4 of 8

হাওয়াই

হাওয়াই

যথারীতি অন্যান্য বছরের মতো এবার আমার ছুটি, তিন মাসের ছুটি। আগস্ট থেকে অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত, এই তিনমাস।

সম্বৎসর আমার এই অন্তর্ধানের সময়, আমার জন্যে নয়, আপনারা কেউ কেউ গঙ্গারামের জন্যে অধীর হয়ে পড়েন, কেউ কেউ সম্পাদককে পত্রাঘাত করবেন।

কিন্তু লিখব তো আমি, আমি লেখা না পাঠালে সম্পাদক কী করবে?

এবছর সম্পাদক মহোদয়ের সঙ্গে আমার ভদ্রলোকের চুক্তি হয়েছে। ছুটিতে যেখানেই যাই, ফাঁকে ফাঁকে দুয়েকটা করে ছোটখাটো ‘কি খবর’ তাঁকে পাঠাব। পাঠকেরা লক্ষ রাখুন, ভদ্রলোকের চুক্তি কতটা পূরণ করতে পারি, দেখুন।

অতঃপর মূল প্রসঙ্গে যাচ্ছি। এবার আমাদের বিষয় ‘হাওয়াই’, মহাসাগরের কোলে মায়াদ্বীপ হাওয়াই। আগে স্বাধীন ছিল, উনিশশো ঊনষাট থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্গত পঞ্চাশতম রাজ্য।

সেই কবে কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছিলেন,

‘হাওয়াই দ্বীপে যাইনি,

দক্ষিণ সমুদ্রের কোনো দ্বীপপুঞ্জে…

…হে ইডি, হাইডি, হা-ই।…

…হে ইডি, হাইডি, হা-ই।…

সাম্রাজ্যবাদ এবং মেকি সভ্যতার আগ্রাসী মনোভাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদময় এই কবিতাটি আমাদের যৌবনকালে খুবই জনপ্রিয় ছিল।

কিন্তু সেজন্যে নয়, বিদেশ যাওয়ার ঠিক পূর্ব মুহুর্তে ‘কি খবর’ লিখতে গিয়ে খেয়াল হল আমিও হাওয়াই দ্বীপে যাইনি। এবার যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু হচ্ছে না।

আমার যাত্রাসূচি ব্যাংকক-টোকিও হয়ে সানফ্রানসিসকো। টোকিও থেকে সানফ্রানসিসকো প্রায় দশ-বারো ঘণ্টা একটানা প্লেন-জার্নি। মধ্যপথে হাওয়াই দ্বীপ একটা স্টপওভার নিলে, সামান্য খরচে যেমন হাওয়াই ভ্রমণ হয়ে যায়, তেমনই শারীরিক স্বস্তির ব্যবস্থাও হয়। বিমানযাত্রা বড় জোর একটানা চার-পাঁচ ঘণ্টা পোষায়, তার চেয়ে বেশি হলে বিরক্তিকর, কষ্টকর এবং অস্বাস্থ্যকর। অথচ আমাদের দেশ থেকে বিলেত-আমেরিকা যেতে হলে বাঁয়ে অতলান্তিক কিংবা ডাইনে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি না দিয়ে উপায় নেই। এবং সেই পাড়ি দেওয়ার সময় স্থানমাহাত্ম্য অনুযায়ী একটানা আট ঘণ্টা থেকে আঠারো ঘণ্টা বিমানে।

এসব অবশ্য অন্য কথা।

আসল কথাটা হল, হাওয়াই দ্বীপ যাব মনস্থ করেও যাচ্ছি না। সোজা টোকিও থেকে সানফ্রানসিসকো যাচ্ছি।

মাননীয় প্রবীণ সাংসদ শ্রীযুক্ত সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় হাওয়াই দ্বীপে, বোধহয় হনলুলু বিমানবন্দরে মার্কিন অভিবাসন দপ্তরের অসৌজন্যে যে রকম হেনস্থা হয়েছেন, তার বিস্তৃত বিবরণ খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে।

ক্ষুব্ধ সোমনাথবাবু কারও কারও কাছে নাকি জানতে চেয়েছেন, ‘আমি কি টেররিস্টের মতো দেখতে?’

এরপর আমার মতো সামান্য ভারতীয় কী করে হাওয়াই ভ্রমণে সাহস পাবে?

হাওয়াই যাত্রা আপাতত স্থগিত, সরাসরি সানফ্রানসিসকো গিয়ে দেখি সেখানে কেমন অভ্যর্থনা হয়।

হাওয়াই শব্দটির মধ্যে একটা ভারতীয় ব্যঞ্জনা আছে। কিন্তু সেজন্যে নয়, হাওয়াই শব্দটি আমাদের পরিচিত এবং ব্যবহৃত বহু বস্তুর নামকরণের কাজে লেগেছে। সম্ভবত হাওয়াই দ্বীপ থেকে আগত এই অর্থে হাওয়াই নামকরণ।

এককালে হাওয়াই গিটার খুব জনপ্রিয় ছিল। এই কলকাতা শহরে অনেক ঘরেই হাওয়াই গিটারের চর্চা হত, বড় বড় অনুষ্ঠানে, বেতারে, গ্রামোফান রেকর্ডে বাজত।

হাওয়াই শার্ট দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর ব্যাপার। পুরনো রীতির শার্ট এখন আবার ফিরে আসছে, কিন্তু হাওয়াই শার্টের কদর কমেনি।

হাওয়াই চটি আমি প্রথম দেখি উনিশশো ঊনষাট কিংবা ষাট সালে। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মন্ত্রী স্বর্গীয় তরুণকান্তি ঘোষের পায়ে। বাটার তৈরি একটা হলুদ রঙের হাওয়াই, দাম পাঁচ টাকা। পাঁচ টাকা তখন বেশ দামি।

এসব ব্যক্তিগত স্মৃতিকথার পরে এবার একটা ঐতিহাসিক কাহিনী বলি।

স্বাধীন হাওয়াইয়ের রানি কুইন লিলিয়োকালানিকে রানি ভিক্টোরিয়া বাকিংহাম প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে হাওয়াইয়ের রানি কুইন ভিক্টোরিয়াকে বলেন, ‘আমার গায়ে ইংরেজের রক্ত রয়েছে।’

ভিক্টোরিয়া জানতে চান, ‘সেটা কী ভাবে?’

কুইন লিলিয়োকালানি উত্তর দেন, ‘আমার ঠাকুরদার বাবা ইংরেজ অভিযাত্রী ক্যাপ্টেন কুককে খেয়েছিলেন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *