4 of 8

পরিশেষে

পরিশেষে

খিটিমিটিটা সাতসকালেই শুরু হয়ে যায়। সাতসকালের মানেটা কী, ঠিক কতটা সকাল তা অবশ্য জানি না। হাতের কাছে অভিধানেও শব্দটা পেলাম না। লিখতে বসে এসব নিয়ে ভাবতে গেলে খেই হারিয়ে যায়।

আমাদের এই গল্পে সাতসকাল হল সকাল সাতটা, সেই সময়েই চায়ের টেবিলে বসে দু’জনের মধ্যে খিটিমিটি লেগে যায়। তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ে।

দামিনী একটু দেরি করে ঘুম থেকে ওঠেন। একটু রাত করে ঘুমনো, একটু বেলা করে ওঠা বহুদিনের পুরনো অভ্যেস তাঁর। ততক্ষণে ধর্মদাস লেকের ধার দিয়ে এক চক্কর দিয়ে আসেন। সকালে না হাঁটলে তাঁর রক্তে অক্সিজেন খেলে না, সারাদিন শরীর ম্যাজম্যাজ করে।

আগে বাইরের দরজা ভেজিয়ে হাঁটতে বেরিয়ে যেতেন। ভিতরের ঘরে দামিনী ঘুমোতেন। কিন্তু ব্যবস্থাটা নিরাপদ নয়। একটা ইয়েলগা তালা দরজায় লাগালে সমস্যাটা ঘুচে যায়, বাইরে থেকে টেনে দিলেই হবে। পরে ফেরার সময় বাইরে থেকেই চাবি দিয়ে খোলা যাবে। কিন্তু ওসব তালা এদিকে কাছাকাছি কোথাও পাওয়া যায় না। ওদিকে বা কোন দিকে পাওয়া যায়, ধর্মদাসের সে বিষয়ে কোনও ধারণা নেই।

আজ কিছুদিন হল ধর্মদাস তাঁর বইয়ের আলমারির তালাটা খুলে বেরনোর সময়ে বাইরের দরজায় লাগিয়ে যান। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব নয়। কাল সকালেই দামিনীর সত্তর বছরের দাদা এসেছিলেন, দামিনী জানতেনই না যে দরজা বাইরে থেকে ধর্মদাস তালা বন্ধ করে যান। যখন এটা সদ্য নিদ্রোত্থিতা দামিনী বুঝতে পারলেন, তিনি রাগে গজরাতে লাগলেন। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। দরজার ওপার থেকেই দাদার সঙ্গে সংক্ষিপ্ত প্রভাতী আলাপ সারতে হল। যাওয়ার সময়ে মোক্ষম কথাটি বলে গেলেন তিনি, ‘ধর্মদাস কি আজকাল তোকে তালা দিয়ে রাখে নাকি? বুড়ো বয়সে এসব বাতিক খুব খারাপ।’

সেদিন মুড়োঝাঁটা কিংবা চেলা কাঠ পিঠে ভাঙা ছাড়া আর সবই করেছিলেন দামিনী। ধর্মদাসের কোনও দোষই ছিল না। নিতান্ত প্রাতঃভ্রমণের মতো একটি নিরামিষ অথচ প্রয়োজনীয় কাজের জন্য ধর্মদাস নিগৃহীত হলেন।

আমরা সকাল বেলায় ওই নজিরটি উপস্থাপন করলাম শুধু এইটুকু বোঝানোর জন্য যে ধর্মদাসবাবুর সারাদিন কেমন কাটে।

বাড়ির বাজার ধর্মদাস নিজেই করেন। বেগুনের পোকা বেগুন ছাড়া আর কোথায় থাকবে, বাজারের বেগুনে পোকা বেরুল। এই দুর্মূল্যের বাজারে পাঁচশো গ্রাম বেগুন কিনেছিলেন ধর্মদাস।

ছোট ছোট বেগুন। প্রায় পনেরো বিশটা উঠেছিল ওই আধ কেজিতে। দাম একটু কম বলে ধর্মদাস কিনেছিলেন। কিন্তু দামিনী তরকারি কুটতে গিয়ে দেখলেন প্রত্যেকটি বেগুনে বিজবিজ করছে পোকা। পাঁচশো গ্রাম বেগুনে প্রায় পঞ্চাশ গ্রাম পোকা।

খেপে গিয়ে দামিনী সেই বেগুনের পোকাগুলো ভেজে বেগুনভাজার বদলে ধর্মদাসকে দিলেন।

এ রকম প্রায়ই হয়। অনেক সময় দামিনী পচা মাছ ছুড়ে মারেন ধর্মদাসকে, খারাপ ময়দা মাথায় ঢেলে দেন।

ধর্মদাস কী আর করবেন, হাঁটেন। সকালে আর বেরনোর সাহস পান না। একটু বেলা করে, দামিনী ঘুম থেকে উঠলে তারপর হাঁটতে বেরোন। রোদে পুড়ে, ঘামে ভিজে হাঁটেন।

আবার হাঁটতে হাঁটতে বাজারে যান, ডাকঘরে যান, পেনশন আনতে যান। বিকেলের দিকে ফের লেকে গিয়ে পায়চারি করেন।

সকালের ভ্রমণকারীরা বিকেলের দিকে কেউ কেউ আসেন। তাঁরা ধর্মদাসবাবুকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘সকালে আর আসেন না কেন?’ ধর্মদাস চুপ করে থাকেন।

একদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নির্যাতিত হওয়ার পরে ধর্মদাস দামিনীর কাছে হেনস্থা হওয়ার কথাটা কবুল করে ফেললেন।

ধর্মদাসের পুরনো ভ্রমণসঙ্গী রমেশবাবু। দু’জনে এক সময়ে একই অফিসে কাজ করতেন। তিনি ধর্মদাসকে বলেন, ‘আপনার স্ত্রীকে এত ভয় করেন আপনি? আপনি কি মশায় ইঁদুর নাকি!’

ধর্মদাস বললেন, ‘ইঁদুর হলে তো ভালই ছিল?’

রমেশবাবু বললেন, ‘সে কী! কেন?’

ধর্মদাস বললেন, ‘আমার স্ত্রী ইঁদুরকে খুব ভয় পান কি না?’

একদিন অবশ্য ধর্মদাস একটা আশার কথা শোনালেন, বললেন, ‘বুঝলেন রমেশবাবু, আমার স্ত্রীকে আজ আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসতে হয়েছিল।’

রমেশবাবু শিহরিত। জানতে চাইলেন, ‘কেন, আপনি কী করেছিলেন?

ধর্মদাস বললেন, ‘কিছুই করিনি। শুধু খাটের নীচে লুকিয়ে ছিলাম।’

পুনশ্চঃ

সর্বানন্দ-সর্বাণী কাহিনী একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছিল। তাই একটু মুখবদল করলাম।

তবে উল্লেখযোগ্য এই যে ধর্মদাস-দামিনী আমাদের সর্বাণীর বাবা-মা, সর্বানন্দের শ্বশুর-শাশুড়ি। এবং আমি হলফ করে বলে দিতে পারি যে একদিন সর্বানন্দ-সর্বাণীরও একই পরিণতি হবে। সেদিকেই তারা এগোচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *