4 of 8

জল

জল

জলই জীবন।

জলের কথা লিখব না, তা হতে পারে না।

ভাতের কথা যে খুব বেশি লিখেছি তা বোধহয় নয়। কিন্তু একটা কথা সত্যি যে আজ পর্যন্ত যা কিছু হালকা লেখা লিখেছি সমস্তই ভাতের জন্য। হয়তো সত্যিতর কথাটা হল ঠিক ভাত নয়, এটা ঘি-ভাতের জন্য। শিরায় মজ্জায় রক্তে, নাড়িতে পেশিতে ধমনীতে বহমান নিতান্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত বাসনার এই হল প্রাপ্য।

এসব বাজে কথা আপাতত থাক। এবারের বিষয়বস্তু জল। জলের কথাই বলি।

কিন্তু জলভাতের জল ঠিক সেই জল নয় যে জলের কথা সপ্তদশ শতকের এক ইংরেজ ধর্ম বিশারদ টমাস কুলার বলেছিলেন, ‘জলের মূল্য আমরা কখনওই বুঝতে পারি না যতক্ষণ পর্যন্ত না কুয়ো শুকিয়ে যায়।’

এই মহৎ মন্তব্যের আধুনিক ভাষান্তরকরণ হওয়া উচিত, জলের মূল্য তখনই বোঝা যায় যখন গলির মোড়ের নলকূপ ভেঙে যায় এবং সেই সঙ্গে নোটিশ বেরয় খবরের কাগজে ‘টালা পাম্প আগামী ছত্রিশ ঘণ্টা অনিবার্য কারণে বন্ধ থাকবে।’

আসল কথায় ফিরে আসি।

এই অনুচ্ছেদ শুধু তাঁদের জন্য যাঁরা ভাল কিংবা মাঝারি ব্যাকরণ জানেন।

বাংলায় আলিঙ্গনাবদ্ধ দুটি শব্দের অনেক সময় অনেক রকম মানে হয়। স্থাবর সংস্কৃতে কিংবা মন্থর প্রাকৃতে ও সুযোগ ছিল না।

‘সর্বনাশ! না বুঝে এ কী লিখে ফেললাম। প্রাণাধিকা পাঠিকাঠাকুরানি, তোমার পড়ার পরে আজকের লেখার পাতা পুড়িয়ে কিংবা ছিঁড়ে ফেলে দিয়ো।

তোমার স্বামী বড় পণ্ডিত, এসব ছেলেখেলা যেন তাঁর নজরে না আসে।’

এতখানি সাবধানতা অবলম্বন করার পর ভয়ে ভয়ে দু’-একটা কথা বলি।

জলভাত অর্থাৎ জলের জন্য ভাত, জলের দ্বারা ভাত, যা জল তাই ভাত, জল থেকে ভাত এতসব, এসব কিছু নয় নিতান্তই জল ও ভাত, জলভাত। আলু পটল, রাম রহিম, শরৎ বঙ্কিম, রেখা অমিতাভর মতো সামান্য দ্বন্দ্ব সমাস।

সেই কতকাল আগে জল বিষয়ে মহামতি শেক্সপিয়র লিখেছিলেন, খুব সম্ভব হেনরি ছয় (Henry VI) কিংবা ওই জাতের কোনও নাটকে, ‘জল সেখানেই শান্তভাবে বয়ে যায় যেখানে নদী খুব গভীর।’

এই সামান্য জলভাতে অনিবার্য কারণেই ভাতের পরিমাণ কম জলের পরিমাণ বেশি। গরিব গৃহস্থের নুন আনতে যে পান্তা ফুরোয় সে পান্তা ভাতের বদলে জলই বেশি থাকে।

বেশি জলের একটা গল্প মনে পড়ছে।

সাবেকি গল্প। যাঁরা জানেন তাঁরা জানেন, তাঁদের ধন্যবাদ। যাঁরা জানেন না বা ভুলে গিয়েছেন কিংবা ভুলে গিয়েছিলেন শুধু তাঁদের জন্য এই বেশি জলের গল্পটা।

মামা ভাগ্নে একসঙ্গে মদ খেত। সত্যের খাতিরে লেখা উচিত মামার কাছেই ভাগ্নে মদ খাওয়া শিখেছিল।

কিন্তু মামাবাবু ছিলেন সেয়ানা মাতাল, সেই যাকে গ্রামেগঞ্জে বলে জাতে মাতাল তালে ঠিক। তিনি পেগ (পানীয়ের ইউনিট) মেপে প্রয়োজনমতো জল সোডা বরফ মিশিয়ে ধীরে ধীরে তারিয়ে তারিয়ে চুক চুক করে নিজের মদটুকু খেতেন।

ভাগিনেয় বাবাজি প্রথম প্রথম মামাবাবুর হাতে খড়ি পেয়ে মামাবাবুর আদর্শই অনুসরণ করেছিল।

কিন্তু সে মাত্র কয়েকদিন, কয়েক মাস। ধীরে ধীরে তার স্বরূপ প্রকাশিত হল।

এবং তার সেই সুপ্রকাশিত স্বরূপ দেখে মামাবাবু বিচলিত হয়ে পড়লেন। ভাগ্নে তখন আর বরফ, জল কিংবা সোডার ধার ধারে না।

যাকে সাদা বাংলায় বলে কঁচা, ইংরেজিতে বলে নিট কিংবা ‘স্ট্রেইট ফ্রম দি বটল’, (Straight from the bottle), ভাগ্নের যাত্রা সেই পথে।

কিন্তু একই গেলাসের ইয়ার হলেও হাজার হলেও মামা হাজার হলেও ভাগ্নে। আপন মায়ের পেটের বোনের আপন ছেলে তার এই পরিণতি মামার পক্ষে মেনে নেওয়া মোটেই সম্ভব নয়।

যখন ভাগ্নে সামনে বসে পান করে, মামা যথাসাধ্য চেষ্টা করেন গেলাসে পানীয়ের প্রবেশ মাত্র তার মধ্যে প্রচুর সাদাজল ঢেলে দেওয়ার। নেহাতই কর্পোরেশনের কলের জল কিংবা গলির মোড়ের টিউবওয়েলের জল। মুখ বিকৃত করে, দাঁতে দাঁত ঘষে ভাগনে মামার প্রতি সামাজিক সম্মান প্রদর্শন করার সূত্রে সেই জল পানীয় চোখ এবং নাক বুজে খেয়ে নেয়। শুকনো জিভটাকেও একটু গুটিয়ে রাখে। তার জিভে জলো পানীয়ের স্বাদ লাগে না। এইভাবে দিনকাল, মামা-ভাগিনেয়ের মদ্যপান ভালই চলছিল। একদিন, শুধু একদিন গোলমাল হল।

ভাগিনেয় বাবাজি সহসা বুকে বিস্তর ব্যথা নিয়ে একদিন গভীর রাতে নিজের বাড়ির এবং প্রতিবেশীদের নিদ্রাভঙ্গ করে অ্যামবুলেন্সে উঠে হাসপাতাল যাত্রা করলেন।

পরদিন প্রভাতকালে খবর পেয়ে মামাবাবু হাসপাতালে ভাগ্নেকে দেখতে গেলেন।

এর পরের কাহিনী খুব সংক্ষিপ্ত, কিঞ্চিৎ আলাপ।

মামা: তোর কী হয়েছে?

ভাগ্নে: বুকে জল জমে গেছে।

মামা: কী করে বুকে জল জমল?

ভাগ্নে: তুমি সবচেয়ে ভাল জান।

মামা: আমি সবচেয়ে ভাল জানি?

ভাগ্নে: হ্যাঁ। তুমি জান। তুমি সবচেয়ে ভাল জান। তুমি বার বার আমার ড্রিঙ্কে জল মেশাতে। বলতে, বলতে জল বেশি করে নিতে।

মামা: কিন্তু তাতে কী হয়েছে?

ভাগ্নে: কী আর হয়েছে। বুকে জল জমে গেছে। এতদিন যা কিছু মদ খেয়েছিলাম সব বেরিয়ে গেছে শরীর থেকে, শুধু তুমি যে জলটুকু দিয়েছিলে সবটা বুকে বসে গেছে।

একটু আগের জলের গল্পটা বড় নির্জলা। এতক্ষণ পরে একটা জলো জলো গল্প বলি। জলের গল্প তারপরেই শেষ।

গল্পটা অকল্পনীয়। সে কবিও নেই সে দারোগাও নেই।

দারোগা সাহেব মাতাল কবিকে ফুটপাত থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপরে পরপর দুটি বাটিতে একটায় নিতান্ত পরিচ্ছন্ন গভীর নলকূপের জল অন্যটিতে ভাল রাম ছয় আউন্স রেখে কবিকে বললেন, ‘একটা গোরুকে যদি বলি তা হলে সে কোনটা খাবে!’ তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করে দারোগা সাহেব বললেন, ‘গোরুটা রাম ছোঁবে না, জলটা খাবে।’

কবি মাথা তুলে বললেন, ‘সেই জন্যই সে গোরু, আর সেইজন্যই আমি কবি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *