হতভাগ্য এক রাজকুমার

মেসিডোনের পথে পথে বুকাফেলাসকে নিয়ে ঘুরে বেড়ান আলেকজান্ডার। সাথে থাকে বন্ধু হেফাস্টিয়ন। কখনো কখনো মেসিডোনের সৈনিকদের ক্যাম্পে চলে যান আলেকজান্ডার। তাদের অবস্থা নিজের চোখে দেখে নেন। মেসিডোনের সব যোদ্ধাই খাঁটি মেসিডোনিয়ান। এদের মধ্যে গ্রিসের অন্য কোনো অঞ্চল থেকে আসা যোদ্ধা নেই। আলেকজান্ডার বাবার নিয়োজিত যোদ্ধাদের দ্যাখেন আর কী যেন ভাবেন। বন্ধু হেফাস্টিয়ন কখনো কখনো জানতে চান, কী ভাবছেন রাজপুত্র?

আলেকজান্ডার উত্তর দেন, ভাবছি অনেক কিছু। ভাবছি শুরু অ্যাস্টিটলের শিক্ষা কখনো বৃথা যেতে পারে না। তার কাছ থেকে আমি যা শিখেছি, তা যদি কাজে লাগাতে পারি তাহলে পুরো গ্রিসের সেরা জাতি হবো আমরা। আমাদের মেসিডোন হবে সেরা দেশ। তবে এর জন্য সুযোগ চাই। 

বন্ধু হেফাস্টিয়ন আলেকজান্ডারের কথা শুনে মনে মনে হাসেন। রাজপুত্র নিজেই যদি বলে যে, সে সুযোগ চায়— এর চেয়ে হাস্যকর আর কী হতে পারে। হেফাস্টিয়ন তখন ভুলে যান, মেসিডোনের রাজা হওয়ার নিয়মের কথা। এর মধ্যেই খবর পাওয়া গেল, রাজা ফিলিপ আরেকটা বিয়ে করছেন। এবার বিয়ে করছেন একজন খাটি মেসিডোনিয়ান নারীকে। যাতে মেসিডোনের ভবিষ্যৎ রাজা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে না হয়। 

প্রথম যেদিন রাজগণক জানালেন রানী অলিম্পিয়াসের গর্ভে আসছে এক রাজপুত্র, সেদিন থেকেই দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছে রাজা ফিলিপের। এই রাজপুত্র নিয়ম অনুযায়ী কোনোদিনই মেসিডোনের সিংহাসনে বসতে পারবেন না। কারণ আর কিছু নয়, একটাই— তা হলো রানী অলিম্পিয়াস মেসিডোনের মেয়ে নন। রানী অলিম্পিয়াস হচ্ছেন এপিরাসের রাজকন্যা। আর রাজা ফিলিপ হচ্ছেন মেসিডোনের রাজা। কাজেই তাদের সন্তান পুরো মেসিডোনিয়ান নন। এটাই আলেকজান্ডারের রাজা হওয়ার পথে একমাত্র বাধা। যদিও রাজা ফিলিপ যে মেসিডোনিয়ার রাজা হয়েছেন, এটাও তার রাজ্য নয়। মেসিডোন হচ্ছে রাজা ফিলিপের ভাই রাজা তৃতীয় পারডিকাস—এর রাজ্য। উত্তর গ্রিসের ছোট্ট একটা দেশ মেসিডোন। খৃষ্টপূর্ব ৩৫৯ অব্দে মারা যান রাজা তৃতীয় পারডিকাস। মেসিডোনের রাজপুত্র তরুণ অ্যামিনটাস ভেবেছিলেন বাবার মৃত্যুর পর তিনিই সিংহাসনে বসবেন। তখন নিয়মও ছিল সেটা। পারডিকাসের ছেলে অ্যামিনটাস সাহায্য চাইলেন চাচা ফিলিপের কাছে। চাচা ফিলিপের বুদ্ধি পরামর্শে দেশ শাসন করবেন এই তার ইচ্ছে। কিন্তু ফিলিপ তার ভাস্তে অ্যামিনটাসকে সরিয়ে নিজেই রাজা হয়ে বসেছিলেন মেসিডোনের সিংহাসনে। সিংহাসনে বসে নিজেকে ঘোষণা দিলেন রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ হিসেবে। বেশ কড়া শাসক হিসেবে কিছুদিনের মধ্যেই নাম ছড়িয়ে পড়ল ফিলিপের। দক্ষ শাসক হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে, দেশের মানুষও তাকে রাজা হিসেবে মেনে নিল। আর রাজা হয়েই মেসিডোনের সীমানা বাড়িয়ে নিলেন ফিলিপ। জয় করলেন গ্রিসের বেশ কিছু রাজ্য। আর কয়েক দশকের মধ্যেই গ্রিসের বেশিরভাগ রাজ্যই দখল করে নিলেন।

রানী অলিম্পিয়াসও এপিরাসের রাজকন্যা। এখনকার আলবেনিয়া আর গ্রিসের উত্তর—পশ্চিমের কিছু অংশ নিয়ে রাজ্য এপিরাস। এপিরাসের রাজা প্রথম নিউটলেমাস। কিন্তু অলিম্পিয়াস যতই রাজকন্যা হন, তাতে কিছু যায় আসে না। মেসিডোনের নিয়ম অনুযায়ী তিনি কখনো রাজার মা হতে পারবেন। তার পক্ষে রানীমা হওয়া সম্ভব নয়। আর সম্ভব নয় বলেই রাজা ফিলিপ আবার বিয়ে করতে চাইলেন। আলেকজান্ডারও ভেবেছিলেন, তার মায়ের পরে আর কেউ তার নতুন মা হবেন না, কিন্তু তিনি তো রাজপুত্র, তিনি ভাবলেই তো আর হয় না। ভাবতে হবে রাজাকে। রাজাও ভাবলেন। আর ভাবলেন বলেই নতুন বিয়ের তোড়জোর শুরু হয়ে গেল। বিশাল তার রাজ্য। এই রাজ্যের একজন উপযুক্ত রাজা দরকার। দরকার এমন একজন রাজা, যার শরীরে থাকবে কেবল মেসিডোনের রক্ত। যদি আলেকজান্ডার একেবারে খাটি এক মেসিডোনিয়ান হতো, তাহলে আর চিন্তা করতে হতো না। বরং আলেকজান্ডার রাজা হলে সবার চেয়ে ফিলিপই বেশি খুশি হতেন। রাজা হওয়ার মতো, রাজ্য টিকিয়ে রাখার মতো সব গুণই তার মধ্যে দেখতে পেয়েছেন ফিলিপ। শুধু তাই নয়, তার মনে হচ্ছে একদিন মেসিডোনের সীমানা গ্রিস ছাড়িয়ে যাবে। এবং আলেকজান্ডার, বীর আলেকজান্ডারই মেসিডোনকে করবে আরো বিশাল, আরো সমৃদ্ধশালী। কিন্তু সে জন্য আগে চাই একজন খাটি মেসিডোনিয়ান রাজা। 

রাজার বিয়ে। মহা ধুমধাম। শান্তি নেই আলেকজান্ডারের মনে। শান্তি নেই রানী অলিম্পিয়াসের মনেও। সবই বৃথা মনে হচ্ছে তাদের কাছে। এই রাজ্য, রানীর সম্মান—সব কেমন মলিন মনে হচ্ছে তার কাছে। রাজপুত্র আলেকজান্ডারের মনের অবস্থা আরো খারাপ। বেশ মন খারাপ তার। এই বুড়ো বয়সের বাবাকে বিয়ে করতে দেখলে কার মন ভালো থাকে? সেই বাবা রাজা হলেই কি, আর ভিখারী হলেই কী। বিয়ের দিন আলেকজান্ডার প্রিয় ঘোড়ার পিঠে চেপে চলে গেলেন অনেকদূর। হেফাস্টিয়নও অনুসরণ করলেন রাজপুত্রকে। অনেক দূরের এক নির্জন প্রান্তরে ঘোড়া থামালেন আলেকজান্ডার। অনেকক্ষণ পর আরেকটা ঘোড়ায় চেপে কাছে এলেন হেফাস্টিয়ন। প্রচণ্ড ক্রোধে জ্বলছে আলেকজান্ডারের চোখ দুটো। ওই চোখের দিকে যেন তাকানো যায় না। একবার তাকিয়েই ভয় পেয়ে গিয়েছেন হেফাস্টিয়ন। ওই চোখে তাকানোর আর সাহস হয়নি তার। চুপচাপ ঘোড়ার লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। একসময় আলেকজান্ডার মুখ খুললেন, আমার কষ্ট আমাকেই সইতে দাও হেফাস্টিয়ন। তুমি জানো না, এটা কী পরিমাণ কষ্ট!

হেফাস্টিয়ন বললেন, না জানলেও কিছুটা হলেও বুঝতে পারি। আপনার কষ্ট আমাকেও কষ্ট দেয় রাজপুত্র। 

আলেকজান্ডার জানতে চাইলেন, এখন আমি কী করবো?

হেফাস্টিয়ন বললেন, ধৈর্য ধরতে হবে।

আলেকজান্ডার বললেন, আর কতদিন? 

হেফাস্টিয়ন বললেন, আপনি তো গ্রিসের সেরা দার্শনিক ও জ্ঞানী। অ্যারিস্টটলের শিষ্য। আপনি এভাবে ভেঙে পড়লে হবে?

আলেকজান্ডার বললেন, ভেঙে পড়া ছাড়া আর কোনো উপায় তো আমি দেখছি না। বাবার বিরুদ্ধে আমি লড়াই করবো? যদিও আমি একাই বাবার পুরো সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে পারবো। সে শক্তি আর সাহস আমার আছে। তবু সেটা কি ঠিক হবে?

হেফাস্টিয়ন বললেন, কখনোই ঠিক হবে না। বরং এভাবে রাজা হলে মেসিডোনের সেনাবাহিনী আপনাকে মেনে নেবে বলে মনে হয় না। প্রজারাও আপনাকে রাজা হিসেবে মানতে চাইবে না। বরং সেটা আপনার জন্য ক্ষতির কারণ হবে। 

আলেকজান্ডার বললেন, তাহলে এখন আমি কী করবো? 

হেফাস্টিয়ন বললেন, রাজার বিয়ের অনুষ্ঠানে যাবেন। রাজার পাশে পাশে এখন আপনার থাকা প্রয়োজন। মুখে যা—ই বলেন না কেন, আমি জানি তিনি। আপনার ওপর নির্ভরশীল। 

অনেক কষ্টে কষ্ট চেপে রেখে রাজা ফিলিপের বিয়ের অনুষ্ঠানে এলেন আলেকজান্ডার। বিয়ের কাজ শেষ। এখন কেবল ভোজ।

নতুন রানী ক্লিওপেট্রা। রাজা ফিলিপের পঞ্চম রানী। আলেকজান্ডারের পঞ্চম মা। নিখাদ মেসিডোনিয়ান। কিন্তু রাজার পাশে নিজের পঞ্চম মা’কে দেখে সহ্য করতে পারলেন না আলেকজান্ডার। মায়ের মতোই রাগ পেয়েছেন। তিনি। হঠাৎই রেগে গেলেন আলেকজান্ডার। চিৎকার করে বললেন, আমাকে আমার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার চক্রান্ত, তাই না বাবা? 

রাজা ফিলিপ কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। যদিও জানেন আলেকজান্ডার একটু বদরাগী। এবং আলেকজান্ডারের এই বদরাগটাকে তিনি সবসময়ই উপভোগ করেন। কিন্তু এখন আর উপভোগ করতে পারলেন না। তিনি নিজেও নিজের কাছে অপরাধী হয়ে আছেন। এ বিয়েটা কেবলই মেসিডোনের জাতীয়তাবাদ রক্ষার জন্য। কাউকে দুঃখ কিংবা আঘাত করার জন্য নয়। শুধুই মেসিডোনের স্বার্থে। অথচ আলেকজান্ডার কি না তাকে ভুল বুঝল? 

ফিলিপ বললেন, কথাটা তুমি ভেবে চিন্তে বলেছ তো? 

আলেকজান্ডারের মাথায় তখন আগুন ধরে গেছে। আগের চেয়েও জোরে চেঁচিয়ে বললেন, আপনি কাজটা ভেবে চিন্তে করেছেন তো? 

ফিলিপ হাসলেন। হাসতে হাসতে বললেন, আমি সব কিছুই ভেবে চিন্তে করি। 

আলেকজান্ডার বললেন, তাহলে আমাকে সিংহাসন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনাও ভেবে চিন্তে করেছেন? খুব ভালো। আমি কি আপনার সন্তান নই? আপনার যখন মেসিডোন থেকে ইউরোপ, ইউরোপ থেকে এশিয়ার দিকে ছোটার কথা, তখন আপনি কেবল এ ঘর থেকে ও ঘরে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এটা কি ঠিক হচ্ছে? 

আর সহ্য করতে পারলেন না রাজা ফিলিপ। আর কত সহ্য করা যায়? তিনিও রেগে গেলেন। রেগে কোনো কথা বললেন না। কোমরে বাঁধা খাপ থেকে তলোয়ার বের করে ছুড়ে মারলেন আলেকজান্ডারের দিকে। 

রাজার এমন কাণ্ড দেখে ঘাবড়ে গেলেন আলেকজান্ডার। ভাগ্যিস তলোয়ারটা ভীষণ বেগে তেড়ে এলেও তার গায়ে লাগেনি। প্রাসাদের মেঝের উপরই পড়ল ঝন ঝন শব্দ করে। 

প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও আবার নিজেকে সামলে নিলেন আলেকজান্ডার। হাসতে হাসতে বললেন, ব্যর্থ চেষ্টা। আশা করি আপনার সকল অপচেষ্টাই ব্যর্থ হবে। আপনি আমাকে কখনো মেসিডোনের সিংহাসন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবেন না। 

রানী অলিম্পিয়াস রাজার এই আচরণ মোটেই মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু কিছুই করার নেই তার। তিনি চেষ্টা করলেন নতুন রানী ক্লিওপেট্রার সাথে মানিয়ে চলতে। কিন্তু নতুন রানী ক্লিওপেট্রা মোটেই সহ্য করতে পারতেন না রানী অলিম্পিয়াসকে। কারণ একটাই। আলেকজান্ডারের উত্থান। ওই ঘটনার পর রাজার সামনে খুব একটা যান না আলেকজান্ডার। কিন্তু সবাই আলেকজান্ডারের শক্তি—সামর্থ্যের কথা আলোচনা করে। সবাই আলেকজান্ডারকে সমীহ করে। মাঝে মাঝে তার মনে হয়, রাজা ফিলিপের চেয়েও যেন আলেকজান্ডার বেশি সমীহ পাচ্ছেন। এর মধ্যেও আলেকজান্ডারের বিরোধিতাকারীদের খোঁজ পেয়েছেন তিনি। তাদের খোজখবর পাওয়া যায় তার চাচা অ্যাটালাসের কাছে। চাচার চোখে মুখে উৎসাহ। তার ভাস্তি রানী হয়েছে। কাজেই কোনো একদিন রানীমা হবে । কিন্তু তাদের পথের একমাত্র কাটা হচ্ছে আলেকজান্ডার। আলেকজান্ডারকে সরাতে পারলে আর কোনো চিন্তা নেই। যদিও আলেকজান্ডারকে সরানোর প্রয়োজন নেই। নিয়ম মতো আলেকজান্ডার কখনোই মেসিডোনের রাজা হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। সে যতই শক্তিশালী হোক, কিংবা যতই ক্ষমতাবান হোক। তবু আলেকজান্ডারকে নিয়ে তাদের ভয়। গোঁয়ার, একগুয়ে, জেদী। একে শায়েস্তা করতে হলে রাজার সভাসদদেরই হাত করতে হবে। হাত করতে হবে সেনাবাহিনীকেও, যেন তারা আলেকজান্ডারকে কখনো কোনো সহযোগিতা না করে। এ বিষয় নিয়ে প্রায়ই রানী অলিম্পিয়াসের সাথে ঠোকাঠুকি লেগেই থাকতো নতুন রানী ক্লিওপেট্রার। রাজা ফিলিপও নতুন রানীর পক্ষ নিয়ে কথা বলতেন। আলেকজান্ডার কিছু বলতে গেলেই বাধা দিতেন রাজা। রাজপ্রাসাদে শুরু হলো অশান্তি। এদিকে নতুন রানীও রাজার কান ভারী করে রাখতেন আলেকজান্ডারের বিপক্ষে কথা বলে। নতুন রানীর সাথে রাজার দু একজন সভাসদও মত দিতে লাগলেন। সভাসদরা বুঝতে পেরেছেন, রাজার ক্ষমতা এখন নতুন রানীর কাছেই চলে গেছে। কাজেই নতুন রানীকে সন্তুষ্ট রাখতে পারলেই তারা ক্ষমতা বজায় রেখে চলতে পারবেন। এজন্য নতুন রানীর পক্ষেই তারা কথা বলেন। নতুন রানী ভুল কোনো কথা বললে সেটাও তারা সমর্থন করেন।

নতুন রানীর আচরণ, রাজার দ্বিমুখী নীতি, নতুন রানীকে সভাসদদের নোংরা তোষামদ— বড় কষ্ট দিল আলেকজান্ডারকে। বুঝতে পারলেন, এখানে ন্যায় বিচার পাবেন না। আবার রাজার বিপক্ষে লড়াইও করতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত মা আর একমাত্র ছোট বোনকে নিয়ে পেল্লার রাজপ্রাসাদ ছাড়লেন আলেকজান্ডার। মেসিডোনের রাজধানী পেল্লা কেবল নয়, মেসিডোনই ছেড়ে গেলেন তারা। চলে গেলেন নানাবাড়ি এপিরাস। মাকে নিয়ে ওখানেই কিছুদিন কাটালেন। নতুন মায়ের অত্যাচার আর ষড়যন্ত্রে মনটাই বিষিয়ে উঠেছে তার। বন্ধু হেফাস্টিয়নও যেতে চেয়েছিলেন আলেকজান্ডারের সাথে। কিন্তু আলেকজান্ডার তাকে সাথে নিলেন না। পাছে বন্ধুর মন খারাপ হয়, তাই বুঝিয়ে বললেন, তুমি এখানেই থাকো। রাজপ্রাসাদে কী কী হয়, আমাকে জানিও। কে কে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, তুমি এখানে না থাকলে আমি বুঝতে পারবো না। তাছাড়া তোমাকে আমি বিশ্বাস করি। তুমি ছাড়া সত্য তথ্য আর কেউ দেবে না আমাকে। অনেকেই আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে। নিজের বীরত্ব আর পাণ্ডিত্য জাহির করার চেষ্টা করবে। আমি জানি তুমি ওদের আর সবার মতো নও। কারণ তুমিও অ্যারিস্টটলের শিষ্য ছিলে একসময়।

হেফাস্টিয়ন বুঝতে পারলেন। কাজেই তিনি রয়ে গেলেন মেসিডোনের রাজধানী পেল্লাতেই। আর অভিমানী আলেকজান্ডার চলে গেলেন মেসিডোন ছেড়ে। মেসিডোন ছেড়ে যাওয়ার সময় এই উপত্যকা, ওই সমতল ভূমি, সবুজ গিরিখাদ আর ওই যে মাইসিয়া, যেখানে শুরু অ্যারিস্টটলের কাছে তিন বছর লেখাপড়া শিখেছিলেন আলেকজান্ডার— সব যেন তাকে বিদায় জানাচ্ছে। সত্যিই কি তাকে বিদায় জানাচ্ছে? নিজের জন্মভূমি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন তিনি। চলে যাচ্ছেন বাবার ওপর রাগ করে। এক রাজপুত্র তার ন্যায্য অধিকার, সিংহাসন ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। কেউ তাকে বাধা দিল না। কেউ বলল না, আলেকজান্ডার এই পবিত্র জন্মভূমি ছেড়ে যেও না। কে বলবে? কেন বলবে? বলার মতো কেউ নেই। তাই চলে যাচ্ছেন আলেকজান্ডার। আবার কি কখনো ফিরতে পারবেন মাইসিয়ায়? ফিরতে পারবেন মেসিডোনিয়ায়? পেল্লায়? জানেন না। বড্ড শক্ত মনের মানুষ আলেকজান্ডার। তবু জন্মভূমির সীমানা পেরোনোর আগে চোখের পানি আটকে রাখতে পারলেন না। কয়েক ফোঁটা চোখের পানি টপ টপ করে পড়ল প্রিয় এবং একমাত্র ঘোড়া বুকাফেলাসের লোমশ পিঠে। হায় বুকাফেলাস! এই চোখের পানি যে তার জন্যও। চেনা পরিচিত জগত ছেড়ে বুকাফেলাসও তার সাথে চলছে অচেনা এক দেশে। হোক সেটা নানাবাড়ি, তবু জন্মভূমির প্রতিই যে প্রত্যেক মানুষের আকর্ষণ, সেটা কে রুখতে পারে? কেউ পারে না। যত বড় বীরই সে হোক, জন্মভূমি সবাইকে টানে। জন্মভূমি ছেড়ে যেতে সবারই কষ্ট হয়। সবারই বুক ফেটে যায় । হায় রাজা ফিলিপ, আপনি কি সেটা টের পেয়েছেন কখনো? কখনো বোঝেননি। কিন্তু আলেকজান্ডার বুঝেছেন। জন্মভূমি ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট তাকে আরো জেদী করেছে। আরো সাহসী করেছে। আরো বীরত্ব দিয়েছে। এবং দিয়েছে মেসিডোনের সিংহাসনও। কীভাবে?