গগেমালার যুদ্ধ

বিশাল বাহিনী নিয়ে রওনা হলেন মেসিডোনিয়ার রাজা আলেকজান্ডার। মেসিডোনিয়া থেকে যতজন যোদ্ধা নিয়ে তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন, এখন তার যোদ্ধা বেড়ে গিয়েছে কয়েকগুণ। তিনি যে অঞ্চলেই যান, সে অঞ্চলের যোদ্ধাদেরই তার বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নেন। ফলে তার বাহিনী হয়ে উঠেছে যেমন বিশাল, তেমনি দক্ষ। বলতে গেলে বহুজাতিক একটি বাহিনী নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করলেন আলেকজান্ডার। 

ফিরতি পথে আলেকজান্ডার আবার টায়ারে এলেন। টায়ারে এসে তার বাহিনী পূর্নবিন্যাস করলেন। নতুন করে সংগঠিত করলেন। তারপর যাত্রা শুরু করলেন ব্যাবিলনের দিকে। এবার তার সাথে আছে ৪০ হাজার পদাতিক সৈন্য এবং ৭ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য। এই যাত্রা পথেই তিনি জয় করে ফেললেন টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল।

রাজা দারিয়ুসও তার সৈন্যদের সংগঠিত করলেন। ইসাসে তিনি যে ভুল করেছেন, এবার আর সে ভুল করতে চান না। ইসাসে সংকীর্ণ গিরিনদীর তীরে যুদ্ধ করেছিলেন। দারিয়ুসের ধারণা সংকীর্ণ জায়গায় যুদ্ধ করার কারণেই তার সৈন্যরা ঠিক মতো লড়াই করতে পারেনি। কাজেই এবার তিনি তার নিজের বিস্তৃত অঞ্চলে যুদ্ধ করতে চাইলেন। প্রায় দুই লাখ সৈন্যসমাবেশ ঘটালেন রাজা দারিয়ুস। অবশ্য কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে প্রায় দশলাখ সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন দারিয়ুস। তবে রাজা দারিয়ুস তার পুরো সৈন্যবাহিনী নিয়ে যুদ্ধ করতে এসেছিলেন। জমায়েত হয়েছিলেন গগেমালা নামক জায়গায়। এখন ও নামে কোনো জায়গা নেই। এখনকার ইরাকের ইরবিল নামক জায়গাই ছিল গগেমালা। জায়গাটা ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলে। 

বিশাল বাহিনীর ঠিক মাঝখানে রাজা দারিয়ুস। আলেকজান্ডারের বাহিনী চলতে চলতে একদিন রাতে হঠাৎ দূরে তাঁবুর আলো দেখতে পায়। আর দেখতে পেয়েই বুঝতে পারে ওটা রাজা দারিয়ুসের বাহিনীরই আলো। সাথে সাথে থেমে যায় তারা। দূরত্ব বজায় রেখেই শিবির স্থাপন করেন আলেকজান্ডার। কয়েকজন চর পাঠিয়ে দেন আলেকজান্ডার, যাতে ওই তাবুর আলোটা কাদের, সেটা নিশ্চিত জানতে পারেন। গুপ্তচররা এসে জানালেন, ওটা রাজা দারিয়ুসেরই শিবির। তখনই জরুরি আলোচনায় বসলেন আলেকজান্ডার। উপস্থিত সকল সেনাপতিকে জানালেন, আমরা এখন গগেমালায়। সামনেই রাজা দারিয়ুসের বাহিনী। আমাদের এ আলোচনা যুদ্ধ কৌশল নিয়ে। 

তখনই একজন সেনাপতি বললেন, ওদের বাহিনী বেশ বড়। 

আলেকজান্ডার বললেন, যোদ্ধাসংখ্যা দিয়ে যুদ্ধে জয়পরাজয় হয় না। এটা আমরা এর আগেও প্রমাণ করেছি। আমাদের সেনাপতিরাও সেটা জানেন। যুদ্ধ জয় হয় কৌশল দিয়ে। আমরা আমাদের কৌশল ঠিক করতেই এখানে মিলিত হয়েছি। 

অন্যএকজন সেনাপতি বললেন, মহামান্য রাজা আলেকজান্ডার, আমরা এখনই ওদের আক্রমণ করি। 

সাথে সাথে চারদিক থেকে শোরগোল ওঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরা এখনই ওদের আক্রমণ করি। ওরা জানতেও পারবে না কারা ওদের আক্রমণ করল। ওরা কিছু বোঝার আগেই আমরা ওদের হারিয়ে দিতে পারবো। 

আলেকজান্ডারের বেশিরভাগ সেনাপতিও তাকে উদ্বুদ্ধ করতে লাগলেন রাতের অন্ধকারেই দারিয়ুসের বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। 

রাজ্য জয়ের প্রতি আলেকজান্ডারের ছিল অসম্ভব নেশা। গ্রিকদের শ্রেষ্ঠবীর আলেকজান্ডার। তাই বলে নেকড়ের মতো রাতের অন্ধকারে শত্রুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কাপুরুষের মতো বীরত্ব দেখাতে রাজি হলেন না। তিনি ছিলেন সত্যিকারের বীর। শত্রুর সাথে মুখোমুখি যুদ্ধকেই তিনি সমর্থন করেন। 

আলেকজান্ডার তার সেনাপতিদের নিরুৎসাহিত করে বললেন, সামনাসামনি লড়াইয়ে আমি কাউকে ভয় পাই না। আমি আশা রাখি আমার বীর সেনাপতিরাও সাহসের পরিচয় দেবেন। আমি কখনোই রাতে যুদ্ধ করার পক্ষে নই।

কেউ তার কথার প্রতিবাদ করার সাহস পেলেন না। ঠিক হলো রাতের বেলা ওরা কেউ দারিয়ুসকে বিরক্ত করবেন না। 

পরদিন অক্টোবরের প্রথম দিন। খৃষ্টপূর্ব ৩৩১ অব্দ। দারিয়ুসের বাহিনীর খুব কাছে চলে এসেছে আলেকজান্ডারের বাহিনী। দারিয়ুসও বিশাল সমরসজ্জা ঘটিয়েছেন। তার বাহিনীও বেশ সুদক্ষ । দুর্ধর্ষ ইরানিয়ান অশ্বারোহী যোদ্ধা, প্রচুর রথ এবং দুঃসাহসী পদাতিক যোদ্ধাদের নিয়ে গঠন করেছেন তার বাহিনী। তার আনা রথদের চাকাগুলোর অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য ছিল। রথের চাকার বাইরে তীরের ফলার মতো ধারালো ছোরা বেরিয়ে ছিল। আলেকজান্ডার তার বাহিনী নিয়ে সোজা রাজা দারিয়ুসের দিকে চললেন। তাইগ্রিসের পূর্ব তীরে আরবালা নামক সমতল প্রান্তরে শুরু হলো তুমুল লড়াই। এই যুদ্ধ তাই আরবালার লড়াই নামেও পরিচিত।

এবারও ফসকে গেলেন রাজা দারিয়ুস। রাজা দারিয়ুস পালিয়ে গেলেন পাহাড়ী আবাসিক অঞ্চল ইকবাতানায়। আলেকজান্ডার তাকে ধাওয়া করলেন সোজা ব্যাবিলন পর্যন্ত। ব্যাবিলন তার কাছে আত্মসমর্পন করল। পারস্য সাম্রাজ্যের রাজধানী সুসা এবং পারসেপলিসও জয় করলেন। ওই দুই শহর তার কাছে সোনা আর রূপার বিশাল এক রত্নভাণ্ডার মেলে দিল। পারসেপলিসের মানুষদের তিনি দাস হিসেবে বিক্রি করে দিলেন। আর পারসেপলিস পুড়িয়ে দিলেন। কারণ এই শহরটার প্রতি তার অসম্ভব প্রতিশোধপরায়নতা কাজ করছিল। আলেকজান্ডার জানতেন, খৃষ্টপূর্ব ৪৮০ অব্দে পারস্য বাহিনী এথেন্স পুড়িয়ে দিয়েছিল।

রাজধানী সুসা জয় করেই আলেকজান্ডার নিজেকে পারস্যের রাজা ঘোষণা দিলেন। আর সমর্থন আদায় করলেন পারস্যের অভিজাতদের। এসব অভিজাতদের সবাই ছিলেন পারস্যের প্রাদেশিক গভর্ণর। এর চারমাস পর মেসিডোনিয়ানরা রাজকীয় প্রাসাদ পুড়িয়ে দেয়। কেবল পুড়িয়েই থেমে থাকেনি, মাটিতে মিশিয়ে দেয়। একটি সাম্রাজ্যের ঐতিহ্যকে ধুলোয় মিশিয়ে সাম্রাজ্যটির ইতিরেখা এঁকে দেয়।

কিন্তু রাজা দারিয়ুস?

খৃষ্টপূর্ব ৩৩০ অব্দ। দারিয়ুসের পিছনে ছুটতেই থাকলেন আলেকজান্ডার। দারিয়ুসকে ধরতে পারসেপলিস থেকে শত শত মাইল পথ পাড়ি দিতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত ব্যাকট্রিয়া নগরে গিয়ে রাজা দারিয়ুসকে ধরতে পারেন আলেকজান্ডার। সত্যিই কি আলেকজান্ডার দারিয়ুসকে ধরতে পেরেছিলেন? কারণ আলেকজান্ডার যখন দারিয়ুসকে ধরলেন, দারিয়ুস তখন অন্য জগতের মানুষ। রাস্তার পাশে রাজকীয় রথে আগেই মরে পড়েছিলেন দারিয়ুস। জীবিত দারিয়ুসকে ধরতে পারলেন না আলেকজান্ডার। জীবিত দারিয়ুস ধরা দেননি আলেকজান্ডারের হাতে। ধরা পড়েও যেন ধরা পড়েননি দারিয়ুস। কিন্তু দারিয়ুসকে ভালো মতো দেখে বুঝতে পারলেন আলেকজান্ডার, তাকে হত্যা করা হয়েছে । কে হত্যা করেছে দারিয়ুসকে?

একান্ত ও বিশ্বস্ত দেহরক্ষী নিয়েই চলাফেরা করতেন রাজা দারিয়ুস। কাজেই তাকে হত্যা ওরাই করেছে। হয়ত একের পর এক পরাজয়ের কারণে নিজের বাহিনীর কাছেই গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছিলেন দারিয়ুস। সে কারণেই তাকে আর কেউ রাজা হিসেবে দেখতে চায় না। পলাতক রাজা কে চায়? সেজন্যই তার দেহরক্ষীরাই তার গুপ্তঘাতক হয়ে যায়। শেষকৃত্যে রাজকীয় মর্যাদা দেয়া হয় রাজা দারিয়ুসকে।

রাজা দারিয়ুসের হত্যা নিয়ে অবশ্য ভিন্ন একটি মত পাওয়া যায়। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ মনে করেন, ব্যাকট্রয়ার প্রাদেশিক শাসক বেসাস ছিলেন দারিয়ুসের চাচাতভাই। এই বেসাসই রাজা দারিয়ুসকে হত্যা করে নিজেকে পারস্যের সম্রাট ঘোষণা দিয়েছিলেন। আলেকজান্ডার ব্যাকট্রিয়া দখল করে বেসাসকে গ্রেপ্তার করেন এবং নিজেকে রাজা ঘোষণার অপরাধে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন।