এক সর্দারের গল্প (৩)
অনুমান করি সর্দার খুশবন্ত সিংয়ের গল্পে এখনও পাঠক-পাঠিকা ক্লান্ত হয়ে পড়েননি এবং সেই ভরসাতেই আরেকটি কিস্তিতে হাত দিচ্ছি। এবং কথা দিচ্ছি, সর্দার কথামালার এটাই শেষ কিস্তি।
শেষ কিস্তির প্রথম আখ্যানটি এক সর্দারজি ট্যাক্সি ড্রাইভারকে নিয়ে।
এই ট্যাক্সিওলা সর্দারজি আর খুশবন্ত সিং একই গ্রামের লোক। মাঝে মাঝে দিল্লির রাজপথে দু’জনের দেখা হয়, উভয়ে উভয়ের কুশল বিনিময় করেন।
একদিন ট্যাক্সি ড্রাইভার সর্দারজি খুশবন্তকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখন তুমি কোথায় কাজ করছ? কত মাইনে পাচ্ছ?’ সর্দার খুশবন্ত সিং তখন বিড়লা বাড়ির পত্রিকা হিন্দুস্থান টাইমসের সম্পাদক, খুশবন্ত এত কথা না বলে সংক্ষেপে বললেন, ‘আমি এখন বিড়লাদের ওখানে কাজ করি।’ বলা বাহুল্য মাইনের কথাটা উচ্চবাচ্য করলেন না।
কিন্তু ট্যাক্সিওলা সর্দারজি বিড়লাদের কথা শুনে বললেন, ‘আমি যদি বিড়লা হতাম তা হলে বিড়লাদের চেয়েও বড়লোক হতাম।’
খুশবন্ত সিং এই কথা শুনে অবাক। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ভাবে?’
ট্যাক্সির সর্দারজি বললেন, ‘বিড়লাদের আয় তো আমার থাকতই, সেই সঙ্গে ট্যাক্সি চালিয়ে আরও কিছু আয় বাড়াতাম। তার মানে বিড়লাদের চেয়ে বড়লোক হতাম।’
জ্ঞানপিপাসা বিষয়ে খুশবন্ত সিংয়ের গল্পটি পুরনো, বেশ পুরনো কিন্তু চমৎকার।
একটি বালক, স্কুলের মাঝারি ক্লাসের ছাত্র, তার বাবার কাছে জানতে চাইছে, ‘বাবা, এভারেস্টের চূড়ায় প্রথম যারা উঠেছিল তাদের নামগুলো কী?’
বাবা দু’-চারবার ‘তেনজি, তেনজি’ করে তারপর বললেন, ‘পুরো নামগুলো মনে পড়ছে না।’
ছেলে একটু পরে জিজ্ঞাসা করল, ‘বাবা পাঞ্জাবের পাঁচটা নদী যেন কী কী?’
বাবা এবারও আমতা আমতা করে বললেন, ‘ভুলে গেছি, নর্মদা-টর্মদা এইসব কী যেন?’
ছেলেটির জিজ্ঞাসা এর পরেও থামেনি, এরপর সে জানতে চাইল, ‘আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্টের নাম কী?’ তারপরে, ‘কোন কোন ভারতীয় আজ পর্যন্ত নোবেল প্রাইজ পেয়েছে?’ এবং তারও পরে ‘কোন কোন ভারতীয় ইংলিশ চ্যানেল সাঁতরিয়ে পার হয়েছে?’
দুঃখের বিষয়, এসব প্রশ্নের যথাযথ উত্তরদান বাবার পক্ষে সম্ভব হল না। ফলে ছেলের মুখে অসন্তোষের ভাব দেখা দিল, তখন বাবা বললেন, ‘কিন্তু তুমি থেমো না, তুমি জিজ্ঞাসা করে যাও, যদি জিজ্ঞাসা না করো, কী করে তুমি জ্ঞান অর্জন করতে পারবে?’
এগুলি সাদামাটা গল্প। খুশবন্ত সাহেবের এইরকম আরেকটা সাদামাটা পুরনো গল্প হল তাঁর এক স্বজাতির আত্মহত্যা করা নিয়ে।
এক সর্দারজি এক হাতে এক বোতল পানীয় এবং অন্য হাতে খাবার ভরতি টিফিন ক্যারিয়াম নিয়ে রেললাইনের ওপর বসে আছেন।
তাই দেখে রেললাইনের পাশে পথচারী এক ভদ্রলোক বললেন, ‘সর্দারজি, আপনি ওভাবে রেললাইনের ওপর বসে থাকবেন না, যে কোনও সময়ে রেলগাড়ি এসে গেলে আপনি রেলে কাটা পড়ে মারা যাবেন।’
নিরাসক্ত কণ্ঠে সর্দারজি বললেন, ‘আমি মারা যেতেই চাই। আমি আত্মহত্যা করতেই এসেছি।’
বিস্মিত পথচারী তখন বললেন, ‘তা হলে আপনার সঙ্গে এত সব খাবার-দাবার, পানীয় কী জন্য?’
সর্দারজি বললেন, ‘দেখ আমি আত্মহত্যা করতে এসেছি ঠিকই কিন্তু অনাহারে মরার আমার কোনও ইচ্ছে নেই।
একথা শোনার পর পথচারীর মুখে জিজ্ঞাসাচিহ্ন দেখে সর্দারজি ব্যাখ্যা করে বললেন, ‘দেখ বেলগাড়ি কখন আসে না আসে তার কোনও ঠিকঠিকানা নেই। হয়তো দেড়দিন, দু’দিন এলই না। শেষে কি আত্মহত্যা করতে এসে উপোস করে মারা যাব নাকি। তাই খাবার-দাবার সঙ্গে নিয়ে প্রস্তুত হয়ে এসেছি।’
গল্পটা লেখার পর মনে হচ্ছে, গল্পটা আগেও একবার আমি লিখেছিলাম। যা হোক, এবার খুশবন্ত সিং মারফত আরেকবার হল। গল্পটা মূলে আমারও নয়। খুশবন্ত সাহেবেরও নয়; সেই অজ্ঞাত পরিচয় সুরসিক ব্যক্তিটি যিনি ভারতীয় রেল সম্পর্কে এই চমৎকার পরিহাসটি করেছিলেন, এই সুযোগে তাঁকে নমস্কার জানাই।
এসব গল্প তো আছেই কিন্তু খুশবন্ত সিংয়ের বাহাদুরি হল রাজনৈতিক টিপ্পনিতে।
জোকবুকের একটা গল্পে আছে, ইংলন্ডের রানি এলিজাবেথকে এক ধুরন্ধর ব্রিটিশ সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আচ্ছা রানিমা, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কেনেডি সাহেব আততায়ীর গুলিতে নিহত না হয়ে যদি সোভিয়েত রাশিয়ার ক্রুশ্চেভ নিহত হতেন, তা হলে কী হত?’
হার ম্যাজেস্টি ইংলন্ডের মহামান্যা রাজ্ঞী সাংবাদিকদের ধারেকাছে সচরাচর ঘেঁষেন না। নিয়ম নেই। কিন্তু সেই সময়টা রাজবাড়ির কয়েকটা মুখরোচক খবর নিয়ে কোনও কোনও সংবাদপত্র কিছু কিছু কেচ্ছা করছিল, যা রাজতন্ত্রের পক্ষে মোটেই সম্মানজনক নয়।
এমতাবস্থায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রানিমাকে উপদেশ দিয়েছিলেন, ‘খবরের কাগজের লোকদের চটাবেন না, একটু হাসিখুশি রাখবেন।’
সুতরাং রানিমা এই সাংবাদিককে ঠোঁট উলটিয়ে, ভুরু কুঁচকিয়ে বিদায় না দিয়ে তার প্রশ্নটি একবার মনোযোগ দিয়ে ভেবে নিয়ে বললেন, ‘তুমি বলছ কেনেডি মারা না গিয়ে ক্রুশ্চেভ মারা গেলে কী হত?’
সাংবাদিকটি উৎসাহ করে বললেন, ‘হ্যাঁ ঠিক তাই।’
রানিমা ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘দেখ, আমার মনে হয় ওনাসিস মিসেস ক্রুশ্চেভকে বিয়ে করতেন না।’
সর্দার খুশবন্ত সিংয়ের আর একটি অনুরূপ রাজনৈতিক রসিকতা দিয়ে সর্দার কথামালা শেষ করছি।
রসিকতাটি আসলে একটি প্রশ্নোত্তর।
প্রশ্ন: মার্কিন যুক্তরাজ্য এবং সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মিল কোথায়?
উত্তর: দু’ দেশের কোথাওই রুবল দিয়ে কিছু কেনা যায় না।