দুর্ঘটনা
দুর্ঘটনাই যখন বিষয়বস্তু তবে বিমান দুর্ঘটনা দিয়েই শুরু করি।
খবরের কাগজের পাতায়, বিভিন্ন বৈদ্যুতিন তথা বেতার মাধ্যমে বিমান দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়। কামকাটকায় বিমান ভেঙে পড়ে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে, সে খবর কাগজের প্রথম পাতায় আর ঘরের পাশে বরিশালে নৌকাডুবিতে তিরিশজন নিহত, চল্লিশজন নিখোঁজ সে খবর সপ্তম পাতায়। বাস দুর্ঘটনা, ট্রেন দুর্ঘটনায় হতাহত শতাধিক না গেলে তেমন পাত্তা পায় না।
বিমান ভ্রমণের আদি যুগে, আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে প্রমথ সমাদ্দারের কার্টুন দেখেছিলাম, বিমান ভেঙে পড়ে আছে। এক গুরুতর আহত যাত্রী অচেতন ভূমি-শায়িত পাইলটকে ধাক্কা দিয়ে প্রশ্ন করছে, ‘ও পাইলট সাহেব, বেঁচে আছেন কি? আমার রিটার্ন টিকিটের কী হবে?’
অধিকাংশ দুর্ঘটনাতেই অবশ্য রিটার্ন টিকিটের সমস্যা থাকে না, সেগুলো ইংরেজিতে যাকে বলে fatal accident, বাংলায় বলা হয় মারক দুর্ঘটনা।
আমরা ও রকম দুর্ঘটনা এড়িয়ে যাব। আমাদের এবারের আলোচ্য বিষয় একটি সামান্য কান-কাটার কাহিনী।
দুর্ঘটনা সংক্রান্ত এই কাহিনীটি আগেও বলেছি। পুরনো গল্প। তবে আগে যাঁরা শুনেছেন বা পড়েছেন তাঁদেরও হয়তো খারাপ লাগবে না।
উল্টোডাঙা আজাদ হিন্দস মিল একটি কাঠ চেরাইয়ের কারখানা। এখানে বৈদ্যুতিক করাতে সব রকম কাঠ কাটা হয়। হেডমিস্ত্রি বঙ্কুবাবু মাপমতো কাঠ কাটা হচ্ছে কি না পেনসিল-নোটবুক নিয়ে তার তদারকি করছিলেন। কী মাপে কাঠ কাটা হবে, নোটবুকে পেনসিল দিয়ে হিসেব কষে তিনি চেরাই মিস্ত্রিদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছিলেন।
হঠাৎ লোডশেডিং হল, বিদ্যুতের করাত খ্যাচাং করে বন্ধ হয়ে গেল। অনেকক্ষণ পরে বিদ্যুৎ ফিরে আসতে আবার চেরাই মেশিন চালু করা হল। কিন্তু কোথাও এবার একটু গোলমাল হয়েছে।
করাতের মধ্য থেকে কেমন একটা কিচি-কিচ কিচি-কিচ শব্দ বেরচ্ছে, করাতের গতিও এলোমেলো। বঙ্কুবাবু হেডমিস্ত্রি, কারখানার সব দায়িত্ব তাঁর, তিনি আগ বাড়িয়ে দেখতে গেলেন করাতের কী হয়েছে।
এরই মধ্যে চেরাই মিস্ত্রি সোলেমান করাত কলের ওপর থেকে ‘বঙ্কুদা সাবধান, বঙ্কুদা সাবধান’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। কিন্তু তখন আর সাবধান হওয়ার সুযোগ নেই। বঙ্কুমিস্ত্রির ডান কান করাত কলে খ্যাচাং করে কেটে মাথা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
কানটা শূন্যে লাফিয়ে উঠে চেরাই করা কাঠের ফাঁকে গিয়ে পড়েছে। সবাই মিলে তাড়াতাড়ি কাঠ সরিয়ে কান উদ্ধার করা হল। এবার বঙ্কুমিস্ত্রিকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে দেখতে হবে কানটা জুড়ে দেওয়া যায় কি না।
বঙ্কুমিস্ত্রি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছেন, কাটা জায়গাটা দিয়ে দরদর করে রক্ত পড়ছে। কানটা কুড়িয়ে এনে বঙ্কুবাবুকে দেখাতে, তিনি কিন্তু একবার দেখেই বলে দিলেন, ‘এ কান আমার নয়।’
কেন নয়? এখানে আরেকটা কাটা কান আসবে কোথা থেকে? এই রকম সব প্রশ্নের জবাবে বস্তুবাবুর একটাই জবাব, ‘ওটা আমার কান হতেই পারে না। আমার কানের পিছনে আমার পেনসিল গোঁজা ছিল। এটার পিছনে তো পেনসিল নেই।’
পেনসিলটা কাঠের গাদার পাশেই পড়ে ছিল। একজন সেটা কুড়িয়ে এনে দিল। সেটা হাতে নিয়ে বঙ্কুবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ এটা আমার পেনসিল, কিন্তু এই কাটা কানটা আমার নয়।’
সবাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন?’
বঙ্কুবাবু বললেন, ‘কেন আবার?’ বলে কাটা কানটা বাঁ হাতে এবং পেনসিলটা ডান হাতে ধরে সেই কানটায় পেনসিলটা গোঁজার চেষ্টা করে সবাইকে দেখিয়ে দিলেন যে, ওই কানটায় পেনসিল গোঁজা যাচ্ছে না। ‘এ কানটা আমার হতে পারে না। আজ তিরিশ বছর ধরে কানে পেনসিল গুঁজে আসছি। পেনসিল গোঁজা যাচ্ছে না আর এখন আমি তোমাদের চাপে পড়ে স্বীকার করব যে এটা আমার কান?’