চারপাশের মানুষের ওপর, বাস্তব প্রকৃতি ও মানবিক সমাজের ওপর।

নাস্তিকতার আরেকটি অসুবিধার কথা ভাবা হয়, তা হলো মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক শৃঙ্খলাসম্পর্কিত। ঈশ্বর-ভীতি ও এ সংক্রান্ত পাপপুণ্যের ধারণা যদি না থাকে, তবে মানুষ আর ন্যায়-অন্যায় বিচার না করে শুধু নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করার চেষ্টাই করবে এবং আধুনিককালের আইনকানুন প্রণয়ন করেও এ মূল্যবোধ, ন্যায়-অন্যায় বোধ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। বহু ধার্মিক ব্যক্তিই আপাতভাবে সৎ ও মানবতাবাদী জীবন যাপন করেন। ঈশ্বর বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা নানা ধর্ম বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন দেশের সামাজিক শৃঙ্খলা, নৈতিকতা, মানুষের মধ্যেকার ঐক্য গড়ে তুলবার দায়িত্ব পালন করেছে। নাস্তিক্যবাদী চিন্তাভাবনা এই ঈশ্বর ও ধর্মের বিকল্প হতে পারে কি-না সে ব্যাপারে বিতর্ক রয়েছে।

কিন্তু এই বিতর্ক প্রায়শই অন্ধ ও যুক্তিহীনভাবে এগোয়। মূল্যবোধ ও সামাজিক শৃঙ্খলা সম্পর্কিত নিয়মাবলী যুগে যুগে দেশে দেশে পাল্টায়। এগুলি ঈশ্বরের মুখনিঃসৃত, সনাতন বা চিরন্তর কখনোই নয়; মানুষই তাদের সৃষ্টি ক’রে তাকে ‘ধর্ম’ নাম দেয়, ঈশ্বরের নাম করে চালায়। নাস্তিক্যবাদী চিন্তায় তথাকথিত ধর্মীয় অনুশাসন অবশ্যই নেই, কিন্তু সাধারণ মানবিক মূল্যবোধ, এবং প্রাসঙ্গিক সামাজিক শৃঙ্খলা অবশ্যই সংশ্লিষ্ট থাকে। প্রকৃতপক্ষে নাস্তিক্যবাদ একটি চিন্তাপদ্ধতি—ধর্মের মতো  বিস্তৃত সামগ্রিক একটি ব্যাপার নয়। পৃথিবীতে বর্তমানে কমপক্ষে ১১ কোটি মানুষ নাস্তিক বা ধর্মপরিচয়মুক্ত। এঁদের কেউ কেউ একই সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক দল বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও যুক্ত। এঁরা সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক বা অমানুষ হিসেবে পরিচিত নন। মানুষকে ভালোবাসা, মানুষের ভালোর জন্য কাজ করা, এবং সততা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা, নিজের ও অন্যের প্রতি সম্মানবোধ—ইত্যাদির মতো মানবিক চেতনাকে স্বাভাবিকভাবে অনুসরণীয় বলে মনে করেন—কোনো ঈশ্বর বা অতিপ্রাকৃতিক শক্তির ভয়ে নয়। ধর্মীয় অনুশাসনের বিকল্প হয়ে উঠেছে আধুনিক নানা রাষ্ট্রের সংবিধান। তবু এখনো অব্দি, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হলেও অনেক রাষ্ট্রেই বিভিন্ন ধর্মের সরকারী পৃষ্ঠপোষকতাই করা হয় (যেমন আমদের দেশে); আবার অনেক রাষ্ট্রে ধর্মকে ব্যক্তিগত আচরণ পছন্দ-অপছন্দ হিসেবে গণ্য করে, সরকারিভাবে কোনো ধর্মকেই পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় না, কিন্তু বাধাও দেওয়া হয়না (যেমন চীনে)। নাস্তিক-ধর্মহীন ব্যক্তির পাশাপাশি ঈশ্বরবিশ্বাসী ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের সংখ্যাধিক্যই এসবের মূলে।

নাস্তিকতা মানবসভ্যতার অতি অগ্রসর পূর্ণতাপ্রাপ্ত (mature) অবস্থার চিন্তা ও এই অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রায় ৫০,০০০ বছর আগে নিয়ানডার্থাল মানুষেরা যে আত্মা ঈশ্বর, ধর্ম ইত্যাদি কল্পনার স্ফুরণ ঘটিয়েছিল, পরবর্তী হাজার হাজার বছর ধরে তা বিকশিত হয়েছে এবং মানুষের মানসিক-জাগতিক প্রয়োজনও কিছুটা মিটিয়েছে। এক সময় মানুষের জ্ঞান ও যুক্তিবোধ বিকশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাত্র হাজার আড়াই বছর আগে নাস্তিক্যবাদী চিন্তা মানুষের মনে আসে (অবশ্য এর আগেও এ-চিন্তা বিচ্ছিন্নভাবে আসা অস্বাভাবিক নয়)। আর প্রাচীনতর ধর্মের ধারাবাহিতায় আধুনিক পৃথিবীর মুখ্য সব ধর্মও সৃষ্টি হয়েছে মোটামুটি এই সময়কালেই।

এ-সব ধর্ম যতদিন শাসকগোষ্ঠী ও বৃহত্তর জনসাধারণের প্রয়োজন মিটিয়েছে ততদিন তা বিকশিত হয়েছে। এ প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে বা কমে গেলে, হয় তার অবলুপ্তি ঘটেছে বা প্রসার কমেছে, কিংবা পরিমার্জিত হয়ে অন্যরূপ ধারণ করেছে। মানুষেরই সত্য উপলব্ধির প্রক্রিয়ায় নাস্তিকতারও সৃষ্টি। মানুষেরই প্রয়োজনে মানুষ দেখেছে, মানব সভ্যতার সুস্থ বিকাশের ও স্থায়িত্বের জন্য, এমন এক সমাজ প্রয়োজন যে সমাজে অজ্ঞতা ও অশিক্ষার অন্ধকার থাকবে না, মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুর্দশা, বৈষম্য ও অনিশ্চয়তা হবে ন্যূনতম। এমন সমাজে ঈশ্বর জাতীয় কাল্পনিক ভরসাস্থলের উপর আত্মসমর্পণের প্রয়োজন মানুষের থাকবে না, প্রয়োজন হবে না ঐ ধরনের ধর্মেরও।

সুতরাং ঈশ্বর ও ধর্মের বিকল্প ঐ সামাজিক অবস্থার উপযোগী জ্ঞান, মূল্যবোধ, নিয়ম কানুন ইত্যাদি। নাস্তিকতা এরই একটি অংশ মাত্র বা এই আদর্শ, ঐ মানবিক অবস্থার উপযোগী চিন্তামাত্র। ঐ উন্নততর স্তরে পৌঁছনোর জন্য যে প্রচেষ্টা তার দার্শনিক ভিত্তির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নাস্তিক্যবাদ ও প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাস থেকে মুক্তি কারণ ঈশ্বর নির্ভরতা ও ধর্মবিশ্বাস (যা কমবেশি অন্ধ হতে বাধ্য) মানুষকে স্বাধীনভাবে ও বিজ্ঞানসম্মতভাবে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাধা দেয়ই। ঈশ্বরের জন্য নয়, মানুষের জন্য কাজ করার প্রচেষ্টা যদি আন্তরিক হয় তবে তা ঈশ্বর ও ঈশ্বরকেন্দ্রিক ধর্মকে অস্বীকার করতে বাধ্য। সম্প্রতি এ-প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। এর একটি যেমন মার্কসবাদ বা কমিউনিজম; সব মার্কসবাদী বা কমিউনিস্টরাই নাস্তিক ও ধর্মপরিচয়মুক্ত (যদি সত্যিই তিনি মার্কসবাদী বা কমিউনিস্ট হন)। কিন্তু সব নাস্তিক ও ধর্মপরিচয়মুক্ত ব্যক্তিই মার্কসবাদী নন এবং তাঁরা বিভিন্নভাবে বিভক্ত। নাস্তিকতা ও ধর্মপরিচয়মুক্তির জন্য এই বিভাজন নয়—এই বিভাজন–নিজেদের শ্রেণীগত ও রাজনৈতিক অবস্থানের বিভিন্নতার জন্য।

তবে নাস্তিক্যবাদী চিন্তার যাথার্থ্য নির্ভর করে তার মানবিক দিকের উপর। নিছক পুরনো মূল্যবোধকে ভাঙ্গার জন্য যদি তা করা হয় এবং পাশাপাশি যদি উন্নততর মানবিক মূল্যবোধকে অনুসরণ ও প্রতিষ্ঠা না করা হয়, তবে ঐ নাস্তিকতা জনবিরোধী, সংকীর্ণ ও উদ্দেশ্যহীন হতে বাধ্য। যুক্তিবাদী, বৈজ্ঞানিক মন ব্যতিরেকে, নিছক আধুনিক সাজার চেষ্টায় যদি ঈশ্বর ও ধর্মকে অস্বীকার করা হয় এবং পাশাপাশি যদি জীবনের সর্বক্ষেত্রে এই উপযোগী চিন্তার প্রতিফলন না ঘটানো হয়—অন্তত তার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা চালানো না হয় তবে তা কপটতা মাত্র। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে পর্যায়ক্রমে ধর্মের বিকাশের স্বরূপকে উপেক্ষা করা মানুষকে ও মানুষের ইতিহাসকে অস্বীকার-অপমান করারই সামিল।

নাস্তিকতা ও ধর্মহীনতাই মানুষকে একটি কাল্পনিক বিভেদ থেকে মুক্ত করে সর্বজনীন ঐক্যের পথ দেখায়, এবং মানুষ তখন অনৈক্যের যে কারণ—অর্থনৈতিক ও শ্রেণীগত বৈষম্য, সে-সম্পর্কে সচেতন হতে পারবে, তার সমাধানেরও প্রকৃত চেষ্টা করতে সক্ষম হবে। অন্যদিকে কেউ বলে সর্বধর্ম সমন্বয় বা ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা; ধর্মের প্রকৃত সত্য জানা (ঈশ্বরকে অস্বীকার না করেই), প্রকৃত হিন্দু প্রকৃত মুসলমান বা প্রকৃত খ্রীস্টান হওয়ার কথা, ইত্যাদি এবং তা হলেই নাকি মানুষে মানুষে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে। কথাগুলি হয়, সরলবিশ্বাসীদের আকাশকুসুম কল্পনা বা সোনার পাথরবাটি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, কিংবা সচেতন ধুর্তদের আরেকটি কৌশল— মানবিক ঐক্য প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসের প্রমাণিত অক্ষমতা ঢাকতে এবং ঈশ্বরে ও প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাস নাস্তিক্যবাদী দর্শন ও বৈজ্ঞানিক সত্যের দ্বারা যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে তার জন্য এই কৌশল তারা নিতে বাধ্য হচ্ছে।

নাস্তিক্যবাদী দর্শনই মানুষকে তার বাস্তব সমস্যা চিনতে ও তার সমাধানের প্রকৃত পথ খুঁজে পেতে সাহায্য করে। ঈশ্বর ও ধর্মে বিশ্বাস টিকিয়ে রেখে এই পথ খোঁজার চেষ্টা একসময় কানাগলির সম্মুখীন হতে বাধ্য।

ঈশ্বর বিশ্বাস থেকে ও প্রাসঙ্গিক ধর্মবিশ্বাস থেকে মুক্ত আকাশ আত্মবিশ্বাস, মানবিক ঐক্য, সত্য ও মনুষ্যত্বের আলোয় উদ্ভাসিত। মানুষই এ-আলো জ্বালিয়েছে, মানুষেরই জন্য। এ-আলোর অনিবার্য সম্যক স্ফুরণ ভবিষ্যতের গর্ভে নিহিত। বিজ্ঞানমনস্ক মানবপ্রেমিকের দল কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, মিথ্যা বিশ্বাস ও যুক্তিহীনতা থেকে মুক্ত হয়ে, অন্যদের সাথী করে এ-আলোর মশাল হাতে সামনে এগিয়ে যাবেন।

***

“….এতগুলো শতাব্দী গড়িয়ে গেল, মানুষ তবু ছেলেমানুষ থেকে গেলে
কিছুতেই বড় হতে চায় না
এখনো বুঝলো না যে ‘আকাশ’ শব্দটার মানে
চট্টগ্রাম কিংবা বাঁকুড়া জেলার আকাশ নয়
মানুষ শব্দটাতে কোন কাঁটাতারের বেড়া নেই
ঈশ্বর নামে কোন বড়বাবু এই বিশ্ব সংসার চালাচ্ছেন না
ধর্মগুলো সব রূপকথা
যারা সেই রূপকথায় বিভোর হয়ে থাকে
তারা প্রতিবেশীর উঠোনের ধুলোমাখা শিশুটির কান্না শুনতে পায়না
তারা গর্জন-বিলাসী—”

–সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (‘একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে’)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *