আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর

বিশাল এক সাম্রাজ্য রেখে মারা গেলেন আলেকজান্ডার। অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে কোনো দিক নির্দেশনাও দিতে পারেননি তিনি। তার চারপাশে তখন জেনারেল ও সেনাপতিদের আনাগোনা। কিন্তু কাউকে কিছু বলে যেতে পারেননি। তিনি এতই অসুস্থ ছিলেন যে, তার পক্ষে হাত উঁচু করাও সম্ভব ছিল না। তবু তিনি যখন বিছানায় শায়িত, তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল বিশাল এই সাম্রাজ্যের পরবর্তী শাসক কে হবেন। কারণ আলেকজান্ডার কোনো বৈধ উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারেননি। মৃত্যুর সময় তার কোনো সন্তানও ছিল না। তবে চতুর্থ আলেকজান্ডার নামে তার এক সন্তান ছিল। কিন্তু সে সন্তান ছিল তার এক উপপত্নীর। সে হিসেবে চতুর্থ আলেকজান্ডার কোনোভাবেই তার উত্তরাধিকার হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। কেউ কেউ মনে করেন, আলেকজান্ডারের কাছে এক জেনারেল জানতে চেয়েছিলেন, স্যার আপনার পর আমরা কাকে আমাদের রাজা হিসেবে মানবো?

আলেকজান্ডার মাথা ঘুরিয়ে চারপাশে যে তাকাবেন, সে শক্তিও তার নেই। যদি মাথাটা ঘুরিয়ে তাকাতে পারতেন, তাহলে দেখতে পেতেন, তার চারপাশে তখন কেমন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছেন তার জেনারেলরা। সবাই তার নির্দেশ শোনার জন্য কান পেতে আছেন। পিন পতন নিরবতা তখন ঘরের ভিতর। আলেকজান্ডার হয়ত মনে মনে কাউকে খুঁজছিলেন। কিন্তু তার দেখা পেলেন না। বন্ধু হেফাস্টিয়ন থাকলে হয়ত কোনো ঝামেলা হতো না। যেহেতু হেফাস্টিয়ন নেই, কাজেই নতুন একজন রাজা রেখে যেতে হবে এই বিশাল দেশটির জন্য। আলেকজান্ডার ফিস ফিস করে বলেছিলেন, ক্র্যাটিস্টো।

আবার কেউ কেউ বলেন, আসলে আলেকজান্ডার বলেছিলেন ক্র্যাটেরোই।

ক্র্যাটিস্টো শব্দের অর্থ সবচেয়ে শক্তিশালীকে আর ক্র্যাটেরোই শব্দের অর্থ অপেক্ষাকৃত শক্তিশালীকে। অর্থাৎ আমার পর তোমরা সবচেয়ে ক্ষমতাশালী যে, তাকেই রাজা বানাও। অথবা অপেক্ষাকৃত শক্তিশালীজনকেই রাজা বানাও।

কিন্তু আলেকজান্ডার সত্যি কী বলেছিলেন সেটা নিয়ে বিস্তর তর্কবিতর্ক আছে। কারণ একজন গুরুতর অসুস্থ মানুষ ফিস ফিস করে কী বলে, সেটা বোঝা সবসময় সম্ভব হয় না। তার কথা তখন জড়িয়ে আসে। এবং সেটাই ঘটেছিল আলেকজান্ডারের বেলায়। তবে বেশিরভাগ ইতিহাসবিদের মতে আলেকজান্ডার নাকি ক্র ক্র্যাটেরোই—ই বলেছিলেন। কারণ গ্রিক ক্র্যাটেরোই এবং ক্রেটারাস শব্দ দুটোর মধ্যে পার্থক্য কেবল উচ্চরণভঙ্গীতে। আর আলেকজান্ডার সত্যিকার অর্থেই ক্রেটারাস বলেছিলেন। বেশিরভাগ পণ্ডিতই এ মতকে সমর্থন দিয়েছেন। ক্রেটারাসই ছিলেন আলেকজান্ডারের বাহিনীর সবচেয়ে বড় অংশ পদাতিক বাহিনীর সেনাপতি। বিভিন্ন যুদ্ধে তিনি নিজেকে একজন কুশলী ও চৌকশ সেনাপতি হিসেবেও জাহির করেছেন। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ মেসিডোনিয়ান। কিন্তু দুর্ভাগ্য ক্রেটারাসের। তিনি তখন আলেকজান্ডারের মৃত্যুশয্যার আশপাশে ছিলেন না। কিন্তু ক্রেটারাসকে আলেকজান্ডার রাজা বানাতে বলেছেন, এটা যদি ক্রেটারাস জানতে পারেন তাহলে আর জেনারেলদের কোনো ক্ষমতা থাকে না। তাই সুযোগ বুঝে বিশ্বাসঘাতকতা করে গুপ্তঘাতক দিয়ে হত্যা করা হয় ক্রেটারাসকে। আর এর পরই আলেকজান্ডারের রাজ্য কয়েকভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

মৃত্যুর সময় রানী বোক্সানের গর্ভে ছিল আলেজান্ডারের সন্তান। ঠিক একই সময় আরেকরানী বারসাইনও গর্ভবতী ছিলেন। রানী রোক্সানে যেহেতু আলেকজান্ডারের বড়রানী, কাজেই তিনি বারসাইনের মা হওয়াকে মেনে নিতে পারছিলেন না। আলেকজান্ডারের মৃত্যর পর, আলেকজান্ডারের নাম ব্যবহার করে রানী রোক্সানে ব্যাবিলনে ডেকে পাঠালেন পারসিয়ান রাজকুমারীকে। বারসাইন এবং তার বোন ড্রিপেটিস ব্যাবিলনে আসার পর রানী রোক্সানের নির্দেশে শিশুসন্তানসহ তাদের হত্যা করে একটা কুয়োর মধ্যে ফেলে দেয়া হয়। এর কিছুদিন পর জন্ম নেন আলেকজান্ডার এইগাস। পরবর্তীতে তিনি চতুর্থ আলেকজান্ডার নামে রাজা হন।

খৃষ্টপূর্ব ৩২৩ অব্দে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার রাজত্ব পান তার সভাই ফিলিপ অ্যারিডায়াস এবং তার ছেলে চতুর্থ আলেকজান্ডার। চতুর্থ আলেকজান্ডার তখন নিতান্তই শিশু। আর ফিলিপ ছিলেন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এমন পাগলকে ছেলে আলেকজান্ডারের সিংহাসনে বসা সহ্য করতে পারলেন না মা অলিম্পিয়াস। তিনি অ্যারিডায়াসকে হত্যা করালেন। এরপর আলেকজান্ডারের এক জেনারেল অর্ন্তবর্তীকালের জন্য রাজা হন। তার নাম পারডিকাস। অনেকে মনে করেন পারডিকাস কৌশলে ক্ষমতা দখল করে নেন। কিন্তু রাজা হওয়ার পরই বিরোধিতার মুখে পড়তে হলো পারডিয়াসকে। তার বিরোধীরাও সক্রিয় হয়ে উঠতে লাগলেন। বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে ৩০টি হত্যাকাণ্ড ঘটাতে হয়েছিল রাজাকে। বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে ব্যাবিলনকে বিভক্ত করতে হয়েছিল। এবং আলেকজান্ডারের কিছু প্রাক্তন জেনারেলকে রাজ্যের বিভিন্ন অংশের প্রাদেশিক শাসনকর্তা হিসেবেও নিয়োগ দিতে হয়েছিল। খৃষ্টপূর্ব ৩২১ অব্দে পারডিয়াসের সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হয় টলেমির। এই দ্বন্দ্ব হয় ট্রিপারাডিসাসের বিভক্তির নেতৃত্ব নিয়ে। নিজের সৈন্যদের হাতেই গুপ্তহত্যার শিকার হন পারডিয়াস। তার এক বিরোধী অ্যান্টিপ্যাটার নতুন রাজা হন। আর ওই সময় থেকেই আলেকজান্ডারের রাজত্বে এখানে সেখানে বিভিন্ন জেনারেলদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব চলতে থাকে কেবল মাত্র ক্ষমতার দখল নিয়ে।

খৃষ্টপূর্ব ৩১৯ অব্দে অ্যান্টিপ্যাটার মারা গেলে অন্তর্বর্তীকালীন রাজা হন পলিপারকন। কিন্তু তিনিও বেশিদিন ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেননি। রাজা হওয়ার কিছুদিন পরই অ্যান্টিপ্যাটারের ছেলে ক্যাসান্ডার তাকে হটিয়ে দিয়ে নতুন রাজা হিসেবে আর্বিভূত হন।

কিন্তু রানীমা অলিম্পিয়াস কোনোভাবেই অ্যান্টিপ্যাটারকে রাজা হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। তিনি বরাবরই তার বিরোধিতা করতেন। পলিপারকনের রাজা হওয়ার পিছনে তার ইন্ধন ছিল কিংবা সরাসরি সমর্থন ছিল বলে মনে করা হয়। ফলে পলিপারকন যখন রাজা হলেন, তখন তাকে মেনে নিলেন রানীমা অলিম্পিয়াস। আবার যখন ক্যাসাভার রাজা হলেন, তখনও তাকে মেনে নেননি অলিম্পিয়াস। তার বিরোধিতা তো করতেনই, উল্টো খৃষ্টপূর্ব ৩১৭ অব্দে নিজেকে অন্তবর্তীকালীন রানী হিসেবে ঘোষণা দিলেন অলিম্পিয়াস। কিন্তু ক্যাসান্ডার তাকে পাত্তাই দিলেন না। অলিম্পিয়াসকে সরিয়ে দিলেন ক্ষমতা থেকে। কেবল সরিয়েই দেননি, তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ডও দেন।

রানীমা অলিম্পিয়াস। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট—এর মা অলিম্পিয়াস। রাজা ফিলিপের চতুর্থ রানী। অনেক অনেক বছর ক্ষমতার কাছাকাছি ছিলেন। রাজদরবারের সবাই বলতে গেলে তার চোখের সামনে বড় হয়েছেন। এই যে বিশাল সাম্রাজ্য যা তার ছেলে আলেকজান্ডার অর্জন করেছেন, সবই ঘটেছে তার চোখের সামনে। মাকে খুব শ্রদ্ধাও করতেন আলেকজান্ডার। অন্তবর্তীকালীন রাজা ক্যাসাভার যখন রানীমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার কথা ঘোষণা করলেন, তখন অনেকেই সেটা মেনে নিতে পারেনি। আর রাজপ্রাসাদে কিংবা রাজধানীতে তো রানীমায়ের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করাও সম্ভব নয়। তাই কিছু অনুগত সৈন্যকে নির্দেশ দিলেন রাজা ক্যাসাভার যাতে তারা অলিম্পিয়াসের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে।

ক্যাসান্ডার বিশাল এক সাম্রাজ্যের রাজা হলে কী হবে, তার এই ক্ষমতার উৎস তো একজনই— আলেকজান্ডার। সেই আলেকজান্ডারের মায়ের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে রাজী হলেন না কোনো সৈনিক। সরাসরি রাজার বিরোধিতা করলেন তারা। রাজা ক্যাসান্ডার বুঝতে পারলেন, এভাবে সোজা পথে অলিম্পিয়াসকে মারা সম্ভব হবে না। তিনি অন্য পথ ধরলেন।

অলিম্পিয়াসকে পছন্দ করে না, এমন অনেক আত্মীয়—পরিজন ছিল। তাছাড়া অলিম্পিয়াস ছিলেন গরম মেজাজের মানুষ। তার এই গরম মেজাজের কারণেও অনেকেই তাকে খুব একটা পছন্দ করত না। রাজা ক্যাসান্ডার তাদের হাতেই তুলে দিলেন অলিম্পিয়াসকে। তাদের হাতেই প্রাণ হারালেন রানীমা।

অলিম্পিয়াসকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হলেন না ক্যাসান্ডার। রানী রোকসানা এবং আলেকজান্ডারের ছেলে চতুর্থ আলেকজান্ডারকেও হত্যা করলেন। আলেকজান্ডার এইগাস খৃষ্টপূর্ব ৩০৫ অব্দে মেসিডোনের রাজা হয়েছিলেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র তের বছর।

আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার গুরু অ্যারিস্টটল এথেন্স থেকে পালিয়ে ইউরিয়া চলে যান। আলেকজান্ডার যখন এশিয়া অভিযান করেছিলেন, অ্যারিস্টটল তখন এথেন্সে ফিরে এসেছিলেন। এখানেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন তার বিখ্যাত লাইসিয়াম। কিন্তু আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাকে এথেন্স ছাড়তেই হলো। ইউরিয়ায় তিনি খৃষ্টপূর্ব ৩২২ অব্দে মারা যান।

আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্য নিয়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলতেই থাকল। খৃষ্টপূর্ব ৩০১ অব্দে ফ্রিজিয়ায় ইপসাসের যুদ্ধ সংগঠিত হয় জেনারেলদের মধ্যে। এই যুদ্ধের পর চারটি ভাগে বিভক্ত হয় বিশাল সাম্রাজ্য। ক্যাসান্ডার শাসন করেন মেসিডোন, থ্রেসের লাইসিমাকাস, মেসোপটেমিয়ার সেলেকাস এবং পারস্য। প্রথম টলেমি শাসন করেন লেভেন্ট এবং মিসর। অ্যান্টিগোনাস পেলেন অ্যান্টোলিয়া এবং সিরিয়া শাসন করার ভার । কিন্তু ইপসাসের যুদ্ধে অন্যান্য জেনারেলদের কাছে হেরে ক্ষমতা হারান অ্যান্টিগোনাস। আর ভারতীয় অংশ শাসন করেন মৌর্যবংশের প্রথম সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।