রাজা হওয়ার আগে

অ্যারিস্টটলের কাছে তিন বছর শিক্ষালাভ করেন আলেকজান্ডার। খৃষ্টপূর্ব ৩৪০ অব্দ। রাজা ফিলিপ ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তার কপালে অসংখ্য ভাজ। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। সিংহাসনে বসেও একদণ্ড শান্তি পাচ্ছেন। বাবাকে অস্থির দেখে জানতে চাইলেন আলেকজান্ডার, কী হয়েছে বাবা তোমার? 

ফিলিপ বললেন, ঝামেলায় পড়েছি। বাইজেনটাইনে কিছু বিদ্রোহী মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ওদের এখনই শায়েস্তা না করলেই নয়। যে কোনো সময় মেসিডোনের রাজধানী পেল্লাতেও আক্রমণ চালাতে পারে ওরা। জানি হয়ত কিছুই করতে পারবে না। কিন্তু কিছু লুটতরাজ তো করতে পারবে। 

আলেকজান্ডার বললেন, তাহলে আমরা ওদের শায়েস্তা করছি না কেন?

ফিলিপ বললেন, সেটাই তো চিন্তা করছি। সৈন্য নিয়ে আমি নিজে বাইজেনটাইন গেলে এদিকে মেসিডোনের সিংহাসন খালি পড়ে থাকে। মেসিডোন দেখা শোনার কেউ থাকে না। 

আলেকজান্ডার বললেন, আমি নিজেই মেসিডোন দেখা—শোনা করতে পারবো। 

রাজা ফিলিপ ভালো মতো তাকালেন আলেকজান্ডারের দিকে। এক মাথা কালো কোঁকড়ানো চুল। মোটা ভ্রুর নিচে গভীর কালো একজোড়া চোখ। ওই চোখজোড়া থেকে যেন দীপ্তি বেরুচ্ছে। সুগঠিত হাতপা। মাংসপেশীগুলো টান টান। শক্তসমর্থ শরীর। কত আর বয়স হয়েছে ওর। মাত্র ষোল বছর। এ বয়সে বন্ধুদের নিয়ে মজা করে বেড়াবে। অথচ এখনই ওকে একটা দেশ দেখা শোনা করার মতো গুরু দায়িত্ব দিতে মন চাইল না তার। কিন্তু কিছুই করার নেই। তাছাড়া এতে একটা লাভ হবে। রাজা ফিলিপ নিজেও চান তার মৃত্যুর পর আলেকজান্ডারই মেসিডোনের রাজা হোক। কিন্তু একটা বাধা আছে। এই বাধার জন্য অনেকেই আলেকজান্ডারকে রাজা হিসেবে মেনে নিতে চাইবে না। এখন যদি আলেকজান্ডারকে তার অবর্তমানে রাজ্য দেখাশোনার দায়িত্ব দেন, তাহলে তো কেউ কিছু বলতে পারবে না। কাজেই আলেকজান্ডারের ওপর মেসিডোনের দায়িত্ব দিয়ে রাজা ফিলিপ একদল সৈন্য নিয়ে গেলেন বাইজেনটাইন। আর আলেকজান্ডার রাজা ফিলিপের নামেই রাজ্য চালাতে লাগলেন। রাজা ফিলিপও নিশ্চিন্ত হলেন, ছেলের কাছে রাজ্যের ভার দেয়া যাবে। বুনো বুকাফেলাসকে যেভাবে বশ মানিয়েছে আলেকজান্ডার, এরপর ওর প্রতি আর আস্থা না থাকার কোনো কারণ নেই। বরং বেশ গর্বও হলো ফিলিপের। তাছাড়া তার শিক্ষাও যতখানি সম্ভব পরিপূর্ণ করার চেষ্টা করেছেন ফিলিপ। অ্যারিস্টটলের কাছ থেকে শিক্ষালাভ করার পর, বিভিন্ন দেশের দূতদের সাথে আলেকজান্ডারের আলাপ করিয়ে দিতেন। যাতে বিভিন্ন দেশের মানুষের রীতিনীতি, চালচলন, আচার—ব্যবহারও জানতে পারে। ফিলিপ জানতেন শেখার কোনো শেষ নেই। যে যত বেশি শিখতে চাইবে, সে ততই জ্ঞান আহরণ করতে পারবে। আর যে যত বেশি জ্ঞান আহরণ করবে, সে তার কাজে ততই দক্ষ হবে। এখন সে রাজা হোক কিংবা কৃষক হোক। বাইজেনটাইনে বিদ্রোহীদের হারিয়ে দিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই ফিলিপ ফিরে এলেন। ১৮ বছর বয়সে আলেকজান্ডারকে তার অশ্বারোহী বাহিনীর একটা অংশের সেনাপতি বানিয়ে দিলেন। আর এই অংশকে পাঠালেন চ্যারোনিয়া যুদ্ধে। চ্যারোনিয়া নামক জায়গায় যুদ্ধটা আসলে হয়েছিল এথেন্স ও থেবসের বিরুদ্ধে। এথেন্স ও থেবস হঠাৎ রাজা ফিলিপের আনুগত্য অস্বীকার করে বসল। কাজেই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে উপায় নেই। এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিলেন আলেকজান্ডার। এবং জয়লাভও করলেন। এরপর রাজা ফিলিপ এথেন্সে মেসিডোনের রাষ্ট্রদূত করে পাঠান আলেকজান্ডারকে। মেসিডোনের রাজা হওয়ার আগেই যুদ্ধ, কূটনীতি, রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন আলেকজান্ডার। তবু রাজা ফিলিপের মনে কষ্ট রয়েই যায়। কারণ নিয়ম অনুযায়ী আলেকজান্ডার কখনো মেসিডোনের রাজা হতে পারবেন না। নিয়মটা কী? নিয়ম হচ্ছে যিনি মেসিডোনের রাজা হবেন, তাকে হতে হবে বিশুদ্ধ মেসিডোনিয়ান। তার বাবা বা মায়ের কেউ একজনও যদি মেসিডোনিয়ান না হন, তাহলে তার পক্ষে মেসিডোনের রাজা হওয়া সম্ভব নয়। দুর্ভাগ্যক্রমে আলেকজান্ডার বিশুদ্ধ মেসিডোনিয়ান ছিলেন না। এই জাতীয়তার দ্বন্দ্বেই আলেকজান্ডারের মেসিডোনের রাজা হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়। আলেকজান্ডারের মা অলিম্পিয়াস ছিলেন এপিরাসের কন্যা। সুতরাং নিয়ম অনুযায়ী আলেকজান্ডারের মেসিডোনের রাজা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এজন্য ফিলিপের মতো আলেকজান্ডারেরও মন খারাপ। বিষন্ন থাকেন সবসময়। তিনি সব সময় স্বপ্ন দেখতেন একিলিস হবেন। দুনিয়ার এ মাথা থেকে ও মাথা জয় করবেন। কিন্তু নিজে যদি রাজা হতে না পারেন, তাহলে তার স্বপ্ন পূরণ হওয়ার তো কোনো সুযোগ নেই। তিনি বললেই তো আর কোনো সৈন্য এসে তার পক্ষে লড়াই চালাবে না। কাজেই তাকে রাজা হতেই হবে। কিন্তু কেমন করে? ওদিকে বাবা ফিলিপের সাথে জড়িয়ে পড়লেন নতুন এক দ্বন্দ্বে।