4 of 8

পাটিগণিত

পাটিগণিত

আমাকে যাঁরা বাল্যকাল থেকে ভালভাবে চেনেন, তাঁদের অধিকাংশই কালক্রমে ধরাধাম পরিত্যাগ করেছেন। তাঁদের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে পাটিগণিত বিষয়ক এই রম্যনিবন্ধ রচনা করছি।

আসল কথা হল, পাটিগণিত নিয়ে কোনও কিছুই লিখবার অধিকার আমার নেই।

অঙ্ক অর্থাৎ পাটিগণিত বিষয়ক আমার বাল্য কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলি অনেকেই জানেন। দায়ি অবশ্য আমি নিজেই, নিজের আত্মগ্লানির এই গল্পগুলি নানাজনকে নানা সময়ে বলেছি, দু’-একবার যে লিখিনি তাও নয়।

সেই প্রথমবার যেবার অঙ্কে শূন্য পেলাম, তখন আমি স্কুলের খুব নিচু ক্লাসে। রেজাল্ট বেরনোর পর রোষান্বিত পিতৃদেবের প্রহার থেকে সেবার আমাকে রক্ষা করেছিলেন আমার পরমা স্নেহময়ী পিসিমা।

পিসিমা যখন শুনলেন, আমি অঙ্কে শূন্য পেয়েছি বলে বাবা আমাকে মারতে যাচ্ছেন, তিনি ছুটে এসে মধ্যস্থতা করলেন, বাবাকে বললেন, ‘জটু, খোকন যে কিছুই পায়নি তা তো নয়, শূন্য তো পেয়েছে। কতজন যে শুন্যও পায় না।’ (বলা বাহুল্য জটু এবং খোকন যথাক্রমে বাবার এবং আমার ডাকনাম)

সেই শিশু বয়সে ‘কিছুই যে পায়নি, তা তো নয়, শূন্য তো পেয়েছে’, এই কথার অর্থ স্পষ্ট বোধগম্য হয়নি। কিন্তু এখন এতকাল পরে জীবনের শেষ ভাগে পৌঁছে কেমন যেন মনে হচ্ছে শূন্য পাওয়াটা কম পাওয়া নয়।

দার্শনিকতা করে লাভ নেই, আমার পরবর্তী কৃতিত্বের কথা বলি।

তখন আমি স্কুলের একটু উঁচু ক্লাসে উঠেছি। সে বছর পরীক্ষায় অবশ্য শূন্য বা গোল্লা পাইনি, এগারো পেয়েছিলাম। সেই সঙ্গে ইংরেজিতে একুশ, বাংলায় চব্বিশ।

রেজাল্ট দেখে পিতৃদেব রেগে আগুন, এই মারেন তো সেই মারেন, আমাকে ধমক দিলেন, ‘পরীক্ষার ফল এটা কী হয়েছে, অঙ্কে এগারো, ইংরেজিতে একুশ, বাংলায় চব্বিশ।’

আমার মনে নেই, কিন্তু অনেকের কাছে শুনেছি, আমি নাকি বাবাকে বলেছিলাম, ‘ওই রকমই হয়। যারা লিটারেচারে ভাল হয়, তারা অঙ্কে কাঁচা হয়।’

আমরা শিশুকালে পাঠশালায় পড়েছি ধারাপাত। দশ একে দশ, দশ দু’গুণে কুড়ি ইত্যাদি নামতা। আর আর্যা। সেই শুভকরী আর্যা, এখন কি কারও মনে আছে।

‘কুড়বা কুড়বা কুড়বা লিজ্জে।

কাঠায় কুড়বা কাঠায় লিজ্জে।’

এতকাল পরে ছড়াটি একটু গোলমাল হতে পারে কিন্তু ব্যাপার-স্যাপার এ রকমই।

এই আর্যার মানেই বা কী, প্রয়োজনই বা কী ছিল? অথচ এর জন্যে কী পরিশ্রমই না করেছি, শৈশবের উজ্জ্বল মুহূর্তগুলি পণ্ডশ্রমে ব্যয় করেছি।

আমরা বড় হয়ে পড়েছি যাদববাবুর পাটিগণিত। আমরা মানে, বাপ-জ্যাঠা-দাদা-ছোট ভাই-বোনেরা সবাই ওই যাদববাবুর বই পড়েছে। যাদববাবু হলেন খ্যাতনামা অঙ্কবিশারদ যাদবচন্দ্র চক্রবর্তী। প্রায় পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে বাঙালি তাঁর বই পড়ে অঙ্ক কষা শিখেছে।

এই বইয়েই ছিল, বানর আর তৈলাক্ত বাঁশের সেই রহস্যময় অঙ্ক। তেল মাখানো বাঁশ বেয়ে একটি বানর সেকেন্ডে তিন ফুট ওঠে আর পরের সেকেন্ড দু’ ফুট নেমে যায়। বাঁশটির দৈর্ঘ্য যদি কুড়ি ফুট হয়, তবে কত সেকেন্ডে সে বাঁশের ডগায় উঠবে।

লীলা মজুমদার মহাশয়ার গল্পের নায়ক এই অঙ্কের উত্তর বার করেছিল আড়াইটা বানর।

এর চেয়েও মারাত্মক শিবরাম চক্রবর্তী। তাঁর কাহিনীতে দুইয়ে-দুইয়ে চার না হয়ে দুইয়ে দুইয়ে দুধ হয়েছিল। অবশ্য পরের দুইয়ে-দুইয়ে ক্রিয়াপদ, গোরু দুইয়ে-দুইয়ে দুধ।

তা, সেই যাদববাবুর পাটিগণিতেরও অনাচার কিছু কম ছিল না।

দুধ দোয়ানোর গল্পে সেই দুধে জল মেশানোর লাভ-ক্ষতির প্রশ্নের কথা মনে পড়ছে।

এক গোয়ালা তিন পয়সা মূল্যের বারো সের দুধের সঙ্গে পাঁচ সের জল মিশিয়ে আড়াই পয়সা সের দরে বিক্রয় করল। তার লাভ বা ক্ষতি কত হল?

হায় রে? কোথায় গেল সেই তিন পয়সা, আড়াই পয়সা সেরে দুধ! জল মেশানো কিন্তু অব্যাহত রয়েছে।

অপচয়ের কথাও যথেষ্ট ছিল।

একটি পঞ্চাশ গ্যালন চৌবাচ্চায় ঘণ্টায় পাঁচ গ্যালন করে জল প্রবেশ করছে আর একটা ফুটো দিয়ে প্রতি দু’ ঘণ্টায় তিন গ্যালন করে জল বেরিয়ে যাচ্ছে। চৌবাচ্চাটি পূর্ণ হতে কতক্ষণ লাগবে?

অঙ্কের সেই সব ভয়াবহ বিভীষিকাময় দিন এখনও শেষ হয়নি। তবে ক্যালকুলেটার, কমপিউটারের যুগ এসে গেছে। আগামীদিনে মাথার কাজ অনেকটাই ওই গণকযন্ত্র করবে।

ইত্যবসরে একালের অঙ্কের গল্প একটা বলে এই আখ্যান শেষ করি।

নার্সারি স্কুলের দিদিমণি এক শিশুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার এক হাতে যদি চারটে আপেল থাকে আর অন্য হাতে তিনটে আপেল, তা হলে আমার কী আছে?’

নির্বিকার কণ্ঠে শিশুটি বলল, ‘তা হলে আপনার হাত খুব বড় আছে আন্টি।’

পুনশ্চ

হিসাব রক্ষকের চাকরির এক ইন্টারভিউ নিচ্ছিলাম। এক প্রার্থীকে সে বছরের হিসেব দেখিয়ে বললাম, ‘এদিকে আয়, ওদিকে ব্যয়। ভাল করে যোগ-বিয়োগ করে হিসেবটা দেখে বলুন তো কী অবস্থায় আছি।’

প্রার্থী বললেন, ‘স্যার, আপনি যেমন চাইবেন তেমনই হবে। যোগ-বিয়োগ আমি সেই ভাবে করব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *