4 of 8

মশা ও লবণহ্রদ

মশা ও লবণহ্রদ

ডোডো-তাতাইয়ের যুগ, মানে সত্তরের দশকের গোড়া থেকে মশা নিয়ে এ পর্যন্ত আমি কিছু কম লিখিনি। তাতে কোনও ফায়দা হয়নি। মশার অত্যাচার কমা দূরে থাক আরও বেড়ে গেছে। আগে দু’-এক জায়গা, যেমন কেশনগর (অর্থাৎ কেষ্টনগর) মশার জন্য কুখ্যাত ছিল। অন্নদাশংকর তাঁর অবিস্মরণীয় ছড়ায় কেশনগরের মশাকে অমর করেছেন,

‘মশায়,

দেশান্তরী করলে আমায়

কেশনগরের মশায়।’

ছোটবেলায় পূর্ববঙ্গের সুদূর টাঙাইল শহরে বড় হয়েছি। সেখানে মশা ছিল, ম্যালেরিয়া ছিল কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি কেউ, সেটা দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ ছিল।

পরে কৈশোর বয়েসে কলকাতায় এসে এসপ্ল্যানেডে এবং পরে পারিবারিক বাসা কালীঘাটে সতেরো বছর কাটিয়েছি। শীত-গ্রীষ্মে-বর্ষায় কোনও মশা ছিল না। মশা ছিল বালিগঞ্জে-টালিগঞ্জে, মশা ছিল কাশীপুরে-দমদমে। সোজা কথা কালীঘাট থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত আসল কলকাতায় সেকালে কোনও মশা ছিল না।

মশারিও দুর্লভ ছিল। ধর্মতলায় অনন্ত মল্লিকের দোকানে কিংবা বউবাজারের বা বড়বাজারের বিছানা পট্টিতে এবং চেতলার হাটে মফস্বলের লোকদের জন্য মশারি বিক্রয়ের ব্যবস্থা ছিল। কলকাতাতে বাতিকগ্রস্ত এবং/কিংবা শৌখিন কেউ কেউ মশারি ব্যবহার করতেন। আমরা ধর্মতলা থেকে দেশে যাওয়ার সময় মশারি কিনে নিয়ে যেতাম।

এখন তো আর শ্যামবাজার বা কালীঘাট বেছে লাভ নেই। সব জায়গাই এক রকম। একই রকম মশা।

সেই গত বছর শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে এসে এক স্পষ্টবাদী কেয়ারটেকারের কথা লিখেছিলাম না? তাঁকে বারংবার স্মরণ করি।

ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘দাদা, এখানে মশা কেমন?’ দাদা অম্লানবদনে জবাব দিয়েছিলেন, ‘মশা আর কেমন হবে? ছোট ছোট, কালো কালো, পাখা আছে, ওড়ার সময় গুনগুন করে গান গায়, সুযোগ পেলে কামড়ায়।’

আসলে সব জায়গার মশাই এ রকম। কৃষ্ণকায়, সংগীত ও দংশন প্রবণ। তবু, কয়েক বছর আগে সল্টলেকে এসে মনে হয়েছিল এখানে মশা একটু অন্যরকম। যতটা উড়ে উড়ে গান গায়, ততটা কামড়ায় না। আসলে সংখ্যায় ছিল খুব কম। নতুন জনপদ, নতুন বাড়িঘর ঠিকমতো দখল নিতে পারছিল না।

কিন্তু এখন আমরা মশার খাসতালুকের প্রজা। আমাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে মশা। কবি ঈশ্বর গুপ্ত ‘রেতে মশা, দিনে মাছি’র কথা বলেছিলেন, সল্টলেকে এখন দিনেরেতে মশা। এতই মশা যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চে উঠে মন্ত্রী বললেন, ‘আগে মশা তাড়াও।’ অন্য এক মঞ্চে দেখলাম ভি-আই-পিদের মিনারাল ওয়াটারের বোতলের সঙ্গে এক টিউব করে মশার মলম দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বলছেন, মশা মারার তেল দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কম দামি তেল হওয়ার জন্যে তেলের জোর কম বলে মশার জোর বেড়েছে। স্থানীয় এক মাননীয় অধিবাসী বললেন, বাদুড় পুষলে উপকার পাওয়া যাবে, বাদুড় ঘণ্টায় অনেকগুলো করে মশা খায়। গঙ্গারাম শুনে বললে, একসঙ্গে অনেকগুলো বাদুড় যদি অনেকগুলো মশা খেতে থাকে তা হলে যে শব্দ উৎপন্ন হবে, সেটা ৬৫ ডেসিবেলের বেশি হবে।

এত সব শোনার পরেও আমি নিজে একটা বুদ্ধি বের করেছি। গত সপ্তাহে শ্রীনিকেতনে গ্রামীন কবিতা উৎসবে গিয়েছিলাম। তিনদিন ছিলাম না। যাওয়ার দিন সকালবেলা উঠে জিনিসপত্র গুছিয়ে নেওয়ার সময় অন্যান্য দিনের মতো মশারিটা তুলে দিলাম না, একটু এলোমেলো করে দিলাম, ঘরের আনাচে-কানাচে যেখানে যত মশা ছিল ছুটে এসে মশারির মধ্যে ঢুকে গেল। যখন দেখলাম বহু মশা ঢুকে গেছে, মশারিটা টান টান করে গুঁজে দিলাম। যেমন শোয়ার সময় গোঁজা হয়।

এরপর তিনদিন মশারির মধ্যে বন্দি ওই মশারা। ফিরে এসে যখন মশারি তুললাম, বহু মশা মৃত, অধিকাংশই জীবন্মৃত। তিনদিন অনাহারে থাকা ওইটুকু জীবের পক্ষে কম কঠিন নয়। জীবন্মৃতেরা কোনওরকমে মশারির নীচ থেকে বেরিয়ে চলে গেল। তারা আর ফেরেনি এবং তাদের মুখে এই দুর্বিপাকের কাহিনী শুনে অন্য মশারাও আমার ঘরে এগোতে সাহস পাচ্ছে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *