4 of 8

সুখের লাগিয়া

সুখের লাগিয়া

বৈষ্ণব কবি বলেছেন, ‘সুখের লাগিয়ে এ ঘর বাঁধিনু।’ অবশ্য তাঁর সেই ঘর অনলে পুড়ে গিয়েছিল। সেই আক্ষেপ থেকেই এই কবিতা।

সুখ নিয়ে বড় অসুবিধে এই যে, সুখের দিনে কবিতা হয় না। সুখের রাতে নিখিল ধরা যেদিন করে বঞ্চনা, সেদিন কাব্য রচনার জন্যে দিস্তে দিস্তে কাগজ দরকার পড়ে।

আমাদের কেউ যদি জিজ্ঞাসা করেন, ‘কেমন আছেন?’ আমরা জবাবে বলি, ‘ভাল আছি।’ এটা কিন্তু কথার কথা, দায়সারা কথা। তা ছাড়াও এই ‘ভাল আছি’ ব্যাপারটা ঠিক সুখে আছি নয়। সুখ অনেক বড় ব্যাপার।

সুখ কী, বুঝতে গেলে অসুখ কী, সেটা জানতে হবে। সুখের অভাব হল অসুখ। সুখ-অসুখ দুই মিলে একত্রে দ্বন্দ্ব সমাস।

এই অসুখের ব্যাপারটা একটু গোলমেলে। সামান্য একটা সাদাসিধে প্রশ্ন—‘এই যে ভাল তো?’ কিংবা ‘কেমন আছেন?’ জিজ্ঞাসা করে কখনও কখনও গুরুতর বিপদে পড়তে হয়।

এ রকম মামুলি জিজ্ঞাসার প্রচলিত মামুলি উত্তর হল, ‘এক রকম’ কিংবা বড়জোর খুব স্মার্ট কেউ কেউ বলেন, ‘ভেবে দেখতে হবে।’

তবু এমন ব্যক্তিত্ব এই ধরা-সংসারে আছেন যাঁকে, ‘কেমন আছেন?’ বললেই যিনি ধরে নেন ‘কেমন আছি’ সেটা বিস্তারিতৃভাবে বলা প্রয়োজন এবং তিনি একটা ফিরিস্তি দিতে শুরু করেন।

(ক) গিন্নিকে বেড়ালে কামড়িয়েছে।

(খ) ছোট মেয়ের জলবসন্ত হয়েছে।

(গ) বড় মেয়ে নাইন থেকে টেনে উঠতে ফেল করেছে।

(ঘ) নতুন জুতো পায়ে দিয়ে পায়ে ফোসকা পড়েছে।

(ঙ) শেষ রাতে হাঁপের টান ওঠে।

পুরো লিখতে গেলে কুলোবে না, তবে যাঁরা এসব কথা বলেন, তাঁদের এ ব্যাপারে ক্লান্তি নেই।

এক বিদেশি দার্শনিক বলেছিলেন যে, সুখী মানুষ শুধু বসন্তের দিনেই সুখী নয়, সব ঋতুতেই সে সুখী। বার্নার্ড শ’ বলেছিলেন, সুখ উপভোগ করতে গেলে সুখ উৎপন্ন করতে হবে।

সুখের বিষয়ে একটা পুরনো ইংরেজি কবিতাও মনে পড়ছে কিন্তু কবির নামটা মনে পড়ছে না। কবিতাটির নাম ছিল বোধহয় ‘জীবনের গান’ কিংবা ওইরকম কিছু।

‘আমি আছি, আমি বেঁচে আছি, আমি সুখী,

আকাশ নীল তাই আমি সুখী,

পাড়াগাঁয়ের পথে আমি সুখী,

আমি সুখী শিশির পড়ে বলে।’

এত দূর লিখে তারপর ভাবলাম, সুখ নিয়ে অন্যের কথা জানা যাক। গঙ্গারামকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সুখ সম্বন্ধে তোমার ধারণাটি ঠিক কী?’

গঙ্গারাম বলল, ‘দাদা, বিয়ের পরে পরেই এক নামকরা জ্যোতিষীকে হাত দেখিয়েছিলাম। জানেন তো, বিয়ের মধুচন্দ্রিমা কাটতে না-কাটতেই আপনার বউমার সঙ্গে আমার ফাটাফাটি-কাটাকাটি শুরু হয়ে যায়। সেই জন্যে জ্যোতিষীর কাছে গিয়েছিলাম। রীতিমতো দক্ষিণা দিয়ে জ্যোতিষীকে হাত দেখিয়েছিলাম।’

ব্যাপারটা আমার জানা ছিল না, তাই বললাম, ‘জ্যোতিষী কী বললেন?’

গঙ্গারাম স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলল, ‘সে অনেক কথা। দাদা, এক কাপ চা খেতে পারি?’

আমি লিখতে লাগলাম। তার আগে বাড়ির মধ্যে চায়ের কথা বলে দিলাম। গঙ্গারাম খবরের কাগজ পড়তে লাগল। একটু পরে চা এল, চা পান করতে করতে গলা ভিজিয়ে গঙ্গারাম তার অভিজ্ঞতার কথা বলল।

‘কলকাতার সবচেয়ে নামকরা জ্যোতিষীর কাছে গেলাম। এক হাজার এক টাকা দক্ষিণা, তাই দিলাম। জ্যোতিষীঠাকুর প্রথমে আমার পা দেখলেন,তাঁর কনসালটিং রুমে ডাক্তারখানার মতো একটা কোচ ছিল, সেখানে আমাকে শুইয়ে লাল কাচওয়ালা টর্চ ফেলে আমার কপাল তন্ন তন্ন করে দেখলেন। পাঁচশো পাওয়ার আলো ফেলে আমার হাত আতস কাচ দিয়ে দেখলেন। অবশেষে বললেন, ‘বলুন কী জানতে চান?’

চায়ের পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে গঙ্গারাম কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইল। আমি বললাম, ‘তারপর?’

গঙ্গারাম বলল, ‘জ্যোতিষীঠাকুর জানতে চাইলেন—তোমার কী জিজ্ঞাসা? তখন আমি বললাম, ঠাকুর আমি সদ্য বিয়ে করেছি। ঠাকুর বললেন, সে আমি জেনে গেছি। তখন আমি বললাম, ঠাকুর আপনি আমাকে বলে দিন, বিবাহিত জীবনে আমি সুখী হব কিনা?’

এবার আমি প্রশ্ন করলাম, ‘জ্যোতিষীঠাকুর কী বললেন?’

গঙ্গারাম বলল, ‘সেটাই তো বলছি। ঠাকুর বললেন যে, প্রথম পাঁচ বছর খুব ঝামেলা যাবে। আমি প্রশ্ন করলাম, তারপরে সুখী হব? ঠাকুর বললেন, সুখী হবে না, তবে সয়ে যাবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *