4 of 8

জুয়া (২)

জুয়া (২)

আটলান্টিক সিটি। বাংলায় বলা যায় অতলান্তিক নগর। নামেই মালুম। আটলান্টিক মহাসাগরের তীরবর্তী একটি ঝলমলে, জমজমাট শহর। বিত্তবান দেশের জুয়া নগরী। আকারে, আয়তনে বা জনসংখ্যায় খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলেও এই বিলাসবহুল, হোটেলাকীর্ণ শহর সারা পৃথিবীর টুরিস্টদের কাছে পরম আকর্ষণীয়। আকর্ষণের প্রধান কারণ জুয়া খেলা।

শমিতী আলোলিকা মুখোপাধ্যায় তাঁর চমৎকার এবং অপ্রতিরোধ্য মার্কিনি জার্নালে এই শহর এবং এখানে অনুষ্ঠিত এক মহোৎসবের কথা লিখেছিলেন, বছর দুয়েক আগে।

সে সময় ‘বিশ্ব বঙ্গ সম্মেলন’ এখানে হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানটি উত্তর আমেরিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার বাঙালিদের সর্ববৃহৎ বাৎসরিক উৎসব, ঘুরে ঘুরে মার্কিন দেশ ও কানাডার নানা প্রান্তে বিভিন্ন শহরে বছর বছর হয়ে থাকে। মার্কিন দেশ ও কানাডার বাইরে থেকেও, বিশেষ করে ভারত বাংলাদেশ এবং ইউরোপ থেকে বাঙালিরা আসেন। অস্ট্রেলিয়া থেকে আগত এক বাঙাল দম্পতির সঙ্গে সে বছর আমার পরিচয় হয়েছিল। আমিও সপরিবারে ওই উৎসবে সামিল হয়েছিলাম, মিনতি-কৃত্তিবাস সহ। বিরাট ব্যাপার। রাজসূয় যজ্ঞ। হাজার-হাজার লোকের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত। কলকাতা থেকে বড় গিটার-বাজিয়ে, অভিনেতা, সাহিত্যিকরা এসেছেন। অহোরাত্র প্রায় নিচ্ছিদ্র প্রোগ্রাম। স্থানীয় কলাকুশলীরা আছেন, তাঁদের অনুষ্ঠান আছে। বাংলাদেশ থেকেও অনেক জ্ঞানী-গুণী এসেছেন। সম্মেলনে উপস্থিতির সংখ্যা দশ-পনেরো হাজার কিংবা তারও বেশি হতে পারে।

সে যা হোক, এ নিবন্ধ বঙ্গ সম্মেলন নিয়ে আমি লিখতে বসিনি, আমি লিখতে যাচ্ছি, জীবনে আমার প্রথম ও শেষবার জুয়াখেলা নিয়ে। তবে এখানে স্বীকার করে রাখা উচিত, ভূ-ভারতে বাঙালির এতবড় এবং এত বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক উৎসব অনুষ্ঠিত হয় না।

অষ্টপ্রহর হরি সংকীর্তনের মতো অহোরাত্র অনুষ্ঠান। বিশাল মূল মঞ্চ ছাড়াও অনেকগুলি ছোট-বড় মঞ্চ, সেমিনার হল। হইহই কাণ্ড, রইরই ব্যাপার। অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে মধ্যে মধ্যেই হল থেকে বাইরে আসছি। কনফারেন্স হল থেকে বেরুতেই সমুদ্রের বাতাস ঝড়ের মতো বইছে। একটু দূরেই সিজার, তাজমহল ইত্যাদি নামের বিশ্ববিখ্যাত হোটেলগুলি। সবগুলিই উন্নতমানের জুয়ার আড্ডা, ক্যাসিনোর জন্য বিখ্যাত। এই সবই একটু দূরে সমুদ্রের তট ঘেঁষে। বারবার আমাকে টানছে।

তবু নিমন্ত্রিত হয়ে এসে অনুষ্ঠান ছেড়ে চলে যাওয়া ভদ্রতা নয়। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। এত নৃত্য-গীত, এত যাত্রা-থিয়েটার, এত আলোচনা, বক্তৃতা একসঙ্গে—আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল।

ইতিমধ্যে স্বল্প বিরতি। পান-ভোজনের জন্য অল্প কিছু সময়। এরপরে সারারাত প্রোগ্রাম। একাধিক নাটক আছে, গান আছে। আরও কত কী আছে।

তা থাক। স্বল্প-বিরতির এই সুযোগে আমি আর মিনতি বেরিয়ে পড়লাম। কৃত্তিবাসকে আশপাশে দেখলাম না। এখানে তার অনেক বন্ধুবান্ধব, চেনাশোনা মানুষজন। ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে গেছে।

আমি ও মিনতি আলোকোজ্জ্বল সমুদ্রতীরের দিকে পা বাড়িয়েছি, কৃত্তিবাস কোথা থেকে দেখতে পেয়ে একটু পরে ছুটে এসে আমাদের ধরল।

নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া, দূরে সমুদ্রগর্জন, শোঁ-শোঁ করে বাতাস বইছে। সমুদ্র তীরবর্তী রাস্তায় ঝলমলে দোকানপাট, বার, ক্যাসিনো, প্রাসাদোপম হোটেলমালা পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

আমরাও সে ডাকে সাড়া দিলাম।

আটলান্টিক সিটি আমার পরিচিত শহর। আমেরিকায় এর আগে বেশ কয়েকবার এলেও এই শহরে আমি আগে আসিনি, কিন্তু শহরটাকে একটু চিনি। ওই তো দেখা যাচ্ছে ক্যাসিনোর জন্য বিখ্যাত সিজার হোটেল, তার পাশে তাজমহল। ওপাশ দিয়ে রাস্তা গেছে বিচে নামার মধ্যে একটা কাঠের সাঁকো।

গোয়েন্দা গল্প, রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনী, থ্রিলার জাতীয় বই আমার পরম প্রিয়। আগাথা ক্রিস্টি বা কনান ডয়েল শুধু নয়, ফরাসি লেখক জর্জ সিমেনো বা ব্রিটিশ ডরোথি সেয়ার্স যখন যা পেয়েছি গোগ্রাসে পড়েছি। জেমস হেডলি চেসের রগরগে থ্রিলার সেও পেলেই পড়ি। এই হেডলি চেসের বইতে বারবার ফিরে আসে আটলান্টিক সিটি, পশ্চিম উপকূলে বা নিউ ইয়র্কে খুন-ডাকাতি করে চেসের র্দুবৃত্তেরা এখানে এসে আশ্রয় নেয়। সিজার হোটেলের ঘর, বারান্দা, ক্যাসিনো-লাউঞ্জ, বিভিন্ন বার আমার নখদর্পণে না হলেও, বই পড়ে চেনা।

ইতিমধ্যে কনফারেন্স হল থেকে বিরতির সুযোগে প্রায় দশ বারো হাজার লোক বাইরে বেরিয়েছে। দূর থেকে হাট বা মেলায় যেমন গমগম শব্দ কানে আসে, এখানেও তাই শোনা যাচ্ছে। অসংখ্য ছায়া ছায়া মানুষকে দেখাও যাচ্ছে, সমুদ্রের দিকে আসছে।

কয়েকজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সাহেব মেম, সাহেবই বেশি, ছড়ি হাতে নৈশভোজের শেষে সমুদ্রবায়ু সেবনে বেরিয়েছেন। শুধু জুয়াড়ি বা র্দুবৃত্তের নয়, অবসরপ্রাপ্তদেরও প্রিয় নিবাস আটলান্টিক সিটি। বোধহয় স্বাস্থ্যকর স্থান, দূষণহীন তো বটেই।

ভ্রমণকারী সাহেব মেমরা অদূরে অসংখ্য মানুষ দেখে এবং গোলমালের শব্দ শুনে বারবার বোঝার চেষ্টা করছিলেন, কী ব্যাপার। আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাদের বোঝালাম, ‘দশ-বারো পর বাঙালি একত্রে এদিকে থাকছে। সাহেবরা আপনারা রয়াল বেঙ্গল টাইগারের কথা শুনেছেন তো, এরা সেখানকার লোক। আর বাইরে থাকবেন না, যে যার বাড়ি ফিরে যান।’

কাছাকাছি কোনও এক বঙ্গসন্তানের হাতের ক্যাসেট প্লেয়ারে তখন বাজছে সুমনের গান…কিচ্ছু বলা যায় না।

সাহেবরা কী বুঝলেন কে জানে। অতি দ্রুত ত্রস্ত পদে তাঁরা পশ্চাপসরণ করলেন।

এবার সামনেই সিজার হোটেল। সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ উঠে গেলেই ক্যাসিনো লাউঞ্জ। বহু লোক সেখানে দ্যূতক্রীড়ায় মত্ত।

আমি ঠিক করলাম, জীবনে এই শেষ সুযোগ। জীবনে অন্তত একবার জুয়া খেলার পাপটা করি। আমি একথা বলতে কৃত্তিবাস বলল, ‘কত টাকা আছে তোমার সঙ্গে?’

‘খুচরো দশ ডলারের মতো হবে।’

আমার একথা শুনে বেশি টাকা নষ্ট হচ্ছে না এটা ধরে নিয়ে কৃত্তিবাস তার মাকে নিয়ে সমুদ্রতীরের দিকে গেল। বলে গেল, ‘এখানেই থেকো, আমরা আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসছি।’

এদিক-ওদিক ঘুরে এর-ওর খেলা দেখে আমি ক্যাসিনোর রীতিনীতি, খেলার কায়দা বুঝে নিলাম। সোজা কথা, পয়সা দিয়ে বোতাম টিপে অপেক্ষা করো, ভাগ্যে মিললে দু’গুণ, চারগুণ কিংবা আরও বহুগুণ টাকা ক্যাসিনোর গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসবে, না মিললে পয়সা গচ্চা।

বিগিনার্স লাক অর্থাৎ নবিশের ভাগ্য বলে ইংরেজিতে একটা কথা আছে। আমার ক্ষেত্রে তাই ঘটল। দুয়েকবার বাদ দিয়ে আমি ক্রমাগত জিততে লাগলাম। আমার কোটের দুই পকেট, প্যান্টের দুই পকেট, হাতের আঁজলা ভরে গেল মার্কিনি মুদ্রায়। মোট পরিমাণ অন্তত হাজার ডলার হবে। কম কথা নাকি। ভারতীয় টাকায় প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা।

উঠব উঠব ভাবছিলাম, এমন সময় দেখি স্ত্রী-পুত্র আমার দিকে আসছে। কী রকম রোখ চেপে গিয়েছিল ভাবলাম শেষ দানটা যা আছে সব দিয়ে খেলি। মারি তো গণ্ডার, লুটি তত ভাণ্ডার। আজ সিজার হোটেলকে ভিখিরি করে দিয়ে যাব, আমার অন্তত কয়েক লাখ টাকা হবে।

কিন্তু যেমন হয়, যা হয়ে থাকে, তাই হল। অবশেষে এবার একটি বিরাট শূন্য, একটা গোল্লা পেলাম। শূন্যহস্তে ক্যাসিনো ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে মিনতি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘একী, তোমার মুখ এত ফ্যাকাশে কেন? ট্রাভেলারস চেক ভাঙিয়ে খেলনি তো? কত টাকা হারলে?’

আমি বললাম, ‘দশ ডলার। সেই দশ ডলার ছিল, সেটাই হেরেছি।’

কৃত্তিবাস বলল, ‘দশ ডলার হেরে মুখ অত শুকনো করতে হবে না। চল তাড়াতাড়ি চল, খুব খিদে পেয়েছে। এর পরে সম্মেলনে আর খাবার পাওয়া যাবে না।’

তারপর ক্যাসিনো থেকে বেরুতে বেরুতে বলল, ‘এখানে প্রত্যেকদিন কত লোক হাজার হাজার ডলার হারে। আর তুমি তো মাত্র দশ ডলার!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *