গ্রন্থবার্তা
শ্রীযুক্ত প্রমথেশ এবং শ্রীমতী সুচরিতা নিয়োগী, স্বামী-স্ত্রী। এখনও তত বুড়ো হননি, এমন দম্পতি।
স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই পেনশনার। একজন রেলে, অন্যজন এ জি বেঙ্গলে কাজ করতেন। মহার্ঘ ভাতা সমেত পেনশন থেকে যা আয় হয় তাতে দু’জনের ভালই চলে যায়। বিশেষ কোনও দায়-দায়িত্ব নেই, বরং সুরাহা আছে। সন্তান-সন্ততি বলতে একটি মাত্র মেয়ে ও তার বর, একটি নাতনি। মেয়ে-জামাই দু’জনেই ডাক্তার, বহুদিন লন্ডনে আছে, নাতনিটিও তাদের কাছে। বিলেত থেকে টুকটাক উপহার আসে।
এখানে কলকাতায় বেলেঘাটায় পৈতৃক বাড়িতে প্রমথেশবাবু থাকেন। তাঁর একমাত্র স্বভাবদোষ, রবিবার দুপুরে পাঁঠার মাংসের ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়া। পাঁঠার মাংস আজকাল সহজলভ্য নয়, সর্বত্রই খাসির মাংস, তিনি রবিবার সাতসকালে উঠে বেলগাছিয়া চলে যান পাঁঠার মাংস কিনতে। সেই মাংস সুচরিতা পেঁয়াজ-রসুন বাদ দিয়ে ছোট আলু আর ঘি, গরম মশলা দিয়ে সাবেকি, সাত্ত্বিকভাবে রান্না করেন।
সুচরিতা দেবীরও কোনও দোষ নেই, শুধু জর্দা পান ছাড়া। যে কোনও রকম জর্দা হলেই হয়, কিন্তু পানের সঙ্গে কিঞ্চিৎ জর্দা তাঁর চাই। তিনি নিজেই নিজের পান সাজেন, চুন-খয়ের, জাঁতি-বাটা সমেত পানের সব সরঞ্জাম তাঁর সাজানো রয়েছে।
এ ছাড়াও নিয়োগী দম্পতির, স্বামী-স্ত্রী দু’জনারই একটি সাধারণ দোষ আছে, সেটি হল বই পড়া। বলা বাহুল্য, শুধু তাই নয় খবরের কাগজ, পত্রিকা, ম্যাগাজিন যা হাতের কাছে পান তাই পড়েন।
আশেপাশের পাড়ার দু’-তিনটে পাঠাগারের তাঁরা সদস্য। অবসরের পর থেকে শুধুই বই পড়ে যাচ্ছেন। বই মানে বাংলা গল্প-উপন্যাস। বঙ্কিম-শরৎ থেকে সুনীল-শীর্ষেন্দু, শংকর-বুদ্ধদেব গুহ, এঁদের যেখানে যে বই পান, মিস্টার এবং মিসেস নিয়োগী গোগ্রাসে আত্মস্থ করেন। দুঃখের বিষয় তারাপদ রায়ের লেখা তাঁদের মোটেই পছন্দ নয়। এত হালকা লেখায় তাঁদের মনের সায় নেই।
সে যা হোক, নতুন বই আর নিয়োগীরা খুঁজে পান না। প্রতি বছর পুজোর সময় সবরকম কাগজ মিলিয়ে গোটা চল্লিশ-পঞ্চাশ উপন্যাস প্রকাশিত হয়। সেগুলির আয়তন খুবই ছোট। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর দুমাসের খোরাক চলে যায়। তারপর আবার ভুখা। প্রমথেশ এবং সুচরিতা হাজার চেষ্টা করেও নতুন পাঠ্যবস্তু সংগ্রহ করতে পারেন না। আবার করে কৃষ্ণকান্তের উইল, শ্রীকান্ত, নৌকাডুবি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়েন।
অবশেষে স্বামী-স্ত্রী মিলে একটি ছোট সিদ্ধান্তে এলেন। দু’জনেই মোটামুটি ইংরেজি জানেন, তাঁরা ঠিক করলেন, এবার থেকে ইংরেজি বই পড়া আরম্ভ করবেন।
একটি সুযোগও এসে গেল। বাড়িতে পুরনো বই-কাগজের ফেরিওয়ালা খবরের কাগজ কিনতে এসেছিল, তার ঝোলায় অন্য বাড়ি থেকে কেনা সামনের পাতা ছেঁড়া, একটু পুরনো, জীর্ণ ইংরেজি বই পাওয়া গেল। প্রমথেশ বইটা তুলে দেখলেন, একটা নাটক, একটু খটমট ভাষা, তবে নীচে ফুটনোটে অনেক রকম ব্যাখ্যা দেওয়া আছে।
ফেরিওয়ালার ঝোলায় একটা কয়েক মাস আগের রিডার্স ডাইজেস্টও পাওয়া গেল। খুচরো কাহিনী ও টুকরো তথ্যের এই বিশ্ববিখ্যাত পত্রিকাটি প্রমথেশবাবুর খুবই প্রিয়, কিন্তু দাম বেশি বলে কিনতে পারেন না।
ফেরিওয়ালা এই দুটি বই ওজন করে একটু আগেই হয়তো একটাকা বা দেড়টাকা দিয়ে কিনেছে, এখন দাঁও বুঝে প্রমথেশবাবুর কাছ থেকে ওই দুটোর জন্যে পাঁচ দু’ গুণে দশ টাকা নিল।
রিডার্স ডাইজেস্ট হাতে নিয়ে পাতা ওলটাতে ওলটাতে প্রমথেশ সুচরিতার হাতে নাটকটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তুমি এই নাটকটা পড়ার চেষ্টা করো দেখি, দরকার হলে ইংলিশ-বেঙ্গলি ডিকশনারিটা সঙ্গে রাখো।’
সুচরিতা অধ্যবসায়ী পাঠিকা, চোখে চশমা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে নাটক পড়া শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পরে বাজার করে ফিরে এসে প্রমথেশ দেখেন নাটক পাঠ প্রায় অর্ধেক শেষ। সুচরিতা রীতিমতো উত্তেজিত, বললেন, ‘দুর্ধর্ষ কাহিনী, রীতিমতো রহস্য-রোমাঞ্চ, ফেলুদা-ব্যোমকেশ এমনকী নীহার গুপ্ত কোথায় লাগে! তার ওপরে কত কোটেশন, সেই ছোটবেলায় ইস্কুল-কলেজে পড়েছি এমন সব কোটেশন।’
ঘণ্টা দুয়েক পরে একটানে বইটা পড়া শেষ করতে প্রমথেশ সুচরিতাকে প্রশ্ন করলেন, ‘ভাল?’ সুচরিতা বললেন, ‘সাংঘাতিক কাহিনী। রক্তেরাঙা নাটক। খুন-আত্মহত্যা, অশরীরী আত্মা। ভাই ভাইকে খুন করে তার কাজকর্ম এমনকী বউ পর্যন্ত কেড়ে নিল। বোকা ভাইপো রাতে অশরীরী কণ্ঠস্বর শোনে। সে তার প্রেমিকার বাবাকে, ভাইকে এমনকী নিজের কাকাকে খুন করল, তারপর নিজেই আত্মহত্যা করল। কী মারাত্মক সব ঘটনা। টিভি সিরিয়াল হলে যা জমবে।’
পাশের বাড়িতে থাকেন অধ্যাপক নিবারণ রায়। তিনি কলেজে ইংরেজি পড়ান, প্রমথেশ তাঁকে নিয়ে ছেঁড়া বইটা দেখালেন, তিনি বইটি এক পাতা উলটিয়েই বললেন, ‘এ তো শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট।’