অবনী, বাড়ি আছো?
অল্পায়ু বংশের সন্তান সত্যজিৎ রায় অবশ্য খুব দীর্ঘায়ু হননি। তবে অপরিণত বয়েসে অকালমৃত্যু নয়, তিনি সত্তর পেরিয়ে মারা গিয়েছিলেন। বংশে অকালমৃত্যু ছিল বলে সত্যজিৎ কখনও কখনও আয়ুর ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন। তাঁর অভিমত ছিল, আশি-নব্বইয়ের বেশি বাঁচা ভাল নয়।
আমাদের মাতামহী-পিতামহীরা বাল্যকালে চিবুক ধরে বলতেন, ‘শতায়ু হও।’ প্রবীণ পণ্ডিতমশায় সস্নেহে মাথায় হাত রেখে বলতেন, ‘নিরাপদে শতং জীবেৎ।’
এই নিরাপদে কথাটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ, যেমন শ্রাদ্ধের আমন্ত্রণপত্রে পরলোকগতের বিষয়ে কখনও কখনও উল্লেখ থাকে, ‘সজ্ঞানে, সুস্থ শরীরে।’
রাজশেখর বসু, বাঙালির পরশুরাম সুস্থ শরীরে আশি পেরিয়ে পরলোক গমন করেছিলেন। তাঁর একটি অসামান্য গল্পে এক শতায়ু ব্যক্তির শতবার্ষিক জয়ন্তী-দিবসের কথা বলেছিলেন। এই শতায়ু ব্যক্তি অতীত ও বর্তমানকে ঘুলিয়ে ফেলেছেন। এমন হাস্যময় বেদনার গল্প বাংলাভাষায় খুব বেশি রচিত হয়নি।
শতায়ু হওয়া সোজা কথা নয়। আমি এখন যে বয়েসে এসে পৌঁছেছি, বাকি জীবন যদি এর অর্ধেক সময় বাঁচি তা হলে আমি শতজীবী হব।
পেছনদিকে তাকালে মনে হয় কিছুই নয়, মাত্র তেত্রিশ-চৌত্রিশ বছর। উনিশশো সাতষট্টি, আটষট্টি সন।
মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। পুরনো কালীঘাট বাড়ি। দোতলার ভাঙা বারান্দায় আমার ছেলে তাতাই টলমল হাঁটছে। ধুলিধূসর রাইটার্স বিল্ডিং-এর নগণ্য প্রান্তে আমার সামান্য স্থান। সন্ধ্যায় জড়াজডি আড্ডা, কবিতা, স্বপ্ন। বাড়ি গিয়ে ঘুমনোর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় তথা শক্তির তারস্বরে চিৎকার। ‘টর্পেডো, টর্পেডো’—টর্পেডো মানে তারাপদ, শক্তির কাছে সেটাই আমার ডাকনাম।
আমি সাড়া দিতাম না। মিনতিকে বলতাম, ‘চুপ।’ সে-ও খুব চাপা স্বরে। কিন্তু শক্তিকে এড়ানো যেত না। সে আরেকটু ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দক্ষিণ দিকের বাড়ির দিকে তাকিয়ে এক বৃদ্ধকে ডাকত, ‘অবনী, বাড়ি আছো? অবনী, অবনী বাড়ি আছো?’ আমার প্রতিবেশী সেই অবনী ছিলেন আমার দূর সম্পর্কের দাদাশ্বশুর। তিনি শক্তির ডাকে সাড়া না দিয়ে পারতেন না। সেই অতিবৃদ্ধ বাড়ির সদর দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেন, দেখতে আসতেন কে তাঁকে এতকাল পরে নাম ধরে ডাকছে।
আমি দোতলার বারান্দা থেকে উঁকি দিয়ে দেখছি। মাত্র গত সপ্তাহেই অবনীদাদুর সঙ্গে শক্তির পরিচয় হয়েছে তাতাইয়ের জন্মদিনে।
সেদিন রাতে দরজা খুলে বেরিয়ে শক্তিকে দেখে অবনীদাদু বললেন, ‘আপনি?’
শক্তি বলল, ‘আরে বুড়ো, আজকেও বাড়ি আছো? আজ তোমার একশো বছরের জন্মদিন, সেটাও খেয়াল নেই?’
ঘুম-চোখে অবনী বললেন, ‘একশো বছর? তা হবে।’