বাগ্বিধি
বাক্+বিধি=বাগ্বিধি
সোজাসুজি বলা যায় কথা বলার নিয়ম। কিন্তু কথা বলার সত্যিই কি কোনও নিয়ম আছে? কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম থাকা কি সম্ভব?
সংস্কৃত শ্লোককার বলেছিলেন, শত কথা বলো কিন্তু কিছু লিখো না। লিখলে রেকর্ড থাকে, স্থিতধী শ্লোককার তাই না লিখে শতং বদ পরামর্শ দিয়েছিলেন।
কিন্তু কথা বলার বিপদও কিছু কম নয়, বিশেষ করে বেশি কথা বলার বিপদ কিছু বেশি। আমার গুরুদেব শিবরাম একবার গল্প লিখেছিলেন, ‘শিব্রাম চক্রবর্তীর মত কথা বলার বিপদ’। সেই ভয়াবহ জটিলতায় আমরা যেতে চাই না।
তবে একথা বলব যে লেখার চেয়ে কখনও কখনও কথা বলাও কম বিপজ্জনক নয়।
লেখা তবু পরে কাটাকুটি করা চলে, সংশোধন করা চলে, তেমন ক্ষেত্রে ছিঁড়ে ফেলাও যায়। কিন্তু কথা তো ফেরত নেওয়া যায় না। টিউব থেকে বেরনো টুথপেস্টের মতো মুখ থেকে বেরনো কথা আর টিউবের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় না, বেশি চেষ্টা করলে পেস্ট আরও ছড়িয়ে পড়ে।
সম্প্রতি ভোটের রণাঙ্গনে খ্যাতনাম্নী চিত্রতারকা শ্রীমতী মাধবী মুখোপাধ্যায় দূরদর্শনে একটি অনর্থক উক্তি করে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন, যতবার তিনি তাঁর প্রথম উক্তি ব্যাখ্যা করতে যান ততই জট আরও বেড়ে যায়। যাই হোক, নির্বাচনে হেরে তিনি আপাতত সমালোচনার উর্ধ্বে।
অহেতুক কথা বলার বিপদ যথেষ্টই। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। আজকাল তরুণী মাত্রেই সুরভিতা। দেশি-বিদেশি নানারকমের পারফিউমে এদের আসক্তি। উৎসব-অনুষ্ঠানে শুধু নয়, রাস্তা-ঘাটে, ট্রামে-বাসে, অফিস-কাছারিতেও এঁরা সৌরভ বিস্তার করেন।
এইরকম এক আধুনিকা তরুণী বাসে যাচ্ছিলেন। তাঁর পাশের সিটে বসেছিলেন এক ভদ্রলোক। তিনি এই তরুণীর সুগন্ধে বিমোহিত হয়ে গেলেন। এ রকম সুগন্ধি পারফিউম কোথায় পাওয়া যায়, কে জানে?
শেষপর্যন্ত কৌতূহল দমন করতে না পেরে ভদ্রলোেক পার্শ্ববর্তিনীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা, আপনি যে পারফিউমটা ব্যবহার করেছেন, ওটার নামটা বলবেন।’
তরুণীটি প্রসাধনীটির নাম বলল, কোন দোকানে পাওয়া যাবে সেটাও বলল, তারপর প্রশ্ন করল, ‘কিন্তু আপনি কী জন্যে কিনবেন?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘আমার স্ত্রীকে একটা উপহার দেব ভাবছি।’
তরুণীটি সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘সর্বনাশ! ও কাজ করতে যাবেন না। তা হলে রাস্তাঘাটে আজেবাজে লোক আপনার স্ত্রীর কাছে জানতে চাইবে, কী পারফিউম, কোথায় পাওয়া যায় এইসব কথা।’
বলা বাহুল্য এই ভদ্রলোক এর পরে অপরিচিতা মহিলার সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে সাবধান হয়ে গিয়েছিলেন।
সাবধান হয়ে কথা না বলার বিপদ মৌখিক পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি, সেখানেই হাতে হাতে ফল পাওয়া যায়।
ডাক্তারির মৌখিক পরীক্ষায় পরীক্ষক ছাত্রকে মুমূর্ষু রোগীর ওষুধ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করছিলেন। প্রয়োজনীয় ওষুধটির নাম ছাত্রটি ঠিকই বলল। এবার অধ্যাপক ওষুধের পরিমাণ জানতে চাইলেন। ছাত্রটির আত্মপ্রত্যয় এসে গেছে, সে চট করে বলে বসল, ‘দশ গ্রেইন।’
বলার পরে পরীক্ষকের মুখের দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারল উত্তর ভুল হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে সে বলল, ‘স্যার দশ গ্রেইন নয় ওষুধের পরিমাণ পাঁচ গ্রেইন হবে।’
নির্বিকার অধ্যাপক বললেন, ‘আর কোনও উপায় নেই। রোগী এক মিনিট আগে মরে গেছে। সামনের বছর আবার এসো।’
পুনশ্চ:
বেশি কথা বলার বিপদ
আদালতের কাঠগড়ায় চুরির মামলার আসামি দাঁড়িয়ে, দুই পক্ষের উকিলের বক্তব্য সাক্ষীদের জবানবন্দি ইত্যাদি সব শেষ, এবার হাকিম সাহেব আসামিকে জিজ্ঞাসা করলেন, সেই চিরাচরিত প্রশ্ন:
হাকিম: আপনি দোষী না নির্দোষ।
আসামি: নির্দোষ। হুজুর আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ।
একবার নথিপত্রে খুব ভাল করে চোখ বুলিয়ে নিয়ে হাকিম সাহেব আসামিকে বললেন, ‘আপনি এর আগে কখনও জেল খেটেছেন?’ প্রশ্ন শুনে আসামি করজোড়ে বলল, ‘না স্যার। কখনওই না। এর আগে কখনওই আমি চুরি করিনি।’ আসামির বক্তব্যের বিপজ্জনক এই শেষ পঙ্ক্তিটি বলার কোনও প্রয়োজন ছিল না। এই স্বীকারোক্তির জন্যেই এবার জেল খাটতে হল তাকে।