4 of 8

সময়ের হিসেব

সময়ের হিসেব

সর্বাণী-সৰ্বানন্দদের ফ্ল্যাটটা তেমন বড় নয়। এই যে রকমটা হয় আর কী। একটা মোটামটি শোবার ঘর। এক চিলতে বাইরের ঘর। একটু খাওয়ার জায়গা। কোনও এক্সট্রা ঘর বা গেস্ট রুম বলে কিছু নেই। অতিথি অভ্যাগত এলে একটু অসুবিধে হয়ে থাকে বইকী।

তাই বলে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব আসবে না তা তো হতে পারে না। যারা বাইরের থেকে আসবে, কলকাতায় থেকে গেলে তাদের রাতের শোবার জায়গাও দিতে হবে।

গতকাল সন্ধ্যাবেলা শ্যামানন্দ দত্ত পাটনা থেকে এসেছেন। কলকাতায় এসে সর্বানন্দদের ফ্ল্যাটে উঠেছেন। শ্যামানন্দ দত্ত সর্বানন্দের কাকা, সেই সূত্রে সর্বাণীর খুড়শ্বশুর।।

শ্যামানন্দ সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন। সরকারি কাজ করতেন। পাটনা সেক্রেটারিয়েটে পঁয়ত্রিশ বছর কাজ করেছেন। বড়বাবু পর্যন্ত হয়েছেন।

শ্যামানন্দ রাশভারী, ধর্মপ্রাণ লোক। তদুপরি চিরকুমার। রিটায়ার করার পরে চারিদিকে তীর্থ করে বেড়াচ্ছেন। কোনও অসুবিধে নেই, ঝাড়া হাত পা। যেখানে যে আত্মীয় আছেন, চিঠি লিখে জানিয়ে দিচ্ছেন অমুক তারিখে যাচ্ছি। আদর-আপ্যায়ন তেমন না হলে সোজা হোটেলে চলে যাচ্ছেন।

শ্যামানন্দ কলকাতায় ভাইপো সর্বানন্দের বাড়িতে এসে উঠেছেন কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর কালীপ্রণাম করতে যাবেন বলে। এ বাড়িতে অবশ্য তাঁর আপ্যায়নে ত্রুটি হবে না। সর্বানন্দ-সর্বাণী তেমন দম্পতি নয়। তা ছাড়া ওয়ারিশহীন সচ্ছল কাকাকে কোনও কারণে ক্ষুণ্ণ করার মতো নির্বোধ সর্বানন্দ নন।

এমনকী এ ব্যাপারে একটু অতিরিক্ত সতর্কতাও গ্রহণ করেছেন সর্বানন্দ। স্ত্রীকে বলে দিয়েছেন, ‘কাকা প্রবীণ মানুষ, উনি যে দু’-এক দিন থাকবেন তোমার ওই চুড়িদার, শালোয়ার-কামিজ এসব না পরে শাড়ি পরেই থাকো।’ সর্বাণী এ ব্যাপারে কোনও আপত্তি করেননি।

ফ্ল্যাটের বাইরের ঘরে সোফা-কাম-বেডে বিছানা করে দেয়া হয়েছে শ্যামানন্দের, সেখানেই আজ সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে পদ্মাসনে জপ করছেন। অসমতল সোফা-কাম-বেড পদ্মাসনের পক্ষে অনুকূল জায়গা নয়। কিন্তু শ্যামানন্দের কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। এ ব্যাপারে তাঁর দক্ষতা অপরিসীম।

সর্বাণীকে এর আগে শ্যামানন্দ মাত্র একবার দেখেছেন, সেও সেই বিয়ের সময়। এখানে আসার আগে একটু খটকা ছিল, নতুন যুগের আধুনিকা মেয়ে, কী জানি কেমন ব্যবহার হবে।

শ্যামানন্দ ধার্মিক ব্যক্তি হলেও, আহারে বিহারে তাঁর অরুচি বা সংস্কার নেই। মাছ-মাংস-ডিম সবই খান। কাল সন্ধ্যাতেই এখানে পৌঁছে সর্বাণীকে তিনি সেকথা বলে দিয়েছেন।

কাল রাতে মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়েছেন। আজ সকালে একটু আগে সর্বাণী এসে জেনে গিয়েছেন তিনি সকালে সাধারণত চা আর ডিম সেদ্ধ এবং টোস্ট খান। সর্বাণী জেনে নিয়েছেন, হাফ বয়েল ডিমই তাঁর পছন্দ, কারণ ডেলি ডিম সেদ্ধ খেলে তাঁর হজমে কষ্ট হয়।

এখন বাইরের ঘরে পদ্মাসনে বসে শ্যামানন্দ, রান্নাঘর থেকে টুকটাক শব্দ হচ্ছে। হঠাৎ তাঁর কানে এল মিঠে গানের সুর। সর্বাণীর গানের গলাটা ভাল। তিনি গুনগুন করে ভজন গাইছেন,

‘ম্যায় নে চাকর রাখো,

চাকর রাখো, চাকর রাখো জি।’

শ্যামানন্দের মনটা খুশিতে ভরপুর হয়ে উঠল। বউমার গুণ আছে, কেমন চমৎকার ধর্মের গান গাইছে। হঠাৎ গানটা মাঝপথে থেমে গেল। শ্যামানন্দ একটু অবাক হলেন, ‘বউমা, বউমা’ করে সর্বাণীকে ডাকলেন।

একটু পরেই সর্বাণী আসতে তাকে শ্যামানন্দ প্রশ্ন করলেন, ‘চমৎকার গাইছিলে, গানটা বন্ধ করলে কেন?’

সর্বাণী বললেন, ‘আজ্ঞে, হাফ বয়েলে ওই পর্যন্তই গাই। এর চেয়ে বেশি হলে ডিম বেশি সেদ্ধ হয়ে যায়।’

এই উত্তরে বিভ্রান্ত শ্যামানন্দকে এসে উদ্ধার করলেন সর্বানন্দ। সর্বানন্দ কাকাকে বুঝিয়ে বললেন, সর্বাণী গান গেয়ে গেয়ে রান্নার সময়ের হিসেব রাখে। এই ভজনটা পুরো গাইলে সেই সময়ে ডিম সম্পূর্ণ সেদ্ধ হয়ে যায়। ভাত সেদ্ধ হতে ‘আগুনের পরশমণি’ দু’বার গাইতে হয়, ডাল সেদ্ধ করার সময় ‘জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে।’

একটু পরে ব্রেকফাস্ট নিয়ে সর্বাণী এলেন। শ্যামানন্দ ডিম খেয়ে দেখলেন হাফ ভজনে হাফ বয়েল চমৎকার হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *