4 of 8

কথা বলার বিপদ

কথা বলার বিপদ

রসরাজ শিবরাম চক্রবর্তী নিজেকে পানাসক্ত বলে ঘোষণা করেছিলেন। এই পান অবশ্য কোনও মদ্য জাতীয় তরল পানীয় নয়, এমনকী নিতান্ত তাম্বুলও নয়। এ হল ইংরেজি পান (Pun), শব্দে শব্দে ধ্বনিগত মিলের ব্যবহারে কৌতুক সৃষ্টি। ইংরেজি ভাষায় ‘পান’-এর মোক্ষম সব ব্যবহার পাওয়া যায়।

বাংলায় রবীন্দ্রনাথ থেকেই একটা উদাহরণ দিচ্ছি। দিলীপ রায় একবার পণ্ডিচেরি থেকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। পরনে লাল রেশমের উজ্জ্বল পোশাক। রবীন্দ্রনাথ তাই দেখে বলেছিলেন, ‘প্রসাধন তো যথেষ্টই হয়েছে, সাধন কেমন হচ্ছে?’ প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, দিলীপ রায় তখন পণ্ডিচেরি আশ্রমে সাধনারত ছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে নয়, রবীন্দ্রনাথের মৌখিক কৌতুকীতে, ‘পান’-এর এ জাতীয় বহু চমৎকার ব্যবহার হয়েছে।

আমাদের বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেও একসময় কথায় কথায় ‘পান’ ব্যবহার করা যথেষ্টই ছিল।

আমি সেই সময় শুয়োরের মাংস বা হ্যাম কখনও কখনও খেতাম। পরে কোথায় পড়লাম হ্যাম খেলে পেটে পোকা হয়। একথা আমার বন্ধু কবি সুধেন্দু মল্লিককে বলাতে সে বলেছিল, ‘ভয়ের কোনও কারণ নেই, তুমি তো আর হ্যামেশা খাচ্ছ না।’

বাঙালতা-দুষ্ট উচ্চারণ থেকে তখনও আমি মুক্ত হইনি, (এখনও হয়েছি কি?)।

তখন আমি সে সময়কার সাপ্তাহিক ‘অমৃত’ পত্রিকায় একটা ফিচার লিখতাম, কিন্তু ইংরেজি বানান অনুযায়ী উচ্চারণ করতাম ফেচার বা ফ্যাচার। সুধেন্দু আমাকে জিজ্ঞাসা করত, ‘কী হে তোমার ফ্যাচাং কেমন চলছে?’

ব্যক্তিগত কথা থাক। যাঁকে দিয়ে আরম্ভ করেছি সেই মহামহিম শিবরাম চক্রবর্তীর প্রসঙ্গে আসি। তিনি তাঁর হাসির গল্পের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে পান প্রাচুর্যে ভরপুর করে দিয়ে গেছেন।

‘মস্তিষ্কের পিণ্ড চটকে পণ্ডিত’ কিংবা ‘একশো একার জমি আমার কুঞ্জকাকার একার’, ‘স্বামী মানেই আসামী’,—

উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই। শিবরামের ভাষায় বলা যায়, তিনি শুধু পানাসক্তই ছিলেন না, তিনি বেশ্যাসক্তও ছিলেন, বেশি + আসক্ত = বেশ্যাসক্ত।

শিব্রাম চক্রবর্তী লিখেছিলেন, ‘শিবরাম চক্রবর্তীর মতো কথা বলার বিপদ’। তাঁর নিজের নাম এবং পদবি শিবরাম এবং চক্রবর্তী এই নিয়ে তিনি কত যে শব্দের মজা, কথার খেলা করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই।

শিবরামের কথা অতঃপর একদিন বিস্তারিতভাবে বলা যাবে, আপাতত কথা বলার বিপদের কথা বলি।

এক মধ্যবয়সি ভদ্রমহিলা। তাঁর স্বামী কর্মরত অবস্থায় বাড়ি ফেরার পথে চোলাই খেয়ে লরি চাপা পড়ে মারা গেছেন। মহা নচ্ছার ছিলেন তিনি, কিন্তু আইনত তাঁর স্ত্রীকে একটি কাজ দিতে হবে।

আমি কর্মকর্তা হিসেবে নিয়মমাফিক বিধবা মহিলার সাক্ষাৎকার নিলাম, ‘আপনাদের কটি ছেলেমেয়ে?’

বিধবা বললেন, ‘দুটি ছেলে, তিনটি মেয়ে।’

আমি বললাম, ‘একত্রে পাঁচটি।’

বিধবা বলেন, ‘আমাকে কি কুকুর-বেড়াল ঠাউরেছেন? একত্রে নয়। একজন-একজন করে এক বছর দেড় বছর বাদে বাদে আমার ছেলেমেয়েরা সব জন্মেছে।’

আমি হতভম্ব হয়ে বিধবা মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সত্যি, কথা বলার কী বিপদ!

পুনশ্চ:

শুধু সাবালকদের সঙ্গেই কথা বলার বিপদ আছে, তা নয়, শিশুদের জগতেও অনেক রকম মারপ্যাঁচ থাকে।

সেদিন পার্কে একটা বেঞ্চিতে বসেছিলাম। আমার সামনেই ঘাসের ওপরে চুলে লাল রিবন বাঁধা একটি ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে আপন মনে খেলা করছিল। শিশুটির বয়েস বড় জোর পাঁচ-ছয় হবে।

মেয়েটিকে ডেকে একটু আলাপ করার লোভ হল। তাকে নাম জিজ্ঞাসা করলাম। সে চুপ করে রইল। কোনও কথা বলল না।

এবার তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘তুমি কি ইস্কুলে যাও?’

মেয়েটি চটপট জবাব দিল, ‘ইস্কুলে আমি যাই না, আমাকে পাঠানো হয়।’ এরপর আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে আবার খেলতে চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *