পবিত্র কুরআনে আলেকজান্ডার

পারস্য এবং আরব্য সংস্কৃতিতে আলেকজান্ডারকে কখনো কখনো জুলকারনাইন বলেও সম্বোধন করা হয়। আরবীতে জুলকারনাইন শব্দের অর্থ হচ্ছে দুই শিঙের কেউ। সম্ভবত আলেকজান্ডারের সময় শিংঅলা মাথার ছাপ দেয়া একটি মুদ্রার প্রচলন ছিল এবং প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের মুদ্রাতেও এমন ছাপ ছিল। পবিত্র কুরআনে যদিও আলেকজান্ডার নামে কোনো ভাষ্য দেয়া নেই, তবু ধারণা করা হয় যে, সূরা কাহাফ—এ জুলকারনাইন নামে যার কথা বলা হয়েছে, তিনিই আসলে আলেকজান্ডার।

আরব উপদ্বীপে জুলকারনাইন নামটি পরিচিত ছিল অল্প বয়সে অধিক ক্ষমতাধর শাসক হিসেবে। এ নামকরণের কারণ সম্পর্কে প্রচলিত রয়েছে নানান কিংবদন্তি, নানা লোককথা। কারো মতে— তার মাথার চুলে দুটি গুচ্ছ ছিল, যেগুলো দেখতে শিংয়ের মতো। আবার কেউ মনে করেন পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যদেশগুলো জয় করার কারণে জুলকারনাইন খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন তিনি। কেউ এমনও বলেছেন যে, তার মাথায় শিংয়ের মতো দুটি চিহ্ন ছিল। অনেকের ধারণা, এগুলো ছিল ক্ষতচিহ্ন। কিছু মুসলিম পণ্ডিতের মতে— এটা নিশ্চিত যে, কুরআন স্বয়ং তার নাম জুলকারনাইন রাখেনি; বরং ইহুদিরা এ নাম দিয়েছিল। যদিও অনেক মুসলিম পণ্ডিত কুরআনে বর্ণিত জুলকারনাইনের বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে আলেকজান্ডারের বৈশিষ্ট্যের মিল খুঁজে পান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— আলেকজান্ডারও দুই শিংবিশিষ্ট হিসেবে খ্যাত এবং তিনি পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের দেশগুলো জয় করেছিলেন। তা ছাড়া বাইবেলেও আলেকজান্ডারকে দুই শিংবিশিষ্ট বলেই অভিহিত করা হয়েছে।

পৃথিবীর মানুষকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য বিভিন্ন সময় নানান নবী—রাসূল এসেছিলেন। এদের মধ্যে অল্পকয়েকজনের নাম কুরআনে উল্লেখ রয়েছে। নবী হিসেবে জুলকারনাইনের নাম উল্লেখ নেই, আবার তিনি নবী ছিলেন না— এমন কথাও বলা হয়নি। তাই পণ্ডিতদের কেউ কেউ বলছেন হয়তো জুলকারনাইন আল্লাহর পাঠাননা নবীদের একজন ছিলেন। হয়তো সে কারণেই নিপীড়িত মানুষ সাহায্য—সহযোগিতার জন্য তার কাছে ছুটে আসত । অনুসরণ করত তার দিকনির্দেশনা।

তাহলে কুরআনের বর্ণনা থেকে কেমন করে কেউ কেউ ভাবলেন জুলকারনাইনই আলেকজান্ডার? সে ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে পবিত্র কুরআনে কী লেখা আছে সেটা জানা যাক।

পবিত্র কুরআনের সূরা কাহাফের ৮৩ নম্বর আয়াত থেকে ৯৮ নম্বর আয়াত পর্যন্ত জুলকারনাইন সম্পর্কে বলা আছে—

(৮৩) ‘ওরা তোমাকে জুলকারনাইন সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে। বলল, “আমি তোমাদের কাছে তার কথা বয়ান করব।’ (৮৪) আমি তাকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দিয়েছিলাম ও প্রত্যেক বিষয়ের উপায় ও পথনির্দেশ করেছিলাম। (৮৫) সে এক পথ অবলম্বন করল। (৮৬) চলতে চলতে সে যখন সূর্যের অস্তাচলে পৌছাল তখন সে সূর্যকে এক পঙ্কিল জলে অস্ত যেতে দেখল এবং সে সেখানে এক সম্প্রদায়কে দেখতে পেল। আমি বললাম, “হে জুলকারনাইন! তুমি এদেরকে শাস্তি দিতে পারো বা এদের সদয়ভাবে গ্রহণ করতে পারো।

(৮৭) সে বলল, “যে—কেউ সীমা লঙ্ঘন করবে আমি তাকে শাস্তি দেবো, তারপর তাকে প্রতিপালকের কাছে ফিরিয়ে আনা হবে ও তিনি তাকে কঠিন শাস্তি দেবেন। (৮৮) তবে যে বিশ্বাস করে সঙ্কর্ম করে তার জন্য প্রতিদান হিসেবে আছে কল্যাণ ও তার সাথে ব্যবহার করার সময় আমি সহজভাবে কথা বলব।’

(৮৯) আবার সে এক পথ ধরল। (৯০) চলতে চলতে যখন অরুণাচলে পৌছল তখন সে দেখল তা (সূর্য) এমন এক সম্প্রদায়ের ওপর উঠছে যাদের জন্য সূর্যের তাপ থেকে আত্মরক্ষার জন্য আমি কোনো আড়াল সৃষ্টি করিনি। (৯১) প্রকৃত ঘটনা এই, তার বিবরণ আমি ভালো করে জানি।

(৯২) আবার সে এক পথ ধরল। (৯৩) চলতে চলতে সে যখন পাহাড়ের প্রাচীরের মাঝখানে পৌছল তখন সেখানে সে এক সম্প্রদায়কে পেল যারা তার কথা একেবারেই বুঝতে পারছিল না। (৯৪) ওরা বলল, হে জুলকারনাইন! ইয়াজুজ ও মাজুজ পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করছে। আমরা কি তোমাকে কর এই শর্তে দেবো যে তুমি আমাদের ও ওদের মধ্যে এক প্রাচীর গড়ে দেবে?

(৯৫) সে বলল, আমার প্রতিপালক আমাকে যে ক্ষমতা দিয়েছেন তা—ই ভালো । সুতরাং তোমরা আমাকে শ্রম দিয়ে সাহায্য করো, আমি তোমাদের ও ওদের মাঝখানে এক মজবুত প্রাচীর গড়ে দেবো। (৯৬) তোমরা আমার কাছে লোহার তাল নিয়ে আসো। তারপর মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা পূর্ণ হয়ে যখন লোহার ঢিপি দুটো পাহাড়ের সমান হলো তখন বলল, তোমরা হাঁপরে দম দিতে থাকো।’ যখন তা আগুনের মতো গরম হলো তখন সে বলল, ‘তোমরা গলানো তামা নিয়ে আসো, আমি তা ওর ওপর ঢেলে দেবো।’

(৯৭) এরপর ইয়াজুজ ও মাজুজ তা পার হতে পারল না বা ভেদ করতেও পারল না। (৯৮) সে (জুলকারনাইন) বলল, এ আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ। যখন আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হবে তখন তিনি ওকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবেন, আর আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি সত্য।

জুলকারনাইন পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়াতেন। নির্যাতিত শাসকের হাতে শোষিত লোকদের মুক্তি দিতেন। আলেকজান্ডারের বেলায়ও ঘুরে বেড়ানোর এবং রাজ্য জয় করার ইতিহাস রয়েছে। কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী অরুণাচলে, যেখান থেকে সূর্য উদিত হয় সেখানে ইয়াজুজ—মাজুজের হাত থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য দেয়াল তুলে দিয়েছিলেন জুলকারনাইন। আর সে স্থানটি পাহাড়ের প্রাচীরের মাঝখানে। এই বর্ণনার সাথে মিলে যায় এমন একটি দেয়াল রয়েছে কাসপিয়ান সাগর উপকূলে। ইতিহাসবিদদের দ্বারা স্বীকৃত যে এ দেয়াল তৈরি করেছিলেন আলেকজান্ডার, যা তৈরি করতে লোহা ও তামা ব্যবহৃত হয়। সেখানে একটি তোরণ রয়েছে যেটি কাসপিয়ান গেট বা আলেকজান্ডারের গেট নামে পরিচিত। দারিয়াল ও ডারবেন্ট নামে দু’টি শহরে এর ব্যাপ্তি। দারিয়াল রাশিয়া ও জর্জিয়ার সীমান্তে অবস্থিত। এটিকে বলা হয় কাজবেক পাহাড়ের পূর্ব স্তম্ভ। ডারবেন্ট রাশিয়ার দক্ষিণে অবস্থিত একটি শহর। কাসপিয়ান সাগরের দক্ষিণ—পূর্ব উপকূলে নির্মিত এ দেয়ালটি তোলা হয়েছে দুটি পাহাড়ের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গায়। এ পাহাড় দু’টিকে বলা হয় পৃথিবীর স্তন। আলেকজান্ডার নির্মিত এ দেয়ালের উচ্চতা ২০ মিটার এবং ৩ মিটার (১০ ফুট) পুরু। এ দেয়াল ভেদ করে শত্রুদের এগিয়ে আসা অসম্ভব। তা ছাড়া কাসপিয়ান গেটে আলেকজান্ডার রেখেছিলেন নিচ্ছিদ্র পাহারা। যাতে গ্রিকের শত্রুরা দেয়ালের এ পাশে কোনোভাবেই আসতে না পারে। কুরআনে রয়েছে, ইয়াজুজ—মাজুজের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য এ দেয়াল নির্মাণ করা হয়। ইয়াজুজ—মাজুজ সম্পর্কে বিভিন্ন মত রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন এ নামে অত্যাচারী শাসক ছিল। আবার কারো মতে প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে এ দুটি শব্দ। এ প্রতীক হতে পারে অত্যাচারী শাসক বা শাসকদের, যারা কাসপিয়ান সাগরের এ উপকূলে আক্রমণ চালাত ও লুণ্ঠন করত।

মুসলমান পণ্ডিতদের পাশাপাশি পশ্চিমা অনেক পণ্ডিতও আলেকজান্ডারকে জুলকারনাইন বলেই অভিহিত করেন। কারণ কুরআন এবং বাইবেলে বর্ণিত অনেক কিছুর সাথেই সাদৃশ্য রয়েছে বর্তমানে প্রচলিত আলেকজান্ডারের ইতিহাসের প্রশ্ন উঠতে পারে, কুরআনে বর্ণিত জুলকারনাইন ছিলেন সুশাসক। কিন্তু সেই জুলকারনাইনকে কিভাবে আলেকজান্ডার ধরা হবে? কারণ আলেকজান্ডারের ব্যাপারে সুনামের চেয়ে দুর্নামের কথাই বেশি প্রচলিত রয়েছে। এর জবাবও দিয়েছেন মুসলিম পণ্ডিতেরা, যারা মনে করেন কুরআনে বর্ণিত জুলকারনাইনই হচ্ছেন আলেকজান্ডার। তাদের মতে পবিত্র কুরআন ব্যতীত আল্লাহ প্রদত্ত ধর্মগ্রন্থগুলো যদি সময়ের সাথে সাথে মানুষের খেয়ালখুশিমতো পরিবর্তিত হতে পারে, তো একজন ব্যক্তি বা শাসকের চরিত্রও বিকৃত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ফলে আলেকজান্ডারের সত্যিকার ইতিহাস রয়ে গেছে আমাদের অগােচরে। আমরা যা জানি তা হয়ত ঠিক নয়। আবার যা ঘটে গেছে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে, খৃস্টধর্ম প্রচারেরও আগে, তার সবটুকুই যে আমরা জানতে পেরেছি তা—ও ঠিক নয়। আবার আমরা যা জেনেছি তা যে একেবারে ভুল তা—ও বোঝা সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে। কোনোদিনও সম্ভব নয়। জানা—অজানার এমনি দোলাচলে আমরা থেকে যাবো অনেকদিন। কতদিন সেটাও জানা সম্ভব নয়। তবে আলেকজান্ডার নামে যে একজন বীর ছিলেন এবং পৃথিবী জয় করেছিলেন, সেটা তো সত্যি। সেটা নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। দ্বিমত নেই আলেকজান্ডারের মতো দ্বিতীয় কোনো বীরও পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত জন্মগ্রহণ করেননি।